তোমার ছোঁয়ায় বসন্তের গন্ধ পর্ব-০৪

0
1

#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
৪.
রিভারভিউ রেস্টুরেন্টে তিন বন্ধু বসেছে আড্ডায়। খোলা ছাদে আকাশের নিচে মুক্ত মৃদু বাতাসে কথপোকথন চলছে তাঁদের। জনির মুখ ভার। বেশ করুন অবস্থা যেন তার মুখশ্রীর। মেশকাত বিরক্ত নিয়ে কফিতে চুমুক বসিয়ে ভারী গলায় জানতে চাইলো,
‘তোদের মধ্যকার সম্পর্ক এখনো কি স্বাভাবিক হয়নি জনি?’
জনি অসহায় চোখে তাকালো। মৃদু শ্বাস নিয়ে বলল,
‘না। নীলিমা আমায় টর্চার করে। সংসার জীবনে আমি বিরক্ত।’
‘সংসার? নাকি নীলিমার উপর বিরক্ত?’ ফের জানতে চাইলো জনি।
‘দু’টোই।’
‘এখনো বাচ্চাকাচ্চা হয়নি, এর আগেই বিরক্ত।’
‘বাচ্চা হলে, মায়ের সঙ্গে তারাও আমাকে টর্চার করবে।’
‘সামান্য মেয়ে মানুষকে কন্ট্রোলে আনতে পারছিস না, তুই আদৌও পুরুষ?’ ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে শুধালো রায়ান।
জনি খেঁকিয়ে উঠল,
‘পাঁচ বছর আগে ঐ মেয়েকে যদি ঠিকিই ঘরে উঠাতি না। তাহলে আমার স্থান থেকে উপহাস্য করতি না।’ জনির তেতে উঠা কথাটায় রায়ান ভাবতে বসল। সেই মেয়েটির কথা সে প্রায় ভুলেই গিয়েছে। মেয়েটার কান্নারত আদল ব্যতীত আর তেমন কিছুই মনে নেই তার। বহু কল্পনায় এক ঝলক মুখশ্রী মনে করতে পারল মেয়েটার। তখনই মেশকাত বলে,
‘মেয়েটার নাম কি ছিল? ওর বান্ধবীর নাম ছিল ফারিন।’
চৈতন্য ফিরলো রায়ানের। জানায়,
‘আই ডোন্ট নো।’
‘জিজ্ঞেস করিস নি?’
‘প্রয়োজন বোধ করিনি।’ কাঠিন্য আচরণের স্বরে বলল।
‘ফারিনকে শহীদ নগরের কাছাকাছি নামিয়ে দেবার পর আর দেখা হয়নি। গাড়ীতে বসে অনেক প্রশ্ন করেছি। কোনো প্রকার উত্তরও সে দেয়নি।’
‘দু’ই বান্ধবী খুব কড়াকড়ি ছিল।’ জনি সরস কণ্ঠে বলল।
‘পরিশেষে হার মানতে হলো তাদের।’ চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল রায়ান।
‘মেয়ে দু’টির খোঁজ নেয়া উচিত ছিল। তোর কাজটা ঠিক হয়নি রায়ান।’ অপরাধী গলায় শুধালো জনি।
‘যেটা করতে এসেছিল? সেটা?’ ভারী কণ্ঠে প্রশ্ন রায়ানের।
‘তুই নীলিমাকে হারাতি চিরতরে।’
‘আমি তবুও বলব, ঠিক হয়নি।’
‘অন্য মেয়েকে নিয়ে গসিব কেন করছি আমরা? পাস্ট ইজ পাস্ট।’ রায়ান ঈষৎ রাগী গলায়ই বলল।
দুই বন্ধু থেমে গেল। টপিক পাল্টে ব্যাবসায়ীক কর্মের কথনে আলোচনায় মশগুল হলো। জনি বিবাহিত হলেও। রায়ান ও মেশকাত এখনো বিয়ে করেনি। সামনের সপ্তাহে মেশকাতের বিয়ে ঠিক হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ পারিবারিক ভাবে। প্রেমের বিয়েতে ঘোর আপত্তি তার।
__
বেশ আনন্দ নিয়ে সন্ধ্যার একটু আগে বাড়ীতে প্রবেশ করল তন্নি। হাতে তার গোলাপ ফুলের তোড়া ও চকলেট রয়েছে। অনুমান করা যায় সেগুলো তার প্রেমিক উপহার সরূপ দিয়েছে তাকে। সবগুলো রাহার হাতে তুলে দিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে জানাল,
‘সব তোর জন্য।’
‘তোর বয়ফ্রেন্ডের দেয়া জিনিস আমি কেন নিবো?’
‘আমি দিয়েছি বলেই তুই নিবি। আজ অনেক ঘুরেছি, খেয়েছি। এগুলো তোর জন্য দিয়েছে।’
‘ফুলও?’
‘এটা আমি তোকে দিলাম।’
‘রেখে দে।’ হালকা মলিন কণ্ঠে শুধায়।
তন্নি রাহার মুখশ্রীর পানে চেয়ে নৈঃশব্দে নিশ্বাস ফেলল। একটা ভয়ংকর অতীত মানুষের জীবনকে নষ্ট করে দেবার জন্য যথেষ্ট। সেদিনের পর থেকে হাস্যকর মুখশ্রী কোথায় যেন মিলে গেছে রাহার। প্রতিটা মুহূর্ত অতিবাহিত হয় বিক্ষিপ্ত মানসিক যন্ত্রণায়। রাতের নিদ্রা পর্যন্ত ঔষুধের সাহায্যে পূরণ করতে হতো। তন্নি পাশে বসল রাহার। মনোযোগ দিয়ে ফুলের তোড়া দেখতে ব্যস্ত ছিল রাহা। হঠাৎ পাশে বসায় রাহা অনুমান করতে পেরে টপিক দ্রুত পরিবর্তন করার জন্য কিছু বলতে উদ্যোত হতেই তন্নি কোমল গলায় শুধায়,
‘নামটা বল বোন।’
‘ফেলে আসা অতীতকে টেনে আমায় পীড়িত করতে চাইছিস?’
‘কক্ষণো ফেলতে পারিসনি। সর্বক্ষণ তোকে তাড়া করে বেড়ায়। একটি বার বল ঐ জালিমের নাম।’
রাহা ফুলের তোড়া তন্নির কোলে দিয়ে দ্রুই প্রস্থান করল রুম থেকে। ড্রইংরুমে খালাকে দেখে ছাদে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। দরজা খুলে বেরোতেই আরানের মুখোমুখি হলো। ‘বিরক্ত হবার জন্য তারই কমতি ছিল।’ মনে মনে কথাগুলো আওড়িয়ে বড়ো নিশ্বাস টেনে হাঁটতে নিলে পিছু নেয় আরান। মুচকি হাসি মুখে ফুটিয়ে বলল,
‘আমায় মিস করছিলে?’
‘খুব।’ ব্যঙ্গ করে বলে।
‘এই দেখো তোমার কাছেই আছি।’
‘তোর কাজ নেই?’
‘তুমিই তো আমার একমাত্র কাজ।’
‘নাটক কম।’
‘এভাবে বলে না জান।’
রাহা চোখ পাকিয়ে তাকাতেই আরান কাচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,
‘আমার রূহ পাখি বের করার জন্য তোমার ঐ চাহনিই যথেষ্ট।’
‘এখান থেকে যা, আমার পিছু নিস না।’ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে জানাল।
‘আচ্ছা একটা কথা বলো। আমি তোমায় যতটা গুরুত্ব দেই, মান্য করি, লাভ মানে এত লাইক করি। এরকম কেউ তোমাকে কখনো দিয়েছে এসব?’
‘আমার প্রয়োজনও নেই।’
‘আছে। আজ তুমি আমায় অবহেলা করছো। এক সময় ঠিক মিস করবে। সেদিন আমি থাকব না। বুঝবে তুমি, খুঁজবে।’ বড়ো নিশ্বাস ফেলে সাহিত্যিক কবিদের মতো টেনেটুনে বলল।
‘পুঁছবো।’
‘কী পুঁছবে?’
‘আশেপাশের দেয়ালে তোর নামগুলো লিখেছিস না। সেগুলো পুঁছব।’ আঙুল দিয়ে চারদিক দেখিয়ে বলল রাহা। আরান মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে গেল। বড়ো বড়ো পা ফেলে দ্রুতই ছাদে এসে রেলিঙের কাছাকাছি দাঁড়াল। সূর্য ডোবার আকাশ ডিমের কুসুমের ন্যায় রং ধারণ করেছে। মৃদু হালকা আলোর ঝলক রাহার মুখশ্রীতে লেগে লুটোপুটি খাচ্ছে।
সন্ধ্যার আকাশ রাহার খুব প্রিয়। খুব ভিন্ন চিত্রের দেখা মিলে আকাশের।
আরান এসে রাহাকে ফের জ্বালাতন করার পূর্বেই তন্নি এসে উপস্থিত হয়।
‘হেই আরাম। তোকেই প্রয়োজন আমার।’ আরানের উদ্দেশ্য বলতে বলতে এগোয় তন্নি। আদল রাগে ঘুচে এলো আরানের। প্রত্যেকবার তন্নি আরানকে আরাম বলে ক্ষেপায়। এতে তার প্রচণ্ড রাগ হলেও ভদ্রতার খাতিরে চুপ থাকে। ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে তন্নির পানে চেয়ে বলল,
‘জি বলুন বড়ো আপু।’
‘আমার এখন আরাম প্রয়োজন। এখান থেকে যাহ!’
আরানের মুখশ্রী ক্রুদ্ধ। নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে সরস কণ্ঠে শুধালো,
‘যেতেই কেন হবে? আরানকে তো আরামের জন্যই প্রয়োজন তাই না?’
‘তবুও যাবি তুই।’
সময় বিলম্ব না করে আরান দ্রুতই প্রস্থান করল। প্রতিবার তন্নির সঙ্গে দেখা হলে এরূপ আচরণ করেই তাড়িয়ে দেয়। তন্নির এই আচরণে আরানের বিরক্তের শেষ নেই।
‘তোকে ডিস্টার্ব করবে দেখেই ভাগিয়ে দিলাম।’
রাহা তন্নির পানে চেয়ে ম্লান হেসে ফের সামনের দিকে তাকাল। তন্নি রেলিঙের দিকে পিঠ ঠেকিয়ে রাহার পানে তাকাল। এখন তন্নির পরনে সেলোয়ার-কামিজ। সরু নিশ্বাস ফেলে বলে,
‘আর কত বছর নিজেকে এভাবে গুটিয়ে রাখবি? কাউকে লাইফে আসতে দিস না, নিজে কারো লাইফে জড়াচ্ছিস না। কত দিন আর?’
‘ভাল্লাগছে না, চুপচাপ থাকলে ভালো হয়।’
‘এড়িয়ে যাবি না। তোর একাকীত্ব আমার সহ্য হচ্ছে না। আরান তোকে পছন্দ করে….’
‘আমি এই বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাইছি না। লিভ মি।’
‘আরান সত্যি তোকে খুব পছন্দ করে।’
‘আমি কিছু বলেছি তন্নি।’ রাগী দৃষ্টি ফেলে বলল রাহা। তন্নি তার হাতের স্বর্ণের ব্যাচ লাইট উঁচু করে তুলে বলল,
‘এটি কি তোর কাছে আছে?’
‘নেই।’
‘আছে নাকি হারিয়ে গেছে?’
‘দেখতে হবে।’
‘পাঁচ বছরে একবারও তোর হাতে দেখিনি।’
প্রতুত্তরে রাহা চুপ থাকে। তন্নি ফের সরু নিশ্বাস টেনে জায়গা ছাড়ল। রাহার মুখ একবার বন্ধ হলে, ফের টু শব্দ বের হতে সময় লাগে। রাহা তন্নির চেয়ে কয়েকগুণ ভারী নিশ্বাস ত্যাগ করল। পাঁচ বছর আগে বিয়ের সাজে ব্যাচটিও হাতে পড়েছিল। বাড়ী ফিরার পর সেটি আর খুঁজে পায়নি। খোঁজার চেষ্টাও করেনি। খালার দেয়া প্রিয় উপহার ছিল এটি। তন্নি ও তার একই ডিজাইনের ব্যাচ দিয়েছিল। তবে ভাগ্যক্রমে সে তা হারিয়ে ফেলেছে সেই ভাগ্যচক্রে।
_
আচমকা ড্রয়ার খুলে ঘড়িটি রাখতেই রায়ানের নজরে পড়ে স্বর্ণের ব্যাচটি। সেদিন রাহা চলে যাবার পর সিটের পাশে পড়েছিল সেটি। একবার ফেলে দেবার চিন্তা করে পরক্ষণেই কি যেন ভেবে তা নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল। পাঁচ বছর পর বন্ধুদের নিকট তার বিয়ে করা অচেনা মেয়েটির কথা শুনে রায়ান ভাবনা কাতর হয়ে পড়ে। সেই অচেনা মেয়েটির ব্যাচ তাকে আরো কয়েকগুণ মনে করিয়ে দিচ্ছে। হাতে তুলে নেবার আগেই একই স্থানে রেখে ড্রয়ার লাগিয়ে দিলো। অতীত নিয়ে তার কোনো প্রকার মাথা ব্যাথা নেই। না কখনো ছিল। সে ভবিষ্যতের আগাম চিন্তিত পুরুষ।
.
.
.
#চলবে?

®সুমাইয়া মনি

কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।