ভাগ্যলিপি পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
10

#ভাগ্যলিপি(শেষ পর্ব)
#মায়মুনা_সালসাবিল

“ভাগ্যলিপি মানে হলো ভাগ্যের লিখন। মানুষের জীবন যেন এক অদৃশ্য কাগজ, যেখানে আগে থেকেই লেখা থাকে তার হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ আর অর্জন-বিয়োগের সব গল্প। কেউ চাইলেই নিজের ভাগ্য মুছে ফেলতে পারে না, আবার অন্য কেউ চাইলেও তোমার ক্ষতি করতে পারবে না—যদি না সেই ক্ষতির লিখন আগে থেকেই ভাগ্যের পাতায় খোদাই করা থাকে। ভাগ্যলিপি তাই এক অচেনা কলমের আঁকা চিত্র, যা আমাদের জীবনের পথচলার অবিচ্ছেদ্য অংশ।”

তুরাবকে প্রথম যখন চোখের সামনে জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, আমার বুকের ভেতর হঠাৎ কেমন যেন ঝড় বয়ে গেল। খুশি নাকি বিস্ময়—আমি বুঝতেই পারছিলাম না। শরীর ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসছিলো, ঠোঁটের কোণে কোনো শব্দ জন্ম নিচ্ছিল না, চোখেও জমছিল না একফোঁটা জল। আমি নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে।কিন্তু তুরাব একেবারে ভিন্ন আচরণ করলো। হঠাৎ দৌঁড়ে এসে আমাকে কোলে তুলে নিলো সে, যেন বহু বছরের দমবন্ধ অপেক্ষার প্রতিদান পাচ্ছে। তারপর নামিয়ে নিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরলো এমন শক্ত করে, যেন ভেতরে লুকিয়ে রাখা সবটুকু ভালোবাসা এক নিমিষে উজাড় করে দেবে। তার আনন্দ এতটাই তীব্র, যেন সে কোনো হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধার করেছে।

আমি তখনো অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মুখে কোনো শব্দ নেই, শুধু দু’চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছিলো। আমার অশ্রু দেখে তুরাবের বুক কেঁপে উঠলো। সে আলতো করে আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে আমাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
—“আই’ম সরি, ঊষা… আই’ম ভেরি ভেরি সরি…” তার কণ্ঠ কাঁপছিলো, গলার ভেতর জমে থাকা কান্না ভেঙে বের হয়ে আসছিলো।
—“তোমাকে আমি পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুখ দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কি অভাগা আমি… তোমাকে দিয়েছি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কষ্ট, সবচেয়ে গভীর দুঃখ। তুমি যদি চাও, আমাকে শাস্তি দাও ঊষা। তোমার যা ইচ্ছে হয় করো আমার সাথে। আমি মেনে নেবো—কিন্তু এই পাপীকে ক্ষমা না করলে আমি বাঁচবো না।”

আমি চুপচাপ তার বুকের ভেতর মুখ গুঁজে রেখেছিলাম। কান্নার শব্দ ছাড়া আর কিছু বের হচ্ছিল না আমার গলা থেকে। বুকের ভেতর জমে থাকা অভিমান আর ভালোবাসা একসাথে গলে গিয়ে যেন ঝরছিল অশ্রুর স্রোতে।

তুরাব আমার চুলে হাত বুলিয়ে কেঁপে কেঁপে বললো,
—“ঊষা, আমি প্রতিজ্ঞা করছি… এ জীবনে তোমার চোখে আর কোনোদিন জল আনবো না। শুধু একবার বলো—তুমি আমাকে ঘৃণা করোনি… তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো…”

তুরাবের এরকম কথা শুনে বুকের ভেতর জমে থাকা আবেগ আর বাঁধা মানলো না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম আমি। দু’হাত বাড়িয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম তুরাবকে।এতো বছরের জমে থাকা কষ্ট কান্না আর ভালোবাসা তার বুকের ভেতর লুটিয়ে পড়লো আমার অশ্রু হয়ে।কিন্তু মুখে কোনো শব্দ আসছিল না। ঠোঁট কাঁপছিল, বুক কেঁপে উঠছিল। আমি তো প্রতিজ্ঞা করেছিলাম—তুরাব ছাড়া অন্য কোনো পুরুষকে আর আমার জীবনে আসতে দিবো না। শুধু আরিহানকে নিয়ে কাটিয়ে দেবো আমার বাকি জীবন। কিন্তু আজ, এভাবে হঠাৎ আবার তুরাবকে এত কাছে পাবো—এটা আমি কখনো কল্পনাও করিনি।

অবশেষে কাঁপা গলায়, কান্নায় ভিজে যাওয়া কণ্ঠে বললাম—
—“তুমি… তুমি কেমন আছো?”
তুরাব তখন আমার কপালে, গালে, নাকে আর ঠোঁটে এলোপাতাড়ি চুমু খেতে লাগলো। তার ঠোঁটের ছোঁয়ায় আমার বুকের ভেতর জমে থাকা দীর্ঘদিনের শূন্যতা ভেঙে যাচ্ছিল। সে ফিসফিস করে বললো—
—“এতোদিন মৃতের মতো অন্ধকার ঘরে পড়ে ছিলাম… কিন্তু আজ মনে হচ্ছে যেন স্বর্গে চলে এসেছি।”
আমি চোখ ভিজে যাওয়া অবস্থায় আধো আধো কণ্ঠে বললাম—
—“আর কখনো এভাবে একা করে চলে যেও না… আমার একা থাকতে ভীষণ কষ্ট হয়েছে।”

আমার কথা শুনে তুরাবের চোখও লাল হয়ে উঠলো, জল জমে উঠলো কোণে। কিন্তু সে সেটা আমাকে বুঝতে দিলো না। চোখের জল আড়াল করে মাথা নেড়ে দৃঢ় কণ্ঠে বললো—
—“না, যাবো না আর। কখনো না।”
এই বলে আবার আমাকে বুকের সাথে চেপে ধরে, আমার ঠোঁটে বারবার চুমু খেতে লাগলো। প্রতিটা চুমুতে যেন তার শপথ, তার অনুশোচনা আর তার ভালোবাসা মিশে যাচ্ছিল।
আমি আলতো করে তুরাবের মুখটা দু’হাত দিয়ে উপরে তুলে ফিসফিস করে বললাম—
—“একটা সারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য… তোমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর গিফটটা আজ আমি দিতে চাই।”

তুরাব এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো।তারপর আবার আমাকে তার বুকের ভেতর আরও জোরে চেপে ধরে বললো,
—“ঊষা… তোমাকে কাছে পেয়েছি এতো বছর পর… এর থেকে বড় গিফট আমার জীবনে আর কিছু হতে পারে না।”

তুরাবের কথা শুনে আমি হেসে উঠলাম। ভেতরে ভেতরে বুক কাঁপছিলো, কিন্তু মুখে সেই হাসি লুকিয়ে রাখলাম। কারণ তুরাব এখনো বুঝতে পারেনি, আমি আসলে কোন সারপ্রাইজের কথা বলছি।ঠিক তখনই রিয়া আরিহানকে নিয়ে চলে এলো সামনে। চোখ ভেজা, কণ্ঠ কাঁপছে—
—“ভাইয়া… দেখো কে এইটা?”

তুরাবের চোখ ধীরে ধীরে ঘুরে গেলো আরিহানের দিকে। কয়েক মুহূর্ত সে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো—কিন্তু হঠাৎই সবকিছুকে অতিক্রম করে আরিহান নিজেই দৌঁড়ে এসে তুরাবকে জড়িয়ে ধরলো। ছোট্ট কণ্ঠে ডাক দিলো—
—“আব্বু… আব্বু…”

তুরাব চমকে উঠলো। তার বুকের ভেতর দম আটকে এলো। এ কী শুনলো সে!চোখ ভিজে উঠলো, কিন্তু সে বিশ্বাস করতে পারছিলো না।একবার আমার দিকে তাকালো,আরেকবার রিয়ার দিকে।

আমি এবার নিজেই এগিয়ে এলাম। তুরাব আর আরিহানকে একসাথে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলাম—
—“এতো বছর পর… আজ আমার পরিবারটা সমপূর্ণ হলো।”
“তুরাব, এ তোমার ছেলে, আরিহান।”

তুরাব তখন আবেগে কেঁপে উঠলো। সে আরিহানকে বুকে চেপে ধরে চুমু দিতে দিতে হকচকিয়ে উঠলো—
—“আমার ছেলে হয়েছে? এ… এ আমার ছেলে? কি শুনছি আমি! আমি বাবা হয়েছি? এতো বড় সারপ্রাইজ জীবনে পাবো, কোনোদিনও কল্পনা করিনি।”
তারপর কাঁপা গলায় বললো—
—“সরি বাবা… সরি আমার কলিজাটা… সরি আমি… অনেক অনেক সরি।”
তুরাব আবার আরিহানকে জড়িয়ে ধরলো।

হঠাৎ আরিহান নিষ্পাপ কণ্ঠে বলে উঠলো—
—“তুমি তো আকাশে চলে গিয়েছিলে… কেনো চলে গিয়েছিলে আমাদের রেখে? আর যেও না, আব্বু।”

আরিহানের মুখে এরকম শুনে তুরাব খুশিতে ভেঙে পড়লো। কান্না আর হাসি একসাথে মিশে গড়িয়ে পড়লো তার মুখ বেয়ে। ভাষা যেন হারিয়ে ফেললো সে। কোনো উত্তর দিতে পারলো না—শুধু আরিহানকে কোলে তুলে বারবার চুমু খেতে লাগলো।
—“না বাবা… আর যাবো না … তোমাদের ছেড়ে আর কোথাও যাব না।”
তুরাবের মনে হচ্ছিলো—সে যেন আজ স্বপ্নের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে হারানো পৃথিবী ফিরে পাওয়া যায়, যেখানে অন্ধকার শেষে আলো জ্বলে ওঠে।

এবার তুরাব আরিহানকে কোলে নিয়ে রিয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো। তারপর কোমল কণ্ঠে বললো—
—“বোন আমার, কেমন আছিস?”

রিয়া তুরাবের কথা শোনামাত্রই হু হু করে কেঁদে উঠে এবং তুরাবকে জড়িয়ে ধরলো হঠাৎ।তুরাব নিজেও রিয়াকে আলতো করে জড়িয়ে নিয়ে বললো—
—“আরেহ, পাগলি, কাঁদছিস কেন? আমি তো ফিরে এসেছি। আর কিসের চিন্তা?”

এরপর আমি লাবণ্যকে সামনে এনে বললাম—
—“তোমার ভাগ্নি কে দেখো, কত মিষ্টি হয়েছে দেখতে।”

তুরাব সেই কথা শুনে লাবণ্যকেও কোলে তুলে নিলো এবং কাঁপা গলায় চুমু দিয়ে বললো—
—“ওহ! কত মিষ্টি। আমার ছোট্ট মিষ্টি পরী।”

তুরাবের এক পাশে আরিহান, আরেক পাশে লাবণ্য। দু’জনকে কোলে নিয়ে তুরাব যেন একেবারে পূর্ণ আনন্দের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে।

আমার শশুর লজ্জায় সামনে আসছিলেন না।সব সাহস যেনো হারিয়ে ফেলেছেন আজ—কোন মুখে ছেলের সামনে দাঁড়াবেন? লজ্জা আর অনুশোচনায় যেন তিনি নিজেই ভেঙে পড়ছিলেন।ঠিক তখন তুরাব এগিয়ে এসে নিজের বাপের হাত ধরে কোমল কণ্ঠে বললো—
—“আব্বু, কেমন আছো?”

আমার শশুর কাঁদো কাঁদো চোখে উত্তর দিলেন—আমরা তো ভালোই আছি,“বাবা, তুই ভালো আছিস তো?
“তোমাদের সবাইকে একসাথে দেখে কি খারাপ থাকা যায়? আজ ভীষণ খুশি আমি, বাবা। আম্মু কই? ভালো আছেন তো তিনি?”
—“এখনো কি রাগ আছে আমার উপর? এখনো কি ঊষাকে মেনে নিতে পারনি?”

আমার শশুর, তুরাবের এমন প্রশ্ন শুনে হু হু করে কেঁদে উঠলেন—
—“তোর মা ভালো নেই, বাবা। প্রালাইজড হয়ে পড়েছেন বিছানায়।”

তুরাব সেই কথা শুনেই সঙ্গে সঙ্গে বললো—
—“কই আম্মু? কই?”

এই বলে সে দৌড়ে রুমের দিকে এগোল। চোখে যা দেখলো, তা হৃদয় ছুঁয়ে গেলো—মরার মতো পড়ে আছে বিছানায় তার মা। তার মায়ের এমন করুন পরিণতি দেখে তুরাবের বুক হাহাকার করে উঠলো।
দৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে তুরাব তার হাত ধরে কাঁদতে লাগলো। কাঁপা কণ্ঠে বললো—
—“আম্মু… আম্মু…”
কিন্তু তার মা কথা বলতে পারছিলেন না, শুধু তাকিয়ে দেখছিলেন আর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল।
এতো আনন্দের মুহূর্তের মাঝেও তুরাব ভীষণভাবে আঘাত পেলো মায়ের এমন অবস্থায়। কিন্তু কিছু করার নেই—ভাগ্যের লিখন কখনোই খণ্ডন করা যায় না।

অন্যদিকে হাবিবও তার পরিবারের কাছে ফিরে আসতে পেরে খুশিতে ভাষা হারিয়ে ফেললো। কোনো কথা বেরোচ্ছিল না তার মুখ থেকে—শুধু বউ আর বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরে আছে শক্ত করে। মনে হচ্ছে, ছেড়ে দিলে যদি আবার তারা হারিয়ে যায়।
আজকের এই আনন্দঘন মুহূর্ত সত্যিই দেখার মতো ছিলো।

আমরা সবাই ওসি আকবরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। দুই পরিবারের এই পুনর্মিলন দেখে নিজেও তিনি ভীষণ খুশি হলেন। যদিও এটি আমাদের ভাগ্যে লেখা ছিলো—সৃষ্টিকর্তা যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবেই আমাদের ভাগ্য তৈরি হয়েছে—তবুও ওসি সাহেবের অবদান ভোলার মতো নয়।যদি তিনি এত যত্ন সহকারে খুঁতিয়ে না দেখতেন, যদি সত্যটা আবিষ্কার করার জন্য তার নজর ও তৎপরতা না থাকতো, তাহলে হয়তো এত সহজে সবকিছু সম্ভব হতো না।

আমরা সবাই এবার এক বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। সিদ্ধান্ত হলো, আর আমরা কেউ কারো থেকে আলাদা থাকবো না, মিলেমিশে সুখী পরিবারের মতো একসাথে থাকবো।
কিন্তু হাবিব আমাদের বাড়িতে থাকতে চাইলো না। সে তার বউ-বাচ্চা নিয়ে চলে যেতে চাইলো। তুরাব আর আমি অনেক অনুনয়-বিনয় করলাম, তাদের আটকানোর চেষ্টা করলাম।কিন্তু হাবিব শান্ত কণ্ঠে বললো—
—“ভাবি, তুমি একা একটা মেয়ে মানুষ হয়ে আমার বউ-বাচ্চার জন্য যা যা করেছো, সত্যিই কল্পনার বাইরে ছিল। আপনাকে স্যালুট জানাই এজন্য। আজীবন আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকবে আমাদের। কিন্তু এবার আমাদের যেতেই হবে।”

তুরাব এবার নিজেও আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো।
—“তুমি অনেক সাহসী মেয়ে ঊষা। তুমি ভেঙে পড়ো নি, বরং বাস্তবতা মেনে নিয়ে সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছো। তার উপর, আমার অবর্তমানে সবার খেয়াল রেখেছো। তোমাকে সত্যিই স্যালুট জানানো উচিত।”

সবার এমন প্রশংসা শুনে আমার মন ভীষণ উষ্ণ হয়ে উঠলো। মনে হলো, এতগুলো মানুষের ভালোবাসা ও স্বীকৃতি পেয়ে আমি যেন নতুন শক্তি পেয়েছি। মনে হলো, সৃষ্টিকর্তা হয়তো খুশি হয়েই আমার হারানো তুরাবকে আবার আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে।

হাবিব ভাই, রেশমি ভাবি আর তাদের বাচ্চাদের নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেলেন। কিন্তু আমার মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো—বিশেষ করে হিয়া আর রিয়ানের জন্য।কিন্তু কিছু করার ছিল না। ওদের তো নিজের একটা পরিবার আছে।

প্রায় এক মাস পর হঠাৎ একদিন ওসি সাহেব আমাকে থানায় ডাকলেন। আমার সাথে তুরাব যেতে চাইলে ওসি সাহেব স্পষ্টভাবে বারণ করলেন—শুধু আমাকে যেতে বললেন। এজন্য আমি চলে গেলাম, কিন্তু ভেতরে কেনো জানি ভীষণ ভয় পাচ্ছিলাম। ওসি সাহেব কেনো এভাবে হঠাৎ ডাকলেন, বুঝতে পারছিলাম না।

রুমে ঢুকেই সালাম দিলাম। ওসি সাহেব আমাকে বসতে বললেন। আমার মুখ, চোখ দেখেই তিনি কোমল কণ্ঠে বললেন—
—“মিস ঊষা, আপনি কি ভয় পাচ্ছেন? আপনি তো ভীষণ সাহসী আর সংগ্রামী একজন মেয়ে। আপনি কেনো ভয় পাবেন?”

ওসি সাহেবের কথা শুনে আমার সাহস যেনো ফিরে এলো। নিজের কণ্ঠ দৃঢ় করে বললাম—
—“না স্যার, ভয় পাচ্ছি না।কেনো ভয় পাবো?আমি তো কোনো অপরাধী না।
“কেনো ডেকেছেন আমাকে?”

ওসি সাহেব তখন হাসতে হাসতে বললেন—
—“শাওনকে মেরেছেন কেনো?”

আমি শোনামাত্রই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম এবং বললাম—
—“না, স্যার, আমি তাকে মারিনি।”

ওসি সাহেব তা শুনে গুরুতর কণ্ঠে বললেন—
—“আপনার মুখে মিথ্যা কথা শোভা পায় না, মিস ঊষা। প্লিজ, সত্যি বলুন। কিছুই লুকাবেন না আমার কাছে। শাওনকে কেনো মেরেছেন আপনি?”

আমি তখন আবারও বললাম—
—“আমি শাওনকে মারিনি, ওসি সাহেব।”

ওসি সাহেব একটু কণ্ঠ স্থির করে বললেন—
—“আবার মিথ্যা বলছেন? আপনি তো থানায় তার নামে জিডি করেছেন। তার কিছুদিন পরেই শাওন মারা যায়। তাই কি না?”

আমি এবার সব সত্য স্বীকার করে নিলাম। বললাম—
—“স্যার, তুরাব বাড়ি না থাকায় শাওন প্রায়ই আমার কাছে আসতো। বার বার আমাকে তার কাছে ফিরিয়ে নিতে চাইতো। কিন্তু আমি রাজি হইনি। তখন শাওন আমাকে একটি প্রলোভনমূলক প্রস্তাব দেয়। আমি রাগের বশবর্তী হয়ে তাকে একটি চড় মারি।”
শাওন তখন হিং*স্র বা*ঘের মতো আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ে।আমি আর বাকি কথা বলতে পারছিলাম না।

ওসি সাহেব তখন বললেন—
—“শাওন যখন আপনার সম্মান নষ্ট করতে চাইছিল, তখন আপনি রাগের বশবর্তী হয়ে তাকে খুন করেছেন, তাই তো?”

আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম—
—“না, স্যার, আমি কিছুই করি নি। শাওন যখন আমার উপর ঝাঁ*পিয়ে পড়ে আমাকে কল*ঙ্কিত করতে চাইছিল, তখন আমার মা ব*টি দিয়ে তাকে একটি কো*প দেন। এ কারণে শাওন ভয়ে পালিয়ে যায় বাড়ি থেকে। কিন্তু সে তখন বেঁচে ছিল, শুধু পালিয়ে গেছে।”

ওসি সাহেব তা শুনে বললেন—
—“আমার সন্দেহই তাহলে সঠিক ছিল। ধন্যবাদ আপনাকে, মিস ঊষা, সত্যি কথা বলার জন্য। আর আপনাদের নতুন জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখে থাকুন আজীবন।

ওসি সাহেবের এই শুভকামনা শুনে আমার মন হঠাৎ হালকা হয়ে উঠলো। আমি নিজেও ওসি সাহেবকে ধন্যবাদ দিলাম আমাদের এভাবে বার বার সাহায্য করার জন্য।এরপর কণ্ঠে অল্প আগ্রহ মিশিয়ে জিজ্ঞেস করলাম—
—“স্যার, তাহলে শাওনকে কে খুন করেছে?”

ওসি সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন—
—“শাওন মারা যায়নি। সে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।”

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম—
—“কেনো, স্যার? হঠাৎ এভাবে পালানোর কারণ কী?”

ওসি সাহেব গভীর শ্বাস নিলেন এবং বললেন—
—“শাওন টয়াকে মেরে ফেলে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখে যাতে সবাই ভাবে সে আত্মহত্যা করেছে। টয়ার ভাই, সৌরভ, যখন জানতে পারে যে তার বোনকে শাওনই খুন করেছে, তখন সে পুলিশের কাছে একটি কমপ্লেইন করে। আমি সেই কমপ্লেইন পেপার দেখে খোঁজখবর নিলাম এবং দেখলাম, শাওন আসলে মারা যায়নি। তার মায়ের কাছে আবার জানতে গেলে, তাকে আর বাড়িতে পাওয়া যায়নি।”

সমাপ্ত