ভাগ্যলিপি পর্ব-০৯

0
8

#ভাগ্যলিপি(৯)
#মায়মুনা_সালসাবিল

হাবিব ভাইকে খোঁজার জন্য আমি আবার নতুন করে থানায় ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। সাথে নিয়েছিলাম আমার কলেজের ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর, তুহিন ভাইকে। ওনার পরিচিত একজন থানার ওসি আছেন—ওসি আকবর।ওসি আকবর ভীষণ বিশ্বস্ত এবং ধার্মিক মানুষ। টাকার বিনিময়ে কখনো কাজ করতেন না। সব সময় ন্যায়ের পাশে থাকতেন।

পাঁচ বছর আগের ঘটনার ক্ষেত্রে তেমন কোনো আশা দেখা যায় না, তবু ওসি সাহেব আশ্বাস দিলেন, যতটুকু সম্ভব নতুন করে তদন্ত করবেন। কারণ তাদের কাছে এই ঘটনা বেশ রহস্যময় মনে হতে লাগল—একই দিনে একজন বন্ধু মারা গেলো আরেকজন নিঁখোজ হয়ে গেলো।

ওসি সাহেব আমার থেকে বিস্তারিত শুনলেন কিভাবে তুরাব মারা গেছে।আমি বললাম, অফিসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল কক্সবাজারে। সেখানে কিছু ডকুমেন্ট নিয়ে তিন-চার দিনের জন্য বের হয়েছিলো সে।কিন্তু পরের দিন আমি খবর পাই—তুরাবের গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে। গাড়ি উল্টে আগুন ধরে গেছে।
আমি আর বলতে পারলাম না। বুকটা কাঁপতে লাগল। তুরাবের সেই পোড়া শরীর চোখের সামনে ভেসে উঠল। কলিজা যেন ছিড়ে যাচ্ছে। আহা রে, কী কষ্ট পেয়ে সে মারা গেছে!
প্রফেসর তুহিন সাহেব আমাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন।রেশমি ভাবি মাথাটা বুকে জড়িয়ে বললেন,
—“ভাবি, শান্ত হন। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

আমি ধীরে চোখের পানি মুছে সব খুলে বললাম ওসিকে।তুরাবের শেষ মুহূর্ত, তার আগুনে পোড়া দেহ, সব কষ্ট—সবই এক এক করে বের হয়ে এলো।
ওসি সাহেব চোখে গভীর ভাব নিয়ে শুনলেন, যেনো প্রতিটি শব্দ তাঁর মনেও দাগ কেটে গেলো।

ওসি সাহেব এবার রেশমি ভাবিকে জিজ্ঞেস করলেন,
—“হাবিব ভাইকে কখন থেকে পাওয়া যাচ্ছিলো না?”
রেশমি ভাবি ধীরে উত্তর দিলেন,
—“হাবিব ওই দিন অফিসে যাওয়ার কথা বলে বের হয়েছিলো—যেদিন তুরাব কক্সবাজার যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছিল। কিন্তু দুপুরে হাবিব বাসায় খেতে আসে না। আমি কল দিয়েছি, কিন্তু সে রিসিভ করে নি। প্রথমে ভেবেছিলাম, হয়তো ব্যস্ত আছে।
কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত—শেষে আমি হাবিবের অফিসে ছুটে গেলাম। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম, তিনি ওই দিন অফিসেই যাননি। পরে তুরাব ভাই এর অফিসে গিয়ে জানতে পারলাম, তুরাব ভাই দরকারী কাজে কক্সবাজারে গিয়েছেন। তখন আমি তুরাব ভাইকে কল করি—হাবিব কোথায় আছে জানেন কি না। কিন্তু তুরাব ভাই এর ফোন এ বারবার রিং হচ্ছে, কিন্তু তিনি ধরছিলেন না।

শেষ পর্যন্ত, হাবিবের কোনো খোঁজ না পেয়ে আমি থানায় জিডি করি। সারারাত কেটে যায়, কিন্তু কোনো খবর নেই। পরের দিন আমি তুরাব ভাই এর বাড়িতে চলে আসি, কিন্তু এসে শুনি তুরাব ভাই এর গাড়ি এক্সিডেন্ট করে আগুনে পুড়ে গেছে।তুরাব ভাই আর গাড়িতে থাকা ড্রাইভার দুইজনই পুড়ে মারা গেছেন।এই কারণে, আমি আর হাবিব এর নিঁখোজের কথা ঊষা ভাবিকে বলতে পারি নি।

ওসি সাহেব সব শুনে ধীরে বললেন,
—“কেউ যদি নিঁখোজ হয়, সাধারণত কয়েকটি ঘটনা ঘটে। হয়তো তাকে কেউ মেরে ফেলে, নয়তো সে নিজে কোথাও এক্সিডেন্টে মারা পড়ে থাকে। আবার কখনো কেউ পাগল হয়ে বাড়ির পথ ভুলে গেলে, তখনও নিঁখোজ হিসেবে গণ্য হয়।”

রেশমি ভাবি ওসি সাহেবের কথা শুনেই হু হু করে কেঁদে উঠলেন।

আমরা সবাই একসাথে তাকে শান্ত্বনা দিতে লাগলাম,
—“ভাবি, প্লিজ শান্ত হন। এরকম কিছু নাও ঘটতে পারে।”

ওসি সাহেব চোখে গভীর ভাব নিয়ে বললেন,
—“হাবিব কি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন?”

রেশমি ভাবি সঙ্গে সঙ্গেই বললেন,
—“হ্যাঁ, ছিলেন। তুরাব আর হাবিব দুইজনই ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত ছিলো। কিন্তু পরে তারা সব ছেড়ে দেয়।”

ওসি সাহেব তা শুনে বললেন,
—“এটা আগে কেনো বলেননি? আমার তো মনে হচ্ছে, নিশ্চয় দলের কোনো লোক কিছু করেছে।”

এজন্য তিনি হাবিব ও তুরাব কোন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, তা খুঁজে বের করতে লাগলেন।হাবিবের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন,কেউ তাকে দেখেছে কিনা কিন্তু কেউ কিছুই বলতে পারলো না।

ওসি সাহেব প্রায় আশা ছেড়ে দিতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ জানতে পারলেন—ঐ একই দিনে তুরাবের অফিসের আরও একজন নিঁখোজ। তখন অফিসার আরও বেশি সিরিয়াস হয়ে পড়লেন।

একই দিনে তুরাব মারা গেছে, আর হাবিব ও তুরাবের সহকর্মী শিমুল নিঁখোজ—এটি দেখে ওসি সাহেব বিষয়টি ভালোভাবে যাচাই করে দেখতে লাগলেন।

ওসি সাহেব যেভাবে নিজের মনে করে হাবিব ভাই আর তুরাবের সহকর্মী শিমুলকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তা দেখে আমরা বেশ খুশিই হলাম।কারণ ওসি সাহেব প্রাণপন চেষ্টা করছেন।

আমি কৃতজ্ঞচিত্তে প্রফেসর তুহিনকে ধন্যবাদ জানালাম। এরকম একজন নিষ্ঠাবান ও দায়িত্বশীল ওসির খোঁজ দেওয়ার জন্য সত্যিই তাঁকে ধন্যবাদ না জানালেই নয়। মনে হলো, অন্তত এই কঠিন সময়ে আমরা ভরসা করার মতো একজন মানুষকে পেয়েছি।

প্রফেসর তুহিন ভাইয়ের জীবনও কম কষ্টের না।
তার স্ত্রীও একজন প্রফেসর ছিলেন। কিন্তু হঠাৎই তিনি স্ট্রোক করে মারা যান। স্ত্রী হারানোর ব্যথা তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়ালো। এরপর তিনি আর বিবাহ বেঁধে সংসার শুরু করেননি।
তুহিন ভাইয়ের দুই ছেলে-মেয়ে—উভয়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী। মাঝে মাঝে আশেপাশের মানুষদের দুঃখ-কষ্টের কাহিনী শুনলে নিজস্ব কষ্টটা অনেকটা হালকা লাগে আমার।
সত্যিই, পৃথিবীতে কেউ পুরোপুরি সুখী নয়। একেক মানুষের জীবনে, একেক কষ্ট।

ওসি সাহেব এবার আমাকে সাথে নিয়ে তুরাবের মা-বাবার বাড়ি যেতে চাইলেন। তাদের থেকে কিছু তথ্য নেওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু জানি না কেনো, আমি যেতে ইচ্ছুক ছিলাম না—কারণ আমাকে দেখলে হয়তো আবার অপ্রত্যাশিত বা আজেবাজে কিছু কথা শুনতে হবে। ওসি সাহেবের সামনে এসব বলার সাহসও আমার ছিল না। তবুও, ওসি সাহেব বারবার অনুরোধ করায় আমাকে যেতেই হলো।

কিন্তু আমি গিয়ে যা দেখলাম, তা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি।

শাশুড়ী প্রালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন, চোখে এক অনন্ত ক্লান্তির ছাপ। শারীরিক অসহায়তার সঙ্গে মিলেমিশে তার অচেতন কান্না যেন মনকে আঘাত করছে। বিছানাতেই মলমূত্র
ত্যাগ করেন, কথাও ঠিকঠাক বলতে পারেন না, শুধু ঝাপসা চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে সব।

উল্টো দিকে রিয়া—ডিভোর্স হয়ে এক সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে—নিজের দুঃখের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। তার চোখে রিক্ত আশা, আর মুখে অবিশ্বাস্য হতাশা। এই দৃশ্য দেখে আমার হৃদয় কাঁপছে; তাদের করুণ অবস্থা দেখে ভেতরটা কাঁদছে।

এই পাঁচ বছরে আমি একা একটা মেয়ে, কতোটা সংগ্রাম করে টিকে আছি—সে যন্ত্রণা, সে ক্লান্তি, শুধু আমি জানি। আর এই শশুরবাড়ির লোকজন? আমাকে সাহায্য করার তো দূরের কথা, সহানুভূতির একটুকরো ছোঁয়া পর্যন্ত দেখায়নি। উল্টো নানা রকমের কথা শুনিয়ে আমার রক্তচাপ বাড়িয়েছে। এই বংশের একমাত্র প্রদীপ—আরিহানকে নিয়ে পর্যন্ত আজেবাজে বকেছে।
তবুও, আমি স্থির—এই করুণ বাস্তবতার মাঝে, মানুষের দুর্বলতাকে দেখে করুণা রাখার শক্তিটা যেন আমার ভেতরে আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে।

শ্বশুর অনেক দিন পর আমাকে দেখলেন। চোখাচোখি হলো ঠিকই, কিন্তু কোনো কথা বের হলো না তার মুখ থেকে। আসলে বলবেনই বা কীভাবে? আমার প্রতি যে অবিচার আর অন্যায় তারা করেছেন, তা কি এত সহজে ভুলে যাওয়া যায়! আমি তো ক্ষমা করেছি, অন্তত চেষ্টা করেছি ভুলে যেতে। কিন্তু মনে হয় সৃষ্টিকর্তা সেই হিসাব মাফ করেননি।

আরিহানের দিকে চোখ পড়তেই শ্বশুর আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। হঠাৎ ছুটে গিয়ে নাতিকে কোলে তুলে নিলেন তিনি। কাঁপা কাঁপা হাতে জড়িয়ে ধরে একের পর এক চুমু খেতে খেতে বলতে লাগলেন
—“দাদুভাই আমার! কেমন আছো তুমি? এ যে আমার তুরাব…”

সেই মুহূর্তে তাঁর চোখের কোণে জমে থাকা জল লুকানো গেল না। সত্যিই, আরিহান যেন তুরাবের ছায়া। মুখের প্রতিটি রেখা, হাসির ভঙ্গি—সবই যেন বাবার প্রতিচ্ছবি।
যারা তুরাবকে একদিন চিনত, দেখেছে, তারা সবাই একবাক্যে বলে—“এই তো তুরাবের ডুপ্লিকেট।”

আরিহান আমার দিকে তাকিয়ে নিষ্পাপ চোখে জিজ্ঞেস করল,
—“আম্মু, উনি কে?”

আমি মুচকি হেসে বললাম,
—“উনি তোমার দাদু।”

আরিহান তখন আরও কৌতূহলী হয়ে উঠল।
—“দাদু আমাদের সাথে থাকে না কেনো, আম্মু?”

তার প্রশ্ন শুনে বুকের ভেতরটা হু-হু করে উঠল। উত্তরটা মুখে আনতে গিয়েও গলা আটকে গেল, কোনো শব্দ বের হলো না।

ওসি সাহেব তখন খানিকটা দ্বিধা ভাঙার মতো কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,
—“মানে… আপনার স্বামী মারা যাওয়ার পর শশুরবাড়ির কেউ কি একবারও আপনার খোঁজখবর নেয়নি?”

আমি চুপ। শুধু একবার শ্বশুরের দিকে তাকালাম, আবার শাশুড়ীর দিকেও। চোখে হাজারটা উত্তর জমে রইল, কিন্তু ঠোঁট সিল হয়ে গেল। যেন নীরবতাই সব বলল—আমার বেদনা, অবহেলা আর দীর্ঘ বছরের নিঃসঙ্গতা।

এবার আমার শশুড়ই বিস্তারিত বললো সব। কেনো তারা আমাকে দেখতে পারতেন না।
কথায় কথায় এবার আমার এক্স হাজব্যান্ড শাওনের প্রসঙ্গ চলে আসলো। শাওন সম্পর্কে বিস্তারিত শুনে ওসি সাহেব তো অবাক হলেন অনেক।

তিনি বললেন,
—“যে মানুষ আপনাকে রেখে তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে পরকিয়ায় লিপ্ত ছিলো, সেই মানুষ ডিভোর্সের পরও কেনো আপনার পিছু ছাড়েনি? তুরাব মারা যাওয়ার পর কেনো বার বার আপনাকে ফিরে নিতে এসেছিলো? ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং তো! এই শাওনের মধ্যে কোনো না কোনো ঘাপলা আছে। একে ধরে নিয়ে গিয়ে থেরাপি দিলেই সমস্ত সত্যি উদঘাটন হবে।”

আমি তা শুনে বললাম,
—“স্যার, তার হাত অনেক লম্বা। কিছুই করতে পারবেন না আপনারা। টাকা দিয়ে সবাইকে সে কিনে নিতে পারে, এমন ক্ষমতা আছে তার।”

ওসি সাহেব হালকা হেসে উত্তর দিলেন,
—“আকবরকে কেনার মতো টাকা ঐ শাওনের নেই। বাসার ঠিকানা দিন… না হয় আপনিই চলুন আমার সাথে।”

আমি তৎক্ষণাৎ মাথা নেড়ে বললাম,
—“না, ওসি সাহেব। আমি আর ঐ বেঈমানের মুখ দেখতে চাই না। যা করার আপনি করুন। কোনো প্রয়োজন হলে কল দেবেন।”

আমার কণ্ঠে দৃঢ়তা শুনে ওসি সাহেব আর কিছু বললেন না। শুধু সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে শাওনের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন।

রিয়া আমাকে আজ আর যেতে দিল না। বললো—
—“ভাবি, থেকে যাও আজ। আরিহান তো প্রথমবার তার দাদুর বাড়ি এসেছে, আজ থাকুক না।”

আমি মৃদু হাসি দিয়ে উত্তর দিলাম—
—“না রিয়া, এখন আর থাকার সময় নেই আমার। কলেজে যেতে হবে, তারপর বাচ্চাদের স্কুল আছে।”

হঠাৎ শাশুড়ী তার ডান হাত দিয়ে আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন। মনে হলো কিছু বলতে চাইছেন, কিন্তু পারেন না। শুধু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো পানি।
শাশুড়ীর এমন নির্মম পরিণতি দেখে কিছুতেই উঠতে মন চাইলো না। কিছুক্ষণ তার পাশে বসে রইলাম। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত হাহাকার জমে উঠলো। আল্লাহ কী এক অবস্থা করেছেন তাঁর—আমার কাছে যে একটু ক্ষমা চাইবেন, সেই শক্তিটুকুও আর নেই তাঁর। তবুও চোখের জলের ভেতর দিয়ে বুঝতে পারলাম, তিনি ভীষণ অনুতপ্ত।

রিয়া এবার আরিহানকে কোলে নিয়ে শাশুড়ীর সামনে ধরলো।
—“আম্মু, এই দেখো কে! এটা তুরাব ভাইয়ার ছেলে।”

বলতেই রিয়ার চোখ ভিজে উঠলো। হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সে—
—“ভাই, কই তুই? আমাদের ছেড়ে কোথায় চলে গেলি?”
ঘরটা মুহূর্তেই কান্নার শব্দে ভরে গেল। শাশুড়ী কাঁপা হাতে আরিহানের মুখমণ্ডল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিলেন, আর অঝোরে কাঁদছিলেন।

এদিকে রিয়া তার মেয়েকে আমার কোলে দিয়ে বললো—
—“ভাবি, এ আমার মেয়ে লাবন্য। এবার তিন বছর পূর্ণ হবে।”

লাবন্যকে কোলে নিয়েই বুকটা হুহু করে উঠলো। ভীষণ মায়া লাগলো ওর দিকে তাকিয়ে। নিষ্পাপ চোখ, কোমল মুখ—আমি ভাবতে লাগলাম, এতো সুন্দর বাচ্চাকে ছেড়ে কেউ থাকে কিভাবে?

রিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,
—“ডিভোর্স হলো কবে?”

রিয়া উত্তর দিলো,
—“এই তো, এক বছর হতে চললো।”

আমি আর কিছু জানতে চাইলাম না। ভেবেছিলাম, বেশি কিছু জিজ্ঞেস করলে রিয়া কষ্ট পাবে। কিন্তু রিয়া নিজেই বলতে শুরু করলো, আর বলতে বলতেই ভেঙে কাঁদতে লাগলো।

সে জানালো—তার স্বামী লাবিব প্রতিদিন বিনা কারণে তাকে মারধর করতো। প্রথম প্রথম সবকিছু মোটামুটি ভালোই ছিলো, কিন্তু কিছুদিন পর যেন বদলে গেলো সব। শুরু হলো অমানবিক নির্যাতন।

রিয়া কাঁদতে কাঁদতে বললো,
—“আমাকে মারে আর বলে, তোকে মারলেই বা কী হবে? তোর তো কেউ নাই। না ভাই আছে, না মা- পাশে আছে।”

তার কণ্ঠে জমে থাকা কষ্ট ছড়িয়ে পড়লো ঘরে।
—“তার নাকি জামাই আদর ঠিকমতো হতো না। মা আজ দুই বছর ধরে বিছানায় পড়ে আছেন,ওরে জামাই আদর করবে কিভাবে?”

রিয়ার কথা শুনে ভীষণ খারাপ লাগলো। সঙ্গে নিজের উপরও রাগ হলো—কেন একটিবারও খোঁজ নিলাম না তাদের?

আসলে, শাশুড়ি-শ্বশুর আমার আরিহানকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলায় ভীষণ কষ্ট লেগেছিল। তারা তো আমাকে আগে থেকেই দেখতে পারেনা, সেটা মানিয়েই নিয়েছি। কিন্তু তারা তুরাবের সন্তানকে অস্বীকার করায় ভীষণ খারাপ লেগেছিল। তাই আর ফিরে তাকাইনি।
আমার কষ্টের দিনগুলোতে কেউ একটুখানি খোঁজখবরও নেয়নি। এই অবহেলা যেন আরও গভীর ভাবে আঘাত করেছে আমাকে।

★★★

ওসি সাহেব আমার ঠিকানা অনুযায়ী শাওনের বাড়ি চলে গেলেন। কিন্তু বাড়িতে শাওনকে পেলেন না। কারণ, শাওন নাকি মারা গেছে। যদিও শাওনকে আমি দু চোখে সহ্য করতে পারতাম না, তারপরও তার অকাল মৃত্যুতে ভীষণ খারাপ লাগলো।

তুরাব মারা যাওয়ার পর শাওন অনেক চেষ্টা করেছিল আমাকে আবার ফিরিয়ে নিতে। সে আমাকে বিভিন্ন ভয়ভীতি পর্যন্ত দেখিয়েছে। কিন্তু আমি আর তাকে বিয়ে করতে রাজি হইনি। উল্টো শাওনের নামে একটি জিডি করে রেখেছিলাম, যাতে সে আমাকে আর বিরক্ত করতে না পারে। তারপর থেকে শাওনের আর কোনো খবর পাইনি।আমি ভেবেছিলাম সে এখন ভালো হয়েছে।বা বিয়ে করে সুখে শান্তিতে বাস করছে।

কিন্তু এখন ওসি সাহেবের কাছ থেকে জানতে পারলাম, শাওন তিন বছর আগে মারা গেছে। ওসি সাহেব ও বেশ অবাক—“শাওন হঠাৎ কীভাবে মারা গেলো?”

শাওনের মাকে বিভিন্নভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে, তিনি জানান—শাওনকে কেউ একজন খুন করেছে।
কিন্তু কে খুন করেছে, পুলিশ তা খুঁজে বের করতে পারেনি।

ওসি সাহেব এরপর শাওনের গার্লফ্রেন্ড টয়ার খোঁজ করতে লাগলেন। নিশ্চয়ই টয়ার সাথে কোনো ঝামেলা ঘটেছে।

কিন্তু তিনি আরও বেশি অবাক হলেন যখন জানতে পারলেন—টয়া চার বছর আগেই সুইসাইড করেছে।

এ কেমন ধাধার মধ্যে পড়ে গেলো ওসি সাহেব! সাথে আমরা সবাই।আমরা খুঁজতে বের হয়েছিলাম হাবিব ভাইকে, কিন্তু এখন একে একে অজানা সব রহস্য উন্মোচন হতে লাগলো।

আমারও মাথা বন বন করে ঘুরছে। কি শুনছি এসব, আর কি দেখছি? প্রতিটা তথ্য যেন আরও গভীর ধাঁধার কাহিনী খুলে দিচ্ছে।

ওসি আকবর এবার তুরাব আর হাবিবের অফিসের সামনের সিসিটিভি ফুটেজ খুঁজতে শুরু করলেন।
কিন্তু সমস্যা হলো—সেটা তো পাঁচ বছর আগের ফুটেজ! এত পুরোনো ভিডিও সংরক্ষিত থাকে না বললেই চলে।
তারপরও তিনি হাল ছাড়লেন না। একটার পর একটা সোর্সে খোঁজ নিতে লাগলেন, পুরনো হার্ডডিস্ক ঘাঁটতে লাগলেন, যেন কোনোভাবে সেই সময়কার সত্যটুকু বের করে আনতে পারেন।

চলবে…….