আমার স্নিগ্ধপরী পর্ব-০৯

0
6

#আমার_স্নিগ্ধপরী
#পর্ব_৯
#লেখা: #নীল_মালতীলতা

কপি নিষিদ্ধ ❌❌❌

নতুন একটা সকাল। নতুন সকাল মানে নতুন কিছুর সূচনা। নতুন একটা দিনের শুরু মানেই নিজেকে স্বপ্নের ধাপে আরও এক পা এগিয়ে নেয়া। নতুন করে আরও একবার প্রকৃতিকে উপভোগ করার সুযোগ পাওয়া।
স্নিগ্ধা সারারাত ছটফট করে ভোর রাতের দিকে একটু ঘুমিয়ে ছিল। সেই ঘুম আবার ভেঙে গেল সুমধুর কন্ঠের আযানের ধ্বনিতে। স্নিগ্ধা আর বিছানায় থাকেনি, ওযু করে নামাজ পড়ে আল্লাহর দরবারে দুই হাত তুলে নিঃশব্দে কিছু চাইল। এরপর খানিকক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত করে মনটাকে শান্ত করল। সেই রাত থেকে পেটে কিছুই পড়েনি, খুধায় বেশ অস্বস্তি হচ্ছে স্নিগ্ধার। রাতের কথা মনে পড়তেই শরীরে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হতে লাগলো,, লোকটা তখন কি বলছিল ছি কি লজ্জা,,, এখন এই লোকের সামনে কিভাবে মুখ দেখাবে এক বাড়িতে থাকলে তো সামনাসামনি হতেই হবে,, স্নিধার আকাশ কুসুম ভাবনার মধ্যে খাবার হাতে ঢুকলেন ফারজানা তালুকদার। সামান্য কিছু এনেছেন, রাতে ছেলে মেয়ে দুটো কেউই খায়নি। তাই তিনি দুজনের জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন। ছেলের ঘরে খাবার রেখে এসেছেন। এরপরে স্নিগ্ধার রুমে এলেন। রাহাতকে তিনি জোর করে রাতে খাইয়েছিলেন কিন্তু এই দুটোকে খাওয়াতে পারেননি। তাইতো সকাল সকাল এই আয়োজন,,

স্নিগ্ধা মা নে এগুলো খেয়ে নে তারপরে আবার একসঙ্গে নাস্তা করবি তাই অল্প কিছু এনেছি,,

আম্মু এসবের কি প্রয়োজন ছিল,,

পেটে ক্ষুধা নিয়ে এ কেমন কথা,, তোদের দুজনের কি হয়েছে বলতো?? ফাইয়াজ তোকে কিছু বলেনি তো আবার?? দুজনেই উপোস থাকার মানেটা কি??

ফারজানা তালুকদারের কথা শুনে স্নিগ্ধার শরীরে একটা ঝাকি লাগলো,, ফারজানা তালুকদারের দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে বলল,, দুজন কোথায় পেলে আম্মু??

রাতে তুই খাস নি মাথাব্যথা করছে বলে, আর ওদিকে ছেলেটা খায়নি পেটে খিদে নেই বলে, কোথায় কি নাকি খেয়ে একেবারে পেট মন সব নাকি ভরে রয়েছে অদ্ভুত কথাবার্তা যতসব,

ফারজানা তালুকদারের কথা শুনে স্নিগ্ধার অদ্ভুত লাগতে শুরু করলো,, মনে মনে ভাবতে লাগলো,, লোকটা তো তাই বলেছিলো? তার মানে,,আর ভাবতে পার না স্নিগ্ধা তার কান গরম হয়ে উঠল,,

ফারজানা তালুকদার স্নিগ্ধাকে খাওয়ার কথা বলে চলে যাচ্ছিলেন নিজের কাজে, তখন স্নিগ্ধা বলল,, আম্মু আজ নাস্তা আমি বানাই??

একদম রান্না করে পা রাখবি না,, কাল সারারাত কিচ্ছু খাস নি এখন খাবার খেয়ে রেস্ট করবি,, চোখ দেখে তো মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমোসনি নিশ্চয়ই ভীষণ মাথাব্যথা করেছিল? আমিও কেমন সেই তোর একটু খোঁজখবরও নিলাম না,,

আহ আম্মু আমি একদম ঠিক আছি তুমি কোন চিন্তা করো না, আমার কোন অসুবিধা হলে তো আমি তোমাকে নিজেই ডেকে নিতাম,

ঠিক আছে মা খাবারটা খেয়ে নে,,

স্নিগ্ধা টুকটাক কিছু মুখে দিলো,, এরপর সারা ঘরময় পায়চারি করতে লাগলো, ভাবতে লাগলো ফারজানা তালুকদারের তখন কার কথা,, খারুশটাও রাতে খায় নি? উহ তাতে আমার কি!! কিন্তু সে তো বলল না খাওয়ার কারণ,, উহ কি হচ্ছে এগুলো,,, স্নিগ্ধার বেশ অস্বস্তি হতে লাগল ,, নিজেকে শান্ত করার জন্য এখন একটু নিজেকে প্রকৃতির মাঝে বিলিয়ে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি, স্নিগ্ধা নিজের দরজা টা খুলে উঁকি দিয়ে দেখলো যে ফাইয়াজ আর তার পাশের রুমের দরজাটা খোলা কিনা,, যখন দেখল দুটো রুমের দরজাই বন্ধ, তখন আর নিজেকে আটকালো না,, নিজেকে পরিপাটি করে চলে গেলো বাগানে যেখানে আছে হরেক রকমের ফল ফুলের গাছের সমারহ।
স্নিগ্ধার পরনে আছে পিংক কালারের একটা লং গাউন, যা তার পা পর্যন্তই ঢাকা আর হাতাটাও লং এবং চুরি হাতা। কোমরের দিকে আবার নিজের পাড়ে আবার হাতার সামনে সোনালী কালারের হালকা কাজ, আর মাথায় বেঁধে নিয়েছে একটা সোনালী রঙের হিজাব। দেখে মনে হচ্ছে যেন কোন রাজ্যের রাজকুমারী চলে এসেছে এই বাগানে,, অবশ্যই সে এই রাজ্যেরই রানী।

,
,

ফাইয়াজ যখন স্নিগ্ধার খুব কাছে চলে যাচ্ছিল তখন স্নিগ্ধার ছটফটানিতে তার হুঁশ ফিরে আসে,, সে তাৎক্ষণিক নিজেকে সামলে ছুটে চলে আসে তার রুমে, বেশ শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করে নিজের গা টা বিছানায় এলিয়ে দেয় কেমন যেন দুর্বল লাগছিল তার,, যখন সে বিছানায় গড়াগড়ি করছিল তখন মনে হল বিছানার এই গন্ধটা তার চেনা, যেটা এক সপ্তাহ আগেও কখনোই সে এই বিছানা থেকে পাইনি। হ্যাঁ একটু আগে এরকমই একটা স্মেল আসছিল স্নিগ্ধার শরীর থেকে,, বেশ সময় করে স্মেলটা টেনে নিলো তার নিজের ভিতর,, সারারাত ওভাবেই পড়ে রইল,
ফাইয়াজ স্নিগ্ধার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে প্রত্যেকটা ঘটনা স্মরণ করতে করতেই যেন তার রাত কেটে গেল,,
উহ,, আমার স্নিগ্ধপরী তুমি আমার চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছো,, ফারজানা তালুকদার খাবার রেখে গেলেও সেটা ফাইয়াজের খাওয়ার আর ইচ্ছে হয়নি। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করেও যখন অস্থিরতা কাটছিল না তখন সে একটু নিজেকে শান্ত করার জন্য গেল তার রুমের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দায়,, নিজের শরীরটাকে একটু ঝাকিয়ে ঠিক করে নিল। এদিক ওদিক চোখ ঘোরাতেই হঠাৎ চোখ আটকে গেল বাগানে দাঁড়িয়ে থাকা এক গোলাপী রাজকন্যার দিকে। এই বাড়িতে একটাই রাজকন্যা আছে আর সেটা তারই রাজ্যের রানী। ফাইয়াজ আর এক মুহূর্ত দেরি করল না ছুট লাগালো সেখানে যেখানে তার ব্যক্তিগত রাণী দাড়িয়ে আছে,,, দৌড়ে গিয়ে স্নিগ্ধার থেকে কিছুটা দূরেই থামল ফাইয়াজ, এবার আস্তে আস্তে একপা একপা করে এগিয়ে গেল কাঙ্খিত রমনীর দিকে, যে এখন ব্যস্ত ফুলগুলোকে ছুঁয়ে দিতে আবার মাঝে মাঝে ঝুকে ঝুঁকে সেই ফুলের ঘ্রাণ নিচ্ছে, কি মনোরম সে দৃশ্য!!! আবার একটু থেমে থেমে গুনগুন করে গানও গাইছে কোকিল কন্ঠে,,

শুভ্র আকাকের নিচে দাড়িয়ে
আমার স্নিগ্ধপরী
কোমল কন্ঠে গান গায় সে
জুড়ায় পরান আমারি

ফুলেরাও দোলে দেখো নির্মল হেসে
হয়তো জানতে চায় সে কোন অপরূপা কে সে??

পেছন থেকে পরিচিত এক কণ্ঠস্বরে এমন একছন্দ ভেসে আসতেই স্থির হয়ে গেল স্নিগ্ধা,,

এমন কেন হলো? সে তো দেখে এসেছিল ওই ঘরের দরজাটা বন্ধ।

স্নিগ্ধপরী তুমি একা কেনো ? এরকম একটা সুন্দর মুহূর্তের সুন্দর ওয়েদারে তোমার এই আস্তো একটা জামাইকে ছেড়ে তুমি একা একা ফুলবিলাস করছো??

স্নিগ্ধা এবার আর নিজের রাগকে আটকাতে পারল না, তড়িৎ গতিতে ফাইয়াজের দিকে ফিরে কন্ঠে রাগ মিশিয়ে বলল,,, মি. তালুকদার আপনার মনে হচ্ছে না এবার আপনি একটু বেশি বেশি করে ফেলছেন??

একদমই না আমার এমনটা কেন মনে হতে যাবে? আমি তো আর পরনারীর সঙ্গে কিছু করছি না, অবশ্যই আমার বউয়ের সঙ্গে করছি সো আই এম চিল।

স্নিগ্ধা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,, আপনাদের মতন শহরের কিছু বড়লোক বাবার ছেলেরা আসলে এমনই,, যখন ইচ্ছা হলো ছুড়ে ফেলে চলে গেল আবার যখন ইচ্ছে হলো কাছে টেনে নিল,, কারণ তাদের তো ক্ষমতার শেষ নেই। আবার যখন শখ মিটে যাবে তখন আবার ছুড়ে ফেলতেও দ্বিতীয়বার ভাববে না। তা এই গ্রামের আনস্মার্ট ক্ষ্যাত মেয়েকে দেখে নিশ্চয়ই আপনারা এমন কোন ইচ্ছাই জেগেছে, বড়লোকে বাবার একমাত্র ছেলে বলে কথা। তবে মনে রাখবেন আমি গ্রামের মেয়ে হলেও, রাস্তার মেয়ে নয়। আপনি যেমন আপনার বাবার রাজপুত্র তেমনি আমিও আমার বাবার রাজকন্যা তাই ভুলেও এমন কোন চিন্তাভাবনা করবেন না আশা করি। আমাকে মোটেও সস্তা ভাববেন না যে যখন চাইবেন কাছে টেনে নিবেন আর যখন চাইবেন ছুড়ে ফেলে দিবেন। খুব খুশি হব আপনি আমার কাছাকাছি না আসলে।

ফাইয়াজের বুকটা কেঁপে উঠলো এমন তাচ্ছিল্য ভরা তিক্ত কথাগুলো শুনে।

স্নিগ্ধা কথাগুলো বলে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না, এসেছিল মনটা ফ্রেশ করতে হয়ে গেল তার উল্টোটা, কোন দিকে না তাকিয়েই হাঁটা দিল নিজের ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে, পথিমধ্যে দেখা হল এক অপরিচিত লোকের সাথে, তবে ধাক্কা লাগার আগেই নিজেকে থামিয়ে নিলো স্নিগ্ধা, রাহাতের পা দুটোও থেমে গেছে, ততক্ষণে ফাইয়াজও পেছন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। একবার স্নিগ্ধার দিকে তাকালো তো একবার রাহাতের দিকে, স্নিগ্ধার চোখে মুখে রাগের আভাস, তবে রাহাতের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু ঠাওর করা গেল না। ফাইয়াজ সেদিকে এগিয়ে এসে, স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বলল,, আমার ভাই ও বন্ধু রাহাত, আর রাহাতের দিকে তাকিয়ে বলল ,, আমার স্ত্রী স্নিগ্ধা,, ফাইয়াজের শেষের কথাটা শুনে স্নিগ্ধার বেশ রাগ লাগলো।
কথায় কথা বাড়বে, আর কথার আঘাতের কষ্ট কখনোই সারে না তাই স্নিগ্ধা কিছু না বলেই চুপচাপ সেখান থেকে চলে গেল,, রাহাত শুধু নিঃশব্দে দেখে গেল স্নিগ্ধার প্রত্যেকটা পদক্ষেপ। ফাইয়াজও ব্যথীত নয়নে তাকিয়ে রইল স্নিগ্ধার দিকে। চোখের আড়াল হওয়ার পর রাহাত এসে হাত রাখল ফাইয়াজের পিঠ চাপড়ে সান্তনার সুরে বলল,,

তোদের দেখা তো কালকেই হল, এর আগে তুই যা যা করেছিস তার সামনে এটুকু কিছুই না, তুই ধৈর্য ধরে চেষ্টা কর দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। মানানোর চেষ্টা কর নিজেকে ওর মনের মত তৈরি করার চেষ্টা কর, জোর করে কিন্তু কিছু হয় না, বলে সেখান থেকে সেও চলে গেলো।

,
,

কেটে গেল আরো এক সপ্তাহ, এই এক সপ্তাহ ফাইয়াজ অনেক ছটফট করেছে স্নিগ্ধার সাথে একটু কথা বলার জন্য, স্নিগ্ধার হাতটা ধরার জন্য, তবে সে রকম কোনো সুযোগই স্নিগ্ধা দেয়নি।

ফজলুল তালুকদার আর ফারজানা তালুকদার ও বেশ লক্ষ করেছেন ছেলে মেয়ে দুটোর নীরব যুদ্ধ। ছেলে যে তার বউয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে তা বুঝতে তাদের কারোরই বাকি নেই। ফারজানা তালুকদারের বিশ্বাস ছিল নিজের ছেলের উপর, আর তা হলোও সত্যি, কিন্তু এদের এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে তা তিনি ঠাওর করতে পারলেন না। একই ভার্সিটিতে দুজন গেলেও দুজনের পথ আলাদা থাকে। ফজলুল তালুকদার একবার বলেছিলেন ফাইয়াজের সঙ্গে যাওয়ার জন্য, জবাবে স্নিগ্ধা বলেছিল,,

আব্বু আমাকে নিয়ে যদি তোমাদের সমস্যা হয় তাহলে আমাকে বরং হলে থাকার ব্যবস্থা করে দাও,

ব্যাস আর কেউ কিছু বলার সাহস করে ওঠেনি,,,

ফাইয়াজ অবশ্য অনেক ভাবেই মানানোর চেষ্টা করেছে স্নিগ্ধাকে,,

আজ নাস্তার টেবিলে ফজলুল তালুকদার জানালেন, তাকে এক্ষুনি বেরিয়ে যেতে হবে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্য অবশ্য রাতেও একবার জানিয়েছিলেন এখন আরো একবার জানানোর কারণ হলো,, তিনি ফাইয়াজের দিকে লক্ষ্য করে বললেন,, এইতো আজ আমাকে এক্ষুনি বেরিয়ে যেতে হচ্ছে তুমি বরং স্নিগ্ধা মা কে নিয়ে যেও,,

ফাইয়াজ আগ্রহের সাথে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধার দিকে সে কি উত্তর দিবে তার আসায়,,

স্নিগ্ধা মা তুমি বরং আজকে ফাইয়াজের সঙ্গে চলে যাও। এই শহরে আমি তোমাকে একা ছাড়তে মোটেও সাহস পাচ্ছি না মা,, না কোরো না মা

ঠিক আছে আব্বু,,

তার উত্তর শুনে ফাইয়াজের খুশির শেষ নেই, এখন একটু লাফালাফি করার অতীব জরুরী তাই সে খাওয়াটা দ্রুত শেষ করে দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেল,

ফাইয়াজকে এত দ্রুত খাওয়া শেষ করে এভাবে ছুটে রুমে চলে যেতে দেখে সবাই অবাক দৃষ্টিতে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল,,

অন্যদিকে ফাইয়াজ রুমের মধ্যে গিয়ে উলালা উলালা করে কয়েকটা লাফ দিল,,,

চলবে???