ধূপছায়া পর্ব-০২

0
3

#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০২

শীত পুরোপুরি বিদায় নিয়েছে সপ্তাহ তিন এক হলো। বিদায় নিতে না নিতেই সূর্য তার রুপ দেখানো শুরু করেছে। বৈশাখ মাস ঘরে আসবে আরো মাস এক পরে। তাই মেঘ বৃষ্টি ছিটেফোঁটা আকাশের ধারের কাছেও নেই। নেই বলে তপ্ত দুপুরের রাগ যেন এখনি গায়ে ফোসকা ধরিয়ে দেয়। আর এই তেজের মধ্যে মেয়েটা এমন মোটা ভারী শাড়িতে জড়সড় হয়ে বসে আছে।

মোমেনার দেখে এতো মায়া লাগলো। না লেগে উপায় কি? মেয়েটার চোখে মুখে উপচে পড়া মায়া। সে মনে মনে বড় একটা শ্বাস ফেলে এগিয়ে এলো। গায়ে তার মলিন কাপড়। সেই কাপড়ের আঁচল টেনে চোখ মুখ মুছতে মুছতে আয়নার সামনে বসলো।

তাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ নেই। গ্রামের অনেকের বাড়িতেই নেই। কুপির তেলের জোগাড়ই দিতে পারে না, আবার বিদ্যুৎ। যাদের অবস্থা ভালো শুধু তাদের বাড়িতে’ই দেখা যায় রাতের অন্ধকারে চাঁদের আলোর মতো, আলো করা ছোট ছোট লাল লাল বাতি। আর এই ছোট ছোট লাল লাল বাতি তাদের সাধ্যের অনেক বাইরে।

মোমেনা তালের পাখা হাতে নিয়ে পা ছড়িয়ে বসলো। তার বসা স্বাভাবিক! দেখে মনে হবে কাজ টাজ করে ক্লান্ত শরীরে একটু বিশ্রামের জন্য বসেছে। আসলে ভেতরে ভেতরে সে ভয়ে কাঁপছে। গরমের চেয়ে এই কাঁপনের ঘাম’ই বেশি। কেননা তার মতো গাঁয়ের বধুর স্বামী, শাশুড়ির বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করা চাট্টিখানি কথা না।

সম্পর্কে সে আয়নার চাচি। চাচি হলেও আয়না ডাকে তাকে বড় মা বলে। তাঁর শাশুড়ি গ্রামের আর পাঁচ, দশটা শাশুড়ির মতোই। ছেলেদের জন্য মমতাময়ী মা, নাতি নাতনীদের জন্য আদরের দাদি আর পুতের বউদের জন্য আজরাইল। এগুলো গাঁও গ্রামে স্বাভাবিক ব্যাপার। মুরব্বি তারা, বাঁচবে কয়দিন। তারা একটু এমন করবেই। এগুলো যেই মেয়ে মানিয়ে সংসার করবে, সেই তো হলো আসল সংসারী।

মোমেনাও ব্যতিক্রম না। সে সব মানিয়েই সংসার করছে। তবে এই মেয়েটার জন্য খারাপ লাগছে। নাড়ি ছেঁড়া ধন না থাক, এই হাতেই তো মানুষ করলো। আর এই মেয়েটাকেই বলতে গেলে এক হিসেবে বেচে দিচ্ছে। হ্যাঁ বেচাইতো! জমির লোভে ঠেলে দেওয়া। তা না হলে, এমন ভয়ংকর দেখতে ছেলে তার মধ্যে কুফা মার্কা বাড়ির ছেলের কাছে মেয়ে দেয় কে? টাকা পয়সাই কি সব? তার তো ধারণা আয়না ছেলের মুখ দেখতেই দাঁত দুপাটি লেগে যাবে। অবশ্য ছেলেও যে রাজি তা না। এই সব কিছু করছে আলাউদ্দিন ফকির আর ঐ বুড়ি। নিজেদের যা মন চায় তাই করতে থাকে। আজরাইল এতো মানুষরে চোখে দেখে, এদের দেখেনা কেন আল্লাহ’ই জানে।

মোমেনা অবশ্য তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। আয়নার এক খালা শহরে থাকে। পাশের গ্রামে বিয়ে হয়েছিল। অভাবে পড়ে শহরে গেছে। এখন অবশ্য সেই অভাব নেই। গার্মেন্টস নাকি কিসে কাজ নিছে। আয়নাকে খুব আদর করে। করবে না কেন? বোনের শেষ স্মৃতি। যখনি গ্রামে আসে জামা কাপড় থেকে শুরু করে লাল ফিতে, কাঁচের চুরি, আলতা, কাজল সব সে’ই নিয়ে আসে।

তাই এই বিয়ের কথা শুনতেই তার মাথায় আয়নার খালার কথাই এলো। তাকে জানালে নিশ্চয়ই কিছু করবে। তবে জানাবে কি করে। সে লেখা পড়া জানে না। তবে আয়না কিছুটা জানে। জানে মানে চিঠি লিখতে পারে। কেলাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে। এর পরে পড়তে গেলে হাইস্কুলে যেতে হয়। এতো টাকা পয়সা কই। তাই সেখানেই শেষ।

তাই সে খাতা কলম নিয়ে আয়নার কাছেই গেলো। সব বুঝিয়ে বলতেই মেয়েটার মুখ ঝিলমিল করতে লাগলো। আর করতে করতেই সুন্দর করে গুছিয়ে সব লিখলো। সে বউ মানুষ! আয়নার মার গায়েব হওয়ার পর থেকে তার উঠান পেরুনো নিষেধ, তাই আয়নাকে দিয়েই পাঠালো। অবশ্য বাজারে না। আজিজ চাচার বাসায়। তিনি এই গ্রামের মহাজন। তবে অন্য গ্রামের মহাজনদের মতো না। খুবই ভালো মানুষ। যে কাউকে বিনা শর্তে সাহায্য করেন। তার ক্ষেত’ই বর্গা নিয়ে তারা চাষাবাদ করেন। এতিম মাইয়া বলে আয়নাকেও খুব স্নেহ করেন। তাই বললেই পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন । কেননা আয়না এমন অনেকবার’ই করেছে। তার শাশুড়ি আয়নার খালার সাথে যোগাযোগ পছন্দ করে না। আয়নার খালা শহরে থাকা চালু মাইয়া। এমন চালু মাইয়া গ্রামের শাশুড়ির ভালো না লাগার’ই কথা। তাই আয়না খালার যোগাযোগ বলতে গেলে এই আজিজ চাচার মাধ্যমেই করে।

তাই এবারো করলো। আর হলোও তাই। আজিজ চাচা কিছু জিজ্ঞেস না করেই চিঠি নিয়েছেন। আয়না, আয়নার চাচি দুজনেই স্বস্থির নিশ্বাস ফেলেছে। তবে তাদের স্বস্থি অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় নি । কেননা চিঠির উত্তর আসতে আসতে কমছে কম তিন দিন। সেই তিন দিন হওয়ার আগেই সারেং বাড়ি থেকে খবর এলো, কালই বিয়ে পড়াবে। যেটুকু আয়োজন করার করো। তারা যা করার তাদের বাড়িতে নিয়ে করবে।

তাদের আর কিছু করার সুযোগ’ই রইল না। আয়না মোমেনার বুকে পড়ে একচোট কাঁদলো। কেঁদে কেটে কাঠের পুতুলের মতো সব করে গেলো। না করে উপায় কি? মেয়ে হয়ে জন্মাইছে, সব ইচ্ছাকে গলা টিপে ধরতে তো হবেই। আর বিয়ে হচ্ছে সেই ধরার শুভ উদ্বোধন।

তবে মেয়েদের ইচ্ছার দাম না থাকলেও পুরুষের আছে। ঐ যে বললাম ছেলেও রাজি না। তারা হাত গুটাইয়া বসে থাকলেও সে থাকবে কেন? পুরুষ মানুষ সে। তার মাথায় না আছে সম্মান হারানোর চিন্তা, পায়ে না আছে সমাজের ধরাবাঁধা শিকল। তারা তাদের জোগাড় করেই ফেলে। এই যে যেমন তাদের মনের খোঁজ ঠিক বের করে ফেলেছে, যেমন ফেলেছে আয়নার খালাকে।

মোমেনা ঢোক গিলে আশে পাশে একবার চোখ বুলালো। তারপর কোমর থেকে একটা কাগজ বের করে আস্তে করে আয়নার হাতের মুঠোয় ঢুকিয়ে দিলো।

আয়না প্রথমে কিছুই বুঝলো না। সে তার বড় মার দিকে তাকালো। মোমেনা চোখ দিয়ে দেখার ইশারা দিলো।

আয়না শাড়ির আঁচলে হাত আড়াল করে খুলতেই দেখলো তাতে লেখা — তোমার খালা শহরের স্টেশনে থাকবে। ভালো করে ভাবো। যদি যেতে চাও। যে কোন উপায়ে নদীর পাড়ে এসো। আমার দায়িত্ব আমি শুধু স্টেশনে তুলে দেবো। ”

আয়না ঢোক গিললো! সে কখনো এই গ্রামের বাইরে পা রাখেনি। সে ঢোক গিলেই তার চাচির দিকে তাকালো।

তার চাচি আস্তে করে বললো, — যে কোন সুযোগ একবার’ই আসে মা। এখন তুমি সিন্ধান্ত নেও কি করতে চাও?

আয়না জানালার দিয়ে বাইরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে করে বললো, — আমি খালার কাছে যাব বড় মা।

মোমেনা হাসলো! হেসে বললো, — যাইবার মন চাইলে যাও। তবে ভয় নাই! তোমার চাচা বলদ কিছিমের মানুষ। জমির লোভ মাথায় বসছে তো, বাকি কিছু চোখে দেখছে না। তবে সে কিন্তু তোমারে খুবই ভালো পায়। তাই সব ঠান্ডা হোক। তারপরে না হয় আবার ফিরে আইসো।

— তারা আমাকে আসতে দিবো?

— তা তো জানি না মা। তবে সময় সব ঠিক করে দেয়। শুধু শক্ত হয়ে টিকে থাকতে হয়।

— বড় বাবা খুব কষ্ট পাইবো।

— তা তো পাইবোই। ধানের ক্ষেত হাত ছাড়া হলো।

আয়না হালকা হাসলো! মোমেনাও হাসলো। হাসতেই আয়নার দাদি দরজায় এসে দাঁড়ালো। গায়ে তার সাদা থান। সেই থানের আঁচল মাথায় টানতে টানতে বললো, — হয়েছে কি?

— কিছু না আম্মা।

— তো ভেটকাইতাছো ক্যা?

— বিয়ের কনের বাথরুম চাপছে। না ভেটকাইয়া উপায় কি?

আয়নার দাদির মনটা এখন একটু হালকা হলো। নাতি, নাতনীদের তিনি বড়ই মহব্বত করেন। আর আয়না তো তার কলজে। এতো ভালো ঘর তাও বিরাগ। এইডা কোন কথা। তাই সকাল থেকে দিছে কয়েকটা ধমক। ধমক দিয়ে নিজের মন’ই আনচান করতাছে। তবে এখন আয়নার হাসি হাসি মুখটা দেখে ভালো লাগছে। সেই লাগা থেকেই কোমল সুরে বললেন, — যাও বউ, বর যাত্রী আসার আগে বাথরুমে থেকে নিয়ে আসো। তারা আইলে তো আর বাইর হইতে পারবো না। যোহরের আযান পড়ে গেছে। তারা কিন্তু বাদ যোহর’ই আসবো।

মোমেনা আয়নাকে ধরে বাড়ির পেছনে আনলো। বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড়। সে ঝাড়ের মধ্যেই টিনের বাথরুম। সেই বাথরুমে সাইড দিয়েই জঙ্গল। সেই জঙ্গল পেরুলেই ধানের ক্ষেত। সেই ক্ষেত ধরে এগুলেই নদীর ঘাট। আয়না চিনে! এখান দিয়েই কতো চুপিচুপি নদীর ঘাটে গিয়ে সাঁতার কেটেছে। তবুও আজ তার গলা শুকিয়ে এলো।

সে শুকানোর মধ্যেই তার চাচি তাড়া দিয়ে বললো, — গেলে তাড়িতাড়ি যা আয়না। কেউ দেখলে আর রক্ষে থাকবে না।

আয়না আর ডানে বামে কিছুই চিন্তা করলো না। জঙ্গলের দিকে দৌড়ে গেলো। জঙ্গল পেরিয়ে লাল শাড়ি আঁচল উড়িয়ে ধানের ক্ষেত মাড়িয়ে সে দৌড়ে গেলো। ভর দুপুর, মানুষ জন খুব একটা নেই বললেই চলে। তাই তেমন কারো চোখেই পড়ল না। তবুও আয়না জান প্রাণ ছেড়ে দৌড়ে গেলো। তাকে যে করেই হোক নদীর ঘাটে যেতে হবে। যেতে যেতে সে বুঝলো, এক গাধামি সে করে ফেলেছে। আসলে চিঠিটা লিখেছে কে? বড় মাকে জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছে।

সেই ভুলের মধ্যেই দৌড়াতে দৌড়াতে আয়না খেয়াল করলো, নদীর ঘাটে আজিজ চাচার ছোট ছেলে দাঁড়ানো। এতো দূর থেকেও চিনলো। চেনার অবশ্য উপায় আছে। গায়ে সাদা শার্ট, প্যান্ট। এই গ্রামের হাতে গোনা কয়েকটা বাড়ির পোলারাই প্যান্ট পরে। তার মধ্যে সারেং বাড়ি, আজিজ চাচাদের বাড়ি, আর চেয়ারম্যান বাড়ি আছে সবার আগে। আর তা না হলে সবাই লুঙ্গি।

লুঙ্গি তো যেমন তেমন। আজিজ চাচার ছেলে এখানে কেন? চাচা কি চিঠি পড়ে ফেলেছে। পড়ে সেই তাকে বাঁচাতে চিঠি লিখেছে। তখনি তার ঝট করে মনে পড়লো। আজিজ চাচার ছেলে আজিজ চাচার ধারের কাছেও নেই। আজিজ চাচা পূর্ব হলে তার ছেলে পশ্চিম। আর সবচেয়ে বড় কথা সারেং বাড়ির বড় নাতির জানের জিগার সে। এতোটাই জিগার একবার এক বিবাদে সারেং বাড়ির বড় নাতির মাথার লাঠির বাড়ি নিজের মাথায় নিয়েছিল সে।

এতো এতো চিন্তা ভাবনায় আয়না দৌড়ের মধ্যে নিজের টাল সামলাতে পারলো না। পায়ে শাড়ি পেঁচিয়ে উল্টে পড়লো। পড়তেই শাড়ি দুমড়ে মুচড়ে গেলো। হাতের কয়েকটা চুড়ি ভাঙলো। সিঁথির টিকলি, টায়রা উলটে পেছনে গেলো। নাকের নথ কানে গিয়ে ঝুললো।

ফরহাদ তাকিয়ে তাকিয়ে এই কাপড়ের পুটলির ডিগবাজি দেখলো। তার অবশ্য তেমন ভাবান্তর হলো না। মেয়ে জাতের কোন কিছু নিয়েই তার ভাবান্তর নেই। এরা যেখানে আপদ সেখানে। আর এই আপদের দায়িত্ব’ই তার ঘাড়ে পড়েছে।

সে বিরক্ত মুখে চোখ ফিরিয়ে নিলো। নিয়ে নির্বিকার চিত্তেই দাঁড়িয়ে রইলো। ডিগবাজি শেষ হোক, নিজেই এগিয়ে আসবে।

আয়না দু’হাতে কাপড় আগলে কুঁকাতে কুঁকাতে উঠলো। ব্যথা পেয়েছে সে। ব্যথা তো যেমন তেমন নাকে মুখে বালি ঢুকে একাকার। সে খকখক করে কয়েকবার কাঁশলো। কাঁশতে কাঁশতে এগিয়ে এলো।

আসতেই ফরহাদ বললো, — সোজা গিয়ে নৌকার পাটাতনের ভেতরে বসে থাকবি। সব ঠান্ডা হলে আমি নিজে গিয়ে রেলে তুলে দিয়ে আসবো। আমার দায়িত্ব এইটুকুই। তোর খালা স্টেশনে থাকবে। এর পরে তোর সাথে যাই হোক এর কোন দায়ভার আমার না। ঠিক আছে?

আয়না মাথা নাড়লো। নেড়ে বললো, — আপনি জানলেন কিভাবে?

— সেটা জেনে তোর কাজ কি? তোর যেটা কাজ সেটা কর। তাড়াতাড়ি কর। সোজা ধানের ক্ষেত। এই লাল নিশানা অনেক দূর থেকেও দেখা যাবে। তাই যা, তাড়াতাড়ি ভাগ।

আয়না মুখ গোঁজ করেই কাপড় দু- হাতে মুঠো করে ধরলো। অবশ্য ফরহাদ ভাই সব সময়’ই এমন। আজিজ চাচার বাড়িতে যাওয়ার সুবাধে তার এই ধাচের ব্যবহার তার পরিচিত। তাই তেমন ভাবান্তর হলো না।

সে শাড়ি আগলে ধীরে ধীরে নৌকার দিকে এগিয়ে গেলো। তার বুক টিপটিপ করছে। করলেও মাথায় অবশ্য কিছুই আসছে না। ফরহাদ ভাই কোন সাইড হয়ে তাকে সাহায্য করছে বাপের না বন্ধুর। তবে যাই হোক আপতত এই যমের বাড়িতে বিয়ে করতে হচ্ছে না। তার জন্য এইটুকুই অনেক।

_______

বুনকা বুনকা ধোঁয়া উড়িয়ে কয়লার ইঞ্জিনটা ধীরে ধীরে থামলো। থামতেই নিস্তব্ধ এই স্টেশন টা যেন আধো আধো ঘুমের মতো হালকা একটু জেগে চোখ মেলে চাইলো। অবশ্য মানুষের শোরগোলে না। এই যে কয়লার ইঞ্জিনটা তার অবদানে।

পৃথিলা তার হাতের চিকল কালো বেল্টের ঘড়িটার দিকে তাকালো। প্রায় রাত নয়টার কাছাকাছি। ঘড়ি থেকে চোখ ফিরিয়ে জানালা দিয়েই আশ- পাশটা দেখার চেষ্টা করলো। এখানে ট্রেন খুব বেশি সময় থামবে না। এই বড়জোর দশ মিনিট।

পৃথিলার সাথে তেমন জিনিস পত্র নেই। একটা সুটকেস আর একটা হ্যান্ডব্যাগ। হ্যান্ডব্যাগটা হাতে নিয়ে সে এগিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। একটা কুলি পেলে ভালো হতো। সুটকেস তেমন ভারী না হলেও, তার অভুক্ত শরীরে টানা সম্ভব না।

স্টেশনের নাম মিঠাপুকুর। গ্রামের ছোট্ট স্টেশন। সে ছাড়া নামলো মাত্র দু’ জন। গ্রাম গঞ্জের নামগুলো সব সময় এমন মিষ্টি হয় কেন তার মাথায় আসে না। মানুষগুলো মিষ্টি, সরল এই কারণেই নাকি?

সে দাঁড়িয়েই আবার আশ পাশে নজর বুলালো। গ্রামের স্টেশন যেমন থাকে তেমনি। গ্রাম গঞ্জে রাত নয়টা মানে নিশুতি রাত। আর এই রাতে একা একটা মেয়ের জন্য খুবই ভয়ংকর। বিশেষ করে এই স্টেশন গুলো। দিনের বেলা মানুষের আনাগোনা থাকলেও, রাতে হয় বেশিভাগই দুষ্টু প্রকৃতির লোকের। দাদুর কাছে কত গল্প শুনতেন। প্রায়ই নাকি রেল লাইনে ছিন্ন ভিন্ন নারীদের দেহ পাওয়া যায়। না এরা সব আত্মহত্যা করে না। অনেকে নিখোঁজ হয়। দুষ্ট লোকেরা এদের মেরে রেল লাইনে ফেলে চলে যায়। রেল লাইনে ছিন্ন ভিন্ন হওয়ার পরেতো আর কেউ দেখতে আসে না। তার মৃত্যু আগে হয়েছে না পরে।

তার অর্ধেক জীবন গেছে এই আতঙ্ক নিয়ে। স্কুলে যেতো ভয়ে ভয়ে। কখন না জানি কেউ রুমাল শুকিয়ে তুলে নিয়ে যায়। সে অতঙ্ক বলতে গেলে এখনো কিছুটা আছে। তাবুও কিভাবে কিভাবে একা চলে এলো, এটা আশ্চর্যের’ই বিষয়। সময় মানুষকে কত বদলে দেয়। তা না হলে যেই মেয়েটা দুনিয়ার কিছুই চিনে না। সেই মেয়েটা হুট করে এমন সিন্ধান্ত নেয় কি করে।

পৃথিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলেই আবার ভেতরে এলো। তার গায়ে খয়েরি তাঁতের শাড়ি। কালো পাড়! সেই কালো পাড়ের শাড়ি সে গায়ে ভালো ভাবে জড়িয়ে সুটকেস টা হাতে তুলে নিলো। কুলি খুঁজতে হলে ট্রেন থেকে নামতে হবে। সুটকেস রেখে নামবে। ট্রেন চলে গেলে আরেক সমস্যা। শহরের স্টেশন গুলোতে কুলিদের হিড়িক থাকে। ট্রেন থামার সাথে সাথেই তাদের প্রতিযোগীতা শুরু হয়। কে আগে মাল নেবে। হয়তো এখানেও কিছুটা এমন। তবে রাতের জন্য সেই রকম সরগরম নেই।

পৃথিলা সুটকেসটা টেনে ট্রেন থেকে নামলো। তার ভাগ্য ভালো। নামতেই এক লোক দৌড়ে এলো। গায়ে ছেঁড়া গেঞ্জি, মলিন লুঙ্গি। এসেই সুটকেস টেনে মাথায় নিতে নিতে বললো, — কোন দিকে যাইবেন। ঘাটে নাকি রাস্তায়?

পৃথিলা বুঝতে পারল না। বোঝার কথাও না। এমন গ্রামে তার প্রথম আসা। তবে তার পানি খাওয়া দরকার। সারা আট নয় ঘন্টার জার্নিতে সে ছিলো বলতে গেলে ঘোরের মধ্যে। সে আশে পাশে তাকিয়ে দোকান খুঁজলো। লাল টিমটিমে আলো জ্বালিয়ে চায়ের দোকান ছাড়া কিছুই চোখে পড়লো না। সে চোখ বুলিয়ে বললো, — পানি কোথায় পাওয়া যাবে চাচা?

— একটু সামনেই মা জননী।

পৃথিলা ফিরে তাকালো। মা জননী! কি সুন্দর একটা ডাক। এই এক ডাকেই মেয়েরা সামনে দাঁড়ানো পুরুষের মনোভাব আঁচ করতে পারে। তার দাদি বলতো, — খারাপ লোকেরা কখনো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবে না। নয় অতি গলে চোখ মাটির দিকে রাখবে, নয় চোখ লাটিমের মতো পুরো শরীরে ঘুরাবে। আর যারা কথা বলবে চোখের দিকে তাকিয়ে তারা হয় স্বচ্ছ। তাদের মনে পাপ থাকে না। তারা অতি সহজেই একটা মেয়েকে মা ডেকে ফেলতে পারে, বোন বলতে পারে। কেননা একটা মেয়ে যত সহজে যে কোন অচেনা ছেলেকে চাচা ভাই বলে ডাকতে পারে। ছেলেরা তা পারে না। তারা অচেনা মেয়েদের সাথে সব সময় কথা বলবে সম্মোধন এড়িয়ে।

লোকটা এগুলো। পৃথিলাও তার সাথে এগুলো। লোকটা এগুতে এগুতে বললো, – এখানেও পাওয়া যেত। ঐ যে দেখেন। বড় দোকান। সারেং বাড়ির দোকান। এই তিন চার গ্রামে যা যা বড়। সবই সারেং বাড়ির। বাপ, দাদারা ছিল ঐ আমলের জাহাজের সারেং। কাচা টাকা কামাইছে। দুনিয়ার কিছু করছে বুঝচ্ছেন। তয় আজকে তাগো বাড়ির ঘটনা ঘইটা গেছে। তাই সব দোকান বন্ধ।

পৃথিলা কিছুটা চমকে উঠল। কেননা এখানে এসেছে সে হুট করে। কোন খবরা খবর দেওয়ার সুযোগ হয়নি। যে চাকরিটার ভরসায় এসেছে সেটা একটা হাই স্কুলের। তার এক বান্ধবীর বিয়ে হয়েছে এখানে। প্রায় মাস খানেক আগে গিয়েছিল ঢাকায়। দেখা হতেই বলেছিলো। অজোপাড়া গাঁ, ভালো শিক্ষক নাকি পাওয়া যায় না। বেতন দেবে ভালোই। তাই যদি আগ্রহ থাকে জানাতে।

সে চমকেই বললো, — কি ঘটনা ঘটেছে?

— আর বইলেন না মা। কুফা বাড়ি। আল্লাহ তো সব দিছে তবে রহমত দেয় নাই। একটার পর একটা লাইগাই থাকে। তাছাড়া রক্তের কোন বংশের বাতিও নাই। তাই কনে ভাগছে। ভাগবো না কেন? কুফা বাড়ি।

পৃথিলা আবারো বুঝতে পারলো না। রক্তের বংশের বাতি কি? বাড়িতে সমস্যা’ই বা কি? তবে তারা একটা দোকানের সামনে এসেছে। টিনের ছোট্ট দোকান। টিমটিম করে লাল বাতি জ্বলছে। এক লোক বসে বসে ঝিমুচ্ছে। পানির কথা বলতেই অতি অনাগ্রহ নিয়ে হাফ লিটারের এক বোতল এগিয়ে দিলো।

পৃথিলা বোতল নিয়ে পাশের কাঠের চিকন বেঞ্চিতে বসলো। আসলে তার শরীর কাঁপছে। খিদে না অনিশ্চিয়তার ভয়ে সে বুঝতে পারলো না। সে পানির বোতল খুলে গলা ভেজালো। ট্রেন চলে গেছে। পুরো স্টেশন কেমন নিস্তব্ধ।

সে গলা ভিজিয়েই বললো, — আমিও সারেং বাড়িতেই যাব চাচা। এখান থেকে কত দূর?

— ওমা তাই নাকি? দেখতো কান্ড! একটু আগে আসলেই তো শাহবাজ বাবার সাথে যাইতে পারতা।

— শাহবাজ?

— আরে সারেং বাড়ির ছোট নাতি। খুবই রগচটা বদমাইশ। মুখ দিয়া একবার যা বের করে তাই করবে। গ্রামের মানুষের হাড় হাড্ডি সব জ্বালায় খাইলো। বড়দের লেহাজ নাই, ছোটদের স্নেহ নাই। তার এক লাঠি। সেটা তার দাদি। ডানে, বামে, পূর্ব, পশ্চিমে সে আর কাউরে চেনে না।

পৃথিলা নিশ্চুপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। আসলে সে আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছে না। তার তাকানোর মাঝেই লোকটা আবার বললো, — কনে ভাগছে পর থেকে সব জায়গায় তারা পাহারা বসাইছে। মেয়ে যেন গ্রাম থেকে বের হতে না পারে। এই স্টেশনেই তো এতোক্ষণ ছিল। এই কিছুক্ষণ আগে গেলো।

— পাহারা?
— হুম।
— কেন?
— আরে বহাইবো না। বিয়া করবার মন চাইনা আগে কইতো। মান সম্মান নিয়া টান দিলো ক্যা। তারা তো আর জোর করে নাই। এখন পাইলে চুল কাইট্টা, কালি মাইখা, পুরো গ্রাম ঘুরাইবো। নাও সারা জীবনের বিয়ের সাধ ঘুরে যাইবো।

পৃথিলা অবাক চোখে তাকালো। তাকিয়ে বললো — এটা কেমন কথা? হয়তো মেয়েটার ইচ্ছে ছিলো না।

— মেয়েদের আবার ইচ্ছে কি? বাবা মা কি খারাপ চাইবো?

পৃথিলা মনে মনে বড় একটা শ্বাস ফেললো! আসলেই বাবা, মা কি সত্যিই খারাপ চায়? তাদের দীর্ঘ জীবনে যে ভুল গুলো তারা করে থাকে, তারা অপ্রাণ চেষ্টা করে, সন্তানেরা যেন সেই ভুলগুলোর ধারের কাছেও না যায়। তবে সন্তানেরা বুঝলে তো। সেও নিজেও তো বুঝেনি। তার মা যে ভুল পথে হেঁটেছে, সেও সেই একই পথে হেঁটেছে। তাইতো আজ এখানে। আর এখান থেকে জীবনের মোড় কোথায় থেকে কোথায় নেবে কে জানে। সে এখন নদীর ঐ কচুরিপানার মতো, ঢেউ যেদিকে সেও সেই দিকে।

চলবে….