ধূপছায়া পর্ব-১৩+১৪

0
3

#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_ ১৩

সারেং বাড়ির অবস্থা থমথমে। এতো বড় বাড়ি, এতো মানুষজন তবুও পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। এই নিস্তব্ধতাকে ঘিরে শুধু আম্বিয়ার পানের পাতায় পান ছেঁচার শব্দ বিরাজ করছে। এই বিরাজের মাঝে বীণা চোখ মুখ কালো করে চুপচাপ দাদির পাশে বসে আছে। চুপচাপ বসলেও ফরহাদের ভাষায় ওড়না আঙুলের ঘূর্ণিঝড় ঠিক চলছে। মেয়েটা আসলেই একদম চুপচাপ বসতে পারে না। সেই ঘূর্ণিঝড়ের সাথে আছে মনের অস্থিরতা। ছোট ভাই বিয়ে করেছে আয়না বুবুকে, সে আছে ইমরান ভাইয়ের ঘরে। তার ধ্যান, জ্ঞান এখন সব ওখানে। যাওয়ার জন্য মন আঁকুপাঁকুও করছে।

তখনি এরশাদ ভেতরে এলো। এতো কিছুর মাঝে সে একদম স্বাভাবিক। এতোক্ষণ কোথায় ছিল কে জানে? ছোট ভাইয়ের বিয়ে নিয়ে তাকে তেমন বিচলিত মনে হলো না। তাই তখন প্রিয় চাচাকে চলে যেতে দেখে সব সময়ের মতো হাসলো! সরলতার হাসি। হেসে বললো, — মাথার উপরে বাপ না থাক, চাচা তো আছে। একটু শক্তও তো হতে পারো। বুড়ি বলেছে, দৌড়ে বেরিয়ে যাচ্ছো। বাহানা খুঁজো শুধু না, সারেং বাড়ি থেকে পালানোর?

জাফরও তার মতো শান্ত ভাবে বললো, — তোর প্রিয় দাদি, কিছু বললে তো আবার গায়ে ফোসকা পড়ে। তাই দূরেই থাকি। যান আপনারা, দাদি নাতিরা মিলে গলাগলি ধরে সারেং বাড়িতে বসে থাকেন। আমাকে কি দরকার?

— তোমাকে না থাক, সম্পতির আছে। যাবে যখন পাকাপোক্ত ভাবে লিখে দিয়ে যাও। বলতে বলতেই পৃথিলার দিকে একবার তাকালো! সে আয়নার কাছে এগিয়ে গেছে। চোখ, মুখ থমথমে। সেই থমথমে মুখটাও এরশাদের কাছে যেন অন্যরকম লাগলো।

তাই সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে আগের মতোই বললো, — পরে দেখা যাবে কোথাকার কোন বাড়ির ছেলে এসে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে । তাই ঝামেলা আজ’ই দফারফা হোক।

জাফর এরশাদের কথা বুঝলো! বুঝলো বলেই হালকা হাসলো। এরশাদ সেই হাসির দিকে তাকিয়ে বললো, — সারেং বাড়ির গেট যেন মাড়াতে না দেখি । নানির বাড়ি পরে বেড়ালেও চলবে ।

— আমি আয়নাকে ছাড়া ভেতরে যাবো না। সে আমার দায়িত্ব।

— যাওয়ার দরকার নেই। এতো সুন্দর পূর্ণিমা রাত। বারান্দায় বসে বসে চাঁদ দেখো। বলেই ফরহাদের দিকে তাকালো।

আর ফরহাদ, সে তো ফরহাদ ‘ই। মেজাজ উঠে আছে তুঙ্গে। চোখ, মুখ কুঁচানো। এরশাদ তাকাতেই গাড়ি থেকে নেমে যেতে যেতে বললো, — আর একটা কিছু যদি আমাকে বলেছিন। ঘুসি মেরে তোর থুবড়ানো চেহেরা আরো থুবড়ে দেবো। শালার, ঘরের শালা। দুই ভাই মিলে জীবনটা তেজপাতা করে দিচ্ছে।

— বয়স মানিস না, সম্পর্ক মানিস না। মাস্টারি করিস সেটার তো একটু লেহাজ কর। তোর কাছ থেকে ছেলে মেয়েরা শিখবে কি?

— তোর বেল মাথা, বলেই ফরহাদ অন্ধকারে মিশে গেলো। এরশাদ আবারো হাসলো! হেসে পৃথিলার দিকে আবার তাকালো! তাকিয়ে তার স্বভাব মতো শান্ত মার্জিত ভাবে বলেছে, — সাবিহা কে নিয়ে একটু কষ্ট করে আয়নাকে ওখানে নিয়ে যান। বাকিটুকু আমি দেখছি।

পৃথিলার থমথমে চোখ মুখ ততক্ষণে শক্ত, শান্ত । অতিরিক্ত কষ্ট বা অতিরিক্ত আবেগের কোন কিছু দেখে সব মেয়েদের মতো তার চোখে পানি আসে না, চিৎকার চেঁচামেচিও করতে পারে না। ব্যস, বরফের মতো শক্ত, শান্ত হয়ে যায়। আর এই যে চোখের সামনে ফুলের মতো মেয়েটা, বয়স কতো হবে সে জানে না, হয়তো তার ছোট বোনের মতোই। যার ফর্সা গালে পাঁচ আঙুলের দাগে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। আর এই জমাট বাঁধা রক্ত যেন তার ভেতর ছুঁয়ে গেলো।

তবুও পৃথিলা এরশাদের কথার বিপরীতে একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না। সে ভালো করেই জানে, এই সময় ঠিক না। কেননা, এই সময়’ই ঠিক করবে এই মেয়েটার ভবিষ্যৎ। অথচ একটি বারও এই মেয়েটাকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করা হবে না। অথচ ভালো হোক মন্দ সব ভুগতে হবে মেয়েটাকেই।

এই হলো জীবন! এই জীবনে নিজে থেকে কিছুই করতে নেই। মন মতো করতে যাবে, ভাগ্য তার নিজের মতো নিজ দায়িত্বে গালে পাঁচ আঙুল বসিয়ে দেবে। আর না হলে এই যে অসম্ভব সুন্দর নিষ্পাপ মেয়েটার, এর মতো সমাজের মানুষগুলো দেবে, ভালো ভাবেই দেবে। আর সর্বশেষে সব দোষ, কলঙ্ক তাদের’ই। সেটা নিজের ইচ্ছায় হোক অন্যের।

মনের উষ্ম মনে রেখেই পৃথিলা শান্ত চোখে এরশাদের দিকে একবার তাকালো। শুধু একবার! তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে আয়নার গায়ে হাত রাখলো।

আর এই শান্ত চোখের এক পলক। এই এক পলকে এরশাদ মাত হলো। কেননা এই এক পলকেই দেখলো, ঐ শান্ত চোখে জ্বলন্ত আগুন, দেখল তাদের প্রতি ঘৃণা। দেখলো পরিচয় না জানা বাবার জন্য ঘৃণা, ভালোবেসে আগলে রেখে, সেই ভালোবাসা দিয়েই গলা চেপে ধরা মায়ের জন্য ঘৃণা, বিশ্বাস হত্যা করা এক ভালোবাসার মানুষের জন্য ঘৃণা। আর এই যে মান – সম্মান, পাপের দোহাই দিয়ে একের পর এক অন্যায় করে যাওয়া, এই সমাজের উপর ঘৃণা।

আর দেখলো বলেই এরশাদ এবার চোখ ফিরিয়ে নিলো না। তার জ্বলজ্বল করা চোখে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল। মন বললো, — ” আর একবার তাকাক, একবার।” তবে মনের এই ডাক ঐ যে ক্ষত বিক্ষত হওয়া হৃদয়। সেই হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছায় না। পৌঁছায় না বলেই দুটো চোখ আর এই পূর্ণিমা সন্ধ্যায় এক হয় না।

জয়তুন সব সময়ের মতো আঙুলের ডগায় পান নিয়ে মুখে পুরলো। বীণা ভেবেছিল এরশাদ ভাই ভেতরে এসে দাদির পাশে বসবে, তাকে বোঝাবে। তবে সেই রকম কিছু’ই দেখা গেলো না। সে তার ন্যাড়া মাথা ঘষতে ঘষতে উপরে নিজের রুমের দিকে গেলো।

যেতেই বীনা আশা নিয়ে দরজার দিকে তাকালো। ছোট ভাইয়ের খবর নেই। সেটা সমস্যা না । তার এমনিতেও খোঁজ খবর থাকে না। তবে ছোট চাচা আসছে না কেন? কোথায় গেলো? সত্যিই চলে যাই নি তো? তার গলা শুকিয়ে এলো। শুকনো মুখেই বললো, — আম্বিয়াবু ছোট চাচা ভেতরে আসছে না কেন?

আম্বিয়া পা ছড়িয়ে বসলো! জ্বালা যন্ত্রনা আর ভালো লাগে না। ভালো না লাগলেও মেজাজ অবশ্য ফুরফুরে। সেই ফুরফুরে মেজাজে’ই বললো, — বাড়ির বউ ঘরে না ঢোকা পর্যন্ত সে ঢুকবে না। বারান্দায় ঘাঁটি গেড়েছে। যার বউ তার খবর নাই, পাড়া পড়শির ঘুম নাই।

বীণা অসহায় চোখে দাদির দিকে তাকালো! জয়তুনের হাবভাবও এরশাদের মতো। স্বাভাবিক!

বীণা ঝট করে উঠে বাইরের দিকে গেলো। তার চোখে পানি চলে এসেছে। বাবা- মাকে চোখের দেখা, আদর তো দূর, দুনিয়ায় আগমনের কিছুদিনের মাথায়’ই সব হারিয়েছে। মা বলতে বুঝে দাদি, বাবা বলতে বুঝে এই ছোট চাচাকে। আর এদের মাঝের ঝামেলায় তার বুক পুড়ে ছারখার।

জাফর কাঠের ইজিচেয়ারে আধশোয়া। সারেং বাড়ির বাহিরের খোলা লম্বা টানা বারান্দার এক সাইডে। আকাশে থালার মতো মস্ত বড় একটা চাঁদ। সেই চাঁদের আলোয় সারেং বাড়ির উঠান ঝিলমিল করছে। তার দৃষ্টি অবশ্য সেই ঝিলমিল করা উঠানে না। তার দৃষ্টি ও যে বাড়ির দক্ষিন কোণে হাফ বিল্ডিং সেখানে। গাছ গাছালির জন্য অবশ্য কিছুই দেখা যায় না। তবুও, দেখতে ভালো লাগে। যেখানে তার হৃদয়ের এক টুকরো গত দুদিন ধরে আছে। ইমরান কে বলে কিছু কিছু জিনিস ঠিক করতে হবে। শহরে বেড়ে উঠা মেয়ে। বাথরুম, গোসলখানা তো সব দূরে। রাত, বিরাতে নিশ্চয়’ই কষ্ট হয়।

তখনি বীণা এসে মোড়া পেতে বসলো। পাশ ঘেঁষে! সে ঠিক করেছে ছোট চাচা যতক্ষণ বাহিরে, সেও ততক্ষণ থাকবে।

জাফর হাসলো! হেসে বীণার দিকে তাকিয়ে বললো, — কেঁদেছিলি নাকি?

— উঁহুম!

— তাহলে নাক টানছিন কেন?

— ঠান্ডা লাগবে।

— মেয়েদের এতো অল্পকে কাঁদতে হয় না।

— অল্পতে মেয়েরাই কাঁদে। ছেলে মানুষ কাঁদে নাকি?

— সব মেয়েরা অল্পতে কাঁদে না।

— বলছে তোমাকে।

জাফর আবারো হাসলো! হেসে বললো — তোদের স্কুলের নতুন মেডাম, ঐ যে যার নাম পৃথিলা! লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে তার মতো হবি।

— কেন?

— কিছুদিন যাক, তাহলেই বুঝতে পারবি।

— তুমি তাকে কতোদিন ধরে চেনো?

জাফর উত্তর দিলো না। সে তাকালো আকাশের থালার মতে চাঁদের দিকে। তখনি সারেং বাড়ির দরজা খোলার শব্দ হলো। জাফর ভ্রু কুঁচকেই তাকালো। তাকালো বীণাও! তাদের তাকানোর মাঝেই সাদা আলখেল্লা পরনে থলথলে শরীর নিয়ে আলাউদ্দিন ফকির এসে দাঁড়ালো। তার হাতে মোটা একটা লাঠি। এই লাঠি তার হাতে সব সময়’ই থাকে। লম্বা চুলগুলো ঘাড় ছুঁয়েছে। জাফর মনে মনে হাসলো। জয়তুন চলে ডালে ডালে তার নাতিরা চলে পাতায় পাতায়। বলেই চোখ বন্ধ করলো। করতে করতে বললো, — ভেতরে যা, মশা ধরবে তো।

বীণা ইজিচেয়ারের হাতলে মাথা রাখলো! রেখে বললো, — তোমার সাথে যাবো।

জাফর চোখ বন্ধ করে আগের মতোই হাসলো। হেসে মমতা মাখা স্নেহের একটা হাত বীণার মাথায় রাখলো। রাখতেই চোখের কোণ ঘেঁষে এক ফোঁটা পানি নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়লো। এই গড়িয়ে পড়া বাবা নামক এক সত্তার। যেই সত্তা ভালো করেই জানে, তার ঔরসজাত সন্তানের মাথায় এই হাত কখনোও রাখা হবে না। আহা ! এই চেয়ে বড় শাস্তি দুনিয়ার কোথাও কি আর আছে?

আলাউদ্দিন ফকির সারেং বাড়িতে এলো অনেক দিন পরে। তিন চার গ্রামে তার খুব নাম ডাক। তাই এখানে ওখানে থাকতে হয় দৌড়ের উপরে । বয়স হয়েছে তার মধ্যে ধরেছে বাতে। এই বাত নিয়ে এতো দৌড়ঝাঁপ শরীরে আর হজম হয় না।

তবুও যেতে হয়, মানুষ এসে হাতে পায়ে ধরে। নিষেধও করতে পারে না। এই যে গত এক সপ্তাহ সে গায়েই ছিল না। এক ছেলেকে সাপে কেটছে, তাই গেলো। সেখান থেকে গেলো আরেক গ্রামে। এমন তার দিন, সপ্তাহ ঘুরতেই থাকে।

সে তার বাড়িতে ফিরেছে কাল রাতে। রাতে ফিরে’ই সব খবর তার কানে এলো। অবাক অবশ্য খুব একটা হয় নি। এটা ভাগ্যের লিখন ছিল। সে সাধারণ মানুষ হয়ে ভাগ্য বাদলাতে চেয়েছিল। তাই তো অতি তাড়াতাড়ি আয়না আর এরশাদের তিথি এক করতে চেয়েছিল। যদি এক হতো সব কিছু ঠিক হতো, সুন্দর হতো। সারেং বাড়ি উপর থেকে বালা মুসিবতের কালো ছায়া ঠিক কেটে যেতো।

তবে ভাগ্য লিখে স্বয়ং আল্লাহ। তার লেখা খন্ডানোর ক্ষমতা কি আর তার আছে? সে দীর্ঘশ্বাস ফেলেই বসার ঘরে পা রাখলো। রেখে সব সময়ের অমায়িক হাসি হেসে তার মিষ্টি সুরে বললো, — আমার সখীর মেজাজ কেমন, আসবো না চলে যাবো?

জয়তুন নির্বিকার, নির্বিকার ভাবে বললো, — সখীর কাছে আইলো আহো, জিজ্ঞেস করার তো কিছু নাই। তবে অন্য কোন কারণে আইলে আগেই ভাগো।

আলাউদ্দিন হাসলো! হেসে এগিয়ে জয়তুনের সামনের চেয়ারে বসলো। বসতেই জয়তুন হাঁক ছেড়ে বললো,– এই কে আছিস? আলাউদ্দিনের জন্য কাগজি লেবুর শরবত আন।

— শরবত! কথা তো মিষ্টি মুখের। বাড়িতে প্রথম নাত বউ আইলো।

— কোথায় আইলো?

— বাড়ির চৌকাঠ পেরুলেই বাড়িতে আসা হয় না রে সখী। আসা যাওয়া হয় সম্পর্কে। এই মেয়ে পৃথিবীর যেই প্রান্তেই এখন যাক। সে সারেং বাড়ির ছোট নাত বউ।

জয়তুন ভ্রু কুঁচকে তাকালো! তারপর থু করে পানের পিক ঘরের ভেতরেই ফেললো। আলাউদ্দিন হাসলো! হেসে আম্বিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, — আম্বিয়া, আমি লেবুর শরবত খাইবো না। যাও আখের গুড়ের তৈরি করতে বলো।

আম্বিয়া আঁচল ঝাড়তে ঝাড়তে বিরক্ত মুখে উঠে দাঁড়ালো। যেতে বলেছে এর জন্য বিরক্ত না। বিরক্ত এই দুই বুইড়া, বুইড়ি কি গুটুরগু করে কে জানে। তখন কাউকেই রাখে না। সে অবশ্য চাইলেই কান পাততে পারে। তবে ফকির মানুষ! একবার বুঝে গিয়ে কি না কি করে ফেলে। তাই খুব করে নিজেকে দমায়। অবশ্য দমানের আরেক কারণ আছে। যাই করুক তাকে ছাড়া তো জয়তুনের উপায় নাই। তাই আগে পরে সব জানবেই।

আম্বিয়া যেতেই আলাউদ্দিন বললো, — এই মেয়ে কিন্তু সত্যিই সোনা কপালি। তাই তার সোনা কপালের রংয়ে এরশাদের দোষ কাটাতে চেয়েছিলাম। তবে ভাগ্য তো ভাগ্যই।

— আমার এরশাদের আবার কোন দোষ?
— তার দোষ হবে সে নিজে।

— তোর ফকিরগিরি গ্রামের মানুষের জন্য রাখ। আমি ওসব মানি টানি না। এই মেয়ে সারেং বাড়ির বউ হইবো, বউ হইবো। হইলো বউ। তোর কালমুখে বের হইছে বলেই, মুখপুড়ি নিজের মুখও পুড়ছে সাথে আমার শাহবাজেরও পুড়ছে।

— সেটা তোর আর তোর নাতির জেদের জন্য পুড়ছে।

— হ এখন সব দোষ আমার। কে জানি এই কালমুখির খবর আনছিলো।

— আমি’ই এনেছি। তবে কি বলেছিলাম? সেই রাত এরশাদের জন্য কাল রাত। সেই রাতেই তার মুসিবতের ছায়া তার উপরে পড়বে। তাই রাতের আগে বিয়ে সম্পূর্ণ হওয়া চাই। সূর্য ডোববার আগে চাই। তাই বললাম দুজন গিয়ে আগে বিয়েটা পড়াও। তা না বর যাত্রী, হামবাম ছাড়া সারেং বাড়ির নাতির বিয়ে হবে নাকি? এখন যেতে যেতে মেয়েই ফুরুৎ। তা হয়েছে, হয়েছে। সূর্য ডুবে গেছে কাহিনী খতম। তা না আরেক নাতিরে দিছে আঠার মতো লাগিয়ে। তখন এক মুসিবত ছিল, এখন শনি তার সব গুষ্টি নিয়ে সারেং বাড়ির মাথার উপরে ঝুলছে।

— ঝুলুক জয়তুন কারোরে গোনায় ধরে না।

— না ধরলে নাত বউ পরের বাড়ি কি করে?

— ও কোন দিনও সারেং বাড়ির বউ হবে না, হবে বান্দি।

— সারেং বাড়ির বউরা কখনোও বান্দি হয় না। হয় স্বামীর সোহাগী, কপাল হয় রাজকপাল।

— হ এতোই সোহাগী, চোখের সামনে সতীন নিয়া ঘর করতে হয়।

— সংসার, সমাজ, সম্মান, দুনিয়া এগুলোর পাল্লায় ভালোবাসা মাপতে হয় না রে সখী। দুনিয়ায় বাঁচতে হলে কতকিছু করতে হয়। ভালোবাসা হলো দুনিয়ার যাঁতাকলে হাজার বার পিষেও মনের কোণে একজনের নামেই দীপ জ্বালানো। যেমন জ্বেলেছে আলতাফ! কেননা ভাগ্য তাকে জোছনার সাথে বাঁধছে তবে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দীপ জ্বলছে জয়তুনের নামে। ভাগ্য জাফরকে মরিয়মের সাথে বাঁধছে তবে তার মনে দীপ কার নামে জ্বলে সেটা তুমিও যেমন জানো তেমন আমিও জানি সখী। ভালোবাসা সব কিছুর উর্ধ্বে।

জয়তুন কিছু বললো না। আম্বিয়া পানের পাতা রেখে গেছে, সেখান থেকে আঙুলের ডগা দিয়ে আবার পান মুখে পুরলো।

আলাউদ্দিন তার মতোই বললো, — বাড়ির বউ বাড়িতে নিয়ে আসো সখী। ঘরের জিনিস বেশিক্ষণ বাইরে রাখতে নেই। শকুনের নজর পড়ে।

— আর এরশাদ?

আলাউদ্দিন তার অমায়িক হাসি হাসলো! তবে কিছু বললো না। জয়তুন নিজের মতোই বললো, — বড় ভাই থাকতে ছোট ভাইয়ের বিয়া ছ্যাহ্! তাও আবার একই মাইয়া। এরশাদের কিছু না আসুক, আমার বুক জ্বলে। জ্বলে কেন তুই জানোস না আলাউদ্দিন? আমার মুখের আগুন এই ছেলে নিছে। নিয়ে নিজের মুখের সাথে নিজের কপাল পুড়ছে। সেই পুড়া আমি জোড়া লাগাইতে চাই। ভাগ্য দেয় না কেন?

আলাউদ্দিন এবারো কিছু বললো না। জয়তুন আগের মতোই বললো, — এখন আর কোন বাছাবাছি নাই। আমি আমার এরশাদরে বিয়া দিমু। নিজের হাতে দিমু।

আলাউদ্দিন বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে বললো, — এরশাদের বিয়ে তখনি হবে, যখন এরশাদ চাইবে। চেষ্টা করে দেখতে পারো। তবে একটা কথা মনে রাইখো সখী। এখন যা’ই করবা হিতে বিপরীত হইবো। সেই বিপরীত সারেং বাড়ি ধ্বংশের দিকেই যাইবো।

জয়তুনও তার তেজ নিয়ে বললো, — তোর ফকিরগিরি তোর কাছে রাখ। আমার নাতি সে।

আলাউদ্দিন আবারো হাসলো! তার অমায়িক হাসি। হেসে তার মিষ্টি সুরে বললো, — এজ্যনই তো ভয় সখী। সে তোমার নাতি।

চলবে…..

#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_ ১৪

আবদুল আজিল বাড়িতে পা রাখতেই ফাতিমা চিন্তিত মুখে এগিয়ে এলো। তার গায়ে মোটা পাড়ের লাল কাপড়। সাধারণ বাঙালি বধুর মতো গোঁজা দিয়ে গায়ে, মাথায় লম্বা টানা ঘোমটা। গোলগাল মুখের রুপবতী মহিলা। ফরহাদ বাপ, চাচাদের গড়ন পেলেও গায়ের রং পেয়েছে মায়ের। শুধু’ই রং, কেননা ফাতিমা তার নামের মতোই শান্ত, নরম, কোমল মনের মহিলা। কারো দুঃখ দেখা তো ভালোই শোনার সাথে সাথে চোখে নাকে পানি গড়িয়ে পড়ে।

কাজের লোক থেকে শুরু করে গ্রামের অনেকে তাকে ডাকে আম্মা বলে। তার উঠান থেকে আজ পর্যন্ত কেউ খালি হাত, খালি মুখে উঠে যায়নি। দু’হাত ভরে দান খয়রাত করে।

মিলাদ মাহফিল শুনেন, যে যেমন তার জীবন সঙ্গীও হয় তেমন। তার বেলায় এমন উল্টো হলো কেন কে জানে ? উপরওয়ালার খেল বোঝা তো বড়ই মুশকিল।

তিনি বসার ঘরে বসতেই ফাতিমা ফ্যান ছাড়লো, স্বামী পা থেকে জুতা খুললো। কাজের লোক হাজার থাক স্বামীর সব কাজ তিনি নিজের হাতে’ই করেন।

আজিজ আরাম করে বসলো! বসতে বসতে বললো, — মুখ অমাবস্যার রাত কেন?

— তো কি হবে? দুনিয়া দারি দেখে দিন রাত কাবার, নিজের ছেলের দিকে তো তাকাতেও দেখি না। কাল এসেছে নাক, মুখ ফাটিয়ে। আজ জ্বরে বেহুঁশ।

— সামান্য জ্বরে আমার ছেলে কাবু হয় না।

ফাতিমা বিরক্ত হলো! বিরক্ত মুখে বললো, — কাবু না হোক। বয়স হচ্ছে না? এক ছেলে তো থেকেও নেই। এই ছেলের বউয়েরও সেবা বুঝি এই জন্মে আমার কপালে নেই।

আজিজ হাসলো! হেসে বললো, — হবে হবে, সব হবে। এতো অস্থির হলে হয়?

— ছাই হবে? বলেই মাথার আঁচল মুখ বরাবর টেনে ভেতরের দিকে গেলো। রাতের খাবার গরম করতে হবে। বাপ, পুতের আবার গলা দিয়ে ঠান্ডা খাবার নামে না।

ফাতিমা যেতেই আজিজ উঠল। ভেতরে গিয়ে ছেলের রুমে উঁকি দিলো। গলা পর্যন্ত কাঁথা টেনে শুয়ে আছে। ফর্সা মুখে ঠোঁট দু’টো রক্ত জবার মতো টকটকে লাল।

সে এগিয়ে গিয়ে মাথায় হাত রাখলো! এখন হয়ত জ্বর কিছুটা কম। মাথা ঘামে ভেজা ভেজা লাগছে। হাত বাড়িয়ে ফ্যান ছাড়তেই ফরহাদ চোখ বন্ধ রেখেই বললো, — তুমি আয়নামতিকে কি বলেছো বাবা?

আজিজ চমকালো না, ভালো করেই জানে তার ছেলে বোকা না। এই প্রশ্নের সম্মুখীন তার হতে হবে আগে থেকেই জানতো। আজিজ এগিয়ে খাটের পাশে রাখা চেয়ারে বসলো। বসে হালকা হেসে বললো, — কি বলবো? অবুঝ মেয়ে, বুঝিয়ে বললাম।

— সেই বোঝানোটা আসলে কি?

— তুই তো সেই বাড়িতে প্রতিদিন’ই যাস। নিজেই জিজ্ঞেস করিস।

— আয়নামতি মিথ্যা বললো কেন?

— সেটা তো আমার জানার কথা না। সব তো তোরাই করেছিস।

— সব করলেও শেষের চালটা আয়নামতি দিয়েছে। তবে সে দিয়েছে না তাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে সেটা বুঝতে পারছি না।

— আমি কোন কিছুতেই নেই। বশির এসে ডেকে না নিয়ে গেলে হয়ত জানতামও না কাহিনী কি?

ফরহাদ চোখ খুলে বাবার দিকে তাকালো। তাকিয়ে বললো, — তুমি কি আমার কাছ থেকে কিছু আড়াল করছো ?

— অনেক কিছু’ই তো করি। মহাজন আমি! এমনি এমনি তো আর হয় নাই। বাপের বোঝা তো তোমরা নেবে না। তাই বলে লাভ কি?

ফরহাদ আর কিছু বললো না। এসব মহাজন টহাজনে সে মহা বিরক্ত। যত্তোসব, ফালতু কারবার। কাঁথা টেনে মুখ ঢেকে বললো, — যাওয়ার সময় দরজা টেনে দিয়ে যাবে। আর খবরদার সকাল হওয়ার আগে কেউ যেন আমার রুমে না আসে।

— খাবি না?
— না।

আজিজ আবার হাসলো! হেসে উঠে যেতে যেতে বললো, — জয়তুন আরার কাছে বীণাকে চাইবো আমি। অনেক আগে একবার সারেং বাড়ির মানুষেরা চেয়েছে, এবার আমরা চাইবো। আশা করি এবার আর তুমি নিরাশ করবে না।

আগের বিয়ের দু’দুটো সম্বন্ধ নিয়ে ফরহাদের যেমন মাথা ব্যথা ছিল না। এবারো দেখা গেলো না। সে আরো আরাম করে শুলো। শুতে শুতে বললো, — দরজার সাথে ফ্যানটাও বন্ধ করে যেও।

শাহবাজ বাড়ি ফিরলো ঘন্টাখানেক পরে। ঘড়ির কাটা তখন রাত দশটার উপরে। চারিদিকে নিস্তব্ধতায় ঘেরা। তিরতির করে বয়ে যাওয়া নদীর শীতল একটা বাতাস শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এই নিস্তব্ধ রাত, নিস্তব্ধ নদী তাদের বাড়ির ছেলেদের জন্য তেমন কোন ব্যাপার স্যাপার না। এই ডালভাতের মতো। তাই তাকে তেমন বিচলিতও মনে হলো না।

সে নৌকা থেকে নামলো একটু ঝিমিয়ে । নেমে ঘাটের সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসলো। তার চোখ টকটকে লাল। দুদিনের ক্লান্তি, ঘুম তার মধ্যে খেয়েছে দু’ঢোক তাড়ি। এই দু’ঢোক তাড়িতে তার নেশা হওয়ার কথা না, তবে মাথা হালকা ঝিমঝিম করছে।

শাহবাজ বসেই নিচু হয়ে মাথায় পানি দিলো। তখনি ঢেউ তোলা নদীর বুকে একজনের ছায়া এসে পড়ল। ছায়ায় মালিক এসে দাঁড়ালো একদম তার পেছনে। শাহবাজ অনায়াসেই বুঝলো কে। না বুঝে উপায় কি? রক্তের ভাই বলে কথা। অবশ্য পুরো বাড়িতে এই রকম ভূতের মতো সারা রাত একজন’ই ঘুরে। সে হলো এরশাদ সারেং। রাতে সে ঘুমায় না। অবশ্য ঘুমায় না বললে ভুল। ঘুম আসে না। সেই যে এক রাতে ডাকাতেরা তার চোখের সামনে বাবা, মা সবাইকে খুন করলো, তখন থেকে সে ঘুমাতে পারে না। ঘুমালেও ঘুমাবে একেবারে শেষ রাতে।

তাই মাথায় পানি দিতে দিতে’ই হালকা হাসলো! হেসে বললো, — কি চাই?

এরশাদ তার শান্ত স্বরে’ই বললো, — ছোট চাচা বাহিরে বসে আছে।

— তো?

— সে আয়নামতিকে ছাড়া ভেতরে যাবে না।

শাহবাজ হাসলো! হো হো করা হাসি। হাসতে হাসতেই সিঁড়িতে প্রায় শুয়ে পড়লো। পড়তেই মাথার পানিতে গলা, ঘাড়, শার্ট পানিতে মাখামাখি হলো । তাকে অবশ্য সেই ভেজা নিয়ে তেমন বিচলিত দেখা গেলো না। সে হাসতে হাসতেই বললো, — বিরাট সমস্যা হয়ে গেলো ভাই। আয়নামতিকে তো আমি ইটের চুলায় দেবো। আহা! সারেং বাড়ির প্রথম নাত বউ, ইটের চুলায় ছাই। এখন ছোট চাচার কি হবে? বাকি জীবন তো মনে হয় বাইরে’ই থাকতে হবে।

— বাড়ির মানুষ নিয়ে হেঁয়ালি না শাহবাজ।

শাহবাজ কৌতুকের সুরেই বললো, — দুঃখিত ভাইজান।

এরশাদ আর দাঁড়ালো না! যেতে যেতে বললো, — ছোট চাচা যদি বারান্দায় বসে বসে’ই কালকের সূর্যের মুখ দেখে। তাহলে ভুলে যাস, তোর একটা বড় ভাই আছে।

— সেটা আমি এমনিতেও মনে রাখি না। তবে ঐ মিথ্যাবাদির জন্য এতো বড় কথা? আহা! বড় ভালো একটা বর মিস করে গেলো।

এরশাদ দাঁড়ালো! সব ঘটনাই শুনেছে। হঠাৎ করে এমন পাল্টি মারার কারণ কি? সে দাঁড়াতেই শাহবাজ উঠলো! এগুতে এগুতে বললো, — আলাউদ্দিন ফকির বুঝি ডাল গলাতে পারেনি?

— সেটা বউ নিয়ে সামনে যা তাহলেই বুঝবি।

— আরে বাহ্! বউ?

— হ্যাঁ! বউ। সারেং বাড়ির বউ। যাকে চাইলেই এখন ইটের চুলায় জ্বালাতে পারবি না। জ্বালালে আঙুল উঠবে সারেং বাড়ির সম্মানে। আর সম্মান যেখানে জয়তুন আরা কাউকে গোনায় ধরে না।

— সেটা শাহবাজও ধরে না।

— না ধরলে যা, বউ নিয়ে দাদির সামনে দাঁড়া। বড় গলায় কবুল বলতে পারিস, বউ নিয়ে দাঁড়াতে পারবি না কেন? নাকি আয়নার কথায়’ই ঠিক? ভয়ে পাল্টি মারছিস।

শাহবাজ হো হো করে হাসলো! তখনি সদর দরজার বাতিটা ফট করে ফিউজ হয়ে গেলো। এরশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তাকে অবশ্য কিছু বলতে হলো না। বাড়ির উত্তর সাইডে জয়তুন আরার পোষা লোকের থাকার আলাদা ঘর করা। সেখান থেকেই কালাম দৌড়ে বেরুলো।

এরশাদ আর দাঁড়ালো না। নিজের মতো এগিয়ে গেলো। এগিয়ে গেলো শাহবাজও। তবে সারেং বাড়ির ভেতরের দিকে না। ঐ যে দক্ষিন কোণে হাফ বিল্ডিং সেখানে।

আয়না ঘুমিয়ে আছে না জেগে পৃথিলা জানে না। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিলো। পৃথিলা নিজেই মাথা ধোয়ালো, জোর করে দু’লোকমা ভাত সাথে ঔষুধ খাওয়ালো, তার বা সাবিহার কারো কাছেই কামিজ নেই। তাই পুড়ে যাওয়া বেনারসি বদলে তার কাপড়ের মধ্যে থেকে একটা সুন্দর করে গায়ে জড়িয়ে দিলো। গহনার খুলে হাত মুখ মুখ পরিষ্কার করে, মাথায় বেনি তুলে দিলো।

জ্বর, ভয় না অন্য কোন কারণে পৃথিলা জানে না। তবে মেয়েটা একদম নিশ্চুপ হয়ে আছে। তাই মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছে, ঘুমাও। ঘুমালেই ভালো লাগবে।

মেয়েটা অবশ্য ঘুমাতে পারেনি। জ্বরে কিছুক্ষণ ছটফট করেছে। কিছুক্ষণ নিজেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। বড় মা, বড় মা বলে কয়েকবার কাকে যেন ডাকলো। তার সাথে অস্পষ্টভাবে কিছুক্ষণ বিরবির করলো। তারপর হয়তো ঔষুধ কিছুটা কাজ করেছে। তারপর থেকে একদম নিরব।

পৃথিলা এখন বসে আছে জানালার পাশে। দৃষ্টি বাহিরে চাঁদের আলোর দিকে। কিছুক্ষণ আগে কোন কারণে উঠানের বাতিটা ফিউজ হয়েছে। ইমরান ভাই কিছুক্ষণ দেখার চেষ্টা করলো। রাতের আঁধারে তেমন কিছু বুঝলো না। তাই হাল ছেড়ে এসে শুয়ে পড়েছে। যা করার সকালে দেখা যাবে। অবশ্য দেখার মতো কিছু নেই। বিনা কারণেই এই যে ছোট ছোট লাল বাল্ব, এগুলো ফিউজ হওয়ার বাতিক আছে।

অবশ্য এক দিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। কৃতিম আলোয় এই যে চাঁদের মন মতানো রুপ, এগুলো চোখে পড়ে না। ফিউজ হলো বলেই তো পৃথিলা বসে বসে চাঁদের আলোর ভেলায় মন ভাসাতে পারছে।

সেই ভাসানো দৃষ্টি চাঁদের উপর থেকে নিচে নামলো কারো এগিয়ে আসার দিকে। নামতেই দেখলো চাঁদের আধো আলো, আধো অন্ধকার ভেদ করে কেউ এগিয়ে আসছে। সারেং বাড়ির ছোট নাতির সাথে এখনো তার দেখা হয়নি। তাই এমন আধো আলো, আধো অন্ধকারে চেনার কথা না। তবুও পৃথিলা বুঝতে পারলো কে? কেন পারলো কে জানে? হয়ত তার ধারণা ছিল এই অধম’ই আসবে।

তখনি দরজায় ধরাম করে দুটো পড়ল। পৃথিলা স্বাভাবিক থাকলেও, সাবিহা ধড়ফড়িয়ে উঠল। মেয়েকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেরও চোখ লেগে গিয়েছিল।

তার স্বাভাবিক হতে হতেই ইমরান উঠল। সে ঘুমাইয়নি। ভালো করেই জানতো কেউ আসবে। এরশাদ ভাই কখনও কিছু ফেলে রাখে না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই দরজা খুললো। খুলতেই শাহবাজ হাসলো। হেসে বললো, — নিশি রাতে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত ইমরান ভাই।

— সমস্যা নেই! ভেতরে আসো।

— ভেতরে গিয়ে কাজ কি? এমনতো না শ্বশুর বাড়ি। জামাই আদর করে, মেয়েকে দেবেন। তাই যার জন্য এসেছি তাকেই ডাকেন।

ইমরান আর কিছু বললো না। তবে এগিয়ে গিয়ে পৃথিলাদের দরজায় মৃদু টোকা দিলো। সাবিহা অবশ্য রুম থেকে বের’ই হলো না। সে মহা বিরক্ত। এই শয়তানকে সে নিজেও দেখতে পারে না। বদমাইশের বদমাইশ।

পৃথিলা ধীরে সুস্থেই উঠল। উঠে দরজা খুলে দাঁড়ালো একদম শাহবাজের মুখোমুখি। তারপর তার স্বভাব মতো শান্ত স্বরে বললো, — জামাই আদর খেতে হলে, আগে জামাই হওয়ার লায়েক থাকতে হয়। শ্বশুরের কাছে মেয়ের হাত চাইতে হয়। তারপরে দেবে না দেবে সেটা পরের বিষয়। এগুলো জোর খাটিয়ে, ক্ষমতার জোরে হয় না। হয় সম্মান, ভালোবাসায়। আমার মনে হয় না এই শব্দগুলো সাথে সারেং বাড়ির কোন মানুষেরা পরিচিত?

শাহবাজ ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো। এতো এতো ঝামেলার বুঝতে পারলো না কে? তাই ইমরানের দিকে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকালো।

ইমরান সাথেই সাথেই বললো, — ওনি সাবিহার বান্ধবী। হাই স্কুলে শিক্ষক হিসেবে এসেছেন।

শাহবাজ ভ্রু নাচিয়ে বলল, — ও আচ্ছা! আপনিই সেই মহামনবী। যার জন্য আমার ভাইয়ের এই দশা।

পৃথিলাও তার মতো বললো — জ্বি না। আপনার জানায় কিছুটা ভুল আছে। আমার জন্য আপনার ভাইয়ের এই দশা না, আপনাদের জন্য’ই আপনাদের এই দশা।

শাহবাজ হেসে ফেললো! এই মেয়ের চাপার জোরে সে বলতে গেলে অবাক’ই হলো! অত্র এলাকায় তাদের সাথে সাথে চাপা চালাবে এমন মেয়ে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সে হেসেই বললো, — বুঝতে পারছি না গো ইমরান ভাই। আজকাল সবার সুর’ই অন্যরকম লাগে। সারেং বাড়ির ভয় ডর সব কমে যাচ্ছে নাকি? যাই হোক, সময় খারাপ। সবাই একটা একটা করে পাছায় লাথি মারছে। সবচেয়ে বড় লাথি মারছে আমার পিরিতের বউ। ভাগাইয়া নিছিলাম গো ইমরান ভাই, ভাগাইয়া। ভয় ডরে তো দাদিরে মুখ দেখাইতে পারুম না। তাই নিয়া দিছিলাম উড়াল। উড়াল দিলেই বুঝি বাঁচা যায়? গ্রামের মানুষ ধইরা দিলো জন্মের এক যাঁতা। যাই হোক! লাথি যখন খাইছি, আর দাদির সামনে দাঁড়াতে কি সমস্যা। তাই দেন, আমার বউ আমারে দেন। নিয়া দাদির সামনে দাঁড়াই। সে আবার ঘোষনা দিছে। বউ ঘরে তুলবো না। কি যে যন্ত্রনায় পড়ছি বলেই পৃথিলার দিকে তাকিয়ে হাসলো। এই হাসিকে অবশ্য হাসি বলা যায় না। যাকে বলে শুধু দু’ঠোঁট ছড়িয়ে হাসির বারোটা বাজানো।

পৃথিলা আগের মতোই শান্ত। শান্ত চোখেই এই হাসি দেখলো। তবে কথার কোন আগা মাথা পেলো না। যতোদূর জানে মেয়েটা নিজের ইচ্ছায় পালিয়েছিল। সেই পালানোতে এর বড় ভাইয়ের হাত ছিল। তো? পৃথিলা ভাবলো! ভাবতে ভাবতেই কিছুটা যেন অনুমান করতে পারলো আর পাললো বলেই মনে মনে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেয়েটার কপালে অনেক ভোগান্তি আছে।

শাহবাজ সেই তাকানোর দিকে তাকিয়ে বললো, — আমি আমার বউকে নিয়ে যেতে পারি মাস্টার সাহেবা?

— মেয়েটা অসুস্থ! আমি আপনার সাথে যাচ্ছি। গিয়ে বুঝিয়ে বলছি। কাল সকালে গেলেও তো কোন সমস্যা হওয়ার কথা না।

— অনেক সমস্যা।

— আমি আপনার ছোট চাচাকে বুঝিয়ে বলছি। চলুন।

— যেতে চাইলে যান, আমাকে বলছেন কেন? দুনিয়া দারির সব মেয়ের দায়িত্ব আমার ঘাড়েই পড়ছে কেন? কি আজব কারবার। একটা বিয়ের জন্য গায়ে আগুন দেয়। আরেকটা এমনি এমনি বলে “চলুন”। বাবারে বাবা!

পৃথিলা চোয়াল শক্ত করলো। সে শান্ত, ধৈর্যশীল মানুষ! তবুও আজ খুব ইচ্ছে হলো, এই ছেলের গালে ঠাস করে একটা লাগাতে। তবে নিজেকে দমালো। কাদায় ইট ছুঁড়লে কাদার কিছু হয়? বরং নিজের গা নোংরা হয়। তাই নিজেকে দমিয়ে কিছু বলবে, তখনি পেছন থেকে মৃদু স্বরে আয়না বললো, — আমি যাবো।

শাহবাজ আগের মতোই হাসলো! হেসে বললো, — মিয়া বিবি রাজি, আপনি কেন নিমরাজি মাস্টার সাহেবা?

পৃথিলা শাহবাজের কথার উত্তর দিলো না। পেছন ফিরে তাকালো! কাঁপা শরীরে কখন উঠে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি। গায়ে তার বেগুনি কাপড়। কি মায়াময় একটা মুখ। যেই মুখে চাঁদের কলঙ্কের মতো রক্ত ছোপ ছোপ জমাট বেঁধে আছে।

পৃথিলা বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে আর একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না। চুপচাপ দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো।

দাঁড়াতেই আয়না পৃথিলার দিকে তাকালো। কি অসহায় সেই দৃষ্টি। নৌকার পাটাতনে বসে সব কথাই সে শুনেছে। তাই চিনতে কষ্ট হয়নি। তবে এই যে ঘন্টা দু’য়েক! এই দু’য়েক তার মনে হয়েছে, মায়ের বুকে আছে সে। তার ভয় নেই, কোন ভয় নেই।

পৃথিলা সেই অসহায় চোখে দিকে তাকিয়ে রইল। এই চোখ তার চেনা। ভালো করেই চেনা। তারেকের সাথে ডির্ভোসের কয়েকদিন যতোবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছে। ততবার এই চোখ দেখেছে। যেই চোখ আর্তনাদ করে বলেছে, – আমার কেউ নেই, কেউ নেই। এই যে এই বিশাল পৃথিবী। এখানে সে একা, একদম একা। আর এই একা পৃথিবীতে তার সব যুদ্ধ একাই লড়বে সে।

আয়না চোখ ফিরিয়ে এগুলো ধীরে ধীরে। না ভয়ে না, ভয় ডর অনেক আগেই শেষ। তবে শরীর কাপঁছে! জ্বর নেই, তবুও রেশ যেন আছে।

সেই রেশ, রুপ, মায়া কোন কিছুর ধার’ই শাহবাজ ধরলো না। সামনে আসতেই কব্জি থাবা মেরে ধরলো আর ধরতে দেরি চোখের পলকে টেনে ঘর থেকে নিয়ে যেতে দেরি হয়নি।

পৃথিলা শান্ত চোখেই দু’জনের দিকে তাকিয়ে রইল। বেশিক্ষণ অবশ্য দেখা গেলো না। লাইট নেই গাছগাছালিতে ভরা। চাঁদের আলো মন ভোলাতে পারে তবে ঘোর অন্ধকার না।

ইমরান পৃথিলার দিকে তাকালো না! কখনোও তাকায়ও না। পরিচয় না থাক, হাজার হলেও মনিবের মেয়ে। তাই চোখ নামিয়ে বললো — আপনি শুয়ে পড়ুন। এরশাদ ভাই আছেন। সমস্যা হবে না।

— ইটের চুলার ব্যাপারটা কি?

ইমরান একটু চমকালো! অবশ্য সাথে সাথেই সামলে নিলো। নিয়ে বললো, — জ্বি বুঝলাম না। কিসের চুলা?

পৃথিলা সেই চমকে যাওয়া দেখলো। তবে আর কিছু’ই জিজ্ঞেস করলো না। হাজার হলেও বান্ধবীর জামাই। যতোই এক বাড়িতে থাক। কিছুটা জড়তা কাজ করে। তাই দু’পাশে হালকা মাথা নেড়ে বোঝালো “কিছু না “। বলেই রুমে চলে এলো। জ্বরের ঘোরে মেয়েটা অনেক কিছুই বলেছে। পৃথিলা কিছু বুঝেছে, কিছু বুঝেনি। তবে মেয়েটার বাবা, মায়ের সাথে সারেং বাড়ির কিছু একটা সংযোগ আছে, সেটা ঠিক বুঝেছে।

সারেং বাড়ির সদর দরজা আর ইমরানে ঘরের কোণার দুটো’লাইট একসাথেই গেছে। কেন গেছে, গত দুদিনের ঝামেলায় কারো মাথা কিছুই এলো না। সবাই ভাবলো সকাল হলেই ব্যবস্থা করা যাবে। তাই অন্ধকারেই যে যার মতো রইল। সেই রওয়ার মাঝে গাছগাছির অন্ধকার, তার মধ্যে দু’দিনের ক্লান্তি, ঘুম, তাড়িতে শাহবাজ চোখে দেখছে ঘোলা। অবশ্য তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। কেননা এই চোখের ঘোলা, অন্ধকারেই আয়নাকে গরুর মতো টেনে নিচ্ছে। সেই নেওয়ায় বাঁধা পড়ল আয়না হোঁচট খেয়ে পড়াতে।

তার পড়াতে শাহবাজের তেমন ভাবান্তর হলো না। হলো বিরক্ত, দাঁড়িয়ে থাকতেও তার কষ্ট হচ্ছে। সে নিচু হয়ে আবার আয়নার হাত ধরতে গেলো। তখনি শক্ত কাঠের এক বাড়ি তার মাথায় পড়ল। শাহবাজ থমকালো! তার থমকানের মাঝেই তার পেছনে দাঁড়ানো মুখে কাপড় বাঁধা লোকটা আবার বাড়ি তুললো। আগের টা না দেখলেও আয়না এবার দেখলো, দেখেই এক চিৎকার দিয়ে শাহবাজ কে ধাক্কা মারলো। আর মারতেই শাহবাজ তো সাইড হলো তবে সেই বাড়িটা আয়নার মাথায় সজোরে লাগলো। আর লাগতেই বিন্দু বিন্দু রক্তের ফোঁটা গুলো শিউলি ফুলের মতো ঝড়ে পড়তে পড়তে আয়নাও ধপাস করে পড়ল।

চলবে…..