উত্তল তরঙ্গ পর্ব-১৫+১৬

0
3

#উত্তল_তরঙ্গ
#পর্বঃ১৫
#লেখিকাঃদিশা_মনি

নেহা তার নতুন কর্মস্থলে এসে কাজ শুরু করল। প্রথম দিন তার কাজের অভিজ্ঞতা যথেষ্ট সুন্দর ছিল। সহকর্মীরা সবাই তার সাথে অনেক ভালো ব্যবহার করেছে। সবার এত সুন্দর ব্যবহারে নেহা মুগ্ধ হয়। যদিও এখনো সে নিজের বসের সাথে দেখা করে নি। তবে সবার মুখে শুনেছে তার বস অনেক ভালো মানুষ। এটা শুনে নেহা স্বস্তি পেয়েছে।

আজকের কাজ শেষে তাকে তার বসের কেবিনে ডেকে পাঠালো হলো। তার বস হলেন শামিম কায়সার নামের এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। যিনি নেহাকে দেখে সহাস্যে বললেন,
“তুমিই নেহা চৌধুরী?”

“জ্বি, স্যার।”

“এসো, বসো। দৃঢ়তার মুখে তোমার কথা শুনেছি। দৃঢ়তা তো একদম আমার মেয়ের মতো। ও একদিন আমাকে অনেক বড় একটা বিপদ থেকে বাচিয়েছিল। যখন আমার পরিবার আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল তখন ও আমার সঙ্গ দিয়েছিল।”

নেহা বলে,
“আসলেই, দৃঢ়তা আপুর মতো মানুষ হয় না। উনি সবার এত সাহায্য করেন..আমি আমার মেয়েকেও ওনার মতো করে গড়ে তুলতে চাই। নিজের মেয়েকে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতেই তো আমার এত লড়াই।”

শামিম কায়সার খুশি হন নেহার কথা শুনে। তিনি স্নেহভরা কন্ঠে বলেন,
“তোমার জীবনে হয়তো অনেক চড়াই উতড়াই আছে সামনেও থাকবে তবে একটা কথা সবসময় মনে রাখবে। সব পরিস্থিতিতে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে নিজের সবটুকু দিয়ে কাজ করে যাবে৷ তাহলে দেখবে একদিন তিনিই তোমাকে তোমার কাঙ্খিত মঞ্জিলে পাঠিয়ে দিবেন।”

“জ্বি, স্যার। দোয়া করবেন আমার জন্য।”

এরপর নেহার জীবন দ্রুত বদলাতে লাগল। সে নিজের সর্বোচ্চ পরিশ্রম দিয়ে নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করল। পাশাপাশি নিজের মেয়েকেও যতটা পারা যায় সময় দিল। তার চোখে ছিল হাজারো স্বপ্ন। যেই স্বপ্নই তাকে ছুটে নিয়ে যাচ্ছিল এক কাঙ্খিত গন্তব্যের দিকে।

★★
৫ বছর পর,
সময়ের স্রোতে ভেসে গেছে হাজারো স্মৃতি, দিন এবং মুহুর্ত। সূর্যকে ঘিরে ইতিমধ্যেই ৫ বার আবর্তন করে ফেলেছে সূর্য।

এই ৫ বছরের ব্যবধানে জীবনের ছন্দেও এসেছে অনেক পরিবর্তন।

নেহা আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। অফিসের ফর্মাল ড্রেসকোডে তাকে বেশ মানানসই লাগছে। সেদিনের সেই ভঙ্গুর মেয়েটা আজ ঘুরে দাঁড়িয়েছে মারাত্মক ইতিবাচক ভঙ্গিতে। তার দুচোখে হাজারো স্বপ্নের ঝিলিক আজো বিদ্যমান।

নেহা আয়নায় নিজেকে দেখে বলে,
“বরাবরের মতো আজকের প্রজেক্টটাও তোকে সঠিকভাবে কমপ্লিট করতে হবে নেহা। যাতে করে এই ডিলটা আমাদের কোম্পানির হাতছাড়া না হয়।”

নেহার এই ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করে দুটো ছোট্ট হাত এসে তাকে জড়িয়ে ধরল পেছন থেকে। নেহা আলতো হেসে পিছন ফিরে তাকালো। তার মেয়ে নিয়া, ৫ বছরের এক শান্তশিষ্ট মেয়ে। তবে মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য সে ব্যকুল! মায়ের কাছে এলে তার সব শান্তশিষ্ট ভাব হারিয়ে গিয়ে এক অবাক চাঞ্চল্য এসে ভাড় করে। নিয়া আধো আধো স্বরে বলে,
“আম্মু..জানো আজ স্কুলে কি হয়েছে?”

নেহা নিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,
“কি হয়েছে আমার নিয়ামনির?”

নিয়া বলে,
“আজ সাদিয়া আমার টিফিন বক্স থেকে খাবার চুরি করে খেয়ে নিয়েছে। আমি এই কথা তাজিব ভাইয়াকে বলে দিয়েছি তারপর তাজিব ভাইয়া এসে সাদিয়াকে বকেছে। আর সাদিয়া ভ্যা ভ্যা করে কেঁদেছে।”

নেহা হেসে ফেলে নিজের মেয়ের কথা শুনে। আর বলে,
“বাহ, তারপর তুমি কি খেলে?”

“তাজিব ভাইয়া আমার সাথে তার টিফিন ভাগ করেছে।”

“ওহ, আচ্ছা। তাজিব ভাইয়াকে ধন্যবাদ দিয়েছ তো?”

“হুম, দিয়েছি তো। আমার প্রিয় তাজিব ভাইয়াকে ধন্যবাদ সহ একটা হামি দিয়েছে।”

“বাব্বাহ! আমার মেয়েটা তো খুব সুন্দর ধন্যবাদ দিতে শিখেছে। তুমি সাদিয়ার সাথে অকারণে ঝগড়া করো নি তো? বা ও যখন কেদেছে তখন ওকে নিয়ে মজা করো নি তো?”

নিয়া মাথা নাড়িয়ে না-বোধক ইশারা করে।

“মনে রেখো, কখনো কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না। তবে কেউ যদি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করে তাকে ছাড়ও দেবে না। যোগ্য জবাব অবশ্যই দেবে।”

নিয়া আবারো মাথা নাড়ায়। নেহা বলে,
“এখন যাও, পড়তে বসো। তারপর বিকেলে তাজিব ভাইয়ার সাথে খেলতে যেও। আর হ্যাঁ, সঠিক সময় খাবারটা খেয়ে নেবে। ইচ্ছা হলে কার্টুন দেখো একটু তবে একঘন্টার বেশি টিভি স্ক্রিনের সামনে থাকবে না। নিজের পুরো ফোকাস পড়াশোনায় দাও। তোমাকে কিন্তু জীবনে অনেক ভালো কিছু করতে হবে নিয়ামনি।”

“হুম, আম্মু। তুমি দেখো একদিন আমি অনেক বড় একজন পাইলট হবো। আকাশে বিমান উড়াব।”

নেহা হেসে বলে,
“কালকেই না তুমি বললে তুমি ডাক্তার হবে। তাজিব ভাইয়াকে ইঞ্জেকশন দিবে! আজকেই আবার পাইলট হতে চাইছ।”

নিয়া কপাল চাপড়ে বলে,
“আরে আম্মু তুমি বুঝছ না, আমি তো ডাক্তারও হবো আর পাইলটও হবো।”

“হ্যাঁ, নিয়ামনি, তুমি একসাথে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট সব হয়ো।”

বলেই মেয়ের সাথে খুনশুটিতে মেতে ওঠে নেহা।

★★
“রাগ করে না আহি বেবি! এই নুডলস টা খেয়ে নাও।”

আহিরা রেগে এবার নুডুলসের প্লেটটাই ছুড়ে মারে। নাতাশা হতাশ হয়ে তাকায় আহিরার দিকে। আহিরা রাগী স্বরে বলে,
“বললাম না, আমি নুডলস খাবো না। আমার স্যান্ডউইচ লাগবে।”

নাতাশা বলে,
“আমি তো জানতাম না তুমি স্যান্ডউইচ খাবে, এত কষ্ট করে তোমার জন্য নুডলস বানিয়েছিলাম। আর তুমি সেটা ফেলে দিলে?”

“আমার অনুমতি ছাড়া তোমায় কে নুডলস বানাতে বলেছে? আমি পাপাকে বলে দেব, তার অনুপস্থিতিতে তুমি আমার কেয়ার করছ না। তারপর বুঝবে।”

নাতাশা ভয়ে বলে,
“নাহ, আহি বেবি। এমন করে না। তুমি না গুড গার্ল। আমি এখনই তোমার জন্য স্যান্ডউইচ বানিয়ে আনছি।”

আহিরা সোফার উপর পায়ে পা তুলে বসে পড়ে। এতটুকুনি মেয়ের এত এটিটিউড দেখে নাতাশার গা জ্বলে যায় কিনে সে কিছু বলতেও পারে না। আহিরা বলে,
“যাও, ফাস্ট ফাস্ট আমার জন্য স্যান্ডউইচ নিয়ে এসো। আর হ্যাঁ, চিকেন ফ্লেভার, সাথে চিলি সস যেন থাকে। যদি খাবারে স্বাদ না হয়, তাহলে কিন্তু আবারো ফেলে দেব।”

নাতাশা দাঁতে দাঁত চেপে রান্নাঘরে যায়। তার হাসপাতালে যাবার সময়ও হয়ে এসেছে। যাওয়ার পথে আবার তাকে আহিরাকে স্কুলেও নামিয়ে দিয়ে যেতে হবে। এসব নিয়ে যারপরনাই বিরক্ত সে৷ আহির কিছু জরুরি কাজে দেশের বাইরে গেছে দুদিন হলো। আর এই দুদিনেই এই ছোট্ট মেয়েটা নাতাশার জীবন একদম বরবাদ করে দিয়েছে। নাতাশা রান্নাঘরে গিয়ে স্যান্ডউইচ বানাতে বানাতে বলে,
“দুই বাপ-বেটি মিলে আমার জীবনটা একদম জাহান্নাম বানিয়ে রেখেছে। আমি তো শুধু আহিরের জন্য এই বাচ্চা নামের আপদটাকে সহ্য করছি নাহলে তো কবেই..কেন যে এই মেয়েটাকেও আহির ত্যাগ করলো না তেমনভাবে ঐ নেহা আর ওর আরেক মেয়েকে করেছিল। যদি তা করতো তাহলে আজ আমায় এই দিন দেখতে হতো না।”

এদিকে মুমিনুল পাটোয়ারী এসে আহিরাকে কোলে দিয়ে বলে,
“কি হয়েছে আমার আহিরা দিদিভাই? এত রাগ করে আছে কেন?”

আহিরা বলে,
“উফ দাদাই, তোমাকে আর কি বলবো। নাতাশা আন্টি কিছুই পারে না। আমার মেজাজটা গরম করে দিলো। তোমার ফোনটা আমায় একটু দাও তো পাপাকে ফোন করি। দেখি পাপা কবে আসে।”

“এই নাও দিদিভাই। আমি কল দিয়ে দেব?”

“না, দাদাই। তার কোন প্রয়োজন নেই। আমি হলাম সুপারস্মার্ট। আমি নিজেই জানি কিভাবে কল করতে হয়। ”

বলে সে অতি সহজেই আহিরকে কল দিল। কিন্তু আহির ফোনটা রিসিভ করল না। আহিরা রেগে ফোনটা আছাড় মারল৷ মুমিনুল পাটোয়ারী ভয়ে বললেন,
“কি হলো দিদিভাই?”

“তোমার ছেলে আমায় ইগ্নোর করছে দাদাই! আমার ফোন রিসিভ করছে না। আই কান্ট বেয়ার ইট। তোমার ছেলেকে বলে দিও, তার সাথে আমি আর কোন কথা বলব না। সে যেন প্রিন্সেস প্রিন্সেস বলে ন্যাকামো করে আমার কাছে না আসে।”

বলেই আহিরা ভীষণ রাগ দেখিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।

চলবে ইনশাআল্লাহ✨

#উত্তল_তরঙ্গ
#পর্বঃ১৬
#লেখিকাঃদিশা_মনি

নেহা আজ অফিসে এসে সব কাজ সঠিক ভাবে সম্পন্ন করে বের হতে হবে। এমন সময় সে তার চারপাশে কিছু কলিগদের মধ্যে কানাঘুষা শুনল। তার এক কলিগ বলছিল,
“আরে শুনেছ, শামিম স্যার নাকি খুব শীঘ্রই অবসর নিতে চলেছেন। তার যায়গায় আসতে চলেছে নতুন কেউ।”

“আমিও তো তাই শুনলাম। শামিম স্যার তো অনেক ভালো লোক ছিলেন। ওনার বদলে যে আসবে তিনি যে কেমন হয় সেটাই ভাবছি।”

“আমি যতদূর শুনলাম, ওনার কোন আত্মীয়ই এই কোম্পানির নতুন সিইও হবেন।”

“আমিও তো তাই শুনলাম।”

কথাগুলো শুনে নেহা অবাক হলো। এমন কিছুর গুঞ্জন সে আগে শোনে নি। শামিম কায়সার তো নেহার কাছে একদম বটবৃক্ষের মতো ছিল এতদিন। বিগত ৫ টা বছর ধরে লোকটা নেহাকে অনেক স্নেহ দিয়েছেন। তাই তার বিদায়ের কথা শুনে নেহার মনটা যারপরনাই খারাপ হয়ে গেল। সে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। তার মনেও বাসা বাধল নতুন আশঙ্কা। তার নতুন বস কেমন হবে? তিনিও কি শামিম কায়সারের মতো মহৎ হৃদয়ের ব্যক্তি হবেন? আর যদি তেমনটা না হয় তখন?

★★
“আমার জীবনে এসব মহানুভবতার কোন স্থান নেই স্যান্ডি। তোমাকে আমি অনেক সুযোগ দিয়েছি বাট তুমি সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারো নি৷ আর তাই আজ আমি তোমায় ফায়ার করে দিচ্ছি।”

স্যান্ডি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তার বসের দিকে তাকাল। কিন্তু লোকটার চোখে বিন্দুমাত্র কোন করুণা ছিল না৷ ছিল শুধু একরাশ দম্ভ। পায়ের উপর পা তুলে বসে তিনি বললেন,
“শাহরিয়ার কায়সারের কাছে ভুলের কোন ক্ষমা নেই। ভুলের সমানুপাত হলো শাস্তি৷ ভুল যেহেতু তুমি করেই ফেলেছ তাই শাস্তি পেতেই হবে।”

স্যান্ডি এবার শাহরিয়ার কায়সারের একদম পায়ের কাছে বসে পড়ে বলে,
“দয়া করে আমায় আর একটা সুযোগ দিন স্যার।”

শাহরিয়ার কায়সার তাকে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে বলল,
“নো চান্স।”

বলেই উঠে দাঁড়ালো। অতঃপর সিকিউরিটি গার্ড দেখে বের করে দেয়া হলো স্যান্ডিকে। অতঃপর সে গলা খাকারি দিয়ে নিজের ম্যানেজারকে ডেকে পাঠালো। ম্যানেজার এসেই তাকে স্যালুট দিলো৷ শাহরিয়ার বলল,
“আমার কানাডা থেকে দেশে ফেরার সব বন্দবস্ত হয়েছে তো?”

“জ্বি, স্যার।”

“গুড। ড্যাড সবকিছু ঠিকভাবে সামলাতে পারছে না। ওনার মহানুভবতাই আমাদের কোম্পানির অনেক ক্ষতি করছে। এভাবে আমাদের কোম্পানি কখনোই ইন্টারন্যাশনালি ফেমাস হতে পারবে না। সেজন্য এবার আমাকে কোম্পানির হাল ধর‍তেই হবে।”

শাহরিয়ার কায়সারের চোখে একটা বুনো জেদ। অতঃপর সে একটু শান্ত হয়ে বলল,
“আমার আজকের সিডিউলটা বলো।”

“জ্বি, আজ দুপুরে আপনার পাটোয়ারী এন্টারপ্রাইজের সিইও আহির পাটোয়ারীর সাথে একটা মিটিং আছে।”

আহির পাটোয়ারীর নাম শুনেই শাহরিয়ারের চোখে একটা অদ্ভুত আলো জ্বলে ওঠে। সে নিজের ডেস্ক থেকে একটি বল হাতে তুলে নিয়ে বলে,
“আহির পাটোয়ারী, বিজনেস ওয়াল্ডে ওনার অনেক নাম শুনেছি। বেশ, মিটিং এর টাইমটা বলে রাখুন।”

★★
নেহা অফিস থেকে বাসায় ফিরেই দেখল নিয়া একদম বাধ্য মেয়ের মতো তার সব কথা শুনেছে। এখনো সে পড়ার টেবিলে বসে আছে। খাবার খেয়ে প্লেট খুব সুন্দর ভাবে ঢাকনা দিয়ে রেখেছে। একটা খাবারও মাটিতে ফেলে নি। এসব দেখে সে তৃপ্তি পেল। অতঃপর নিয়ার পড়ার টেবিলের কাছে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে গালে একটা হামি দিয়ে বলল,
“আমার মেয়েটা তো একদম গুডগার্ল হয়ে গেছে। কত সুন্দর আমার সব কথা মেনে চলছে।”

কিন্তু নেহা খেয়াল করল নিয়ার মনটা বিষন্ন। এটা দেখে সে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল,
“কি হয়েছে নিয়ামনি? তোমাকে এমন লাগছে কেন?”

নিয়া হঠাৎ করে কেঁদে ওঠে। নেহার বুকটা ছ্যাত করে ওঠে।

“কাঁদছ কেন নিয়ামনি? তুমি কি পড়ে গিয়ে কোথাও ব্যথা পেয়েছ?”

“আম্মু জানো..আজ আমি যখন তাজিব ভাইয়ার সাথে পার্কে খেলতে গেছিলাম তখন এক আঙ্কেল আমাকে আমার বাবার নাম জিজ্ঞেস করেছিল..আমি তখন বলতে পারি নি৷ এজন্য ঐ আঙ্কেলটা আমার দিকে কিভাবে যেন তাকিয়ে ছিল৷ তারপর আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললো, আমার কি কোন বাবা নেই, তাহলে আমি কিভাবে জন্ম নিয়েছি। ওনার কথা আমি কিছু বুঝতে পারি নি। উনি বললেন, সবারই তো বাবা থাকে, আমার বাবা কেন নেই। আমি ওনার কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি নি আম্মু।”

নিয়ার কথা শুনে নেহা তার মেয়েকে একদম বুকে জড়িয়ে নেয়। নেহার চোখেও জল। সে মনে মনে বলে,
“এই ভয়টাই যে আমাকে সবসময় গ্রাস করে। কিন্তু তোমাকে আমি কিভাবে তোমার বাবার পরিচয় দেব..সে যে একটা অমানুষ। আজো আমার তার করা অমানবিক অত্যাচারের কথা মনে পড়ে। শুধুমাত্র তার জন্য আমার সাজানো গোছানো জীবনটা একদম এলোমেলো হয়ে গেছে।”

নেহা নিজের চোখের জল মুছল। নাহ, তার এমন ভেঙে পড়লে চলবে না৷ সে যদি ভেঙে পড়ে তাহলে তার মেয়েকে কে সামলাবে? এজন্য নেহা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“নিয়ামনি, চলো আজ আমরা একটা নতুন গেইম খেলব।”

নিয়াও এবার কান্না থামিয়ে বলল,
“কি গেইম মামনি?”

নেহা এবার নিয়াকে নিয়ে বিছানায় বসল। তারপর তার সাথে রক, পেপার, সিজার খেলতে শুরু করল। খেলায় দুজনে এত মজা করতে লাগল যে নিয়া তার সব দুঃখের কথা ভুলেই গেল।

★★
নিজের রুমে বসে আছে আরাভ। তার অবস্থা এখন আগের থেকে শোচনীয়। আজমাইন চৌধুরীর অসুস্থতার জন্য তাদের স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তিই বিক্রি করে দিতে হয়েছে। এখন সে বিপাসা চৌধুরী ও আজমাইন চৌধুরীকে নিয়ে একটা ভাড়া বাড়িতে থাকে। আজমাইন চৌধুরী এখনো কোমায়।

আরাভ বসে বসে মাসের সব বাজারের হিসাব করছিল৷ এমন সময় একটা পুরাতন ফাইল ঘাটতে গিয়ে সে নিজের আর নেহার একসঙ্গে একটা ছবি দেখে। ছবিটা দেখে সে এতোটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে যে তার চোখে জল চলে আসে। বিপাসা চৌধুরী তাদের প্রতিবেশী রিনা নামের একটি মেয়েকে নিয়ে আরাভের রুমে আসেন। রিনা এসেই আরাভের দিকে তাকায় ব্যকুল দৃষ্টিতে। আরাভের প্রতি রিনার রয়েছে এক অন্যরকম অনুভূতি। যা সে কখনোই ব্যক্ত করতে পারে না৷ তবে বিপাসা চৌধুরী জানেন রিনার মনের কথা। তিনি এটাও বিশ্বাস করেন যে, এই রিনা নামের মেয়েটা তার ছেলেকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে। কিন্তু আরাভের মনে যে আজো নেহার বাস। সে কি নেহাকে ভুলে নতুন জীবন শুরু করতে পারবে?

★★
আহিরা নিজের হাতে থাকা স্মার্টওয়াচে বারবার সময় দেখছে। ইতিমধ্যেই তার স্মার্টওয়াচে ২০ টারও বেশি কল এসেছে আহিরের নাম্বার থেকে। কিন্তু সে ফোনটা একদম রিসিভ করে নি। সে মনের সুখে টিভিতে কার্টুন দেখছে ও পপকর্ন খাচ্ছে। এমন সময় নাতাশা তার রুমে এসে বলে,
“আহিরা, এই যে তোমার জন্য স্যান্ডউইচ নিয়ে এসেছি।”

আহিরা রাগান্বিত স্বরে বলে,
“এত টাইম লাগল কেন? তোমার স্যান্ডউইচ তুমি খাও। আমার স্কুলের জন্য লেইট হয়ে যাচ্ছে। আমাকে জলদি স্কুলে পৌঁছে দাও।”

“আমি এত কষ্ট করে স্যান্ডউইচ বানালাম, তুমি সেটা খাবে না?”

“তুমি কি বয়রা নাকি? কানতে শুনতে পাও না?”

“শুনেছি কিন্তু এত কষ্ট..”

“এসব সিল্লি কথা আমার সামনে বলবে না। তাড়াতাড়ি স্কুলে রেখে এসো নাহয় আমি ড্রাইভারকে নিয়ে একাই বেরিয়ে পড়ছি।”

নাতাশা বলে,
“ঠিক আছে, আমি তাহলে স্যান্ডউইচটা তোমার টিফিনের জন্য দিচ্ছি।”

“ওকে।”

এমন সময় মুমিনুল পাটোয়ারী এসে বলেন,
“দিদিভাই, তোমার পাপা নাকি তোমায় ফোন করছে। তুমি রিসিভ করছ না কেন?”

“আমার ইচ্ছা হয়নি আমি রিসিভ করি নি৷ তুমি নিজের ছেলেকে বলে দাও, আমায় যেন আর কল করে ডিস্টার্ব না করে। আমি এখন স্কুলে যাচ্ছি। আর এটাও বলে দিও যে ভ্যাংকুবার থেকে আমি যা যা আনতে বলেছি তার সবকিছু যেন নিয়ে আসা হয়। আদারওয়াইজ, যেন সে বাংলাদেশের মাটিতে পা না রাখে।”

চলবে ইনশাআল্লাহ✨