#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_ ২৯
ফরহাদের ঘুম ভাঙলো কিছুটা হইচই এ। তাদের বাড়িতে হইচই হয় বড় ভাই, তাদের ছেলে মেয়ে এলে। তা না হলে বাকি সময় বেশিভাগ’ই নিশ্চুপ, চুপচাপ। বাচ্চা কাচ্চা নেই, মানুষ মাত্র তিনজন। কাজের লোক অবশ্য আছে, তবে তারা নিশ্চয়’ই হইচই করে বাড়ি মাতিয়ে রাখবে না। তাই হঠাৎ এই হইচই এর কারণ তার মাথায় এলো না। অবশ্য মাথা যে বিশেষ ভাবে ঘামালো তেমনও না। বরং নিজের মতোই ঘুম থেকে উঠলো। উঠে গোসল করে একেবারে স্কুলের জন্য তৈরি হলো। হতে হতে সে বুঝলো বাড়িতে শুধু হইচই না, কোন খুশির আমেজ চলছে। ফাতিমা তো যেমন তেমন আবদুল আজিজও দেখলো খুশিতে ঝিলমিল করছে। তার মা সব সময়’ই এমন। ছোট ছোট যে কোন কারণেই গা ভাসিয়ে খুশি হতে পারে। তবে তার বাবার কারণ কি?
সেটা ভাবতে না ভাবতেই ফাতিমা মিষ্টি নিয়ে এলো। ফরহাদ সেই মিষ্টি আর মা দু’জনের দিকেই ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
ফাতিমা হাসলো! দুটো ছেলে পেটে রেখেছেন। দু’টোই হয়েছে দুই’রকম। বড়টা নরম, কোমল। ছোটটা হয়েছে আগুন গরম। আগুন গরম হলেও মনটা খুব ভালো। এতোটাই ভালো সবাই কিন্তু দেখলেই চট করে বুঝতে পারে না। এটা বোঝার জন্য তার ছেলের কাছে আসতে হবে। তাকে বুঝতে হবে।
ফাতিমা হেসেই মিষ্টি তুলতে গেলেন। ফরহাদ দেখেই বিরক্ত মাখা কণ্ঠে বললো, — সাত সকালে মিষ্টি খাবো না।
— একটা খা।
— অর্ধেকও না।
— আমার জন্য খা।
— তোমার জন্য হলে তো কথায়’ই ছিল না। তবে এই মিষ্টি তোমার জন্য না।
— তাহলে বল কার জন্য?
— আমার কোন দরকার এতো বলাবলির। সরো তো। আমি বেরোবো।
ফাতিমা সরলেন না। বরং মিষ্টির কোণা ভাঙলেন। ভেঙে বলতে গেলে জোর করেই ছেলের মুখে পুরলেন। পুরে বললেন, — ছেলে পর হবে সেই খুশির মিষ্টি।
ফরহাদ শুনলো! শুনে তেমন ভাবান্তর হলো না। এমন হবে আগেই অনুমান করেছে। তার বাবা কিছু চাইবে আর হবেনা এটা খুব কম’ই হয়েছে। তাই মিষ্টিটুকু স্বাভাবিক ভাবেই গিললো। গিলে এগিয়ে পানি খাবে তখনি কেন জানি বীণার সেই দিন সকালের মুখটা ভেসে উঠল। যে ঝরঝরিয়ে কেঁদে বলছে, ” ফরহাদ ভাই আমি পরীক্ষা দিতে চাই।”
ফরহাদ পানি খেলো না। গ্লাস রাখলো। রেখে মায়ের হাতের বাটি থেকে নিজেই বাকি মিষ্টিটুকু নিয়ে খেলো। ফাতিমা খুশি হয়ে গেলো। খুশিতে ঝিলমিল করতে করতে বললো, — তোদের স্কুলের নতুন শিক্ষক কি যেন নাম। ওর তো অবস্থা নাকি ভালো না। এরশাদরা নাকি রাতে সদরে নিয়ে গেছে।
ফরহাদ আবারো ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তাকিয়ে বললো, — কাকে নিয়ে গেছে?
— ঐ যে নতুন মহিলা ম্যাডাম।
— কেন?
— কি জানি বাপু। এতো খবরতো জানি না। সাত সকালর দই মিষ্টি নিয়ে সারেং বাড়ি থেকে খবর এলো। দাওয়াত এলো। তখন শুনলাম।
ফরহাদ আর কিছু বললো না। এই মেয়ে তো দেখা যায় ঝামেলার গুষ্টি নিয়ে ঘুরে। এসেছে পর থেকে একটার পর একটা লেগেই আছে।
ফাতিমা মিষ্টির বাটিটা টেবিলে রাখলো। সেই ছোট বেলায় একবার দেখেছিল বীণাকে। বাসা আর স্কুল ছাড়া তেমন বেরোয় না। সে নিজেও তেমন বেরোয় না। তাই আর দেখাও হয়নি। তবে শুনেছে গায়ের রং খুব একটা পাকা না। তাদের বড় বউ আবার বিশ্বসুন্দরী। সেই সুন্দরের দেমাগে শ্বশুর বাড়ি টিকতে পারে না। শ্বশুর বাড়ি লাগে ক্ষ্যাত, ঝামেলা। তাই জাতের মেয়ে কালো হলেও ভালো, তাছাড়া ফরহাদও যে এখনো কোন বিরক্ত দেখাচ্ছে না এই’ই অনেক। তাই রেখেই বললো, — দাওয়াতে সবাই মিলেই যাবো। বড় বউকে আজ’ই খবর পাঠাবো। তোর আব্বা বললো, টুকটাক কথা বলার সেই দিন বলবে। আর আমরাও এই সুযোগে একটু দেখে আসলাম।
ফরহাদ এবারো উত্তর দিলো না। সে বরং মোজা নিয়ে খাটে বসলো। কালকে সারেং বাড়ি যায়নি। স্কুল থেকে সোজা জানাজায় গিয়েছে। এমন বৃষ্টি তাই সোজা আবার সেখান থেকেই বাড়িতে এসেছে।
ফাতিমা ছেলের দিকে তাকালের। তাকাতেই মনে মনে বললেন, — মাশাআল্লাহ! স্কুলের জন্য পরিপাটি ভাবে এই যে যখন তৈরি হয়। কি সুন্দর যে লাগে। মনে হয় বিলেত থেকে ফেরা সাহেব। সে সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিলো। সন্তানের দিকে মায়েদের মুগ্ধ চোখে তাকাতে নেই। নজর লাগে। সে চোখ ফিরিয়ে বললো, — বীণাকে তোর পছন্দ তো ফরহাদ?
ফরহাদ এ কথা শুনেই হেসে ফেললো! হাসার অবশ্য কারণ আছে। তার আবার বীণার সেই দিনের কথা মনে পড়েছে। যে চোখ মুখ ফুলিয়ে বলছে, তাছাড়া আপনাকে আমার পছন্দও না। ”
সে হেসেই দেয়াল ঘড়ির দিকে একবার তাকালো। এখন বেরুলে একবার সদর ঘুরে আসা যাবে। অবশ্য যেহেতু এরশাদ আছে। কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। তবুও উঠল! মেয়েটার সমস্যা হবে না জানে। তবে এরশাদের খবর কি? তাই ঝট করে বাকি তৈরিটুকু হতে লাগলো। ফাতিমা দেখে অবাক কণ্ঠে বললো,– কি বলছি তোর কানে যাচ্ছে?
— না।
— না মানে?
— না মানে নায়’ই হয় মা।
— ফাজলামি করছিস?
— আমি কখনও ফাজলামি করি না ।
ফাতেমা হাল ছাড়লো। ছেড়ে বললো, — নাস্তা খেয়ে যা অন্তত।
ফরহাদ জুতা পড়লো। পড়ে বের হতে হতে আগের মতোই বললো, — না।
ফরহাদ সদর যখন পৌঁছালো ঘড়ির কাটা নয়টার উপরে। এরশাদ হাসপাতালে নেই। সে অবাক’ই হলো! তার চেয়েও অবাক হলো, ছোট চাচাকে দেখে। পৃথিলা বেহুঁশের মতো ঘুমাচ্ছে। কালকের চেয়ে অনেকটা ভালো। এখনো অবশ্য কারো সাথে কথা বলেনি। তবে ঠিক আছে। সেই ঠিক আছে মেয়েটার পাশে অক্লান্তভাবে ছোট চাচা বসে আছে। সারা রাত নির্ঘুম দেখেই বোঝা যাচ্ছে। একদিনে’ই দেখে মনে হচ্ছে বয়স দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
ছোট চাচা নরম মনের মানুষ। ভেতরে মায়া মহব্বতে ভরপুর। তবুও অচেনা একটা মেয়ের জন্য এতোটা কাতর চোখে লাগার মতোই। আর তার চোখেও বলতে গেলে ভালো ভাবেই লাগলো। আর লাগলো বলেই বুঝলো এখানে শুধু এরশাদ না, অন্য কোন ঘটনা আছে। অবশ্যই আছে। তবে সেটা কি, ফারহাদ বুঝতে পারছে না। আর পারছে না বলেই, ইমরানের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো। বাচ্চা আছে তাই হয়ত রাতে সাবিহা আসতে পারেনি। তুই বেটা দূরে দূরে কেন? তোর বউয়ের সখী। বাড়িতে গেঁথে রেখেছিস। দায়িত্বের বেলায় সারেং বাড়ির ঘাড় কেন?
ইমরান অবশ্য দেখেও দেখলো না। সে আছে মাইনকার চিপায়। না কিছু বলতে পারে, না কিছু করতে। তবে এই মেয়ের কপালে ভোগান্তি আছে । ছোট চাচার অবস্থা না বোঝার কিছু নেই, তবে এরশাদ ভাই ? শান্ত, নিশ্চুপের মাঝেও যে পাগলামি কাল রাতে তারা দেখেছে। এতো বছরে এই রকম পাগলামি এরশাদ ভাইয়ের মাঝে কখনও দেখেনি। ঝড় বৃষ্টিকেও সে হার মানিয়েছে। সাবিহাকে সাবধান করতে হবে। আর সবচেয়ে ভালো হয় মিঠাপুকুর থেকে পৃথিলা চলে গেলে। কেননা জয়তুন সব মানবে, সারেং বাড়ির দিকে আঙুল উঠবে এমন কিছু সে কখনও হতে দেবে না। তাই পৃথিলার হাজার গুণ থাক, তার সব গুণ ঢাকা পড়বে তার তালাকে। গ্রাম গঞ্জে তালাম প্রাপ্ত মেয়েকে সবাই বাঁকা, নিচু চোখেই দেখে।
ফরহাদ ইমরানের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে জাফরের কাছে এগিয়ে গেলো। গিয়ে বলল — অসুস্থ হয়ে যাবে তো। তুমি বরং বাসায় চলে যাও। আমি কিছুক্ষণ আছি। তাছাড়া ইমরান তো আছেই।
জাফর হাসলো। হাসিটা অবশ্য মলিন। মলিন ভাবেই বললো, — মেয়েটা এখনো কথা বলেনি। কথা বলুক। তারপর দেখি ডাক্তার কি বলে।
— ভয় নেই। তুমি বাসায় যাও। আমরা আছি তো।
— না! আমি থাকি। বাসায় গিয়ে শান্তি পাবো না।
ফরহাদ জাফরের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তার সন্দেহ পাকাপোক্ত’ই হলো। তাই হেসে বললো, — এরশাদ কই?
— এক ছেলে এসে কি যেন বললো । তারপর ডাকঘরের দিকে গেলো। আমাকে শুধু বলে গেলো। যাবো আর আসবো।
ফরহাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। এই ছেলের মাথায় আসলে চলছে কি? সে তাকিয়ে’ই বাইরে এসে দাঁড়ালো। গতকাল টানা পুরো দিন রাত বৃষ্টি হয়ে আজ আকাশ বড়’ই ক্লান্ত। কান্ত হলেও সূর্য এখনো উঁকি দেয়নি। নিভু নিভু অন্য রকম একটা কোমল আলোয় চারপাশ আচ্ছাদিত হয়ে আছে। সেই আচ্ছাদিত আলোয় এরশাদকে আসতে দেখা গেলো। হাতে মুঠোয় সব সময়ের মতো সিগারেট। গায়ে কুঁচানো সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট। যার অর্ধেক কাদায় মাখামাখি। খোঁচা খোঁচা ছোট ছোট চুলগুলোও এলোমেলো।
মুখটা ভয়ংকর, গায়ের রং শ্যামলা হলেও এরশাদের শরীর বেশ শক্ত সামর্থ্য। আসলে তাদের দু’ভাইয়ের গড়নই একরকম। তাদের বাবা মানে জসিম চাচার গড়নও এমনই ছিল, শক্তপোক্ত। তবে জাফর চাচা আলাদা ধাঁচের মানুষ। তিনি শুধু স্বভাবে নরম কোমল না, দেখতে গড়নেও কোমল।
তবে আশ্চর্যের বিষয় এই শক্ত।সামর্থ্য শরীর নিয়ে এরশাদকে কখনো মারামারি বা ঝগড়ায় জড়াতে দেখা যায়নি। সে শান্ত, মার্জিত। আজ পর্যন্ত গ্রামের কেউই এরশাদ মারধর, রাগ, জেদ করতে দেখেনি। বরং ছোটবেলা থেকেই মারামারি, কাটাকাটিতে সবার পরিচিত ছিল ফরহাদ আর শাহবাজ। গ্রামের কোণায় কোণায় এমন অনেক গল্প’ই আছে ।
তবে কলেজের পরে ঢাকায় থাকার সুবাধে তারটা ঢাকা পড়ে গেছে। শাহবাজেরটা এখনো পুরোদমে চলছে। তবে এরশাদ তাকে ফরহাদ এখন আর পুরোপুরি বুঝতে পারে না। ডাকাতের ঘটনার পর থেকে সে অন্য রকম।
এরশাদ এসে স্বাভাবিক ভাবেই ফরহাদের পাশে দাঁড়ালো। স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়ালেও আজ সিগারেট এগিয়ে দিলো না। নিজের মতো শুধু বললো, — কখন এসেছিস?
— এইতো এখনি।
— স্কুলে যাবিনা?
— যাবো।
— ওর ব্যাপারে হেড স্যারের সাথে কথা বলিস।
— বলবো।
— তাহলে যা।
ফরহাদ হেসে ফেললো! হেসে বললো, — তাড়িয়ে দিচ্ছিস মনে হয়।
এরশাদও হাসলো। হেসে বললো, –.হ্যাঁ দিচ্ছি।
— জানতে পারি কেন?
— কাউকে সহ্য হচ্ছে না।
ফরহাদ আবারো হাসলো। হেসে নিজেই এরশাদের হাত থেকে সিগারেট টেনে নিলো। নিতে নিতে বললো, — কার চিঠি এসেছে?
— ছোট চাচা ।
— প্রেরক কে ?
— সাবিহার বাবার।
— চিঠি আছে না হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছিস।
এরশাদ নির্বিকার ভাবেই পকেট থেকে চিঠি বাড়িয়ে দিলো। ফরহাদ ঠোঁটে ভাঁজে সিগারেট রেখে হাতে নিলো। নিয়ে ভাঁজ খুলে চোখ বুলালো।
জাফর,
কেমন আছিস? অবশ্য মেয়ে আছে এখন মনে হয় না খারাপ আছিস। তবে শুনেছিস হয়তো তারেক খুন হয়েছে, আর পুলিশ পৃথিলাকে খুঁজছে। খোঁজা টা সমস্যা না। এসে কথা বললেই মিটমাট হয়ে যাবে। তবে সমস্যা হলো। কেসটা মনে হয় শায়লার বর্তমান স্বামী হাতে নিচ্ছে। এমনকি পৃথিলার সব বন্ধু -বান্ধবীদের খুঁজে বের করছে। শায়লা সাবিহাকে চিনতো। আমার মেয়ে হিসেবে না চিনলেও ওর বান্ধবী হিসেবে চিনতো। যে কোন সময় আমার বাড়িতে আসবে। এখন তুই বল আমার কি করা উচিত। শায়না যদি জানে পৃথিলা মিঠাপুকুরে, আগুন লাগিয়ে ফেলবে। আর যেই সত্য পৃথিলা আজ পর্যন্ত জানে না, তা জানবে। আর জানতে পারলে পৃথিলা মিঠাপুকুরে একসেকেন্ডও থাকবে না। এখন তোদের যা ভালো মনে হয় কর। করে আমাকে অতি শীঘ্রই জানা।
ইতি
ইমদাদুল হোসেন
ফরহাদের ঠোঁটের ভাঁজ থেকে সিগারেট পড়ে গেলো। পড়তেই অবাক হয়ে তাকালো। এরশাদ অবশ্য স্বাভাবিক। স্বাভাবিক ভাবেই বললো, — সারেং বাড়ির আসল রক্ত।
ফরহাদ কথা বলতে পারলো না। সব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সব গেলেও সেই প্রথম দিনের চিঠির শায়লার রহস্য বুঝলো। ভালো ভাবেই বুঝলো। বুঝলো বলেই থমকে দাঁড়িয়ে রইল। ছোট চাচার এমন কাহিনী আছে সে তো ভাবতেই পারছেনা।
এরশাদ অবশ্য ফরহাদের ভাবা না ভাবা নিয়ে মাথা ঘামালো না। সে টেনে ফরহাদের হাত থেকে চিঠি নিলো। নিয়ে বললো, — নাস্তা করেছিস?
ফরহাদ থমকেই দু’পাশে মাথা নাড়লো। এরশাদ দেখে তার মতোই বললো, — আমিও না। চল করে আসি।
ফরহাদ নাস্তা করতে করতে সবই শুনলো। শুনে কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে বুঝতে পারলো না। তবে এরশাদ সেই চিঠিটা বের করে টুকরো টুকরো করলো, করে হোটলের চুলার আগুনে জ্বালালো। জ্বালিয়ে সুন্দর করে নিজ হাতে দু’টো চিঠি লিখলো।
একটা তার অতি প্রিয় চাচার জন্য। যেখানে সব বক্তব্যে ঠিক রেখে মূল জায়গায় লিখলো,” ঢাকার অবস্থা খারাপ। অনেক খারাপ! পৃথিলাকে সবাই খুনি ভাবছে। তাই কোন ভাবেই পৃথিলা যেন এখন ঢাকার দিকে না আসে। সব একটু ঠান্ডা হোক। তারপরে ওকে একবার নিয়ে এসে মিটমাট করে ফেললেই হবে। ”
আর দ্বিতীয় সাবিহার বাবাকে। যেখানে খুব দরদ দিয়ে লিখলো, — পৃথিলা এখানে ভালো আছে। আমিও ভালো আছি। অনেক অনেক দিন পরেই একটু ভালো আছি।আর কেউ না জানুক তুই তো জানিস? তাই বন্ধু হয়ে বন্ধুর কাছে হাত পাতলাম। শায়লা বা শয়লার বর্তমান স্বামী কেউ’ই যেন জানতে না পারে পৃথিলা এখন কোথায় আছে। বিশ্বাস কর, এটা আমাদের জন্য ভালো। সবার জন্যই ভালো। শেষ বয়সে এসে মেয়েটার ঘৃণা নিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না। তাই বন্ধু হয়ে বন্ধুর প্রতি এই দয়াটুকু কর। এতে আমরা সবাই’ই ভালো থাকবো।
জয়তুন বসে আছে চুপচাপ। সব সময়ের মতো বসার ঘরে। সব সময়ের মতো বসলেও, সব সময়ের মতো অবস্থা তার নেই। উপরে যতোই শক্ত দেখাক, আলাউদ্দিনের মৃত্যু জয়তুনকে ভেঙেছে। ভালো ভাবেই ভেঙেছে। আর কেউ না বুঝুক, আম্বিয়া বুঝে। এই যে সকাল থেকে একা একা হাঁটতে পারছে না। দাঁড়ালেই শরীর কাঁপছে। আম্বিয়া বলতে গেলে একেবারে জড়িয়ে ধরে বসার ঘরে এনে বসিয়েছে। তার মধ্যে সকাল গড়িয়ে দুপুর গড়িয়ে এলো। না ছোট চাচা বাড়ি ফিরেছে, না এরশাদ। এমনকি কোন খবর পর্যন্ত নেয়নি। অথচ জয়তুনের একটু মুখের রং বদল হলেও এরা দুনিয়া লুটিয়ে ফেলতো।
অবশ্য আম্বিয়া নিজেও অবাক হয়ে আছে। ছোট চাচা যেমন তেমন, তবে এরশাদ ভাই, সে তার প্রিয় দাদিকে ভুললো কি করে? অসুস্থ ছিল বুঝেছে। রাত বিরাত, পাশাপাশি থাকে বিপদে ডেকেছে গেছে। তাই বলে মাথায় করে নিয়ে বসে থাকতে হবে? কিছু একটা ঠিক নেই, কি নেই?
তখনি সাবিহা এলো। পৃথিলার টেনশনে চোখ মুখ শুকিয়ে আছে। অবশ্য ইমরান সকালে খবর পাঠিয়েছে। তবুও সে তো যেতে পারছে না। বাড়িতে তো কেউ নেই। মেয়েটাকেও কার কাছে রাখবে? এর মধ্যে আবার জয়তুন দাদি ডেকে পাঠালো।
সাবিহা ভাবলো আলাউদ্দিন ফকিরের জন্য দোয়া পড়াবে। হয়তো তাকেও থাকতে বলবে। কিন্তু সাবিহাকে অবাক করে জয়তুন শান্ত ভাবে বললো, — তোর কি মাথা গেছে রে সাবিহা?
সাবিহা বুঝতে পারে না। তাই একটু হেসেই বললো, — কি হইছে দাদি?
জয়তুন ইশারায় বসতে বললো। সাবিহা স্বাভাবিক ভাবেই এগিয়ে বসলো। বসতেই জয়তুন বললো, — স্বামী ছাড়া মাইয়া নিজের মায়ের পেটের বোন হলেও বিশ্বাস করতে নাই। বোন জামাইয়ের সাথে ইটিশ পিটিশের কতো নজির আছে। আর এখানে কোথাকার কোন সখী। আক্কেল কি বেইচা খাইছোস নি?
সাবিহা মুখে কথা আসে না। স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। আল্লাহ! কি নোংরা কথা। পৃথিলাকে না চিনুক, ইমরানকে তো তারা ছোট বেলা থেকে চেনে।
জয়তুন হালকা হাসলো!হেসে আম্বিয়াকে ইশারা দিলো পান বানাতে। দিয়ে বললো, — সুখে থাকলে ভূতে কিলায়। তোকে দেখে আমায় এইটাই মাথায় আইল। আচ্ছা ঠিক আছে। ইমরানরে আমরা চিনি, তয় এলাকার মানুষরা ভালো চোখে দেখবো? ও তো সারেং বাড়ির জন্য এখনো কেউ আঙুল তুলে নাই। তাহলে এমন মাইয়া, তার মধ্যে নাই মুরব্বি মাথার উপরে । একই ছাদ, একই ঘর। তুই বল কেমন দেখায়?
সাবিহার মনে হলো কেউ তার গলা চেপে ধরেছে। তবুও অনেক কষ্টে বলতে চাইলো। পৃথিলা ওমন মেয়ে না। তবে জয়তুন শুনলে তো। সে হাত উঠিয়ে ফেরালো। ফিরিয়ে বললো — যাই হোক। তোদের আমি কখনোও আলাদা ভাবি নাই। আমার কাছে বীণা যেমন, তুইও তেমন। এরশাদ, শাহবাজ যেমন ইমরানও তেমন। তাই সোজা’ই বলছি। এই সব ব্যাপারে আঙুল উঠলে ভাই জয়তুনরে পাবা না। কেলেঙ্কারির ঘটনায় জয়তুন নাই। তাই যত তাড়াতাড়ি পারো ব্যবস্থা নাও। পরে বইলো না, সময় থাকতে সাবধান করলাম না।
সাবিহা শূণ্য দৃষ্টিতে জয়তুনের দিকে তাকিয়ে রইল। সে প্যাচ বুঝে না, তবুও জয়তুনের সোজা ইঙ্গিত ঠিক বুঝলো। বুঝলো বলেই উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়াতেই জয়তুন বললো, — আমার কোন কথা মনে নিও না। ভালো চাই, তাই বললাম। যাগগে, আলাউদ্দিনের জন্য দোয়া পড়াবো। তুমি কিন্তু সেইদিন চুলায় আগুন দিও না। বিয়ান হইতে এখানেই থাইকো। সবাই মিলাই থাইকো।
সাবিহা হ্যাঁ, না কিছুই বললো না। তার ভেতর থেকে কেন জানি কাঁপুনি আসছে। বিয়ের পরে গ্রামের সারেং বাড়ি নিয়ে কতো কিছু শুনেছে। তবে তাদের কোন প্রকোপে তাকে পড়তে হয়নি। বরং ভালো সম্পর্ক’ই ছিল। তবে আজ ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠল। আর উঠল বলেই চুপচাপ চলে গেলো।
সেই চলে যাওয়া জয়তুন চুপচাপই বসে দেখল। দেখলো আয়নাও। সাবিহার কাছে পৃথিলার খোঁজ জানতে এসেছিল, অথচ এসে এক নিকৃষ্ট জগতের নিকৃষ্ট মানুষদের দেখলো। যারা কতো সহজে মানুষকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে। আর দেখলো বলেই, কিছু দৃশ্য, কিছু অনুভব, যেন চুপিচুপি বলে গেল অনেক কিছু’ই। কথায় আছে না, বয়স মানুষকে শেখায় না, শেখায় সময়। এই যে আয়না কয়দিনেই কতোকিছু শিখছে। আর শিখছে বলেই, ঐ যে শান্ত মুখে বসে থাকা জয়তুন আরা, তার দিকে তাকিয়ে রইল সে নিজেও। সমান নীরবে, সমান গভীরে।
চলবে……
#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব-৩০
পৃথিলা মোটামুটি ঠিক হলো দুপুরের পরে। ঠিক হতেই এক রাশ অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরলো। অচেনা আজানা কতোগুলো মানুষ তার জন্য কতো কিছু করে ফেলেছে। ইশ! এই দায় থেকে বাঁচবে কি করে?
জাফর পৃথিলার অবস্থা বুঝলো। না বোঝার কিছু নেই। মেয়েটাকে একটু একটু হলেও কিছুটা চিনতে পারছে । তাই হেসেই বললো, — কখনও সুযোগ হলে সুধে আসলে শোধ করে দিও কেমন?
পৃথিলা তখন হেসেছে! বলতে গেলে মলিন মুখে প্রাণ খোলা হাসি। হেসেই বললো, — আমার সেই সাধ্য নেই। আমি খুব’ই সাধারণ একজন। তবুও এই সাধারণ একজনের জন্য এতো করলেন। তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
জাফর কিছুক্ষণ পৃথিলার ক্লান্ত চোখে মুখে নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল। যতোক্ষণ জ্ঞান ছিল না, ততোক্ষণ অসংখ্য বার মাথায় হাত রেখেছেন। এই সুযোগ যে আর কখনও আসবেনা, সে জানে। তবুও আবার এই যে ক্লান্ত মুখটা। এই মুখটায় পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করলো। আর বলতে ইচ্ছে হলো, — তুমি যে কি মা, নিজেও জানো না। এই যে বিশাল এক শূণ্যতা নিয়ে বেঁচে থাকা একজন মানুষ, তার হৃদয়ের এক টুকরো স্বস্তির আলো তুমি। যে আলোর দিকে তাকিয়ে আজকাল শান্তির নিশ্বাস ফেলি।
তবে মুখে বললো, — আমরা আসলে কে যে কি, তা কেউ’ই জানি না। তবে তোমার ধন্যবাদ গ্রহণ করা হলো। আর এতো অস্বস্তি হওয়ার কিছু নেই। মানুষের পাশে মানুষ থাকবেই।
পৃথিলা আগের মতোই হাসলো। আর হাসতে হাসতে’ই চোখ গেলো কেবিনের বাহিরে। ডাক্তারের সাথে এরশাদ কথা বলছে। বলতে বলতে এক পলক তাকালো। তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই চোখ ফিরিয়ে নিলো। নেওয়াটা’ই স্বাভাবিক! তবে পৃথিলার স্বাভাবিক মনে হলো না। এই চোখ, এই চোখ অন্য কিছু বলে। আর এই যে সুস্থ হয়েছে বলতে গেলো অনেকক্ষণ। আর এই অনেকক্ষণের মাঝে লোকটা একবারের জন্যও কেবিনে আসেনি। অথচ স্বাভাবিক কর্মকান্ড হলে, যে রোগী নিয়ে এতো দৌড়াদৌড়ি, একটু সুস্থ হলে সর্ব প্রথম তাকেই এসে দেখা।
পৃথিলা নিজেও চোখ ফিরিয়ে নিলো। নিতেই এরশাদ তাকালো। আর যতোক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে কথা বললো। একপলকে তাকিয়েই রইল।
মিঠাপুকুরের আকাশে আজ মেঘের ঘনাঘটা না থাকলেও, সারেং বাড়িটা যেন থমকে আছে। সব কিছুই ঠিক, চলছে নিজ ছন্দে। তবুও যেন কিছু একটা ঠিক নেই। অথচ সব সময়ের মতো জয়তুন দুপুরে খাবার খেয়েছে, খেয়ে কিছুক্ষণ নিজের রুমে গড়াগড়ি করে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নিজের রুমেই গিয়েছে। তবে সেই যাওয়াও যেন কিছুটা অন্য রকম। বীণাও আছে তার মতো, রাতে ঘুমায়নি তাই সারাদির রুম থেকে আর বেরও হয়নি। তবে আম্বিয়া আছে মহা ব্যস্ত হয়ে। তারতো আর বসে থাকলে চলে না। এতো বড় সংসারের ঘানি ঘাড়ে। তার মধ্যে আবার আলাউদ্দিনের আয়োজন। ঝামেলা তো কম না। তবে সে জানে এরশাদ ভাই আসলেই সব কাজ পানির মতো হয়ে যাবে। সব কাজ সুন্দর মতো করে ফেলার গুণ তার আছে। তবে ভেতর বাড়ি তো তার ঘাড়েই। তার মধ্যে কুটুম বাড়ি থেকে মানুষ আসবে। আগের সম্পর্ক এক ছিল, এখন হবে মেয়ের বাড়ির কুটুম। এক দুই পদ পিঠা সামনে না রাখলে তো মান ইজ্জত যাবে। তাই তো চাল ভিজিয়েছে। বিকেলে ঢেকিতে কুড়োবে। সেই আয়োজন করছে ব্যস্ত হয়ে।
আর আয়নামতি আছে তার তোষক বালিশ নিয়ে। অবশ্য নিজ হাতেই জগ ভর্তি পানি ঢেলে ভিজিয়েছে। শয়তানটা বুঝে নি। বিনা কারণে ধমক দিলো কেন? নিজেদের বেলা ঠিক ষোল আনা, অন্যের বেলা এক আনাও নেই। কথায় কথায়, “মিথ্যা বলেছিলে কেন? নাটক করছিস কেন? ” আর এদিকে একেকজন দুনিয়া ফালাফালা করে ফেলছে, তাতে কোন দোষ নেই। তাই ভেবেছিল, নে এবার ঘুমা, ভেজা বালিশ, কাঁথায় সাঁতরে সাঁতরে ঘুমা। অবশ্য যেমন ভেবেছিলো তেমন লাভ হয়নি। তখনি বুড়ি ডেকে পাঠিয়েছে। আর ডাকতেই চলে গেছে। ফিরেছে একেবারে দুপুরের কাছাকাছি। ফিরে কয়টা নাকে মুখে খেয়ে অন্য রুমে চুপচাপ শুয়ে পড়েছে। এতো বড় সারেং বাড়িতে রুমের অভাব কি আর আছে। বরং মানুষের চেয়ে থাকার জায়গা বেশি।
তাই নিজের কপাল আয়না নিজে’ই চাপড়েছে। কোন দুঃখে পানি ঢালতে গিয়েছিল। এই যে নিজের দম’ইতো বের হচ্ছে। অবশ্য আম্বিয়াবু কে বলতেই প্রথমে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়েছে। তাকানোর কারণ আছে, ঐ শয়তারটা না বুঝলেও, পুরো বাড়ির কোণা কাঞ্চি আম্বিয়াবুর নখদর্পণে। তাই জালানা যতোই খোলা থাক, যতোই ঝড় বৃষ্টি হোক, বিশাল রুমের খাট পর্যন্ত যাওয়ার কথা না। আর গেলেও আশপাশ ভিজবে তবে তোষক না। তবে কিছু’ই বলে নি। বাইরে থেকে জয়তুন বুড়ির দু’জন লোককে ডেকে এনেছে। এনে সুন্দর মতো ছাদে তুলেছে। তুললে কি হবে, সব ঝামেলা তো তার উপর দিয়েই যাচ্ছে। তাছাড়া এতো সহজে কি আর শুকায়? রোদ উঠেছে নাম মাত্র। অনেক কষ্টে উল্টে পাল্টে শুকানো।
এই পুরো বাড়িতে সারেং বাড়ির নাতিদের থাকার জায়গার অভাব না হলেও, তার আছে। তাই তো এই কষ্ট। তাই সেগুলোই এখন আবার নামানোর আয়োজন করছে। আর সেই আয়োজনের ধুম ধারাক্কায় শাহবাজের গাঢ় ঘুম যে পাতলা হচ্ছে, আয়না বুঝতেই পারে নি। কেনানা শাহবাজ ঘুমিয়েছে একেবারে সিঁড়ির সাথের রুমে। সিঁড়ি দিয়ে উঠা নামা সব তার কানে যাচ্ছে। আর যাচ্ছে বলেই বিরক্ত নিয়ে ফট করে চোখ খুলে তাকালো।
আর তাকিয়েই ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে দরজা খুললো প্রায় ধরাম করে। সকাল থেকে সে ছিল দৌড়ের উপরে। সংসারের কাজের ঝামেলায় সে অভ্যস্ত না। সব করে এরশাদ ভাই। তবে সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তাদের কারো খবর নেই। দাদি সব ফেললো তার ঘাড়ে। সেগুলে করতে করতেই মেজাজ তার তুঙ্গে। সেই তুঙ্গে যাওয়া মেজাজ নিয়েই বাইরে এলো। আর আসতেই তুঙ্গে যাওয়া মেজাজে আগুন লেগে গেলো।
কেননা তাদের বাড়ির দু’লোক ধরাধরি করে তোষক নামাচ্ছে। নামাক সেটা তার সমস্যা না, সমস্যা হলো তাদের সাইডে এক সিঁড়ির উপরে’ই আয়না দাঁড়িয়ে। দু’হাতে মুঠোকরে বুকে দু’টো বালিশ চেপে ধরে রেখেছে। গায়ে সকালের ফিরোজা রঙের’ই কাপড়। তবে এখনো মাথায় ঘোমটা নেই, হয়ত দৌড় ঝাপে পড়েছে। তবে দু’হাত বালিশ ঝাপটে ধরে রাখার জন্য আঁচল কিছুটা বেঁকেছে। আর বেঁকেছে বলেই, ফর্সা কোমরের কাছটা সকালের মতোই উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে।
হাজার বৈরিতা থাক, হাজার ঘৃণা থাক। কবুল, কবুল’ই। আর নিজের জিনিস নিজের’ই। কেননা কবুলের শক্তি ঐ যে কালো জাদুর মতো। ফট করে তো ঘাড়ে চাপে। তবে কাজ করে খুব ধীরে ধীরে। মানুষ বুঝেনা, দেখেনা তবে এমন কাবু করে। চাইলেও মোহ কাটা যায়না। আর শাহবাজ স্বীকার না করুক, নিজের অহমের কাছে মাথা নত না করুক। সে যে এই মোহে্ পড়েছে অনেক আগেই তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই যেই উঁকি ঝুঁকি মারা কোমর সকালে তার সামনে ঠিক থাকলেও, এখন তার কাছে বড়ই বেঠিক লাগলো।
আর লাগলো বলেই শাহবাজের মেজাজের বারুদে আগুন ঠিক লেগে গেলো। গিয়ে অবশ্য আয়নাকে কিছু বললো না। ঐ যে বুকে মাথা রাখলো। তখন থেকে কিছু বলতে গায়ে লাগছে। তা না হলে শাহবাজের হাতে গরম দুধ ফেলা, তার তোষক বালিশকে পানি দিয়ে গোছল। চুপচাপ বসে থাকতো? আছড়ে না ব্যাঙ বানিয়ে ফেলতো।
তাই ধড়মড়িয়ে এগিয়ে গেলো। গিয়ে শরীরের সব শক্তি দিয়ে তোষক ছুঁড়ে মারলো।
আয়না হতবাক হলো। হয়ে যেখানে ছিল সেখান থেকেই নিচে উঁকি দিলো। তোষক একেবারে ধরাম করে বসার রুমে গিয়ে পড়েছে। এই শয়তানের আবার হলো কি? দেখতো! এখন আবার টেনে উপরে কে তুলবে? ধুর! এমনিতেই সকাল থেকে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে তার জান শেষ। তার হতবাক বিরক্তিতে পরিণত হলো। এই বাড়ির জ্বালা যন্ত্রণা আর ভালো লাগে না। কিছু করতে যাও তাও দোষ, না করতে যাও তাও দোষ।
জয়তুনের লোকও হতম্ভব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি করবে দিশে পাচ্ছে না। তাই একবার আয়না, একবার শাহবাজের দিকে তাকালো। শাহবাজ তার মতোই বললো, — লাথি খাইবার না চাইলে ভাগ।
জয়তুনের লোক কিছু বলবে তার আগেই আয়না বললো, — ভাগ মানে? এই তোষক এখন কে উঠাবে? ছাদে আরেকটা আছে। আমাকে মেরে ভূত বানিয়ে ফেললোও আমার দ্বারা সম্ভব না।
শাহবাজ আয়নার কথার উত্তর দিলো না বরং এই কালনাগিনী কথা বলতে গিয়ে বালিশ দু’টো আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। এমন ভাবে আঁকড়ে ধরছে, যেন হীরে জহরতের বাক্স। আর সেই বাক্স আঁকড়ে ধরতে গিয়ে তার নজরে অন্য কিছুই পড়লো। আর পড়তে’ই আগুন চোখে জয়তুনের লোকের দিকে তাকালো। এই বেচারা রা আয়নার দিকে ফিরেও তাকায়নি, তাদের সেই সাহস আছে? যে সারেং বাড়ির বউয়ের দিকে তাকাবে। জয়তুন চোখ উপড়ে ফেলবে না। তাই তারা কিছু’ই বুঝলো না। তবে এবার ঠিক চলে গেলো। আর যেতেই শাহবাজ একবার আয়নার দিকে কটমটিয়ে তাকালো, তাকিয়ে নিজের মতো আবার সেই রুমের দিকে গেলো।
আয়না শান্ত চোখে’ই যাওয়া দেখলো। তার শান্তি এই শয়তানের সহ্য হয় না, সে জানে। আরামে আরামে কাজ করবে এটা বুঝি সহ্য হবে? খাটাশের ঘরে খাটাশ।
বলেই নিজের মতো রুমে গিয়ে বালিশ রাখলো। ভেতরের টা আম্বিয়াবুর নজরে পড়লেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তবে ছাদের তোষকের করবে কি? তাই মুখ গোঁজ করেই আবার ছাদে এলো। তোষক নিয়ে কতোক্ষণ টানাটানি করলো। দুনিয়া উল্টো গেলেও তার দ্বারা সম্ভব না। তাই তোষকের উপরেই পা ছড়িয়েই কিছুক্ষণ বসে বসে বিকেলের আকাশ দেখলো। দেখে সাবিহাদের বাড়িতে একটু উঁকি ঝুঁকি মারলো। পৃথিলা আপাকে নিয়ে ফিরছে না কেন সবাই। খবরতো এসেছে জ্বর নাকি কমেছে, তবে? তার খুব ইচ্ছে একটু দেখতে যাওয়ার। তবে এই বাড়িতে তার ইচ্ছের মূল্য দেবে কে?
তাই উঁকি ঝুঁকির পরে ছাদ থেকে কতোগুলো লাল চন্দন কুড়ালো। সাইডেই বিশাল গাছ।ছাদে কি সুন্দর বিছিয়ে থাকে। সেই বিছানো থেকেই নিয়ে কতগুলো আঁচলে বাঁধলো। ছোট বেলা কোথায় কোথায় থেকে কুড়িয়ে আনতো। এনে নারিকেল তেলের বোতলে রাখতো। আর এখন কতো, ছুঁয়ে দেখার সময়ও নেই।
তাই কতগুলো আঁচলে বেঁধে ফিরে যাবে তখনি দেখলো শাহবাজ উঠে আসছে। আগের মতোই চোখে মুখে বিরক্তের রেখা। সেই রেখা নিয়েই আঙুল তুলে আয়নাকে ডাকলো।
আয়না ভয়ে ঢোক গিললো! দোতলা, ছাদ পুরোই খালি নিস্তব্ধ। ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দিলে কেউ জানবেও না, এই শয়তানের কারসাজি। তাই ঢোক গিলেই শান্ত ভাবে এগিয়ে গেলো। বেশি না অবশ্য এই দু’তিন কদম।
আয়না দু’তিন কদম এগুলোও শাহবাজ বাকিটুকু এগুলো। এগিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই কোমরের দিকে ঘাড় কাত করে তাকালো। আয়না প্রথমে বুঝলো না। তাই শাহবাজের সাথে সাথে নিজেও কাত হয়ে তাকালো। তাকাতেই তার নজরে পড়ল, নেয়ে ঘেমে বিন্দু বিন্দু ঘাম নিয়ে চিকচিক করা তার ফর্সা কোমর। আর নজর পড়তেই আবারো ঢোক গিললো। গিলে ফট করে সোজা দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে আঁচল টেনে ঢেকে মুঠো করে ধরলো।
শাহবাজ সব ঢং’ই দেখলো। দেখে তার সেই চিরচেনা হাসি দিয়ে বললো, — আহা ঢাকছো কেন? এই দেড় ইঞ্চি কোমর আমাকে দেখাবার জন্যই তো জায়গার কাপড় জায়গায় থাকে না। দেখি হাত সরাও, ভালো ভাবে দেখি।
আয়না কোমরের কাপড় আরো শক্ত করে মুঠো করলো। করে সাথে সাথে’ই দু’কদম পেঁছালো।
আয়না যেমন দু’কদম পেঁছালো, শাহবাজও দু’কদম এগুলো। এগিয়ে তার মতোই বললো, — এই রং ঢং দেখিয়ে আমার মাথা খারাপ করতে’ই তো চাও, আমি বুঝিতো। লেদা বাবু তো আর না। তোমার মতো তিন চার আয়না আমি এমনিই হজম করতে পারি। তবে সমস্যা হলো তোকে পারছি না। গলায় কাঁটার মতো বিঁধে গেছিস। এখন না পারি ঢোক গিলে হজম করতে, না পারি টেনে বের করতে।
শাহবাজের একবার তুমি, একবার তুইতে আয়নার গলা শুকিয়ে এলো। আবার মাথা বিগড়েছে ঠিক বুঝলো। আর যখন বিগড়ে তার উপর দিয়ে ঝড় যায়। আল্লাহ রক্ষা করো। কিন্তু এখন করেছে টা কি? সকালে করলেও এক কথা ছিল। বালিশ তোষক ভিজিয়েছে। তাছাড়া কথা সত্য তখন তাকে জ্বালানোর জন্য’ই কোমর ঠিক বের করেছিল।
শাহবাজ আরেকটু এগুলো। আয়না আরেকটু পেছানো। পিছিয়ে আস্তে করে বললো, — দিন দুপুরে তাড়ি খেয়েছেন আপনি?
— না কালনাগিনী! আপনার কাছে এলে আমি সব সময় মাথা ঠিক করে আসি। জানি তো মাথা নষ্ট করার জন্য দু’পায়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
আবার আপনি! আয়না হাল ছাড়লো! ছেড়ে বললো — দেখেন কথায় কথায় এতো হাবিজাবি বলবেন না। তাছাড়া আমার কোন দরকার জাদু টোনা করার। আমি এমনিও সারেং বাড়ির বউ, ওমনিও সারেং বাড়ির বউ।
— কথা সত্য। তাহলে বাড়ির কামলাদের মাথা চিবুতে গেছেন কেন?
আয়না অবাক হলো! অবাক হয়ে বললো, — কি?
— এতো সাধু সেজে তো লাভ নেই। সুন্দরী, রুপসী রুপের আগুনে জ্বলে। সেই জ্বালা নেভাতে বুঝি?
আয়না উত্তর দিলো না। তবে তার গোল গোল চোখে পানি চিকচিক ঠিক করলো। শাহবাজ সেই চিকচিক করা পানি দেখলো। দেখে আসলেই বুঝলো এই মেয়ের শান্তি তার হজম হয় না। এই যে এখন কতো আরাম আরাম লাগছে। লাগছে বলেই হাসলো। হেসে স্বাভাবিক ভাবে তোষকের কাছে গেলো। মুরিয়ে ঝট করে কাঁধে তুললো। তুলতে তুলতে বললো, — সারেং বাড়ির রুপসী বউ, এসে একটু সাহায্য করেন। যদি সিঁড়িতে উল্টে পড়ি। তোষকে পানি ঢালার জন্য ওই দেড় ইঞ্চি কোমর মুচড়ে ভাঙবো।
আয়না কিছু বললো না। শান্ত ভাবেই এগিয়ে গেলো। গিয়ে পেছন থেকে ধরলো। শান্ত ভাবে ধরলেও তার শরীর জ্বলছে। মানুষ মনে করে নাতো এরা। যখন যা মন চায় তাই বলে। সেই বলায় সামনের জন মরলো বাঁচলো তাতে তাদের কিছু আসে যায় না। আর যায় না বলেই সেই দিন মাথার বাড়িটা ফেরানোর জন্য আফসোস হলো। মহাজন চাচা’ই ঠিক। এদের প্রতি দয়া করলে কি হবে, এরা কারো প্রতি দয়া করে না।
আর এই দয়াহীন মানুষের জন্য আয়নার ভেতর থেকে ঘৃণা উপচে পড়লো। আর পড়তে পড়তেই তার নজর গেলো শাহবাজের পায়ের দিকে। ভারী তোষক! কাঁধে নেওয়ার জন্য নিচে না দেখে’ই হনহনিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
আয়নার তখন কি হলো কে জানে। আঁচলের বাঁধটা মুখে নিয়ে খুললো, খুলে চন্দন গুলো হাতে নিলো। নিতেই মহাজন চাচার একটা কথা কানে বাজতে লাগলো — মেয়েরা চাইলে সব পারে।
আর তখনি মুঠোর চন্দনগুলো আস্তে করে সিঁড়িতে ছড়িয়ে দিলে। আর দিতেই শাহবাজের পায়ের নিচে পড়লো। আর পড়তেই শাহবাজ তোষক নিয়ে উলটে পড়লো।
আর পড়তেই আয়নার কলিজা খাবলে উঠল। গ্রামের সিধেসাদা মেয়ে। যে যতোই খারাপ থাক। কারো ক্ষতি তো চাইতে পারে না। আর পারে না বলেই সেই দিন যেমন ঠিক মূর্হুত্বে মত ঘুরে গিয়েছিল, আজও গেলো। আর যেতেই দৌড়ে ধরতে গেলো। আর গেলো বলেই যে চন্দন শাহবাজের জন্য ছড়িয়ে দিয়েছিল সেই চন্দনে তার পাও হড়কে গেলো।
উলটে পড়ায় শাহবাজের তেমন কিছু হয়নি। তবে আয়নাকে পড়তে দেখে উঠে দাঁড়ানোর আগেই জাপটে ধরলো। সোজা সিঁড়ি, ধরে আর ব্যালেন্স রাখতে পারলো না। দুজনেই গড়িয়ে পড়লো। এই গড়িয়ে পড়ায় আয়নার কিছুই হলো না। সে রইলো শাহবাজের বুকে, দু’হাতের শক্ত দেয়ালের মাঝে। তবে শাহবাজ পড়ার সময় এক পাশ ঘুরে রেলিংয়ের ধারে এক হাত ধরাম করে লাগলো।
চলবে……