#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৫
আয়নার অবস্থা খারাপ। একতো ভয়, আবার কিছুক্ষণ আগে নৌকার ধাক্কায় খেয়েছে মাথায় এক বাড়ি। সেই বাড়ির জায়গায় হয়েছে বিরাট সাইজের এক আলু। সেই আলু চেপেই চোখ মুখ কুঁচকে নৌকার গা এলিয়ে দিলো।
নৌকার পাটাতনে চিপচিপে পানি। সেই পানিতে অনেক আগেই শাড়ি ভিজে শেষ। সেই ভেজা শাড়ি গায়ে নিয়েই কাঠের ফোকর দিয়ে ঝিরিঝির আসা চাঁদের আলোর দিকে নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল। না তাকিয়েই উপায় কি? জয়তুন আরার লোকের জন্য ফরহাদ ভাই তাকে রেল স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। তার পালিয়ে যাওয়ার খবর শুনতেই পুরো গ্রাম ছড়িয়ে গেছে। আর সবচেয়ে বড় কথা রেলে সারেং বাড়ির ছোট নাতি স্বয়ং পাহারায় দাঁড়িয়েছে। তাই গেলেই শেষ। তাই ফরহাদ ভাই বলেছে, না বলা পর্যন্ত একদম বের হবি না, একদম না। সে বের হয়নি, হওয়ার চেষ্টাও করে নি।
বসে থাকতে থাকতে রাত! কে যেনো খবর নিয়ে এলো সারেং বাড়ির ছোট নাতি বাড়িতে গেছে। তখনি নৌকা ছাড়ার প্রস্তুতি নিলো। তবে নৌকা ছাড়ার আগে যখন দেখলো ফরহাদ ভাইয়ের সাথে সারেং বাড়ির বড় নাতিও নৌকায় উঠলো। সে তো শেষ। বলতে গেলে আঁতকে উঠেছে। দাঁতে দাঁত লেগে যাওয়ার জোগাড়। অবশ্য ভয় পাওয়ার মতো সে কিছুই করে নি। নৌকায় উঠেই মাঝিকে হারিকেন নিভাতে বলেছে। এই পর্যন্ত’ই! তার ব্যাপারে কোন শব্দ’ই উচ্চারণ করে নি। তখন আয়না বুঝল ফরহাদ ভাই কার সাইড হয়ে তাকে সাহায্য করছে।
সে বুঝলেও কোন এক অজানা আতঙ্ক তাকে ঘিরে রইল। না ঘিরে উপায় কি? সারেং বাড়ির মানুষ স্বয়ং মাথার উপরে। যাদের ব্যাপারে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে শুনেছে নানা কিচ্ছা। সেই কিচ্ছার অংশ যে তার বাবা, মাও।
সেই আতঙ্ক নিয়েই চুপচাপ বসে রইল। সেই বসার মধ্যে তার আতঙ্ক বাড়িয়ে ধুম ধামাকা লাগিয়ে ছোট জন হাজির। উপরের সব তান্ডব’ই তার কানে এসেছে। আর তখন তার এমন অবস্থা নৌকার পাটাতন ভেঙেই সে নদীতে সাঁতার দেয়। কেননা বড়টা তো যেমন তেমন, ছোট টা তো হাড়ে বজ্জাত। এই হাড়ে বজ্জাতের খপ্পরে সে একবার পড়েছিল। এখন না অবশ্য, অনেক আগে। তখন একেবারে ছোট। থাকতো গ্রামের দিকে।
সারেং বাড়িতে বিরাট পুষ্কনি আছে। একটা না কয়েকটা। একটার পানিতো সারা গ্রামের মানুষ রেঁধে বেড়ে খায়। আরেকটা আছে শান বাঁধানো ঘাট। কি সুন্দর টলটলা পানি। দেখলেই টুপ করে ডুব দিতে ইচ্ছে করে। আর তার তো পানির আজন্মের লোভ। তাই নিজের চুনোপুঁটি দলবল নিয়ে গেলো গোসল করতে। হুটুপাটির কথার কি আর কিছু বলার আছে।
তখনি কোথা থেকে ছোট নাতি এসে হাজির। বেতের ইয়া লম্বা ডান্ডা নিয়ে। কথা নেই বার্তা নেই শুরু করলো এলোপাথাড়ি বাড়ি। সবাই যে যেদিকে পারে সেদিকে দিলো দৌড়। সে তো পারলো না। খালি গা, এক ঘা এসে পড়লো পিঠে। আয়নার মনে হলো, বেতের সাথে তার চামড়াও খুলে চলে গেছে। সে সেই খুলে যাওয়া চামড়া রেখেই কিভাবে যে পালালো একমাত্র আল্লাহ’ই জানে। সে দাগ এখনো তার ফর্সা পিঠে হালকা রয়ে গেছে। বড় মা তো দেখলেই আফসোস করতো। আহারে, পিঠটা একেবারে শেষ। সেই থেকে যে ভয়! এইটার সামনে সে ভুলেও আর পড়েনি। অথচ সেই ভয় জান, প্রাণ লাগিয়ে তাকে খুঁজছে। তার গলা শুকিয়ে এলো।
সে শুকনো গলা নিয়েই চুপচাপ নৌকার পাটাতনে শুয়ে রইল। দৃষ্টি আগের মতোই ঝিরিঝিরি চাঁদের আলোর দিকে। তার গায়ের বেনাসরি শাড়ির মতো তার চোখের কোণও ভেজা। কেননা তার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, যদি তার বাবা- মা বেঁচে থাকতো, তার এই অবস্থা হতো? তারাও কি জমির লোভে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিতো? না! রক্ত, রক্ত’ই হয়। দুনিয়ার কোন লোভ রক্তকে খন্ডাতে পারে না। মাটির সাধারণ জমি রক্তের টানের সামনে খুব’ই তুচ্ছ। আর এই তুচ্ছের জন্য আয়না আজ এখানে। উঁহুম! জমির জন্য না বরং সারেং বাড়ির জন্য এখানে। তারা না থাকলে আয়নার বাবা- মা থাকতো। আর বাবা- মা থাকলে আয়না এখানে থাকতো না।
এরশাদ কে দেখে শাহবাজ রাগ আরো বাড়লো। ফুঁসতে ফুঁসতে বললো, — এতো বন্ধু বন্ধু করো। এই বন্ধুই তোমার জাত শত্রু। শেষবার নদীর ঘাটে আয়নামতির সাথে এরেই দেখা গেছে।
এরশাদ বড় একটা শ্বাস ফেললো! শাহবাজ অন্য রকম। তার ভেতর মায়া দয়া কম। সবাইকে পায়ে পিষতেই সে পছন্দ করে। বড় ছোট মানে না । কিছুদিন আগে বাপের বয়সী এক লোককে থাবড়া মেরে গাল ফাটিয়ে দিয়েছে। সে বড় একটা শ্বাস ফেলেই বললো, — নৌকায় একজন মেয়ে ছিলো শাহবাজ। এভাবে ধাক্কা মেরেছিস কেন?
— কথা ঘোরাবে না ভাই। আর মেয়ে ছিলো আমার কি? না আমার কোন জাত গোষ্টি। আমার কাজ আয়নামতিরে খোঁজা। ব্যস, তাকেই খুঁজে বের করবো। দরকার পড়লে দুনিয়া এফোঁড় ওফোঁড় করবো। তবে বের তো করবোই।
— কর নিষেধ করেছে কে?
— তাই তো করছি। বলেই ফরহাদের দিকে তাকালো। ফরহাদের অবশ্য ভাবান্তর নেই। সেই ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসছে। যেন শাহবাজের কথায় খুব মজা পাচ্ছে।
শাহবাজের রক্ত খলবলিয়ে উঠলো। সে আবার এগিয়ে গেলো। এরশাদ ফেরালো। ফিরিয়ে বললো, — মেয়েটা অন্ধকারের একা জঙ্গলের মধ্যে আছে। ভয় পাবে, আর না।
— কোন মেয়ে? আর তার জন্য তোমার এতো দরদ কেন? নিজের বউ ভেগেছে তা নিয়ে তো মাথা ব্যথা নেই।
— তুই ভালো করেই জানিস এই বিয়ে আমি করতে চাইনি।
— সেটা তো তুমি কাউকেই চাও না। নতুন কি? তবে দাদি চেয়েছে, তো সে এই বাড়ি’ই বউ হবে।
এরশাদ হাল ছাড়লো! এর সাথে কথা বলাই বৃথা। সে ফরহাদের দিকে তাকালো। নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে তার। এরশাদ তাকিয়ে বললো, — বয়সের তো একটু লেহাজ কর।
— সেটা তোর ভাইকে বল। রক্ত গরম বড় ভাইদের সামনে না।
শাহবাজও ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো, — বড় ভাই, তুই? হাহ্।
— সেটা সময় এলেই দেখাবো।
— সময় তোর***
ফরহাদ আবারো হাসলো। এরশাদ ফরহাদের দিকে তাকিয়ে বললো। তুইও শাহবাজের সাথে এই নৌকায় যা। এই চেহেরা নিয়ে আমার সাথে আসার দরকার নেই।
শাহবাজও সাথে সাথে বললো, — আমার নৌকায় এই গাদ্দারকে নেবো না। আয়নামতি কোথায় বলতে বলো।
ফরহাদ নাক মুছতে মুছতে নির্বিকার ভাবে বললো, — আয়নামতিরে দিয়ে তুই কি করবি? তোর ভাই তো জীবনেও বিয়ে করবে না। যদি তুই করিস তাহলে বল। বলে দিই কই আছে। ঝামেলা খতম। একে বারেই খতম।
শাহবাজ আগুন চোখে তাকালো। ফরহাদ তার মতোই হাসলো। একে অবশ্য হাসি বলে না। বলে বারুদ ছুড়ে মারা।
আর তার ছুড়ার শাহবাজের শরীর দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো। এরশাদ এদের দিকে আর তাকালো না। নিজেদের নৌকায় ফিরে যেতে যেতে বললো, — বাসায় যা শাহবাজ। যে গেছে গেছে।
— আমি বুবুজান রে কথা দিয়েছি। সেই কথা আমার জানের উপরে। মেয়ে আমি তার সামনে হাজির করবো। তারপর বুবুর যা ভালো মনে হয় করবে।
এরশাদ আর কিছু বললো না। বুড়ির মাথা গেছে। সে তাকালো নদীর পারে অন্ধকারে। ভয়ে মেয়েটা থরথর করে কাঁপছিল। অবশ্য বুঝতে দেয়নি। খুব কাছে থাকায় সে ঠিক বুঝেছে। তবে বলতেই হবে, এতো শক্ত ধাতের মেয়ে সে খুব কম’ই দেখেছে। সে মাঝিকে ইশারা দিলো নদীর ঐ পাড়টার দিকে যেতে।
পারে আসতেই এরশাদ লাফিয়ে নামলো। নেমে পৃথিলার সামনে এসে আগের মতোই আবার বললো, — আপনি ঠিক আছেন?
পৃথিলার আগের মতোই কোন রকম বললো — হুম
— এই বিপদের জন্য আমি খুবই দুঃখিত। আপনি কি নৌকায় উঠতে পারবেন?
পৃথিলা আগের মতোই শুধু হুম বললো। বলে এগুতে গিয়েও পড়ে যেতে নিলো। কাপড় ভিজে পুরো পেঁচিয়ে আছে ।
এরশাদ কবজি ধরে ফেরালো। মেয়েটা লম্বায় তার কাছাকাছি। শহরের আরাম আয়াশে পেলে বেড়ে উঠা মেয়ে। গ্রামের মেয়েদের মতো শুকনো না। বরং যতোটুকু থাকা দরকার ঠিক যেন ততটুকুই। গায়ের রং অবশ্য এই আধো আলো, আধো অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না। তবে এরশাদের শক্ত সামার্থ্য হাতের থাবার ভেতরে কোমল নরম হাতটা তার কাছে অন্য রকম’ই মনে হলো।
পৃথিলা সোজা দাঁড়াতেই এরশাদ কবজি ছেড়ে দিলো। দিয়ে নিজেই আগে নৌকায় উঠলো। উঠে হাত বাড়িয়ে দিলো। পৃথিলার ভয়, আতঙ্কে আকস্মিক নানান ঘটনায় মাথা জ্যাম হয়ে গেছে। সুস্থ ভাবে কিছু চিন্তা করবে সেই অবস্থা তার নেই। সে ঘোরের মধ্যেই এগিয়ে আঁকড়ে হাত ধরলো।
এরশাদ সেই আঁকড়ে ধরা হাতের দিকে এক পলক তাকালো। তারপর সাথে সাথেই টেনে নৌকায় তুললো।
পৃথিলা নৌকায় জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। ততক্ষণে নৌকা চলতে শুরু করেছে। নিজেকে সামলে উঠতেই সে আশে পাশে তাকালো। তাকিয়ে বললো,– আপনার বন্ধু কোথায়?
— ঐ নৌকায় চলে গেছে।
পৃথিকা অবাক কণ্ঠে বললো, — সেটাও আপনাদের নৌকা ছিলো?
— হ্যাঁ।
— তাহলে ধাক্কা মেরেছে কেন?
এরশাদ হাসলো। পৃথিলার মেজাজ খারাপ হলো। সে বিরক্ত মাখা সুরে বললো, — আপনার এই সব কিছু মজা মনে হচ্ছে?
— না! তবে আপনি হাজির’ই হয়েছেন এক ঝড়ের মধ্যে। তান্ডব গায়ে কিছুটা হলেও তো লাগবে।
পৃথিলা আর কিছু বললো না। সে বিরক্ত মুখে পানির দিকে তাকালো। পেট ভারি ভারি লাগছে। কতটুকু ভেতরে গেছে কে জানে। বমি করতে পারলে ভালো লাগতো।
শান বাঁধানো ঘাটের সামনে যখন নৌকাটা এসে থামলো, পৃথিলা বলতে গেলো একটু বিস্ময় নিয়েই তাকালো। রাতের অন্ধকারে নিস্তব্দ এই ঘাটের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক বাড়ি। বাড়িটি সাদা চুনকাম করা। অন্ধকারও তার সৌন্দর্য আড়াল করতে পারেনি। বরং চাঁদের আলোতে যেন তা ঠিকরে পড়ছে।
ভেজা কাপড় এখন কিছুটা শুকনো। শুকনো মানে পানি নেই। পৃথিলা সেই কাপড় সামলে হ্যান্ডব্যাগটা তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে নামলো। শান বাঁধানো ঘাট তাই নামতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না। সে নেমে এরশাদের দিকে তাকিয়ে বললো,– আপনাদের পূর্বপুরুষেরা জমিদার টাইপ কিছু ছিলেন নাকি?
এরশাদ হাসলো ! সরলতার হাসি। কিছু কিছু মানুষ আছে অচেনা হলেও ঝট করে পরিচিত মনে হয়। তাদের দেখে কখনো ভয় উদয় হয় না। কথা বলতে দ্বিধা আসে না। পৃথিলার মনে হলো এরশাদ লোকটা সেই রকম।
এরশাদ হেসেই বললো, — না, একেবারেই সাধারণ বলতে পারেন। আমাদের দাদারা জাহাজের সারেং ছিলো। বুঝতেই পারছেন। তখন যারা একটু টাকা পয়সা ধরতে পেরেছিল। আজ বলতে গেলে তারাই মাথা উঁচু করে আছে।
— উঁচু করে, না ক্ষমতার বলে।
— এসেছেন তো, ধীরে ধীরে সবই দেখতে পাবেন।
পৃথিলা কিছু বললো না। ঠিক তখনি পাটাতনের মেয়েটার কথা মনে পড়লো। এতো ধাক্কা ধাক্কিতে মেয়েটার কি অবস্থা? তার মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিলো। সে এরশাদের পেছনে এগুতে এগুতে বললো, — আমি কি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি।
এরশাদ আগের মতোই এগিয়ে গেলো। যেতে যেতে আগের মতোই সহজ গলায় বললো, — মেয়েটা বিয়ে করতে চায়নি। আমি শুধু সাহায্য করছি। সে গ্রামের মেয়ে। এসব ধাক্কা টাক্কায় অভ্যস্ত। তাই চিন্তা করার কিছু নেই।
— আপনি চেয়েছিলেন?
— না। তবে সে রাজি থাকলে আমি এই ব্যবস্থা নিতাম না।
— মানে বিয়ে করতেন।
এরশাদ আগের মতোই শান্ত ভাবে বললো — না।
পৃথিলার ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। মেয়ে রাজি না, সে রাজি না। আবার মেয়ে রাজি হলে এই রকম ব্যবস্থা নিতো না। আবার বিয়েও করতো না। তাহলে আসলে করতো তা কি?
সে ভ্রু কুঁচকেই হাঁটায় মনোযোগ দিলো। আঁচল টেনে ভালো করে নিজেকে আবৃত করার চেষ্টা করলো। কিছুটা শুকনো হলেও কাপড় গায়ের সাথে লেপটে যাচ্ছে।
সে দেখতে দেখতেই এগুলো। এটা সম্ভবতো বাড়ির পেছন দিক। সুন্দর বাগানের মতো করা। বাড়ির কাছাকাছি যেতেই আলোর দেখা পাওয়া গেলো। বিয়ে বাড়ি, বিভিন্ন রঙের মরিচ বাতির আলোতে বাড়িটা ঝিলমিল করছে। সেই আলোর সামনে এরশাদ লোকটা যেতেই পৃথিলা থমকে গেলো। অবশ্য সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নিলো।
এরশাদ লোকটা সেই সামলে নেওয়া বুঝলো কি না কে জানে। তবে সে একটু থেমে একবার পেছন ফিরে তাকালো। তাকাতেই পৃথিলার চোখে চোখ পড়ল। আর পড়ল বলেই পৃথিলা স্পষ্ট পুরো মুখটা দেখলো। তবে পৃথিলা এবারো চোখ সরিয়ে নিলো না। না হলো তার চেহেরায় কোন পরির্বতন। তবে এবার এরশাদ নিলো। নিয়ে সাথে সাথেই আবার এগিয়ে গেলো।
প্রাসাদের মতো বাড়িটা পেরিয়ে পৃথিলা একটা হাফ বিল্ডিং বাড়ির সামনে এলো। এই বাড়িটা ঐ প্রাসাদের বাড়ির দক্ষিণ কোণে। পরে হয়তো আলাদা ভাবে করা হয়েছে। এই বাড়ির সাথে ঐ বাড়ির যোগসূত্র থাকলেও, চলাফেলার জন্য রাস্তা, উঠান সব আলাদা ভাবে করা।
এরশাদ উঠানে দাঁড়িয়ে ডাকলো, — ইমরান..
রাত কতো পৃথিলা জানে না। হাতের ঘড়ি পানিতে পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। তবে তার কাছে মনে হচ্ছে নিশুতি রাত। চারিদিকে এতো নিস্তব্ধতা। সেই নিস্তব্ধতাকে ভেঙে এরশাদ আবার ডাকলো, এবার বেশ জোরেই ডাকলো — ইমরান..
তখনি ভেতর বাড়ির আলো জ্বললো। ফট করে দরজা খুলে হন্তদন্ত হয়ে এক লোক বেরিয়ে এলো। পৃথিলা সাবিহার জামাইকে না দেখলেও নাম জানে। তাই বুঝতে পারলো কে? তার পেছনে ঘুম ঘুম চোখে সাবিহাও এসেছে। এসে চোখ বড় বড় করে বললো, — পৃথিলা?
পৃথিলা স্বস্থির একটা শ্বাস ফেললো। তার মনে হলো। কতো জনম পর পরিচিত একটা মানুষ দেখলো। সে এগিয়ে গেলো। এরশাদ সুটকেস ইমরানের হাতের দিয়ে বললো, — সকালে এসে দেখা করো।
ইমরান সাথে সাথেই মাথা নাড়লো। এরশাদ পৃথিলার দিকে একবার তাকালো। তাকিয়ে হনহন করে অন্ধকারে মিশে গেলো।
পৃথিলাকে দেখে সাবিহার মাথায় হাত। এই মেয়ে রাত দুপুরে এমন একা এসেছে। ভেবেই সে আকাশ থেকে পড়ছে। তার মধ্যে পুরো ভেজা। নৌকায় উঠতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল নাকি। দেখতো তো কান্ড।
সে তাড়াতাড়ি করে টেনে তাকে কলপারে নিলো। সাবান গামছা এনে, নিজেই চেপে বালতি ভরে বললো, তুই তাড়াতাড়ি গোসল করে কাপড় ছাড়। কতোক্ষণ ধরে এমন আছিস। চোখ, মুখ পুরো ফ্যাকাশে। জ্বর ঠিক আসবে দেখিস।
পৃথিলা হালকা হাসলো! হেসে বললো, — “আসবে না। এতো টেনশন করিস না।”
এটা অবশ্য কথার কথা না। পৃথিলার সহজে জ্বর আসে না। শুধু জ্বর না, ছোট বেলা থেকে অসুখ, বিসুখও কম। তার ছোট বোন মিথিলা আবার বারো মাসই অসুখ, বিসুখ। সে তাকে দেখে বলতো, — তুই মানুষ নারে আপা। অন্য গ্রহের প্রাণী। এলিয়েন!
পৃথিলাকে সব গুছিয়ে দিয়ে সাবিহা দৌড়ে গেলো। আজ সে রান্না করেনি। ইমরান বর যাত্রী ছিল। তাই ভেবেছে মা, মেয়ে যা আছে তাই দিয়ে চালিয়ে দিবে। পৃথিলাকে কি আর তা দিয়ে দেওয়া যায়। তবে এতো রাতে আর চুলা জ্বালালো না সে। মাটির চুলা! আগুন জ্বালাতেই ঘন্টা পেরিয়ে যাবে। স্টোভ আছে! সেখানে ভাত গরম করে ডিম ভেজে ফেলবে। ঘরে গাছের মিষ্টি কুমড়া আছে, চাক চাক করে কেটে ভেজে চটকে শুকনা মরিচ দিয়ে ভর্তাও করে ফেলবে।
চলবে……