#তোমার_ছোঁয়ায়_বসন্তের_গন্ধ
৬.
পরপর তিনদিন অতিবাহিত হয়ে আজ সেই কাঙ্ক্ষিত সময় চলে আসে পিকনিকে যাবার। তারা চারজন কক্সবাজার যাবে। রাতে বাসের টিকিট বুক করা হয়েছে। নয়টার দিকে গাড়ি কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। এজন্য সাড়ে আটটায় তারা গাড়িতে পৌঁছে যায়। যাত্রী কমের তুললায় সামান্য বেশি ছিল। দু তিন সিট এখনো খালি পড়ে রয়েছে। বাসের মাঝামাঝি সিট ছিল তাদের। সামনে ছিল তন্নি, সাইদ। পেছনের দু’টি ছিল রাহা ও আরানের। যাত্রী এখনো উঠানামা করছে। ব্যাগগুলো বক্সে দিয়ে আরান সবে গাড়িতে উঠলো। সিটের কাছাকাছি আসতে নিলে রাহাকে ছোট্ট ব্যাগ মাথার উপরের থাকগুলোতে রাখতে দেখতে পায়। তখনই আচমকা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সামনে এগিয়েই জোরে ব্রেক কষে ড্রাইভার। ব্যালেন্স ঠিক রাখতে না পেরে রাহা পড়ে যাবার পূর্বে পেছন থেকে আরান খপ করে জড়িয়ে ধরে সিটের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখল নিজের শরীর। হঠাৎ রাহা বক্ষের উপর পুরুষের শক্তপোক্ত আঁকড়ে ধরা হাত দেখে আকস্মিক ঘটনায় হাত সরিয়ে ক্রুদ্ধ হয়ে পেছনে ফিরলো। আরান তাড়াহুড়ায় নিজের কর্মে অপরাধ বোধ নিয়ে হাসার চেষ্টা করে মুখ খোলার আগেই রাহা থাপ্পড় বসালো ডান গালে। থাপ্পড় দেবার ফলে অপরাধ বোধ যেন কিছুটা কেটে গেল আরানের। অবশ্য সে ইচ্ছাকৃতভাবে করেনি। ভুলক্রমে তাড়াহুড়োয় হয়ে গেছে। কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘মিস্টেক ছিল জান।’
বাক্যগুলো শুনেই রাহা ফের হাত তুলতে নিলে আরান হাত ধরে ফেলে ফিক করে হেসে দেয়। রাহা ক্ষিপ্ত হয়ে বাঁ হাত দিয়েই অপর গালে চড় বসায়। আরান হাত ছেড়ে গালে হাত রেখে চোখমুখ কুঁচকে মৃদুস্বরে বলল,
‘উপকারের সুন্দর প্রতিদান। আউচ, এটা বেশি জোরে লেগেছে।’ বলা শেষে গালে হাত বুলাতে লাগলো। তৎক্ষনাৎ তন্নি পেছনে ফিরলে আরানকে গালে হাত দিতে দেখে ফেলে। রাহার রাগী দৃষ্টি দেখে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কি হয়েছে?’
রাহা রেগেমেগে জালানার সিটে বসল মুখ ঘুরিয়ে। গাল থেকে হাত সরিয়ে আরান হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘প্রতিদান।’
‘মানে?’
‘আরে যাও, বোসো তো সিটে।’ কিঞ্চিৎ বিরক্ত বোধ নিয়ে বলল।
তন্নি যাত্রী উঠতে দেখে সিটে বসল। এতক্ষণ পেছনে যাত্রী ছিল না। গাড়ি স্টার্ট দেবার ফলে একে একে সবাই উঠছে। থাপ্পড়ের মুহূর্ত কেউ দেখেনি ভেবে সরু নিশ্বাস নিয়ে রাহার পাশাপাশি বসতেই চোখ পাকিয়ে তাকায় সে। ভয়ে আরান এই সিট ছেড়ে পাশের সিটে বসল। একটি সিট খালি ছিল সেখানে। আপাতত নিজের স্থান ছেড়ে সেখানে বসার সিদ্ধান্ত নেয় রাহার রাগ শান্ত হবার জন্য। গাড়ি তার গন্তব্যের উদ্দেশে ছাড়ে। লাইট অফ। বাড়ি থেকে আসার জন্য কেউ নিষেধাজ্ঞা করেনি। সাইদের সঙ্গে তন্নির বিয়ের কথা পাকাপোক্ত হয়ে আছে। আরানকে ঘরের সবারই পছন্দ। রাহার সঙ্গে যদি আরানের সম্পর্ক থাকে, এতে তাঁদের কারো আপত্তি ছিল না। তিন দিনের জন্য তারা যাচ্ছে কক্সবাজার। এর বেশি ছুটি নিতে পারেনি রাহা।
_
হলুদের অনুষ্ঠান দশটা নাগাদ আরম্ভ হয় মেশকাতের। আত্মীয়ের জোঁক পড়েছে হলুদ ছোঁয়ানোর জন্য মেশকাতকে। দূরে একাকী সামান্য আড়ালে বসে বিয়ার খাচ্ছিল রায়ান। সব ছেলেদের পরনে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি থাকলেও, তার পাঞ্জাবি ছিল ব্লু রঙের। গাঢ় রঙের পাঞ্জাবির ওপর স্টোনের কারুকাজ। হালকা আলোয় চকচক করছিল দূর থেকে।
মেশকাত পড়েছিল হলুদ ও খয়েরী কারুকার্যময় পাঞ্জাবি। জনি নীলিমাকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। এজন্য ওঁকে একা রেখে রায়ানের নিকটে তেমন যেতে পারছে না। জনি নীলিমার সঙ্গেই শাড়ী মেচিং করে পাঞ্জাবি পড়েছে। রঙ ছিল বেগুনি। স্টেজের সামনে নীলিমাকে বসিয়ে জনি রায়ানের নিকট এলো। পাশের চেয়ার টেনে বসে বলে,
‘মেশকাতও বিয়ের পর বউয়ের আঁচল ধরে ঘুরবে দেখিস।’
‘তোর মতো?’ এক ভ্রু উঁচু করে হালকা ঘাড় তার পানে তাক করে প্রশ্ন ছুঁড়লো রায়ান। জনির মুখ ঘুচে এলো। সরস কণ্ঠে শুধালো,
‘প্রেমের বিয়ে এমনই হয় বেশিরভাগ।’
‘এ্যারেঞ্জ ম্যারেজ?’
‘সেটাতেও এমনই হয় কিছুটা।’
‘লজিকহীন কথা অপছন্দ। নীলিমা ডাকছে, গো।’
‘কোথায় ডাকলো?’ পুরোপুরি তার দিকে ঘুরে প্রশ্ন করল।
‘অন্তরে অন্তরে।’
বিরক্ত ও রাগ মিশ্রিত নয়নে রায়ানের পানে তাকায়। কোনোই ভ্রূক্ষেপ নেই তার এতে। কয়েক মিনিট বাদে সে নিজ থেকে আসন ছাড়ল। নীলিমাকে সঙ্গে নিয়ে মেশকাতকে হলুদ ছুঁইয়ে এলো। সর্বশেষে রায়ান হলুদ না ছুঁইয়ে কয়েকটি ছবি তুলে নিলো বন্ধুর সঙ্গে।
_
ভোরবেলায় বাস এসে থামলো। তখন ঘড়িতে ছয়টা ছুঁই ছুঁই। আবহাওয়া বেশ শীতল। চারদিক আবছা কুয়াশা। চোখ খোলার পর রাহা তার মাথা আরানের কাঁধে আবিষ্কার করল। নিজেকে দ্রুত সরিয়ে নিয়ে কপাল কুঁচকে তাকাল। আরান সেই কাঁধে হাত রেখে ব্যাথায় ‘আউচ’ করে উঠে।
সারারাত একইভাবে বসে ছিল দেখে কাঁধে ব্যাথা অনুভব করে। অপরাধ বোধ এসে জড়ো হয় রাহার মনে। তবে সে মুখ খুলে কিছু বলে না। নিজ থেকে আরানের কাঁধে মাথা রাখেনি। কখন, কীভাবে ঘুমিয়েছিল টেন পায়নি। আর কখনোই বা আরান পাশে এসে বসেছে অজানা। আমতা আমতা করে বলল,
‘কে বলেছিল আমার মাথা তোর কাঁধে রাখতে?’
‘আমার হৃদয়।’ আবেগময় ভাষায় শুধালো।
আবেগপ্রবণ কথা শুনে খেঁকিয়ে বলল,
‘সরে যাহ, বের হবো।’
কাঁধে হাত বুলাতে বুলাতেই সরে দাঁড়ালো আরান। রাহা ওপর থেকে ব্যাগ বের করে বাস থেকে নেমে গেল। ইতিমধ্যে তাঁদের আগেই সবাই নেমে গেছে। তন্নি, সাইদ বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে কোন হোটেলে উঠবে তা নিয়ে আলোচনা করছিল। রাহা ওঁদের কাছে এসে দাঁড়ায়। জানতে চায়,
‘কোন হোটেলে উঠব আমরা?’
‘কক্সবাজার বীচ হোটেলে উঠব ভাবছি।’ সাইদ জানালো রাহাকে
‘চলেন তাহলে ভাইয়া।’
‘আরান কোথায়?’ পাল্টা প্রশ্ন করল সাইদ।
‘বাসে..’ রাহা কথা শেষ করার পূর্বেই কাছাকাছি এসে হাজির।
‘এই যে আমি।’
সাইদকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটা ধরলো আরান। বড়ো-ছোট অনেক হোটেল রয়েছে সৈকতের কাছাকাছি। এই হোটেলটিও খুব কাছেই ছিল। হোটেলটি ছিল পাঁচতলা। তিন তলায় দু’টি রুম নিলো তারা। রাহা, তন্নি একত্রে। সাইদ ও আরান একত্রে থাকবে। ঘুমিয়ে, ফ্রেশ হয়ে নয়টায় বের হয় তারা। সকালের নাস্তা খাবার পর সমুদ্র সৈকতে ভ্রমণে বের হয়।
রৌদ্রস্নাত প্রকৃতির সঙ্গে শীতল সাগরের বাতাস। তন্নি সাইদের সঙ্গে হেঁটে সামনে এগিয়ে যায়। রাহা ধীরে ধীরে একাকী হাঁটছে পানির নিকট ঘেঁষে। আরান রাহার নিকটে এসে একটি ক্যান্ডি এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘তোমার জন্য।’
‘নো থ্যাংকস।’
‘সঙ্গ দিতে আসলাম।’
‘একাকী থাকতে চাই। প্লিজ!’
‘কতক্ষণ?’
‘কতক্ষণ মানে কী?’ পাল্টা প্রশ্ন।
‘সময় বলো, ততক্ষণ পরে আসবো।’
‘তুমি একেবারে যাও। সন্ধ্যায় দেখা করো।’
মুখ মলিন হয়ে এলো আরানের। তবে সেটা বুঝতে না দিয়ে কৃত্রিম হেসে কোমলভাবে বলল,
‘অপেক্ষা করব। সারাজীবন।’ বলেই প্রস্থান করল আরান। খট করে স্থির দাঁড়িয়ে পিঠের পানে চেয়ে রইলো রাহা। ছেলেটা কি আদৌও ওঁকে পছন্দ করে নাকি ভালোবাসে? নাকি এটা শুধু রসিকতার একাংশ?
মৃদু বাতাসের সঙ্গে নৈঃশব্দ্যে মিলিত হলো তার দীর্ঘশ্বাস। আবার নিজ মনে ধীরে পায়ে এগোতে লাগলো। খালি পায়ে বালি ও হালকা ঢেউয়ের পানি মিশ্রিত শীতল সাগরের কিনারায় হাঁটতে বেশ ভালো লাগছে। পাঁচ বছর পর এই প্রথম বহুদূরে পিকনিকের উদ্দেশ্যে এসেছে। এ কয় বছরে কোথাও যাওয়া হয়নি। মনটা বিশাল সাগরের ন্যায় শান্ত হয়ে গেল। কয়েক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল যাবতীয় দুঃখ, ভয়াবহ অতীতের ছোঁয়া।
আসলেই সত্যি, অতিরিক্ত ভ্রমণের ফলে মন ও মস্তিষ্ক শান্ত-শীতল করতে সক্ষম হয়। আবার কখনো নিষ্ক্রিয় করে ফেলে অতীতগুলো। তন্নিকে মন থেকে ‘ধন্যবাদ’ প্রধান করে রাহা।
.
মেশকাতের সঙ্গে বধু আনতে দুই বন্ধু সহ মোট একশোজন বরযাত্রী যাত্রা দিয়েছে। একটি বাস ও তিনটি মাইক্রো এবং বরবধূর জন্য একটি প্রাইভেট কার নিয়েছিল। সাদা রঙের প্রাইভেট কারটি ছিল রায়ানের। বেশ সুন্দর ভাবে ফুল দিয়ে সাজিয়েছে প্রাইভেট কারটি। এগারোটার দিকে গাড়ি মিরপুর থেকে বেরিয়ে ফাল্গুনী কমিউনিটি সেন্টারে এসে পৌঁছায় একটার দিকে। বর বরনের পর্ব শেষ করে খাওয়া-দাওয়া শুরু হয়। পরিশেষে বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ করে বর ও বধুকে একত্রে বসিয়ে ছবি তোলা হয়। মেশকাত এই প্রথম তার বধুকে কাছ থেকে দেখলো। এর আগেও একবার চোখের দেখা দেখেছে ফোনে। চেহারা আহামরি সুন্দর না হলেও এতটাও খারাপ না। এজন্য মায়ের পছন্দকে প্রধান্য দিয়ে বিয়েতে হ্যাঁ বলেছিল। ফোনে ও বাস্তবে কখনো দেখা বা কথা হয়নি। তাঁদের মাঝে আন্ডারস্ট্যান্ডিং নেই বললেই চলে। ফর্মালিটির জন্য ছবি তুলে দু’জনে। তখনো কথা বলেনি একে অপরের সাথে।
বিয়ের যাবতীয় রীতিনীতি সম্পূর্ণ করে পাঁচটার দিকে ফের রওয়ানা হয় বধু নিয়ে। রায়ান গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে বসে ছিল। পেছনে ছিল মেশকাত ও তার নতুন বধু। সেন্টার থেকে বের হবার সময় কান্নায় ভেঙে পড়লেও এখন বিন্দুমাত্র কান্নার শব্দ আসছে না। এজন্য মেশকাতের সান্ত্বনাও প্রধান করতে হলো না। তাঁদের পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে এলো। বরবধূকে মিষ্টিমুখ করিয়ে ঘরে তোলে আত্মীয়রা। মেশকাতের নতুন জীবনের সূচনা হবে আজ থেকে। কেবল একা রয়ে গেল রায়ান।
.
.
.
#চলবে?
®সুমাইয়া মনি
কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।