উত্তল তরঙ্গ পর্ব-৫০

0
5

#উত্তল_তরঙ্গ
#পর্বঃ৫০
#লেখিকাঃদিশা_মনি

আহির ধীর পায়ে আহিরাকে সাথে নিয়ে এগিয়ে এলো নেহার কাছে। নেহা হাসপাতালের বেডে বসা অবস্থায় ছিল৷ তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। আহিরা এসে নেহাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠল,
“আমার মাম্মা!”

নিয়া ও বিপাসা চৌধুরী অবাক হয়ে তাকালো। নিয়া বলে উঠল,
“এই মেয়েটা আম্মুকে কেন নিজের মা বলছে?”

বিপাসা চৌধুরী বলেন,
“হ্যাঁ, তাই তো৷ আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

আরাভ বলে ওঠে,
“অনেক কিছুই জানতে এবং বুঝতে পারবে তুমি আম্মু। তোমার এখনো অনেক কিছু জানার আছে। কিন্তু তার আগে আমায় বুঝতে হবে, মিস্টার আহির এসব কেন করছেন। এসব কি ওনার নতুন কোন চাল।”

আহির বলে উঠল,
“এসব আমার কোন চাল নয় আরাভ চৌধুরী। আমি সত্যিকার অর্থে সবকিছু ঠিক করার জন্যই এখানে এসেছি। আজ আমি পুলিশের কাছে গিয়ে নিজের সব অপরাধ কবুল করল।”

নেহা অবাক চোখে আহিরের দিকে তাকায়৷ আহিরের চোখ দেখে মনে হচ্ছিল না সে মিথ্যা বলছে। কিন্তু নেহা বুঝে উঠতে পারে না, যেই লোকটা একটু আগে অব্দি তার বিরুদ্ধে কেস লড়ছিস সে এখন হঠাৎ কেন নিজের সব অপরাধ স্বীকার করতে চাইছে। এই ৫ বছরে কখনো তো করে নি। আহির নেহার দিকে তাকায়। তার চোখ বেদনায় নীল হয়ে গেছে। আহির ধীর পায়ে নেহার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“জানি আমি ক্ষমার অযোগ্য..কিন্তু আজ আমায় ক্ষমা চাইতেই হবে। নিজের অপরাধের জন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি নেহা। তোমার সাথে আমি যা যা করেছি তার কোনটাই তুমি ডিজার্ভ করতে না। বিনা অপরাধে তোমার জীবনটা নরক বানিয়ে দিয়েছি আমি।”

নেহা কিছু বলার মতো খুঁজে পায়না। এরইমধ্যে একজন ডাক্তার ছুটে এসে আরাভকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“মিস্টার আরাভ, আপনার বাবা কেমন জানি করছে..”

কথাটা শুনেই আরাভ আর স্থির থাকতে পারে না। বিপাসা চৌধুরীও হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। তারা দুজনেই আজমাইন চৌধুরীর কেবিনের দিকে দৌড় দেন। কিন্তু কেবিনের সামনে গিয়েই আরাভের পা থেমে যায়। বিপাসা চৌধুরী কেবিনে প্রবেশ করতে চাইলে আরাভ তাকেও থামিয়ে দিয়ে বলে,
“দাঁড়াও আম্মু। আজ আমাদের নয় অন্য একজনের ভেতরে যাওয়া প্রয়োজন।”

বিপাসা চৌধুরী হতবাক স্বরে বলেন,
“কার?”

আহিরও ততোক্ষণে সেখানে চলে এসেছিল। আরাভ আহিরের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“যান মিস্টার আহির,,, আব্বুর সাথে দেখা করে আসুন। আব্বুর হাতে হয়তো আর বেশি সময় নেই। ওনাকে গ্লানি থেকে মুক্তি হবার একটা সুযোগ দিন।”

আহির পাথরের মতো শক্ত মুখ করে ভেতরে প্রবেশ করে। বিপাসা চৌধুরী বলেন,
“মানে কি এসবের আরাভ? এই লোকটা কে? আর তুই কেন ওনাকে ভেতরে যেতে দিলি।”

আরাভ বুঝতে পারে এখন তাকে তার মাকে সব সত্য জানাতে হবে। নিজের বাবার সব অপকর্ম খুলে বলতেই হবে। আরাভ একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে দেয়।

★★
আজমাইন চৌধুরীর শ্বাস ক্ষীণ হয়ে আসছিল। আহির ধীর পায়ে এগিয়ে এসে তার সামনাসামনি দাঁড়ায়। আজমাইন চৌধুরী নিজের চোখের সামনে আহিরকে দেখে অক্সিজেন মাক্সটা খুলে ধরে আসা গলায় বলেন,
“কে তুমি?”

আহির শান্ত স্বরে বলে,
“চিনতে পারছেন না আমায়? আপনি আপনার ঔরসজাত সন্তান…যাকে আপনি কখনো স্বীকৃতি দেন নি…আমি সেই হতভাগা ছেলে যে নিজের মাকে আজীবন দুশ্চরিত্রা বলে অপমানিত হতে দেখেছি। নিজের মাকে অসহায়ভাবে দুনিয়া ত্যাগ করতে দেখেছি..কিন্তু শেষ মুহুর্তেও তার চোখে আপনার জন্য ভালোবাসা দেখেছি। আমি সেই যে আপনার অপকর্মের বোঝা বহন করে নিজেও পাপের পথে চলে আসি। একটা নিরপরাধ মেয়ের জীবন ধ্বংস করে দেই।”

আজমাইন চৌধুরীর দুচোখ জলে ভড়ে ওঠে। জীবনের শেষ সময়ে এসে নিজের করা অপরাধগুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে থাকে৷ তিনি উত্তেজিত স্বরে বলেন,
“তোমার এবং তোমার মায়ের সাথে যেই অন্যায় আমি করেছি তা অপূরণীয়..তার কোন ক্ষমা হয় না। তার জন্য আমি যতই ক্ষমা চাই না কেন৷ আমি জানি, আমার লোভ এবং স্বার্থপরতার জন্য তোমার মার জীবন কতটা কষ্টে কেটেছে। তোমার জন্মদাতা পিতা হয়েও আমি কখনো তোমায় নিজের সন্তানের স্বীকৃতি দিতে পারি নি। সবদিক দিয়ে আমি ব্যর্থ। আমি এটাও জানি, নেহার সাথে যা হয়েছে তার জন্যেও পরোক্ষ ভাবে আমি দায়ী। তাই হয়তো আল্লাহ আমায় এত শাস্তি দিচ্ছেন।”

আহির নিশ্চুপ। আজমাইন চৌধুরী বলে ওঠেন,
“কিন্তু তুমি নেহার সাথে যা করেছ সেটা ঠিক করো নি। আমার উপর যদি তোমার রাগ থেকে থাকে তাহলে আমায় এসে মেরব ফেলতে। কেন শুধু শুধু ঐ মেয়েটার জীবন নষ্ট করলে? মেয়েটার তো কোন দোষ ছিল না। বিনা দোষে ও নিজের সবটা হারালো।”

এরপরেই তিনি থেমে বলেন,
“আমরা দুজনেই নেহার কাছে দোষী। আর আমি তো তোমার মা, তুমি,নেহা সবার কাছে৷ এত পাপের বোঝা নিয়ে আমায় দুনিয়া ত্যাগ করতে হবে।”

আহির আর কিছু না বলে বেরিয়ে আসতে নেয়। পেছন থেকে আজমাইন চৌধুরী বলে ওঠেন,
“আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। নাহ, আমায় ক্ষমা করার প্রয়োজন নেই তোমার। শুধু নিজের মনের বোঝাটা হালকা করার জন্য বলছি।”

“পারলে আমার মায়ের সাথে দেখা করে ক্ষমা চেয়ে নেবেন হাশরের ময়দানে। আমার ক্ষমা পাওয়া বা পাওয়ায় কিছুই যায় আসেনা আপনার। কারণ আমি নিজেও একজন অপরাধী৷ আর একজন অপরাধীর কোন অধিকার নেই অন্যের পাপের বিচার করার।”

বলেই আহির বেরিয়ে আসে। এর কিছু সময় পরই আজমাইন চৌধুরী দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে যান। বিপাসা চৌধুরী দরজায় দাঁড়িয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিলেন। নিজের স্বামীর সব অপরাধের কথা তিনি শুনলেন আরাভের মুখে। একজন স্ত্রীর পক্ষে কি এসব মেনে নেয়া এতই সহজ? বিপাসা চৌধুরীও পারলেন না। আহির বাইরে আসতেই তিনি তার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,
“বুঝতে পারছি না কি বলবো তোমায় আমি। নিজের স্বামীর করা পাপের জন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাব নাকি নেহার মতো একটা নিরপরাধ মেয়ের জীবন তুমি যেভাবে নষ্ট করেছ তার জন্য অভিশাপ দেব!”

আহির হেসে বলে,
“আমার জীবনটা এমনি অভিশাপময়। আপনাকে আর নতুন করে আমায় অভিশাপ দিতে হবে না। আর আমার সাথে আপনি কোন অন্যায় করেন নি। যা করেছে তা আপনার স্বামী। তাই আপনার ক্ষমা চাইতেও হবে না।”

বিপাসা চৌধুরী আর কিছু বলতে যাবেন এমন সময় ডাক্তার আজমাইন চৌধুরীর কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে বললেন,
“হি ইজ নো মোর।”

বিপাসা চৌধুরী আর কিছু বলতে পারলেন না। শোকে পাথর বনে গেলেন৷ আরাভ তাকে সামলাতে লাগল। এদিকে ততক্ষণে পুলিশ অফিসারও চলে এসেছে। আহির তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“নিন, আমার হাতে হাতকড়া পড়ান।”

পুলিশ অফিসার বলেন,
“মিস নাতাশাকে খু*নের দায়ে আপনাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।”

আহির বাকা হেসে বলে,
“আরো অনেক পাপ করেছি আমি। সবকিছুর শাস্তি নাহয় একসাথে দিলেন।”

★★
আজকে আহিরকে আদালতে হাজির করা হয়েছে। নেহা, আরাভ দুজনেই কোর্টে উপস্থিত। বিপাসা চৌধুরী আজমাইন চৌধুরীর মৃত্যুতে ভেঙে পড়ায় আসতে পারেন নি। আহিরা ও নিয়া যেহেতু ছোট বাচ্চা তাই তাদেরও আনা হয়নি। বিচারক কোর্টের কার্যক্রম শুরু করেন। আজ আসামীপক্ষের কোন উকিল নেই। এটা দেখে তিনি অবাক হয়ে যান৷ আহির বলে ওঠে,
“অবাক হবার কিছু নেই স্যার। আমি এখানে নিজের সব অপরাধ অকাট্যভাবে স্বীকার কর‍তে এসেছি। আমিই খু*ন করেছি মিস নাতাশাকে। শুধু তাই নয়, নেহা চৌধুরীকে আমি রে***প করেছি। তারপর তাকে আর তার সদ্যোজাত মেয়েকে রাস্তায় ফেলে এসেছি। শুধু তাই না, তার আরেক মেয়ে আহিরাকে পাঁচ বছর তার থেকে আলাদা রেখেছি।”

বিচারক সব শুনে স্তব্ধ। এরমধ্যে নাতাশার মা নূর বেগম দাঁড়িয়ে বলেন,
“আমার মেয়ে তোকে নিঃস্বার্থ ভালোবেসেছিল..সেই ভালোবাসা তুই বুঝলি না৷ ওকে মেরে ফেললি তুই। ওকে কত বারণ করেছিলাম তোকে ভুলে যেতে কিন্তু…যার জন্য এসব করলি এখন তার জন্যই জেলে পচে মরবি, মিলিয়ে নিস।”

নেহাও কাঠগড়ায় উঠে নিজের সাথে হওয়া সব অন্যায় বলে।
বিচারক ঘোষণা করেন,
“সমস্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আহির পাটোয়ারীকে আদালত যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করছে।”
চলবে ইনশাআল্লাহ✨