সুখান্বেষণ পর্ব-০২

0
1

#সুখান্বেষণ (পর্ব:২)

#আরশিয়া_জান্নাত

সব মেয়েরা বাবার রাজকন্যা হয়না, কেউ কেউ চোখের বালি হয়। আমি হয়তো সেই অভাগীদের দলে। ছোট থেকেই দেখে এসেছি আমার মা চুপচাপ সব সহ্য করে, উনাকে মারতে মারতে আধমরা করে ফেললেও এক বেলা রান্না তার বন্ধ হয়না। এমনকি জ্বরে ভুগলেও মাকে সব করতে হয়। আমার ছোট ভাই হবার পর দেখেছি মাকে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে হলেও সংসারের সব কাজ করতে হয়েছে, ২বেলা ভাত বেড়ে খাওয়াতে হয়েছে।
আমি তাই ভাবতাম সংসার খুবই কঠিন কর্মক্ষেত্র। যেখানে কাজ করা মানুষের কখনো ছুটি হয়না, অসুখবিসুখ হয়না। এই কাজের প্রতিদান আসুক কি না আসুক প্রতিটা নারীর শ্রম দেওয়া বাধ্যতামূলক। আমি সবসময় চাইতাম খুব দ্রুত বড় হয়ে যেতে আর মায়ের কাজে সাহায্য করতে। আমার মা যদিও সেটা চাইতেন না, তিনি আমাকে পড়াশোনা করতে বলতেন। রান্নার কাজের চেয়ে পড়ার কাজে ব্যস্ত রাখতে চাইতেন। আর হয়তো দোয়া করতেন আমি যেন দ্রুত বড় না হই। কিন্তু এর কোনোটাই পূরণ হলোনা। বয়সের তুলনায় আমার গ্রোথ অন্যদের চেয়ে বেশি হলো। আমি ১৩/১৪ বছরেই অনেক বড় হয়ে গেলাম। বড় কাজিনদের চেয়ে হাইটে এতো বেশি লম্বা হলাম সবাই ভাবতো আমি সবার বড়। আমার বাহ্যিক এই পরিবর্তন আমার বাবা ভালোভাবে নিলেন না। তিনি এতে ভীষণ বিরক্ত। তার মতে আমাকে অতিরিক্ত যত্নের নামে খাইয়ে খাইয়ে আমার মা বড় করে ফেলেছে।
তাই তিনি খুব দ্রুত আমাকে বিয়ে দিতে তোড়জোড় শুরু করলেন। এই ভয়টাই আসলে মা পাচ্ছিল সেটা আমি তখন বুঝিনি। দেখা যেত যাকে তাকে ধরে আনছে বিয়ে দিতে। সেই দিনগুলো কত দূর্বিষহ কেটেছে বলতে গেলেও চোখে পানি চলে আসে। একেকটা বিয়ে ভাঙতো আর বাসায় মারধর শুরু হতো। সাথে চিৎকার চেঁচামেচিসহ ভাংচুর তো আছেই। এমন পরিবেশে বড় হওয়ার পর পুরুষ সম্পর্কে আমার ধারণা ভালো হবেনা এটাই স্বাভাবিক। তাই যত সময় যায় আমি ততোই পুরুষ বিদ্বেষী কাম বিয়ে বিদ্বেষী হয়ে উঠি। আমার মনে হতো পৃথিবীর সব পুরুষ খারাপ, ওরা আর সবার কাছে ভালো হলেও স্ত্রীর সামনে এরা বর্বর, অত্যাচারী। এরা অকৃতজ্ঞ, নিজেকে মনিব ভাবে, রিজিকদাতা ভাবে, এরা ভাবে এদের জন্যই আমরা খেয়ে বাঁচতে পারি নয়তো না খেয়ে মরতে হতো। তাই ওরা ওদের ইচ্ছেমতো মারধর করার অধিকার রাখে, গালিগালাজ করার অধিকার রাখে।
আমি কতবার শুনেছি বলেছে, উনি খাওয়ায় দেখেই খেতে পারছি, নয়তো শরীর বেচেও ভাত জুটতো না আমার!
সেদিন ঘেন্নায় শুধু চোখের পানি ফেলেছি, বাবা হয়ে মেয়ে কে কেউ এতো নোংরা কথা বলতে পারে আমি কোনোদিন কল্পনা করতে পারিনি। অবশ্য আমার কল্পনার বাইরেই সব করতো তিনি। আমি প্রতিবার নিত্যনতুন যন্ত্রণায় কাঁদতাম। মানুষ নাকি দুঃখ সইতে সইতে একসময় পাথর হয়ে যায়। আমি কেন পাথর হচ্ছিলাম না সেই অভিযোগ ও করতাম রবের কাছে। আমার কথাগুলো শুনে আপনাদের কার কাছে কেমন লাগছে জানি না, তবে ভুক্তভোগী ছাড়া আমার এই যন্ত্রণার গভীরতায় কেউ পৌঁছাতে পারবেনা স্বাভাবিক।

আম্মু কে আমি প্রায়ই বলতাম, চলো না আমরা সেপারেট হয়ে যাই। এই জাহান্নামে আর কতদিন পুড়বা?
আম্মু বেশিরভাগ সময় কোনো প্রতিক্রিয়া করতোনা, মাঝেমধ্যে বলতো,”কই যাবি কার কাছে যাবি? বাপ ছাড়া আশ্রয় পাবি কই? মাথার উপর বাপের ছায়া না থাকলে এই পৃথিবীতে কোনো দাম আছে? উল্টা এই বয়সে কলঙ্কের বোঝা চাপবে মাথায়, সবাই কত কথা রটাবে…”

আমি বিরক্ত গলায় বলি,”আজ যদি উনি মরে যাইতো বা বাপ না থাকতো আমার পৃথিবীতে কী বাঁচতাম না? এই পৃথিবীতে কেউ কাউকে ছাড়া মরেনা। এমন অনেক মানুষ আছে যার বাপ নাই, ওরা কী টিকেনাই? ওরা কী বেঁচে থাকেনাই?”

“তোর আছে তো তাই বুঝতেছোস না। যার নাই তারে গিয়ে জিজ্ঞেস করিস। তাহলে উত্তর পাবি।”

“এরকম থাকার চেয়ে না থাকা ভালো ছিল। অন্তত ডেইলি আতঙ্ক নিয়ে বাঁচতে হতোনা।”

“তো বিয়ে করে পরের বাড়িতে চলে যা না। ভালো একটা ছেলেকে বিয়ে কর। তোর বাপতো বলছে রিকশাওয়ালা ধরে আনলেও রাজি হবে।”

“তা তো হবেই আমাকে কেউ বিয়ে করলেই তোমার স্বামী বাঁচে!”

“এসব কী ধরনের কথা তাহু! বাপকে নিয়ে কেউ এভাবে কথা বলে?”

“আমি বলি, কারণ আমি খারাপ মেয়ে।”

মা আমার দিকে বিরক্ত মুখে তাকান। আমি আর কিছু না বলে রুমে চলে আসি‌।

আকাশে বেশ ঘটা করে কালো মেঘ জমা হচ্ছে। আগামী কিছুদিন টানা বর্ষণ হবে হয়তো। বৃষ্টি হলে আমার বাসা থেকে বের হতে মন চায় না। কিন্তু টিউশন মিস দেওয়া সম্ভব না। তাই ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।

আমার বিয়ের প্রতি অনীহা দেখে মা আর‌ নানু সবসময় আতঙ্কে থাকতেন। তাদের মতে আমি বেপথে চলে যাবো, আমার ভবিষ্যৎ কঠিন হয়ে যাবে। তাই বিয়ে করা সুন্নত, নয়তো দ্বীন পূর্ণ হয়না, বাবা মায়ের পাপের বোঝা বাড়ে প্রভৃতি ইমোশনাল ও রিলিজিয়াস ব্ল্যাকমেইল করে আমার মা আর নানু আমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য করেন। শুধু মাত্র উনার মুখের দিকে চেয়ে আমি ২২বছর বয়সে তিন‌ অক্ষরের শব্দ বলে সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। আমার বিশ্বাস ছিল আমার আল্লাহ আমাকে নিরাশ করবেন না। তার উপর ভরসা করেই আমি বিয়ের ফোবিয়া বাক্সবন্দী করে নতুন জীবনে পদার্পণের দুঃসাহস করি। বিয়ে নিয়ে মেয়েদের যত রঙিন কল্পনা জল্পনা থাকে আমার সেসব কিছুই ছিল না। তবে হ্যাঁ ভয়ঙ্কর কল্পনা ঠিকই ছিল। আমি ও ধরে নিয়েছিলাম মায়ের মতো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের স্বীকার আমাকেও আজ থেকে হতে হবে।

বিদায়ের আগে আমার নানী শুধু একটা কথাই বলেছে, “বাসর রাইতে জামাই ঘরে ঢুকলেই পায়ে ধরে সালাম করবি, ২রাকাত নামাজ পড়বি। এরপর কোনো রাও করবি না, যেমনে চাইবো তেমনে সাড়া দিবি। খবরদার কোনো বেয়াদবি করবি না……”
আমি নিজেকে মানসিকভাবে সেভাবেই প্রস্তুত করছিলাম।

।।

ফুল দিয়ে সাজানো ঘরের মধ্যমণি হয়ে বসে অপেক্ষা করছিলাম আমার নতুন মনিবের। যাকে সন্তুষ্ট করে নিজের ভরণপোষণের বন্দোবস্ত নিশ্চিত করা যায়!! কান্না করতে করতে চোখ ফুলে ঢোল হয়ে আছে সাথে তীব্র মাথা ব্যথা। ঘুমের তোপে চোখ বুজে আসছিল কিন্তু ভয়ে ঘুমাতে পারছিলাম না। বসে বসে ঝিমাচ্ছিলাম বলতে গেলে। দরজার শব্দ শুনে আমি নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকাই, অবয়ব দেখে বুঝলাম তিনি এসেছেন। দ্রুত উঠে কদমবুসি করতে গিয়ে শাড়ির কুঁচিতে পা পেঁচিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ি। তিনি আমার দুই বাহু আঁকড়ে তুলে ধরে গম্ভীর গলায় বললেন,”এরকম হুড়মুড় করে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লে কেন?”

আমি কাচুমাচু হয়ে বললাম,” শাড়ির জন্য হোঁচট খেয়েছি।”

“সেটা তো দেখেছি, উঠে এলে কেন তা জিজ্ঞেস করলাম।”

“নানু বলেছেন আপনাকে কদমবুসি করতে তাই..”

“মুখে সালাম দেওয়াই সুন্নত। কদমবুসি করার রেওয়াজ মানতে হবেনা। তাছাড়া আমি ই সালাম দিতাম তুমি এমন ঝড়ের গতিতে এসেছো কিছু বলার সুযোগ পাইনি।”

“স্যরি,”

“স্যরির কী আছে! পায়ে ব্যথা পেয়েছ কি না বলো?”

“নাহ ঠিক আছে।”

“এখনো মেকাপ উঠাওনি যে! এতো ভারী সাজে গরম লাগেনা?”

“হু..”

“ফ্রেশ হয়ে অযু করে এসো।”

আমি গয়নাগাটি খুলে একটা থ্রিপিস নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়লাম। আগে কখনো এমন ভারি মেকাপ না করায় পানি দিয়ে চোখ মুছতে গিয়ে সব লেপ্টে কালো করে ফেলেছি। মাথাতেই ছিল না এসব কৌশল খাটিয়ে করতে হয়। ফেসওয়াশ ঘষতে ঘষতে চোখ জ্বালাপোড়া করতে শুরু হয়েছে। বহু কষ্টে কালো ভাব দূর করে চুলের দিকে হাত বাড়ানোর সাহস হলোনা। অযু করে বের হয়ে দেখি উনি বিছানার সব ফুলের পাপড়ি ঝেড়ে একপাশে রেখেছেন, গয়নাগুলো বক্সে গুছিয়ে ফেলেছেন। আমাকে দেখে বললেন, “সময় কাটছিল‌ না তাই সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। মেকাপ তুলতে বেশি ঝামেলা হয়েছে নাকি?”

“মেকাপ রিমুভারের কথা ভুলে গিয়েছিলাম তাই গন্ডগোল হয়ে গিয়েছিল।”

তিনি জায়নামাজ বিছিয়ে বললেন, দু’রাকাত নামাজ আদায় করে নাও।

আমি উনার পেছনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। নামাজ শেষে উনি আমার দিকে ঘুরে বসলেন, আমার দু’হাত ধরে কিছুক্ষণ স্থির রইলেন। তারপর আমার কপালে চুমু দিয়ে মুচকি হাসলেন।
আমি লজ্জায় চোখ নামিয়ে রেখেছিলাম পুরোটা সময়। তিনি আমার চিবুক তুলে বললেন,”আমি যদি তোমাকে আসল নামে ডাকি কোনো আপত্তি থাকবে? তানহা নামটা কেমন একাকিত্বের আভাস দেয়, কিন্তু তুমি তো একা নও। আজ থেকে আমি তোমার পাশে আছি। আল্লাহ চাইলে এই জীবনের পাশাপাশি পরবর্তী জীবনেও একসাথে ই থাকবো। এই দীর্ঘ সফরের সঙ্গী যার আছে সে তানহা থাকে বলো?”

“আপনার যে নামে ডাকতে ভালো লাগে সেই নামেই ডাকতে পারেন। আমার উপর আপনার পূর্ণ অধিকার আছে।”

তিনি পকেট হাতড়ে একটা বক্স বের করে বললো,”মোহরানা পরিশোধে প্রাপ্ত পূর্ণ অধিকার গ্রহণের প্রেক্ষিতে অনুমতি চাইনি জনাবা। ব্যাখ্যা শুনে অনুমতি দিবেন কি না তা বলুন।”

“জ্বী অনুমতি দিলাম‌”

“বেশ তবে আমি তোমাকে হুমায়রা বলেই ডাকবো। তোমার নাম দেখেই প্রথম আমার কী মনে হয়েছিল জানো? মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার বিবি আয়েশা কে আদর করে হুমায়রা বলে ডাকতেন, যদি নসীবে থাকো তবে তুমিও আমার হুমায়রা হবা, কি সৌভাগ্য ই না হবে আমার!”

“নাম দেখেই নিজেকে সৌভাগ্যবান ভেবে ফেলেছেন? ”

“হ্যাঁ অবশ্যই! অনেক ভেবেচিন্তে গিফট রেডি করেছি। দেখো তো খুলে পছন্দ হয় কি না..”

আমি বক্স খুলে দেখি একট গোল্ড পেন্ডেন্ট। ইনফিনিটি সাইনের মাঝে হার্ট শেইপ কানেক্ট করা। সেখানে ডায়মন্ডের স্টোন দিয়ে লেখা Soulmate। “বাহ, অনেক সুন্দর তো!”

“আলহামদুলিল্লাহ পছন্দ হয়েছে তাহলে! May I..বলেই উনি হাত বাড়ালেন গলার দিকে। আমি গলার চেইনটা খুলে তার হাতে দিলাম, সে চেইনে পেন্ডেন্ট ঢুকিয়ে আমার গলায় পড়িয়ে দিলেন। বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে বললেন, “মাশাআল্লাহ অনেক মানিয়েছে।”

“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”

তিনি আমার কোলের উপর মাথা রেখে বললেন, ধন্যবাদ না দিয়ে দোয়া করে দিবা, যাতে তোমাকে সবসময় খুশি রাখতে পারি। আমাকে যেন তোমার অপরাধী হিসেবে হাশরের মাঠে দাঁড়াতে না হয়।”
তার এই কথা শুনে আমার চোখে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে পানি চলে আসে। আমি জানিনা এতো আবেগী আমি কবে হলাম, কিংবা কারো কথায় এতো আপ্লুত হওয়া যায় কি না যে আনন্দে চোখে পানি চলে আসে! কিছুক্ষণের আলাপে মানুষ কে চেনা যায় না এ কথা সত্যি, তবে কিছু মানুষ অল্পতেই আপন মনে করানোর ক্ষমতা রাখে তাকে দেখে সেটারই প্রমাণ পেলাম। আমি উনার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললাম, “আপনি বরং আমার জন্য দোয়া করে দিন আমি যেন আপনার মনমতো হতে পারি, আপনার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি।”

“সেটা তুমি খুব সহজেই পারবে ইনশাআল্লাহ, ও নিয়ে আমার চিন্তা নেই। তবুও দোয়া যখন চাইলে দোয়া করে দিলাম আল্লাহ তোমাকে সুখী করুক, অনেক সন্তানের জননী করুক।”

আমি লজ্জায় দু’হাতে মুখ লুকালাম। উনি আমাকে টেনে নিজের বুকে নিয়ে বললেন,”আজকে অনেক ধকল গেছে‌। শান্তি তে ঘুমিয়ে নাও। রাত এমনিতেই দ্রুত ফুরিয়ে যায়…”

আমি মুগ্ধ হয়ে মানুষটাকে অনুভব করছিলাম। জীবনের প্রথম কোনো পুরুষের সান্নিধ্য যেমন মন অস্থির করেছে, অস্বস্তিকরভাবে হৃদস্পন্দন বাড়িয়েছে, সেই সাথে একরাশ ভালোলাগা ও মুগ্ধতার মিশেলে সে এক অন্যরকম অনুভূতি জন্মিয়েছে বলা বাহুল্য।
ক্লান্তিতে কখন ঘুমের দেশে হারিয়েছি মনে নেই।

ভোরে নামাজ শেষে উনি বললেন, “হুমায়রা হাঁটতে বের হবে?”

“কেউ কিছু বলবে বের হলে?”

“কে কী বলবে?”

“না মানে ১ম দিন তো তাই আর কি!”

“আরেহ চলো তো, কেউ কিছু বলবেনা।”
বলেই তিনি আমাকে বাইরে নিয়ে গেলেন। আবছা আলোয় আমরা বাড়ির চারপাশে হাঁটতে লাগলাম, সূয্যিমামা তখনো আলো ছড়ায়নি, পুব আকাশে কেবল রক্তিম আভা ছড়াচ্ছিল। ধীরে ধীরে আলো ফুটতে শুরু করলো, তিনি বললেন,”চা খেতে পছন্দ করো?”

“হ্যাঁ। আপনি বসুন আমি বানিয়ে আনি?”

“দারুন প্রস্তাব। তবে খালি পেটে খাবোনা। তুমি ভেতরে গিয়ে বসো আমি একটা দৌড় দিয়ে আসি, ফেরার পথে নানরুটি আনবো। গরুর গোস্ত নিয়ে নানরুটি সেই মজা লাগে, তুমি নানরুটি খাও তো নাকি পরোটাও আনবো?”

“নানরুটি হলেই হবে।”

“আচ্ছা।”

আমি ভেতরে ঢুকে দেখি মুরুব্বি অনেকেই উঠে গেছেন। আমাকে দেখে শাশুড়ি মা এগিয়ে বললো,”আমাদের নতুন বৌ দেখি সবার আগে উঠেছে। হাঁটতে বেরিয়েছিলে বুঝি? তা তাশরিফ কোথায়?”

“উনি বাইরে গেছেন, বলেছেন ফেরার পথে নানরুটি আনবেন।”

“আচ্ছা তাহলে ফ্রিজ থেকে গোশত বের করে গোশত গরম করো, আর চায়ের পানি বসাও।”

“জ্বি আচ্ছা।”

“চিনি বাদে চা বানাবে, অনেকেই ডায়বেটিসের রুগী তো, যার লাগবে সে চিনি মিশিয়ে খাবে।”

“আচ্ছা।”

আমি চায়ের পানি বসাতেই চারদিকে শোরগোল পড়ে গেল নতুন বৌ চা বানাচ্ছে, মিস করতে না চাইলে সবাই উঠো। বুঝলাম এইটুকু তে হবেনা তাই বড় কেটলিতে পানি বসিয়ে চা পাতার বয়াম খুঁজছি। ইতোমধ্যেই কিশোরী বয়সের মেয়েরা খুব উৎসাহ নিয়ে রান্নাঘর দখল করে ফেলেছে। এই বয়সী মেয়েরা অল্পতেই হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে, তাদের হাসির তালে আশেপাশে সবাই ও আনমনে হেসে দেয়। আমি ও হাসছি আর চা বানিয়ে কাপে ঢেলে বাকিটা ফ্ল্যাক্সে রেখেছি। টেবিলে সোফায় মোড়ায় যে যেখানে বসার জায়গা পেয়েছে বসে গেছে। অথচ আমার উনার কোনো খবর নেই। মা কয়েক পদের বিস্কুট, মিষ্টি, নিমকি সহ নানারকম নাস্তা দিয়ে চায়ের পর্ব সারানোর চেষ্টা করলেন। সবাই যে এতো তাড়াতাড়ি উঠবেন উনি আশা করেননি, তাই রুটি বা পরোটা বানানোর সুযোগ হয়নি।
উনি এসে ভুত দেখার মতো চমকে বললেন,”এটা কী হলো আমার আগে আমার বৌয়ের বানানো চা সবার খাওয়া হয়ে গেছে! দিস ইজ নট ফেয়ার। কিরে তোরা আজ এতো সকালে উঠলি? অন্য সময় তো ১০টার আগে তোদের ঘুম ভাঙেনা।”

তার কথা শুনে সবাই হাসতে হাসতে বললো, “তুই এতো লেট লতিফ হলে আমাদের কী করার?”

“আমি লেট লতিফ না বলো যে তোমরা সবাই আজকে রূপ বদলছ ফেলেছো।”

নাফিসা বলল,” ভাবি ভাইয়ার চা দাও তো, বেচারা তোমার চা খেতে না পারার দুঃখে কান্না করে দিচ্ছে দেখো!”

আরমান, তবে যাই বলিস ভাইয়া ভাবি চা যা মজা বানায় না! সেরা…”

সবাই খেয়েদেয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। আমি উনার জন্য নাস্তা নিয়ে টেবিলে রাখতেই তিনি বললেন, “তুমি আমাকে ফেলে খেয়ে ফেলেছো বলিও না প্লিজ। তাহলে এবার মিনি হার্ট এ্যাটাক হয়েই যাবে…”

আমি বহুকষ্টে হাসি আটকে বললাম, “আপনি এতো পাগলামি করতে জানেন আমি কল্পনাও করিনি।”

“পাগলামি করলাম কই! কোথায় ভেবেছি দুজন নিরিবিলি তে একসঙ্গে বসে নাস্তা খাবো, এসে দেখি মাছের বাজার বসে গেছে। মাথা নষ্ট হবে না বলো? গতকাল সকালেও ৯টা অবধি কেউ উঠেনি, আর আজ…”

“ওরা আনন্দ করতে ভালোবাসে, তাই সুযোগ পেলেই হৈচৈ করে। এখন আর কথা না বলে খাওয়া শুরু করুন।”

“ওদের লাই দিও‌না মাথায় চড়ে বসবে। সবকয়টা ফাজিলের হাড্ডি সাবধান করে দিলাম।”

“আচ্ছা আচ্ছা ঠিকাছে।”

আমি মনে মনে ভাবি এতো মিষ্টি একটা পরিবার আমার ভাগ্যে জুটলো কীভাবে কে জানে!

চলবে…