#সুখান্বেষণ (পর্ব:৫)
#আরশিয়া_জান্নাত
আকাশে আজ রূপালী থালার মতো চাঁদ উঠেছে। উথাল পাতাল করা বাতাস আর সাগরের ঢেউয়ের গর্জন সবমিলিয়ে রাতটা আমার কাছে অপার্থিব মনে হচ্ছে। চাঁদের আলোয় চিকচিক করে উঠা অথৈ জলের দিকে চেয়ে চুপচাপ বসে আছি তাশরিফের ডেকোরেশন করা তাঁবুর সামনে। ছোট ছোট লাইট দিয়ে সে খুব সুন্দর করে এই তাঁবু এটে সাজিয়েছে পুরো সন্ধ্যা জুড়ে। সে খুব আয়োজন করে ফায়ারক্যাম্প জ্বালিয়ে সেখানে চা বানাচ্ছে। তার নাকি প্ল্যান ছিল এখানে বসে ডিনার করার, কিন্তু রনি ভাই হুট করে মাছ কিনে ফেলবে সে ভাবেনি। তাই আপাতত চা দিয়ে চন্দ্র বিলাস করা ছাড়া উপায় নেই। আমি তার দিকে চেয়ে বললাম, “এতো রাতে চা খেলে ঘুম আসবে আর!”
“না আসলে ক্ষতি আছে?”
“নেই বলছেন?”
“অবশ্যই নেই বরং লাভ আছে।”
“আপনি অযথা ই এসবে ব্যস্ত থেকে একটা সুন্দর রাত মিস করছেন। এদিকে এসে বসুন তো দেখুন চাঁদ টা কত সুন্দর..”
“আর ২মিনিট প্লিজ তারপর পুরো রাত দেখবো।”
সে এক মগ চা এনে আমার পাশে বসে বলল, “আজকে আমরা এক মগে চা খাবো।”
আমি উনার বাহুতে মাথা এলিয়ে বললাম, “যদি চাঁদের দেশে যাওয়ার সুযোগ আসে আপনি কী যাবেন?”
“নাহ।”
“কেন?”
“কিছু জিনিস দূর থেকেই সুন্দর এবং উপভোগ্য। আমি যদি এখন কাছে গিয়ে দেখি এটা ধূলাময় শিলা ব্যতীত কিছুই না তাহলে আর ভালো লাগবে! তার চেয়ে আমি সেই সুযোগ পৃথিবীর কোনো প্রান্তে যাওয়ার কাজে লাগানো শ্রেয় ভাববো।”
“আপনার ঘোরাঘুরি এতো পছন্দ?”
“হ্যাঁ। আমার অনেক ইচ্ছে বিভিন্ন দেশে ট্র্যাভেল করা। আচ্ছা তোমার পছন্দ কী? এমন কোনো উইশ বা হবি আছে?”
“এই বিষয়ে ভাবিনি আগে।”
“ওমা এতো গুলো বছর একটাও ভাবো নি বলো কী?”
“এখন নিজের ই অবাক লাগছে আমার কোনো উইশ নেই কেন!”
উনাকে বলতে পারি নি আমার উইশ ছিল কখনোই বিয়ে না করার, আর অনেক টাকা ইনকাম করার। যাতে আমার মা কে নিয়ে সেপারেট হয়ে যেতে পারি। সব কথা প্রকাশ করা যায় না। কিছু কথা একান্তই ব্যক্তিগত হয়। আমার জীবনের লক্ষ্য বা ইচ্ছা যে নাম ই বলি ছিল ঐ একটাই। এর বাইরে কখনো কিছু মাথাতেই আসেনি।
“হুমায়রা?”
“জ্বি?”
“আগামীকাল আমাদের বাসায় ফিরতে হবে। অফিস থেকে জরুরি কল এসেছে।”
“সমস্যা নেই, যথেষ্ট বেড়ানো হয়েছে।”
“ধন্যবাদ।”
“ধন্যবাদ কেন?”
“আমার পরিস্থিতি বোঝার জন্য।”
“আমি না বুঝলে কে বুঝবে?”
“তা ঠিক, তুমি তো আমার সোনা বৌ।”
সেন্টমার্টিন থেকে ফেরার পর তাশরিফ ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়লো। অফিস থেকে লেট করে ফেরে আবার সকালে তাড়াতাড়ি যায়। তাকে আমি বলতেও পারছিলাম না আমাদের বাসায় যাওয়ার কথা। মামা মামী আমাদের জন্য পথ চেয়ে আছেন। তাদের দেখতে যাওয়ার সময়টুকুও চাইতে পারছিনা। শেষে আম্মু কল করে বললো উনারা দু একদিনের মধ্যে চলে যাবেন, যেন গিয়ে চোখের দেখা হলেও দেখে আসি। অনেকটা সংকোচ নিয়ে তাকে বলি সে কথা। আমার ভয় ছিল সে হয়তো রেগে যাবে আমার বিবেক দেখে। বেচারা দিনরাত এতো খাটছে শান্তিতে ঘুমাতেও পারছেনা কাজের চাপে, আর আমি সেসব দেখেও নাইওর যাওয়ার কথা বলছি।
কিন্তু সে তেমন কিছুই করলো না। বরং আফসোসের গলায় বললো, “আমি শুনেছিলাম মামা মামী এসেছেন, তাও এতো দিন গিয়ে দেখা করিনি কি লজ্জার বিষয়। তুমি মনে করাবেনা একবার! ইশ কত কেয়ারলেস দেখালো আমায়।”
“আরেহ না না, আপনার কোনো দোষ নেই। আপনার অফিসে এতো চাপ যাচ্ছে উনারা বুঝেছেন। কিছু মনে করেননি।”
“হুমায়রা আমি যদি কাল অফিস যাওয়ার পথে তোমাকে ওখানে নামিয়ে দিয়ে রাতে যাই কোনো সমস্যা হবে? বাসায় ফেরার পর কোথাও বের হবার মুড থাকেনা তাই আর কি”
“সমস্যা নেই। তাহলে কাল সকালে একটু আর্লি করে বের হবো।”
“ওকে।”
আমার অনেক আনন্দ লাগছিল বাসায় যাবো ভেবে। কতদিন পর আম্মুকে দেখবো, উনার রান্না করা খাবার খাবো। সবচেয়ে বড় কথা হাত ছড়িয়ে লম্বা ঘুম দিবো। বিয়ের পর মায়ের বাড়িতে যাওয়া এতো আনন্দের হয় আমি জানতাম না। যদিও দেখতাম আপুরা বাড়িতে আসার জন্য শুধু উপলক্ষ খু্ঁজতো।
সকালে সবার জন্য চা নাস্তা বানিয়ে শাড়ি গয়না পড়ে রেডি হচ্ছিলাম তখন তাশরিফ বিছানায় শুয়ে আমার দিকে চেয়ে রইলো। আমি তাকে তাগাদা দিচ্ছিলাম তাড়াতাড়ি উঠে রেডি হতে, কিন্তু সে নড়ছিলোই না। বিরক্ত হয়ে বললাম, “আপনি উঠবেন নাকি আমি পানি আনবো?”
“পানি এনে ঢাললে তোমার ই কাজ বাড়বে। আমার কোনো সমস্যা হবেনা।”
“এমন করার মানে কী? উঠতে ইচ্ছে করছেনা যাবেন না আজকে?”
সে আড়মোড়া ভেঙে বললো, “এই মেয়ে এখন থেকে রোজ আমার সামনে বসে সাজবে। মাথায় থাকবে তো?”
“আপনার বুঝি অতো সময় থাকে আমার সাজ দেখার?”
“এতো দিন ছিল না এখন থেকে থাকবে।”
“আচ্ছা!”
“আল্লাহ কি করেছো এটা তুমি, সব গন্ডগোল করে দিলো তো?”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম আবার কী ভেজাল বাধিয়েছি আমি!
সে আমাকে জাপটে ধরে বললো, “এখন ঠিক আছে। সব পারফেক্ট।”
“এতো ঢং করতে পারেন আপনি, বললেই হতো জড়িয়ে ধরবেন।”
“বলে বলে রোমান্স করতে মজা আছে? আমি যদি বলি এই বৌ এদিকে আসো চুমু খাবো, এই বৌ এদিকে আসো জড়িয়ে ধরবো…কেমন লাগবে!”
“যান আপনিই জয়ী। হ্যাপি!”
“জয়ী হতে চাইলে তো হ্যাপি হতাম। আমি তো চাই চুমু খেতে, দিয়ে দাও হ্যাপিয়েস্ট পার্সন হয়ে যাবো।”
আমি তার গালে চুমু দিয়ে বললাম, হয়েছে এবার উঠুন। পরে সত্যি ই অনেক লেট হবে। কিন্তু বান্দার মাথায় শয়তানি ঘুরছে, সে কিছুতেই নড়লো না। বরং কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, “আমি গালে চাইনি ম্যাডাম। এরকম উপরি উপরি চুমুতে যে আমার মন ভরেনা।”
আমি তাকে একপ্রকার টেনে উঠিয়ে ঠেলেঠুলে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে বললাম, “অলরেডি ৮টা বেজে গেছে.. আল্লাহ কা ওয়াস্তে দ্রুত করুন।”
সে চেঁচিয়ে বললো, ” মনে রেখো কিন্তু আমি পাওনা বুঝে নিবো।”
।
বাসায় গিয়ে দেখি এলাহি অবস্থা। বড় চাচ্চু ফুফু আর আমার সব কাজিনরা একত্রিত হয়েছেন। এতো মানুষ উপস্থিত হবে এটা আমার আইডিয়া ছিল না। ভাগ্যিস তাশরিফ ফলমিষ্টি বোঝাই করে ভেতর অবধি এসে তারপর গিয়েছিল নয়তো সবাই মাইন্ড করতো। সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষে আমি নিজের ঘরে গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। পৃথিবীর সব আরাম এক দিকে আর নিজের রুমের বিছানায় শোয়ার আরাম এক দিকে। আমি বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে সাইড টেবিলের ড্রয়ারে থাকা ডায়েরী টা তুলে নিলাম। সেখানে আমি লাস্ট লিখেছি হলুদের রাতে। অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার উৎকণ্ঠার কথা প্রতিটি লাইনে স্পষ্ট। আমি কলম নিয়ে মুহূর্তে ই কয়েক পৃষ্ঠা লিখে ফেলেছি। এই ডায়েরী আমার সুখ দুঃখের সব স্মৃতি বহন করে আছে। তাই এটাকে আমি কঠোর নিরাপত্তায় রাখার চেষ্টা করি। এর লক কোড আমি ছাড়া কেউ জানেনা কোনোদিন জানবেও না ইনশাআল্লাহ।
লেখা শেষে এটাকে ড্রয়ারে রেখে আমি বেলকনিতে গিয়ে বসলাম। আমার রুম থেকে বিশাল একটা পাহাড় দেখা যায়। সেই পাহাড়ে উঁচু উঁচু দুটো গাছ আছে, যাদের দেখলে মনে হয় মুখোমুখি দুটো ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে সামনের দু পা উঁচু করে। আম্মু ঘরে ঢুকে বললেন, “কিরে এখানে বসে আছিস যে? কিছু খাবি না?”
“আমি নাস্তা খেয়েই এসেছি, তুমি এতো প্যারা নিও না তো।”
আম্মু আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “ওখানে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? ভালোভাবে মানিয়ে চলিস?”
“না চললে কী খবর পেতে না? এখন পর্যন্ত কল এসেছে কমপ্লেইন দিতে?”
“তুই কী এখনো আমার উপর রাগ জোর করে বিয়েতে রাজি করিয়েছি বলে?”
আমি হেসে বললাম, “রাগ করলে আসতাম ভাবছো? মরে গেলেও তো এমুখো হতাম না হু..”
“সবাই বলে তোর ভাগ্য ভালো, এতো ভালো জামাই পেয়েছিস। তোর বাবা তো ভীষণ খুশি তোকে নিয়ে।”
“তা তো হবেই অনেক বড় বোঝা কমেছে বলে কথা। যাই হোক ঐসব বাদ দাও তো, বলো আগে এখনো কী চিল্লাচিল্লি করে? আমি তো নেই কার রাগ ঝাড়ে এখন তোমার উপর? বলো না ছোটুর উপরেও রেগে যায়!”
আম্মু প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, হ্যাঁ রে মণি জামাইয়ের রাগ কেমন? মেজাজ ঠান্ডা নাকি গরম?”
“জানিনা, রাগ দেখিনি এখনো। দেখলে বুঝবো।”
“এখনো দেখিস নি তারমানে রাগ কম। দোয়া করি সেটা দেখার দিন না আসুক। আর রাগ হলেও তুই তর্ক করবিনা, চুপচাপ থাকবি। ছেলেরা তর্ক পছন্দ করেনা, এটা ওদের রাগ আরো বাড়ায়।”
আমি আম্মুর চোখে তাকিয়ে বললাম, “তুমি তো কখনো তর্ক করোনি, উঁচু গলায় কথা পর্যন্ত বলোনি কখনো তারপরও কেন এতো মারতো তোমায়? এতো রাগ দেখাতোই বা কেন?”
“সবাই এক না, কিছু মানুষের নাকের ডগায় রাগ থাকে। তোর বাবা সেই দলের লোক।”
আমি আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “এই দুনিয়ায় তোমার কঠিন পরীক্ষার ফল আখিরাতে মিষ্টি হোক। আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনাই করি। তুমি সুখি হও আম্মু অনেক অনেক সুখী হও।”
“শোনো মেয়ের কথা, কোথায় আমি এই দোয়া করে দিবো আমার শাশুড়ি আম্মা নিজে এই দোয়া করতেছে।”
“উহু আমি তোমার শাশুড়ির মতো দজ্জাল না। আমাকে হয় মা ডাকবা নাহয় মেয়েই ডাকবা শাশুড়ি আম্মা ডাকবা না।”
আম্মু হাসতে হাসতে বললেন, “যতোই বলিস লাভ নেই হয়েছিস তো দেখতে ঠিকি তার মতো..”
“এ আমার হতভাগা কপাল!”
আমার ছোট ভাই তূর্য কলেজ থেকে ফিরেই আমার কাছে এসে বলল, “আরেহ এটা কে! আমার বোন কই?”
“বাবা রে কয়টা দিন দূরে থাকায় বোনকে চিনতে পারছিস না?”
“তুই অনেক সুন্দর হয়ে গেছিস রে, কি মাখিস বলতো নাকি এসিরুমে থাকিস বলে সাদা হয়ে গেছিস!”
“তোর চোখের পাওয়ার কমে গেছে। ভালো মতো তাকাই দেখ আগের মতোই আছি। এক শেড ও পাল্টায় নাই।”
পাশ থেকে ফুফু বলল, “বিয়ের পানি পড়লে মানুষের গায়ের রং ফুটে উঠে। সেজন্য তানহাকে সুন্দর লাগেতেছে।”
“ফুফু তাহলে আমাকেও বিয়ে করাই দাও। আমিও আপুনির মতো গ্লো করি!”
“বিয়ে করলে বৌকে খাওয়াবি কী? এখনো তো চাকরি বাকরি কিছু করিস না।”
“আপুনি থাকতে যা খেতো তা বেঁচে গেছে না এখন ঐটা খাওয়াবো। আমার বৌ এতো রাক্ষস ও হবেনা যে তাকে খাওয়ানো কঠিন হবে। রিজিকের মালিক আল্লাহ।”
বড়চাচী বললো, “যুক্তি ঠিকাছে তা বলে দেখবো নাকি তোর বাবাকে?”
এমন সময় আব্বু উপস্থিত হলেন আমি আর ভাই স্বভাবতই চুপসে গেছি ভয়ে। ভাই দ্রুত নিজের রুমে চলে গেল। আমিও মায়ের সঙ্গে কাজ করার বাহানায় রান্নাঘরে ঢুকে গেলাম। চাচী আর ফুফু অন্য কথা বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করলেন। আব্বু বাজারের ব্যাগ রেখে বললো, “জামাই তো দুপুরে খাবেনা, রাতে ওর জন্য ভালোমন্দ রান্না করবা। রান্নায় যেন ত্রুটি না হয়। তোমার তো আবার মেহমান দেখলে লবণ মরিচ বাড়াই দিতে মন চায়…”
আমি ব্যাগ থেকে সদাই বের করে গুছিয়ে রাখতে শুরু করলাম। একটু আগেও বাসায় সবাই হাসি ঠাট্টা করলেও এখন সবাই চুপচাপ বসে আছে। এখানে ১৫জন+ মানুষ দেখে বোঝার উপায় নেই।
।
তাশরিফ অফিস শেষে আসতে আসতে রাত প্রায় ১১টা বেজেছে। আমাদের বাসায় সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে অভ্যস্ত বলে ইতোমধ্যেই অনেকেই ঘুমিয়ে কাঁদা। বড়োরা সবাই তার সঙ্গে খাবে বলে এখনো না খেয়ে বসে আছেন। তাশরিফ ফ্রেশ হয়ে বললো, “আমি কী বেশি দেরি করে ফেললাম?”
“নাহ ঠিকাছে। আপনি খেতে চলুন আব্বু বড় চাচ্চু মামা সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন.”
আমি তার পিছু পিছু গিয়ে ডাইনিং রুমে দাঁড়ালাম। বড় চাচী সবাইকে খাবার বেড়ে দিলো, আম্মু ও এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। আমি চুপচাপ পাশে দাঁড়িয়ে আছি। উনারা সবাই টুকটাক কথা বলে খাচ্ছেন। তাশরিফ হঠাৎ বলে উঠলো, “গরুর মাংস টা কে রান্না করেছে?”
তার কথায় সবার কথা বন্ধ হয়ে গেল। আম্মু ভয় পেয়ে গেলেন কোনো ভেজাল হলো কিনা ভেবে। কাঁপা গলায় বললেন,”বাবা কোনো সমস্যা হয়েছে? কিছু কী কমবেশি হলো?”
উনি আম্মুর চেহারা দেখে ভদ্রতার হাসি দিয়ে বললেন, ” না না আম্মা সেরকম কিছু না। আসলে এতো মজা হয়েছে এটা প্রশংসা না করে পারছিনা। এখন বুঝেছি হুমায়রার রান্না এতো মজা কেন হয়, আপনার থেকে শিখেছে কি না.”
আম্মুর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। উপস্থিত সবার ঠোঁটে হাসি ফুটলেও আব্বু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। বরং তাশরিফের গোস্ত পছন্দ হয়েছে শুনে তার পাতে কয়েক চামচ গোস্ত তুলে দিলেন। বড় চাচী আমার কানের কাছে ধীর গলায় বললো, “ভাগ্য করে এমন জামাই পেয়েছিস মণি, যত্ন করে রাখিস।”
আমি মনে মনে ভাবছি, “এই পরিবারের কোনো পুরুষ বৌয়ের প্রশংসা করেনা। রান্নার প্রশংসা ও যে করা যায় এটা বোধহয় তারা জানেই না। আজ পরের বাড়ির ছেলে দেখিয়ে দিলো কিভাবে প্রশংসা করা লাগে। দোষ ধরার বেলা সবাই পন্ডিত হলেও ভালো কথা কারো মুখেই আসেনা।”
খাওয়া শেষে রুমে ঢুকেই আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আমার এতো আনন্দ লাগছিল যা বলে বোঝানোর ক্ষমতা নেই। আমার এহেন কান্ড দেখে উনি বিস্মিত গলায় বললো, “কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে এতো আমূল পরিবর্তন! অনেক মিস করছিলে বুঝি?”
“হ্যাঁ অনেক অনেক অনেক মিস করছিলাম।”
“ঘটনা কী বলো তো? এতো আনন্দের রহস্য কী?”
“রহস্য কিছু ই না। আমার অনেক ভালো লাগছে আপনাকে স্বামী হিসেবে পেয়ে।”
“তাই নাকি? এক মহৎ ব্যক্তি ঠিকই বলেছেন নারীদের মন জয় করা এতোটাও কঠিন না।”
“অবশ্যই কঠিন না, একটু কেয়ার পেলেই আমরা গলে যাই।”
তিনি আমাকে কোলে তুলে বললেন, “লেট মি চেক কতটুকু গলেছ..”
আমি উনার কাঁধের কাছে কপাল ঠেকিয়ে বললাম, “আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি এটা কী আপনি জানেন?”
সে আরো উপরে তুলে বললো, “এতো আস্তে বললে হবেনা জোরে বলো কী বলেছো।”
“কিছু বলিনি”
সে আমাকে বিছানায় শুইয়ে বললো, “মনের কথা যখন মুখে চলে আসে তখন সেটা কয়েকবার বলতে হয় যাতে অপর মানুষের কান থেকে শুরু করে দেহের প্রতিটি কোষে সেই কথাটা ছড়িয়ে যায়। মস্তিষ্কে শক্তপোক্ত ভাবে গেঁথে যায় যাকে ভালোবাসি সেও ভালোবাসে….”
আমি দু’হাতে মুখ লুকিয়ে বললাম, “ভালোবাসি আপনাকে। অনেক অনেক ভালোবাসি…”
সে বিজয়ের হাসি দিয়ে আমার হাতের উপরেই চুমু দিয়ে বললো, “ধন্যবাদ ম্যাডাম আমাকে ভালোবাসার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।”
আমি হাত সরিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকালাম তার দিকে, “এটা কী হলো? ভালোবাসি বলার বিনিময়ে ধন্য…
কথাটা আর শেষ করতে পারিনি। সে পরম আবেশে আমার সমস্ত দেহ অসাড় করে দিলো, আমার চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে যায় তার একটি কর্মকাণ্ডে। হৃদস্পন্দন গতির তীব্রতা এতোটাই প্রকট হলো মনে হচ্ছিল এই বুঝি বুক চিরে বেরিয়েই আসছে। কিছু সময় পর দু’হাতের বাঁধন আলগা করে কপালে কপাল ঠেকিয়ে সে গাঢ় গলায় যখন বললো,”আমার জবাব কী হবে তা বুঝতে এখনো কী বাকী আছে হুমায়রা?”
আবেগে আমার চোখের কোণ ভরে আসে। সে আলতোভাবে অশ্রু মুছে বলে, “তোমাকে বুকের খাঁচায় রেখে দিতে ইচ্ছে করে জানো? যাতে পৃথিবীর কোনো দুঃখ তোমাকে ছুঁতে না পারে।”
আমি উনার গালে হাত রেখে বললাম, “বুকে কাঁপুনি তোলা কথা কোথায় শিখেছেন বলুন তো? হার্টফেল করে মরে যাই যদি!”
“এতো দূর্বল হার্টের অধিকারী হলে চলবে না। আমার ভালোবাসার তীব্রতা তো এখনো টেরই পেলে না, এইটুকুতে কাত হলে হবে?”
আমি একপাশে ফিরে বললাম, “আমাকে কেউ একটু আদর করে কিছু বললেই আমার কান্না পায়। সেখানে আপনি তো মাথায় করে রাখেন। আমি কোথায় রাখি আপনাকে বলুন তো?”
সে হাসলো মুখে কিছুই বললোনা, আমি নিরবতা টের পেয়ে তার দিকে ফিরলাম। সে তখনো এক ধ্যানে আমার দিকে ই চেয়ে আছে,
“তোমাকে যখন ই কাছে টানি এভাবে কাঁদতে হয় তোমার? এ কেমন কাঁদুনে বৌ পেলাম বলোতো?”
“আমি কাঁদুনে না, আপনার কাছে এলেই আমার কান্না পায়। আমি বুঝি না আবেগে কেউ এভাবে কান্না করে নাকি! কিন্তু আমি করি। কেন করি জানিনা…”
“এতো আবেগ রেখে লাভ কী বরকে একটা দিন নিজ থেকে চুমু খাওনা। আদর করে কাছে টানোনা, সব আবেগ ঐ চোখেতেই সীমাবদ্ধ!”
আমি তার কলার চেপে বললাম, “আমি বুঝি একবারও আপনাকে কাছে টানিনি? এতো বড় অপবাদ?”
“আমার তুলনায় কম অস্বীকার করতে পারবে?”
“যদি নির্লজ্জ ভাবেন?”
“কেন ভাববো? বরকে ভালোবাসবে না তো কাকে বাসবে? তাকে আদর করলেই বা নির্লজ্জ ভাবতে যাবে কে!”
“জানি না…”
“Now love me with all of ur soul & Let me love u too…”
আমি সংকোচ ছেড়ে তাকে কাছে টানলাম যতোটা কাছে টানলে দুটি প্রাণ একটি দেহে রূপান্তরিত হয়, কোনো অন্তরায় থাকেনা বিন্দুমাত্র ও না….
চলবে….