বৈরী বসন্ত পর্ব-২৫+২৬

0
8

#বৈরী_বসন্ত ২৫
লেখা – আয্যাহ সূচনা

শ্বশুরবাড়িতে প্রথমদিনটি সাধারণ দিনের মতোই কেটেছে। তবে কিছু, কিছু নয় বিশাল কমতি ছিল। যদিও বারান্দায় গিয়ে বাবা মায়ের সাথে দেখা করেছে নাফিয়া, কিন্তু দূর থেকে দেখা আর কাছে থাকা কি এক? তবে এ নিয়ে মন খারাপ করতে দেননি শিরীন বেগম আর আরিভ কেউই। সারাদিন এদিক ওদিকের আলোচনা করে তাকে খুশি রাখার চেষ্টা করেছেন।

তবে রাতের ঘুমটা হুট করেই সব ধ্যান ধারণা ভুলিয়ে বসছে। প্রিয় মানুষের গায়ের ঘ্রাণ পাবে বলেই এত শান্তি? নাফিয়া বলে বোঝাতে পারবে না, তার কতটা ভালো লাগে আরিভের বুকে মাথা গুঁজে শুয়ে থাকতে। একদিনে নতুন ভালো লাগার জন্ম নিয়েছে যেন।

তবে মাঝরাতে নিজেকে একা অনুভব করল। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানিয়ে দিয়েছে আরিভ তার পাশে নেই। কিন্তু শরীরে এক ঝাঁকুনি অনুভব করছে। চোখ খুলে তাকাল নাফিয়া। আবছা আঁধারে মৃদু স্বরে তার নাম শুনতে পেল,

-“নাফি.. উঠো।”

মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ জাগ্রত হতে সময় নিল খানিক। চোখ কচলে প্রশ্ন করল,

-“কয়টা বাজে?”

ঘরজুড়ে আঁধার। সকাল হয়নি এতটুকু নিশ্চিত। আরিভ ঘরের বাতি জ্বালায়। নাফিয়ার সম্পূর্ণ চোখ যেন জ্বলে উঠে। সাথে সাথে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে নিল। আরিভ বলল,

-“রাত দেড়টা বাজে। দ্রুত রেডি হয়ে নাও।”

রেডি হয়ে নাও? চোখ থেকে হাত নামালো নাফিয়া। অবুঝ চোখে চেয়ে বলে,

-“রেডি হব? এতরাতে?”

আরিভ হাতে থাকা দুটো হেলমেট দেখিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসল। বলল,

-“চলো রাতের শহর ঘুরে বেড়াবো।”

যতসব পাগলের প্রলাপ! নাফিয়ার মুখভঙ্গি অদ্ভুত রূপ ধারণ করে। বলে বসল,

-“কীসব বলছেন? এত রাতে মানুষ বাহিরে যায়?”

-“আমরা যাব, চলো।”

শাড়ির প্রতি নাফিয়ার এতই ঝোঁক ছিল যে শাড়ি পড়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ঘুম চোখে ঢুলতে ঢুলতে উঠল নাফিয়া। আরিভ তাকে সাহায্য করল। নিঃশব্দ রাতে পায়েলের মৃদু ঝংকারে একবার মুচকি হাসে আরিভ। কেন জানেনা এই ছোট্ট বিষয়টিও অসাধারন লাগছে।

নাফিয়া দ্রুত কাপড় পরিবর্তন করে নিল। এরপর আরিভের আস্কারাতে সায় দিয়ে চুপিচুপি চোরের মতো ঘরের দরজা খুলেছে আঁধারে। বাবা মা যেন কোনোভাবে টের না পায়। নাফিয়া ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট এক হাতে ধরে বলল,

-“মনে হচ্ছে আমরা বিয়ে করেও পালিয়ে যাচ্ছি।”

আরিভ দরজা খুলতে খুলতে মুচকি হাসে। বলে,

-“মাঝেমধ্যে এমন মিছেমিছি সিচুয়েশন তৈরি করে নিতে হয়, বউ। আমরা জানি এটা সত্য নয়, তবে সত্য ধরে নিয়ে উপভোগ করব।”

-“পালিয়ে গেলে কেমন লাগে, সেটা অনুভব করতে চাইছেন?”

-“হ্যাঁ।”

বাড়ির গ্যারেজে বাইক স্টার্ট দিল না আরিভ। বাইকের আওয়াজে নয়তো লাফিয়ে উঠবেন শিরীন বেগম। কোনো রকম মেইন দরজা খুলে বাইক বাইরে টেনে আনল। সাবধানতার সাথে দরজা বন্ধ করে একটু এগিয়ে নাফিয়াকে ডেকে হেলমেট পরিয়ে দিল সযতনে। এটাতো তারই দায়িত্ব।

-“এখন বাইকে ভয় করে বউ?”

ল্যাম্পপোস্টের আলো নিভু নিভু। তারও যেন জান যায় যায় অবস্থা। কিছুদিনের মধ্যেই ফিউজ হয়ে যাবে। তবুও সামান্য আলো দিয়েছে তার স্ত্রীর মুখে। সেখানে তার মিষ্টি হাসি দৃষ্টিগোচর হল। নাফিয়া খুব উৎসাহের সাথে বলল,

-“আপনার সাথে আর বাইকে ভয় করেনা।”

আরিভ খুশিতে সাথেসাথে নাফিয়ার গাল টিপে দেয়। বলে,

-“এসো আর হ্যাঁ এবার কাঁধে হাত রাখা চলবে না।”

নাফিয়া ঘাড় বাঁকা করে অবুঝ গলায় শুধায়,

-“তাহলে কীভাবে বসবো?”

রাত যতই হোক, কাজল ব্যতীত নাফিয়া অসম্পূর্ণ। তবে লেপ্টে আছে কিছুটা। আরিভ হাত এগিয়ে চোখের কোণের কাজল মুছে দিয়ে বলল,

-“কোমর জড়িয়ে পিঠে মাথা রেখে বসতে হবে, বুঝলে? এবার ঝটপট উঠে পড়ো।”

নাফিয়া বিনাবাক্যে উঠে বসল। আরিভ তার ডান হাতটা টেনে নিজের কোমরে পেঁচিয়ে নিল। নাফিয়া নিজে থেকেই অন্যহাতে আরিভকে জড়িয়ে ধরে মাথা এলিয়ে দেয় পিঠে। আরিভ চমকায়। প্রশ্ন করে,

-“আগে আমার কাছেও ভিড়তে চাইতে না। একজন নিজে থেকেই ধরা দিচ্ছ, কাহিনী কী?”

-“কাহিনী হচ্ছে, এখন আপনি আর আমি অপরিচিত কেউ নই।”

-“আচ্ছা? আগে অপরিচিত ছিলাম বুঝি?”

-“কোনো সম্পর্কতো ছিল না।”

আরিভ বাইক স্টার্ট করল। তার গতির চেয়ে কিছুটা ধীরেই চালায় নাফিয়াকে নিয়ে। তার কথার পিঠে আবার প্রশ্ন করল,

-“এখন সম্পর্ক আছে বলে অধিকার খাটানো হচ্ছে?”

-“হ্যাঁ! পূর্ণ অধিকার খাটানো হচ্ছে।”

আরিভ হাসল। হাসির তালে বুক কাঁপলো তার। ঠিক সেখানে রাখা নাফিয়ার হাতটা সেই কম্পন অনুভব করেছে। শার্ট আরও খামচে ধরে। আরিভ বলে,

-“অধিকারের সাথে একটু আধটু ভালোবাসলে, আদর করলেও আমি খুশি হই।”

-“এত লোভী হবেন না। অধিকার খাটাচ্ছি, এটা নিয়েই খুশি থাকুন।”

আরিভ চলন্ত বাইকে আকাশের দিকে চেয়ে বলে উঠে,

-“কপালে বোধহয় বউয়ের আদর সোহাগ নেই!”

নাফিয়া আরিভের পিঠে মুখ লুকিয়ে হাসে। অলিগলি পেরিয়ে হাইওয়েতে উঠতেই আরিভ সুরেলা কণ্ঠে বলে,

-“এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলোতো?”

নাফিয়া আরিভের পিঠে থুতনি ঠেকিয়ে খানিক মুখ তুলে তাকায় আর বলে,

-“কেমন হতো?”

-“ভালোই হতো, দুজন হারিয়ে যেতাম।”

-“সত্যিই ভালো হতো?”

-“হ্যাঁ ভালো হতো।”

নাফিয়া ঠোঁট টিপে হেসে বলল,

-“আপনার বাইকের তেল ফুরিয়ে যেত।”

-“ধুর! আনরোমান্টিক মেয়ে।”

দুষ্টু মিষ্টি খুনসুটির মধ্যেই যাত্রাপথ পেরোচ্ছে। রাতের ঠান্ডা হাওয়া মুখে মাখছে নাফিয়া। বারবার মন বলে উঠছে, কি স্নিগ্ধ! তারিফ করার শব্দ নেই। দ্রুত গতিতে পেরিয়ে যাওয়া ল্যাম্পপোস্টগুলোকেও চোখ ধাঁধানো মনে হল। ব্যস্ত শহর অনেকটাই নীরব, তবে সম্পূর্ণ নয়। দূরপাল্লার গাড়ি চলছে, কেউ কোনো জরুরি কাজে ছুটছে। নাফিয়া বাতাসের তীব্র দাপটে নিজের কণ্ঠস্বর উঁচু করল। আরিভের কানের কাছে গিয়ে বলল,

-“মনে হচ্ছে শুধু আমরাই ঘুরতে বেড়িয়েছি, বাকি সবাই কোনো না কোনো প্রয়োজনে।”

আরিভ নীরবে হাসল। বাইকের গতি সামান্য বৃদ্ধি করে ঢুকে পড়ল পুরান ঢাকার অলিগলিতে। সরু গলিতে প্রবেশ করতেই নাফিয়ার চক্ষু চড়কগাছ। রাতের কয়টা বাজে সেই হিসেবে করল মস্তিষ্কে, হবে আনুমানিক দুটোর বেশি। এখানে এখনও এত আলো? চারিপাশ দেখে মনে হচ্ছে মাত্র সন্ধ্যা। রাস্তায় মানুষের কোলাহল। আরিভ একপাশে বাইক পার্ক করে নাফিয়ার হেলমেট খুলে দিল। দেখল তার অবাক মুখখানা।

আরিভ হেসে বলল, – “অবাক হচ্ছো তাই না?”

-“খুব! মনে হচ্ছে মাত্র সন্ধ্যা নামল।”

-“পুরান ঢাকা এমনই।”

-“কিন্তু আমরা এখানে কেন এসেছি?”

আরিভ নাফিয়ার দিকে চেয়ে চোখ টিপে বলল,

-“খেতে।”

নাফিয়া মুখ কুঁচকে নেয়। মিছেমিছি রাগ দেখিয়ে বলল,

-“আপনি আর আপনার খাবারের প্রতি প্রেম! খাওয়ার জন্য আমার ঘুম নষ্ট করলেন?”

-“আমি একা খাবো নাকি? তুমিওতো খাবে। আর পুরান ঢাকায় রাতেই বেশি আনন্দ পাওয়া যায়।”

নাফিয়া ভেংচি কেটে বলে, -“এসেছেন খাওয়ার লোভে, বুঝি না মনে হয়?”

সত্যিটা ধরা পড়ে গেছে। তাতে বিশেষ কিছু আসে যায় না আরিভের। খাওয়ার পাশাপাশি নতুন বউকে নিয়ে রাতের শহর দেখা দুটোই তার পছন্দের কাজ। নাফিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

-“এসো বউ।”

নাজিরা বাজারের বোখারী রেস্তোরা জনপ্রিয়। জমজমাট আয়োজনের সাথে নাকে ঘ্রাণ ভেসে আসছে খাবারের। আরিভ নাফিয়ার হাত আরও শক্ত করে চেপে দ্রুত হেঁটে চলে গেল ভেতরে। নাফিয়া তাল মেলাতে চাচ্ছে, কিন্তু পারছে না। কোনরকম হেঁটে উপর তলায় গিয়ে বসল। আরিভ বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে খাবার অর্ডার করে বলল,

-“খাবারের ঘ্রাণে আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে।”

নাফিয়া পুনরায় মুখ ভেংচি কেটে বলল,

– “ছোচা বিড়াল।”

-“আমাকে বলছো?”

-“তো কাকে বলব?”

-“আমি মোটেও ছোচা নই, ভোজনরসিক।”

-“রাক্ষস বলে এটাকে।”

আরিভ কড়া জবাব দিয়ে বলল,

– “আমার পরিবারের সকলেই ভোজনরসিক, আমার বাবা, দাদা পূর্ব পুরুষ সবাই খেতে পছন্দ করতেন। তোমার মত নাকি?”

সাথে সাথে চটে গেল নাফিয়া। বলল,

-“এই আমার মত মানে? কি বলতে চাইছেন?”

-“তোমাকে দেখলে মনে হয় মাসের পর মাস তোমাকে খেতে দেওয়া হয় না।”

-“আমাদের বাড়িতেও ভালো ভালো খাবার হয় বুঝলেন।”

দুজনের মধ্যে যেন বিতর্ক প্রতিযোগিতা শুরু হলো। আরিভ জবাব দিল উল্টো দিকে ঘুরে,

-“দেখে তো মনে হয় দুর্ভিক্ষ চলে।”

জবাব দিয়েছে তাও অন্যদিকে চেয়ে। নাফিয়া গলায় জোর পায় আরও। প্রতিপক্ষ চোখে চোখ রেখে তর্ক করছে না। নাফিয়া তর্জনী আঙুল তুলে বলল,

-“এই কি বললেন আপনি? আমাদের বাড়িতে দুর্ভিক্ষ চলে? আমরা ফিট মানুষ। আপনার ভুঁড়ি দেখেছেন। কেউ দেখলে বলবে একটা আস্ত বাচ্চা আছে এখানে।”

আরিভ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। পেটে হাত রাখল চিন্তিত ভঙ্গিতে। আসলেই ভুঁড়ি এতটা বেড়ে গেছে? মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে এল তার। নাফিয়া তার এমন মুখ দেখে আলগোছে হাসে। সুযোগ যেহেতু পেয়েছে সৎ ব্যবহার করবে। আরও বলল,

-“খেয়ে খেয়ে দিনদিন হাতি হচ্ছেন। কপাল তো আমার পুড়লো! ভুঁড়িওয়ালা লোককে বিয়ে করেছি, কবে যেন সামনের চুলগুলোও বিদায় নেয়।”

খাবারের পর আর একটি প্রিয় জিনিস হচ্ছে চুল। আরিভের মুখে আরও কালো মেঘ ঘনাতে শুরু করে। আসলেইতো! যদি চুল চলে যায়? কি বিশ্রী দেখাবে তাকে?

নাফিয়া মুখে আসা হাসিটা আটকে রাখছে খুব কষ্টে। এই মুখের একটা ছবি তোলা উচিত ছিল। কিন্তু সেটিতো বাসায় ফেলে এসেছে।

নাফিয়া বলে উঠে,

-“আপনি কি মাইন্ড করলেন নাকি আবার? আমি কিন্তু আপনাকে রিয়ালিটি চেক দিলাম। কষ্ট পেলে আমার কিছু করার নেই।”

ততক্ষণে খাবার হাজির। হাফ প্লেট করে তিনটে কাচ্চি অর্ডার করেছিল আরিভ। তার মতে হাফ প্লেটে নাকি বেশি পাওয়া যায়। দু প্লেট সে নিজে খাবে। আরেক প্লেট নাফিয়ার। খাবার সামনে রাখা হল কিন্তু আরিভের কোনো হেলদোল নেই। অন্যমনস্ক হয়ে কি যেন ভাবছে। নিশ্চয়ই চুল আর ভুঁড়ির কথা?

-“আপনার প্রথম প্রেম আপনার সামনে, খাচ্ছেন না কেন?”

ধ্যান ভাঙলো আরিভের। জীবনে প্রথমবার খাবার দেখে চুপচাপ বসে আছে। নাফিয়া এবার হেসে ফেলে। তার হাসি দেখে আরিভ মলিন মুখে শুধায়,

-“হাসছো কেন?”

-“হাসছি আপনার অবস্থা দেখে।”

-“আসলেই ভুঁড়ি বেশি….”

-“তো? ভুঁড়ি বেশি অথবা কম তাতে কি আসে যায়? দ্রুত শুরু করুন, দেখে মনে হচ্ছে অনেক মজার।”

আরিভ কেমন যেন সংকোচ বোধ করল। নাফিয়া খেতে শুরু করে। আরিভের দিকে চেয়ে বলল,

-“উফ! আপনার উপর আমার ভূত চেপেছে? মজা করছিলাম। কোনো ভুঁড়ি বাড়েনি, খেয়ে নিন।”

লম্বা নিঃশ্বাস ফেলতে দেখা গেল আরিভকে। এই খুশিতে আরও হাফ প্লেট অর্ডার করল। নাফিয়া হা করে তাকাল তার দিকে। কিন্তু আরিভের নজর নাফিয়ার দিকে নেই। সে খেতে ব্যস্ত।

-“যা অবস্থা দেখছি, খাবার পেলে আমাকে ভুলে যাবেন আপনি।”

খাবার মুখে পুড়ে অস্পষ্ট গলায় আরিভ বলল,

-“যতক্ষণ খাচ্ছি ততক্ষণের জন্য।”

-“কিহ! এই আপনি যেকোনো একটা চুজ করুন, আমি নয়তো খাবার?”

-“তোমার হাতের খাবার।”

নাফিয়া নাক ফুলিয়ে বলল,

-“অনেক চালাক আপনি!”

-“থ্যাংকস।” ভাবলেশহীন জবাব দেয় আরিভ।

খাওয়া দাওয়া শেষে অলসতা ঝেঁকে বসল আরিভের দেহে। এখন বাইকটাও চালাতে ইচ্ছে করছে না। দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে ভাবল কোথাও যদি শুয়ে পড়ার ব্যবস্থা থাকত তাহলে ভালোই হতো। অন্যদিকে মুখ ফুলিয়ে রেখেছে নাফিয়া। কারণ নেই কোনো, আবার আছে, আরিভের সাথে তার ছোটখাটো তর্ক।

আরিভ নাফিয়ার কাঁধে হাত রাখল শক্ত করে। বলল,

-“কেউ যদি তুলে নিয়ে বাড়ি দিয়ে আসতো? কতই না ভালো হতো বলো?”

-“অলস কোথাকার!”

-“খাওয়া দাওয়ার পর আর নড়তে ইচ্ছে করেনা।”

নাফিয়া হতাশায় মাথা দোলায়। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাইক স্টার্ট করল আরিভ। আগামীকাল থেকে অফিস শুরু। বিয়ের কারণে তিনদিন অফিসে যাওয়া হয়নি।

বাইক চলছে। হুট করেই আসমান ডেকে উঠল। নাফিয়া ভয় পায়। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আরিভকে। ভয়ের রেশ কাটানোর সুযোগ দিল না প্রকৃতি, অল্প স্বল্প করে বারিধারা প্রবল হতে শুরু করে। নাফিয়া বলল,

-“বৃষ্টি হচ্ছে।”

জবাব এল, -“হোক।”

-“ভিজে যাচ্ছি তো।”

-“আমার প্রেমের বৃষ্টিতে ভিজেছো, প্রকৃতির বৃষ্টিকে অবহেলা করলে সে নারাজ হবে।”

-“কি ডায়লগ! একদিকে সাইড করুন।”

পাশেই একটা চায়ের দোকান। দোকানী দোকান বন্ধ করেননি। বরং দোকান খোলা রেখেই শুয়ে আছেন ভেতরে। গভীর রাতে যদি কোনো পথচারীর চা খেতে ইচ্ছে হয়? সেই আশায়। অদ্ভুত শহর, কিছু প্রয়োজনীয় কাজও কারো কাছে প্রয়োজনীয়।

ততক্ষণে ভিজে গেছে তারা দুজনেই। আরিভ নাফিয়ার হাত ধরে টিনের ছাউনির নিচে আনল। অর্ধ ঘুমে থাকা দোকানীকে ডেকে উঠে,

-“মামা ঘুমোচ্ছেন?”

নাফিয়া ইশারা দিয়ে না করে। যেন না ডাকা হয় তাকে। কিন্তু দোকানী উঠল সময় নিয়ে। চোখ কচলে বলল,

-“না ঘুমাইতাসিলাম না, একটু ঘুমের অভিনয় করতাসিলাম।”

বেকুব বনে গেল আরিভ। অন্যদিকে নাফিয়া মুখে হাত রেখে হেসে ফেলে। আরিভ বলল,

-“আচ্ছা আপনি আপনার অভিনয় জারি রাখেন। অভিনয় শেষ হলে দু কাপ চা দিয়েন।”

আরিভ নাফিয়ার দিকে তাকাল। ভিজে চুপসে আছে মেয়েটি, ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে। আরিভ গা ঘেঁষে বসল। তার দুহাত নিজের হাতে নিয়ে ম্যাসাজ করতে করতে দোকানীকে বলল,

-“দু কাপ নয়, এক কাপ চা দিবেন চাচা।”

নাফিয়া অবাক সুরে প্রশ্ন করল,

-“এক কাপ কেন?”

হুট করেই আরিভের কন্ঠ খাদে নামে,

-“দুজনে ভাগাভাগি করে নিব…”

আরিভ মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেছে ঠিক তার কাছে। চোখজোড়া তার দিকে গভীরভাবে আবদ্ধ। নাফিয়া সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিল। বলল,

-“মুভিতে দেখেছি নায়ক নায়িকাদের এভাবে ঘুরে বেড়াতে। এখন নিজেদেরও ঠিক কোনো মুভির নায়ক নায়িকার মত লাগছে।”

-“ভালো লাগছে?”

-“হুম।”

-“এবার একটা চুমু খাই? মুভিটা রোমান্টিক হবে তাহলে?”

নাফিয়া মুখ তুলে তাকানোর সাথে সাথেই টুপুর টাপুর বৃষ্টির মত চুমু পড়ল গালে। অবাক হওয়ার সুযোগটুকু দিল না তাকে। দোকানীর চোখ বাঁচিয়ে নিজের সঙ্গে লেপ্টে রাখল নাফিয়াকে।

চলবে…

#বৈরী_বসন্ত ২৬
লেখা – আয্যাহ সূচনা

শিরীন বেগম দাঁড়িয়ে দরজায়। মুখখানা থমথমে। এক হাত কোমরে রেখে কাক ডাকা ভোরে সদ্য বিবাহিত কপোত কপোতীর দিকে চেয়ে আছেন। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুজনই আঁটসাঁট হয়ে, চুল গড়িয়ে এখনও পানি পড়ছে। নাফিয়ার ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো। শ্বাশুড়ি মা ভীষণ রেগে গিয়েছেন বোধহয়। আড়চোখে একবার আরিভের দিকে চেয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। তার দিকে চেয়ে লাভটা কি? বাঘ এখন বিড়াল সেজে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে। রক্ষা পাওয়ার লাভে তার দিকে তাকানোও বিপদ।

শিরীন বেগম কোমর থেকে হাত নামিয়ে বললেন,

-“আগে জানতাম আমার ছেলে হাঁদারাম, এখন দেখছি পলাতক আসামীও।”

-“আম্মা…”

-“চুপ!”

এক ধমকে দুজনেই কেঁপে উঠল। অসময়ে হাঁচিটাও এলো। তার দেখাদেখি নাফিয়াও কেশে উঠে। হাঁচি কাশি আর সময় পেলো না আসার। মায়ের সামনেই আসতে হবে?

শিরীন বেগম বললেন,

– “মানুষ ঘুরতে যায় দিনের বেলা আর তুই? রাতের বেলা নতুন বউ নিয়ে বেরিয়ে গেছিস?”

-“আম্মা মন চাইলো একটু রাতের শহর দেখার…”

-“তোর মনকে আমি উনুনে দিব,বেয়াদব ছেলে! রাতে এই শহরে কত বিপদ হয় জানিস? তার মধ্যে বৃষ্টি! হাঁচি কাশি সাথে এনেছিস। জ্বর বাঁধলে আস্ত রাখব না বলে দিলাম।”

আরিভ এগিয়ে এল শিরীন বেগমকে জড়িয়ে ধরবে বলে। তার পূর্বেই শিরীন বেগম তাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বললেন,

-“এই ভেজা গায়ে আমাকে ধরবি না। যা ঘরে গিয়ে কাপড় চেঞ্জ কর, আমি আদা চা দিচ্ছি দুজনকে।”

বলে নাফিয়ার দিকে তাকালেন তিনি। আরিভ বাধ্য ছেলের মত জুতো হাতে তুলে ঘরের দিকে পা বাড়ানোর পূর্বেই নাফিয়া বলে উঠল,

-“মা, আমি যেতে চাইনি। আমাকে ঘুম তুলে থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেছে।”

বিষম খেয়ে দাঁড়াল আরিভ। এ কেমন পল্টি? চোখ গোলগোল করে ঘুরে তাকাল। তার বউ তার সাথে এমন শত্রুর মত আচরণ করতে পারলো?

নাফিয়া আরও বলল,

– “আমিতো বলেছিলাম, মা। সকালে যাব, সে কিনা পুরান ঢাকার কাচ্চি খাবে। আমাকেও সাথে নিয়েছে।”

আরিভ বলল,

-“কতবড় বাটপার! এই তুমি না বললে তোমার ঘুরতে এসে ভীষণ ভালো লাগছে?”

-“দেখলেন মা? আমাকে বাটপার বলছে, আমাকে ঘুরতে নিয়ে এটাও বলেছে আমাকে দেখে নাকি মনে হয় আমাকে খেতে দেওয়া হয়না। আমার বাবা আমাকে না খাইয়ে রাখতেন।”

আরিভের মাথাটা ভনভন করতে লাগল। ঘরের শত্রু বিভীষণ। এমন বউয়ের চেয়ে তো শত্রুও ভালো। শিরীন বেগম কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে প্রশ্ন করেন,

-“এসব বলেছিস?”

-“কসম আম্মা, আমি এমন কিছুই বলিনি…”

-“আবার কসম কাটিস! চড়িয়ে দাঁত ফেলে দিব।”

আরিভ নাফিয়ার দিকে চেয়ে রাগী গলায় বলল,

– “তুমি ঘরে এসো একবার।”

-“দেখলেন মা, হুমকি দিচ্ছে।”

শিরীন বেগম ছেলেকে শাসিয়ে বললেন,

-“তোর হাড়গোড় ভেঙে দরজায় ঝুলিয়ে রাখব যদি ওকে একটা উল্টোপাল্টা কথা বলেছিস।”

বলে চলে গেলেন শিরীন বেগম রান্না ঘরে। নাফিয়ার মুখে বিজয়ের হাসি। সেই সময়ের তর্কের প্রতিশোধ যেন নিল। হেলেদুলে আরিভকে টপকে ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,

-“আমাকে ভয় করুন, বুঝলেন মশাই?”

দুজনকে সামনে বসিয়ে আদা চা খাইয়েছেন শিরীন বেগম। রাগ তার মিছেমিছি, যাওয়ার পথে দুজনের গায়ে হাত রেখে দেখে গেলেন জ্বর হয়েছে কিনা। যাওয়ার পথে আরিভকে শাসিয়েও গেলেন, যেন নাফিয়াকে কিছু না বলা হয়। আরিভতো সেই অপেক্ষাতেই ছিল। কিন্তু সেটি হলো কোথায়? শিরীন বেগম বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই নাফিয়া বলে উঠল,

-“আমাকে কিছু বললেই আমি মা’কে ডাকব, তাই সাবধান।”

আরিভ দাঁত কিড়মিড় করে বলল, -“চন্ডাল!”

-“হ্যাঁ আপনার বউ চন্ডাল।”

_____

আরিভের অফিস শুরু হয়েছে। সকাল সকাল তড়িঘড়ি করে বেরিয়েছে। রাতে ঘুমোতে দেরি হওয়ায় সকালে পুরো ঘর এলোমেলো করে রেখে গিয়েছে। নাফিয়া একহাতে সেসব গোছালো। এলোমেলো ঘর তার কখনোই পছন্দ না। ঘর গুছিয়ে বেরোতেই শিরীন বেগম ডাকলেন। বললেন,

-“এটা এখন থেকে তোমারও সংসার। এসো ঘরে কোথায় কি রাখা আছে দেখিয়ে দেই।”

শিরীন বেগম এক এক করে নাফিয়াকে সবটা দেখিয়ে দিচ্ছেন। প্রয়োজনীয় জায়গাগুলোর স্থান দেখিয়ে দিলেন। নাফিয়া খুব আগ্রহ নিয়েই সবটা দেখছে। ঠিক তখনই কলিং বেল বাজল। নাফিয়া উঠে গেল। বলল,

-“আমি দেখছি।”

দরজা খুলতেই চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল নাফিয়ার। রেশমা বেগম এবং সিদ্দিক সাহেব দাঁড়িয়ে। তাদের হাতে গাছ। অধরে লম্বাটে হাসি টেনে এগিয়ে গেল। জড়িয়ে ধরল দুজনকেই।

সিদ্দিক সাহেব বলে উঠলেন,

-“তোমার ঘরে আসতে দিবে না? দরজায় দাঁড়িয়ে থাকব?”

নাফিয়ার হুশ ফিরল। তাড়াহুড়ো করে বলল,

-“তা কেন হবে বাবা? এসো, ভেতরে এসো।”

বারান্দার গাছগুলোকে মিস করছিল নাফিয়া। তারাই তো তার একাকীত্বের সঙ্গী। মন খারাপের কালে তাদের সতেজতা মন ভালো করেছে। নাফিয়া ভাবছিল গাছগুলোকে এখানে নিয়ে আসবে। সিদ্দিক সাহেব তার না বলা কথাগুলো যেন অজান্তেই বুঝে গেছেন। পুরোনো গাছগুলোর সাথে নতুন কিছু গাছও নিয়ে এসেছেন মেয়ের জন্য।

বসার ঘরে বসে বিনয়ের সাথেই সিদ্দিক সাহেব বললেন,

-“আপা মেয়ের জন্য গাছগুলো এনেছি, আপনার কোনো সমস্যা নেইতো?”

শিরীন বেগম জবাব দিলেন,

-“সমস্যা কেন হবে? ভালোই হলো উল্টো, আমারও গাছ ভীষণ ভালো লাগে।”

রেশমা বেগম বললেন,

– “এভাবেই না জানিয়ে এতগুলো গাছ নিয়ে এলাম। বিষয়টা দৃষ্টিকটু লাগছিল আমাদের কাছে। যতই হোক মেয়ের শ্বশুরবাড়ি।”

-“আপনারা বেশি ভাবছেন। আমি একদম কিছু মনে করিনি। আপনারা মেয়ের কাছে বসুন আমি চা করে আনছি।”

নাফিয়া মায়ের পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল। আগ্রহী সুরে বলল,

-“মা আমি চা বানাই?”

সিদ্দিক সাহেব আর রেশমা বেগম দুজনেই অবাক হলেন। শিরীন বেগম বললেন,

-“সেটাও ভালোই হয়। তোমার বাড়িতে তোমার বাবা মা এসেছেন, চা নাহয় তুমিই বানাও।”

নাফিয়ার মুখে হাসি ফুটল। রান্নাঘরে এক প্রকার দৌঁড়ে চলে গেল। নতুন সম্পর্ক, নতুন ঘর। সে চাইছে আপন করে নিতে। যেমন ওবাড়িতে ছিল ঠিক সেইভাবেই থাকতে চাইছে। নতুন সংসার নিয়ে তার আগ্রহের শেষ নেই। সিদ্দিক সাহেব ও রেশমা বেগম একে অপরের দিকে চেয়ে স্মিত হাসলেন। তাদের চাওয়া এতটুকুই ছিল।

_________

বিয়ের সবে মাত্র দুদিন। আরিভের বাড়ির ব্যালকনিতে তেমন একটা আসা হয়নি। বাবা মায়ের সাথে দেখা করার জন্য অল্প সময়ের জন্য আসা হলেও সময় কাটানো হয়নি। আরিভ বাড়িতে নেই। শিরীন বেগম বিশ্রাম করছেন। সিদ্দিক সাহেব ও রেশমা বেগম চলে গিয়েছেন কিছুক্ষণ পূর্বে। অলস সময় পাড় করার জন্য নাফিয়া ব্যালকনিতে গাছগুলো ঠিকঠাক করতে লাগল। হরেক রকমের গাছ উপহার দিয়েছেন বাবা। তার মাঝে সবচেয়ে প্রিয় সাদা গোলাপ।

বিকেলের প্রায় শেষ প্রহর। কাজ করতে করতে হাত মাটিতে যুথুবুথু হয়ে গেছে নাফিয়ার। ঠিক তখনই আরিভের বাইকের আওয়াজে লাফিয়ে উঠল। দ্রুত দৌঁড়ে গিয়ে কোনো রকম হাত ধুয়ে দরজায় দাঁড়ায়। কেন করল এই কাজটা ঠিক জানা নেই।

-“অপেক্ষায় ছিলে বুঝি?”

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জুতো খুলতে খুলতে হাসিমুখে প্রশ্ন করল আরিভ। নাফিয়া কাঁধে থাকা ব্যাগটা একহাতে টেনে নিল। আরিভ নাফিয়ার বাহু পেঁচিয়ে ধরে ভেতরে আসতে আসতে বলল,

-“গিন্নী হওয়ার প্র্যাকটিস চলছে? বাবা ফিরলেও মা এভাবেই দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতেন, ব্যাগ নিয়ে নিতেন।”

নাফিয়া মুচকি হাসে। মাথা নুয়ে বলল,

-“আমার এসব ভালো লাগছে, সবকিছু নতুন নতুন।”

আরিভ তার এই ছোট্ট বাক্যে প্রশান্তি পেল। নয়তো ভেবেই বসেছিল অল্প বয়সী মেয়ে। সংসার তার পছন্দ হবে তো? মানিয়ে নিতে পারবে তো? এই চিন্তাটুকু ঘুচিয়ে দিল নাফিয়া।

দূর থেকে শিরীন বেগমও দুজনকে দেখে নিশ্চিন্ত হলেন। শঙ্কা তার মনেও ছিল নাফিয়ার হাত নিয়ে। তবে মেয়েটিকে যত দেখছে অবাক হচ্ছে।

-“জানেন বাবা আমার জন্য গাছ এনেছেন। আমি আপনার ব্যালকনি লাগিয়েছি সেগুলো।”

ভেজা চুল মুছতে মুছতে থামল আরিভ। থমথমে দেখালো মুখটা। নাফিয়ার দিকে চেয়ে বলল,

-“আমার ব্যালকনি মানে?”

নাফিয়া হাত দিয়ে বাম দিকে ইঙ্গিত করে বলল,

-“এখানে।”

-“আমি জানি নাফি ব্যালকনি এখানে। তবে তুমি বলেছো আপনার ব্যালকনি।”

-“হ্যাঁ, আপনারইতো।”

আরিভ কি বোঝাতে চেয়েছে সেটা নাফিয়ার বোধগম্যতার বাহিরে। আরিভ সেই রুক্ষ মুখেই বিছানায় বসল। নাফিয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,

-“তোমার আর আমার আলাদা শব্দদুটো বেশ বেমানান। বিয়ে এমন একটা সম্পর্ক যেখানে ভিন্ন ভিন্ন দুজন একত্রিত হয়। এখানে উঁচু-নিচু, কম-বেশি, তোমার আমার বলে কিছু হয়না,নাফি। যা হয় আমাদের হয়। তুমি শব্দে ভুল করেছো। আপনার ব্যালকনি নয় আমাদের ব্যালকনি হতো।”

নাফিয়া হুট করেই চোখ নামাল। এ সম্পর্ক, এই নতুনত্ব উপভোগ করছে তবে এ বাড়িতে মানুষগুলো ছাড়া আর কিছুই কেন যেন নিজের মনে হচ্ছে না। ভাবনার সমুদ্রে ডুবে থাকা নাফিয়ার থুতনিতে স্পর্শ অনুভব করল। আরিভ তার সামনে দাঁড়িয়ে। নত গলায় প্রশ্ন করল,

-“মেনে নিতে পারছো না, তাইতো?”

নাফিয়া সঙ্গেসঙ্গে জবাব দিল,

-“তেমন নয়। আমি খুশি, ভীষণ খুশি। নতুন সবকিছু উপভোগ করছি। কিন্তু….”

-“কিন্তু?”

-“বুঝতে পারছি না। বিয়ে হুট করে হয়েছে, হুট করে আমার স্থান পরিবর্তন হয়েছে। কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূত হয় মাঝেমধ্যে। আকস্মিক সবকিছুর পরিবর্তন এই ভালোলাগাগুলোকেও কেমন যেন নিস্তেজ করে ফেলে।”

নাফিয়াকে বুকে টেনে নিল আরিভ। বুঝতে পারছে তার মনের অবস্থা। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

-“সময় লাগবে, বউ। সময়ের সাথে বুঝবে এটাই তোমার বাড়ি।”

-“ওটাও তো আমার বাড়ি।”

আরিভ মৃদু হাসল। বলল,

-“দুটোই তোমার বাড়ি। এক বাড়ির রাজকন্যা, অন্য বাড়ির রানী। তফাৎ এতটুকুই।”

-“বুঝেছি।”

আরিভ নাফিয়ার মুখের দিকে তাকাল। ঝুঁকে এসে নাকে নাক ঘষে দিয়ে শুধায়,

-“কি বুঝলে শুনি?”

-“বুঝলাম যে আমার দুটো বাড়ি আর আপনার একটা।”

বলে হেসে উঠল নাফিয়া। আরিভ কপাল কুঁচকে বলল,

-“ঐটা আমারও বাড়ি। ওই বাড়ির একমাত্র মেয়ের জামাই আমি, ভাব আছে একটা।”

বলেই পেছনে তাকাল আরিভ। সিদ্দিক সাহেব হন্তদন্ত হাতে জানালা বন্ধ করছেন। দাঁত দিয়ে জ্বিভে কামড় দিল আরিভ। এ আরেক মহা বিপদ! নাফিয়া দ্রুত সরে দাঁড়ায়। বাবা কি দেখে ফেলল তাদের এভাবে? যদি দেখে ফেলেন? কি ভাববেন? আরিভ দ্রুত গিয়ে পর্দা টেনে দেয়। ফিরে এসে বলে,

-“কি জ্বালা! বউকে হুটহাট জড়িয়ে ধরব সেটিও পারি না। আশপাশ দেখে তারপর আগ বাড়তে হয়।”

নাফিয়া এক কোণায় দাঁড়িয়ে বলল,

-“বাবা কি আমাদের এভাবে দেখে ফেলেছেন?”

-“কে জানে!”

-“যদি দেখে ফেলেন? আমিতো লজ্জায় চোখ মেলাতে পারব না বাবার সাথে।”

-“কেন? সে তার স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরেনা?”

ক্ষেপে গেল নাফিয়া। রেগে বলল,

-“একদম ফালতু কথা বলবেন না।”

-“ফালতু কোথায়? ভালো কথা বললাম।”

-“আপনি এত নির্লজ্জ কেন? শশুড় শাশুড়ির নামে এসব কী বলছেন?”

-“স্বামী স্ত্রী একে অপরকে জড়িয়ে ধরতেই পারে। নট এ বিগ ডিল।”

স্থান ত্যাগ করা উত্তম। নাফিয়া এক মুহুর্ত সময় অপচয় করল না। কোনো লেহাজ নেই লোকটার। যাতা বলে যাচ্ছে। বেরিয়ে যাওয়ার পূর্বে আরিভের রাক্ষসের মতো হাসির আওয়াজ যেন আরও গা জ্বালিয়ে দিল নাফিয়ার।

খাবার টেবিলে সবাই একত্রিত হয়েছে। আতাউর সাহেব বাড়িতে থাকলে একসাথে বসেই সন্ধ্যার নাস্তাটা করতে হয় বাধ্যতামূলকভাবে। আজও তাই। শিরীন বেগম গরম গরম ডাল পুরি করেছেন আর সাথে চা। আকাশ ডাকছে, এই মৌসুমে আতাউর সাহেবের ভাজাপোড়া খেতে চাওয়ার আবদার ফেলেননি শিরীন বেগম। নাফিয়া সেসব টেবিলে এনে রাখল। চায়ের কাপ আরিভের দিকে এগিয়ে দিতেই হুট করে আরিভ বলে উঠল,

-“তোমার ডান হাত দেখি?”

বুঝতে পারল না নাফিয়া। বাম হাত দিয়ে ডান হাত তুলে ধরল আরিভের সামনে। আরিভ চায়ের কাপ টেবলের উপর রেখে চিন্তিত গলায় বলল,

-“হাত কেটেছে কিভাবে?”

হাত কেটেছে শুনে শিরীন বেগমও খাবার টেবিলের সামনে এসে হাজির হলেন। হাত ধরে দেখতে লাগলেন। নাফিয়া বিস্মিত হয়ে চেয়ে আছে। হাত কেটেছে অথচ তার জানা নেই।

-“কি হলো জবাব দিচ্ছো না যে?”

আরিভের কথার জবাবে নাফিয়া অবুঝ ভঙ্গিতে বলল,

-“আমি.. আমি জানি না কীভাবে কেটেছে।”

-“আশ্চর্য নাফিয়া! কতখানি হাত কেটে গেছে তোমার কোনো হুশ নেই?”

নাফিয়া আরিভের উচ্চ স্বরে দৃষ্টি নুয়ে ফেলে। বলে,

-“কিভাবে হুশ থাকবে? আমিতো এই হাতে কিছু অনুভবই করতে পারিনা।”

আরিভ হাত টেনে ধরল। অনেকখানি হাত কেটেছে। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখল মাটি লেগে আছে সেখানটায়। তৎক্ষণাৎ নাফিয়ার দিকে চেয়ে বলল,

-“গাছের মাটিতে ধারালো কিছু ছিল?”

নাফিয়া মাথা দুলিয়ে জবাব দেয়, – “জানি না।”

আরিভের রাগ হলো এই বেখেয়ালিপনাতে। কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই শিরীন বেগম বললেন,

-“ভুল হয়ে গেছে। এখন এটা পরিষ্কার করে এন্টিসেপটিক লাগাতে হবে, নয়তো ইনফেকশন হয়ে যাবে।”

আরিভ বিনাবাক্যে উঠে গেল। ঘর থেকে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এসে কঠিন গলায় বলল,

-“সামনে বসো।”

নাফিয়া আরিভের মুখের দিকে তাকাল। রাগান্বিত দেখাচ্ছে। নাফিয়ার হাত টেনে দেখল ক্ষতটা। কেমন যেন কালচে হয়ে গেছে জায়গাটা। চিন্তা বাড়লো আরিভের। হাত পরিষ্কার করে এন্টিসেপটিক লাগিয়ে বলল,

-“কাল একবার ডাক্তারের কাছে দেখিয়ে আনব।”

নাফিয়া ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা শুনেই আতকে উঠল। যেতে চায় না সেখানে। বলে উঠে, -“ছোট্ট একটা আঘাতের জন্য কি দরকার…”

-“চুপ থাকো তুমি! নিজের যত্ন নিতে জানো না, আবার বেশি কথা। যা বলেছি তাই শেষ কথা।”

চলবে….