বৈরী বসন্ত পর্ব-২৩+২৪

0
7

#বৈরী_বসন্ত ২৩
লেখা – আয্যাহ সূচনা

অন্যায় হচ্ছে আরিভের সাথে। চাতক পাখির মতো ছটফট করছে এক পলক নিজের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে দেখবার জন্য। কিন্তু কেউই সুযোগ দিচ্ছে না। কত শখ ছিল বউকে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে আসবে। সেটাও হল না, কোনো সুযোগই পেল না। সাপের মত সোফায় বসে ফোস ফোস করছে। এটা কেমন বিয়ে? যার সর্বপ্রথম অধিকার সেই দেখতে পারছে না। বাকি সবাই দেখে ফেলল।

ছোট আকারে বিয়ে হয়েছে। আতাউর সাহেবের পূর্ব শর্ত ছিল। এই বিয়েতে সিদ্দিক সাহেব কোনো প্রকার কোনো টাকা খরচ করবেন না। অনুনয় বিনয় করেও সেই শর্তের অবাধ্য হতে পারেননি সিদ্দিক সাহেব। শুধু তার হৃদয়ের অংশ মেয়েকে তুলে দিয়েছেন। ভিন্নধর্মী বিয়ে তাদের। নাফিয়ার বাবা মাও সাথে এসেছেন মেয়েকে দিতে। আজকের দুপুরের খাবার আরিভদের বাড়িতেই আয়োজন করা হয়েছে।

শিরীন বেগম আরিভের রুষ্ট মুখের দিকে চেয়ে বললেন,

– “খাবি না?”

আরিভ ত্যাড়া চোখে চেয়ে বলে,

-“না।”

-“ঢং করিস না। এক থালে খাবার নিয়ে এসেছি, আয় তোকে আর নাফিকে খাইয়ে দিব।”

আরিভ নাকচ করার জন্য প্রস্তুত ছিল। নাফি আর তাকে একসাথে খাইয়ে দিবে শুনে উঠে দাঁড়াল। গম্ভীর রাগী ভাবমূর্তি বজায় রেখে টেবিলে গিয়ে বসল। শিরীন বেগম ছেলের অবস্থা দেখে মুচকি হাসেন। নাফিকে নিয়ে এলেন খাবার ঘরে। সবাই একত্রে বসেছে। আরিভ তাকাল না একবারের জন্যই। এই অল্প দেখাতে তার মন ভরবে না। ঘরে গিয়ে একবারে চোখ জুড়িয়ে দেখবে। ততক্ষণ অব্দি নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রাখল।

নাফিয়া কাচুমাচু হয়ে আছে। শিরীন বেগম পরম যত্নে নিজের মেয়ের মত করেই প্রথম লোকমা নাফিয়ার মুখে তুলে দিয়ে বললেন,

-“আমার মেয়ের শখ পূর্ণ হল।”

নাফিয়া চোখ নামিয়ে হাসে। সবার আড়ালে এক পলক আরিভের ভোঁতা মুখটাও দেখে নিল। ভাবল, তার আবার কী হয়েছে? বিয়ে তো করল? মুখ কেন বাংলার পাঁচ বানিয়ে রেখেছে?

খাওয়া দাওয়া বাকি সব আয়োজন শেষ করতে করতে রাত গড়িয়েছে। আরিভ অবশেষে সুযোগ পেল ঘরে যাওয়ার। সেখানেই তার জন্য অপেক্ষায় নাফিয়া। আরমোড়া দিয়ে ঘরের কাছে যেতে না যেতেই বাঁধা হয়ে দাঁড়াল সাদিফ আর জোহান। হাত মেলে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে।

আরিভ চটে গেল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলল,

– “তোরা এখনও বিদায় হোস নি?”

জোহান বলল,

-“টাকার হিসেব বাকি।”

-“আবার কীসের টাকা?”

-“টাকা না দিয়ে ঘরে যেতে পারবেন না।”

নাফিয়াদের বাড়িতে ঢোকার পথেও পাঁচ হাজার টাকা ডাকাতি করেছে দুই ভাই মিলে। এখন আবার এসেছে। আরিভের ইচ্ছে হল মাথা দুজনের মাথা চারভাগ করে দিতে। এতো সময় পর বউকে দেখার সুযোগ পেয়েছে। তার মধ্যেই এসে দাঁড়াল এই দুইজন।

-“তোদের আমি অলরেডি টাকা দিয়েছি।”

-“সেটা মেয়ে পক্ষের টাকা। এবার ছেলে পক্ষের।”

আরিভ লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। নাহ! এদের সাথে তর্কে যাওয়া যাবে না। যত তর্ক, ততো দেরি। পকেট থেকে এক হাজার টাকার দুটো নোট বের করে বলল,

-“যা দিচ্ছি নিয়ে বিদায় হ। অতিরিক্ত একটা কথা বললে ভালো হবেনা বলে দিচ্ছি। আমাকে আমার বউয়ের কাছে যেতে দে।”

জোহান বলল,

-“ভাই আপনি এত কিপটে কেন? মাত্র দুই হাজার?”

-“দুই হাজার দিয়েছি এটাই অনেক। ভাগ!”

বলে দুজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল আরিভ। যথাসম্ভব দ্রুত ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। পেছন থেকে সাদিফ জোহান উভয়েই চেঁচাচ্ছে। তাতে আরিভের কিছুই আসে যায় না।

ঠোঁটে লম্বা হাসি টেনে সামনের দিকে তাকাতেই আত্মা উড়ে গেল যেন। তার ঘরে গোলাপের সুভাস, তার মধ্যিখানে এক লাল টুকটুকে রক্তজবা। মাথা নিচু করে নিজেকে গুটিয়ে বসে আছে।

আরিভ আর এক মুহুর্ত ব্যয় করল না। দ্রুত কদমে গিয়ে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়ল। নাফিয়া নিজেকে আরও গুটিয়ে নিল। আরিভ যেন বসে থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে কয়েক মুহূর্তে। মাথার একপাশে মুষ্টিবদ্ধ হাত ঠেকিয়ে এককাতে আধশোয়া হয়ে বলল,

-“হ্যালো বউ।”

ঘোমটার নিচে চোখজোড়া গোলগোল হয়ে যায় নাফিয়ার। হবু বউ থেকে বউ। ভিন্ন ভিন্ন দুটো ডাক তার পাগল করছে তাকে।

-“মনে হল এক বিশ্বযুদ্ধ শেষ করে তোমার কাছে এসেছি। তুমি জানো কতটা ছটফট করছিলাম?”

আরিভ সোজা হয়ে বসল। এগিয়ে এল নাফিয়ার দিকে। নাফিয়া কিছুটা পিছু হটে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারলো না। আলতো হাতে ঘোমটা তুলতেই লজ্জায় লাল টকটকে মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠে। পৃথিবীটা হুট করেই যেন ঘুরতে লাগল আরিভের। মনে হল এর আগে এই সৌন্দর্য দেখতে পায়নি। বউ সাজলে মেয়েদের রূপ দ্বিগুণ হয়ে যায় বুঝি?

আরিভ কিছু না ভেবেই কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। আকস্মিক আক্রমণে কেঁপে উঠল নাফিয়া। আরিভ তার হাত ছুঁয়েছে বহুবার, কাঁধে মাথা রাখা হয়েছে। কিন্তু আজকের স্পর্শ ভিন্ন অনুভব করাচ্ছে কেন? নিঃশ্বাস আটকে আসে নাফিয়ার।

আরিভ দুহাতে নাফিয়ার গাল আগলে নিয়ে বলল,

-“অপ্রিয় থেকে ভীষণ প্রিয় হয়ে কেমন লাগছে, বউ?”

নাফিয়া ঠোঁট কামড়ে, দৃষ্টি নামায়। জবাবহীন রয়। আরিভ নাফিয়ার কাছ থেকে সরে গেল। নাফিয়া ঝটপট চোখ তুলে তাকাল। আরিভ উঠে গিয়ে জানালার পর্দা টেনে দেয়। বারান্দার দরজাটাও লাগিয়ে দিল। ফিরে এসে কোমরে হাত রেখে বলল,

-“শ্বশুড়-শ্বাশুড়ির ঘর আর মেয়ে আর মেয়ের জামাইর ঘর পাশাপাশি হওয়া একটা ডেঞ্জারাস বিষয়।”

নাফিয়া ঠোঁট টিপে হেসে ফেলে। বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল শাড়ি আর মাথার কাপড় গুটিয়ে নিয়ে। আরিভ আচমকা হাত ধরে টেনে আনল নিজের দিকে। কোমর জড়িয়ে মিশিয়ে নিল বুকের সাথে। নাফিয়া ঢোক গিলে। আমতা আমতা করে বলে উঠে,

-“মা.. মা বলেছিল নামাজ পড়তে…”

আরিভ নাফিয়ার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,

-“উম! ঠিক আছে। ফ্রেশ হয়ে এসো।”

ছেড়ে দিল নাফিয়াকে আরিভ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল নাফিয়া। দম আটকে ছিল যেন এতক্ষণ। এভাবে কেউ কাছে টানে? এই লোককে দিয়ে একবিন্দু ভরসা রাখাও ভুল।

নাফিয়া সময় নিয়েই ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে। অন্যদিকে আরিভ ঘরেই কাপড় বদলে নিয়েছে। ওযু করে এসে নাফিয়ার দিকে জায়নামাজ এগিয়ে দিল। নাফিয়া দৃষ্টি এড়াচ্ছে। তাকাতে পারছে না আরিভের দিকে। দুজনেই একত্রে নামাজ পরে নেয়।

নাফিয়া জায়নামাজ টেবিলের উপর রাখতেই মৃদু গানের ধ্বনি শোনা গেল। নাফিয়া ঘুরে তাকায়। আরিভ ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে। আরিভ নাফিয়াকে টেনে নিল। তার হাত এনে রাখল নিজের কাঁধে। কোমর জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে দুলতে শুরু করল গানের তালে,

ক্রমশ এ গল্পে আরো পাতা জুড়ে নিচ্ছি
দু মুঠো বিকেল যদি চাও ছুঁড়ে দিচ্ছি
আরো কিছুক্ষণ যোগাযোগ ধরে রাখছি
আঙুলে আঙুল যেন ভুল করে ডাকছি
এ ছেলেমানুষী তুলি দিয়ে আঁকছি
তোমায় ছোঁবে বলে আদর করবে বলে
উড়ে উড়ে আসে এলোমেলো কিছু গান
ডেকে যায় তোমার আঁচল ধরে
তুমি ছুঁলে জল, আমি বৃত্ত হয়ে থাকছি
দু মুঠো বিকেল যদি চাও ছুঁড়ে দিচ্ছি

গুনগুন করে গাইছে আরিভ। নাফিয়ার ভেজা চুলে মুখ গুঁজে হেলে দুলে যাচ্ছে দুজনের দেহ। নাফিয়া আরিভের টিশার্ট খামচে ধরলো। আরিভ স্থির হয়ে জড়িয়ে ধরে নাফিয়াকে। ভারী গলায় কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

-“তোমাকে বুকে জড়ানোর সাধনা পূরণ হল অবশেষে।”

নাফিয়া সাহস করল। লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে প্রশ্ন করে বসল,

-“আমাদের সত্যিই বিয়ে হয়েছে, তাই না?”

আরিভ আরও শক্ত করল বন্ধন। যেন এই আবদ্ধতায় নাফিয়াকে বিশ্বাস করানো সহজ হয়। আরিভ বলল,

-“হ্যাঁ, সত্যিই বিয়ে হয়ে গেছে।”

-“মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি।”

আরিভ মুখ তুলল। দুষ্টু হেসে টুপটাপ চুমু খেতে শুরু করল নাফিয়ার সারা গালে। নাফিয়া ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মত করে স্থির দাঁড়িয়ে। এই সামান্য স্পর্শতে বরফের মত জমে যেতে শুরু করেছে।

-“এবার বিশ্বাস হলো মিসেস?”

নাফিয়ার হুশ ফিরে। আরিভের দিকে রাগী দৃষ্টি ছুঁড়ে বলে,

-“আপনি চরম অসভ্য!”

-“আরেহ! বউকে চুমু খাওয়াতে অসভ্য হয়ে গেলাম?”

-“তাই বলে এভাবে?”

আরিভ ফের কপালে কপাল ঠেকায়। চোখে চোখ রাখল। প্রগাঢ় দৃষ্টি তার মনের সব কথা বলতে সক্ষম। কেমন যেন ধাঁধানো চোখ। এতো কাছ থেকে কখনও দেখা হয়নি। নাফিয়া যেন এই চোখের মোহে বেহায়া হয়ে উঠল। চোখ ফেরালো না নিজের, চেয়ে রইল। আরিভ ঝোড়ো নিঃশ্বাস ফেলে শুধায়,

-“তো কীভাবে বউ? কীভাবে ভালোবাসতে হবে বলুন? কীভাবে ভালোবাসলে আপনি এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী নারী হবেন? আজ থেকে আপনি যা বলবেন সেটাই সঠিক, বাকিসব ভুল।”

নাফিয়া লাজুক হাসে। এ যাত্রায় চোখজোড়া আর তার চোখে রাখতে সাহসে কুলালো না। অদ্ভুত ভালোলাগায় টইটুম্বুর হয়ে যাচ্ছে সে। বলে বুঝাতে চেয়েও পারছে না। অভ্যন্তরে ছটফট করছে। এক পর্যায়ে আপনাআপনি চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। আরিভ খানিক বিচলিত হল। থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে বলে উঠল,

-“কাঁদছো যে? আমার কাছাকাছি থাকতে ভালো লাগছে না?”

নাফিয়া একহাতে আরিভের টিশার্ট খামচে ধরলো। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল,

-“আমার খারাপ লাগছে না, আমার একদম খারাপ লাগছে না। বরং ভালো লাগছে, আমি যা চেয়েছি সেটা নির্বিঘ্নে পেয়ে গেছি। আমি বোঝাতে পারছি না, মুখ ফুটে বলতে পারছি না। আমার ভীষন ভালো লাগায় কান্না পাচ্ছে।”

আরিভ নাফিয়ার কপালে প্রগাঢ় চুমু খেল। চট করেই পাজাকোলে তুলে বলল,

-“এতদিন স্বপ্নে বিরক্ত করতে, এসো আজ বাস্তবে একটু বিরক্ত করো।”

জ্বালাতন এর অর্থ বুঝল না নাফিয়া। তবে শুনেছে আরিভের কাছে পূর্বেও। আরিভ নাফিয়াকে ফুলে ভরা বিছানায় বসিয়ে দিল। ঘরের বাতি নিভিয়ে বারান্দার দরজা সামান্য খুলে দিল। সেখান থেকে চাঁদের আলো সরাসরি ঘরে আসে। আরিভ এসে নাফিয়ার কোলে মাথা রাখে। নাফিয়ার ডান হাত টেনে বুকে রাখল। কিন্তু কিছু অনুভব করল না নাফিয়া। পরপর বাম হাত মাথায় রেখে বলল,

-“তোমার ডান হাত আমার বুকে সর্বপ্রথম জায়গা পাবে। যে হাত তোমার অপূর্ণতা, সে হাত আমার কাছে অমূল্য।”

নাফিয়া মনমরা হয়ে বলল,

-“এই হাত আপনাকে অনুভব করতে পারবে না যে?”

-“তোমার মন আমাকে অনুভব করতে পারলেই হল।”

নাফিয়া ছোট্ট করে জবাব দিল, “হুম।”

-“তোমাকে প্রথম অনুভব করতে শুরু করি কখন জানো?”

-“কখন?”

-“হুট করেই একদিন আমার স্বপ্নে এলে। কীভাবে? কেন? জানি না। শুধু এসেছো। সেদিন শাড়ি পড়েছিলে তুমি। নিজে থেকে আমার পাশে এসে বসলে। নিজের কোলে আমার মাথা তুলে নিলে, বুকে হাত রাখলে, চুলে আর গালে হাত বুলিয়ে দিলে। সেসব স্বপ্ন ছিল নাফিয়া। আমি বাস্তবে অনুভব করছিলাম তোমাকে। মোহিত হতে শুরু করেছিলাম। বারবার নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম, তুমিই কেন? এরপর আমার মস্তিষ্ক থেকে এক দণ্ড নামলে না তুমি। আমার ভাবনারা আমাকে জ্বালাতন করছিল। আস্কারা দিচ্ছিল তোমার ব্যাপারে। সেসবই ইঙ্গিত ছিল। আমার ভাগ্য তোমার সাথেই জড়িয়ে ছিল। আমি কখনও কাউকে ভালোবাসি নি। এই যুগে কথাটা হাস্যকর মনে হলেও সত্যি। ভালোবাসিনি, তবে আজ বেসেছি। ভীষণ রকমের মাতোয়ারা হয়েছি প্রেমে। প্রেম এত সুন্দর? আমি প্রেমিক রূপে এক মাতাল, সেটা জানতাম না। ভালোবাসি…. যতদূর তোমার কল্পনা যায়, তার চেয়ে বহু লক্ষ গুণ বেশি ভালোবাসি।”

নাফিয়া নির্বিকার শুনল কথাগুলো। আরিভের কন্ঠ কেঁপেছে কয়েকদফা। একজোড়া জ্বলজ্বল করা চোখে তার জন্য অগাধ ভালোবাসা। অভ্যস্ত নয় নাফিয়া এত সুখে। ফের চোখ ভিজে গেল।

আরিভ উঠে পড়ল। নাফিয়ার দুহাত আগলে বলল,

-“আবার কেন কাঁদছো?”

নাফিয়া নাক টেনে জবাব দিল, -“খুশিতে।”

আঁধার কক্ষে মৃদু শব্দে হাসে আরিভ। গলা ঝাড়া দিয়ে বলল,

-“শুনো..”

-“হুম?”

-“আরেকটু অসভ্যতামি করি?”

নাফিয়া নির্বোধের মতো পলকহীন চোখে তাকাল। অনুমতি চাইল দেখে হতভম্ব। আরিভকে নাফিয়ার বোকা মুখ আরও আকর্ষণ করল। আপনাআপনি এগিয়ে গিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে সাথে সাথে সরে গেল আরিভ। তাড়াহুড়ো করল, যেন তার কৃতকর্মকে ধামাচাপা দিতে চাইছে। নিজে শুয়ে মূর্তির মত শক্ত হয়ে বসে থাকা নাফিয়াকে টেনে নেয়। বুকে জড়িয়ে বলে,

-“আপাতত এতটুকু অসভ্যতামি যথেষ্ট, বউটা আমার অল্পবয়সী। বয়সের সাথে সাথে নাহয় এক ধাপ করে অসভ্যতামি বৃদ্ধি করব, কী বলো বউ?”

_________

সকালের স্নিগ্ধ আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভাঙ্গে নাফিয়ার। চোখজোড়া জ্বলসে, সাথে বাহুর উপর ভারী কিছু অনুভব করছে। সচরাচর সকালেই ঘুম ভাঙ্গে তার। কিন্তু মস্তিষ্ক জাগ্রত হতে সময় নেয়। চোখ খুলে সামনের দিকে তাকাতেই পরিবর্তন লক্ষ্য করল। এই দৃশ্য ঘুম থেকে উঠে কখনও দেখেনি। প্রতিদিন সকালে চোখ খুলেই দৃষ্টি পড়তো পড়ার টেবিলে, দেয়ালের রং আকাশী ছিল। আজ কালো পর্দায় ঢেকে থাকা জানালা দেখল, পড়ার টেবিলের পরিবর্তে ছোট্ট একটি ডেস্ক এক কোণে।

লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে নাফিয়া। ঘুরে তাকাতেই কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। তার ওড়নায় মুখ শরীর পেঁচিয়ে শুয়ে আছে আরিভ। দুহাতে তাকে জড়িয়ে, শক্ত করে। সবকিছু পরিষ্কার হতে শুরু করল তার কাছে। নাফিয়া ঠোঁট চেপে হাসে আরিভের অবস্থা দেখে। কাঁথার পরিবর্তে তার ওড়না জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে।

নাফিয়া আরিভের মুখ থেকে ওড়না সরিয়ে দেখল ঘুমন্ত শান্ত মুখমন্ডল। গভীর ঘুমে তলিয়ে থাকা আরিভকে দেখে আনমনে হেসে উঠে নাফিয়া। বিড়বিড় করে বলল,

-“খুব সহজেই পেয়ে যাব ভাবিনি।”

বলেই বিরতি নিল কয়েক মুহূর্তের। আরিভের চুলের দিকে হাত বাড়িয়ে আবার ফিরিয়ে আনল। যদি জেগে যায়?

সাহস আবার হুট করেই জাগ্রত হয়। অধিকার আছে তার, কেন এই চুলগুলোতে হাত বুলাবে না? নাফিয়া হাত এগিয়ে আরিভের চুলে বিলি কেটে দিল কিছু সময়। আরিভ নড়েচড়ে উঠে। নাফিয়া হাত সরাতেই ঘুমন্ত ভারী কন্ঠে আরিভ বলল,

-“ভালো লাগছিল.. হাত সরালে কেন?”

-“আপনি জেগে আছেন?”

-“হুউউউউম? উহু!”

অদ্ভুত জবাব। হ্যাঁ – না কোনোটিই নয়। কিন্ত বোঝা গেল আরিভ অর্ধ ঘুমে। আরিভ চোখ খুলে তাকায়। লালাভ বর্ণ ধারণ করা চোখজোড়া নাফিয়ার দিকে তাকাল অদ্ভুত দৃষ্টিতে। চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিল তৎক্ষণাৎ। কপালে চুমু খেয়ে বলল,

-“আমার প্রতিটা সকাল এমনই সুন্দর হোক।”

চলবে….

#বৈরী_বসন্ত ২৪
লেখা – আয্যাহ সূচনা

-“এক হাতে কী শাড়ি পড়া যায়?”

আরিভের সামনে শাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে নাফিয়া। মুখে নেই কোনো জ্যোতি, আঁধার সেখানটায়। শখ করে শাড়ি বের করেছে, বিয়ের পরদিন সকালে নিয়ম অনুযায়ী শাড়ি পড়বে, সেটিও নিজের ইচ্ছায়। কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়াল তার অকেজো হাত।

আরিভ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিছানা ছেড়ে ল্যাপটপ হাতে তুলল। ইউটিউবে ভিডিও খুঁজতে শুরু করল, ‘শাড়ি কিভাবে পড়তে হয়’। বেশি কষ্ট করতে হয়নি তার। তাড়াতাড়ি পেয়ে গেছে। ভিডিও একবার মনোযোগ সহকারে দেখল নাফিয়াকে অপেক্ষায় রেখে। এরপর বলল,

-“এসো পরিয়ে দেই।”

নাফিয়া পেছনে সরে দাঁড়ায়। আরিভ শাড়ি চেয়ে হাত এগিয়ে রেখেছে। কিন্তু নাফিয়া দিতে নারাজ। আরিভ এগিয়ে এসে বলল,

-“কী হলো? দাও।”

নাফিয়া কিছুটা বিব্রত হয়ে বলে,

– “না! আমি আন্টির কাছে গিয়ে পরে নিব।”

আরিভ খানিকটা কপাল কুঁচকে তাকায় বলে, “আন্টি না মা। আর মা ওরফে শ্বাশুড়ির আগে স্বামীর সাহায্য নিতে হয়। কাম অন!”

-“না না। আমি আপনার হাতে শাড়ি পরব না।”

আরিভ বাঁকা হাসল। নাফিয়া সঙ্গেসঙ্গে তার এই দুষ্টু মুখপানে সন্দেহের চোখে তাকায়। এতদিনে তাকে অল্পস্বল্প করে ভালোই চেনা হয়েছে। মতলব মোটেও ভালো ঠেকছে না। আরিভ এগিয়ে এল, খপ করে শাড়িটা হাত থেকে টেনে নিয়ে বলল,

-“তুমি যেটা না করবে সেটা আমি আরও বেশি করেই করব।”

নাফিয়া চটে গেল। দু কদম পিছিয়ে যায়। তর্জনী আঙুল তাক করে বলল,

-“আপনার মতলব খারাপ আমি আগে থেকেই জানি। দূরে সরে দাঁড়ান বলছি।”

-“বুদ্ধিমতি বউ আমার। তোমার ক্ষেত্রে আমার মতলব কখনোই ভালো হবেনা।”

হতবাক নাফিয়া। আকার ইঙ্গিতে আজেবাজে বকে যাচ্ছে গতকাল রাত থেকেই। ঠোঁট চেপে বলল,

-“আপনি এমন অশ্লীল জানলে বিয়েই করতাম না।”

আরিভ হেসে উঠে। এগিয়ে এসে নাফিয়ার এক হাত চেপে ধরলো। অন্যহাত ধরার কোনো প্রয়োজন নেই। সেটা দিয়ে আক্রমণ করার সুযোগও নেই। শাড়ির এক অংশ নাফিয়ার কাঁধের উপর রেখে শাড়ি পেঁচাতে শুরু করে। নাফিয়া গায়ে পেঁচিয়ে রাখা ওড়না আরও ভালোভাবে জড়িয়ে খিচে দাঁড়িয়ে আছে। মানবে এই লোক? কখনও মেনেছে তার কথা? সবসময় জোর চালিয়ে গেল।

অন্যদিকে আরিভ একবার ভিডিও দেখছে আরেকবার শাড়ির দিকে নজর দিচ্ছে। কুচিগুলো ঠিকঠাক করল কোনোরকম। নাফিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

-“নিজে গুঁজবে নাকি আমি…”

নাফিয়া নিজের হাত ছাড়িয়ে অন্যদিকে ফিরে যায় দ্রুত। একহাতে কুচি গুঁজে বলল,

-“হয়েছে আর লাগবে না, আপনি এবার ব্যালকনিতে যান।”

-“কেনো?”

-“যেতে বলেছি যান।”

আরিভ কথা বাড়ালো না। নাজুক মেয়েটাকে লজ্জা দিতে চাইছিল, কিন্তু সে যে সইতে পারবে না। লজ্জার ভারে নুয়ে পড়বে। শিস বাজাতে বাজাতে ব্যালকনির দিকে যেতেই নাফিয়া ডেকে উঠে,

-“শুনুন।”

আরিভ দরজায় উঁকি দিয়ে আদুরে ভঙ্গিতে বলল,

-“জি ম্যাডাম? হেল্প লাগবে?”

একহাতে সেফটিপিন লাগাতে সমস্যা হচ্ছে। পারছে না কিছুতেই। অস্বস্তি হলো নাফিয়ার। কিন্তু কোনো উপায় নেই। দ্বিধা দ্বন্দ হটিয়ে বলল,

-“হ্যাঁ।”

লাফিয়ে ঘরে আসে আরিভ। বউ সাহায্য চাইছে, সেটা কী না করা যায় নাকি? ভদ্র বেশে এসে দাঁড়াল নাফিয়ার পেছনে। নাফিয়া সেফটিপিন দেখিয়ে বলল,

-“একা পিন আপ করতে পারছি না।”

ড্রেসিং টেবিল থেকে সেফটিপিন তুলে এগিয়ে আসে আরিভ। নাফিয়া শক্ত হয়ে দাঁড়াল, সে কাছে এলেই আতঙ্ক বিরাজ করে তার মধ্যে। আরিভ আলতো হাতে আঁচল পিন আপ করতে করতে বলল,

-“স্বামী ছাড়া আপনার কোনো গতি নেই, বুঝলেন।”

-“ঝামেলাযুক্ত স্বামী, অসভ্য স্বামী, ঝগড়ুটে স্বামী।”

আরিভ নাফিয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে আয়নায় চেয়ে বলল,

-“আর?”

-“মনে পড়ছে না আর…”

-“আমি কাছে থাকলে সব ভুলে যাও, তাইতো?”

-“মোটেও না।”

নাফিয়ার অর্ধ ভেজা চুলে মুখ ঘষে দিয়ে আরিভ বলল,

-“কখনও কখনও স্বীকার করলে ক্ষতি নেই।”

-“আপনিও কম অসভ্যতামি করলে, তাতেও কোনো ক্ষতি নেই।”

-“ইহা অসম্ভব, বউ।”

‘বউ’ ডাক শুনে হেসে ফেলল নাফিয়া। তাকে পুরোটাই আবৃত করে রেখেছে আরিভ। নাফিয়ার মনে হল, সে যেন তার ঢাল। প্রতিরক্ষা করছে তাকে। নাফিয়া আয়নায় তাকায়। চোখ বুঁজে তার কাঁধে পরে থাকা লোকটির দিকে চেয়ে শুধায়,

-“আমি প্রতিনিয়ত আমার অপূর্ণতার কারণে নত হয়েছি, কখনও কটু কথা শুনেছি আবার কখনও অহেতুক সহানুভূতি পেয়েছি। আপনার মাঝে দুটোর মধ্যে একটাও নেই। কেনো বলুনতো? আমার অপূর্ণতা নিয়ে মাথা ঘামাননি কেন?”

আরিভের কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ে। যেন বিরক্ত এই প্রশ্নে। এই মুহূর্তে তার কান এসব কথা শুনতে চাইছিল না বোধহয়। তারপরও জবাব দিল,

-“মনে কারো জন্য অগাধ ভালোবাসার জন্ম নিলে তার ত্রুটিগুলো অদৃশ্য হয়ে যায়।”

-“কিন্তু…”

-“আর একটা কথাও নয় নাফি। এই বিষয়ে আমি আরেকটা কথাও শুনতে চাই না।”

বেশ কঠিন সুরেই বলল। নাফিয়া আর কথা বাড়ালো না। আরিভ মুখ তুলে। নাফিয়াকে টেনে বসিয়ে দিল ড্রেসিং টেবিলের সামনে। বলল,

-“পায়েল কোথায়?”

-“পায়েল?”

-“ভুলে গেছো? আমি যে তোমায় দিয়েছিলাম? বলেছিলাম পরিয়ে দিব।”

কপালে হাত পড়ল নাফিয়ার। নিজের উপর রাগও হলো, কীভাবে ভুলে যেতে পারে সে পায়েলের কথা? নিজের ব্যাগে যত্ন করে রেখেছিল। দ্রুত উঠে দাঁড়াল। ব্যাগ সাথেই এনেছে। খুলে বের করল বক্সটি। আরিভের কাছে এসে বলল,

-“সত্যি বলতে আমি পায়েলের কথা ভুলে গিয়েছিলাম।”

আরিভ বক্সটি নিজের হাতে নিয়ে ফের নাফিয়াকে বসিয়ে দেয়। নিজেও হাঁটু গেড়ে বসল জমিনে। এই দৃশ্যে নাফিয়ার হৃদয়ে দোল খায় মুহূর্তেই। নাফিয়ার পা স্পর্শ করে নিজের উরুতে রেখে পায়েল পরিয়ে দিয়ে বলল,

-“প্রেমিকের দেওয়া উপহার ভুলে গেলে চলবে, স্বামীর ভালোবাসা ভুলা যাবেনা কিন্তু…”

নাফিয়া কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু পারল না। আরিভের ঠোঁটের ছোঁয়া পেল পায়ের পিঠে। কেঁপে ওঠে নাফিয়া। এমন একটি ঘটনা ঘটে যাবে তার কল্পনাতীত ছিল। নাফিয়া পা সরিয়ে বলল,

-“এটা কী করলেন?”

আরিভ অতি স্বাভাবিক সুরে জবাব দিল,

-“বউয়ের নরম তুলতুলে পায়ে চুমু খেলাম।”

-“না না কাজটা মোটেও ভালো হয়নি। পায়ে চুমু খায় কেউ?”

-“আমি খাই।”

-“উফ!”

-“উফ টুফ বাদ দাও। এসো তোমাকে নিজের মনের মত করে সাজিয়ে দেই।”

নতুন বউদের যাবতীয় অলংকার বের করে ড্রেসিং টেবিলে সাজানো হয়েছে। গলায় সরু স্বর্ণের চেইন পরিয়ে দিল আরিভ, হাতে চুড়ি। চুলগুলো যত্ন করে আঁচড়ে দিচ্ছে। খুঁজে খুঁজে একটি টিপের পাতা বের করল। গভীর মনোযোগ দিয়ে কপালের মধ্যিখানে টিপ পরিয়ে দিল। আবারও খোঁজাখুঁজি অভিযান শুরু করে, নাফিয়া অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখল আরিভকে। আকস্মিক মনে হল নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী নারী। তার স্বামী তাকে সাজিয়ে দিচ্ছে, বিনা বিরক্তিতে, বিনা অভিযোগে। নাম পড়ে পড়ে কাজল এগিয়ে দিয়ে বলল,

-“কাজল পড়ো।”

নাফিয়া বিনাবাক্যে কাজল এঁকে দিল দু চোখে। শাড়ির আঁচল ঠিক করে আরিভের সামনে দাঁড়াতেই আরিভ প্রশান্তিতে হেসে বলে,

-“আমার বউ।”

______

সেজে গুঁজে নতুন বধূ সেজেই বেরিয়েছে আরিভ নাফিয়া। সকাল তখন নয়টা। নাফিয়া হুট করেই আরিভকে ফেলে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। লাজুক ভঙ্গিতে এসে দাঁড়ায় শিরীন বেগমের কাছে।

নত গলায় বলল, -“আসসালামু আলাইকুম।”

গরম গরম পরোটা ভাজতে ভাজতে শিরীন বেগম ঘুরে তাকালেন। নাফিয়াকে দেখে সালামের জবাব নিয়েই আপ্লুত কন্ঠে বললেন,

-“মাশাল্লাহ! ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে তো তোমাকে। পুরোই নতুন বউয়ের মত লাগছে।”

পেছন থেকে আরিভ এসে হাজির হল। বাটি থেকে গরুর গোশতের এক পিস হুট করেই মুখে পুড়ে নেয়। খেতে খেতে বলল,

-“সবই আমার অবদান।”

শিরীন বেগম কোমরে হাত রেখে বললেন,

-“কী করে তোর অবদান?”

-“নিজ হাতে সাজিয়েছি বউকে, তাইতো এত সুন্দর দেখাচ্ছে। নয়তো এই বোকা মেয়ে সাজগোজ এর ‘স’ ও জানেনা।”

শিরীন বেগম মুচকি হাসেন। হাসিটা আড়াল করে তীর্যক চাহনী ছুঁড়ে বললেন,

-“ও মেয়ে হয়ে সাজগোজ জানে না। তুই কী করে জানিস? হ্যাঁ? তোর তো আগে বিয়ে হয়নি, অভিজ্ঞতাও নেই। তাহলে কী করে জানলি? আমার তো মনে হচ্ছে এখানে একটা ঝামেলা আছে।”

আরিভ থতমত খেয়ে গেল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নাফিয়ার দিকে তাকায়। বলে উঠে,

-“আম্মা! নতুন বউয়ের মনে কুমন্ত্রণা ঢুকিয়ে দিও না। আমি বিনা অভিজ্ঞতায় সাজিয়েছি। কীসব ভুলভাল বলছো?”

-“তোকে কীভাবে সাইজ করতে হয় সেটা শেখাব না?”

-“আম্মা!”

কাঁদো স্বরে বলে উঠে আরিভ। ভয় পাচ্ছে সে। নাফিয়া যদি সন্দেহ করে বসে। মেয়েটা অত্যন্ত বোকা স্বভাবের। মুখের কথা ধরে বসে থাকবে। শিরীন বেগম নাফিয়াকে আড়ালে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন। আরিভের দিকে চেয়ে বললেন,

-“গোশতের বাটি নিয়ে টেবিলে রাখ, যা।”

নাফিয়া বলে উঠল,

-“আন্টি… মানে মা আমি নিয়ে যাই?”

শিরীন বেগম কিছুসময়ের জন্য থমকালেন। কিছু যেন মনে পড়ল তার। পরপরই নিজেকে স্বাভাবিক করে বললেন,

-“না, আরিভ নিয়ে যাক। তুমি আমার কাছে থাকো।”

আরিভের বোঝা হয়ে গেছে কাজটা তারই করতে হবে। তাছাড়া এসব ছোটখাটো কাজ আগেও করেছে সে। বাটি নিয়ে টেবলের দিকে চলে গেল। নাফিয়া ফের বলল,

-“মা আমি ডিম ভেজে দেই?”

আবারো আমতা আমতা করে বলল,

– “একহাতে ডিম ভাজতে পারব, দেবেন?”

শিরীন বেগম নাফিয়ার মলিন মুখের দিকে তাকালেন। মেয়েটা শঙ্কিত, কিছুটা লজ্জিতও বটে। নতুন বউকে দিয়ে কাজ করাতে নেই। কিন্তু সে যদি ভেবে বসে থাকে, তার হাতের কারণে তাকে দেওয়া হচ্ছে না? মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলেন। বললেন,

-“করো।”

নাফিয়ার মুখে হাসি ফুটে। শিরীন বেগম সবকিছু এক এক করে এগিয়ে দিলেন। উৎফুল্লতা নিয়েই নাফিয়া ডিম ভাজতে শুরু করল। শিরীন বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

-“আরিভের বয়স তখন পাঁচ বছর। সংবাদ এলো আমি আবার মা হতে চলেছি। আমার বয়স তখন কম ছিল, তবে দ্বিতীয় সন্তানের জন্য খুবই খুশি ছিলাম। মার্কেটে গেলে মেয়েদের ছোট ছোট জামাকাপড়, ক্লিপ, জুতো দেখতাম আর মুচকি হাসতাম। শখ ছিল আমার মেয়ে হলে তাকে পুতুলের মত সাজাব। যখন জানতে পারলাম আমি আবার মা হবো তখন দুয়া করতে শুরু করলাম যেন মেয়ে হয়। খুব করে চেয়েছিলাম।”

নাফিয়া নিষ্পলক চেয়ে শুনল কথাগুলো। শুধায়,

-“এরপর?”

-“এরপর আর কী? নিয়তি আমার চাওয়া মেনে নেয়নি। আমার সন্তানটা পৃথিবীতে আসার পূর্বেই চলে গেল। আমি জানতাম আমার মেয়েই হতো, আমার মন বলেছিল।”

নাফিয়া জানেনা কীভাবে সান্ত্বনা দিতে হয়। এই মুহূর্তে কী বলতে হবে সেটিও বুঝতে পারছে না। মায়াভরা দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শিরীন বেগমের দিকে। শিরীন বেগম নাফিয়ার দিকে তাকালেন। ফিক করে হেসে বললেন,

-“তুমি মনমরা হয়ে গেলে কেন? এখনতো তুমি আছো।”

-“আমি চেষ্টা করব আপনার মেয়ে হয়ে থাকার। কখনও কোনো ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমা করে দিবেন।”

-“কেউই ভুল ত্রুটির ঊর্ধ্বে না। আমিও না। কেউ পরিপূর্ণ না, আমিও অপূর্ন। তোমাকে মেনে নেওয়ার পেছনে কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না আমার। তবে ছেলের সুখ আর আমার ঘরের অপূর্ন জায়গাটা পরিপূর্ণ করার জন্য তুমি আজ আমার ছেলের বউ।”

-“ছেলের বউতো অন্য কেউ হতে পারতো, সুস্থ স্বাভাবিক কেউ।”

বলেই চোখ নামিয়ে ফেলে নাফিয়া। শিরীন বেগম জবাবে বললেন,

-“হতে পারতো। কিন্তু কী নিশ্চয়তা সেই সুস্থ স্বাভাবিক মানুষটি এই ঘরকে, ঘরের মানুষগুলোকে ভালোবাসতো? মানুষ বাছাই করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে কিছু অমুল্য জিনিস পেছনেই ফেলে আসে। সেসব তাদের চোখে পড়েনা।”

-“আমি ভালো, মা?”

-“খারাপতো নও।”

-“যদি হই?”

-“হবেনা। আমার বিশ্বাস আছে আমার ছেলের পছন্দের উপর।”

শুধু ডিমটাই করেছে নাফিয়া। শিরীন বেগম চেঁচিয়ে ডাকলেন আরিভকে। ধমকের সুরে খাবারগুলো নিয়ে টেবিলে সাজাতে বললেন। আরিভও বাধ্য হয়ে কাজগুলো করেছে, বোচা মুখ বানিয়ে। নতুন বউয়ের সামনেও শিরীন বেগম তাকে ধমকে যাচ্ছে, কাজ করাচ্ছে। ইগোতে লাগল, কিন্তু কিছু বলতে পারল না। মায়ের সামনে তার চলে না।

খাবার টেবিলে বসে সেইদিনের মত হাত চেপে ধরলো আরিভ। মৃদু ছটফট করে উঠে নাফিয়া। হাত ছাড়াতে চাইলেও পারল না। শিরীন বেগম বলেন,

-“নাফিয়া ডিম ভেজেছে। সবাই সেটা দিয়েই শুরু করুন আজ।”

ডিম ভাজা খুবই সামান্য একটা বিষয়। অসাধারণ কোনো রান্না নয়। তার এই ছোট বিষয়টাকেও বড় করে উপস্থাপন করলেন শিরীন বেগম। আতাউর সাহেব আর আরিভও সায় দিল। প্রশংসায় ভাসাল। নাফিয়া অবাক হয়ে দেখল তাদের। বাড়িতে তার মা আর বাবা ছাড়া দাদী কখনোই খাবারের তারিফ করত না। উল্টো খুঁত বের করত। অকেজো হাতের দোহাই নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা শোনাতো। এখানে সবাই একই সুর বলছে। আতাউর সাহেবতো নাফিয়ার হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন,

-“তোমার বকশিস।”

নাফিয়া নিতে চাইল না। কিন্তু জোর করেই দিল আতাউর সাহেব। আরিভ নাফিয়ার হাতে বৃদ্ধাঙ্গুল চালিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল,

-“এখানে সবাই আপন, তার চেয়ে আপন আপনার বর।”

চলবে….