#উত্তল_তরঙ্গ
#পর্বঃ৭
#লেখিকাঃদিশা_মনি
নেহা কিছু দূর এগিয়ে এসে আবার হঠাৎ করে পিছনে ফিরে তাকালো। তার মন হঠাৎ করে কেপে উঠল। ছোট্ট বাচ্চাটার প্রতি মায়া জন্মাল তার মনে। কিন্তু সে তখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছিল না কি সিদ্ধান্ত নেবে৷ একদিকে তার মন নবজাতক শিশুটির প্রতি অবিচার করতে চাইছিল না আবার নিজের প্রতি হওয়া অন্যায়ের জন্যেও কোথাও না কোথাও ঐ বাচ্চাটিকে দায়ী মনে হচ্ছিল। এরমধ্যেই নেহা লক্ষ্য করে একটা কুকুর এগিয়ে যাচ্ছে ডাস্টবিনটার দিকে। কুকুরটাকে ভীষণ হিংস্র মনে হচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে নেহা আর নিজেকে সামলাতে পারল না। আশেপাশে তাকিয়ে নিচে পড়ে থাকা একটা ইট তুলে নিল অনেক কষ্টে। কুকুরটা ডাস্টবিনের কাছে পৌঁছে যাবে তার আগেই নেহা ইটটি ছুরে মারে তা*র দিকে কুকুরটি ভয়ে দৌড়ে পালায়।
নেহার পেটে তখনো ভীষণ ব্যথা ছিল৷ সে কোনরকমে ডাস্টবিনের কাছে যায়। ডাস্টবিনের কাছে যেতেই বাচ্চাটার গোঙানির আওয়াজ শুনতে পায়৷ নেহার মন এবার কেঁদে ওঠে। সে ডাস্টবিন থেকে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে,
“তুই খুব ভয় পেয়ে গেছিলি তাই না? আমাকে ক্ষমা করিস রে, আমি খুব নির্দয় হয়ে গেছিলাম। আমার প্রতি হওয়া অবিচারের জন্য আমি তোকে দায়ী ভাবছিলাম,,,,কিন্তু তুই তো একটা নিষ্পাপ বাচ্চা,,তোর কি দোষ?”
বলেই সে বাচ্চাটিকে নিজের আরো কাছে নিয়ে এসে বলে,
“কিন্তু আমি কি করবো বল? তোকে নিজের সাথে রাখলে যে এই সমাজ তোকে বা আমাকে কাউকেই বাঁচতে দেবে না।”
বাচ্চাটা ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাঁদতে থাকে। নেহা সেটা বুঝতে পেরে আশেপাশে তাকিয়ে একটা নিরাপদ স্থানে গিয়ে বাচ্চাটাকে মাতৃদুগ্ধ পান করাতে থাকে। কিছু সময় পর দুধ খেয়ে শান্তি পেয়ে বাচ্চাটি ঘুমিয়ে পড়ে। বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে নেহার ভীষণ মায়া কাজ করে। নেহার মনে এখন চলছে দোলাচল, একবার সে ভাবল বাচ্চাটিকে অনাথ আশ্রমে রেখে আসবে পরক্ষণে আবার বাচ্চাটার মায়াভরা মুখের দিকে তাকিয়ে সে বুঝে উঠতে পারে না কি করবে। বাচ্চাটিকে ভীষণ দূর্বল লাগছে। স্বাভাবিকের চেয়ে তার ওজন অনেক কম। এই বাচ্চা কি মা ছাড়া বাঁচবে? কিন্তু এই বাচ্চাকে নিজের সাথে রাখলেও বা সে কি পরিচয় দেবে।
এসবের মধ্যেই হঠাৎ নেহার মনে পড়ে তার যমজ বাচ্চা হবার কথা ছিল৷ নেহা উঠে দাঁড়িয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বলে,
“আরেকটা..আরেকটা বাচ্চা কোথায়?”
সে চারিপাশটা ভালো করে খোঁজে কিন্তু বাচ্চার কোন খোঁজ না পেয়ে ভাবে,
“তাহলে কি আরেকটা বাচ্চা…”
নেহার মনে নেতিবাচক ভাবনা আসে। যেভাবে সে ফ্লোরে পড়ে গিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল তাতে তো এটা হওয়া অস্বাভাবিক না। নেহা এবার নিজের কোলে থাকা নিজের ছোট্ট মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে,
“এই বাচ্চাটা যখন জন্ম নিয়েই ফেলেছে তখন ওর প্রতি আমার দায়িত্ব আমি অস্বীকার করতে পারবো না। কিন্তু এখন আমি কোথায় যাব?”
নেহার মনে পড়লো তার বড় আব্বুর কথা। সে ভাবল,
“বড় আব্বু, আরাভ ভাই, বড় আম্মু ওরা কি আমায় মেনে নেবে?”
নেহা জানে মেনে না নেয়ার সম্ভাবনাই বেশি তবুও এখন তার আর অন্য কোথাও যাওয়ার যায়গা নেই। নেহা তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোকে আর আমাকে এখন এই সমাজে টিকে থাকতে অনেক বেশি সংগ্রাম করতে হবে রে! তবে তুই চিন্তা করিস না, আমি তোকে নিজের কাছছাড়া করবো না।”
বলেই সে মেইন রোডের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। একটা সিএনজি দেখে দাঁড় করিয়ে অতঃপর নিজের বড় আব্বুর বাসার ঠিকানা দেয়। নেহা চোখ বন্ধ করে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে বলে,
“আমায় সাহস দাও আল্লাহ। আমি যেন সব পরিস্থিতি সামলাতে পারি। আজ একা থাকলে হয়তো আমি নিজেকে শেষ করে দিতাম কিন্তু এই বাচ্চাটা..ও যতোই আমার উপর হওয়া অন্যায়ের চিহ্ন হোক এত মাসুম বাচ্চাকে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমি একা ছাড়তে পারব না। ওকে সঙ্গ দেয়ার জন্য হলেও আমায় বেঁচে থাকতে হবে।”
★★
নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে নিজের চেম্বারে বসে আছে আহির। মেয়েটা ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠছে। আহির নিজের মেয়ের কান্না থামাতে বদ্ধপরিকর। এজন্য তাকে Lactogen দুধ খাওয়ায়। যদিও এতে বাচ্চাটা পরিপূর্ণ তৃপ্তি পায় না তবু পেট ভড়ে যাওয়ায় কান্না থামায়। এতেই আহির স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়।
এমন সময় হঠাৎ করে আহিরের রুমে চলে আসেন মুমিনুল পাটোয়ারী। মুমিনুল পাটোয়ারী এসেই বলে ওঠে,
“কি ব্যাপার আহির? এ তুমি কার বাচ্চাকে নিয়ে এসেছ?”
আহির বলে,
“আসলে আব্বু…”
“দেখো, আমার থেকে কোন কথা লুকিও না। সত্যি করে বলো, এই বাচ্চাটা কার। আমি তো নাতাশাকেও একই প্রশ্ন করেছিলাম কিন্তু ও কোন উত্তরই দিল না।”
আহির বললো,
“তোমাকে আমি মিথ্যা বলবো না, আব্বু। এই বাচ্চাটা আমারই।”
মুমিনুল পাটোয়ারী হতবাক স্বরে বলে উঠলেন,
“তোমার বাচ্চা মানে? তাহলে ওর মা কে?”
“ওর মা..ওর মা নেই। আমি ওর বাবা৷ ওর জন্য এই পরিচয়টাই যথেষ্ট।”
“এসব কি বলছ তুমি? আমাকে অন্ধকারে রেখো না।”
“আব্বু, আমাকে ভরসা করো তো নাকি?”
“নিজের থেকেও বেশি ভরসা করি।”
“তাহলে সেই ভরসাটা বজায় রেখো। আমি সময় হলে সব কথা তোমায় খুলে বলবো।”
মুমিনুল পাটোয়ারী দীর্ঘ শ্বাস ফেলেন। অতঃপর বলেন,
“বেশ, তাই হবে।”
বাচ্চাটা বেশ পুষ্ট ও সুন্দর দেখতে ছিল। মুমিনুল পাটোয়ারী এগিয়ে এসে বাচ্চাটিকে দেখে বললেন,
“বাহ, এই মেয়েটা যেন একদম তোমারই প্রতিচ্ছবি।”
বাচ্চা মেয়েটা যেন হেসে উঠল। মুমিনুল পাটোয়ারী মেয়েটিকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,
“দিদিভাই, আমাকে চেনো? আমি তোমার গ্র্যান্ডপা।”
আহির নিজের মেয়েকে তার বাবার সাথে এভাবে দেখে খুশি হয়। মুমিনুল পাটোয়ারী আহিরকে জিজ্ঞেস করে,
“তা নিজের মেয়ের জন্য কি কোন নাম ঠিক করেছ?”
আহির বলে,
“হুম, করেছি। আমার মেয়ের নাম হবে আহিরা।”
★★
সিএনজিটা এসে থামলো চৌধুরী বাড়ির সামনে। নেহা ভয়ে ভয়ে সিএনজি থেকে নামলো। সে বুঝতে পারে, কিছু সময় পর তাকে ভীষণই ভয়াবহ এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
এরমধ্যে সিএনজি চালক বলে উঠল,
“ওহ, ম্যাডাম। ভাড়াটা মিটিয়ে দিন!”
নেহা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“একটু অপেক্ষা করুন, আমার কাছে টাকা নেই। আমি বাসায় গিয়ে..”
সিএনজি চালক তেতে উঠে বললেন,
“এসব চালাকি একদম চলবে না। ভালোয় ভালোয় টাকাটা দিন নাহলে কিভাবে টাকা উসুল করতে হয় সেটা আমার জানা আছে।”
এমন সময় হঠাৎ করে আরাভ সেখানে এসে উপস্থিত হলো। সে সবেমাত্র বাজার থেকে ফিরছিল। তার হাত থেকে বাজারের ব্যাগটাও পরে গেল। দীর্ঘ ৯ মাস পর নেহাকে দেখে সে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। আরাভ যেন কথা বলতেও ভুলে গেল। অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
“নেহা!”
নেহারও দৃষ্টি যায় আরাভের দিকে। চোখাচোখি হতেই দুজনে থমকে যায়। নেহা আবেগাপ্লুত হয়ে বলে ওঠে,
“আরাভ ভাই!”
আরাভ ছুটে চলে আসে নেহার কাছে। এসেই বলে ওঠে,
“এতদিন কোথায় ছিলিস তুই? জানিস, আমি আর আব্বু কত খুঁজেছি তোকে। ৯ টা মাস তোর কোন খোঁজ পাই নি আর..”
হঠাৎ নেহার কোলে থাকা শিশুটির দিকে চোখ পড়তেই যেন স্থির হয়ে গেল আরাভ। বিস্ময়ে ছায়াচ্ছন্ন কণ্ঠে সে বলল,
“এই শিশুটা…”
তার চোখে রাজ্যের বিস্ময়। নেহা বুঝতে পারে না সে কিভাবে আরাভকে সমস্ত সত্যটা খুলে বলবে। সে ক্ষীণ হয়ে আসা কন্ঠে বলে,
“ভেতরে গিয়ে আমি তোমায় সব বলছি আরাভ ভাই..তোমাদের আমার অনেক কথা জানানোর আছে। এই ৯ মাস আমার সাথে কি কি হয়েছে সবটা জানাবো তোমায়। তুমি ওনার সিএনজি ভাড়াটা একটু মিটিয়ে দাও আমার কাছে কানাকড়িও নেই।”
আরাভ বুঝতে পারে নেহা নিশ্চয়ই কোন বড় সমস্যার মাঝে ছিল। তাই আর বেশি কথা না বাড়িয়ে সে বলে ওঠে,
“ঠিক আছে, তুই ভেতরে যা। আমি ভাড়াটা দিয়ে আসছি।”
নেহা এবার বাড়ির ভেতরের দিকে রওনা দেয়। যত কাছে যাচ্ছিল তার হৃদস্পন্দন যেন ততোই বাড়ছিল।
চলবে ✨