#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৭
পৃথিলা গোসল শেষে বেরিয়ে এসে দেখলো সাবিহা এর মধ্যে সব রেডি করে ফেলেছে। ধোঁয়া ওঠা মোটা চালের সাদা ভাত, ডিম ভাজা, ভর্তা। মেয়েরা সংসারী হলে সব কাজে কেমন নিপুণ হয়ে যায়। অথচ এই মেয়েটাই ভার্সিটিতে ছিল আধা পাগলের মতো। কি করতো না করতো তার কোন সঠিক হদিস নেই।
সাবিহা আর তার পরিচয় ঢাকায় এসে ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পর। সে সব সময়’ই চুপচাপ। নিজে থেকে কারো সাথে বন্ধুত্ব করবে, এমন গুণ তার মধ্যে কখনও ছিল না। বলতে গেলে সাবিহার বদৌলতেই হয়ে গেছে। সাবিহা মধ্যবিত্ত পরিবারের সাদাসিধে নিরহংকার মেয়ে। যার সাথে কথা বলে মনে থেকেই বলে, যার সাথে মিশে মন থেকেই মিশে।
আর এই সাদাসিধে মেয়ের বন্ধুত্বের রেশ ধরে একদিন এমন চলে আসবে কখনো কি ভেবেছে? না, কখনোও না। মানুষ যা কখনো কল্পনাও করে না, সেগুলেই তাদের সাথে ঘটতে থাকে অনায়াসে। মানুষ সেগুলো দেখে প্রথমে থমকায়, অবাক হয়, বাকরুদ্ধ হয়ে ভাবে, তারপরে ঠিক মানিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।
সেও কি যাচ্ছে না, তার মাও কি যায় নি? তবে কোন কারণে এই মেয়েটা সব সময় তার পাশে ছিল। সব সম্পর্ক ছিন্ন করে যখন তারেকের হাত ধরেছিল। তখনোও ছিল! কেন ছিল সে জানে না। কেননা সাবিহা অর্নাস কমপ্লিট করেনি। মাঝামাঝি এসে শুনে তার বিয়ে। মধ্যবিত্ত পরিবার! তা মধ্যে চার মেয়ে। ভালো ঘর পেলে কেউ কি আর বসিয়ে রাখে। রাখে না! রাখে না বলেই এই যে শহরে বেড়ে উঠা মেয়েটা কি সুন্দর এই অজোপাড়া গাঁ’য়ে সংসার করে যাচ্ছে।
আর এই সংসারের নানান ঝামেলার মাঝেও এই মেয়েটা তার সাথে যোগাযোগ রেখেছে। মাঝে মাঝে একটা চিঠি পৃথিলার ডাকবক্সে ঠিক জমা হয়েছে। ঢাকা বাবার বাড়িতে গেলে পৃথিলার সাথে ঠিক দেখা করেছে। তা না হলে ভার্সিটির বন্ধুত্ব, ভার্সিটির বাইরে এতোদিন খবর রাখে কে?
পৃথিলা খেতে বসলো চুপচাপ। নারিকেল পাতার সুন্দর চকচকে পাটি। অতিরিক্ত বিলাসিতা না থাকলেও সে বলতে গেলে বড় হয়েছে আরাম আয়াশে। এভাবে খাওয়ার অভ্যাস নেই। তবুও কেন জানি পৃথিলাম ভালো লাগলো।
তবে অতিরিক্ত খুদা পেলে আর বোঝা যায় না, শরীর ঝিমিয়ে আসে, তারও আসছে। সেই আসা নিয়েই সে খাওয়া শুরু করলো। তবে দু’লোকমার বেশি খেতে পারলো না। অবশ্য আজ না, যেই দিন তারেকের অফিস থেকে ফিরলো, সেই দিন থেকে আর তার গলা দিয়ে খাবার নামে না।
সাবিহা পৃথিলার দিকে তাকিয়ে রইল। গায়ে রুপালি পাড়ের কালো কাপড়। সেই কাপড়ে ছোট ছোট লাল সুতোর ফুল। একতো কালো কাপড় তার মধ্যে অনেকক্ষণ ভিজে থাকায় এই ছোট লাল বাতির আলোতে কাপড়ের রুপালি পাড়ের মতোই পৃথিলাকেও দেখতে ভালো লাগছে। শুধু ভালো না চোখে ঘোর লাগে এমন। ভেজা চুলগুলো গামছায় পেঁচানো। চোখ দুটো এক রাজ্যের বিষন্নতায় ডোবানো। মুখ শুকিয়ে এই এতোটুকু। কতোদিন ঠিকমতো খাওয়া ঘুম নেই কে জানে।
সে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। দিয়ে আস্তে করে বললো, — তারেক ভাইয়ের সাথে কিছু হয়েছে?
পৃথিলা হাত বাড়িয়ে গ্লাস নিলো। মুখের ভাত দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। চেষ্টা করেও গলা দিয়ে নামাতে পারছে না। সে পুরো গ্লাস পানি’ই ঢকঢক করে খেলো। খেয়ে তার স্বভাব মতোই শান্ত ভাবে বললো, — না।
— তাহলে?
— আমরা আর এক সাথে নেই।
সাবিহা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে গোছগাছ করলো। করতে করতে বললো, — সেই বার ঢাকায় গিয়ে তারেক ভাইকে একদিন দেখলাম গাড়িতে। সাথে একটা মেয়ে। আমি তোকে বলতে চেয়েছিলাম। তবে সাহস হয়নি। আমি তো তোকে চিনি। তাই সেধে চাকরির কথা বলেছিলাম। টেনশন করিস না। আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে।
— তোকে বিপদে ফেলে দিলাম।
সাবিহা হো হো করে হেসে ফেললো। নিস্তব্ধ রাতে হাসিটা এই বাড়িতে ঝিমঝিম করেতে লাগলো। তার হাসিতে তার পাঁচ বছরের মেয়ের ঘুম ভেঙে গেলো। বাবার সাথে শুয়ে ছিলো। তবে মায়ের হাসির শব্দে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে পাশের রুমের দরজায় থেকে উঁকি দিলো।
পৃথিলা হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকলো। মেয়েটা অবশ্য এলো না। না আসার ই কথা। ছোট বাচ্চারা ঝট করে অপরিচিত মানুষের কাছে ঘেঁষে না। তারা আগে দেখবে, বুঝবে, ভাব হবে তারপর কাছে আসবে। আর তারা এতো বড় হয়েও, এতো বুদ্ধি নিয়েও, না জেনে না বুঝে ঝট করেই একজনকে আপন করে নেয়। চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে জীবনের সব সুখ গুলো তাদের পায়ের কাছে রাখে। আর রাখে বলেই তারা অতি সহজেই মাড়িয়ে চলে যায়।
______
আয়না হতম্ভব হয়ে তার লেপটে যাওয়া কাজলের গোল গোল চোখে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। আসলে সে স্বপ্ন দেখছে না বাস্তব এখনো বুঝতে পারছে না।
শাহবাজ আয়নার হতম্ভব চেহেরা দেখলো। দেখে নির্বিকার ভাবে হাই তুললো! মধ্যরাত, তার মধ্যে সারাদিন দৌড়ঝাঁপ, মারামারি। শরীর, মাথা একদম শেষ।
শাহবাজ হাই তুলতেই আয়না কেঁপে উঠল। আর সাথে সাথেই বুঝল, সে কোন স্বপ্ন দেখছে না। এটা বাস্তব, একেবারেই বাস্তব। আর বাস্তব বলেই তার গলা শুকিয়ে এলো।
সারেং বাড়ি ছোট নাতির চোখে, মুখে, নাকে, ঠোঁটে মারের জখম। বেশ ভালো’ই জখম। শ্যামলা বরণ, তবুও স্পষ্ট! বেশ ভালো ভাবেই স্পষ্ট। নৌকার পাটাতনের ভেতরে থাকলেও ফরহাদ ভাই আর এর যুদ্ধের আঁচ সে ভালো ভাবেই পেয়েছে। পেয়েছে বলেই তখন মনে মনে ঠিক করেছিল আবার যদি ফরহাদ ভাইয়ের সাথে দেখা হয়, সে পায়ে হাত দিয়ে তাকে সালাম করবে। আর বলবে, — “এই যে এতিম মেয়েটার জন্য এতো করলেন। মার পর্যন্ত খেলেন। যদি কখনো সুযোগ হয়। আমি নিজের জীবন দিয়ে হলেও তা শোধ করার চেষ্টা করবো, সত্যিই করবো।”
অবশ্য আর দেখা হবে বলে মনে হয় না। এই যে আজরাইলের হাতে ঠিক পড়ে গেলো। যেই আজরাইল সোজা এখন তার দিকে তাকিয়ে আছে। এমন ভাব, যেন না বলেও বলছে, ঘুম ভালো হয়েছে মহারানি?
আয়না ঢোক গিলে সোজা হয়ে বসলো। তার চোখে মুখে স্পষ্ট আতঙ্ক। কেননা তার সাথে যে লোক দেওয়া হয়েছিল, সে বসে আছে নিচে। সারেং বাড়ির ছোট নাতির পায়ের কাছে। তার মুখেও মারের দাগ। আর সবচেয়ে বড় কথা তার এক হাত শাহবাজ নামক লোকটার পায়ের নিচে। সেই হাতের উপরেই পা রেখে ইচ্ছে মতো আরেক পা নাচিয়ে যাচ্ছে। আর লোকটা চাপা আর্তনাদ করছে।
আর তার আর্তনাদে আয়না ঘুম ভেঙেছে। ইশ! সব তার জন্য। আয়নার চোখে পানি চলে এলো। কি নিষ্ঠুর মানুষ এরা।
আয়নার গোল গোল চোখে টলমলো পানি। সেই পানি দেখে শাহবাজ মুখ বাঁকিয়ে হাসলো। রেল স্টেশনে তার মানুষ ছিল। সারা রাত’ই থাকতো। এরা ভেবেছে সে বাড়িতে গেছে বালা মসিবতও গেছে। আসলে সে ঠিক জানতো, যাওয়ার হলে রেলেই যাবে, আর হয়েছেও তাই। তাই তার লোক দেখেই খবর পাঠালো কোন ট্রেনে উঠেছে। অবশ্য সে আসতে আসতে ততক্ষণে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।
দিলে কি? কোন ট্রেন কোথায়, কতোক্ষণ থামে এই মেয়ে না জানলেও শাহবাজ ঠিক জানে। জানে বলেই সে ধীরে সুস্থে’ই এসেছে। কেননা এই যে কিছুক্ষণ আগের যেই স্টেশন গেলো সেখানে এই ট্রেন বেশ কিছুক্ষণ থেমেছে। থেমেছে বলেই ধরতে কোন বেগ পেতে হয়নি। এসে দেখে এই মেয়ে আরামছে ঘুমাচ্ছে। ট্রেন থেমেছে, কি থেকে কি হয়েছে। এই মেয়ের খবরও নেই। আমাদের ঘুম হারাম করে এদিকে সে হাতি, ঘোড়া বেচে ঘুমাচ্ছে। ভাবা যায়!
শাহবাজ নিজের কেটে যাওয়া ঠোঁট জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে বললো, — যা ঘোল খাওয়ালেন। বিশ্বাস করেন, অনেক দিন পর পুরো সারেং বাড়ি একটু নড়েচড়ে উঠেছে। এই একটু! আবার নিজেকে এতো দামি ভাববেন না যে আপনার জন্য পুরো নড়েচড়ে গেছে।
আয়নার চোখ ফিরিয়ে নিলো। নিতেই গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। এখন কি করবে তাকে নিয়ে।
তখনি শাহবাজ দু’আঙুলে একটা চুটকি বাজালো। আয়না আবার চোখ তুলে তাকালো। তাকাতেই শাহবাজ বললো, — আমি যখন কথা বলবো, দৃষ্টি সোজা সামনে।
আয়নার ভেতর ফুঁপিয়ে উঠলো। সে অনেক কষ্টে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে তাকিয়ে রইলো। তার মনে হলো সারেং বাড়ির বড় নাতির মুখের চেয়েও এই যে শক্ত চোয়ালের কঠিন মুখ, এটা ভয়ংকর। অনেক অনেক ভয়ংকর।
শাহবাজ ঠোঁট ছাড়িয়ে হাসলো! হেসে বললো, — এবার ঠিক আছে। এখন বলুন, পালিয়েছেন কেন? আমার ভাইয়ের মুখ আপনার মুখের মতো চাঁদ মুখ না, এই জন্য?
আয়না সাথে সাথে দুপাশে মাথা নাড়লো।
— তাহলে ?
— আমি বিয়ে করবো না।
— ওরে বাবা, কেন?
আয়না উত্তর দিলো না। শাহবাজ’ই আগের মতো বললো, — শুধু সোজা তাকালে হবে না। প্রশ্ন আমি একবার করবো। আশা করি উত্তর একবারে’ই আসা চাই। একই গ্রামের মেয়ে যেহেতু আমার ধৈর্য্য সম্পর্কে ধারণা থাকার কথা। আল্লাহ সব কিছু দিয়েছেন, এটার বেলা এমন কাঞ্জুসি করলেন কেন কে জানে? তাই শুধু একবার।
আয়না আবারো ঢোক গিললো। গিলে কোন রকম ঠোঁট নাড়িয়ে বললো, — আপনারা ভালো মানুষ না।
— তো? আপনি ভালো মানুষ? আপনার লোভী চাচা ভালো মানুষ? ছোট বেলা থেকে তো বড় হলেন এর গাছের ওর গাছের ফল নেচে নেচে চুরি করে খেয়ে খেয়ে। তখন গিয়েছি আমরা বলতে?
আয়নার কণ্ঠ এবার একটু বাড়লো! বেড়েই বললো — এতে কারো ক্ষতি হয়নি। আপনারা জমি বর্গা দেন সময় মতো টাকা বা ধান দিতে না পারলে তাদের যেটুকু জায়গা থাকে সেইটুকুও নিয়ে নেন। জায়গা না থাকলে অত্যাচার করেন। এমনকি আমার বাবা.. আয়নার গলা ধরে এলো। ধরা গলা নিয়েই বললো, — আপনারা মানুষের জীবন পর্যন্ত নিয়ে নেন।
শাহবাজ মাথা নাড়লো! নেড়ে বিজ্ঞের মতো বললো, — অনেক বড় কারণ?
আয়না উত্তর দিলো না। ভয়ে তার পেট পাক দিচ্ছে। শাহবাজও আর কিছু বললো না। তবে তার সাথে যে লোক ছিলো, এবার আরো জোরে আর্তনাদ করে উঠলো। আয়না আবারো কেঁপে উঠলো। তার দিকেই খুব স্বাভাবিক ভাবে দৃষ্টি রেখে পা ইচ্ছে মতো ঘষছে।
আয়না ফুঁপিয়েই বললো, — আমাকে তো পেয়েছেন’ই। ওনাকে ছেড়ে দিন। দয়া করে ছেড়ে দিন।
শাহবাজ মাথা চুলকালো! চুলকে নিচে বসা লোকটার দিকে তাকিয়ে কৌতুকের সুরে বললো, — দয়া কি জিনিস?
আয়না নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টি পুরো উপেক্ষা করে, শাহবাজ আরো আরাম করে শুলো। তার সাথেও দুটো লোক। শুতে শুতে তাদেরকে বললো, — মাথাটা বানিয়ে দে। সারাদিনের দৌড় ঝাঁপে পুরো শেষ।
সাথে সাথে তার সাথে আসা দু’টো লোকের একজন এগিয়ে এলো। এসেই তার কাজ শুরু করলো। শাহবাজের চোখ বন্ধ, তবে আয়না ভয়েও চোখ নামালো না।
সেই তাকানো আর আল্লাহর বানানো মাথা আরেক ধাপ বানাতে বানাতেই আরেক স্টেশন এলো। কোন স্টেশন আয়না জানে না? তার জানার কথাও না। তবে শাহবাজ চোখ খুললো। খুলে ঘাড় এই কাত থেকে আরেক কাত করতে করতে উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়াতেই নিচের লোকটা আবার আর্তনাদ করে উঠল। বেশ জোরেই উঠল। উঠার কারণ আছে। পুরো শরীরের ভার নিয়ে হাতের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। ভালো ভাবেই আছে।
সেই ভাবে দাঁড়িয়ে’ই আগের মতো বললো, — ভাইয়ের আদেশ পালন করেছিস তাই অল্পতে ছাঁড়লাম। তবে তোর তো আবার ঢাকার যাওয়ার খুব শখ জেগেছে। তাই তুই ঢাকায়’ই যা! তবে এক কথা, এক মাসের আগে যদি গ্রামে চেহেরা দেখছি। বিশ্বাস কর, তোর চেহেরা তুই নিজেই চিনবি না।
বলেই পা’টা আরেকটু ঘষলো! ঘষে এগুলো! আয়না এই সব দেখে পাথরের মূতির মতো বসে আছে। সেই বসা থেকেই সোজা তার হাতের কবজি ধরলো! ধরে আর কোন কথা টথা নেই। টেনে হিঁচড়ে ট্রেন থেকে নামানো। সেই টেনে হিঁচড়েই এক বন্ধ চায়ের দোকান পর্যন্ত নিলো। নিয়ে চায়ের দোকানের কাঠের বেঞ্চ দেখিয়ে বললো, — চুপচাপ এখানে বসেন। মিঠাপুকুরের পরের ট্রেন, ভোর পাঁচটায়। সেই পর্যন্ত চুপ! একদম চুপ। যদি মনে করেন মেয়ে বলে পার পাবেন। তাহলে এসব চিন্তা যেখানেরটা সেখানেই হজম করে ফেলেন। আসলে শাহবাজের সেন্টারে সেই রকম কোন কিছু নেই। ঊনিশ থেকে বিশ হলেই চাপা খুলে হাতে চলে আসবে। চাপা সেহি সালামত চাইলে একদম চুপ।
আয়না কাঁপতে কাঁপতেই চুপচাপ বসলো। ছোট খাটো মানুষ সে। আগেই ছিল শাড়ি দুমড়ানো, মুচড়ানো। টানা, হেঁচড়ার এখন মাটিতে লুটোপটি খাচ্ছে। গুছিয়ে উঠাবে সেই সাহসও তার হলো না। তাকে দেখতে লাগছে পাগলের মতো। সেই পাগলের মতোই চুপচাপ বসে রইল। অবশ্য বেশিক্ষণ বসতেও পারলো না। তার পেট মুচড়ে উঠল। আর উঠল বলেই কেঁদে ফেললো।
শাহবাজ চোখ মুখ কুঁচকে বললো, — কি হয়েছে?
আয়না হেঁচকি তুলতে তুলতে কোন রকম বললো, — বাথরুমে যাবো।
— দরকার পড়লে তো যাওয়া দরকার’ই। শাহবাজের সামনে ভালো ভালো মানুষের অবস্থাও ঢিলে হয়ে যায়। আর আপনি তো চুনোপুঁটি। তবে এমন কেঁদে উঠার কারণ কি?
আয়না উত্তর দিলো না। শাহবাজ উত্তরের আশাও করলো না। বিরক্ত মুখে তার মাথা বানানো পার্টিকে বললো নিয়ে যেতে।
আয়না বাথরুমে গেলো ভালো ভাবেই। যাওয়ার আগে শাড়ি গুছিয়ে কোমরে গুজেছে। গুজেটুজে হালকা হয়ে বাথরুম থেকে বের হতে দেখলো, মাথা বানানো পার্টি একটু দূরে, ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে।
সে যে বের হয়েছে দেখেনি। আর দেখেনি বলেই সে টুপ করে সাইড কেটে বেরিয়ে এলো। বেশি দূর অবশ্য যাবে না। এই অন্ধকার রাতে যাওয়ার সাহস কই। তাই আশে পাশেই ঘাপটি মেরে বসবে। কতো রাত কে জানে? সকাল হলেই কারো কাছে সাহায্য চাওয়া যাবে।
আয়না পালিয়েছে শাহবাজ বুঝলো মিনিট খানেক পরে। যেই চাপা খুলে আয়নার হাতে আসার কথা ছিল, সেটা এলো এই মাথা বানানোর পার্টির। এই পার্টি হলো জয়তুন আরার পোষা লোকদের’ই একজন। তাই তেমন ভাবান্তর হলো না। তবে এই এক থাপ্পড়ে তার দাঁত নড়ে গেছে। সেই নড়া দাঁতের চাপায় হাত আর মুখ ভরা নোনতা রক্ত নিয়েই এক দিকে দৌড়ে গেলো। আরেকটা গেলো আরেক দিকে। শাহবাজও এগুলো! রাতের অন্ধকারে বেশিদূর যাবে না সে জানে। আশে পাশে বাড়ি ঘর গুলোতেই খুঁজতে বললো।
আয়না সত্যিই বেশিদূর যায়নি। স্টেশনের পাশেই এক গৃহস্থ বাড়ি। সেই বাড়ির উঠানে এক টিনের ঘরের সাইডে খড়ের পালা। সেই খড়ের পালা ঘেঁষে চুপচাপ বসে আছে। সে ঠিক করেছে সকাল হলে এই বাড়ির মানুষদের কাছেই সাহায্য চাইবে। খালার ঠিকানা চিঠি লিখতে লিখতে তার মুখস্ত। শুধু অনুরোধ করবে তাকে যেন একটু পৌঁছে দেয়। টাকা পয়সা এখন আর সমস্যা না। গয়না টয়না সব তার গায়ে। একটা বেচলেই সব সমস্যার সমাধান।
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলেই আরেকটু গুছিয়ে বসলো। এক রাতোর মধ্যেই তার সব ভয় ডর কোথায় গেছে কে জানে। তবে গ্রামে ফিরে গেলে তো তার আর রক্ষে নেই। এমনিতেও মরবে ওমনিতেও মরবে। তার চেয়ে ভালো, মরার আগে একটু শেষ চেষ্টা করা যাক। তখনি তার হাত বেয়ে কোন একটা পোকা উঠলো। আয়না এক লাফ দিয়েই হাত এমন ঝাড়া মারলো। মারতেই তার হাত লাগলো বাড়ির টিনের মধ্যে। নিস্তব্ধ রাত এই হাত লাগার শব্দে শাহবাজ ঠোঁট টিপে হাসলো। সে মাত্রই এ বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়িয়েছে। শুধু যে সে শুনলো তা না, টিনের ঘরের ভেতরের মানুষও ধড়ফড়িয়ে উঠল। না উঠে উপায় কি? কিছুদিন আগেই তাদের গোয়াল থেকে গুরু চুরি হয়েছে। তাই তারা থাকে বলতে গেলে সবসময়’ই কিছুটা সজাগ। ভাবলো আবারো চোর এসেছে নাকি। তাই তারা সজাগ হয়েও কোন রকম শব্দ করলো না। তবে ঠিক টুপ করে উঠে পড়ল ।
আয়না অবশ্য এতো কিছু বুঝে নি। সে আবার আগের মতোই বসতে গেলো। ভেবেছে মধ্য রাত। সবাই গভীর ঘুমে। হয়ত কেউ খেয়াল’ই করেনি। তবে সে তো আর জানে না। ভাগ্য তাকে মিঠাপুকুর ছাড়তে দেবে না। ছাড়া তো বহুত দূর। যেই বাড়ির বউ হবে না বলে এতো কিছু। সেই বাড়ির বউ হওয়ার আয়োজন নিজ হাতেই করে ফেলেছে। সেই করার প্রথম ধাপ হিসেবেই সে বসতে গিয়ে দেখল, পেছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়েছে বলেই তার ছায়া ঠিক তার সামনে পড়েছে।
হাজার চাঁদের আলো থাক। মধ্য রাত! তার মাথায় অন্য কিছু আসেনি, এসেছে জ্বীন, ভূতের মতো কিছু। তাই দিক বেদিক ভুলে সে লাফিয়ে এক চিৎকার দিতে গেলো। শাহবাজ পেঁছন থেকে জাপটে মুখ চেপে ধরলো। না ধরে উপায় কি? হাঁটুতে ঘিলু থাকা মেয়ে, এই রাত বিরাতে চিৎকার কি জিনিস এই মেয়ে জানে?
ধরতেই আয়নার আত্মা উড়ে যাওয়ার জোগাড়। সে তো প্রায় ডানা ভাঙা পাখির মতো ছটফটিয়ে উঠল। আর তার ছটফটানিতে কোমরে গোজা কাপড় পুরো খুলে ছড়িয়ে গেলো, অন্ধকারে শাহবাজ বুঝেনি তবে থামানোর জন্য আরো শক্ত করে চেপে ধরলো। আর ঠিক তখনি এক জাল এসে পড়ল তাদের উপরে। শুধু পড়ল না, ঐ সাইড থেকে টান পড়তেই একেবারে অষ্টেপৃষ্ঠে পুরো পেঁচিয়ে গেলো।
আয়না তো যেমন তেমন শাহবাজ নিজেও হতবুদ্ধি হয়ে গেলো। কিছু করবে তার আগেই কেউ চেঁচিয়ে উঠলো। চোর ধরছি গো চোর। সবাই তাড়াতাড়ি আহো। চোর ধরছি চোর।
পুরো বাড়ির মানুষ দৌড়ে এলো। শুধু বাড়ির মানুষ না। দৌড়ে এলো আশ পাশ থেকেও। শাহবাজের ভ্রু কুঁচকে গেলো। তার হাতের নিচে চেপে রাখা আয়নার মুখও হা হয়ে গেলো। হচ্ছে কি? তখনি একেক পর এক টর্চের আলো তাদের মুখের উপরে পড়তে লাগলো। পড়তেই সবাই অবাক! কেউ কেউ তো আস্তাগফিরুল্লাহ বলে মুখে হাত দিয়ে দিলো।
চলবে…..