উত্তল তরঙ্গ পর্ব-১০

0
5

#উত্তল_তরঙ্গ
#পর্বঃ১০
#লেখিকাঃদিশা_মনি

নেহা নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে ট্রেন থেকে নামলো। ট্রেন এখন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে। ঢাকা শহরে এর আগেও এসেছে নেহা। তবে এবার আসার সম্পূর্ণ ভিন্ন এক তাগিদে৷ নেহা জানত গাজীপুরে চেনা পরিবেশে নিজের মেয়েকে বড় করতে হলে তাকে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হবে৷ সেজন্য সে বেছে নিয়েছে ঢাকা শহরকে। এখন এই শহরেই সে নিজের জীবনটা নতুন ভাবে শুরু করবে নিজের মেয়ের সাথে। যেখানে অতীতের কোন কালো ছায়া থাকবে না৷ ট্রেন থেকে নেমেই নেহা নিজের মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
“এই দেখ, তোর মা তোকে নিয়ে এক নতুন শহরে পা রাখল। তোর মা একজন যোদ্ধা। এত সহজে সে হারবে না। যাকে আমাকে ভাঙতে চেয়েছিল নতুন নিজেকে নতুন ভাবে গড়ে তুলেই তাদের উচিৎ শিক্ষা দেব।”

এরপর নেহা দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে চলে সামনের দিকে। এই ঢাকা শহরে তার আপন বলতে কেউ নেই, তবে চেনা জানা অনেকেই আছে। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের বাইরে আসতেই নেহার মাথায় প্রথম প্রশ্ন জাগলো সে কার সাথে যোগাযোগ করবে। অনেক ভেবে একজনের নাম তার মাথায় এলো,
“দৃঢ়তা আপু!”

দৃঢ়তা ছিল ভার্সিটিতে নেহার সিনিয়র। নেহাকে অনেক স্নেহ করত সে। নেহার সাথে তার জীবনেরও অনেক মিল ছিল৷ নেহা যেমন অনাথ ছিল, নিজের চাচা-চাচির কাছে মানুষ দৃঢ়তাও ঠিক তেমনি। তাই নেহা আর বেশি সময় নষ্ট করলো না। দৃঢ়তার ফোন নাম্বার তার মনে ছিল। অনেক সংশয়ে ভুগে অবশেষে একটি দোকানের সামনে গিয়ে অনেক অনুনয় বিনয় করে এক মিনিট ফোন করার সুযোগ পেল৷ যদিও তার মনে এই চিন্তাও কাজ করছিল যে দৃঢ়তা যদি নিজের ফোন নাম্বার পরিবর্তন করে ফেলে তাহলে কি হবে! তবে সৌভাগ্যবশত নাম্বারটা চেইঞ্জ করে নি সে। রিং হবার কিছু সময় পরই দৃঢ়তা ফোনটা রিসিভ করে বলে ওঠে,”হ্যালো, কে বলছেন?”

“দৃঢ়তা আপু!”

“হ্যাঁ, আপনি কে?”

“আমি নেহা আপু। মনে আছে ভার্সিটিতে আপনার জুনিয়র ছিলাম।”

“ওহ, নেহা তুমি। কতদিন পর তোমার সাথে কথা হচ্ছে। এতদিন পর বুঝি এই আপুর কথা মনে পড়ল?”

“আপু আসলে অনেক বড় একটা বিপদে পড়েই আপনাকে ফোন দেয়া। আপনি কি আমার একটা সাহায্য করতে পারবেন?”

দৃঢ়তা বলে ওঠে,
“কি হয়েছে নেহা? সবকিছু ঠিকঠাক তো?”

“এতকিছু ফোনে বলা সম্ভব নয় আপু৷ আমি কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের বাইরে অপেক্ষায় আছি। আপনি দয়া করে, এখানে আসুন। আমি অনেক অসহায় হয়ে এই ঢাকা শহরে পা রেখেছি। আপনি ছাড়া ভরসা করার মতোও কাউকে পেলাম না।”

“আচ্ছা, তোমার লোকেশনটা একটু পাঠিয়ে দাও। আমি আসছি।”

দৃঢ়তা বুঝতে পারে নেহা কোন বড় সমস্যার মধ্যে আছে। তাই আর বেশি কথা বাড়ায় না। নেহাও দোকানের লোকটাকে বলে লোকেশন পাঠিয়ে দেয়। অতঃপর নিজের মেয়েকে আরো শক্ত করে ধরে বলে,
“আশা করি, এবার আমাদের একটা গতি হয়ে যাবে। আর এভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হবে না।”

★★★
নাতাশার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল আহির। তার মনে হচ্ছিল নাতাশা বোধহয় মুমিনুল পাটোয়ারীকে সব সত্য বলে দেবে কিন্তু আহির চায় না এসব সত্য প্রকাশ পাক। তাই সে চোখের ইশারা করে নাতাশাকে থামতে বলে। কিন্তু নাতাশা না থেমে এগিয়ে এসে বলে,
“আঙ্কেল, আপনি জানতে চান তো এই বাচ্চাটার মা কে? আমি আপনাকে সব বলছি। এই বাচ্চাটার মা হলো নেহা চৌধুরী। সেই নেহা চৌধুরী যার জন্য মৃদুল মারা গেছে।”

মুমিনুল পাটোয়ারী অবাক স্বরে বললেন,
“কিন্তু আহির যে বলল, এই বাচ্চার বাবা ও তাহলে এসবের মানে কি?”

আহির রক্তিম চোখে নাতাশার দিকে তাকায়। নাতাশা সেসবে পাত্তা না দিয়ে বলে,
“আসলে হয়েছে কি, আপনি জানেন তো। আহিরের কাছে মৃদুল শুধু ওর বন্ধু না ওর ভাই ছিল। তো প্রতিশোধ তো আরহামকে নিতেই হতো। এজন্য ঐ নেহা চৌধুরী নামক মেয়েটাকে আহির প্রেমের জালে ফাসায়। আর ঐ নেহা মেয়েটাও ছিল সেরকম। আহিরের রূপ, ঐশ্বর্য এসব দেখে ওর প্রেমে পড়ে যায়। আহিরের আসল উদ্দ্যেশ্য তো ছিল ওকে প্রেমের ফাদে ফেলে কষ্ট দেয়া। তবে মেয়েটা প্রেমে এতো বেশি আসক্ত হয়ে পড়ে যে একদিন সুযোগ বুঝে নিজেই আহিরকে অফার দেয় বিয়ের আগেই ইন্টিমেট হবার। আহির তো শুরুতে একদম রাজি হয়নি কিন্তু ঐ মেয়েই জোরাজোরি করে। একদিন তো ও আহিরকে নেশা করিয়ে তারপর ওর সাথে ফিজিক্যাল হয়!”

“কি বলছ এসব তুমি?”

“হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। আসলে ঐ মেয়ের উদ্দ্যেশ্য ছিল আহিরকে ফাসানো। এরপরই তো ও প্রকাশ করে, ও আহিরের বাচ্চার মা হতে চলেছে। আহির এরপর ঐ মেয়েকে সমস্ত সত্য বলে দেয় যে প্রতিশোধ নিতেই ও সব করেছে। এরপর সেই মেয়ে যে কি পাগলামী শুরু করে, বাচ্চাটা পর্যন্ত নষ্ট করতে চেয়েছিল। আহির তারপর কত করে বলল ওকে বিয়ে করবে ওকে স্বীকৃতি দেবে তবুও কোন কথা শুনতে চাইল না। ওর দরকার ছিল শুধু আহিরের টাকার৷ এজন্য আহির বাধ্য হয়ে মেয়েটাকে বন্দি করে রাখে। তারপর বাচ্চাটা জন্ম নেয়ার পর তো ঐ মেয়ে আর এক মুহুর্ত থাকতে রাজি ছিল না। আহিরও ওকে যথাযথ টাকা পয়সা দিয়ে বিদায় করেছে। আপনি জানেনও না, আঙ্কেল বাচ্চাটার প্রতি ওর কোন মায়া ছিল না। টাকা পেয়ে ডেংডেং করে বিদেশে চলে গেছে।”

মুমিনুল পাটোয়ারী ঘৃণার সহিত বলেন,
“মেয়েটা তো ভীষণ খারাপ। এই বাচ্চাটার কথাও একবার ভাবলো না!”

বলেই তিনি আহিরের কোল থেকে তার মেয়েকে নিয়ে বলে,
“আমি তোমার অবস্থা বুঝতে পারছি আহির। আমাকে আগেই সবটা বললে পার‍তে। এই বাচ্চার যে কোন অযত্ন না হয় আমরা সবাই মিলে তার খেয়াল রাখব। তুমি একদম চিন্তা করো না।”

আহির কৃতজ্ঞতার সাথে নাতাশার দিকে তাকায়। নাতাশা তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,”এটুকু তো আমায় করতেই হতো তোর জন্য। তোর দু দুটো প্রতিশোধ ছিল বলে কথা।”

কথাটা শুনেই আহির হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। মনে পড়ে যায় তার অতীতের কষ্টের কথা। ছোটবেলায় যখন কেউ তাকে তার বাবার নাম জিজ্ঞেস করত তখন সে বলতে পারত না, সবাই তাকে জারজ বলত! তার মাকেও কম অপমান শুনতে হয়নি। এমন এক অসুস্থ শৈশব নিয়েই বেড়ে উঠেছে সে। তার মাও কখনো তাকে তার বাবার ব্যাপারে বলেনি। এজন্য মায়ের প্রতিও একটা চাপা রাগ ছিল। তবে মৃত্যুর আগে আহিরের মা আমিনা বেগম তাকে সব সত্য খুলে বলে৷ তার মায়ের সাথে এক ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে আজমাইন চৌধুরীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল৷ দুজনে গোপনে বিয়েও করে নিয়েছিল। কিন্তু আজমাইন চৌধুরী নিজের পরিবারের সাথে কখনো আমিনাকে পরিচয় করান নি৷ বরং নিজের বাবার কথা রাখতে ও তার ব্যবসায়িক অংশীদার পেতে তার পছন্দ করা বিপাসা নামের এক মহিলাকে পরবর্তীতে বিয়ে করেন তিনি। যেদিন আমিনা প্রথম জানতে পারেন তিনি প্রেগন্যান্ট ঠিক সেদিনই স্বামীর এই প্রতারণাও কথাও জানেন তিনি। এরপর তার বাড়িতে গিয়ে নিজের অধিকারের দাবি করেন। কিন্তু আজমাইন চৌধুরী ও তার পুরো পরিবার তাকে ভীষণভাবে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়। আমিনা বেগমকে নিজের স্ত্রী হিসেবেও অস্বীকার করেন তিনি। এসব শুনে আহির বুঝতে পারে তার এত ভয়াবহ শৈশবের কারণ কি। সেই সময় সে ভীষণ রেগে গিয়েছিল। তারপর যখন জানতে পারে তার প্রিয় বন্ধু মৃদুলের মৃত্যুর জন্যেও নেহা চৌধুরী নামক মেয়েটি দায়ী যে কিনা আজমাইন চৌধুরীর ভাইয়ের মেয়ে তখন তার রাগ আরও তীব্র হয়। প্রতিশোধের জন্য হয়তো নেহাকে বেছে নিত না সে কিন্তু এই ঘটনা তার পরিকল্পনা বদলে দেয়৷ এই কারণেই সে নেহাকে ব্যবহার করে একাধারে নিজের ও নিজের বন্ধুর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছে।
চলবে ✨