#বৈরী_বসন্ত ৩৫
লেখা – আয্যাহ সূচনা
কাঠফাটা রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরে আরিভ ঘেমে নেয়ে একাকার। সূর্যটা যেন ইচ্ছেকৃত তার মাথার উপরে এসে কষ্ট দিচ্ছে তাকে। কোনো গাছ নেই সেখানে, যে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়া যাবে। ঠাণ্ডা পানির বোতলটাও তাপে গরম হয়ে গেছে। কোনো রকম দুই ঢোক গিললো আরিভ।
বিগত চার ঘণ্টা যাবত নাফিয়ার ক্যাম্পাসের সামনে অপেক্ষায় আরিভ। পরীক্ষা চলছে নাফিয়ার। বিয়ে, অপারেশনের পর পড়ালেখাটা গোল্লায় যাচ্ছিল প্রায়। আরিভ ধরে-বেঁধে তাকে লাইনে এনেছে। নয়তো তার প্রিয়তমার উদ্দেশ্যে ছিল পড়ালেখা ছেড়ে গৃহিণী হওয়ার।
চার ঘণ্টা দশ মিনিট পর প্রিয় রমণীর দেখা মিলল শতশত নারীর ভিড়ে। এই মুখটাই আকর্ষণ করল বেশি। বিরক্ত মুখটা চোখ প্রশান্তিতে গ্রহণ করে হেসে ফেলে ঠোঁট। নাফিয়া এগিয়ে আসে। বাম হাতে থাকা ফাইলটা আরিভের হাতে একপ্রকার ছুঁড়ে দিয়ে কোমরে হাত রেখে বলল,
-“জানেন কত কষ্ট হয়েছে আমার! এত এত লিখা! তাও বাম হাতে। এর চেয়ে ভালো পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে আপনার জন্য মজার মজার রান্না করতাম।”
আরিভের প্রিয় কাজ নাফিয়ার চুল এলোমেলো করে দেওয়া। এবারও সেটিই করল। ক্লান্ত ঘামে ভেজা দেহ তুলে নাফিয়ার চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়। হাতে থাকা পানির বোতল এগিয়ে বলল,
-“মজার মজার রান্না অবশ্যই করবেন, ম্যাডাম। কিন্তু সেটা গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে।”
-“করব না।” জেদি গলায় বলল নাফিয়া।
-“আপনি করবেন, আপনার ঘাড়ও করবে।”
-“আপনি নিজের ঘাড়কে দিয়ে করিয়ে নিন।”
-“আমার ঘাড় একবার গ্র্যাজুয়েশন করেছে।”
নাফিয়া এগিয়ে এল। মেয়েটার স্বভাবতই লজ্জা কম। আরিভের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে শার্টটা হাতের মুঠোয় নিয়েছে। আদুরে ভঙ্গিতে বলল,
-“আমি ছোটবেলা থেকেই মায়ের ওড়না পেঁচিয়ে শাড়ি পরতাম, বউ সেজে ঘুরে বেড়াতাম। রান্নার অভিনয় করতাম কোমরে আঁচল গুঁজে। পড়ালেখার প্রতি আমার তখনও ইন্টারেস্ট ছিল না। আমি গৃহিণী হয়ে পুরো ঘর সামলাতে চাই। আপনার সেবা করতে চাই, দিবেন না স্বামীর সেবা করতে?”
ঢং দেখে ভীষণ হাসি পাচ্ছে আরিভের। কিন্তু হাসলেই নাফিয়া চেপে ধরবে। কথা মানিয়ে ছাড়বে। আরিভ নাফিয়ার মাথায় হালকা গাট্টা মেরে বলল,
-“জি না। অত সেবা করা লাগবে না। আপনি আগে পড়ালেখা শেষ করুন।”
ক্ষেপে গেল নাফিয়া। লোকটা কি বুঝে না পড়ালেখা তাকে দিয়ে হবে না? মুখটা ছোট্ট করে অন্যদিকে ফিরে রইল। আরিভ পানির বোতল থেকে সামান্য পানি হাতে নেয়। সেটি নাফিয়ার মাথায় আচমকা ঢেলে দিল। পরিমাণ সামান্য পুরোপুরি ভিজেনি। নাফিয়া চেঁচিয়ে বলল,
-“এটা কি করলেন!”
-“মাথা গরম বউয়ের মাথা ঠাণ্ডা করলাম।”
নাফিয়া কিছু বলতেই যাচ্ছিল। তার আগে থেমে গেল। চোখ গেল আরিভের শার্টের দিকে। ঘেমে গায়ের সাথে লেগে আছে শার্টটা। চুল দাড়ির নাজেহাল অবস্থা, সেগুলো লেপ্টে আছে কপাল ও মুখে। রাগটুকু মায়ায় রূপান্তরিত হল। তবুও রাগের ছাপ গেল না মুখ থেকে। বলল,
-“কি অবস্থা করেছেন নিজের? কে বলেছিল এতক্ষণ বসে থাকতে?”
-“কয়েকজন এসে বলে গেছে, আরিভ তোর অপেক্ষা করা উচিৎ।”
-“তারা কারা?”
আরিভ পকেট থেকে রুমাল বের করে নাফিয়ার কপালের ঘাম মুছে দিতে দিতে বলল,
-“তারা হল বউয়ের প্রতি প্রেম, ভালোবাসা, মোহ, মায়া, আকর্ষণ।”
-“কি অদ্ভুত কথাবার্তা!”
-“আমি মানুষটাই অদ্ভুত।”
-“জীবনে প্রথমবার সত্য বলেছেন।”
বাইকের এক কোণে রাখা চারটে গোলাপ। লাল, সাদা, হলুদ আর হালকা গোলাপি। এগিয়ে দিল প্রিয়তমার হাতে। বলল,
-“আমার গোলাপের জন্য চার রঙের গোলাপ।”
নাফিয়া হাসি মুখে গ্রহণ করল। ঘ্রাণ শুঁকে বলল,
-“কিছুদিন আগে না দোলনচাঁপা ছিলাম?”
-“মৌসুমের পরিবর্তনে ভালোবাসার রং বদলায়।”
-“বদলে যায়?”
-“বদলে যায় কিন্তু শেষ হয়না। নতুন নতুন রঙে নিজেকে উজ্জীবিত করে, নতুন অনুভূতির জন্ম দেয়।”
-“এখন কি রঙের মৌসুম চলে, জনাব?”
আরিভ চোখ দিয়ে ইশারা করল নাফিয়ার হাতে থাকা গোলাপগুলোর দিকে। ইশারা খুবই সহজ। তারপরও স্পষ্ট করতে আরিভ বলল,
-“আপনার হাতে যে রঙের গোলাপ, সে রঙের মৌসুম চলছে।”
নাফিয়ার কাউন্সেলিং চলছে বিগত তিনমাস যাবত। সেখানে যেতেও নারাজ মেয়েটি। তার মতে সে ঠিক আছে, সুস্থ আছে। কিন্তু ডাক্তারের মতে তার এই মুহূর্তে প্রয়োজন মানসিক সাপোর্ট। তার মস্তিষ্কে চাইল্ডহুড ট্রমা কিছু অংশে রয়ে গেছে। পরপর দু’বার বিশাল ধাক্কা খাওয়ার পর নিজের দুশ্চিন্তাগুলোকে ভুলে থাকার চেষ্টা করছে সে। যখনই মাথায় অকেজ হাত আর অপারেশনের কথা আসে তখনই দূরে ঠেলে দেয় সে। হারিয়ে আপন মানুষগুলোর আড়ালে।
-“আপনার মতে আমি পাগল?”
-“হ্যাঁ।” দুষ্টুমির সুরে বলল আরিভ।
বাইকে বসেই আরিভের পিঠে খামচি দিয়ে নাফিয়া বলে,
-“আমি মানসিকভাবে সুস্থ, তাহলে কাউন্সেলিং এর কি দরকার?”
হুট করেই বাইক একপাশে নেয় আরিভ। বাইক এর গতি মধ্যম করে বলল,
-“সমস্যা থেকে দূরে পালানো আর মেনে নেওয়ার মধ্যে তফাৎ আছে নাফি। তুমি মেনে নিতে চাইছো না, দূরে পালাতে চাইছো।”
-“মেনে নিচ্ছি তো।”
-“উহু! তুমি পাগল নও, তোমার মধ্যে এক মানসিক অস্থিরতা আছে। আমি চাইছি তোমাকে সেখান থেকে বের করে আনতে।”
-“আপনি একটা ডমিনেটিং হাসবেন্ড জানেন। আমাকে জোর জবরদস্তি পড়ালেখা করাচ্ছেন সাথে কাউন্সেলিং। আমি আমার বাচ্চাদের শেখাব তোমাদের বাবা একজন বাজে লোক।”
রাস্তার কোণ ঘেঁষেই চলছিল বাইকটি। অকস্মাৎ থেমে গেল। আরিভ হেলমেট খুলে পেছনে তাকাল। বলল,
-“বাচ্চাদের?”
-“হ্যাঁ, তো?”
-“তুমি বাচ্চাকাচ্চাও প্ল্যান করেছো?”
-“তো করব না? আমরা দুজন একা থাকব নাকি? আমি আমার ঘরভর্তি বাচ্চাকাচ্চা চাই।”
-“তোমার এ কথা বলতে একদমই লজ্জা লাগছে না?”
-“না।”
কাটকাট জবাব দিল নাফিয়া। তবে মুখখানা অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলেছে। নিজের কথায় নিজে ফেঁসে যায় মাঝেমধ্যে। এবার আরিভ লজ্জা দিবে। আরিভ হেসে পুনরায় মাথায় হেলমেট পরে বলল,
-“একা একা বাচ্চার স্বপ্ন দেখছেন অথচ বাচ্চার বাবাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করেননি।”
-“আপনাকে বলা আর না বলা একই কথা।”
-“আমার অংশীদারিত্ব ছাড়া আপনার বাচ্চারা আসবে কি করে শুনি?”
নাফিয়া ভালোমতই জানতো এমন কিছু হবে। এবার আরিভ নয় নিজের প্রতি রাগ হচ্ছে। নিজেকে ঠোঁটকাটা মনে হল। নাফিয়া কোনো জবাব দিল না। আরিভ বাইক স্টার্ট করে বলল,
-“বলো? আমাকে ছাড়া সম্ভব?”
নাফিয়া ধমকের সুরে জবাব দেয়,
-“চুপচাপ বাইক চালান। বেশি কথা বলবেন না।”
______
বাইকটা বাড়ির সামনে আসতেই দেখা মিলল সাদিফের। ভাবভঙ্গি সম্পূর্ণ আসামীর মতো। তার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে নোহা। চোখ দিয়ে বোকাসোকা ছেলেটাকে শাসাচ্ছে। আরিভ নাফিয়া এ দৃশ্য দেখে এগিয়ে গেল। আরিভ সরাসরি সাদিফের মাথায় চাপড় মেরে প্রশ্ন ছুড়লো,
-“কি করেছিস? চেহারার মধ্যেই একটা চোর চোর ভাব।”
বিরক্তির সহিত তাকাল সাদিফ। কিন্তু একটি শব্দ উচ্চারণ করল না। এমনিতেই বলির পাঠা সে। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে জোহান হাজির। এমন থমথমে পরিবেশ দেখে কিছু প্রশ্ন করতে যাবে ঠিক তখনই নোহা বলল,
-“এই বাচাল ছেলে, মুখ দিয়ে কথা বের করবি না। চুপচাপ দাঁড়া, তোর ভাইয়ের প্রেমের ভূত ঝারছি আমি।”
জোহান থামলো না। বরং বলেই বসল, -“আপনি কি ওঝা?”
আরিভ জোহানের গোলা পেঁচিয়ে ধরে বলল, – “চুপচাপ সিনেমা দেখ। এত প্রশ্ন করিস কেন?”
সেখানে নীরব দর্শক নাফিয়া। মনে শঙ্কা, নোহা আপু জেনে গেল নাতো? নাফিয়াই তার ননদের সাথে সাদিফের পরিচয় করিয়েছে মাসখানেক আগে। ঢোক গিলে নাফিয়া। নোহা বলল,
-“এখনও গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করিসনি, এখনই মনে প্রেমের দোলা? এক থাপ্পড়ে নামাবো প্রেমের ভূত।”
সাদিফ মুখ খুলল,- “আপু আমি সত্যিই ওকে ভালোবাসি।”
আরও রাগ হলো নোহা। বলল,- “নিজের পায়ে দাঁড়া আগে। ততদিন অব্দি কোনো কথা নেই।”
-“তোমরা অপেক্ষা করবে ততদিন? তাহলে আমি হার্ড ওয়ার্ক করব। নিজের পায়ে দাঁড়াবো। এসো ডিল করি।”
ডিল করার জন্য হাত এগোতেই থাপ্পড় উপহার পেল। গালে হাত রেখে নোহার দিকে চেয়ে আছে সাদিফ। নোহা বলল,
-“এক বছর সময় দিলাম। পড়ালেখার পাশাপাশি জব করতে হবে। নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। তোকে ছোটবেলা থেকে চিনি বিধায় সুযোগ দিচ্ছি। নাহয় এখনই ঝাটা পেটা করতাম। যা ভাগ!”
সিদ্দিক সাহেব হাজির হলেন তাদের মধ্যে। আজ নাফিয়ার পরীক্ষা শেষ। মেয়েকে নিতেই আরিভদের বাড়ির দিকে আগাচ্ছিলেন। থামলেন তাদের বাহিরে দেখেই। এগিয়ে এসে বললেন,
-“ভালোই হল এখানে দেখা হয়ে গেল। তোমাদের বাড়িতেই যাচ্ছিলাম।”
-“আসসালামু আলাইকুম, বাবা।” আরিভ সিদ্দিক সাহেবকে সালাম জানালো হাসিমুখেই।
সিদ্দিক সাহেব বললেন, -“আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি কিছুদিনের জন্য আমার কাছে। পরীক্ষা শেষ, কিছুদিন বাবার কাছে থাকুক নাহয়।”
আরিভের মুখের রোশনি ধপ করেই নিভে গেল যেন। পরীক্ষার কারণে নাফিয়াকে নিজের কাছ থেকে দূরে রেখেছে, শাসনে রেখেছে। আজই ভেবেছিল বউকে আদর যত্নে কাছে টেনে নিবে। সে সুযোগটা এইমাত্র হাতছাড়া হয়ে গেল যেন।
-“এসো, মা। তুমিও এসো আরিভ।”
নাফিয়া সরাসরি গিয়ে সিদ্দিক সাহেবের পাশে দাঁড়িয়েছে। আরিভ বিরস মুখে বলে,
-“আসবো বাবা কিন্তু এখন না।”
-“ঠিক আছে তাহলে আমি নাফিকে নিয়ে যাচ্ছি। তোমার যখন ইচ্ছে চলে আসবে।”
আরিভ মাথা দোলালো মধ্যম গতিতে। নাফিয়ার দিকে তাকাতেই মুখ আরও বেজার হয়ে গেল। ভীষণ খুশি সে। ঢ্যাং-ঢ্যাং করে বাবার সাথে হাঁটা দিয়েছে। যাওয়ার পথে পিছু ফিরল। আরিভের চেয়ে মুখ ভেংচি কেটে আবার সামনের দিকে চেয়ে হাঁটা শুরু করে।
ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই জমিলা বেগমের মুখোমুখি হয় নাফিয়া। মহিলাটি আজকাল অদ্ভুতরকমের নীরব। আগে নাফিয়াকে দেখলে কটু কথা শোনাতে পিছুপা হতো না। আর এখন? যথাসম্ভব এড়িয়ে যায়। মুখ গোমড়া করে রাখে।
-“দাদী..”
-“তোর লগে কথা কইতে চাই না আমি। এই পরিবার, ওই পরিবাররে নিজের বশে আইনা রাখছোস, যে কোনো সময় আমারে ঘরছাড়া করবি।”
নাফিয়া বুঝল বিষয়টি। সে আর নাফিয়ার সাথে কোনো প্রকার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে চান না। মনের মাঝে হয়তো বুড়ো বয়সে ঘরছাড়া হওয়ার ভয় জেগেছে। নাফিয়া শান্ত স্বরে বলে উঠল,
-“আপনাকে কেউ ঘরছাড়া করবে না, দাদী। আপনি এই বাড়ির বুজুর্গ। আপনার অধিকার সবচেয়ে বেশি।”
______________
তুমুল বৃষ্টি নেমেছে শহরজুড়ে। যেন আকাশের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে সবটুকু ঢেলে দিচ্ছে জমিনে। আকাশ চিরে বিদ্যুতের সরু ঝলকানি অম্বরের ক্রোধের প্রকাশ ঘটাচ্ছে বারবার। এদিকে জমিনের মানুষজন ছুটোছুটি করতে লাগলো আশ্রয় খুঁজে পেতে। কেউ স্বেচ্ছায় ভিজছে, আবার কেউ বাধ্য হয়ে।
ভিজে একাকার শরীরে ত্যক্তবিরক্ত মুখে ঘরে ফিরল আরিভ। অফিসের জরুরি ফাইলগুলো এই বৃষ্টির হাতে অক্ষত আছে কি না কে জানে? বাবা-মা কেউ বাসায় নেই, নাফিয়াও নয়। অগত্যা পকেট থেকে বাড়তি চাবিটা বের করে দরজা খুলল।
ভেতরে ঢুকতেই চোখের সামনে ভেসে উঠে আঁধার। আলোহীন ঘরে হঠাৎই মস্তিষ্কে আঘাত হানল এক অচেনা, অথচ অদ্ভুত মিষ্টি ঘ্রাণ।
নিজেই বিড়বিড় করল, -“ঘ্রাণ?”
ঠিক সেই সময় বজ্রের আওয়াজের সাথে তাল মিলিয়ে অপেরা মিউজিক বেজে উঠে। আরিভের চোখজোড়া সঙ্গে সঙ্গে কপালে উঠল। ঘর থেকেই আসছে এই আওয়াজ। আরিভ হন্তদন্ত হয়ে এগোলো। কোথা থেকে আসছে এই আওয়াজ জানতে। অপেরা মিউজিক তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে যায়। আরিভের কদমজোড়া থামল। এবার মিউজিকের পরিবর্তে ভাসল নূপুরের ধ্বনি। না চাইতেও আরিভের মনে ভয় কাজ করতে শুরু করে। হাতড়ে লাইট অন করতে চাইল। বারবার সুইচ চেপেও কোনো বাতি জ্বললো না ঘরে।
নূপুরের আওয়াজ ততক্ষণে থেমে গেছে। আরিভ ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালানোর চেষ্টা করল ভেজা হাতে। আকস্মিক সাফোকেশন শুরু হয়েছে অন্ধকারে। তার মাঝে এই ঘ্রাণ। পাশেই রান্নাঘর, আরিভ সেখানেই এগিয়ে গেল। মোম খুঁজতে হবে। এগোলো আর কই? খট করে আওয়াজ ভেসে উঠল তার রুম থেকে। যেন কোনো কাঁচের জিনিস জমিনে পড়েছে। এবার আর থামল না দ্রুত পায়ে ঘরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সাথেই চিৎকার করে পেছনে হেলে পরে আরিভ। জমিনে পড়ে যেতে নিচ্ছিলো। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় হাত আটকে নিজেকে সামলায়। ফোনটা জমিনে পড়ে গেছে।
সামনেই সাদা শাড়ি পড়ে চুলগুলো সামনে এনে ভূত সেজে দাঁড়িয়ে আছে এক নারী। আরিভ বুকে হাত রেখে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। সাদা শাড়ি পরিহিত নারীটি এগিয়ে এল। আরিভের শার্টের কলারে হাত রেখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলল,
-“কি খবর মিস্টার আরিভ ইনতিশার? অল গুড?”
আরিভ কম্পিত কন্ঠে বলে,- “ন.. নাফি।”
সামনের মানুষটি ক্ষেপে গেল। হাত মুখ ভর্তি সাদা আস্তরণ। আরিভের কলার চেপে বলল,
-“নাফি আবার কে? দেড়শ বছর যাবত এখানে আমার আত্মা ঘুরঘুর করছে। তোমরা আমার আস্তানায় বাড়ি করেছো? যাক! ক্ষমা করলাম। এখন তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। চলো বিয়ে করব। নাফি টাফি বাদ।”
আরিভের অজ্ঞান হওয়ার উপক্রম। ফোন জমিনে পড়ে আধমরা অবস্থা। লাইট জ্বলছে নিভছে। সামনের মানুষটি কন্ঠ ভারী অদ্ভুত। গলা দিয়ে কোনো কথা বেরোলো না। আশপাশের পরিবেশ ভীষণ ভূতুড়ে।
-“আ…”
-“চুপ!”
ধমকে উঠে ভারী আওয়াজে। এসেই গলা পেঁচিয়ে ধরল একহাতে। বুকে মাথা রেখে বলল,
-“চলো পালিয়ে যাই। তোমাকে মানুষদের দুনিয়াতে মানাচ্ছে না। তোমার মত সুদর্শন পুরুষকে ভূত সমাজে মানাবে।”
কন্ঠ স্বাভাবিক এবার। আরিভের মস্তিষ্ক জ্বলে উঠল। বুকের ধড়ফড়ানি কমে আসে। তাকে সায় দিয়ে ইলেকট্রিসিটিও ফিরে এসেছে। পুরো ঘরে আলো জ্বলে উঠল। আরিভ মুখ নামায়। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বুঝতে পেরে চেঁচিয়ে উঠল,
-“নাফির বাচ্চা!”
দুহাতে বাহু চেপে নাফিকে বুক থেকে আলাদা করল। মুখের দিকে তাকাতেই চক্ষু চড়কগাছ। মুখে মাখা এক গাদা পাউডার, হাতটাও বাদ রাখেনি। সাদা শাড়ি পরে মুখের সামনে চুল এনে এলোমেলো করে রেখেছে। আরিভের চোখে চোখ পড়তেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল নাফিয়া। হাসতে হাসতে পেছনের হেলে যায়।
-“কেমন দেখাচ্ছে আমাকে? সুন্দর না?”
-“তুলে একটা আছাড় দিব বেয়াদব মেয়ে!”
ঘর কাঁপিয়ে ধমকে উঠল আরিভ। তাকে তিল পরিমাণও ভয় দেখা গেল নাফিয়ার মধ্যে। সে হেসেই যাচ্ছে। ভূতুড়ে মুখেই ভেংচি কেটে বলল,
-“ভীতুর ডিম!”
রেগে আছে আরিভ। এতদিন বাপের বাড়ি গিয়ে পড়ে ছিল। স্বামীর কোনো খোঁজ খবর অব্দি নেয়নি। আর আজ এই কাণ্ড ঘটালো। আরিভ মুখ কুঁচকে এড়িয়ে গেল। পরনের ভেজা শার্ট খুলতে লাগল অন্যপাশে ঘুরে।
-“এই আপনি বললেন না আমাকে কেমন লাগছে?”
-“রাক্ষসীর মত লাগছে।” রুষ্ট গলায় জবাব দিল আরিভ।
-“আমাকে তো রাক্ষসীর মত লাগবেই। ভালো লাগবে শুধু অফিসের সুন্দরী কলিগদের। ভালো টালো তো বাসেন না। নাহয় ভূতনী লুকেও সুন্দর লাগত আমাকে।”
আরিভ পাত্তা দিল না। শার্ট খুলে ছুঁড়ে ফেলল জমিনে। নাফিয়া তার সামনে এসে দাঁড়ায়। আঙুল দিয়ে ফ্লোরে পড়ে থাকা শার্ট দেখিয়ে বলল,
-“এটা আপনি উঠাবেন। উঠিয়ে বিনে রাখবেন।”
-“এটা এখানেই পড়ে থাকবে।”
-“আমি বলেছি এটা বিনে যাবে।”
আরিভ আবারও কোনো তোয়াক্কা না করে ড্রয়ার থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। নাফিয়া তার পিছু নেয়। ওয়াশরুমে এর বাতি নিভিয়ে দরজা আটকে দিয়ে বলল,
-“বউয়ের সামনে বাড়াবাড়ি করবেন না বলে দিচ্ছি।”
ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে আরিভের। রাশভারী কন্ঠে বলে উঠে,
-“লাইট জ্বালাও।”
-“আগে বলুন কথা শুনবেন কিনা?”
আপাতত কোনো উপায় নেই। মিথ্যা বলে হলেও কাজ উদ্ধার করতে হবে। তাই বলল,
-“শুনব।”
-“এইতো গুড বয়।”
বাহির থেকে বিশ্রী হাসির আওয়াজ ভাসছে। ওয়াশরুমের লাইট জ্বলে উঠেছে। বাহির থেকে ছিটকিনি খোলার আওয়াজও পাওয়া গেল। আরিভ শাওয়ার চালিয়ে বিড়বিড় করল,
-“হাড়ে বজ্জাত একটা মেয়ে বিয়ে করেছি।”
গোসল সেরে বেরিয়ে দেখল নাফিকে। বিছানায় পা দুলিয়ে তখনও হেসে যাচ্ছে। দেখেই পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে আরিভের। চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে গেলো নাফিয়ার দিকে। বাহু টেনে দাঁড় করিয়ে দিল। দুহাতে কোমর পেঁচিয়ে কাছে টেনে নিল। উচ্চতার তারতম্য দেখা দিল। আরিভ শক্তি প্রয়োগ করে তাকে কিছুটা উঁচুতে তুলে নিয়ে বলল,
-“খুব হাসি পাচ্ছে তাই না?”
নাফিয়ার মুখ ভঙ্গি বদলে গেছে। আরিভের সিক্ত মুখখানা বেজায় আকৃষ্ট করল। চুলগুলো কপালে পুরোপুরি লেপ্টে আছে। দাড়িগুলো সম্পূর্ণ নেতিয়ে। আপনাআপনি মুখ ফুটে বলে উঠল,
-“আপনাকে দারুন লাগছে….”
আরিভ না চাইতেও ম্লান হেসে উঠে। ভেজা গাল এগিয়ে নাফিয়ার পাউডার মাখা গালে ঘষে দিল আলতো করে। সদ্য গোসল করার ফলে হাতটাও ভেজা। এক হাত তুলে মুখটা ভালোভাবে মুছে দিয়ে বলল,
-“এবার আপনাকেও দারুন লাগছে। স্পেশালি শাড়িতে। ঠিক যেমন আপনাকে স্বপ্নে দেখেছি…”
গভীর নেত্রদ্বয় আকস্মিক ঝংকার তুলে। চোখ নত করে হাসলো নাফিয়া। আরিভ বলল,
-“আজ থেকে বাবার বাড়ি যাওয়া বন্ধ। গেলেও রাতে থাকতে পারবে না।”
-“এটা তো অন্যায়।”
-“এতশত কথা আমি বুঝি না। তোমার থেকে দূরে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব।”
-“আমার পক্ষে বুঝি সম্ভব?”
-“তাহলে এক সপ্তাহ যাবত বাবার বাড়ি গিয়ে পড়ে ছিলে কেন?”
-“আপনাকে শায়েস্তা করার জন্য।”
আরিভের মুখাবয়ব পরিবর্তন হল। আরও শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরলো নাফিয়াকে নিজের সাথে। দৃষ্টি এতটাই প্রখর যে তাকানোই গেল না তার চোখের দিকে। নেশাতুর চোখজোড়া তাকে গ্রাস করতে শুরু করবে এক্ষুনি। নিজেকে সামলানোর সব পথ হারাবে। কোমরে হিমশীতল হাতের বিচরণ আড়ষ্ট করতে করছে নাফিয়াকে। কেঁপে উঠতে লাগল নরম দেহটি বারেবারে।
-“এবার আমি শায়েস্তা করি?”
ঘাড়ে শীতল স্পর্শ অনুভব করে নাফিয়া। গলা দিয়ে বিপরীতে কোনো শব্দ বেরোলো না। বরফের ন্যায় জমে রইল প্রিয় পুরুষের আচ্ছাদনে।
আরিভ বলল, -“বলো করব শায়েস্তা? আমার শায়েস্তার ধরন একটু ভিন্ন হবে।”
নিজের পায়ে যেন নিজেই কুড়াল মেরেছে নাফিয়া। ভয় দেখিয়ে বিপদ ডেকে এনেছে। আচমকা শূন্যে ভাসল সে। কিছু বোঝার পূর্বেই পিঠ ঠেকে নরম তুলতুলে শয্যায়।
-“আপনার অনাগত বাচ্চাদের বাবা আজ ভীষণ পাগলাটে আচরণ করতে পারে। আশা করি সামলে নিবেন। তাদের মা উড়নচণ্ডী হয়েছে ভীষণ, বাগে না আনলে বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।”
সমাপ্ত~