#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
৫.
বেলকনিতে ইজি চেয়ার সহ এডজাস্ট দুটি সোফা রয়েছে। ছোট্ট টেবিলের উপর গরম কফির মগ থেকে উষ্ণ ধোঁয়া উড়ছে। এক হাত চেয়ারের উপর রেখে, ওপর হাত দ্বারা একটি কাগজ বেশ চিন্তিত ভাবে কপোলে বারংবার ছোঁয়াচ্ছে রায়ান। চোখ জোড়া বন্ধ। মস্তিষ্কে রয়েছে অতীতের ঝলক। যা ঘোরপেঁচ খাচ্ছে পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে। হঠাৎ সেখানে দুই বন্ধুর আগমন ঘটে। কক্ষে না পেয়ে বেলকনিতে এসে রায়ানকে দেখতে পায়। জনি ও মেশকাত রায়ানকে প্রশ্ন করার পূর্বে সোফায় বসল। চোখ তুলল রায়ান। হেলান দেবার সময়ই মেশকাত প্রশ্ন ছুড়লো,
‘জরুরী তলব কেন? এত চিন্তিত তুই? ব্যাপার কী?’
‘মেয়েটা কী ফিরে এসেছি?’ জনির প্রশ্নে উদ্বিগ্নতার ছোঁয়া।
রায়ান আড়মোড়া ভেঙে টেবিলে কাগজটি রেখে অনুদ্ধত কণ্ঠে শুধালো,
‘মেয়েটার নাম রাহা মনি। কোর্টে লিখার সময় নামটি উল্লেখ করেছিল সে, অথচ কারো মস্তিষ্কে নেই, ডিলিট?’
মেশকাত দ্রুত কোর্ট ম্যারেজের কাগজ হাতে তুলল। সেখানে স্পষ্ট ভাবে রাহার হাতের লেখা রয়েছে। জনি উঁকি দিলো। নজর সরিয়ে জানাল,
‘আছে লিখা রাহা মনি। তুই কাগজ কেন বের করে দেখাচ্ছিস আমাদের?’
‘নামের জন্য। ওর বাবা-মায়ের নামও সেখানে উল্লেখ করেছে। আদৌও সত্যি নাকি মিথ্যা জানি না।’
‘তাহলে তো রাহা নামটিও মিথ্যা হতে পারে।’ মেশকাত কাগজটি টেবিলে রেখে বলল।
‘ধারণা করা যায়। আই ডোন্ট কেয়ার। এই বিয়ে আমার কাছে জাস্ট প্রতিশোধ ছিল মাত্র।’ দৃঢ়তার স্বরে শুধায়।
জনির কপারে কয়েকটি বিরক্তির রেখা দেখা গেল। কৃত্রিম হেসে বলল,
‘এযাবৎ প্রতিশোধ কম নেওয়া হয়নি তোর। এসব থেকে বেরিয়ে নিজেকে প্রকৃতিক আইনের আওতায় প্রসারিত কর।’
‘আমার লাইফ নিয়ে জেলাস?’ তাচ্ছিল্য হেসে জানতে চাইলো রায়ান।
‘নাহ!’ ছোট করে উত্তর দিলো জনি।
‘রায়ান মির্জা কক্ষণো পরিবর্তন হবে না।’ দৃঢ়তার স্বরে বলল।
‘অল দ্য বেস্ট।’ জনি পাল্টা উত্তর দেয়।
প্রতিত্তোরে রায়ান চুপ থেকে মেকি হাসি প্রধান করল। মেশকাত দুই বন্ধুর মধ্যকার কলহ-বিষয়ের আলোচনাকে দূরে ফেলে বলে,
‘পাস্ট নিয়ে ঘেঁটে ভবিষ্যতের আগাম চিন্তা করা বোকামি। আপাতত সব ফোকাস আমার বিয়ের জন্য করা উচিত।’
‘কোথায় হচ্ছে বিয়ে?’ জনির প্রশ্ন।
‘এলিজা সেন্টার বুক করা হয়েছে। রাতে রিসিপশন।’
‘যে কোনো প্রয়োজনে আমায় কল দিবি। লোক দিয়ে পাঠিয়ে দিবো।’ রায়ান আত্মবিশ্বাসী স্বরে বলল। জনি কিঞ্চিৎ সন্দিহান স্বরে বলল,
‘তুই আজ বাড়িতে কেন?’
‘আব্বু আছে মিটিংয়ে। এজন্য আজ চলে এসেছি।’
‘হলুদ কবে?’ জনি জানতে চায়।
‘পরশুদিন। পাঞ্জাবি পাঠানো হবে সেইম রঙের। পার্সেল রিসিভ করে নিস। রায়ান তোর জন্য পাঠাব না। আমি জানি তুই নিজের কালেকশন ব্যবহার করবি।’
‘অবশ্যই।’
‘যাচ্ছি। বিকেলে দেখা হবে শপিং মলে।’ বলেই উঠে দাঁড়ালো মেশকাত। জনিও পিছু উঠে হাঁটা ধরলো। পাশাপাশি হাঁটার সময় মেশকাত জনির পারিবারিক বিষয়ে খুটিনাটি প্রশ্ন করছে। তবে তাদের পথরোধ করল অরুণা বেগম। বিভিন্ন নাস্তপানি খাইয়ে তবেই ছাড়ল দুই বন্ধুকে। উপর থেকে একবার সেসব দেখছিল রায়ান। সে মায়ের কারসাজিতে ম্লান হাসে। ওদের আটক করার উদ্দেশ্য ছিল রায়ানের বিষয়ে তথ্য নিবেন সে। প্রেম, ভালোবাসার সম্পর্কে আবদ্ধ আছে কি-না তা শিওর হবেন।
হতাশ হন তিনি। না করছে তার পুত্র প্রেম। না করতে চাইছে বিয়ে। নিরবে নিরাশায় ভুগেন তিনি।
__
এডামজি টেক্সটাইল কোম্পানির বিদেশি বায়ারদের সাথে মিটিংয়ের পর একত্রে দুপুরের আহার সেরে নেয় রাহা। এবার সে নিজের কেবিনে ফিরে বাকি কাজগুলো সম্পূর্ণ করে বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হলেন। রিকশার জন্য অপেক্ষা করতেই আরান বাইক নিয়ে সামনে এসে থামল। হেলমেট বিহীন বাইক চালিয়েছে এটি বুঝতে পেরে কপালে ভাজ পড়ে। তার চেয়ে বড়ো কথা আরান বাইক কবে কিনেছে? কবেই বা ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়েছে? আরান মুখ খোলার আগেই ভারী গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে রাহা,
‘বাইক কার? লাইসেন্স ছাড়া বাইক চালাচ্ছিস কেন?’
‘উঠে বোসো, বলছি।’
‘আগে বল।’ জেদি স্বরে বলল।
‘বন্ধুর। আজকের জন্য নিয়েছি। তোমায় বাড়িতে পৌঁছে দিয়েই ফেরত দিয়ে আসবো।’
‘আমি তোর সাথে যাব না। রিকশায় যাব।’
‘আমায় আশাহত করে তুমি কি শান্তি পাবে জান?’ কোমল গলায় কিঞ্চিৎ অভিমান নিয়ে বলল। রাহা আশেপাশে নজর বুলায়। দাঁতে দাঁত পিষে ধীরে কণ্ঠে বলে,
‘থাপ্পড় খেয়ে লজ্জাহত না হতে চাইলে ভাষা ঠিক কর।’
‘উঠে এসো। নয়তো সব আবেগময় ভাষা ব্যবহার করব।’ নাছোড়বান্দা আরান। দ্বিধাবোধ নিয়ে ফের চারদিক নজর বুলিয়ে বাইকে উঠে বসল। কেলেঙ্কারির কাজে সে পড়তে চায় না। আবার আরানের সঙ্গে বাইকে যাবার ইচ্ছেশক্তি না থাকা শর্তেও তাকে উঠতে হলো। আরান আয়নার মাধ্যমে পেছনে বসা রাহাকে এক পলক দেখে মুচকি হাসি প্রধান করল। তারপর ঘাড় হালকা বাকিয়ে ধরে বসার নির্দেশ দিলো। রাহা ইতস্তত বোধ নিয়ে আরানের কাধে ডান হাত রাখলো। স্টার্ট দিলো বাইক। এক ছুটে জায়গা ছাড়ল। কোনো প্রকার জোরে ব্রেক না কষিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির নিকটে এসে থামলো। তাদের দু’জনকে বেলকনি থেকে খেয়াল করল তন্নি। বেশ সুন্দর ভাবে বাইক চালিয়েছিল আরান। বাইক থেকে নেমে বিনাবাক্যে ভেতরে যেতে নিলে পেছন থেকে আরান চেঁচিয়ে উঠলো,
‘ধন্যবাদ তো বলে যাও জান।’
রাহা পেছনে না ফিরে সোজা ভেতরে প্রবেশ করল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দরজায় বেল বাজানোর পূর্বেই দরজা খুলল তন্নি। রাহা অবাক না হয়ে ভেতরে এলো। প্রায় সময় তন্নি বেলকনি থেকে তাকে দেখে দরজা খুলে দেয়। এজন্য এ বিষয়ে প্রশ্ন করেনি কবু। মাগরিবের আজান দিয়েছে। নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত তার অফিস টাইম। কখনো সময় কম বেশি হলে সমস্যা হয়না। রাহা ফ্রেশ হয়ে বাহিরে বের হবার পর তন্নি চেয়ে বলল,
‘চারদিনের ছুটি নিবি।’
রাহা খাপছাড়া কণ্ঠে শুধালো,
‘কেন?’
‘আমরা ঢাকা যাচ্ছি।’
রাহা উৎসুক দৃষ্টি ফেলল। বলল,
‘কারণ?’
‘পিকনিকে।’
‘কিসের পিকনিক? আমি কখনো শুনিনি খুলনা থেকে পিকনিকের জন্য ঢাকা যাওয়া হয়।’
‘আমরা চার জন।’ তন্নি ভ্রুক্ষেপহীন চাহনিতে তাকিয়ে ফের বলল।
‘চার জন কে?’
‘আমি সাইদ, তুই ও আরান।’
‘শিওর জানিস আমি ঢাকা কেন যাব না। তবুও আমার সিদ্ধান্ত না জেনে আগেভাগে পরিকল্পনা করার কোনো মানেই হয় না।’ কিছুটা ক্ষুব্ধ গলায় জানাল।
তন্নির কণ্ঠেও রাগ। কাঠিন্য স্বরে বলে,
‘আমরা যাচ্ছি। এবং তিনদিন পর।’
‘ফোর্স করা অপছন্দ তন্নি।’ স্বাভাবিক ভাবে জানায়।
‘কোথাকার কোন ছেলের জন্য নিজের জীবন কেন নষ্ট করব? সেই ছেলে তো বুক ফুলিয়ে স্বাধীন হয়ে বেঁচে আছে। আজকালকার কোর্ট ম্যারেজে কিচ্ছু যায়-আসে না। পাঁচ বছর হয়েছে। এখন পর্যন্ত না কোনো রেসপন্স এসেছে, না সেই ছেলে তোকে বউ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গ্রহণ করেছে। সে ভুলে গেছে। তুই কেন ভুলতে পারছিস না?’
‘কারণ আমি নারী, আর সে পুরুষ।’ খেঁকিয়ে বলল রাহা। নিজেকে ধাতস্থ করে ধীর কণ্ঠে শুধালো,
‘ঢাকা ব্যতীত যেখানে ইচ্ছে বল। আমি যাব। আরান সঙ্গে থাকলেও আপত্তি নেই। এই বিষয়ে আর একটা কথাও হবে না।’
‘ঠিক আছে। ছুটি নেবার ব্যবস্থা করে রাখ।’ বলেই তন্নি বেলকনিতে এলো। রেলিং থেকে নিচে উঁকি দিতেই আরান ইশারায় জানতে চাইলো,’কী?’ তন্নি হেসে মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাব প্রধান করল।
আরান খুশিতে গদগদ করে বাইকের হ্যান্ডেল কষে ধরেই দ্রুত গতিতে ছুঁটালো। পিকনিকে যাবার জন্য আরান ও তন্নি এরূপ ছক এঁকেছিল। তন্নি জানতো ঢাকার কথা বলায় রাহা রাজি হবে না। এজন্য তার কথার জালে তাকেই ডুবিয়ে ফেলে যাবার জন্য হ্যাঁ সূচক জবাব বের করল। এখন টেনশনে নেই, মুক্তভাবে পিকনিকে যেতে এবং ফিরে আসতে পারবে।
.
.
.
#চলবে?
®সুমাইয়া মনি