#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১০
এরশাদ জাফরের রুমে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। কাঠের কারুকাজ করা ছোট্ট আয়না। কোন রকম শুধু মুখটাই দেখা যায়। এরশাদ সেই আয়নায় নিজের আগুনে ঝলসে যাওয়া কোঁচানো মাংসের ভয়ংকর মুখটার দিকে তাকালো রইল। অনেক দিন পরেই তাকালো। তাকিয়ে হেসে ফেললো! এতোদিন ছিল ভয়ংকর। আজ ন্যাড়া মাথায় সব সীমা ছাড়িয়ে ষোলকলা পূর্ণ হয়ে গেছে।
সে হেসেই খাটে এসে বসলো। তার রুমে আয়না নেই। চাচার রুমেও ছিল না। ছোট চাচির সাথে তার সংসার জীবন সীমিত। এই বছর ছয় একের মতো। সেই সংসার ভেতরে কেমন ছিল এরশাদ জানে না। জানার কথাও না। বয়স আর তখন কতো তার। চৌদ্দ, পনেরো! এই বয়সে চাচা – চাচির বিবাহিত জীবন নিয়ে আগ্রহ থাকার কথা না। তবে বাহিরে দেখতে ঠিক ঠাক’ই ছিল। তখন চাচা- চাচির রুম ছিল, দ্বিতীয় তলার অন্য পাশে। সেই ডাকাতের ঘটনার পরে চাচা এই রুমে চলে এসেছিল। এই রুমে একটা পালঙ্ক ছাড়া চেয়ার টেবিল, বইয়ের তাক আর একটা কাঠের আলমারি।
বাকি যা টুকটাক আছে, সব বীণার বদৌলতে। এই যে কাঠের কারুকাজের আয়না, সেটাও। শুধু এই রুমে না, পুরো বাড়িতে। কেননা মেলা থেকে একেক সময় একেক জিনিস কিনে। কিনে যেখানে মন চায় সেখানে লাগিয়ে ফেলে। এই বাড়িতে সব চেয়ে সুখী মানুষ মনে হয় সে’ই। কোন টেনশন নেই, চিন্তা নেই। ধূসর এই সারেং বাড়ির রঙিন প্রজাপতি সে।
সে খাটে বসে ভেজা গামছা গলায় ঝুলিয়ে বললো, — এখন তো আর সমস্যা নেই। পরিচয় গোপন করছো কেন?
জাফরের দৃষ্টি ছিল বাহিরে! চোখ ফিরিয়ে এরশাদের দিকে তাকিয়ে বললো — তোর কি ধারণা, পরিচয় পেলে এই মেয়ে গদগদ হয়ে বাপের গলায় ঝুলে পড়বে?
এরশাদ হাসলো! হেসে বললো, — দ্বিতীয় জয়তুন আরা সে।
— উঁহুম, বলেই জাফর এগিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। বড় ভাই আর তার বয়সের পার্থক্য অনেক। তাই ভাই সংসারী হয়েছে আগে। সন্তান, সন্তানাদি হয়েছেও আগে। এরশাদ বাড়ির প্রথম সন্তান। সেই হিসেবে চাচা, ভাতিজা বলতে গেলে একে অপরের নেওটা হয়ে বড় হয়েছে।
সে বসে এরশাদের দিকে তাকিয়ে বললো, — আলতাফ আলির প্রতিচ্ছবি সে।
— বুইড়াকে মনে নেই আমার। জ্ঞান বুঝ হওয়ার আগেই উড়াল দিলো।
— সেই চুপচাপ, শান্ত আর নিজের শক্ত নীতিতে চলার দৃঢ় মনোবল সম্পূর্ণ। জয়তুন আরার কোন নীতি নেই। তার এক নীতি সে নিজে।
— সবার এই নীতি’ই চাচা। নিজের ঊর্ধ্বে গিয়ে কেউ কখনোও ভাবে না। তাছাড়া এতো নীতিবান ছিল, তো বউ রেখে আরেক বিয়ে করেছে কেন?
— আমি করেছি কেন? খারাপ মানুষেরা কখনোও কোথাও আটকায় না, আটকে যায় ভালো মানুষেরা। তাছাড়া গ্রাম গঞ্জে বংশ কি, তোর তো না জানার কথা না। বংশ, সমাজ রক্ষায় অনেক কিছুই করতে হয়। তবে তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল, জয়তুন আরার রুপে দেওয়ানা হয়ে এই বাড়ির বউ করে আনা।
— প্রিয় দাদি আমার। একটু মুখ সামলে টামলে বলো।
জাফর হালকা হাসলো! হেসে আবার জানালার দিকে তাকিয়ে বললো, — ইমরানের সাথে কথা হয়েছে?
— হ্যাঁ!
— আমার মেয়ে এখানে কেন?
এরশাদ উত্তর দিলো না। জাফরের দৃষ্টি আগের মতোই বাইরে। কিছুক্ষণ সেই ভাবেই নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল। তারপর বললো, — বাবা মায়ের পাপের শাস্তি মাঝে মাঝে সন্তানের উপর দিয়ে যায়। আমার পাপের অংশটা হয়তোও মেয়েটার উপর দিয়ে গেলো। যেই পাপ আমি করেছি, সেই পাপ আরেকজন আমার মেয়ের সাথে করে গেলো।
— তুমি পরিস্থিতির স্বীকার ছিলে।
— সেটায় নিশ্চয়’ই শায়লায় সাথে অন্যায়ের পাপের ওজন কমে যাবে না।
— তা যাবে না।
— শায়লা বাদে আমি কখনো স্বজ্ঞানে কারো ক্ষতি হবে এমন কাজ করিনি এরশাদ। তবে একটা করবো।
এরশাদ হাসলো! হেসে বললো — জামাইকে জামাই আদর করা দোষের কিছু না।
— সে জানে না কার মেয়ের জীবন নিয়ে খেলেছে ।
— হ্যাঁ! সেটা শায়লা চাচির বাবার জানানোরও প্রয়োজন ছিল।
— সেটা জালালে আমি নিজেই মাথা পেতে নিতাম।
— আফসোস শায়লা চাচি তোমাকে সেই যোগ্যও মনে করেনি।
জাফর ভ্রু কুঁচকে এরশাদের দিকে তাকালো! তাকিয়ে বললো — তুই কোন সাইড হয়ে কথা বলছিস?
— আমি কোন সাইড হয়ে’ই বলছি না। তুমি বলছো, চুপ করে তো আর বসে থাকতে পারি না। তাই বলছি। তাছাড়া বলে কোন লাভ আমার।
— তা ঠিক! বলেই জাফর উঠলো! উঠে আবার জানালার পাশে গেলো। মেয়েটাকে দেখেছে পর থেকে বুকের ভেতরে এক অস্থিরতা। এই অস্থিরতার হাল কি? সে গিয়ে বললো, — আজ যা হলো, তোমার প্রিয় দাদি চুপ বসবে না। তার এক নীতি। যে যতটুক দেবে ততটুকু’ই ফিরিয়ে দেবে। সেটা ভালো হলে ভালো। মন্দ হলে মন্দ। আমার মেয়ের গায়ে ফুলের টোকাও যেন না লাগে এরশাদ। আমার মেয়ে ক্ষত বিক্ষত হয়ে নিজের অজান্তে বাবার ছায়ায় এসেছে। এই ছায়ার তলে কিছু হলে আমি মরে যাবো।
— এখন সব কাজ টাজ ফেলে তোমার মেয়েকে পাহারা দেবো?
— আমাকে চাচা মনে করলে অবশ্যই দেবে।
— জয়তুন আরার চেয়ে তুমি তো কম না। সারেং বাড়ির মানুষ আর কিছু পারুক আর না পারুক। শুধু কথায় কথায় মরে যাবো, মরে যাবো। এটা ঠিক পারে। আরে যেতে যেতে তো সব শেষ। আর কত?
— হাজার হলেও ছেলে।
— তার ছেলে আমার কি?
— এরশাদের প্রিয় চাচা।
এরশাদ আবারো হাসলো! হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, — আমার সবাই প্রিয় । আমি প্রিয় কয়জনের চাচা?
— প্রিয় না?
— সময় এলে দেখবো।
জাফর ফিরে তাকালো! এরশাদ অবশ্য দাঁড়ালো না। যেতে যেতে বললো, — বুড়ির একটু খবর নেই গিয়ে। যে আগুন চোখে তাকিয়েছে। তোমার মেয়েকে তো ভালোই আমাকেও না জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
— তো মুখে কুলুপ এঁটে বসে গেলি কেন?
— না বসে উপায় কি? এক দিকে প্রিয় দাদি আরেক দিকে প্রিয় চাচার একমাত্র কন্যা। মাঝে আমি চিড়েচ্যাপটা।
জাফর এবার পুরোই হেসে ফেললো! এরশাদ অবশ্য সেই হাসির দিকে ফিরে তাকায়নি। সে নিচের দিকে গেলো।
জয়তুন বসেছে বসার ঘরে। আম্বিয়া অবশ্য এখন তার সাথে নেই। এতোগুলো মানুষের পেট। এমনি এমনি তো চুলায় হাড়ি চড়ে না। তাই সকাল থেকেই রান্নার আয়োজনে লেগে যেতে হয়।
সে পা ছড়িয়ে আরাম করে বসলো। বাড়িটা দেখার মতো হলেও বসার ঘর করেছে সেই তুলনায় ছোট। তবে চারিদেকে এতো সুন্দর কারুকাজ। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। তবে এটা তাদের পৈত্রিক শ্বশুর বাড়ি না। শ্বশুর বাড়ি ছিল গ্রামের অন্য সাইডে। তখন অবশ্য তাদের বাড়ি সারেং বাড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল না। অন্য আর পাঁচ দশটা গ্রামের মানুষের মতোই তারা ছিল সাধারণ। সারেং বাড়ি মুখে মুখে প্রচলিত হলো তার শ্বশুরের মাধ্যমে। তিনি’ই এ গ্রাম তো ভালোই কয়েক গ্রামের মধ্যে প্রথম জাহাজের সারেং হয়ে কাজে গেলো। তখন থেকেই এই বাড়ির মানুষেরা টাকার মুখ দেখলো। তার শ্বাশুড়িও ছিলো শক্ত হাতে মহিলা। স্বামীর কষ্টের টাকা তিনি বৃথা ব্যয় করেন নি। জমির পর জমি কিনেছেন। গাঁও গ্রামে জমি যার যতো, নামও ততো। তাই তাদেরও নাম হতে সময় লাগেনি। তখন থেকেই তার শাশুড়িকে দেখলে বলতো, ” আরে সারেং বউ নাকি। ”
ব্যস সেই সারেং বউ, মুখে মুখে বলতে বলতে গ্রামে এই বাড়ির পরিচিত হলো সারেং বাড়ি হিসেবে। আর একবার পরিচিত হলে সেটা আস্তে আস্তে গ্রামের ধূলোবালি থেকে শুরু করে মানুষের রক্তে মিশে যায়। সারেং বাড়ি’ও কি যায় নি?
বাপে যে রাস্তায় গিয়েছে স্বাভাবিক ভাবে সন্তানেরাও সেই রাস্তায় যায়। তার স্বামী আলতাফ আলি ও সেই রাস্তায়’ই গেছে। ততদিনে এই বাড়ির মানুষদের দিন দুনিয়া ঘুরে গেছে। তার স্বামী অবশ্য বেশিদিন জাহাজের সারেং ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। তাই চলে এসেছিল। অবশ্য ততদিনে সে সারেং বাড়ির বউ হয়ে গিয়েছে।
আর বউ হওয়ার একমাত্র কারণ ছিল, তার চাঁদের মতো চোখ ধাঁধানো রুপ। আলতাফ আলি এক দেখায় গো ধরে বসেছিল, এই মেয়ে বিয়ে না করে বাড়ি ফিরবে না। জয়তুনের বাবা মায়েরও অমত করার কারণ ছিল না। যাদের এলাকা জুড়ে ধানের জমি, আর এমন নাম ডাক। মেয়ের বাপের আর কি চাই? ব্যস সেই দিন’ই লাল টুকটুকে শাড়ি পরে শ্বশুর বাড়িতে পা রাখলো । সেই বাড়িতে অবশ্য বেশিদিন থাকা হয়নি। তার কিছুদিন পরেই এই বাড়িটা কেনা হয়। ঐ যে দোতলায় পশ্চিশ পাশে বড় রুম। সেটা ছিল তার। কতো সুখ দুঃখ কেটে গেছে সেই রুমে। সেই রুমের জানালা, দেয়াল, আসবারপত্র আর জয়তুন ছাড়া জানে কে?
জয়তুন নিচে চলে আসে তার স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের পরে। চাঁদের মতো রুপ দিছে, তার সাথে চাঁদের মতো কলঙ্কও দিছে। বাচ্চা জন্ম না দেওয়ার চেয়ে বড় কলঙ্ক কি মেয়েদের আছে। না নেই! তবে নিজের স্বামীকে সতীন নিয়ে দরজায় খিল দেওয়া দেখা বড় কষ্টের। তাই ঘৃণায়, কষ্টে নিচে চলে এসেছিল। অন্তত নিচে থেকে সেটা দেখতে তো হবে না। দেখতে হয়ও নি। জয়তুন আরা যেখান থেকে একবার চোখ ফিরিয়ে নেয়, সেখানে আর দ্বিতীয় বার ফিরে তাকায় না। কখনোও না।
এরশাদ দাদির পায়ের কাছে এসে বসলো। বসতেই জয়তুন এরশাদের ন্যাড়া মাথা দেখলো। দেখেই হেসে ফেললো! এরশাদ সেই হাসির দিকে তাকিয়ে বললো, — বুড়ি, কাজটা কি করলা? এমনিতেই বউ পাই না। তার মধ্যে আবার বেল মাথা।
— তুই বউ পাছ না?
— কোথায় পাই? পেলে বুঝি ধানের ক্ষেত দিয়ে রাজি করাতে হয়?
— সেই কথা বাদ! তুই রাজি তো হ। মেয়ে নেচে নেচে আসবো।
— নাচলেওয়ালি বউ তো আমি চাই না দাদি।
— তাহলে কেমন বউ চাস তুই?
এরশাদ দাদির কোলে মাথা রাখলো। জয়তুন আদর করে তার ভাঁজ পড়া চামড়ার কোমল হাত এরশাদের মাথায় রাখলো। রাখতেই এরশাদ বললো, — কোন ভয় ডর ছাড়া যেই মেয়ে এরশাদের চোখে চোখ রাখবে, নিজের চোখের এক ইশারায় এরশাদকে মাত করে দেবে। এই রকম বউ চাই আমার।
— এই রকম এক পিস’ই দুনিয়াতে ছিল। সেটা তোমার দাদা কপালে জুটে গেছে।
এরশাদ হাসলো! হেসে বললো, — তাহলে দাদার টা দিয়েই কাজ চালাই। এক পিস’ই যেহেতু কি আর করার।
— সত্যিই তোর এমন ডাকাইতা বউ চাই।
— হ্যাঁ।
— তাহলে আর হইছে কাজ।
— হইলে হইছে। এরশাদ তো আর বিয়ের জন্য মরে যাচ্ছে না।
— তাহলে ঠিক’ই আছে। জয়তুনের সাথে বাটপারি। শুধু কোলের ধন বলে বেঁচে গেলি। তা না হলে খবর ছিল।
এরশাদ আবারো হাসলো! হেসে দাদির হাত মাথা থেকে টেনে নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। তখনি কালাম এগিয়ে এলো। এসে বললো, — কালি ঘাট থেকে এক লোক খবর নিয়ে আইছে।
জয়তুন, এরশাদ দুজনেই কালামের দিকে তাকালো। কালিঘাট তাদের গ্রাম থেকে বেশ অনেকটা দূরে। কখনোও তেমন ভাবে যাওয়া হয়নি। শহরের দিকে গেলে রেল থেকে আসতে যেতে দেখে। এইটুকুই! সেখান থেকে কি খবর আসবে।
কালাম নির্বিকার! অবশ্য সে সব সময়’ই এমন। তাই সব সময়ের মতো নির্বিকার চিত্তে’ই বললো, — রাতের আনধারে শাহবাজ ভাইরে এক মেয়ের সাথে আপত্তিজনক অবস্থায় পাওয়া গেছে। গ্রামের মানুষ হাতে নাতে ধরছে। এমন অবস্থায় ধরলে কি হয় সেটাতো জানেন ‘ই। দু’তিনটা চড় থাপ্পড় দিয়া বিয়া পড়ানো হয়। পড়িয়ে যেখানের মাল সেখানেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখানেও হওয়ার কথা। তবে শাহবাজ ভাই তেড়া হয়ে বসে আছে। এমনকি গ্রামের কয়েকজনকে মেরে নাক মুখ তো ভালোই, মাথা’ই নাকি ফাটিয়ে দু’জনের। পরে বাগে আনতে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে । তাই অভিবাকদের খবর পাঠিয়েছে। তারা যেন যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব গিয়ে এর বিহিত করে।
জয়তুন হেসে ফেললো ! হাসতে হাসতেই বললো, — মাইয়াডা কে, আমাদের আয়নামতি নাকি ?
— জ্বি বুবু।
জ্বি বুবু বলতে দেরি, জয়তুনের কাত চিত হয়ে হাসতে দেরি হলো না!
এরশাদ তাকিয়ে তাকিয়ে দাদির হাসি দেখলো। দেখে বড় একটা শ্বাস ফেললো! এতো পোড়া কপালি মেয়ে সে এই জীবনে দেখেনি। পুরো একদিন ঘুরে ফিরে কুয়োর ব্যাঙ, কুয়োতেই এসেই পড়ছে।
বীণা চোখ তুলে তাকিয়ে পরপর কয়েকটা চোখের পলক ফেললো! তারপর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে অংক করায় মন দেওয়ার চেষ্টা করলো। তার পেট উপচে হাসি আসছে। অবশ্য না এসে উপায় কি? সে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। বরং এমন অবস্থায় হাসি না আসাই অস্বাভাবিক।
ফরহাদ বসলো স্বাভাবিক ভাবে। সব সময়ের মত বিরক্ত চোখে মুখে নিয়ে। সে বসতে বসতেই চোখ মুখ কুঁচকে বীণার দিকে তাকালো। সে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে অংক করার চেষ্টা করছে। এমন ভাবে করছে যেন, দুনিয়া দারি একখান করে ফেলছে।
অথচ সহজ অংক! বিয়ের ঝামেলার আগে সুন্দর মতোই বুঝিয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া এই মেয়ের ব্রেইন ভালো। ভালো বলতে বেশ ভালো। এই পর্যন্ত কোন ক্লাসে দ্বিতীয় হয়নি। বলতে গেলে মিঠাপুকুর হাইস্কুলের কৃতী শিক্ষার্থী সে। তাই তাকে নিয়ে স্কুলের খুব’ই আশা ভরসা। কেননা এবার সে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে।
অবশ্য এই কৃতী অর্জনে কোন অংশেই সে নেই। মিঠাপুকুর হাই স্কুলে সে নিজেও শিক্ষাকতায় আছে। তার বড় ভাই শহরে চাকরি করে। বড় ছেলে গেছে তাই তার বাবা ছোট ছেলেকে যেতে দেবে না। তাই ছোট চাচাকে বলে নিজেই এই চাকরির ব্যবস্থা করেছে। তা না হলে তার মেজাজের সাথে এই চাকরি যায়? মেরে ধমকিয়ে পুরো স্কুল ঠান্ডা। স্কুলের ছেলে মেয়েরা তাকে দেখে যমের মতো কাঁপে। এমনকি যেই সাইড দিয়ে সে যায়, ছেলেমেয়ে দৌড়ে পালায়।
বীণাকে পড়াচ্ছে সে বছর একের মতো। ছোট বেলা থেকে পড়িয়েছে গ্রামের এক মেয়ে। তার বিয়ের পরে পড়িয়েছে কিছুদিন ইমরানের বউ। তার বাচ্চা আসায় বাদ দিয়েছে। গ্রামে ভালো মেয়ে মাস্টার নেই বললেই চলে। কিছুদূর পড়ার পরই বাবা, মা বিয়ে ঘটিয়ে দায় মুক্ত হয়। তাই এক ছেলে মাস্টার রাখা হলো। এক বছর তো গেলো ভালো ভাবেই। তবে একদিন শুনলো মাস্টার নাকি পায়ে পায়ে ঘষাঘষি করে। ব্যস শাহবাজ নাক মুখ ফাটিয়ে বিদেয় করলো।
তারপর এলো তার ঘাড়ে। মাধ্যমিক দেবে! পড়াতো আর বন্ধ করা যায় না। তাই এরশাদ নিজেই বললো! ভালো মাস্টার পেলে তাকে বাদ দেবে। সেই পর্যন্ত যেন সে দেখে। বন্ধুর কথা, ফেলা তো যায় না। সে দেখছে, ভালো ভাবেই দেখছে। তবে সমস্যা হলো এই স্থির ভাবে বসতে পারে না। আরে পড়বি, এতো নড়াচড়া কিসের। দেখা গেলো সে অংক বুঝাচ্ছে, এই মেয়ে মন দিয়েই খেয়াল করছে তবে তার সাথে হাই স্পিডে ওড়না আঙুলে পেঁচিয়ে ঘূর্ণিঝড় তুলে ফেলছে। রচনা পড়ছে তার সাথে পা ও সমান তালে তিড়িংবিড়িং করছে। পড়া বলছে আরে, তার সাথে আঙুলের মাঝে কলম এদিক ওদিক নাচিয়ে আঙুলের বারোটা বাজিয়ে ফেলছে। তার তো দেখেই চান্দি গরম হয়ে যায়। দেয় ঠাটিয়ে কয়টা লাগিয়ে। তবে এই মেয়ের হজম শক্তি ভালো। সব হজম করে পরের দিন ঠিক পড়তে বসে। আরেকটা দিকও এই মেয়ের খুবই ভালো। পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ। অবশ্য বেশিদূর যেতে পারবে না। যে জয়তুন আরা! হঠাৎ করে একদিন মাথার পোকা নাড়া দেবে। সে বিনা বিলম্বে ধাক্কা দিয়ে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দেবে।
সে বিরক্ত মুখেই পানির গ্লাস হাতে নিলো। নিয়ে চোখ, মুখ কুঁচকে পানি খেলো। শয়তানটায় ঘুসি মেরেছে চাপায়। এখন হা করতে কষ্ট হচ্ছে।
এরশাদ আর সে বন্ধু হলেও বয়সে এরশাদের দেড় দু’বছরের ছোট। একই গ্রাম, একই এলাকা। এক সাথেই খেলে বড় হয়েছে। বয়স কোন ছাল। তবে বড় হওয়ার পর কিছুটা ভাটা পড়েছিল। সে পড়তে শহরে চলে গিয়েছিল, তবে এরশাদ যায়নি। মুখের জন্যই যায়নি। বীণার মতো তার ব্রেইনও ছিলো তুখোড়।
তবে লেখাপড়া না করলেও নিজের রাস্তা নিজে খুঁজে নিয়েছে। তার পড়ালেখা শেষ হতেই আবার গ্রামে ফিরলো। তখন আবার সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধুত্ব পুক্ত হলো। পুক্ত হলেও কিছুটা ফাঁক সময় নিজের মতো তৈরি করে ফেলেছে। আর সেই তৈরি করা ফাঁক গলিয়ে এরশাদের কাছে এখন পুরোপুরি কখনো যাওয়া যায় না।
বীণা লিখতে লিখতেই আড়চোখে তাকালো। তাকাতেই আবার হাসি পেয়ে গেলো। চোখ, নাক ঠোঁট, গাল, মুখের বিভিন্ন জায়গা ফুলে আছে। লাল কালো জখম, সেই জখমে আবার সাদা সাদা মলম। তার মধ্যে আবার চোখ, মুখ কুঁচকে পানি খাচ্ছে। এমন অবস্থায় একজন কে দেখলে কার না হাসি আসবে। বরং তার জায়গায় অন্য কেউ হলে, এতোক্ষণে নির্ঘাৎ হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতো।
সে মুখ চেপে হাসি দমিয়ে আবার লেখায় মন দেওয়ার চেষ্টা করলো। এই হাসির কুতকুতে অংক মিলছে না। ধুর! আল্লাহ রক্ষা করো। কেননা, হাসা যাবে না। কিছুতেই না! হাসলেই দেখা যাবে উড়াধুড়া খাতা দিয়ে বাইড়ানো শুরু করে দিছে। এটা তার মুদ্রা দোষ। ঊনিশ, বিশ হলেই বাড়ি। শুধু ঊনিশ,বিশ না। পড়ার বাইরে কিচ্ছু করা যাবে না। কিচ্ছু না মানে, কিচ্ছু না। তার এমন ভাব পড়ার সময় নিশ্বাস নিতে দিচ্ছি এটাই তো সাত জনমের ভাগ্য। তা না হলে এটাও বাদ। জীবনটা একেবারে তেজপাতা করে দিচ্ছে। হুহ্! বলেই সে একটু নড়েচড়ে বসলো। বসতেই ঝুমঝুম শব্দ হলো। হতেই বীণা ঢোক গিললো, — সকালের এতো ঝামেলায় পা থেকে খুলতে’ই ভুলে গেছে। কেননা পড়ার সময় সব নিষেধ, এই ঝুমুর পুনুর তো আরো আগে নিষেধ । প্রথম দিন পরে বসেছিল। দিয়েছে এক বাড়ি। সেই থেকে বীণা পড়তে বসার আগে সব খুলে টুলে একেবারে চুপচাপ বসে।
ফারহাদ অবশ্য আজকে কিছু বললো না। সে চোখ, মুখ কুঁচকে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিলো। বীণা হাঁফ ছাড়লো, সাথে হালকা হাসলো। পড়তে তো বসে না সে। কলিজা হাতে নিয়ে বসে। যে কোন সময় চিপড়ে ধরে।
ফরহাদ এতোক্ষণ খেয়াল না করলেও এখন করলো। তাই ভ্রু কুঁচকে বললো— হাসছিস কেন?
বীণার মুখ সাথে সাথেই শক্ত হয়ে গেলো! তোতলে বললো — কই নাতো!
— ঢং করিস।
বীণা সাথে সাথেই দু সাইডে মাথা নড়লো। ফরহাদের কুঁচানো ভ্রু এবার বাঁকা হলো। বীণা দেখে হড়বড় করে বললো, — ঢং করবো কেন ! আপনি কি ঢংয়ের মানুষ। আপনি হচ্ছেন শ্রদ্ধেয় স্যার, ফারহাদ স্যার। আপনার সাথে কি ঢং চলে। আর আমার মুখটাই এমন একটু বুঝলেন! বাঁকা, দেখলেই মনে হয় হাসছি।
— আমাকে হাসি শেখাছ। আর তোর মুখ এমন! তোকে তো আমি আজ নতুন দেখছি তাইনা?
বীণার কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো। ফাহাদ কিছুক্ষণ বীণার দিকে তাকিয়ে বললো— তোর ভাগ্য ভালো আজ আমার শরীরটা ভালো না। তা না হলে আজকে তোর খবর ছিল। একতো ঢং আবার মিথ্যা কথা। মুখ’ই নাকি এমন, বাবাগো! ভাবা যায়।
বীণা আর টু শব্দও করলো না, চুপচুাপ লেখায় মন দিলো। তখনি আবার ফরহাদ বললো, –
— বীণা।
বীণা ফারহাদের দিকে না তাকিয়েই বলো– হুম।
— বাড়ির খবর কি ?
বীণা অবাক হলো। অবশ্য বুঝতে দিলো না। পড়ার বাইরে ফরহাদ ভাই কথা বলছে। অবাক হওয়ার মতোই ঘটনা। সে লিখতে লিখতে বললো — বিয়ের খবর তো জানেন’ই । নতুনের মধ্যে আমাদের স্কুলের জন্য বাবা নতুন শিক্ষিকা এনেছেন। সাবিহা ভাবির বান্ধবি। ইশ কি সুন্দর দেখতে। নামটাও কি সুন্দর পৃথিলা।
— কিসের সুন্দর?
— তিনি দেখতে অন্য রকম। সকালে দেখলাম বান্দায় বসে আছে। আপনি বিশ্বাস করবেন না। আমার মনে হয়েছে, মাটির তৈরি নিখুঁত একটা মূর্তি।
— নিখুঁত মূর্তি তুই জীবনে দেখেছিস?
বীণা উত্তর দিলো না, তবে সে দেখেছে। তাদের পাশের গ্রামে ভাঙা পুরোনো এক মন্দির আছে। সেখানে। সেখানে সবার যাওয়া নিষেধ! সবাই বলে খুব’ই খারাপ জায়গা। তবে তার বান্ধবীরা মিলে একদিন গিয়েছিল। টিফিনে স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে। ভালো ছাত্রী বলতেই স্যারেরা দিয়ে দিছে।
— শহরের মেয়ে! তার মধ্যে একটু চামড়া ধলা।
তাই তোর কাছে মনে হচ্ছে অন্য রকম। এর বেশি কিছু না।
— আমার কাছে তো এই’ই অনেক।
— কিসের অনেক? সাদা চামড়া ছাড়া তোরা সৌন্দর্যের আর মানে বুঝিস কি?
— তা ঠিক।
— কিসের ঠিক ? সাদা তো মূলাও হয়। কয়জনের পছন্দ?
— আকাশ সাদা বলেই সবার ভালো লাগে। যদি কালো হতো কয়জনের হতো বলেন তো?
— বা’বাহ! সাদা নিয়ে তোর মনে এতো কষ্ট তা তো জানতাম’ই না।
— আপনার জানার কথাও না ফরহাদ ভাই। তাছাড়া আপনার গায়ের রং সুন্দর। তাই হয়তো আপনার কাছে কিছু না। তবে আমার মতো শ্যামলা মেয়েদের কাছে তো অনেক কিছুই । অবশ্য বলতে গেলে সাদা বলতে যা বুঝাচ্ছেন তিনি কিন্তু সেই রকম না। অন্য রকম! তার গায়ের রংয়ের চেয়ে অন্য কিছু একটা নজর কারে।
ফারহাদ চোখ বন্ধ করলো! করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বললো, — আমি তো ভেবেছি শুধু তোর হাত, পায়’ই চলে। এখন তো দেখি মুখও ভালো চলে।
বীণা মুখ বাঁকালো! ফরহাদের চোখ বন্ধ তাই সে খেয়াল করেনি। মুখ বাঁকিয়ে বললো, — আপনি জিজ্ঞেস করলেন বলেই তো বললাম।
— ভালো!
ফরহাদ আর কিছু বললো না। তবে বীণা চোখ তুলে ফারহাদের দিকে তাঁকালো। সে চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। ফর্সা মানুষ তাই জখম গুলো বেশি স্পষ্ট। ফরহাদ ভাই শুধু বড় ভাইয়ের বন্ধু না। সে ছোট দাদির তরফ থেকে আত্মীয়ও। ছোট দাদির আপন ভাতিজার ছেলে সে। তবে সেই সম্পর্ক কে, কেন জানি কেউ মনেই করতে চায় না।
সে কোমল সুরে ডাকলো — ফরহাদ ভাই!
— হুম!
— আজকে বাসায় চলে যান। আপনার শরীরটা মনে হয় ভালো না।
ফরহাদ সাথে সাথে’ই চোখ খুলে মাথা উঁচু করলো। করে চোখ, মুখ আগের মতো কুঁচকে বললো—- আমাকে তোর ফাঁকিবাজি টিচার মনে হয়। আর আমার শরীর নিয়ে তোর এতো মাথা ব্যথা কেন? নাকি ভেবেছিস গদগদ হয়ে বলবি আর আমি ছুটি দিয়ে দেবো। ফাঁকিবাজের ফাঁকিবাজ!
বীণার রাগ হলো। এজন্যই বলে কারো ভালো করতে নেই, ভালোর জন্য কিছু বলতে নেই। কোন দুঃখে যে বলতে গিয়েছিল। সে রাগ নিয়েই বললো,– আমি কখনো ফাঁকি দেইনা ফরহাদ ভাই। আপনি ভালো করেই জানেন।
— কি ভালো করে জানি? স্কুলে একটু সুনাম কি হয়েছে মাটিতে তো পা ফেলিস না। তবে শুন, এসব স্কুলের মেধা টেধা না কোন কাজে আসে না। আসল দুনিয়া শুরু হয় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে। অবশ্য কলেজের চেহেরা দেখবি বলে মনে হয় না। জয়তুন আরার নাতনী আপনি। যে কোন সময় ফুরুৎ।
বীণা আগুন চোখে তাকালো। ফরহাদ খাতা নিয়ে ঠাস ঠাস করে দুটো বাড়ি মাথায় মারলো। মারতে মারতে বললো, — সাহস কতো! আমাকে চোখ রাঙায়। তোর মতো চোখ রাঙানির মেয়ের জন্য না, পা দিয়ে গুঁতাগুঁতি করে এমন শিক্ষক’ই ভালো। কি যেন নাম ছিলো ঐ ছেলের। ওর সাথেই এই ভাবে গদগদ করে কথা বলতি তাই না। তা না হলে, কে অকারণে পা দিয়ে গুঁতাঁগুতি করে।
বীণা আগের মতোই তেজ নিয়ে বললো, — ফাহাদ ভাই! পড়াচ্ছেন বলে যা খুশি তাই বলবেন না, বলে দিলাম।
— বললে তুই কি করবি? হ্যাঁ, কি করবি? বলেই আরো দুটো ঠাস ঠাস করে দিলো।
বীণা কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে কেঁদে ফেললো। সে বেশিক্ষণ রাগ ধরে রাখতে পারে না। কান্না চলে আসে। সে কান্না দমানেরও চেষ্টা করলো। কেননা পড়ার সময় কান্নাও নিষেধ। কাঁদলে আরো কয়েকটা পড়বে এতে কোন সন্দেহ নেই।
ফরহাদ বিরক্তি নিয়ে বললো— এই কাঁদা ছাড়া আর কি পারিস বলতো। কি? ভালো একটা কোন গুণ যদি তোর মধ্যে থাকে।
বীণা উত্তর দিলো না। ওড়না দিয়ে নাকের পানি চোখের পানি মুছলো। ফরহাদ হাসলো!
বীণা চোখ, মুখ কুঁচকে তাকালো! তার তাকানো দেখে ফরহাদ নির্বিকার ভাবে বললো, – আমার মুখটাই এমন একটু বুঝলি! বাঁকা! দেখলেই মনে হয় হাসছি।
বীণা ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো! তখনি এরশাদ এলো। এরশাদকে দেখে ফরহাদ আবার হো হো করে হেসে উঠলো। আর এই হাসি দেখে বীণার ইচ্ছে করলো এক ধাক্কায় এই চেয়ার থেকে শয়তানটাকে উলটে ফেলে দিতে।
চলবে……