ভাগ্যলিপি পর্ব-০২

0
1

#ভাগ্যলিপি(২)
#মায়মুনা_সালসাবিল

একজন ডিভোর্সি মেয়ে কি কোনো অবিবাহিত ছেলের শখের নারী হতে পারে?তুরাবের কথা শুনে—আমি যেন আকাশ থেকে সোজা মাটিতে আছড়ে পড়লাম।আমি নাকি তার শখের নারী!
আমার বিয়ের আগে থেকেই সে নাকি আমাকে পছন্দ করতো।কিন্তু হঠাৎ করে শাওনের সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়ায়, মনের কথা জানানোর সুযোগ পায়নি।জানালেও, আমি কখনোই তাকে গ্রহণ করতাম না—
কারণ, সে ছিল পুরোপুরি একটা বখাটে, রগচটা, গুণ্ডা স্বভাবের ছেলে।আমার ডিভোর্সের খবর পাওয়ার পর,সে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে প্রস্তাব পাঠিয়ে দেয় আমার বাবা-মাকে।আর অবিবাহিত কোনো ছেলের প্রস্তাব—আমার বাবা-মা কি আর ফেলে দিতে পারেন?তাছাড়া তুরাব এখন একটা কোম্পানিতে জবও করে।

তুরাব আমার একদম কাছে বসতেই শরীরটা অদ্ভুতভাবে গুলিয়ে উঠলো।সে তো আমার স্বামী—আবার আমাকে ভালোওবাসে তবু কেন জানি তার প্রতি এক অজানা ঘৃণা ভর করলো মনে।যখন তার হাত আমার হাত ছুঁলো,হঠাৎ করেই আমার ভেতরের আচরণ বদলে গেল।আমি কেঁপে উঠে চিৎকার করে বললাম—
“প্লিজ, আমাকে ছোঁবেন না! আমি মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়া এক মেয়ে।সবকিছু জেনেই তো আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন।এই অবস্থায় আপনার সাথে আমি এতো সহজে স্বাভাবিক হতে পারবো না।”

তুরাব আমার কথা শুনে একটুও প্রতিক্রিয়া দেখাল না।নিঃশব্দে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো, দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে খুলে বাইরে চলে গেল।আমি স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলাম খোলা দরজার দিকে,মুহূর্ত পর, বুকের ভেতরের চাপা কান্না হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে এলো—আমি গলা ছেড়ে কেঁদে উঠলাম।কান্নার ফাঁকে সৃষ্টিকর্তার কাছে আর্জি জানালাম—
“কোন পাপের কারণে আজ আমার ভাগ্য এমন হলো?”আজ যদি আমি স্বাবলম্বী হতাম…বা আমার পরিবারের আর্থিক অবস্থা যদি একটু ভালো হতো…
আমি জীবনে কখনোই এই দ্বিতীয় বিয়ে করতাম না।
এটা কত বড় এক অস্বস্তি, কত গভীর এক ক্ষত—
যারা এর ভেতর দিয়ে গেছে,তারা ছাড়া এই কষ্টের ওজন কেউ কখনো বুঝতে পারবে না।প্রথম স্বামীকে ভুলে দ্বিতীয় স্বামীকে মনে জায়গা দেওয়া—
এ যেন আত্মাকে ছিঁড়ে ফেলে আবার নতুন করে সেলাই করার মতো কষ্টের।

সারারাত চোখের পাতায় একফোঁটাও ঘুম আসেনি।
ফজরের আজান ভেসে এলো কানে—তখনই বুঝলাম, রাত শেষ… সকাল হয়ে গেছে।তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হতে গেলাম।অযু করে নামাজ পড়ার জন্য ঘরজুড়ে খুঁজলাম একটা জায়নামাজ—কিন্তু কোথাও নেই।শেষমেশ ব্যাগ খুলে নিজের একটা ওড়না বের করলাম এবং সেটাই বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ালাম।

সকাল হয়ে গেলো। চারপাশ আলোয় ভরে উঠেছে, কিন্তু ঘরটা এখনো ফাঁকা। তুরাব আর ফিরে আসেনি। কেন জানি না, ছেলেটার জন্য বুকের ভেতর অদ্ভুত এক মায়া কাজ করছে—এক তরফা ভাবে ভালোবেসে এসেছে এতোদিন, আজ আমি ডিভোর্সি জেনেও বিয়ে করেছে অথচ বাসর রাতে আমি আমার হাত পর্যন্ত ধরতে দিলাম না। হয়তো কষ্ট পেয়েই, অভিমানে, রাগ করে বাড়ি ফেরেনি সে।

সকাল ঠিক সাতটা বাজতেই দরজায় টোকা পড়ল। নক করার দরকারই ছিল না, দরজা খোলাই ছিলো। তবুও আমি উঠে গিয়ে দাঁড়ালাম।দরজার ওপাশে রিয়া—তুরাবের ছোট বোন। মুখে অদ্ভুত একটা তাড়া।
—“একটু বাইরে আসেন তো।”

আমি কিছু বলার আগেই তার চোখ ঘরটা স্ক্যান করল। বিছানায় তুরাব নেই দেখে ভ্রূ কুঁচকালো।
—“ভাইয়া কই? এত সকাল সকাল কোথায় গেলো আবার?”

আমি চুপ করে রইলাম। উত্তর দিতে ইচ্ছে করল না।

হঠাৎ রিয়া আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে, কণ্ঠে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল—
—“এই বিয়েতে কিন্তু আমাদের কারো মত ছিল না। আমাদের কোনো আত্মীয়স্বজন, এমনকি আম্মুও চাননি ভাইয়ার সঙ্গে কোনো ডিভোর্সি মেয়ের বিয়ে হোক। সবাই ভীষণ কষ্ট পেয়েছে ভাইয়ার এমন সিদ্ধান্তে। জানি না, কী যাদু করেছো তুমি, একজন ডিভোর্সি হয়েও ভাইয়া তোমাকে চয়েজ করলো! দুনিয়ায় কি মেয়ের অভাব ছিল, আল্লাহই ভালো জানে।”

তারপর এক নিঃশ্বাসে যোগ করল—
—“তাড়াতাড়ি বাইরে আসেন। আপনাকে দেখার জন্য পুরো মহল্লার লোক জড়ো হয়েছে। সবাই মজা নিতেই এসেছে। মান-সম্মান সব শেষ হয়ে গেলো এই বাড়ির।”

কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়ে রিয়া ফিরে গেলো।
সকাল সকাল ননদের এমন কথাবার্তা শুনে বুকটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। অপমানও যে এত ধারালো হতে পারে, তা যেন প্রথমবার টের পেলাম। মুখের ওপর কেউ এভাবে কথা বলে নাকি?

অজান্তেই মনে পড়ল শাওনের বাবা-মায়ের কথা—কতটা ভালো ছিলেন তারা, আমাকে কত আদর-স্নেহে আগলে রেখেছিলেন। অথচ তুরাবের বোনের আচরণই এত রূঢ়, তাহলে তার মা কেমন হবেন, ভাবতেই বুকের ভেতর একটা শীতল ভয় জমে গেলো।

চোখে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল, আর মনে হলো—এই বাড়িতে আমার পথটা সহজ হবে না। প্রতিটা দিন হয়তো লড়াই করেই পার করতে হবে।

পরক্ষণেই বাইরে হট্টগোলের শব্দ কানে এলো। হৃদপিণ্ডটা কেমন যেন ধক করে উঠল। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে দেখি, ডাইনিং রুমে ইতিমধ্যেই শোরগোল শুরু হয়ে গেছে।

রিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলছে—
—“আমি আর থাকবই না এই বাড়িতে! যেদিকে মন চায় চলে যাবো!”এ কথাই বলে সে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।

এদিকে যেসব মহিলা আমাকে দেখার জন্য মহল্লা থেকে এসেছিল, তারা মুখে হাত দিয়ে হায় হায় করতে লাগল।
—“ছিঃ! নিজের বোনকে এভাবে কেউ চড় মারে নাকি?”
—“কি এমন বলেছে রিয়া? এক ঘর খেটে এসেছে যে মেয়ে সেই মেয়েকে নিয়ে কি এখন মাথায় তুলে নাচবে সবাই?”

তাদের চোখেমুখে বিদ্রূপ, কণ্ঠে বিষ। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, কিছুই বলার মতো শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না।

ঠিক তখনই তুরাব গর্জে উঠল—
—“চলে যান সবাই! খবরদার কেউ আসবেন না এই বাড়িতে। আমার যদি সমস্যা না থাকে, আপনাদের কেন এত জ্বলছে? খেয়ে দেয়ে কাজ নাই—সকাল সকাল মাথা গরম করে দিতে চলে এসেছেন!”

আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। তুরাবের এমন কর্কশ চিৎকার শুনে পুরো শরীর কেঁপে উঠল। এ কেমন ব্যবহার? পাড়াপ্রতিবেশিদের সঙ্গে কি কেউ এমন ভাবে কথা বলে? তাছাড়া, নিজের বোনের সঙ্গেও এমন দুর্ব্যবহার! তাহলে আমার সাথে তার আচরণ কেমন হবে—ভাবতেই বুকের ভেতর শীতল এক আতঙ্ক জমে গেল।

পরে জানতে পারলাম, রিয়া আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করায় তুরাব এভাবে রেগে গিয়েছিল। আসলে, সে ঘরে ঢুকতে গিয়ে রিয়ার কথাগুলো শুনে ফেলেছিল। তার ক্ষোভ তখন আর বাঁধা মানেনি।এজন্য রেগে রিয়াকে সবার সামনেই চড় মেরেছে।

ঠিক তখনই আমার শাশুড়ি রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। মুখে থমথমে রাগ, চোখে যেন আগুন জ্বলছে। কোনো কিছু না বলেই তিনি তুরাবের কাছে গিয়ে চড়াম করে—দুই গালে দুইটা চড় বসিয়ে দিলেন।

—“বের হয়ে যা এই বাড়ি থেকে! বিয়ে করতে চেয়েছিস—করিয়ে দিয়েছি। এখন তোর শখের বউকে নিয়ে যেখানে খুশি চলে যা। এই বাড়িতে আমি তাকে থাকতে দেবো না।বাড়িতে আসতে না আসতেই বউয়ের হয়ে সবাইকে অপমান করতে শুরু করেছিস? কত বড় সাহস তোর—নিজের বোনকে পর্যন্ত ছাড়লি না!”

তুরাব মায়ের এমন আচরণে যেন ভিতর থেকে ভেঙে পড়ল।সে ভীষণ জেদী, রাগী আর একরোখা স্বভাবের ছেলে—যা মনে করে, তা করেই ছাড়ে। মায়ের এই অপমান সহ্য করতে না পেরে হঠাৎ আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরল।

—“তোমার ব্যাগ নিয়ে এসো রুম থেকে। আর এক মুহূর্তও থাকবো না এই বাড়িতে। আমার বউকে নিয়েই যখন এত সমস্যা তোমাদের, তাহলে তাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো।”

আমি হতভম্ব হয়ে তুরাবের দিকে তাকিয়ে রইলাম। গতকালই তো বিয়ে হয়েছে, আর আজই যদি এভাবে বাড়ি ছেড়ে চলে যাই, লোকে কি বলবে? এমনিতেই ডিভোর্সি হওয়ার কারণে পদে পদে অপমান শুনতে হয়। এখন যদি তুরাবের সঙ্গে বেরিয়ে যাই, সবাই তো আমাকেই দোষারোপ করবে—বলবে আমার কারণেই মা-ছেলের মাঝে দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

মাথার ভেতর হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি শুধু কাঁদছি—নিঃশব্দে, কিন্তু বুকের ভেতর যেন ঝড় বইছে। মনে হচ্ছে, এ জীবনে আমি কোনোদিন সুখের দেখা পাবো না। আমার বাবা-মা কি ভেবে যে এই পরিবারে বিয়ে দিলেন, তা তারাই ভালো জানেন। না জানি শেষ পর্যন্ত কী হয়!

তুরাব এখন হয়তো মোহে আছে—এই মোহ কেটে গেলে কি তখনও সে আমাকে পছন্দ করবে? নাকি এই সংসারও ভেঙে যাবে আমার কপালে?

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ তুরাবের কণ্ঠ বজ্রপাতের মতো কেটে গেল নীরবতা—
—“কি হলো, কথা কানে যায় না? বললাম তো ব্যাগ নিয়ে এসো! আমি এখনই, এই মুহূর্তে, এই বাড়ি থেকে চলে যাবো।”

চলবে…..