ধূপছায়া পর্ব-০৪

0
3

#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৪

পৃথিলা হ্যান্ডব্যাগ থেকে তার আধখাওয়া পানির বোতলটা বের করলো। করে গলা ভেজালো। ভেজানো মানে এই এক ঢোক। গলা শুকিয়ে আসছে আবার পানি গলা দিয়ে নামাতেও পারছে না। কি যন্ত্রনা! সে পানির বোতলটা আবারো হ্যান্ডবাগে রাখলো! হাফ লিটার বোতল অথচ শেষ করে উঠতে পারছে না।

সে বোতল রেখেই স্বাভাবিক ভাবে বসার চেষ্টা করলো। আধো আলো, আধো অন্ধকার। খেয়াল না করলে অবশ্য বোঝা যায় না। তার হাত হালকা হালকা কাঁপছে। অবশ্য সারা দিন অভুক্ত না অন্য কোন কারণে পৃথিলা বুঝতে পারছে না।

সে কোন সাহসী মেয়ে না। আবার একেবারে ভীতু ও না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার বাস্তবিক জ্ঞান ভালো। ভালো বলেই অনেক কিছু ঝট করেই ধরে ফেলতে পারে। এই যে যেমন ধরে ফেলেছে সে ছাড়াও এই নৌকায় আরেকটা মেয়ে আছে। নিস্তব্ধ রাত ! একটা মানুষের অস্তিত্ব পুরো গায়েব করা সম্ভব না। চুড়ির টুংটাং শব্দ, কাপড়ের খচখচ আর নিশ্বাস। সারা দুনিয়ার শব্দ যেখানে শেষ হয়, সেখান থেকে নিশ্বাসের গান শুরু হয়। সেটা যতোই চেষ্টা করা হোক, আড়াল করা সম্ভব হয় না।

তার ধারণা যেই মেয়েটা বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছে সে এই নৌকার আছে। আইডিয়া অবশ্য খারাপ না। কেউ হারালে সবাই পুরো দুনিয়া চষে বেড়ায়, নিজের ঘরে তল্লাশি চালায় কে? আর ছেদ যদি আপন মানুষেরা করে সেটার ধারণা কার’ই বা থাকে।

পৃথিলা বসে আছে নৌকার ছাউনির ভেতরে। পাশেই তার সুটকেস। এক মাথায় মাঝি আরেক মাথায় ঐ ফরহাদ লোকটা সটাং দাঁড়িয়ে আছে। মুখ দেখা না গেলেও লোকটা যে মহাবিরক্ত হাব ভাবেই বোঝা যাচ্ছে। তার পাশেই ঐ এরশাদ লোকটা বসে। দৃষ্টি পানির দিকে। নিস্তব্ধ রাত, বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ গান। কেমন যেন একটা বিষন্ন সুর তুলছে।

সে অবশ্য এখনো স্পষ্ট ভাবে এই মানুষটার মুখ দেখেনি। নৌকায় বসতেই মাঝি বিনা বাক্যে হারিকেনের আলো মৃদু করে ফেলেছে। সেই মৃদু আলোয় শুধু কোন রকম মানুষের অবয়য় বোঝা যায় তবে চেহেরা না।

পৃথিলা চোখ ফিরিয়ে নৌকার পাটাতনের দিকে তাকালো। নৌকা সম্পর্কে তার কোন ধারণা নেই। তাই ধারণা নেই একটা মানুষ এর ভেতরে কিভাবে থাকতে পারে। তার মনে মনে একটু সন্দেহও হলো, আচ্ছা মেয়েটা ঠিক আছে তো ?

সে ঢোক গিললো! আবারো গলা শুকিয়ে আসছে। কি যন্ত্রনা দেখ তো! পৃথিলা আবার পানির বোতলটা বের করলো। অবশিষ্ট পানিটুকু মনের বিরুদ্ধে গিয়ে গলায় ঢাললো। ঢালতেই পেট মুড়িয়ে উঠলো। সে চোখ বন্ধ করে কয়েকটা বড় বড় শ্বাস ফেললো। ফেলে আবার স্বাভাবিক ভাবে বসার চেষ্টা করলো।

চেষ্টা করলেই কি হওয়া যায়? হয়তো, এইযে অচেনা দু’টো পুরুষ! চেনা নেই, জানা নেই। কি সুন্দর নির্ভয়ে নৌকায় উঠে বসলো। আজকাল কেন জানি কোন কিছুতে তার কিছু আসে যায় না। মনে হয় যা হবার হোক, কি আসে যায়।

তার দাদি বলতো ” এই দুনিয়ায় সব কিছু হয় মৃত্যুকে ঘিরে। একবার যদি মৃত্যুর ভয় কেটে যায়। তাহলেই জীবনের সব কিছু শেষ। কোন কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। সেটা ভয় হোক, ক্ষমতা হোক, বিস্ময় হোক, হোক বা ভালোবাসা। তখন সব কিছুকেই মনে হয় তুচ্ছ।

তার কাছে কি এখন সব কিছুই তুচ্ছ। কি জানি? সাবিহাদের বাসা থেকে বের হয়ে সে সারা দিন একা একা ঢাকার রাস্তায় হাঁটলো। হাতে একটা হ্যান্ড ব্যাগ আর সুটকেস। অনেকেই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো। বিকেলের দিকে এক রেল লাইনে গিয়ে দাঁড়ালো। দূর থেকে ট্রেনকে আসতে দেখলো। তার কোন ভয় করেনি, বরং কেন জানি ভালো লাগলো।

সেই ভালো লাগার মাঝেই ট্রেন তার নিজ গতিতে তার আঁচল উড়িয়ে পাশ দিয়ে চলে গেলো। পৃথিলার এতো হাসি পেলো। সে ভুল লাইনে দাঁড়িয়েছিল। যেমন ভুল মানুষকে বিশ্বাস করে সব ছেড়ে তার হাতটা আঁকড়ে ধরেছিল, ঠিক তেমনি।

পৃথিলা সেই লাইনেই অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কেউ জানলো না, কেউ বুঝলো না। তখন পৃথিলা দাঁড়িয়ে ছিল না। দাঁড়িয়েছিল এই যে রক্ত মাংসের মাটির দেহ, শুধু এটা। কেননা সব সময় দেহের মৃত্যু হয় না, মাঝে মাঝে আত্মারও হয়। তাই ট্রেন তাকে স্পর্শ না করলেও, মৃত্যু হয়তো তাকে ঠিক ছুঁয়ে গিয়েছিল।

পৃথিলা বড় একটা শ্বাস ফেলেই ছাউনির ভেতর থেকে বাইরে উঠে দাঁড়ালো। একটা মানুষের উপরে এভাবে বসে থাকা যায় না। অন্তত সে পারবে না। সে ছাউনি ধরেই দাঁড়িয়ে রইল। তার দৃষ্টি পানিতে। কুচকুচে কালো পানি। অবশ্য হয়ত রাতের জন্য। তবে এই কুচকুচে কালো পানির বুকে চাঁদটা ঝিলমিল করছে। এই ঝিলমিল করা চাঁদ তাকে বিমোহিত করতে পারলো না। না পারলেও তার দৃষ্টি চাঁদের উপরেই রইলো। কেননা সে বুঝতে পারছে না তার কি করা উচিত। তখনি সেই শান্ত কণ্ঠ আবার ভেসে তার কানে এলো, — আপনার এভাবে একা আসা ঠিক হয়নি।

পৃথিলা পানি থেকে চোখ ফিরিয়ে সামনে তাকালো। তাকাতেই এরশাদ লোকটার সাথে চোখাচোখি হলো। লোকটা হয়ত তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। থাকতেই পারে, কথা বলার সময়তো আর অন্য দিকে তাকিয়ে থাকবে না। তবে চোখে চোখ পড়তেই সরিয়ে নেওয়া কথা। সেই রকম কোন হাবভাব বা জড়তা এই লোকের মধ্যে দেখা গেলো না।

পৃথিলা নিজেও সরালো না। সে শান্ত, নিশ্চুপ, তবে তার মধ্যেও জড়তা, সংকোচ কম। তবে কথা ঘোরালো। ঠিক বেঠিকের হিসাব কোন অচেনা লোকের সাথে করা কারোই ভালো লাগার কথা না, আর তার তো আরো না।

সে ঘুরিয়ে’ই বললো — চিঠিতে কি লেখা ছিল?

— আপনি জানেন না?

— না।

— কেন? আপনার কাছেই তো ছিল। খুলে দেখেন নি?

পৃথিলা দেখেনি! দেখার মতো অবস্থা তার ছিল না। সাবিহাদের বাসায় গিয়েছিল ঘোরের মধ্যে। ঘোরের মধ্যেই ঠিকানা নিয়ে বেরিয়েছে। চিঠি দেখার কথা মাথায় আসেনি।

সে আগের মতোই বললো, — আমি দেখি নি।

— যেটা দেখেন নি, সেটা না হয় না দেখাই থাক।

— সাবিহার বাবা মানে ইমদাদুল চাচা কি আপনাদের পরিচিত?

— আমার ছোট চাচার বন্ধু।

— ওহ।

— আপনি সম্ভবতো ইমদাদুল চাচা মেয়ের বন্ধু।

— হ্যাঁ।

— হঠাৎ এখানে, জানতে পারি কেন?

— আমার একটা চাকরির প্রয়োজন।

এরশাদ কিছু বললো না। তবে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলো। পৃথিলা আগের মতোই বললো,

— ইনি কি হন আপনার?

এরশাদ ফরহাদের দিকে তাকালো। তাকিয়ে হালকা হাসলো! হেসে বললো, — বন্ধু।

— এভাবে রেগে আছেন কেন?

— তার সব কিছুতেই রাগ।

তার বলতে দেরি ফরহাদ লোকটার কটমটিয়ে তাকাতে দেরি হলো না। এরশাদ সেই তাকানোর বিপরীতে আগের মতোই হাসলো।

পৃথিলা আবছায়া আলোয় সেই হাসির দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মেয়েটার কথা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে হলো। কেন নিজের বিয়ে ভেঙে, নিজেই মেয়েকে চুপিচুপি এভাবে সরিয়ে ফেলতে চাইছে। মেয়েটার বাধ্যতা থাকতে পারে। তবে সে তো পুরুষ, তার কিসের বাধ্যতা? তবে কিছুই জিজ্ঞেস করলো না। এক মন চাইলেও, আরেক মন বলছে ব্যক্তিগত ব্যাপার তাদের। তার নাক না গলানোই উচিত।

তাই সে চোখ ফিরিয়ে আবার পানির দিকে নিলো। তার নিজের জীবন’ই এলোমেলো। অন্যেকে নিয়ে ভাববে কি? কেননা জীবন তাকে কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে বুঝতে’ই পারছে না। তার সেই বিয়ের আয়োজন শুরু হলো ভালো ভাবেই। জানা কথা, মা কোনদিনও তার ভালোবাসা মেনে নেবে না। তাই পৃথিলা পালিয়ে যাওয়ার সিন্ধান্ত নিলো। সে তার মনের কথা স্পষ্ট জানিয়েছে। তবুও যদি জোর করে তাহলে আর কি করার। তাই এক ভোরে বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্য রুম থেকে বেরোলো। তবে পড়ল ঠিক মায়ের সামনে।

তার মা শায়লা! শায়লা আফরোজ। যার কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। শান্ত ভাবে সোফায় বসলো। দৃষ্টি ঐ যে জানালা গলিয়ে ভোরের কোমল রোদ, পর্দার আড়াল থেকে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছি সেখানে। সেই দিকে তাকিয়ে বললো, — তোমার মতোই আমি ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে একজনের হাত ধরেছিলাম। ভুল মানুষের হাত! বুঝতে বুঝতে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। সেই দেরির মাসুল কি জানো? বলেই তার মা এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো।

পৃথিলার মনে হলো তার গলাটা তখন কেউ শক্ত করে চেপে ধরলো। সেই ধরায়, হাতে ব্যাগ ছিল কখন হাত থেকে ছুটেছে বুঝতেই পারেনি।

তার মায়ের চোখ থেকে মুক্ত দানার মতো কয়েক ফোঁটা পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। তার মা সেই মুক্ত দানা ছুঁয়েও দেখলো না। যেন কারো বিরহের নামে এই চোখের পানির প্রতিও তার অসীম ঘৃণা। সেই ঘৃণা নিয়েই দৃঢ় কণ্ঠে বললো, — তুমি বুদ্ধিমতি মেয়ে। আশা করি আমার কথা বুঝতে পেরেছো। আমি আমার সবটুকু দিয়ে সব সময় তোমায় আগলে রাখার চেষ্টা করেছি। তাই আজ যদি এই দরজা পেরিয়ে তুমি একবার যাও। আমাদের সম্পর্ক এখানেই শেষ। আমি কখনো আর তোমার দিকে ফিরে তাকাবো না। এই দরজার এক সাইডে তোমার মা, আরেক সাইড তোমার ভালোবাসা। নিতে হলে যে কোন একটা নিতে হবে। বাকি তোমার ইচ্ছে।

পৃথিলার তখন পুরো দুনিয়া এলোমেলো। যেই দুনিয়ার যাকে বাবা ভেবেছে, যার মায়ের গন্ধে শৈশব থেকে কৈশোরে পা দিয়েছে। যেই ঘর বাড়িকে আপন ভেবেছে। আসলে এসব তার কিছুই না। অথচ এই বাবা নামক মানুষটা কখনো বুঝতে দেয়নি। দাদি নামক মানুষটা! যাকে নিজের মায়ের চেয়েও আপন ভেবেছে। যাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার গলা জড়িয়ে না ধরলে চোখের পাতায় ঘুম আসে নি। তারা তার কেউ না। কখনো ছিলোও না। অথচ তারা একটি বারের জন্যও বুঝতে দেয়নি। ভালোবাসা সত্যিই অন্ধ। সেটা প্রেমিক প্রেমিকার হোক, বাবা, মা, ভাই, বোন সম্পর্কের নাম যাই হোক। যেখানে ভালোবাসা সেখানে কালো কাপড়ের মোটা একটা আস্তর। সেই আস্তর কেউ নিজ হাতে বাঁধে, কেউ না জেনে বাঁধে।

তখনি নৌকায় এক ধাক্কা লাগলো। কিসের পৃথিলা বোঝার আগেই এক ঝটকায় পানিতে পড়ে গেলো। সে দাঁড়িয়ে ছিলো হালকা ভাবে, তার মধ্যে স্মৃতির গভীরে ডুবে। তাই ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারেনি।

পৃথিলার পড়তে দেরি এরশাদের দৌড়ে লাফিয়ে পড়তে দেরি হয়নি। পৃথিলা সাঁতার জানে না। তার মধ্যে গায়ে শাড়ি। পুরো পেঁচিয়ে কয়েক সেকেন্ডেই পানি টানি খেয়ে দম আটকে যাওয়ার জোগাড়।

নৌকায় ধাক্কা মেরেছে তাদের সাইজেরই আরেকটা নৌকা। সেই নৌকায় দাঁড়ানো শাহবাজ। ফরহাদের মেজাজ আগে থেকেই তুঙ্গে। এই ধাক্কায় সব তার চান্দির উপরে চলে গেলো। কেননা সে ছিল একেবারে নৌকার মাথায়। আরেকটু হলে সে নিজেও নদীতে। সে হনহনিয়ে এগিয়ে গেলো।

ফরহাদকে আসতে দেখে শাহবাজ হাসলো! তার আর ফরহাদের মাঝে নানার বেগড়া আছে। ছোট বেলা কোন কিছুতেই তাদের বনিবনা নেই। ভাইয়ের বন্ধু হলেও তার শত্রু বলা যেতে পারে। একবার তো ইট মেরে মাথা ফাটিয়ে পর্যন্ত ফেলেছিল। মরতে মরতে বেঁচেছে বেচারা। আর আজ তাদের সম্মানে হাত দিয়েছে। তুই তো এবার শেষ। সে হেসেই ঘাড় এই কাত থেকে ঐ কাত করলো। সারা দিনে দৌড় ঝাপে শরীর অবস্থা তেনাতেনা।

সেই তেনাতেনার মাঝেই তার নাক বরাবর পড়লো ফরহাদের এক ঘুসি। শাহবাজ কাত হয়ে নাক চেপে ধরলো। রক্ত বের হচ্ছে। সেই রক্ত দিকে তাকিয়ে হাসলো! হেসে সোজা দাঁড়িয়ে বললো, — বয়সের ধার আমি কখনো ধরি না। তবে আমার ভাইকে ধরি। তাই ভালো ভাবে জিজ্ঞেস করছি, — আয়নামতি কোথায়?

ফরহাদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো — এতো না মুরোদওয়ালা। যা নিজে খুঁজে বের কর। নাকি মুরোদ এই নৌকায় ঠোকাঠুকি পর্যন্ত’ই।

শাহবাজ আবারো হাসলো! হাসতে হাসতে হাত মুঠো করে এগুতে এগুতে বললো, — এজন্য’ই বলে ভালোর ভাত নেই রে।

পৃথিলাকে নিয়ে এরশাদ ততক্ষণে নদীর কিনারে এসে পড়েছে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে মাঝ নদীতে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা লন্ঠনের নাচানাচিতে তাদের হাতাপাই এরশাদ অনুমান করতে পারছে।

পৃথিলা কাশতে কাশতে চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে। তার সাথে জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। এরশাদ অন্ধকারে মুখ না দেখলেও কোমল সুরে বললো, — আপনি ঠিক আছেন?

পৃথিলার অবস্থা খারাপ। এমন পরিস্থিতে তো কখনোও পড়ে নি। তবুও কাশতে কাশতেই কোন রকম শুধু শব্দ করলো, — হুম।

— আপনি দু’ মিনিট একা থাকতে পারবেন?

পৃথিলার বলতে ইচ্ছে করলো, না। নদীর পাড় জঙ্গলের মধ্যে শুয়ে আছে। ভয়ে শরীর কাটা দিচ্ছে। তবে কাপড়ের অবস্থা বেহাল। বেহাল মানে পুরো বেহাল। কাঁধে পিন মেরেছিল। সেটা কারণে বুকের উপরে ছাড়া সবই খুলে গেছে। অন্ধকার থাক তবুও এই লোকের সামনে নিশ্চয়ই ঠিক করতে পারবে না।

— তাই সে মাথা নাড়ালো। মানে পারবে! তার এই মাথা নাড়ানো অন্ধকারে কিভাবে বুঝবে পৃথিলার মাথায় এলো না। তবে এরশাদ বুঝলো। না বোঝার কারণ নেই। পৃথিলা শুধু যে জঙ্গলের উপরে শুয়ে আছে তা না। শুয়ে আছে এরশাদের হাতে উপরে। জড়িয়ে ধরে এনে নদীর পাড়ে তুলেছে। এরশাদ সরে যাওয়ার সুযোগ পায়নি। তাই এরশাদ যে তার খুব কাছে পৃথিলা ভয়ে খেয়ালই করেনি।

এরশাদ আস্তে করে হাত সরিয়ে নিলো। সে ভেবেছিল, তার হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে দূর অজানায় সে অনেক আগেই ছুড়ে ফেলেছে। আসলে তা না। এই যে ধকধক করে আজ ঠিক জানান দিলো। এখনো সে আছে, বেশ ভালো ভাবেই আছে। তা না হলে এতো জোরে ধকধক করে কি করে।

সে হাত সরিয়ে এক সেকেন্ডও ব্যয় করলো না। আবার নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। এরশাদ যেতেই পৃথিলার চোখ বন্ধ করলো। তার শরীর থরথরিয়ে কাঁপছে। তার কিছুক্ষণ পরেই সব আবার পুরো নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। হতেই পৃথিলা উঠলো। পুরো গায়ে কাদা, বালু। সেই কাদা বালু নিয়েই হাতড়ে গায়ের কাপড় ঠিক করতে লাগলো।

এরশাদ নৌকায় এসে দু- জনকেই থামালো। দুটোই তারছেঁড়া। এই অল্প সময়ের মাঝেই নাক, মুখ ফাটিয়ে ফেলেছে। নৌকার মাথায় কালাম বৈঠা জড়িয়ে আরামছে বসে দাঁত খোঁচাচ্ছে।

কালাম জয়তুন আরা বেগমের একদল লোকদের মধ্যে একজন। হাট্টা কাট্টা’ই একজন। আর এই হাট্টা কাট্টা লোক রাখার একটাই কারণ। সারেং বাড়িকে দেখে রাখা। কেননা অনেক দিন আগে ভয়াবহ এক রাত নেমে এসেছিল সারেং বাড়িতে। সেই রাতেই সারেং বাড়ির বড় ছেলে আর জয়তুনের প্রিয় পুত্র জসিম মারা গিয়েছিল। তার সাথে মারা গিয়েছিল সারেং বাড়ির দুই পুত্র বধু। আর এরশাদ হারিয়েছিল তার মুখের সৌন্দর্য।

সেই থেকে জয়তুন আরা সব সময় সর্তক। এবার সারেং বাড়ির দিকে কেউ চোখ তুলে তাকাক। ছিঁড়ে ফালা ফালা করে ফেলবে এরা। সেই এরাদের একজনের দিকে তাকিয়ে এরশাদ বললো, — থামাসনি কেন?

কালামও নির্বিকার চিত্তে বললো, — কোন দরকার ভাই। তাছাড়া দেখতে ভালোই লাগছিল। তবে নৌকায় বলে তেমন জুইত পাই নাই। হেইলা ঢুইলা শেষ।

নৌকা কথা মাথায় আসতেই এরশাদ তাদের নৌকার দিকে তাকালো। মেয়েটা সেই দুপুর থেকে পাটাতনের ভেতরে। অবশ্য সে এসেছে কিছুক্ষণ আগে। ভাগ্যিস যা হওয়ার এই নৌকায় হয়েছে। তবুও ধাক্কায় কি অবস্থা কে জানে। তাছাড়া বলতে গেলে বাধ্য হয়েই সে এই রাস্তায় নেমেছে। কোন কারণে দাদি এতো পাগল হলো কে জানে। তার এই মেয়ে বউ হিসেবে চাই’ ই চাই। গো ধরে বসে আছে। যেই পর্যন্ত এই মেয়ে বউ হিসেবে ঘরে আসবে না সে অন্নের দানা পেটে ফেলবে না। অথচ দিব্যি পান খেয়ে খিকখিক করে হাসছে। হাসতে হাসতেই এরশাদকে বললো, — খালি পেটে এই পান বিষের মতো। আমি আরামছে বিষ খাই, তুই তোর যা মর্জি কর।

এরশাদ আর রাস্তা দেখেনি। তাই বিয়ের জন্য সম্মতি দিয়েছে। তবে মেয়ে যদি নিজে থেকে সরে যায় সম্মতির মূল্য কি? তাই এই রাস্তা। এখন মেয়েটাকে ভালোয় ভালোয় তার খালা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেই বাঁচে।

চলবে……