#উত্তল_তরঙ্গ
#পর্বঃ৮
#লেখিকাঃদিশা_মনি
নেহা ভয়ে ভয়ে বাড়ির সামনে এসে কলিং বেল বাজালো। কয়েক বার বাজানোর পর ভেতর থেকে বিপাসা চৌধুরী বিরক্ত স্বরে বলে উঠলেন,
“আরে আসছি, আসছি। এতবার বাজানোর কি আছে?”
দরজা খুলেই নেহার দিকে তিনি অবাক চোখে তাকান। নেহার আসাতে যে তিনি খুশি নন সেটা তার চোখেমুখেই ফুটে ওঠে। তিনি বেশ শক্ত কন্ঠে বলে ওঠেন,
“তুই এত দিন পর হঠাৎ কি মনে করে?”
নেহা বলে উঠলো,
“তুমি ভালো আছ, বড় আম্মু?”
বিপাসা চৌধুরী কিছু বলতে যাবেন তার আগেই তার চোখ গেল নেহার কোলে থাকা বাচ্চাটার দিকে। তিনি তেতে উঠে বললেন,
“এই বাচ্চাটা কার?”
নেহা কিছু বলবে তার আগেই আরাভ এসে বিপাসা চৌধুরীকে বলে,
“তুমি এমন কেন আম্মু? এতদিন পর নেহা ফিরে এসেছে আর তুমি ওকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে না বসিয়ে এত প্রশ্নের মেলা নিয়ে বসেছ। নেহা, তুই আয় আমার সাথে।”
বলেই আরাভ নেহার হাত ধরে তাকে ভেতরে নিয়ে যায়। নেহাকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসতেই বিপাসা চৌধুরী তাদের পথ আটকে বলেন,
“আর এক পাও সামনে এগোবি না আরাভ, আগে এই মেয়েটা আমার সব প্রশ্নের উত্তর দেবে তারপর ওর ঠাঁই হবে এই বাড়িতে।”
আরাভ বলে ওঠে,
“আম্মু, প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো৷ নেহার দিকে একবার ভালো করে তাকাও। ওর চেহারায় ফুটে ওঠা মলিনতা আর ক্লান্তি তুমি দেখতে পারছ না? দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও এতদিন ও বাজে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে। ওকে একটু থিতু হতে দাও তারপর সব কিছু শুনিও।”
বিপাসা চৌধুরী কঠোর স্বরে বলেন,
“দেখতে পাচ্ছি রে আরাভ, আমার চোখে তোর মতো ছানি পড়ে নি তাই আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি নেহার কোলে থাকা এই বাচ্চাটাকে। তারপরও তুই বলবি, আমি ওকে কোন প্রশ্ন না করেই ঘরে ঠাঁই দেব? না জানি এটা কার বাবাকে এখানে নিয়ে এসেছে।”
এরমধ্যে হঠাৎ করে বাচ্চাটা কেঁদে উঠতেই নেহা বলে ওঠে,
“বড় আম্মু, বাচ্চাটা কাঁদছে। তুমি দয়া করে আমায় ভেতরে যেতে দাও।”
“না, দেব না। আগে বল এই বাচ্চাটা কার…”
হঠাৎ তিনি থেমে গিয়ে বলেন,
“কোথাও এটা তোর নিজের বাচ্চা নয় তো? চুপ করে আছিস কেন কথা বল। ৯ মাস আগে তো ভেগে গেছিলি নিজের নাগরের সাথে..তারপর এই বাচ্চাও পয়দা করে ফেললি। তার মানে নিশ্চয়ই আগে থেকে চক্কর ছিল। দেখেছিস, আরাভ। আমি বলেছিলাম না, তোরা বাপ ছেলে তো আমার কোন কথাই বিশ্বাস করতে চাস নি। এখন নিজের চোখে সবটা দেখ। এই মেয়ে ঠকিয়েছে আমাদের সবাইকে।”
এমন সময় আজমাইন চৌধুরীও চলে আসেন সেখানে। তিনি এসেই নেহাকে দেখে হতবাক ও কাতর স্বরে বলে ওঠেন,
“নেহা, তুই,,,তুই এসেছিস মা।”
নেহা ছুটে যায় তার বড় আব্বুর দিকে। আজমাইন চৌধুরীর সামনে গিয়ে তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে অনবরত। সে কিছু বলতে যাবে এমন সময় আশেপাশের কিছু প্রতিবেশী চৌধুরী বাড়িতে ছুটে আসে। বিপাসা চৌধুরী স্বস্তির নিঃশ্বাস নেন। তিনিই নেহাকে দেখে সুযোগ বুঝে তাদের পাড়ার হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ম্যাসেজ করে বলেছিলেন সবাইকে তাদের বাড়িতে আসতে। কারণ তিনি চান, যে করেই হোক নেহাকে এখান থেকে তাড়াতে। ছোটবেলা থেকেই তিনি নেহাকে সহ্য করতে পারেন না। যখন নেহার সাথে তার একমাত্র ছেলে আরাভের বিয়ে ঠিক হয়েছিল তখন তো ব্যাপারটা আরো মেনে নিতে পারেন নি। শুধু নিজের স্বামী ও ছেলের ভয়ে কিছু বলতে পারেন নি। কিন্তু নেহার হঠাৎ করে বিয়ের আগে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ায় তিনি অনেক খুশি হয়েছিলেন, গোপনে মসজিদ মাদরাসায় অনেক দানও করেছিলেন। আর আজ যখন নেহা আবার ফিরে এসেছে তাও আবার একটা বাচ্চা নিয়ে তাহলে এই সুযোগেই নেহাকে চিরতরে বিদায়ের ফন্দি এটে ফেললেন তিনি।
বিপাসা চৌধুরী সবার উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলেন,
“আমার স্বামী আর ছেলে বোকা হতে পারে কিন্তু আমি নই। আজ এই মেয়েকে সব জবাব দিতেই হবে। এতদিন কোথায় লাপাত্তা ছিল আর আজ হঠাৎ এভাবে একটা বাচ্চাকে নিয়ে এবাড়িতে এসে দাঁড়িয়েছে আমি কি এভাবেই ওকে মেনে নেব নাকি?”
তাদের এক প্রতিবেশী মহিলা বলে উঠলেন,
“সেটাই। আমাদের এলাকার তো একটা সম্মান আছে। এই নেহা, তুই কোথায় ছিলিস রে এতদিন?”
আরেকজন বলল,
“বিয়ের দিন পালিয়ে গিয়ে আজ একটা বাচ্চাকে নিয়ে উঠেছে। এই কয়মাসে বাচ্চাও জুটিয়ে ফেলল।”
আরো নানা জঘন্য কথা বলছিল সবাই যা শুনে নেহা মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছিল।
এমন সময় আরাভ বলে উঠল,
“চুপ করুন আপনারা সবাই। নেহাকে কিছু বলার সুযোগ দিন। ওকে কিছু বলতে না দিয়েই আপনারা তো নিজেদের মতো কাহিনি বানিয়ে ফেলছেন।”
এলাকার এক প্রৌঢ় বলে উঠলেন,
“ওর আর কি বলার আছে? বিয়ের দিন পালিয়ে গিয়ে যেই মেয়ে একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে ফিরে আসে তার চরিত্র কেমন তা তো বোঝাই যায়। আর তুমি কোন মুখে ওর হয়ে সাফাই গাইছ? তোমাকেই তো বিয়ের আসরে বসে পালিয়েছিল ও।”
নেহা আজমাইন চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
‘বিশ্বাস করো বড় আব্বু। আমি নিজের ইচ্ছাতে পালাই নি।।তুমি তো নিজের নেহাকে বিশ্বাস করো, তাই না?’
আরাভ এগিয়ে এসে নেহার কাধে হাত রেখে বলে,
“হ্যাঁ, নেহা আমরা সবাই তোর উপর ভরসা করি। আমি জানি, আমার নেহা আমাকে ছেড়ে কখনো পালাবে না। তুই সব সত্য সবাইকে খুলে বল।”
এমন সময় আজমাইন চৌধুরী হঠাৎ করে রাসভারী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন,
“তুই কি পালিয়ে গিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করেছিলি নেহা?”
নেহা দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,
“নাহ,করিনি।”
আরাভ যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো।
আজমাইন চৌধুরী আবারো শক্ত গলায় বললেন,
“তাহলে বাচ্চাটা কার নেহা?”
কার কন্ঠে তো সমবেদনা ছিল না ছিল শুধু কঠোরতা। নেহা তৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারে না। আজমাইন চৌধুরী আবারো ধমকে বলে ওঠেন,
“চুপ না থেকে বল এই বাচ্চাটা কার? ওর বাবা মা কে?”
নেহা আতকে উঠল। চোখ বন্ধ করে মনের মাঝে ভীষণ সাহস সঞ্চার করে বলল,
“বাচ্চাটা..এই বাচ্চাটা আমার..কিন্তু ওর বাবা..”
আর কিছু বলতে পারল না নেহা। তার আগেই আজমাইন চৌধুরী জোরে ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারল তার গালে। যাতে নেহা, আরাভ সহ সবাই হতবাক হলো। এই প্রথম তার বড় আব্বু তার গায়ে হাত তুলল, নেহা বিষয়টা মেনে নিতে পারল না। না চাইতেও অশ্রু গড়াল তার চোখ দিয়ে।
বিপাসা চৌধুরীর চোখ যেন জুড়িয়ে গেল এই দৃশ্য দেখে। তিনি সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বললেন,
“একদম ঠিক হয়েছে আল্লাহ। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ এই দৃশ্য দেখানোর জন্য। এখন এই আপদটাকে জলদি আমাদের জীবন থেকে বিদায় করো।”
নেহা অস্ফুটস্বরে বলল,
“বড় আব্বু তুমি আমায় মারলে..”
“চুপ..একদম চুপ। তোর ঐ পাপী মুখে আমায় বড় আব্বু বলে ডাকবি না। তোকে কত বিশ্বাস করেছিলাম আমি আর তুই এভাবে আমার বিশ্বাস ভেঙে দিলি। তোকে নিজের ছেলের বউ করে কাছে রাখতে চেয়েছিলাম, নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতাম, আমার হৃদয়ের সবথেকে কাছে ছিলিস তুই আর আজ তুইই আমার হৃদয়ে সবথেকে বড় আঘাতটা দিলি।”
“বড় আব্বু আমার কথাটা শোনো..”
বিপাসা চৌধুরী এগিয়ে এসে নেহার গালে একের পর এক চর মেরে বলেন,
“তোর মতো দুশ্চরিত্রা, বারোভাতারী, বে* মুখে আর কি শুনব আমরা?”
“বড় আম্মু!”
“চুপ। তোর মতো মা*কে আমরা কেউ চাই না।”
আজমাইন চৌধুরীও বললেন,
“কি ভেবেছিলি তুই? একটা জারজ বাচ্চা নিয়ে এসে আমাদের সামনে দাড়াবি আর আমরা তোকে আপন করে নেব?”
নেহা অনেক ভরসা নিয়ে আরাভের দিকে তাকায়। কিন্তু তার ভালোবাসার মানুষটাও আজ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আরাভ মনে মনে বলে,
“তুই আমাকে এভাবে ঠকালি নেহা! তোকে তো ভালোবেসেছিলাম আমি।”
পাড়ার লোকও অনেক কথা বলে৷ আজমাইন চৌধুরী বলেন,
“এক্ষুনি এই মুহুর্তে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়েছে যা তুই। আমি তোর মুখ দেখতে চাই না। আজ থেকে তুই আমার কাছে মৃত।”
চলবে ✨