#আমার_স্নিগ্ধপরী
#পর্ব_১৭
#লেখা: #নীল_মালতীলতা
কপি নিষিদ্ধ ❌❌❌
মাঝে মাঝে আমাদের সামনে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু চলে আসে যা আমাদের কল্পনারও বাইরে। ফাইয়াজের সাথেও সেই পার্সেল থেকে শুরুকরে একএকটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেই চলেছে, যা প্রত্যেকটাই তার ভাবনার বাইরে,
ফাইয়াজ স্নিগ্ধার ডাইরির ভাজে লুকানো খামটা খুলে এমন কিছু দেখবে তা সে কোনোদিনও কল্পায়ও আনেনি। তার সাথে অন্য একটা মেয়ের ঘনিষ্ঠ কিছু ছবি। তবে মেয়েটার চেহারা স্পষ্ট নয়। তবে ছবিগুলো দেখলেই মনে হবে তাদের গভীর প্রেম চলছে। তার কাছেও এমন একটা খাম আছে। যেখানে এই ছবিগুলোর সম্পূর্ণ বিপরীত। এখানে তার সাথে অন্য মেয়ের ছবি আর সেখানে স্নিগ্ধার সাথে অন্য ছেলের ছবি। যা দেখে ফাইয়াজ প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিল ভীষণ। তার স্নিগ্ধপরী অন্যকারো এই কথাটা ভাবতেই তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। সে খুব গোপনে পরীক্ষা করে যখন দেখলো ছবিগুলো এডিট করা তখনই নিশ্চিন্ত হয়, তবে এমন নিকৃষ্ট কাজ কার হতে পারে ভেবে খানিক বিচলিত হয়। যে এহেন কাজ করেছে তার নিশ্চয় ভালো কোনো উদ্দেশ্য নেই, অনেক ভেবেও এর সমাধান ফাইয়াজ পায়নি। তবে এখন তার কাছে সব কিছুই পরিষ্কার। কিন্তু কেনো? এই কেনোর উত্তরটা ফাইয়াজের জানা নেই। ফাইয়াজের বুকের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে এমন অনুভুতি হচ্ছে। চেনা প্রিয়জন যখন অচেনা হয়ে যায় সেই কষ্ট কিভাবে সয্য করে মানুষ?
হঠাৎ ফাইয়াজের মস্তিষ্ক নাড়া দিয়ে উঠল, স্নিগ্ধপরী ছবিগুলো দেখে তাকে ভুল বোঝেনিতো? ভয় জেকে ধরল ফাইয়াজের অন্তরে, সে ডাইরিতে চোখবোলালো, ডাইরির যেই ভাজে খামটা ছিলো সেই পাতায় লেখা,,
আমি আপনাকে বিশ্বাস করি, কোনো অচেনা শুভাকাঙ্ক্ষীকে নয়।
লেখাটা দেখে ফাইয়াজের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো, আমার স্নিগ্ধপরী আমাকে বিশ্বাস করে। আমাকে ক্ষমা করে দিও আমার পরী প্রথমে তোমাকে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি ভেবেছিলাম তুমি অন্যকারো। ফাইয়াজের নিজের প্রতি তাচ্ছিল্যতা এসে গেল, মনে মনে ভাবলো, যার জন্য হৃদয় ব্যকুল তাকে বিশ্বাস করতে পরিক্ষা করলাম, আর সেই মানুষটা আমাকে নিঃশব্দে বিশ্বাস নিয়ে বসে রইলো।
ফাইয়াজ নিজের মোবাইলটা বের করে স্নিগ্ধার একটা ছবি বের করলো, যা সে স্নিগ্ধার আড়ালে ক্লিক করেছিলো। ছবির সাথে সে একাএকাই বলছে, আর মাত্র কয়েক ঘন্টা একটু কষ্ট করো আমার পরী, তার পরই তোমাকে আমি আমার বক্ষ পিঞ্জিরায় লুকিয়ে রাখবো একটুও কষ্ট পেতে দিব না।
,
,
রাতে কারোই ঘুম হয়নি, রাহাত খুব ভোরেই বেরিয়ে গেছে সবাইকে বলে, ফাইয়াজও বেরিয়েছে রাহাতকে ফলো করতে। তার ধারণা রাহাতকে ফলো করলেই সে স্নিগ্ধাকে পেয়ে যাবে। ফাইয়াজ নিজের বাবা মা আর স্নিগ্ধার বাবা মা সবাইকেই ঢাকায় আসতে বলে দিয়েছে। স্নিগ্ধাকে ঢাকাতেই পাওয়া যাবে আর ফাইয়াজ তাকে নিয়ে সরাসরি তালুকদার ম্যানশনে যাবে এটাই বলে এসেছে,,
তবে তারাও ফাইয়াজকে ফলো করছে , পাছেনা আবার ছেলেটা বিপদে পড়ে যায়, স্নিগ্ধার ছোট দুই ভাই বোনকে বাড়িতেই রেখে এসেছে কাছে পিঠের দু-একজন আত্মীয়-স্বজন আর বাড়ির কাজের লোকেরা তো আছেই।
,
,
বেশ নামিদামি একটা ফ্লাটের সামনে এসে থামল রাহাত, এবার সোজা চলে গেল আট তলার একটা আলিশান ফ্লাটে। যেখানেই তার দুইজন প্রিয় নারী আছে, একজন তার আদরের বোন আরেকজন তার সুস্মিতা স্নিগ্ধা তালুকদার। তিন রুমের একটা ফ্লাট। ফ্ল্যাটের ভিতরে সম্পূর্ণ আভিজাত্যে ভরা। এরপর চলে গেল তার আলিশান রুমে যেখানে তার সুস্মিতাকে রাখা আছে। ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ল সোফায়, শান্ত চোখে থাকালো নরম বিছানার দিকে, যেখানে ঘুমিয়ে আছে ক্লান্ত মুখের স্নিগ্ধা।
এই মেয়েটাকে সে প্রথম যেদিন দেখেছিল সেদিন এই মেয়েটা নিজের অজান্তেই তার মনটা চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। দিনটা ছিল রবিবার। রাহাত নিজেও ঢাকা ভার্সিটির একজন স্টুডেন্ট। তার ইচ্ছা ছিল তার বোনও এখানে পড়াশোনা করবে তাই সে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল, যেদিন স্নিগ্ধা এসেছিল পরীক্ষার দিতে, সেদিন রাহিও এসেছিল পরীক্ষা দিতে। আর রাহিকের রাহাতই নিয়ে এসেছিল। সেদিনই রাহাত দেখেছিল স্নিগ্ধাকে। বোনের পরীক্ষা শেষে তাকে আনতে গিয়ে দেখে পরীক্ষা দিয়ে হাসিমুখে বেরিয়ে আসছে হল থেকে এক রমণী মুখের সেকি নজরকাড়া হাসি, মেয়েটার নাম জানে না রাহাত, তাই নিজের অজান্তেই এমন সুন্দর হাসির মেয়ের নাম দিয়েছিল সুস্মিতা। রাহাত এক নজরে তাকিয়ে ছিল স্নিগ্ধার দিকে। কখন যে স্নিগ্ধা তার চোখের আড়াল হল টেরও পায়নি। রাহি সেদিন অন্ধকার মুখ নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল হল থেকে। তার পরীক্ষা খুব একটা ভালো হয়নি। বারবার রাহাতকে ডাকার পরেও যখন রাহাতের কোন সাড়া পাচ্ছিল না, তখন জোরে ধাক্কা দিয়ে বলেছিল,, ভাইয়া কি হয়েছে কি ভাবছিস??
রাহাতের হুশ ফিরে এলে সে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে তার সুস্মিতা হারিয়ে গেছে,
রাহি ফের বলে, কি হয়েছে ভাইয়া কাউকে খুজছিস?
না তেমন কিছু না। তোর পরীক্ষা কেমন হয়েছে?
সরি ভাইয়া খুব একটা ভালো হয়নি।
বাবা মা হারা বোনকে রাহাত সবসময়ই খুব আদরে রাখার চেষ্টা করে, ঠিক আছে কোন ব্যাপার না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়তে হবে এমন কোন কথা নেই, চেষ্টা করেছিস পারিস নি, ঢাকাতে কি ভার্সিটির অভাব আছে একটা ভালো ভার্সিটি দেখে তোকে ভর্তি করে দেবো মন খারাপ করার কিছু নেই।
রাহাত সেই হাসি আর ভুলতে পারেনি।যখনই সে রাস্তায় কোথাও বেরিয়েছে আশেপাশের সে সর্বদাই সেই হাসির মালিককে খুঁজে বেরিয়েছে।
যখন সে ফাইয়াজের বাড়িতে প্রথম স্নিগ্ধাকে দেখলো তখন যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। আর যখন জানতে পারলো এই মেয়েটাই তার বন্ধুর বউ তখন যেন তার দুনিয়া উল্টে গেল।
রাহিও এসে ভাইয়ের পাশে বসলো, সে দরজার শব্দ পেয়ে বুঝতে পেরেছি তার ভাই এসে গেছে। তাই সে ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এলো,
রাহাত বোনকে দেখে বলল, ওকে এত ক্লান্ত লাগছে কেনো?
আসলে ভাইয়া কাল থেকে কিছু খায় নি তাই হয়তো,
রাহাত আর কথা বাড়ালো না, এরকম পরিস্থিতিতে খেতে না চাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, জ্ঞান ফিরেছিল কখন?
রাতেই, তারপর পাগলামি করছিল তাই আবারও,,
মানে কি রাহি তুই ওকে বারবার অজ্ঞান করে রেখেছিস?
সরি ভাইয়া, মানানো যাচ্ছিল না,
মানানো যাচ্ছিল না, নাকি ওর উপরে রাগ ঢেলেছিস, এরপর যদি এমন কিছু দেখি তাহলে তোকে তোর চাওয়া আমি কখনোই পেতে সাহায্য করবো না।
সরি ভাইয়া,
ওদের কথার মধ্যে স্নিগ্ধার চোখ পিটপিট করে উঠলো। জ্ঞান ফিরলে মাথাটা বেশ ভার মনে হলো স্নিগ্ধার। কোনরকম মাথাটা চেপে উঠে বসলো।
স্নিগ্ধার জ্ঞান ফিরে আসায় রাহাত আর রাহীর নজর সেদিকে গেল।
স্নিগ্ধা দুই হাতে মাথা চেপে ধরা চোখ দুটো বন্ধ, এমন অবস্থায় সে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করছে, পানি, পানি,
রাহাত তরঘরি করে বেড সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে ধরল স্নিগ্ধার মুখের সামনে।
স্নিগ্ধা চোখটা আলতো খুলে চোখের সামনে পানির গ্লাস দেখে সে কোন দিকে না তাকিয়ে পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢগঢগ করে পানিটুকু খেয়ে নিল। এরপর নিজেকে ঠিক করে পানির গ্লাসটা যখন সামনে থাকা ব্যক্তিকে দিতে যাবে তখনই তার দিকে চোখ পড়ে, রাহাত ভাইয়া,,,
স্নিগ্ধা তরিঘরি করে খাট থেকে নামলো, তার গায়ে এখনো সেই কালকের বিয়ের শাড়ি,
রাহাত ভাইয়া, আপনি! নিশ্চয়ই আপনার বন্ধুও এখানে এসেছে। আপনারা আমাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছেন তাই না? স্নিগ্ধা যেন একটু সাহস পেল ,, কোথায় আপনার বন্ধু?
রাহাত শান্ত চোখে স্নিগ্ধার পাগলামি দেখছে, রাহি স্নিগ্ধার এমন পাগলামি দেখে ভিতর থেকে জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে, দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগ কন্ট্রোল করছে,
কি হলো ভাইয়া কথা বলছেন না কেন? স্নিগ্ধার চোখ যায় রাহীর দিকে, রাহিকে ইসারা করে বলে জানেন ভাইয়া এই মেয়েটা আমার বান্ধবী সেজে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিল, আর তারপর আমার মুখের সামনে কি একটা স্প্রে করে তারপর আর আমার কিছু মনে নেই তারপর তো আমি এখানে, তাকে তো আমি চিনিও না কিন্তু আমার প্রতি তার এত রাগ কেন সেটাও আমি জানিনা, যতবার জ্ঞান ফিরলো আমি তার রাগের শিকার হলাম, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, স্নিগ্ধা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে রাহাতের সঙ্গে মনে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছে,
স্নিগ্ধার কথা শুনে রাহাতের মনে বেশ রাগ হলো বোনের উপর, তবে কিছু বললো না শান্ত চোখে শুধু দেখে যাচ্ছে স্নিগ্ধাকে যেন কত দিনের তৃষ্ণা,
স্নিগ্ধার এতক্ষণে হুস এলো, সে লক্ষ্য করলো রাহাত এক ধ্যানে শুধু তার দিকেই তাকিয়ে আছে কিছুই বলছে না, এবার স্নিগ্ধার কেমন অস্বস্তি হতে শুরু করল আশেপাশে চোখ বুলিয়েও ফাইয়াজকে খুঁজে পেল না,,
রাহাত এবার শান্ত কন্ঠে বলল,, ফাইয়াজকে খুব ভালোবাসো তাই না?
স্নিগ্ধা এবার একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, সে আমার স্বামী তাকেই তো ভালোবাসবো,
খুব বিশ্বাস করো তাই না?
হ্যাঁ,
তুমি কি জানো যে ফাইয়াজের সঙ্গে অন্য মেয়ের সম্পর্ক আছে?
মানে?
ছবিগুলো কি যথেষ্ট প্রমাণ নয়?
ওহ তারমানে ছবিগুলো আপনি পাঠিয়ে ছিলেন?
হ্যাঁ, যাতে জীবনের আরো এক ভাগ গভীরে পৌছানোর আগেই তুমি বেরিয়ে আসতে পারো।
কি বলতে চাইছেন?
তুমি ফাইয়াজকে ছেড়ে দাও ,
স্নিগ্ধা কিছু বলতে যাবে এর মধ্যেই হঠাৎ কলিং বেল বেজে ওঠে, রাহাত বেশ বিরক্ত হয়,
ফাইয়াজ এতক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করছিল, ভেতরে আসবে কি আসবে না ভাবতে ভাবতে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে শেষ পর্যন্ত কলিং বেলটা বাজিয়েই দিল, ভাগ্য ভালো হলে তার স্নিগ্ধপরীকে এখানে পেয়েও যেতে পারে, তবে সে মনে প্রাণে চায় যেন তার ভাবনাগুলো ভুল হয়, কিন্তু সব সময় সব চাওয়া পূরণ হয় না।
রাহি বিরক্তি নিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দেয়, দরজাটা খুলেই একটা ধাক্কা খায় কারণ বাইরে স্বয়ং ফাইয়াজ দাঁড়িয়ে আছে,
ফাইয়াজ রাহীকে দেখে খুব একটা অবাক হয় না তবে খুব কষ্ট পায়, সে কিছু না বলেই রাহিকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে যায় , এটা রাহাতের ফ্ল্যাট কিন্তু এখানে সে কখনোই আসিনি, এই ফ্ল্যাটের কথা রাহাত কখনো তাকে বলেনি, ভেবেই একটু তাচ্ছিল্য হেসে নিলো ফাইয়াজ,
চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারে ফ্ল্যাটটায় তিনটা রুম এর মধ্যে দুটো রুমের আলো নিভানো যে রুমটায় আলো জলছে ফাইয়াজ সেখানেই যায়, দরজাটা হালকা ভেজানো ছিল, দরজাটা খুলেই সামনে দেখতে পায় তার স্নিগ্ধপরী ক্লান্ত বিধ্বস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, পাশে দাঁড়িয়ে আছে রাহাত,
রাহাত এখানে ফাইয়াজকে মোটেও আশা করেনি,
স্নিগ্ধাকে দেখে ফাইয়াজ নিজেকে আর একটুও আটকে রাখতে পারে না, দৌড়ে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে,,,
চলবে????