#সুখান্বেষণ (পর্ব:৬)
#আরশিয়া_জান্নাত
বিয়ের ১ম ১/২ বছর সবারই নাকি খুব সুন্দর কাটে, তারপর ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। এমনটাই সবসময় শুনি;দেখি। আমি আমার এক্সপেক্টেশন এর ঝুলি বরাবরই শূন্য রেখেছিলাম। জীবন নিয়ে আমার বিশেষ প্রত্যাশা কখনোই ছিল না। তাই যতটুকু পেয়েছি তা পুরোটাই মহান আল্লাহ তায়ালার অসীম করুণা। তাশরিফ আমার জীবনের সবচেয়ে বড় একটা ব্লেসিং এই কথা আমি অস্বীকার করতে পারিনা। উনি সবসময় এরকম থাকবেন কি না জানি না, আমার প্রতি তার আগ্রহ বা ভালোবাসা ও একই থাকবে কিনা নিশ্চয়তা নেই। তবে আমি বর্তমানটা পুরো মন দিয়ে উপভোগ করতে চাই। তার কর্মকান্ডে নিজেকে ভীষণ স্পেশাল মনে হয়। তবে এ ভেবেও ভয় হয় তার প্রতি আমার যে দূর্বলতা ক্রমশ বাড়ছে তা পরবর্তীতে ভোগাবে না তো? আমরা মেয়েরা খুব সহজেই মায়ায় পড়ে যাই, এই মায়ায় পড়ে হাসিমুখে কতকিছু যে ত্যাগ করে বসি! তাই আমার ভয় হয় মায়ায় জড়াতে…
দুপুরের খাওয়ার পর্ব সেরে ভাতঘুম দেওয়া বাঙালির সহজাত বৈশিষ্ট্য। এ বাসায় সবাই খুব ভোরে উঠে, দুপুরে খেয়ে একটু ঘুমায়। বিকেলে আসর নামাজের পর চা বিস্কুট খাওয়া হয়। সন্ধ্যার পর হালকা নাস্তা। রাতে ১০/১১টার মধ্যে ই খেয়ে ঘুম। আমাদের বাসায় ও বলতে গেলে এরকমই নিয়ম ছিল তাই সময়ের মারপ্যাঁচে খুব একটা ভোগান্তি আমার হয়নি। পার্থক্য এই ওখানে মা সব করতো এখানে আমি করছি। যদিও হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে দুজন আছে।
এখানে আমি অসুখী নই এটা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন আপনারা। শারীরিক ও মানসিকভাবে শান্তিতে থাকতে যা যা প্রয়োজন সবই এখানে আছে আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমার যে একটা মা আছে, যার জীবন এমন এক মানুষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে যে ভীষণ টক্সিক বলতে বাঁধা নেই। আমি ভাবতাম পৃথিবীর সব পুরুষ ই বুঝি স্বামী হিসেবে উনার মতোই হয়। রাগী মেজাজী সেজে থাকা বাবাদের সাধারণ ন্যাচার বা বৌ-সন্তানকে খাওয়ার খোঁটা দেওয়া নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। এটা সব বাবারাই করেন। আমি উনার বিহেভিয়ারে এতোটাই অভ্যস্ত ছিলাম আমার কাছে সত্যিই ঘরের কর্তা বলতে এই মডেল ই সেট হয়ে গিয়েছিল। সংসারে মায়েদের মতামত বলেও যে কিছু থাকে সেটা আমি জানতাম না। ঘরের পর্দা থেকে শুরু করে বাজারের ফর্দ সব যে মায়ের আয়ত্তে থাকে এই কমন ব্যাপার ও যেন আমার মাথায় আসেনি। আমাদের বাসায় সবকিছু উনার কথামতো হয়। ক্ষমতা থাকলে হয়তো ঘরের একটা পিঁপড়াও তার অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করতে পারতোনা।
আমি ছোট থেকে কি নিদারুন মানসিক যন্ত্রণায় বড় হয়েছি তা প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই। শাসন করা আর শোষণ করার মাঝে যে বিস্তর পার্থক্য আছে এটা বোঝার মতো সক্ষমতা হয়তো আমার বাবার নেই। আমি যখন ই খুব আগ্রহের সঙ্গে কিছু রান্না করেছি তিনি খেয়ে কোনোদিন প্রশংসা করেননি, বরং তিরস্কার করেছেন সবসময়। এ রান্না নিয়ে শ্বশুরবাড়ির ভাত জুটবেনা এমন বঞ্চনা করতেও দু’বার ভাবেননি। অথচ রিলসে দেখি বাবারা কত আদরে মেয়েদের আবদার মানেন, তাদের বিদঘুটে রান্না খেয়েও বলেন দারুন হয়েছে। অন্যদের কথা বাদ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সোমা ওর বাবার কথাই যদি বলি ও ভাত রান্নার সঠিক সময় বুঝেনা, বেশিরভাগ ভাত নরম করে ফেলে। ওর বাবা এ নিয়ে বকা তো দূর বরং বলে, আমার মেয়ে রাঁধতে বসেছে এটাই তো অনেক। একদিন ঠিকই শিখে যাবে।
না ওকে আমি হিংসে করিনা। ইনফ্যাক্ট আমি পৃথিবীর কোনো রাজকন্যাকেই হিংসে করিনা। আমার শুধু চাপা কষ্টে বুক ভার হয়ে উঠে। মনকে যতোই বলি সবাই সবদিকে সুখী হয়না, মন তবুও বিষাদে ডুবে। আমি আমার মা আর ভাইয়ের জন্য কষ্ট পাই। জানি ছোটোখাটো বিষয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করা বন্ধ হয়নি, আমি নেই তো কি হয়েছে ইস্যুর তো অভাব পড়েনা। ভাই সারাদিন কলেজ কোচিং নিয়ে ব্যস্ত থাকে, ঘরে কতক্ষন ই বা থাকে। তাই মায়ের জন্য মন কেমন কেমন করে। আমার জনম দুঃখী মা সুখী হোক এই প্রার্থনাই করি সবসময়।
গ্রাম থেকে অনেক গুলো কাঁচা আম আনা হয়েছে আচার দেওয়ার জন্য। আমার শ্বশুরের আমের আচার অনেক পছন্দ, তিনি ২বেলা ভাতের সাথে আচার খেতে ভীষণ পছন্দ করেন। তাই প্রতিবছর এই সময়ে বেশি করে আচার বানিয়ে রাখা লাগে। আম কুটতে বসে মা পুরনো দিনের গল্প বলছিলেন। এই আচার বানানো কে কেন্দ্র করে কত গল্প যে বের হলো। আমি সব মন দিয়ে শুনছিলাম।
তাশরিফকে অসময়ে দেখে মা বললেন,”কিরে আজ এই সময়ে চলে এলি সব ঠিক আছে তো?’
“হ্যাঁ ঠিক আছে। একটা মিটিং ছিল বাইরে, ওটা শেষ করার পর বস বললো আজকের জন্য ছুটি। তাই চলে এসেছি।”
“ভালো করেছিস। তানহা তুমি উঠে যাও তো মা। ফ্রিজে কাঁচা আমের শরবত বানিয়ে রেখেছি ওটা নিয়ে যাও।”
আমি উঠে উনার জন্য শরবত নিয়ে গেলাম। জনাব দেখি বেলকনিতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে বললো, “হুমায়রা তুমি আমাকে কতোটা বিশ্বাস করো?”
“যতোটা প্রয়োজন..”
“কতোটা প্রয়োজন?”
“পরিমাপ করে দেখিনি তো..”
“সবসময় টুইস্টার জবাব।”
আমি তার কাঁধে হাত রেখে বললাম,”কি হয়েছে বলুন তো? কোনো সমস্যা কি হয়েছে?”
“গুরুতর কিছু হয়নি। তবে মিটিং টা স্যাটিসফাইং ছিল না। বস খুব ক্ষেপে আছে।”
“মাঝেমধ্যে উত্থান পতন হয়, জীবনের পথ মসৃণ নয়। মন খারাপ করবেন না।”
“হুম সেটাই।”
“শরবত খেয়ে নিন, আপনার জন্য কিছু বানিয়ে আনবো? কী খাবেন বলুন?”
“ব্যস্ত হয়ো না। শান্ত হয়ে আমার সামনে বসো ওতেই চলবে।”
আমি গ্রিলে হেলান দিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়ালাম। সে বুকে দু’হাত ভাঁজ করে রেখে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালো। আমি হেসে বললাম, “এমনভাবে লুক দিচ্ছেন যেন আমি আসামি!”
“আসামিদের দিকে কেমন লুক দেয় এটাও জানো দেখছি! তা কোন অপরাধে জেলে গিয়েছিলে শুনি?”
“আসামিরা জেলে যায় নাকি? ওরা খোলা আকাশের নিচে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করে। জেল অবধি টেনে নেওয়ার সাধ্যি কার?”
“তাও ঠিক। এই হুমায়রা দেখি তো তুমি আমার কতটুকু সমান।”
বলেই তিনি আমাকে কাছে টেনে মাপতে লাগলেন।
“ওহো লাভলি হাইট, একদম বুক বরাবর মাথা..”
“আজ জানলেন যেন?”
“হ্যাঁ আজই তো জানলাম। আগে মেপেছি নাকি?”
“আইডিয়া তো হবার কথা।”
“অলস অনুমান করে সময় নষ্ট করে লাভ আছে?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, না না একদম ই নেই।
সে হেসে আমার নাক টেনে বললো, “এতো আদর লাগে তোমাকে দেখলে ইচ্ছে করে গাল টেনে দিই।”
“ইচ্ছে হলো গাল টানতে অথচ টেনে দিলেন নাক! আমার নাক টেনে টেনে লম্বা বানানোর ফন্দি আটছেন বুঝি?”
“তোমার নাকটা অনেক সফট, টেনে দিতে মজা লাগে। বোচা হলেও কিউট আছে।।”
“কিহ আমার নাক বোঁচা? ভালো মতো দেখেন মোটেও বোঁচা না।”
“ভালোমতো দেখলেই বোচা নাক খাঁড়া হয়ে যাবেনা। আমি তো বলিনি দেখতে খারাপ।”
আমি গাল ফুলিয়ে বললাম, “আমার নাক বোঁচা নাআআআ…”
“আচ্ছা যাও বোচা না চ্যাপ্টা।”
“ধুররর…”
“হুররর..”
“মজা নিচ্ছেন?”
“মজা দিচ্ছেন?”
“এই কি সমস্যা হ্যাঁ?”
“কি সমস্যা হ্যাঁ?”
“কপি করছেন?”
“কপি ভাবছেন?”
“আহহহ মেজাজ টাই বিগড়ে দিচ্ছে, পঁচা লোক।”
“হাহাহাহা…”
আসল ঘটনা জানা গেলো সপ্তাহখানেক বাদে। অফিসে সমস্যা বেঁধেছিল এ কথা এড়িয়ে গেলেও পরবর্তীতে যখন সে রিজাইন লেটার জমা দিয়ে বাসায় আসে কারোই বুঝতে বাকি থাকে না রোজ অসময়ে বাড়ি ফেরার কারণ।
তাশরিফের চাকরি চলে গেছে ব্যাপারটা যতোটা খারাপ হবার ছিল ততোটা হয়নি। বরং বাবা-মা দুজনেই ছেলেকে সাপোর্ট করে বললেন, “যেখানে তোমার কদর নেই সেখানে না থাকাই শ্রেয়। আমার বিশ্বাস খুব শীঘ্রই তুমি ভালো জব পেয়ে যাবে।”
আমি কিছু টা দুশ্চিন্তায় ভুগছিলাম, কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া চাকরি ছেড়ে দেওয়া কী উচিত হয়েছে? বাংলাদেশে ভালো চাকরি এখন সোনার হরিণের মতো। সহজে হাতের নাগালে আসেনা। যদিও তাদের ফিন্যান্সিয়াল অবস্থা অনেক ভালো, তবুও আমার ভয় হচ্ছিল। আসলে মিডলক্লাস ফ্যামিলিতে বিলং করেছি তো। আমার জন্য এসব ব্যাপার হজম হওয়া সহজ কথা নয়। কিন্তু আমি কিছু বলতেও পারছিলাম না পাছে সে ভুল বুঝে রাগ করে যদি।
তবে যতটুকু জানি তাশরিফ তার জব সেক্টরে তুখোড় মেধাবী। তাকে কোম্পানিতে নিতে কারোই আপত্তি থাকার কথা না। এখন দেখা যাক আল্লাহ রিজিকের ব্যবস্থা কোথায় রেখেছেন।
।
তাশরিফের চাকরি নেই কথাটা আমি আমার পরিবারের কাউকে ই বলিনি। বলার মতো বিষয় কি না তাও জানি না। তাশরিফ আজকাল খুব খিটখিটে থাকে। বিভিন্ন জায়গায় সিভি দিচ্ছে, ইন্টারভিউ দিচ্ছে কিন্তু মনমতো কোথাও পাচ্ছে না বলে জয়েন করছেনা। কাজের মানুষ বেকার হয়ে গেলে তাদের সময় কাটতে চায়না। সে চায় আমি সারাক্ষন তার পাশে থাকি যা মোটেই সম্ভব না। আমাকে সংসারের কাজ করতে হয়, সারাদিন রুমে বসে থাকা বাড়ির বৌয়ের পক্ষে সম্ভব হয়না বা এটা দৃষ্টিকটু ঠেকে এটা সে মানতে নারাজ। তার মতে বাসায় অনেকেই আছেন আমি ছাড়াও এসব চলতো। তো এখন কী সমস্যা! এমন না আমি সারাদিন রান্নাঘরে থাকি, তবে যতক্ষণ থাকি ও অযথাই ডাকাডাকি করবে, এটা ওটার বাহানায় নিয়ে যাবে। আমার কাছে এটা ভীষণ বিব্রতকর ও বিরক্তিকর ও বটে। মা ব্যাপারটা বুঝতে পারেন হয়তো। তাই তিনি ইচ্ছে করেই আমাকে কাজ দিয়ে পাশে বসিয়ে রাখেন বা তাকে বাজারের ফর্দ ধরিয়ে বলেন নিয়ে আয়। তাকে এঙ্গেজড রাখতে বাবাও বিভিন্ন অফিশিয়াল কাজ দেন। আমি সত্যিই অবাক হয়ে দেখি আমার শ্বশুর শাশুড়ি কত ধৈর্যশীল। প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে চাকরি ছেড়ে বসে আছে এ নিয়ে তাদের বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই, না একবার ও কোনো কটু কথা বলছে। অথচ আমি মেয়ে হয়েও কত কথা শুনেছি ইনকাম না করায়। আব্বু সবসময় আমাকে বলতো আমার মতো মেয়েরা টাকা রুজি করে সংসার চালায়, আর আমি ঘরে বসে বসে খাই। আমি আদৌতে বসে বসে খাইনি, টিউশন করে নিজের পড়ার খরচ থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ নিজেই চালিয়েছি। আমাকে ঈদে জামাকাপড় পর্যন্ত কিনে দেওয়ার দরকার পড়েনি। তারপরও তিনি আমাকে অপমান অপদস্থ করতেন। বাবারা সন্তানের ভালো চায় তাই এসব বলে” এই লজিক এট লিস্ট কেউ দিবেন না প্লিজ। সন্তানেরা সারাজীবন বাবা মায়ের আশ্রয়ে থাকেনা, তাদেরকে একসময় না একসময় ডানা ঝাপটে বেরিয়ে যেতেই হয় জীবনের তাগিদে। আমিও চলে এসেছি। দূর্ভাগ্য গ্রাস না করলে মৃত্যু পর্যন্ত এখানে ই থাকবো এটাই তো নিয়তি।
“ভাবি আসতে পারি?”
“হ্যাঁ আসো। কিছু বলবে?”
“তোমার সঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল, তুমি কী ফ্রি আছো?”
“দাঁড়িয়ে কেন বসো?”
“ভাইয়া কোথায় গেছে?”
“উনার ফ্রেন্ডদের সাথে দেখা করতে গেছে, দেরি আছে আসতে। কি বলবে বলো তো?”
নাফিসা ভীষণ চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে। সবসময় বাড়ি মাথায় তুলে রাখে টাইপ। ওর এই চঞ্চলতার জন্য আমার ওকে কেন জানি অনেক ভালো লাগে। তবে ওর একটা মুদ্রাদোষ আছে, ও প্রচুর খরুচে। মাঝেমধ্যে এমন বেহিসেবি খরচা করে বাড়ির সবাই না বকে পারেনা। যে কেউ খুব সহজে ওকে বোকা বানিয়ে টাকা নিয়ে ফেলতে পারবে। বিশেষত মেকাপ আইটেমের নাম বললে তো শেষ। যত টাকাই বলুক ও চোখ বন্ধ করে নিয়ে ফেলবে।
নাফিসার চেহারা দেখে গেস করতে পারছি ও আবারো এমন কোনো কাজ করেছে যাতে সবাই বকা দিবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ও বলল, “ভাবি তুমি কী মা কে বলবে আমি আর পড়াশোনা করতে চাই না, উনি যেন আমাকে বিয়ে দিয়ে দেন?”
আমি বিস্মিত হলেও মুখে প্রকাশ না করে বললাম, “কেন পড়াশোনা করতে কী সমস্যা?”
“আমি আর স্কুলে যাবো না ভাবি। আমার পড়াশোনা করতে ভালো লাগেনা।”
“নাফিসা কিছু কী হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে তোমাকে??
“পড়ালেখা করে লাভ কী? আমি যতটুকু পড়েছি নিজের ছেলেমেয়েকে পড়াতে পারবো, সংসারের খরচ হিসাব করতে পারবো। এইটুকু কী এনাফ না?”
“হ্যাঁ এনাফ, কিন্তু এখনের যুগে কেউ কী চাইবে এমন মেয়ে কে বৌ করতে যে মাধ্যমিক পাশ ও করেনি? তাছাড়া এখন সবাই হায়ার এডুকেটেড হতে চায়। তুমি উল্টো কেন ভাবছো খুলে বলো তো?”
“অনেক গুলো কারণ আছে, বলতে ইচ্ছে করছেনা। ”
“দু’একটাও কী বলা যাবেনা?”
নাফিসা কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলো। তারপর বলল, “আমাদের স্কুলে একটা স্যার আছে, উনি খুব বুলি করে। মেয়েদের দিকে বাজেভাবে তাকায়। আমার দিকেও তাকিয়েছে। আমি একদিন পড়া দিতে পারিনি বলে শাস্তি হিসেবে বলেছিল টিফিন ঘন্টার পর গিয়ে দেখা করতে। আমি ভয়ে যাইনি বলে ক্লাসে সবার সামনে আমাকে যা তা বলে অপমান করেছেন। এমনকি বলেছেন আমি ম্যাথে কীভাবে পাশ করি উনি দেখবেন। এমন কোনো দিন নেই উনি আমাকে বকেন না মারেন না। যেভাবে আমার বুকের দিকে তাকিয়ে থাকেন ভাবলেও গাঁ ঘিনঘিন করে উঠে।”
বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,” তুমি এতো দিন বলোনি কেন? একা একা এতো কঠিন সময় পার করছো। আমরা আছি কিজন্য হুম? ”
“তুমি তো জানো আমি এখন চাইলেও স্কুল বদলাতে পারবোনা। আমার রেজিস্ট্রেশন এখানে হয়ে গেছে। এসএসসি পর্যন্ত আমাকে এখানেই থাকতে হবে। স্যারের ভাবভঙ্গি তে আমি নিশ্চিত উনি আমাকে টেস্টে ফেইল করিয়েই ছাড়বেন। আমি কী করবো ভাবি? আমার স্কুলে যেতে একদম ইচ্ছে করেনা। আমি আর পড়াশোনা করবোনা…”
আমি নাফিসার হাসিখুশি চেহারা দেখে অভ্যস্ত, ওর কান্না সহ্য করা আমার জন্য কঠিন হয়ে উঠলো। নিজের উপর রাগ উঠলো আমি কেন খেয়াল করিনি ওর উপর কি ঝড় যাচ্ছে। কিছু দিন আগে ও বলছিল স্কুল ড্রেস আর পড়বেনা বোরকা পড়ে যাবে কিন্তু ওদের স্কুলে বোরকা পড়ার অনুমতি নেই। তাই মা ওকে বলল স্কুলে হিজাব পড়তে। অন্য সবজায়গাতেই নাহয় বোরকা পড়িস। কিন্তু ও মানতেই চাচ্ছিলো না। তখন বুঝিনি ও কেন এতো জেদ করছিল।
ক্রস বেল পড়ে ১০০ বার ঠিক করতো, হিজাবের ভাজ গাঢ় করতো যাতে কিছু বোঝা না যায়। আয়নার সামনে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে দাঁড়িয়ে দেখতো কিছু বোঝা যায় কিনা। ওর এইসব দেখে মা বিরক্ত হতেন। ১ঘন্টায় ও রেডি হওয়া শেষ হতোনা বলে কত বকা যে শুনেছে।
বেচারিকে আর কীভাবে বলি দোষটা ওর পোশাকের চেয়েও বেশি কুদৃষ্টির। যে কুদৃষ্টি দেওয়ার সে লোহার কাপড়ে মুড়িয়ে রাখলেও দিবে। ওদের দৃষ্টি থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই।
আমার মন মেজাজ ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ও যদি আমার বোন হতো আমি এখুনি ওকে এই স্কুল থেকে নিয়ে আসতাম যত টাকা লাগার লাগুক। এই স্কুলে আর পড়াবোনা। এখন বলতে পারেন এরকম ভাবনা তো কাপুরুষতার লক্ষণ আমার উচিৎ ঐ স্যারটাকে শায়েস্তা করার।
কিন্তু সত্যি করে বলুন তো আমি যদি কমপ্লেইন করি স্যারটার কী আদৌ কিছু হবে? এদেশে বিচার পাওয়া যায়?
রেইপ কেইসের আসামির ই কিছু হয়না আর এটা তো কিছুই না! পথেঘাটে,স্কুল-কলেজে, বাসে ট্রেনে যেখানেই যাবেন কুদৃষ্টি পড়বেই। চোখের ভাষা যতো নোংরা হোক, কথা বলার ভঙ্গি যতোই কুৎসিত হোক কোনো আইন কী আছে এর বিরুদ্ধে? নাকি কেউ কারোনামে বলতে পারবেন “এই লোকটা আমার দিকে বাজেভাবে তাকিয়েছে, তার নজর আমার **** দিকে ছিল?” বরং একদল চলে আসবে কিভাবে আপনার পোশাক বা চরিত্রকে দোষ দিয়ে দায়সারা হওয়া যায় তা বলতে। এই সমাজের প্রতি আমার খুব আক্ষেপ!
আমি নাফিসা কে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা পাইনা, বরং নিজেই মুষড়ে পড়ি কিভাবে এর সমাধান করা যায় ভেবে। আমি কী একবার তাশরিফের সঙ্গে আলাপ করবো ? উনার রিয়েকশন যদি আমার মনমতো না হয়? কিংবা উনিও যদি আর পাঁচ জনের মতো নাফিসাকেই দোষী ভাবে? আমি কী তাকে আর সম্মান করতে পারবো?
আমার ওভারথিংক আমাকে অস্থির করে তোলে। আমি ভয় পাই কোনো মেয়ে সন্তান কে গর্ভে ধারণ করতে। আমি ভয় পাই এই বর্বর পৃথিবীতে কোনো মেয়েকে আনতে….
চলবে,