#ভাগ্যলিপি(৩)
#মায়মুনা_সালসাবিল
তুরাব আমাকে নিয়ে এল একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে।
যেখানে ছিল মাত্র একটি বেডরুম, একটি ডাইনিং, একটি ছোট্ট রান্নাঘর আর একটি ওয়াশরুম। ফ্ল্যাটটি ছিল তার কর্মস্থলের একদম কাছেই। এতদিন এখান থেকেই অফিসে যাওয়া-আসা করত সে।তার পরিকল্পনা ছিল—বেতন কিছুটা বাড়লে বড় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেবে, তারপর আমাকে আনবে নিজের সংসারে। কিন্তু তার আগেই ঘটল এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা—কে জানত বিয়ের পরের দিনই তুরাবের মা রাগের মাথায় তাকে বাসা ছেড়ে চলে যেতে বলবে আর তুরাবও রাগে-অভিমানে আমাকে নিয়ে বের হয়ে আসবে।
এভাবে, অপ্রস্তুত অবস্থাতেই, আমি এলাম তুরাবের এই ছোট্ট ফ্ল্যাটে—যেখানে আমাদের নতুন জীবনের প্রথম অধ্যায় শুরু হলো।
তুরাব এভাবে নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে আসায় আমার বাবা-মা গভীর দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন।
তারা ভাবতে লাগলেন—কেন যেন তাদের মেয়ের কপালে সুখ সহ্য হয় না! বড়লোক ও ভালো ছেলে দেখেই তো শাওনের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন, তবুও সেই ঘরের সুখ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। মাত্র দুই বছরের মাথায় সুখের সংসার ভেঙে আমাকে ফিরে আসতে হয়েছিল বাপের বাড়ি।
এবার আবার অবিবাহিত তুরাবের ভালো বাড়ি, সচ্ছল পরিবার আর চাকরি দেখে তবেই আমার বিয়ে দিলেন। কিন্তু কে জানত, মাত্র এক রাতের ব্যবধানে তুরাব সেই বাড়ি আর পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে আসবে!
আমার বাবা-মাও বুঝতে পারেননি—তুরাবের পরিবারের লোকজন আমাকে মন থেকে মেনে নেয়নি।
আমার বাবা-মা আমাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন—
“মা, মেয়েদের কপালের সুখ কেউ লিখে দিতে পারে না। কোন বাবা-মা আছে যে নিজের সন্তানের খারাপ চায়? কিন্তু সুখ যদি কপালে না থাকে, তবে কোনো বাবা-মাই পারে না মেয়েকে সুখী রাখতে।”
তাদের কথায় সান্ত্বনার ছোঁয়া ছিল, কিন্তু সেই সান্ত্বনা আমার বুকের ভেতরে জমে থাকা শূন্যতা পূরণ করতে পারেনি।আমি তুরাবের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। সে ছিল ভীষণ রাগী স্বভাবের—মেজাজ প্রায়ই তুঙ্গে, শান্তভাবে কথা বলা তার স্বভাবের ছিল না। আর যখন সে যা বলে, সেটা যদি ঠিক মতো না মানা হয়, তার মেজাজ আরও ভয়ঙ্করভাবে বিগড়ে যেত।তুরাবের রগচটা স্বভাব যতই কঠোর হোক অন্য সবার প্রতি, আমার সঙ্গে সে সবসময় ভালোভাবেই কথা বলতো।কিন্তু এতেও আমার মনে তার জন্য কোনো অনুভূতি জাগছিল না।
এক সপ্তাহ পর তুরাবের বন্ধু হাবিব আর তার স্ত্রী রেশমি আমাকে দেখতে এলেন।তারা দু’জনেই আমাকে ভীষণ পছন্দ করলো, আর আমার সঙ্গে অনেক গল্পগুজব করলো।হাবিব যখন তুরাবের ভালোবাসার কাহিনী বলল, আমি শিউরে উঠলাম।বাসর রাতে তুরাব শুধু বলেছিল, সে আমাকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতো, কিন্তু আমি বিষয়টা গুরুত্ব দিইনি। ভেবেছিলাম, কাউকে ভালো লাগা তো স্বাভাবিক ব্যাপার।কিন্তু হাবিবের মুখ থেকে যখন শুনলাম—
“শাওনের সঙ্গে বিয়ের পরও তুরাব আমার আশায় পথ চেয়ে বসে ছিল।আমি যদি ওর জীবনে না আসতাম, সে হয়তো কখনো বিয়েই করত না”—আমি যেনো পুরোপুরি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।
হাবিব বারবার বলছিল,
“ভাবি, তুরাবের কাছে আপনি কতটা মূল্যবান—তা হয়তো এখনো আপনি বুঝতে পারছেন না। তবে সময় হলে একদিন বুঝবেন।”
তারপর সে এক নিঃশ্বাসে বলে গেল,
“আপনাকে প্রথম যেদিন তুরাব ভার্সিটিতে দেখেছিল, সেদিনই আমাকে বলেছিল—‘দোস্ত, এই মেয়েকে যদি আমি আমার জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পাই, সব অপকর্ম ছেড়ে দেব। গুন্ডামি, সন্ত্রাসগিরি, রাজনীতি—সব বাদ দিয়ে একটা আদর্শ স্বামী হয়ে ওর গোলামি করব আজীবন।’”
হাবিবের চোখে-মুখে তখনও সেই দিনের বিস্ময় আর আবেগ লেগে ছিল।সে থেমে একটু হেসে আবার বলল,
“আমি জানি না, আপনার মধ্যে কী আছে—কিন্তু আপনাকে দেখলেই তুরাব কেমন যেন শান্ত হয়ে যেত। যেন ঝড় থেমে গিয়ে হঠাৎ নদী শান্ত হয়ে এসেছে।”
হাবিবের কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম।
তুরাবের মনে আমার জন্য এত ভালোবাসা ছিল?
হাবিব যেন থামতেই চাইছিল না—
“এই যে এখন তুরাব যে চাকরিটা করছে, জানেন এটা কেন করছে? আপনার ডিভোর্স হওয়ার খবর শোনার পরই সে এই চাকরি নেয়। কারণ সে জানত—চাকরি ছাড়া আপনার বাবা-মা কখনোই বেকার ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন না।”
আমি নির্বাক হয়ে শুনতে লাগলাম। হাবিব বলতেই থাকল,
“তুরাবের ফ্যামিলির কেউই রাজি ছিল না এই বিয়েতে। সে রাগে-অভিমানে খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিল। শেষে সব বন্ধু-বান্ধব মিলে রিকোয়েস্ট করে তার বাবা-মাকে রাজি করানো হয়—যদিও মন থেকে তারা এখনো আপনাকে মেনে নেয়নি।”
হাবিবের কথাগুলো শুনে আমার মনে এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি জাগল—
একজন মানুষ কতটা ভালোবাসতে পারে, নিজের পুরোনো স্বভাব, অভ্যাস আর জীবনযাত্রার ধরন পর্যন্ত বদলে ফেলতে পারে—শুধু আমাকে পাওয়ার জন্য।
এই সত্যটা উপলব্ধি করে আমি নিজের কাছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলাম—আজ থেকে তুরাবকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমার কাঁধে। তুরাবের স্ত্রী হয়ে আমি আমৃত্যু তার পাশে দাঁড়াবো।যতই বিপদ আর বাঁধা আসুক, আমি তাকে একা কখনো ছাড়ব না।তুরাবের এই অপূর্ব ভালোবাসা আমার শক্তি হয়ে থাকবে,যতই কঠিন সময় আসুক সামনে, আমি সেসবকে জয় করবো তার জন্য।
আজ তুরাবের অফিস ছুটি। সারাদিন সে বাসাতেই ছিলো।বিকেল বেলায় বলল, “বের হব, তোমাকে নিয়ে।” বিয়ের পর এখন পর্যন্ত কোথাও নিয়ে যায়নি তোমাকে।আমি ভীষণ খুশি হয়ে দ্রুত একটা সুন্দর শাড়ি পরলাম, হালকা সাজগোছ করলাম।
তুরাব বারবার আমাকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো, কিন্তু আমার চোখে চোখে পড়লে সে দ্রুত তাকানো থেকে বিরত হয়।তার এই লুকোচুরি দেখে ইচ্ছে হলো সামনে গিয়ে মাথা টা ঊর্ধ্বে করে বলতে—
“এই যে স্বামী, কিসের এত লজ্জা? তাকান আমার দিকে ভালো করে। এখন থেকে তো আমি আপনারই সম্পদ।”
বাসর রাতে, তুরাবকে আমি উচ্চস্বরে বলেছিলাম,
“আমাকে ছোঁবেন না, প্লিজ। আমি মানসিকভাবে এখনও প্রস্তুত নই।”
সত্যি বলতে, তুরাব এখন পর্যন্ত আমাকে ছুঁয়েও দেখেনি, এমনকি ভালোভাবে তাকিয়েও দেখেনি।
অথচ আমি তাকে জানতাম সন্ত্রাসী আর গুন্ডা হিসেবে। ভেবেছিলাম সে কতটা ভয়ঙ্কর হবে, হয়তো আমার ওপর জোর করে স্বামীর অধিকার আদায় করবে।কিন্তু না, আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ছিল।
তুরাবের শান্ত মুগ্ধ দৃষ্টি, অটুট শ্রদ্ধা—সব কিছুই আমার ধারণাকে পাল্টে দিয়েছিল।
আসলে যাদেরকে বাহির থেকে ভদ্র আর ভালো মানুষ মনে হয়, তাদের মনেই অনেক সময় অন্ধকার আর খারাপের ছায়া থাকে। আর যাদের বাহির থেকে খারাপ মনে হয়, তাদের মনটাই বেশি ভালো ও সৎ হয়। তারাই প্রকৃত সুন্দর মনের অধিকারী হয়।
শাওন আমার সঙ্গে দুই বছর ধরে এমন নিঁখুত ভালোবাসার অভিনয় করেছে, যা আমি কখনোই বুঝতে পারিনি।কী নিঁখুত অভিনয় ছিল তার!
একটা মেয়েকে পুরোপুরি প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে, পাগলের মতো ভালোবেসে, নিঃস্ব করে ছেড়ে দিলো।
আমি যতদিন বেঁচে থাকবো, শাওনকে কখনোই ক্ষমা করবো না।তার কারণে আজ আমি সমাজের চোখে কলঙ্কিত এক নারী।আর আজ, শুধু শাওনের জন্যই আমাকে শুনতে হচ্ছে—
“তুরাব ডিভোর্সি একজন মেয়েকে বিয়ে করেছে।”
এখন ভীষণ আফসোস হয় আমার তুরাব কেন আমার প্রথম স্বামী হলো না?কেন সে আগে আমার কাছে নিজের মনের কথা খুলে বললো না?এই কথাগুলো মনে আসতেই বুক ভরে আহাজারি উঠে।
তুরাব আর আমি রিকশায় উঠলাম। পাশাপাশি বসে আছি—রিকশার প্রতিটি ঝাঁকুনিতে আমাদের শরীর অনিচ্ছাসত্ত্বেও ছুঁয়ে যাচ্ছিল একে অপরকে।
খোলা আকাশের নিচে বসে হালকা বাতাস গায়ে লাগছিলো, অনেকদিন পর মনে হলো বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি।
আমার চুল উড়ে বারবার তুরাবের মুখে এসে পড়ছিল, কিন্তু সে একটুও বিরক্ত হচ্ছিল না।
হঠাৎ তুরাব আমার হাত আলতো করে চেপে ধরে বললো—
“তোমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে এই ছোট্ট বাসায়। প্লিজ, কষ্ট করে একটু মানিয়ে নাও। খুব শিগগিরই একটা বড় ফ্ল্যাটে তুলবো তোমায়।”
আমি হেসে বললাম—
“আমার একটুও কষ্ট হচ্ছে না। আমি ভালো আছি, বিশ্বাস করুন।”
আমার কথা শুনে তুরাব কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো—যেন আমার হাসির আড়ালে লুকানো সত্যটা পড়ার চেষ্টা করছে।
হঠাৎ পিছন থেকে এক মাইক্রোর ধাক্কায় আমি রিকশা থেকে প্রায় ছিটকে পড়তে যাচ্ছিলাম। শেষ মুহূর্তে রিকশার হাতল আঁকড়ে ধরলাম, কিন্তু তুরাব এক ঝটকায় আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ফেললো।
“ব্যথা পাইলা?”—তার কণ্ঠে উদ্বেগ ভরা।
আমি মাথা নেড়ে ‘না’ বললাম, কিন্তু তুরাব থামলো না। হঠাৎ রিকশা থেকে নেমে পিছনের মাইক্রোর দিকে এগিয়ে গিয়ে গর্জে উঠলো—
“এই যে মিস্টার! চোখে কম দেখেন নাকি? দাঁড়িয়ে থাকা রিকশাকে এভাবে ধাক্কা মারলেন কেন? এক চুলের জন্য আমার স্ত্রী পড়ে যায়নি। পড়ে গেলে খবর করে ছাড়তাম!”
তুরাবের এমন রাগ দেখে আমি তাড়াতাড়ি রিকশা থেকে নেমে তার হাত টেনে বললাম,
“প্লিজ, আসুন… এভাবে তর্ক করবেন না।”
কিন্তু তুরাব যেন শুনতেই পাচ্ছিল না। ঠিক তখনই মাইক্রোর জানালা ধীরে ধীরে নেমে এলো।
আমার চোখ সেদিকে যেতেই হৃদপিণ্ড যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল—
ভেতরে বসা শাওন। আর তার পাশে শাওনের গার্লফ্রেন্ড টয়া।
চলবে…..