ধূপছায়া পর্ব-৩৮+৩৯+৪০

0
5

#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৩৮

মিঠাপুকুরের আর পাঁচ দশটা সকালের চেয়ে আজকে সকালটা ভিন্ন। বেলা তো হচ্ছে তবে সূর্য এখনো উঁকি দিতে পারেনি। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে আছে। মাঝরাত থেকে মিহি দানায় গুঁড়ি গুঁড়ি অবিরাম বৃষ্টি, পড়ছে তো পড়ছে।

পাকা ঘরে সেই বৃষ্টির গান বাজে না, তবে এই যে গায়ে শীত শীত একটা আমেজ, এই আমেজটাই বৃষ্টির স্বাদ ঠিক বুঝিয়ে দেয়। আর দেয় বলেই এরশাদের শেষ রাতের ঘুমটুকু গাঢ় হয়েছে। অবশ্য বলতে গেলে এখন প্রায় প্রতিদিন’ই ঠিকঠাক ঘুম হচ্ছে।

রাতে সে ঘুমোতে পারে না। ঘুমোলেই চোখের সামনে ভাসে শুধু রক্ত আর রক্ত। কত রাত গেছে নির্ঘুম। নির্ঘুম থাকতে থাকতে শুষ্ক চোখেরা শেষ রাতে ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ে। সেই লুটিয়ে পড়াও কিছুক্ষণের। তার পরেই ভয়ংকর এক আতঙ্ক নিয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে, গলা শুকিয়ে আসে। চোখের সামনে ভাসতে থাকে বাবা, মায়ের মুখটা। যেই মুখ দেহ থেকে বিছিন্ন হয়ে আছে, চোখ দুটো খোলা। সেই শান্ত চোখ দু’টোতে দেখে কষ্ট, মৃত্যুর যন্ত্রনা। তখন তার অস্থির শুরু হয়, আর হলেই সবাইকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে।

আর এই অস্থির মাখা রাতের পর রাত গেছে এই যে চার দেয়াল, এই দেয়ালের মাঝে ছটফট করতে করতে। আর সেই করার যখন সে অভ্যস্ত, তখন একটা জাদুর ছোঁয়া। সেই ছোঁয়ায় অনেক দিন পরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে গেছে। গাঢ় ঘুম! যেই ঘুমে আতঙ্ক নেই, ভয় নেই, জ্বলে যাওয়ার যন্ত্রনা নেই। সেই রাতটা ছিল যেদিন পৃথিলা মিঠাপুকুরে পা রেখেছে। নৌকা থেকে পানিতে পড়লো। সাঁতার জানে না, তার মধ্যে হঠাৎ এক ধাক্কায় পড়েছে। ভয়, আতঙ্ক, কাপড় সব মিলিয়ে তখন সে হুটোপুঁটি খাচ্ছে। সে টেনে বুকে জড়িয়ে নদীর পাড়ে নিলো। তখনো একটা হাত তার বুকে। বুকের শার্টটা শক্ত মুঠো করে ধরা। ধরেই হাতে মধ্যে শুয়ে থরথর করে কাঁপচ্ছে।

তখনই কিছু একটা হলো। সেই থরথর করে কাঁপা যেন তার শরীরের প্রতিটা কোণায় কোণায় পৌঁচ্ছে গেলো।আর গেলো বলেই তার হারিয়ে যাওয়া শান্তির ঘুম অনেক দিন পরে চোখে এসে জমা হলো। এত ঝামেলায় কেউ খেয়ালই করেনি, এরশাদ সেদিন কত বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। ঘুম থেকে উঠেছে একেবারে তার দাদির সালিশের ঝংকারে।

তার এই অভিশপ্ত কলঙ্ক মাখা জীবনে কাউকে জড়াতে চায়নি। কোন মেয়েকে দেখে জড়াতে ইচ্ছেও হয়নি। তার জীবনের একটাই উদ্দেশ্য ছিল। সেই বাকি দু’তিনজনকে খুঁজে বের করা। তাদের সামনে তাদের প্রিয় মানুষকে খুন করে যেই যন্ত্রনা দিয়েছে। সেই যন্ত্রনা তাদের চোখেও দেখা। তারপরে তার যা খুশি হোক আর আফসোস নেই। এমনিতেও প্রতিদিন মরে সে। তবে সেই মৃত শরীরকে অদৃশ্য এক মোহে হুট করেই এই মেয়ে তাকে জড়িয়ে ফেলেছে। এই জড়িয়ে ফেলায় অচেনা এক তৃষ্ণায় কাতর হলো। সেই তৃষ্ণা তার কমে না, বরং সেকেন্ডে সেকেন্ডে বেড়েছে। বেড়েছে বলেই আগে ঘুমের জন্য ছটফট করেছে, আর এখন এই মেয়ের জন্য করে। করে বলেই এই যে তাকে চম্বুকের মতো টানে। এই যে ঘুম ভেঙেছে, এখনো টানছে।

আর টানছে বলেই এরশাদ ঝট করেই উঠে বসলো। তার রুমটা ছোট, ছোট একটা জানালা। বাড়ির একেবারে পেছনের কোণায়। তাই আলো আসে না বললেই চলে। তার মধ্যে আজকে সূর্য উঠেনি, পুরোই অন্ধকার। এই অন্ধকার ভরা রুমটা সে নিজ ইচ্ছায় নিয়েছে। আলো তো চোখে বাজে, যদি এই অন্ধকার একটু শান্তি দিতে পারে। আর সেই অন্ধকারে বসেই এরশাদ ঠোঁটে সিগারেট রাখলো। আগুন জ্বালিয়ে কয়েকটা টান দিলো।

রুম বদলাতে হবে তার। পৃথিলার খোলামেলা রুম পছন্দ, আলো পছন্দ, মৃদু বাতাস পছন্দ, আকাশ পছন্দ, খোলা জানালা পছন্দ। সেই জানালায় চাঁদের আলো পছন্দ, এই যে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, এই বৃষ্টিও পছন্দ।

আর এতো সব ভাবতে ভাবতেই এরশাদ ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। তার সকালগুলো পৃথিলা নামক মেয়েটিকে দিয়ে শুরু হবে কবে? সে সময় দিতে চাইছে, আবার অধৈর্য নিজেই হচ্ছে। এই অধৈর্যের বাঁধ টিকিয়ে রাখবে কী করে?

এরশাদ চিন্তিত ভাবেই হাতের মুঠোর সিগারেট নিয়ে নিচে নামলো। নেমে নিজের মতো বেরিয়ে গেলো। জয়তুন সব সময়ের মতো বসার ঘরে বসা। সে নিশ্চুপ তাকিয়ে দেখলো। আর দেখে হাতের সাইডে তার প্রিয় পানের পাতাটা রেগে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। আম্বিয়া দেখলো, দেখে মুখ বাঁকিয়ে হাসলো।

পৃথিলা সকালের খাবার খেলো স্বাভাবিক ভাবে। খেয়ে স্বাভাবিক ভাবেই ওষুধ খেলো। সেইদিন লাইব্রেরি থেকে দুটো বই নিয়েছিল। আর হাত দেওয়া হয়নি। এমন আবহাওয়ায় ঘরবন্দি মানুষের বইয়ের চেয়ে ভালো অপশন আর কী হতে পারে! তবে কোথায় রেখেছে, মনে করতে পারলো না। ফেরার সময় ভ্যানে এমন কাণ্ড হলো। সেই কাহিনীর মাঝে বই মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। তাই নিজের মতো ব্যাগে খুঁজে দেখতে লাগলো।

সাবিহা সবই দেখলো। খাবার খেয়েছে, সে খুশি। তবে এই স্বাভাবিক ব্যবহার তার হজম হচ্ছে না। তবে জিজ্ঞেস করবে, সেই ইচ্ছেও হলো না। থাক না নিজের মতো। তবে তাকে অবাক করে পৃথিলা খুঁজতে খুঁজতেই শান্ত ভাবে বলল,– টেবিলের ওপর একটা কাগজ আছে, পড়ে দেখ।

সাবিহা ভ্রু কুঁচকে টেবিলের দিকে তাকালো। সাথে সাথেই এগিয়ে গিয়ে কাগজটা হাতে নিলো। নিয়ে চোখ বোলাতেই বিস্ময় চোখে তাকালো। তার মাথায় ভালো মন্দ কিছুই এলো না। তবে এই ছেলে হচ্ছে জন্মগত ফাজিল! ফাজিল না হলে, কাউকে এমন ভাবে চিঠি লিখে? যেমন হাতে লেখা, তেমনি বাক্যের ছিঁড়ি, ছিঃ!

পৃথিলা সাবিহার চেহারা দেখলো। মুখটা মলিন, সেই মলিন মুখেই মৃদু হাসলো। হেসে বলল, — কী বুঝলি?

— কী বুঝবো! সাহায্য চেয়েছিস, তাই নিজ স্বার্থে’ই সাহায্য করছে। তা না হলে সেধে সাহায্য করবে এমন ব্যক্তি সারেং বাড়িতে নেই।

— না।

— কিসের না?

— তারা পথের কাঁটা সরাতে চাইছে না, বরং চিরতরে শেষ করতে চাইছে।

— মানে?

— ভাইয়ের সাথে ঝামেলা চায় না। তাই কাউকে বলতে নিষেধ করতেই পারে। তবে বিশেষভাবে তোদের নাম উল্লেখ করেছে। কেন করেছে জানিস? আমি বাইরে কাউকেই বলতে যাবো না। যদি বলি, সেটা তোদের। আর তোদের বলা মানে সাক্ষী থাকা। ধর আমি চলে গেলাম, নিজ ইচ্ছায়’ই গেলাম। তারা জানে এরশাদ আমাকে খুঁজে বের করবে। দুনিয়া এফোঁর ওফোঁড় করে হলেও করবে। তো তারা ঝুঁকি নেবে কেন? তাই যেহেতু কাউকে কিছুই বলিনি, হঠাৎ গায়েব হলে, এতো মানুষের মাঝে এরশাদ আঙুল উঠাবে কার দিকে? আর উঠলেও সবার আগে উঠবে তোদের উপর। কেননা থাকছি তো এখানেই। তোরা কিছুই জানিস না। তো সে আর তার দাদি অনায়াসেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে। খুব সুন্দর করে তোদের ফাসিয়েও দেবে। ভাই রইল, ঝামেলা গেলো। কাহিনী খতম।

সাবিহা হা হয়ে গেলো। হা হয়ে বলল, — তুই এক্ষুনি এই চিঠিটা এরশাদ ভাইকে দেখা। সব ওই বুড়ির কারসাজি। সে সাপ মারবে, লাঠিও ভাঙবে না। এই বুড়ি দুনিয়ার সেয়ানা। এরশাদ ভাইও জানুক তারা কী করছে।

— না।

— কেন?

— আমি এর শেষ দেখতে চাই।

— মাথা গেছে তোর? এরা তোকে শেষ করতে চাইছে!

— করুক।

— নিজের প্রতি রহম কর পৃথিলা। এরা তোকে বাঁচতে দেবে না।

— তো? এখানেও বুঝি আমি বেঁচে থাকবো? এখানে থাকলেও আমি মরবো, তবে ধুকে ধুকে। প্রথমে পৃথিলার রুহ্, তারপর অহম, তারপর সম্মান। আর এই মৃত্যুর চেয়ে ঐটা আমার কাছে খুব ভালো। তবে বিনা অপরাধে শাস্তি পাচ্ছি, কিছুটা শাস্তি সারেং বাড়িও পাবে।

সাবিহার কথা আসে না। কি বলে এই মেয়ে?
পৃথিলা বই পেয়েছে। ব্যাগেই ছিল, আর বের করা হয়নি। তাই নিয়ে জানালার পাশে বসলো। বসতেই ঐ যে সারেং বাড়ি আর এই বাড়ির সেতু, চিকন গলিটা। তার একটা গাছের পাশে, বৃষ্টিতে নীল রঙা শার্টে একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। কে সে, পৃথিলা জানে। এই কয়দিনে এতটুকু ঠিক চিনে গেছে।

পৃথিলা চোখ ফিরিয়ে নিলো। সে ভালো করেই জানে তাদের কোন কথা সেই পর্যন্ত যাবে না। তাই বইয়ে মনোযোগ দিতে দিতে বলল, — চিঠিটা যত্ন করে তুলে রাখ সাবিহা। দূর্বল মানুষের মুখের কথার দাম কই? তবে আমি যখন চলে যাবো, এই চিঠিটা সারেং বাড়ির বড় নাতির হাতে দিবি। সুন্দর করে নিজের হাতে’ই দিবি।

সাবিহা হতভম্ব। হতভম্ব হয়েই বলল,– এরশাদ ভাই সব ধ্বংস করে ফেলবে।

পৃথিলা উত্তর দিলো না। মুখের হাবভাবেরও তেমন পরির্বতন হলো না।তবে বইয়ে চোখ রেখেই আস্তে করে জানালার কপাটটা দিয়ে দিলো। এরশাদ সেই বন্ধ কপাটের দিকে তবুও আগের মতো’ই তাকিয়ে রইল। তাকিয়ে’ই সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে হাত দিয়ে তাদের লোকদের একজনকে এদিকে আসার ইশারা দিলো। দেওয়ার সাথে সাথে এগিয়ে এলো। আর আসতেই বলল,– গিয়ে দেখতো, খেয়েছে কি না।

লোকটা সাথে সাথে সাবিহার ঘরের দিকে গেলো। ফিরে এলো কিছু সময়ের মাঝেই। এসে বলল,– খাইছে ভাই।

সিগারেটের আগুনে পোড়া কালচে ঠোঁট দুটোয় হাসিরা ছুঁয়ে গেলো। সেই হাসির ছোঁয়া নিয়েই আর বাড়ির ভেতরে গেলো না, বাইরের দিকে এগুলো। চেয়ারম্যানের সাথে তাদের আলাদা ঝামেলা নেই। ইমরান তাদের সব জায়গা জমির হিসাব দেখে। তাই ইমরান জানালো, চেয়ারম্যান নাকি নদীর পাড়ে জায়গা নিয়ে ঝামেলা করছে। কিসের কাগজপত্র নাকি বের করছে। সেই জমি নাকি তাদের। সারেং বাড়ির মানুষেরা জোর করে ভোগ করছে। যদি ভালোয় ভালোয় জমি বুঝিয়ে দেয় ভালো। তা না হলে আঙুল বাঁকা করবে।

আঙুল বাঁকা নিয়ে এরশাদকে চিন্তিত দেখা গেলো না। এই জমি তাদের’ই। এক দাগের জায়গা। তার মধ্যে কয়েটা শুধু আজিজ চাচার আর চেয়ারম্যানের। তো পায়ে পাড়া দিয়ে হঠাৎ করে এমন ঝামেলার মানে কী?

—-

আয়না খাবার ঘর থেকে বেরুতেই দেখলো বসার ঘরে এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। জয়তুন আরার সাথে কিছু নিয়ে কথা বলছে। এই লোককে সে চেনে। আজিজ চাচার লোক। তার সাথেই সব সময় থাকে।

সে বেরুতেই তার দিকে তাকালো। তাকিয়ে হেসে বললো, — ভালো আছেন?

আয়না সাথে সাথে মাথা দোলালো। জয়তুন দেখে বলল, — নয়া বউ বীণার জুতা, আর ব্লাউজের মাপটা নিয়ে আসো তো। আজিজের বউ নাকি পাঠাইছে। তার বড় পুতের বউ সব নাকি শহর থেকে কিনবে। তাই মাপ চায়। ঢং দেখে আর বাঁচি না। আমাগো সদরে জিনিসের অভাব আছে। শ্বশুর শাশুড়ির খবর নাই, জামাই নিয়া দিছে উড়াল। এখন দেবরের বউ নিয়া আদিখ্যেতা। যাও তাড়াতাড়ি আইনা দেও। কিছুক্ষণের মধ্যেই নাকি রওনা দেবো।

আয়না বীণার রুমের দিকে গেলো। অনেক দিন পরে তার ঘর থেকে গুনগুন করে পড়ার শব্দ ভেসে আসছে। শুনতে ভালো লাগছে। এই বিয়ে নিয়ে ফরহাদ ভাইয়ের যেমন মাথা ব্যথা নেই, বীণারও নেই। একজন বাপের নেওটা আরেকজন লেখাপড়ার। বিয়ে পরে কি হবে আল্লাহ’ই জানে।

তাই আয়না এগিয়ে গেলো। বীণাকে অবশ্য জ্বালালো না। নিজেই এক জোড়ে জুতা নিলো,আলনা থেকে ব্লাউজ নিলো। কালকে পড়বে বলে আম্বিয়াবু সব বের করেছিল। এখনো গুছানো হয়নি। বীণাও ধরে নি! আম্বিয়াবু আবার রাগে গজ গজ করবে। তাই সেখান থেকেই একটা নিলো। বীণা পড়তে পড়তে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কাহিনী কি?”

আয়না ঠোঁট টিপে হাসলো! হেসে বলল,– চুরি করি।

বীণাও হাত তুলে ইশারা দিলো। নিয়ে যাও! পারলে সব নিয়ে যাও।

আয়না হেসেই একটা ব্যাগে ভরলো। ভরে বেরিয়ে এলো। এসে এগিয়ে দেবে তার আগেই লোকটা দু’কদম এগুলো। এগিয়ে হেসে হাত বাড়ালো। আয়না অবশ্য বুঝেনি, এই দু’কদমে জয়তুনের চোখের আড়াল হয়েছে। তাই ব্যাগ দিতে গিয়ে’ই একটু চমকালো। কেননা ব্যাগ নেওয়ার সাথে সাথে’ই ছোট্ট একটা কাগজ তার হাতে গুজা হয়েছে। আর বুঝতেই সাথে সাথে’ই নিজেকে সামলে নিলো।

জয়তুন দেখে বিরক্ত মাখা কণ্ঠে বললো, — এমন গায়ের উপরে উঠে যাচ্ছিস কেন রে হারামজাদা। সর আমার নাত বউয়ের সামনে থেকে।

লোকটা জ্বিহা কেটে কানে হাত দিয়ে সাথে সাথেই দূরে চলে গেলো। যেতে যেতে বলল,– কি যে কন আম্মা। আপনের নাত বউ, আমাগো মা জননী। মায়ের কষ্ট হবে তাই এগিয়ে গেছি।

— হ, হ জানা আছে তগো মা জননী। যা ভাগ।

লোকটা হেসেই বেড়িয়ে গেলো। আয়না আগের মতোই দাঁড়িয়ে বলল,– আপনার কিছু লাগবে দাদি?

— না! শাহবাজ কই?
— ঘুমে।
— কয়ডা বাজে এহন? আরেকটু পরে তো যোহরের আজান পড়বো।

আয়না উত্তর দিলো না। কালকে সে ঘুমিয়েছে আগে। এখন তো আর দরজায় খিল দেয় না। তাই জানে না শাহবাজ কখন এসেছে। কাল মেহমান যাওয়ার পর ইচ্ছেমত গোসল করলো। করে কয়টা খেলো। নিজের হাতেই খেলো। খেয়ে বেরিয়ে গেছে। সকালে ঘুম ভেঙে দেখে পাশে শুয়ে আছে। গাঢ় ঘুম। অবশ্য ঘুমালে এর দিন দুনিয়ার হুঁশ থাকে না। ঘুমায়ও খুব এলোমেলো ভাবে। কোথার সে, কোথায় লুঙ্গি তার খবরও থাকেনা। তাই আয়না এক ঝলক দেখে আর তাকায়ইনি। নিজের মতো উঠে চলে এসেছে। আর ওমুখো হয়ইনি।

— যাও ডাইকা তুলো। এক ওয়াক্তের খানাও তো ঠিক সময়ে খায় না।

আয়না দাঁড়ালো না! বলতে গেলে কিছুটা হনহনিয়ে’ই চলে এলো। অবশ্য রুমে গেলো না। ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। শয়তানটা জেগে থাকলে’ই তার অশান্তি । তাই সোজা চলে এলো ছাদে। এখনো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। ভিজে ভিজে একটা নরম ছায়া মেখে আছে চারপাশে। সেই ছায়ার মাঝেই সে চুপচাপ চিঠিটা খুলল। খুলে চোখ বুলালো। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই টের পেল, কেউ একজন পেছনে। আয়নার কলিজা কেঁপে উঠল। আর সাথে সাথেই কাগজটা মুড়িয়ে ব্লাউজের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেললো।

শাহবাজ পেছন থেকে সামনে এলো। তার চোখে মুখে ঘুমের চিহ্ন। মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে। বেরুবে, দেখলো এই রমণী হনহনিয়ে ছাদের দিকে যাচ্ছে। এই মেঘ বৃষ্টির দুপুরে ছাদে কি? তাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,–

— কি লুকালে?

আয়নার মাথা ঘোরা শুরু হয়ে গেছে। সে ঢোক গিলে বলল, — কই?

— মাত্রই দেখলাম কিছু একটা আপনার অতি মূল্যবান গোপন কুঠরিতে পাচার করলেন।

আয়নার গলা কাঁপছে, তবুও অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালো। সামলে কোন রকম বলল — একদম বাজে বকবেন না।

— তো কি বলবো? সত্য বললে আবার শাহবাজ বেশরম।

— কিসের সত্য, আমিতো এমনিই ঝাড়লাম।

— আচ্ছা দেখি।

আয়না দু’কদম পিঁছিয়ে গেলো। তবে শাহবাজ এগুলো, দাঁড়ালো আয়নার একদম মুখোমুখি। দাঁড়িয়ে বলল,– ঘুম থেকে উঠে এতো তেনাবেনা ভালো লাগে না। তাই আর একবার বলবো। তারপর ঊনিশ বিশ হলে আমার দোষ নেই।

আয়না ভয়ে ঢোক গিললো। এই তারছেঁড়া ভরসা নেই। তাই ভয়ে সব সময় যা করে তাই আজও করতে গেলো। শাহবাজকে এক ধাক্কা দিতে গেলো। অবশ্য লাভ হলো না। এতোদিনে এই মেয়েকে শাহবাজের চিনতে বাকি আছে আর। তাই ফট করে’ই সাইড হয়ে ডান হাতে কব্জি ধরে ফেললো। বেশ শক্ত করেই ধরলো। আরেক হাতে প্লাস্টার, এই মেয়ে যে তাকে উল্টো ফেলবে না, সেই গ্যারান্টি কি? বাসর রাতে ফেলেছে চেয়ার থেকে, সেই দিন সিঁড়ি আর আজ নির্ঘাত ছাদ। তাই শক্ত করে ধরেই বলল,– না দেখে আমি ছাড়ছি না।

আয়না কেঁদে ফেললো। শাহবাজ ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে বলল,– কেঁদে লাভ নেই। বের করো।

— কি বের করবো?

— যেটা লুকিয়েছো?

— মিথ্যা কথা।

— উঁহুম, আপনি মিথ্যাবাদী।

আয়না আর কিছু বলল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। সে তো মরে গেলেও বের করবে না। শাহবাজও তার মতো দাঁড়িয়ে রইল। একহাত গলায় আরেক হাত আয়নার কব্জিতে। আর গুঁড়ি গুড়ি বৃষ্টি তাদের দু’জনের উপরে পড়তে লাগলো অবিরত। এই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শরীরকে ভেজাতে পারে না। তবে মোহনীয় ঠিক করতে পারে। আর পারে বলেই, শাহবাজ আস্তে করে কব্জি ছেড়ে দিলো। দিয়ে মনে মনে দু’টো শব্দ’ই আবার বলল,– শালার প্লাস্টার।

চলবে…..

#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৩৯

টিফিনের ঘন্টা পেরুতেই ফরহাদ ক্লাস থেকে বেরুলো। চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। এই মেঘ বৃষ্টির দিনে কাদা পানি মাড়িয়ে স্কুলে আসা বিরক্তির কাজ’ই বটে। তার মধ্যে ছেলে মেয়েরা নামমাত্র এসেছে। এই নামমাত্র কয়জন ছেলে মেয়ে নিয়ে বসে থাকাও আরেক বিরক্তি। তাই সে তার বিরক্তির মেজাজ নিয়েই টিচার্স রুমে আসলো। আসতেই দেখলো এরশাদ বসে আছে।

তাকে দেখে ফরহাদ আবাক হলো না। সে জানতো এরশাদ আসবে। তার কাজ সব গোছানো। একটা মেয়ে চাকরিতে জয়েন করে ফট করেই আসা বন্ধ করা স্বাভাবিক না। হেড স্যারেরা খোঁজ অন্তত করবে। অবশ্য সে বলেছে অসুস্থ, তবুও এখন মনে হয় না আর চাকরি করতে পারবে। তাই এরশাদ সে ভাবেই এগুবো।

তাই ফরহাদ এখানে আর কথা বাড়ালো না। তার ড্রয়ার থেকে কয়েকটা সিট বের করে হাতে নিয়ে বলল,– আয় চা খেয়ে আসি।

এরশাদ বিনা শব্দেই উঠল। স্কুল থেকে বেরিয়ে একটু দূরেই চায়ের দোকান। সেখানে যেতে যেতে ফরহাদ হাতের সিটগুলো এরশাদকে এগিয়ে দিলো।

এরশাদ স্বাভাবিক ভাবেই নিলো। নিয়ে চোখ বুলালো। টেস্ট পরীক্ষার সাজেশন। স্কুল থেকে হয়ত দিয়েছে। বীণা তো স্কুলে আসছে না। হেড স্যারও জিজ্ঞেস করলেন। এরশাদ সব বুঝিয়ে বলল। হেড স্যারের অবশ্য কিছুটা মনঃক্ষুন্ন হয়েছে। তবে লেখাপড়া কথা শুনে খুশি হলো। গ্রামের ছেলে মেয়েদের গ্রামের ছেলে মেয়েদের মাঝেই বিয়ে হয়। ফরহাদ, বীণার বিয়ের কথা শুনে তেমন প্রতিক্রিয়া হলো না। তাছাড়া গ্রামের দুই’ প্রভাবশালীর ছেলে মেয়ের বিয়ে। কি’ই বা বলার আছে।

এরশাদ সাজেশন মোড়াতে মোড়াতে বলল,– আমার বোন ভালো থাকবে তো ফরহাদ?

ফরহাদও তার মতো বলল, — তোর বোন ভালো থাকবে কি না, সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করছিন কেন ? তাছাড়া বোনের ভালো চাইতে তো দেখলাম না। কি এক ঘোড়ার ডিম বিয়ের প্রস্তাব গেছে। পুরো গুঁষ্টি উঠে পড়ে লেগে গেছে বিয়ে দিতে।

এরশাদ হাসলো! হেসে বলল,– ঘোড়াটা না চিনলেও ডিমের উপরে ভরসা আছে।

— ডিমের চেয়ে ঘোড়া ভালো। দেখলি না চট করে পড়ালেখার জন্য রাজি হয়ে গেলো। আমি হলে কখনও হতাম না।

— কেন?

— প্রথমটাও বিদ্যাসাগরী ছিল। আলা ভোলা। বই ছাড়া ডান বান চিনে না। ওমা প্রেমের এক বছর পর দেখি আরেকজনের সাথে লটরপটর।

এরশাদ আগের মতোই হাসলো! হেসে বলল,– আমার বোন ওমন না।

— ওই মেয়ের ভাইও সেই কথাই বলতো।

— তুই জানিস?

— আমি সব জানি।

— ভালো।

— ভালো তো অবশ্যই। তবে নিজের বোনের এতো চিন্তা, পরের মেয়ের চিন্তা কই?

— ওর ব্যাপারে কথা থাক।

— কেন?

এরশাদ উত্তর দিলো না। চায়ের দোকান এসেছে। তারা ভেতরে গেলো না। ইশারায় দু- কাপ দেখালো। দেখিয়ে একটু দূরেই দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে এরশাদ সিগারেট ধরালো। ধরিয়ে বলল,– কোন কিছুর বিনিময়ে আমি ওকে ছাড়বো না।

— আমি ছাড়তে বলছি না। তবে যেটা করছিস সেটা অন্যায়। এভাবে সংসার হয় না। তাছাড়া সে কোন অবুঝ মেয়ে না, জোর করে বিয়ে করে আদর সোহাগ দিলেই ভুলে যাবে। বরং ঘৃণার চাদর বাড়বে। বাড়তে বাড়তে কোন অঘটন ঘটাবে।

— সে আমাকে এমনিতে’ই ঘৃণা করে। নতুন করে কিছু করার নেই।

— তাহলে?

— আগেই তো বললাম, আমি তাকে ছাড়ছি না।

— এতো পাগল হলি কেন? রস কষ বিহীন একটা মেয়ে। কথায় কথায় জ্ঞান। জীবন তেজপাতা করে ফেলবে বলে দিলাম।

— দিক।

ফরহাদ হাল ছাড়লো! ছেড়ে বলল,– তাহলে আপাতত বিয়েটা বাদ রাখ।

— কেন?

— তালাক হয়েছে কতোদিন? গুনে দেখেছিস?

এরশাদ হো হো করে হাসলো! যার জীবন আছে পাপে ডুবে, সে ঠিক বেঠিক গুনে দেখবে। সে হেসেই সিগারেট টা পায়ে পিষল। চা এসেছে, স্বাভাবিক ভাবেই হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিলো।

জয়তুন আরার রাতের খাবার আজকেও আয়না নিয়ে এলো। রাতের খাবার বেশি ভাগ সময় তিনি নিজের রুমেই খান। খাওয়ার সময় আগে, ঘুমিয়ে যান ও আগে। তাই আর বের হন না। তবে সবাই বাড়িতে থাকলে আলাদা কথা। তখন তিনি খাবার না খেলেও খাবার ঘরের দরজায় বসেন। তবে সেই সময় আজকাল হয় না বললেই চলে। যে যার মতো আসে,যায়। অবশ্য নাতি দের কখনও তিনি ঘরে বেঁধে রাখার চেষ্টাও করে নি। বরং সিংহের মতো তৈরি করেছেন। ছেলে মানুষ ঘরকোণে হবে কেন? আলতাফ ছিল ম্যানমেনা, তার রক্ত। যাবে কোথায়? জাফরও ম্যানমেনা। তবে জসিম, সে যেমন ছিল, তার রক্তও তেমন।

জয়তুন নিজের মতোই ধীরে ধীরে উঠল। আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পর থেকে একা হাঁটতে চলতে সমস্যা হচ্ছে। শরীর কাঁপে! তবুও নিজের মতোই উঠল। আম্বিয়া হলে নিজে থেকেই ধরতো। জ্ঞান হয়েছে পর থেকে এই বাড়িতে, সবার হাবভাব বুঝে। তবে এই মেয়ে এখনোও তেমন ভাবে কিছু বুঝে না। সব সময় কোন এক আতঙ্কে আছে। আতঙ্ক লুকিয়ে রাখবে তাও না। চোখে মুখে স্পষ্ট নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। অবশ্য তার নাতি’ই এমন। তাইতো লোকে বলে, যা হয় ভালোর জন্যই হয়। তার এই মাথা গরম নাতির জন্য এমন ঠান্ডা মেয়ের’ই দরকার ছিল। সাত চড় পড়বে, তবুও রা করবে না। এই যে কি সুন্দর মানিয়ে নিচ্ছে।

জয়তুন উঠে চেয়ারে বসলো। আয়না সব গুছিয়ে এগিয়ে দিলো। জয়তুন সব চুপচাপ দেখলো। তবে আজকেও কিছু বলল না। আম্বিয়া কোন শোকে কাতর, সে জানে। সব কয়টা বড় হলো তো চোখের সামনে। কার কোন দিকে নজর, এইটুকু বোঝে।

আম্বিয়া কাজের লোকের মেয়ে হলেও এখন সারেং বাড়ির সদস্যর মতো। খুবই ভালো মেয়ে এতে সন্দেহ নেই। তবুও সদস্য হোক আর যাই হোক, ভালো হোক বা খারাপ। বাপ পরিচয়হীন মেয়েকে স্নেহ করা যায়, বাড়ির সব দায়িত্ব দেওয়া যায়, তবে নাতি পুতির বউ করা যায় না। বউ দিয়ে বংশ এগোয়। আর বংশে রক্তে দূষিত রক্ত? ছ্যাঁ! জয়তুন মরে গেলেও হবে না।

কেননা জয়তুন সব সহ্য করতে পারে, তবে রক্তের ছিনিমিনি মানতে পারে না। পারে না বলেই জসিমকে সে পালক এনেছে দেখে, শুনে। হ্যাঁ গরীর ছিল তবে দূষিত রক্ত না। তাই চোখ মুখ কিছুটা বিকৃত করেই খাবার টেনে নিল। আম্বিয়ার বাড়াবাড়ি ভালো লাগছে না। অযথা, এরশাদ শুনলে লাথি মেরে ঘর থেকে বের করবে। তাই তিনি চুপ আছেন। আম্বিয়া এমনিতে যাই থাক, তবে সে আছে বলেই সারেং বাড়ির সঠিক নিয়মে চলছে।

সাদা ভাত, হালকা মসলায় পেঁপে আলুর ঝোল। তাতে কালোজিরার ফোড়ন। মাছ আলাদা ভাজা। জয়তুন মাছ নিলেন না, শুধু ঝোল পাতে নিলেন। মসলাদার খাবার এখন আর পেটে সয় না। খাবারদাবারও কমে গেছে অনেক। সময় যে কমে আসছে, সব কিছুই তা জানান দিচ্ছে অনায়াসেই।

তাই খেতে খেতেই বলল, — দুপুরের পর থেকে নিচের এই কোণায় ঐ কোণায় শুধু ঝিমুতে দেখলাম। ব্যাপার কী?

আয়না ঢোক গিলল। সাধে কি আর এখানে ওখানে ঝিমাইছে। দিনটা গেলো তার লুকিয়ে লুকিয়ে। যতক্ষণ শাহবাজ বাড়িতে ছিল, সে আর সামনে তো ভালোই ডান, বাম আশে পাশেও নেই। তখন ছাদে হাত ছাড়তে দেরি, আয়নার সোজা নিচে নামতে দেরি হয়নি। সোজা নিচে নেমে গিয়ে গোসলখানায় ঢুকে পড়েছে। ঢুকেই প্রথম চিঠিটা পানিতে গুলিয়ে ফেলে দিয়েছে। তারপর গোসলটাও সেরে ফেলেছে, যেন আর কিছুই অবশিষ্ট না থাকে। গোসল করে রুমে তো ভালোই, উপরেই আর যাইনি।

তাবে তার গোসল হতে হতে শাহবাজের খাওয়া টাওয়া শেষ। খেয়ে রুমে কী করেছে কে জানে, তবে অনেকক্ষণ আর নিচে আসেনি। সেও আর উপরে যায়নি। ব্যস, বিকেলে নিজের মতো বেরিয়ে গেছে। যেতেই সে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। তবে রাত নিয়ে বহুত চিন্তায় আছে। এই চিঠি প্যাঁচ এত সহজে হজম করবে বলে মনে হয় না।

তখনই ফট করে কারেন্ট চলে গেল। জয়তুন কারেন্টের লোকদের ইচ্ছেমতো তুলোধোনা করল। বৃষ্টি কমেছে, তবে আকাশ পরিষ্কার হয়নি। এই থামছে, এই আবার গুঁড়িগুঁড়ি একটু হচ্ছে। আর এই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে কারেন্টও নাটক শুরু করেছে। আসছে আর যাচ্ছে।

জয়তুনের বিরবির করতে করতেই আম্বিয়া হারিকেন নিয়ে এলো। রেখে নিজের মতোই চলে গেল। সে যেতেই শাহবাজ উঁকি দিল। জয়তুন দেখলো, দেখলো আয়নাও। আর দেখেই ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠল। জয়তুন বিরক্ত মাখা কণ্ঠে বলল, — কী হইছে তোমার?

আয়না সাথে সাথে’ই দু’পাশে মাথা নাড়ল। জয়তুন দেখে শাহবাজের দিকে ফিরে বলল, এমন ভূতের মতো ঘুরে বেড়াইতাছোস ক্যা?

শাহবাজ ভেতরে এসে দাদির খাটে পটাং হয়ে শুয়ে পড়ল। ছোট হারিকেন। জয়তুন আরার আশপাশ ছাড়া, ঘরে আধো আলো আধো অন্ধকার। সেই অন্ধকারে শাহবাজ দৃষ্টি এক জায়গায়। আরে সেখানে রেখেই বলল, — ঘাড় মটকানোর ইচ্ছা। তবে ঘাড় পাচ্ছি না।

আয়না শুনে সাথে সাথে একটু চেপে জয়তুনের সাইডে এলো। আল্লাহ, আজ এত তাড়াতাড়ি কেন? এমনিতে তো অর্ধেক রাত ছাড়া বাড়ি ফেড়ে না। আয়নার আবার মাথা ঘুরতে লাগলো। সে অবশ্য জানে না, তার সব কিছু’ই আরেকজন ঠোঁটে সেই চিরচেনা হাসি নিয়ে দেখছে।

জয়তুন খাওয়ায় আবার মনোযোগ দিল। শাহবাজ নড়েচড়ে শুতে শুতে বলল , — চেয়ারম্যান চাচার সাথে ভাইয়ের গণ্ডগোল হয়েছে।

জয়তুনের হাত থেমে গেল। থেমে শাহবাজের দিকে তাকাল। তাকাতেই শাহবাজ বলল, — ইটের ভাটার সাইডে নদীর পাড়ের জায়গা, সেগুলো নিয়ে।

জায়গা যে চেয়ারম্যান চাচ্ছে সে জানে। ইমরান আরো আগেই তাকে বলেছে। তাই ভ্রু কুঁচকেই বলল — কেমন ঝামেলা?

— ভাইকে তো জানোই। বেয়াদবি, চিল্লাচিল্লি, রাগারাগিতে সে নাই। তবে চেয়ারম্যান চাচা খুব হ্যাঁকড্যাঁক করেছে। ভাইকে হুমকিও দিয়েছে।

জয়তুন হাসল! হেসে বলল, — এরশাদ কী বলছে?

— কিছুই না। সব সময় যা করে। হেসেছে।

জয়তুন আরা নিজেও হাসলেন। হেসে আবার খাওয়া শুরু করলেন। করতে করতে বললেন, — ছেলেটারে কেউ শান্তিতে থাকতে দেয় না। এক কালমুখি এসে মাথাডারে খাইতেছে, আরেকজন এখন বিগড়াইতে চাইছে। তার মধ্যে আবার বাড়িতে বিয়া! শোন, আমি আগেই কইলাম, আমার একমাত্র নাতনীর বিয়া। বিয়ায় যদি কোনো কমতি থাকে, মাথার চুল তোগো একটা ও রাখবো না।

শাহবাজ হাসল! হেসে আবার আয়নার দিকে তাকালো। তাকিয়ে বলল, — আজকে বাড়িতে কেউ এসেছিল, দাদি?

জয়তুনের খাওয়া শেষ। হাত ধুতে ধুতে বললেন, — কে আইবো?

— সেটাই তো জানতে চাই।

— ফাউ কথা বাদ দে। জুম্মাবার আইলো বলে। ও নয়া বউ, বীণার রুম থেকে কাগজ কলম আনতো। কী কী করতে হবে, গোছগাছ করে ফেলি।

বলতে দেরি, আয়নার হড়বড় করে বেরুতে দেরি হলো না। সে বেড়িয়ে গেলো। শাহবাজ সেই বেরিয়ে যাওয়া দেখলো, দেখে বলল, — বিয়ের সব দায়িত্ব ভাইয়ের ঘাড়ে ফেলো দাদি।

— সেটা তো এমনিতেই সব সময় তার ঘাড়ে’ই থাকে।

— না, সেই থাকা না। এমন ভাবে ফেলো, বাড়ির দক্ষিন কোণের কথা কিছু সময়ের জন্য মাথা থেকে বেরিয়ে যায়।

জয়তুন এবার বুঝলো। বুঝে হাসলো। হেসে পা ছড়িয়ে বসলো। তখনি নিস্তব্ধ সারেং বাড়ি ঝনঝন শব্দে কেঁপে উঠল।

আর এই কেঁপে উঠার কারণ, আয়নামতি। অন্ধকারে হড়বড় করে বেরিয়েছে। আম্বিয়া আসছিল সামনে থেকে। দু’হাতে কালকের থালাবাটি নিয়ে। সব এলোপাথাড়ি হয়ে আছে। সে না গুছিয়ে রাখলে তো কেউ হাতও দেবে না।

তখনি এমন এক ধাক্কা লাগল, আম্বিয়ার হাত থেকে সব ফসকে পড়ল। কাচের গুলো ভাঙলো। স্টিলের গুলোর ঝংকারে সারেং বাড়ির রাত ঝনঝন করে উঠল।

আম্বিয়ার মেজাজ এমনিতেই খারাপ, তার মধ্যে আরও বাড়ল। বাড়লো বলেই ঝাঁজের সাথে বলল, — চোখের মাথা খাইছো? কাজকাম তো একটাও করতে দেখিনা, অকাজের বেলা উইড়া চলো!

আয়না মুখ অন্ধকার করে ফেলল। আম্বিয়ার মেজাজ কমলো না। বরং বাড়লো। কথায় আছে না ঝামেলা যখন লাগে সব দিক দিয়েই লাগে। তাই আগের চেয়ে আরো বেশি ঝাঁজের সাথে বলল, — আবার খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছো ক্যা? মুখ দিয়া একটা শব্দ না বললে তো, এখানের কোটা ওখানেও নাড়াতে দেখি না। ঝট করে ধরবে তাও না।

শাহবাজ এসে দরজার মাঝামাঝি দাঁড়ালো। দু’ হাত দরজার দু’পাশে। দু’পাশে রেখেই ঘাড় কাত করে আয়নার দিকে তাকালো। ভয়ে মুখ এতোটুকু হয়ে গেছে। সে ঘাড় কাত করেই আম্বিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, — কি হইছে?

আম্বিয়া আগের মতোই বলল,– কি হইছে দেখতাছোস না?

— দেখলাম। অন্ধকার, হতেই পারে। এভাবে চেঁচাচ্ছো কেন? আমার বাপ দাদার টাকার প্লেট গ্লাস গেছে। তোমার এতো জ্বলছে কেন?

আম্বিয়া আগের তেজ নিয়েই বলর — শাহবাজ..

— কি শাহবাজ? দেখো আম্বিয়াবু, একটা কথা সোজা বলি। ঐ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মন বাঁচিয়ে কথা আমার হয় না। তাই ভুল করছে, করতেই পারে। বয়স কত? তাই ভালো করে বলো। তা না হলে আমার বদ হজম হবে। পরে কি থেকে কি করবো। পরে দোষ দিতে পারবে না। হাজার হলেও শাহবাজের বউ। ভুলে যাও কেন?

আয়না অবাক হয়ে তাকালো! তাকালো আম্বিয়াও।
তাদের তাকানো দেখে শাহবাজ তার মতোই বলল — এতো তাকাতাকি করে তো লাভ নাই। পুরো এক গ্রাম মানুষের সামনে কবুল বলে বিয়ে করছি। তাই এর পর থেকে একটু সামলে।

আয়না এই ভূতের মুখে মিষ্টি কথায় ভুললো না। বরং ভাবতে লাগলো, কাহিনী কি? আম্বিয়া অবাক অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। জানা কথা, একদিন তো এই দিন আসতোই। যে বুকে শোয়, তার জন্য দুনিয়া ক্ষয়। আরেকজন তো না শোয়ায়েই দুনিয়া ক্ষয় করে ফেলছে।

তাদের এতো ভাবাভাবির মধ্যে শাহবাজ নিজের মতো চলে গেলো। জয়তুন এসেছে ধীরে ধীরে। তাই দরজায় হাত রেখে চোখ মুখ কুঁচকে আম্বিয়ার দিকে তাকালো। এই কয়দিন চুপ থাকলেও আজকে আর থাকলেন না। তার তেজের সাথেই বললেন, — মেজাজে লাগাম লাগা আম্বিয়া। নিজের অবস্থান ভুললে চলবে না। সংসার সামলালেই কর্ত্রী হওয়া যায় না।

আম্বিয়া ধাক্কার মতো খেলো। সবাই সবকিছু বললেও জয়তুন আরা তাকে সোজা এমন কথা বলতে পারে, তার ধারণা ছিল না। তাই সেও বাঁকি থাকবে কেন? আগুন চোখে তাকাল। জয়তুন সেই চোখের দিকেই তাকিয়ে বললেন, — মানুষ তার অবস্থা ভুলে গেলেই সব হারায়। তাই অবস্থান শক্ত রাখ। আবেগে ভাসলে সব হারাবি।

আম্বিয়া হাসল! তাচ্ছিল্যের হাসি। হেসে বলল,– হারানোর মতো আমার কিছু নাই।

— সেই দায় তো আমাগো না। নিজের নাতনীর মতো ভালো ঘর, ভালো ছেলে দেখছি। সেটা তো মনে ধরে নাই।

— হাহ্! নিজের নাতনী। নিজের নাতনী মনে করলে আজ এই দশা দেখতে হতো না।

— কি দেখছোস তুই? মায়ের মতো পেট বাজিয়ে ঘাটে ঘাটে লাথি গুতা খাইতি। তখন বুঝতি দুনিয়া কি? এই জয়তুন যদি না থাকতো, এই দুনিয়ার মুখও দেখতি না।

— সেটা তোমরাও দেখতে না, সেই দিন যদি আম্বিয়া সঠিক সময়ে উপরে না গিয়ে বলতো। এতো নাতি নাতির বড়াই সব ছুটতো।

জয়তুন চেঁচিয়ে উঠল! উঠে বলল, — আম্বিয়া… জিভ তোর টাইনা ছিড়া ফেলামু আমি। আমার মুখে মুখে কথা? আমি এখনোও দুনিয়া দেখতাছি আমার এরশাদের জন্য। আর কারো জন্য না।

আম্বিয়ার চোখে পানি চলে এলো। তবে আর কিছুই বলল না। হনহনিয়ে নিজের রুমের দিকে গেলো। আয়নার এতো খারাপ লাগল। সব দোষ তার। তার জন্যই তার এতো কথা শুনলো।

আম্বিয়া যেতেই জয়তুন আয়নার দিকে আগুন চোখে তাকালো। আয়না ঢোক গিললো। জয়তুন দাঁতে দাঁত চেপে বলল,– অর্কমার ঢেকি। কাজের কাম কিছু’ই আসে না। অকাজ করতে ওস্তাদ বলেই নিজের মতো চলে গেলো।

আয়না কি করবে দিশে পেলো না। তবে মন খারাপ করেই সব উঠালো। ভাঙা কাচ ফেললো। ফেলে সুন্দর করে লেবু চিপড়ে একগ্লাস শরবত বানালো। বানিয়ে আম্বিয়াবুর রুমের দিকে গেলো। আজিজ চাচা চিঠিতে বলেছে, আম্বিয়াবুর সাথে ভাব জমাতে। বাইরে থেকে কারো ভেতরে যাওয়া সম্ভব না। তবে কেউ যদি একবার পৃথিলা আপাকে সারেং বাড়ির প্রাচীর থেকে বের করে দেয়। বাকি সব সে সামলে নেবে। আর সেটা নাকি এখন একমাত্র আম্বিয়াবু’ই করতে পারবে। চিঠিতে সে আম্বিয়াবুর মন খরাপের কথাও লিখেছিল। আর দেখো, এদিকে লেগে গেলো আরেক ঝামেলা। একটা কাজও যদি ঠিকঠাক মতো পারে। ধুর!

অবশ্য এই ঝামেলায় একটা দিক ভালো হলো। যার যার রুমে সে সে চলে গেলো। তাই আয়না আম্বিয়ার রুমে বেশ কিছুক্ষণ থাকলো। না এবার আম্বিয়া রাগ ঝাড়লো না। বরং কেউ তার দুঃখের ভাগ নিতে এসেছে বলে সিক্ত হলো।

তারপর সেখান থেকে বের হয়ে আরামছেই বসার ঘরেই বসে রইল। বাকি কাজটাজ করলো। আম্বিয়ার জায়গায় এরশাদের জন্য দরজাও খুললো। অবশ্য কথা বলল না। চুপচাপ মুখ ফুলিয়ে অন্য পাশে তাকিয়ে রইল। তার তাকানো দেখে এরশাদ শুধু একটু হাসলো। হেসে যেতে যেতে বলল,– ভাসুরের পছন্দ, পছন্দ হয়নি বুঝি?

আয়না উত্তর দেয় নি। মুখ ফুলিয়ে’ই দরজা লাগালো। অসুরের সাথে হুরপরী! কখনও যায়? তাই লাগিয়ে একচোট বিরবির করে সারেং বাড়ির আবার গুষ্টি উদ্ধার করলো। করে আগের মতোই চেয়ারে বসে রইল। বসে বসে ঝিমুতে লাগলো। সেই ঝিমুনের মাঝেই কেউ হাত ধরে এক ঝাঁকি দিয়ে দাঁড় করিয়ে ফেললো।

আয়নার ঘুম তো ভালোই, আজকেও মাগো বলে চিৎকার দিতে যাচ্ছিল। তার আগেই গলার চিৎকার গলায় শেষ। না সেই দিনের মতো ভাত তরকারি মুখে গেলো না। বরং অন্য কিছু। আর এই অন্য কিছুতে আয়না শক্ত হয়ে গেলো।

শাহবাজের হাতের প্লাস্টার হাতেই। তবে গলায় ঝুলানো নেই। তাই ঝাপটে ধরতে কষ্ট হলো না, বরং আরো আট পাট করেই ধরলো। ধরে যেমন ছিল তেমনি রইল। সেই থাকার মাঝেই ফিসফিস করে বলল, — এখানে কি?

আয়না উত্তর দিলো না। দেওয়ার মতো অবস্থা অবশ্য তার নেই ও। কথা বলতে গেলেই ঠোঁট নড়বে। আর নড়লেই। আয়না চোখ বন্ধ করে ফেললো।

শাহবাজ দেখলো! দেখে বলল,– অন্যের জন্য মিথ্যা বলতে গলা কাঁপে না। শুধু আমার সামনেই যতো ঢং।

আয়না ফট করে আবার তাকালো। আর তাকালো বলেই শাহবাজ আরো বেপোরোয়া হলো। এতোটাই হলো আয়না তাল সামলাতে পারলো না। পেছনের তার বসা চেয়ারে পা লেগে উল্টে পড়লো। দু’জনে একসাথেই পড়ল। আর পড়তেই আয়না কুঁকিয়ে উঠল। সে ছোট খাটো মানুষ। এই আশি কেজি চালের বস্তার ভার সে নিতে পারে? তবে শাহবাজ হেসে ফেললো।

তখনি আম্বিয়ার ঘরে হাঁটা চলার শব্দ হলো। চেয়ার উল্টো সমানে দু’টো মানুষ ধপাস করে পড়েছে। শুনে নিশ্চয়’ই এগিয়ে আসছে। আয়না দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেললো। শাহবাজ আগের মতোই হাসলো! হেসে ঝট করে উঠে গেলো। গিয়েই আগে হারিকেন কমালো। কমাতেই আম্বিয়া ফট করে দরজা খুললো। হারিকেনের মৃদু আলোতে হারিকেনের সামনে শুধু শাহবাজকে’ই দেখলো। দেখতেই তখনের কথা মনে পড়ল। আর পড়ল বলেই ডানে, বামে আর তাকিয়ে দেখলো না, সোজা আবার ফট করে দরজা লাগিয়ে দিলো।

দিতে দেরি আয়নার জান প্রাণ ছেড়ে দৌড় দিতে দেরি হয়নি। এক দৌড়েই সে তাদের রুমে গেলো। গিয়ে দরজায় খিল দিলো। আজকে আর সে মরে গেলেও দরজা খুলবে না। জীবনেও না।

চলবে……

#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৪০

পৃথিলার ঘুম ভাঙল ভোরে। সাবিহার খোয়ারের মোরগ, মুরগির ডাকে। ভোর হতেই তাদের গান শুরু হয়, সাবিহা উঠে খোয়ারের দোর খোলা না পর্যন্ত তাদের এই গান এভাবেই চলতে থাকে।

সাবিহা এখনো উঠেনি, তবে উঠে যাবে। গ্রামের বউরা বেলা করে ঘুমায় না। তার অবশ্য এমন কোন সমস্যা নেই। কাজকর্ম নেই, ঘুমিয়েছে তাড়াতাড়ি, ঘুম ভেঙেছেও তাড়াতাড়ি। তাই পৃথিলা নিজের মতো করে উঠল, খুলে যাওয়া চুলগুলো হাত খোঁপা করল। গায়ের কাপড় গুছিয়ে ঠিক করল। মশারি সরিয়ে জানালা খুলতেই, ভোরের কোমল আলো ঘরে আসতেই টেবিলের ওপর ব্যাগটার দিকে চোখ পড়ল। কিসের ব্যাগ, কোথা থেকে এলো বুঝতে পারল না। তাই কিছুটা কৌতূহল নিয়ে প্রথমে ঘরের আলো জ্বালালো। আলো জ্বালিয়ে ব্যাগটা খুলল। খুলতেই দেখল, অনেকগুলো বই।

পৃথিলার বুঝতে দু’সেকেন্ডও লাগল না, এই বই কোথা থেকে এসেছে। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েছে, হয়তো রাতে পাঠিয়েছে। ঘুমালে সাবিহা তাকে ভুলেও ডাকবে না। তাই চুপচাপ রেখে দিয়েছে। তাছাড়া ফিরিয়ে দেবে সেই সাধ্য কই?

পৃথিলা বই প্রিয় মানুষ। বলতে গেলে অনেকটাই প্রিয়। তারেকের ফ্ল্যাটে তার বইয়ের আলাদা তাক ছিল। শাড়ি গহনার লোভ, আকাঙ্খা কখনও তেমন ছিল না। আর খরচের দিকে তারেক কখনও কোন হিসেব চায়নি। তাই ইচ্ছে হলেই দু,তিনটে বই এমনিই কিনে ফেলতো।

তবুও পৃথিলা আজ বই গুলো আর ধরল না। খুলে দেখলোও না, কি কি বই। বরং আস্তে করে হাত সরিয়ে নিলো। যেমন ব্যাগ, তেমনি পড়ে রইল। পৃথিলা বাতিটা নিভিয়ে বাইরে চলে এলো। কাল সারাদিন রাত বৃষ্টি গেছে। আজ অবশ্য নেই। তবে কোমল নরম মিষ্টি একটা মৃদু বাতাস গায়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে।

পৃথিলার ভালো লাগল। তাই এগিয়ে বারান্দায় বসল। এখন অবশ্য বাইরে তেমন কিছু দেখা যায় না। মাঝারি সাইজের লোহার গেট লাগানো হয়েছে। ইমরান ভাই ফেরার সাথে সাথে গেটে তালা ঝুলানো হয়। এমনিতে অবশ্য সবসময় খোলা থাকে। তবে সারেং বাড়ির লোকের নজরের ভেতরে। চাইলেও এখন আর হুট করে কারো বাইরে বা ভেতরে আসা যাওয়ার উপায় নেই।

তখনি পৃথিলার নজর পড়ল সারেং বাড়ির দ্বিতীয় তলার বারান্দায়। জাফর লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। সোজা, পেছনে হাত মোড়ানো। গায়ে ঘরোয়া সাদা ফতুয়া। দৃষ্টি অবশ্য এদিকে নেই, আকাশের দিকে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

পৃথিলার কেন জানি দৃশ্যটা ভালো লাগলো। সে গাছগাছালির ফাঁকে নিচ থেকে দেখছে। তাই আকাশ আর লোকটাকে একই রকম মনে হলো। মনে হলো, আকাশের একটুকরো মেঘ ভেসে একটু দূরে চলে এসেছে। এখন ফেরার জন্য উঁকি ঝুঁকি মারছে।

তখনি জাফর ফিরে তাকালো। পৃথিলা কিছুটা থতমতো খেলো। খেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। নিয়ে অবশ্য সেখানে আর বসলো না। এগিয়ে খোয়ারের দোর খুলে দিল। মোরগ, মুরগি গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো।

পৃথিলা আর সেদিকে তাকায়নি। তার তাকানোর প্রয়োজনও নেই। তবে জাফর, পৃথিলাকে যতোক্ষণ দেখা গেলো চোখ ফেরালো না। আগের মতোই তাকিয়ে রইল। আর থাকতে থাকতেই মনে হলো, তারা আসলে’ই সবাই স্বার্থপর।

এরশাদ জয়তুনের মুখোমুখি হলো সকালে। জয়তুনই ডেকে পাঠালো। দাদি তো এখন চোক্ষের বিষ। সামনে পড়লেও ফিরে দেখে না। দাদি তো মুখ ফেরাতে পারে না। তাই বেরিয়ে যাওয়ার আগেই খবর পাঠালো।

তবে কাজের লোক এসে জানালো, এরশাদ ভাই ঘুমে, একটু পরে আইতেছে। পরে আসছে শুনে অবাক হয়নি। অবাক হলো ঘুমাচ্ছে শুনে! এরশাদের ঘুম কম। কোনো রকম কাকের গোসলের মতো ঘুম তার। ঝলক পলক। সেই এরশাদ এত বেলা করে ঘুমাচ্ছে! জয়তুন কিছুটা বিস্ময় নিয়েই বসে রইলো।

তার পাশেই আয়না। পান ছেঁচে ভর্তা করছে। ভর্তা করতে গিয়ে তার ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে। পান ছেঁচার নিয়ম আছে। আস্তে আস্তে ঘষতে হয়। এই মেয়ে শরীরের যত শক্তি আছে, সবটুকু দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে। সেই চালিয়ে যাওয়ার মাঝে চোখের আড়ালে মুখে কিছুটা পান পুরেছে। সেই পানে ঠোঁট লাল টকটকে হয়ে আছে। দেখতে ভালো লাগছে, তা না হলে জয়তুন এতক্ষণে দিতেন এক ধমক। সে জোটা পান খাবে?

আম্বিয়া তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। দিলেও স্বাভাবিক ভাবে কাজটাজ করছে। এও ভালো। এই মেয়ে থামলে সারেং বাড়ি থেমে যাবে। তবে আম্বিয়াকে টাইট সে দেবে। বিয়ের ঝামেলাটা আর এরশাদের ঝামেলাটা মিটুক, তারপর। জয়তুন সব সহ্য করতে পারে, তবে তার সাথে চাপা চালানো, এই স্পর্ধার কোন মাফ নাই।

ঠিক তখনই ঘুম ঘুম চোখে এরশাদ নামল। তবে তৈরি হয়েই নেমেছে। বেরিয়ে যাবে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আয়না দেখল। দেখে মুখ বাঁকাল। একটা ছোট শয়তান, আরেকটা বড় শয়তান! একটা পৃথিলা আপাকে জ্বালিয়ে মারছে, আরেকটা তাকে। এতোদিন জ্বালানো ছিল এক জ্বালানো, এখন শুরু হইছে আরেক জ্বালানো। প্রথমে কি ঢং। দেখতে পারে না, ঘৃণা করে। এখন কোথায় গেলো সেই ঘৃণা। তার দাদি ঠিক’ই বলতো। পুরুষ মানুষের রাগ, জেদ সব এক জায়গায় গিয়েই শেষ হয়। মাইয়া মানুষ! আর মাইয়া মানুষ দেখলে পুরুষ গলবো না, এমন পুরুষ দুনিয়ায় নাই। অবশ্য বলতে গেলে তার দোষও কম না। সে নিজেও রাগে জেদে কয়দিন রং ঢং করে বশে আনতে চাইছে। কেননা আজিজ চাচা হাসপাতালে বলেছিল, জয়তুন আরাকে ভাঙতে হলে নাতিদের ভাঙো। ভাঙার জন্য আগে, বশে আনতে হবে। তবে জয়তুন আরার নাতি দু’টাই বিটলা শয়তান। যাই করতে গেছে গন্ডগোল। এখন তো আর কিছু করছে না। তো গলছে কেন? উফ! জ্বালা তো ভালো লাগে না।

কোমরটা তার এখনোও টাটাচ্ছে। উপর নিচ হতে গেলে কুঁকিয়ে উঠতে হচ্ছে। আম্বিয়াবু তো একবার ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সে লজ্জায় শেষ। অথচ শয়তানটা দেখো। এখনোও কি সুন্দর পরে পরে ঘুমাচ্ছে। অবশ্য রাতে আর রুমের দরজায় গিয়ে ধরাম ধরাম করে তাল ফেলেনি। অন্য রুমে চুপচাপ শুয়ে পড়েছে। তাই মুখ বাঁকিয়ে নিজের অজান্তেই আবার আরেকটু পান মুখে পুরল। আর মুখে পুরতেই কাল রাতের কথা মনে পড়লো। পড়তেই মুখ গোঁজ করলো।

জয়তুন নির্বিকার চিত্তে এবারো দেখলো। মনে মনে কার গুষ্টির উদ্ধার করছে কে জানে? করবি ভালো কথা। লুকিয়ে চুরিয়ে কর। তা না! সব হাবভাব মুখে বোঝা যাচ্ছে। সারেং বাড়ির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। একেবারে ডাহা অন্ধকার।

এরশাদ অবশ্য তাকালো না। সে নিজের মতো এসে জয়তুনের সামনে বসে তার স্বভাবমতো কোমল স্বরেই বলল,
— ডেকেছো দাদি?

জয়তুন ডানে বামে গেলেন না। গেলেই কথা উঠবে। অন্তত তিনি এখন আর কোনো ঝামেলা চান না। তাই সোজাসুজি বললেন, — হাতে তো সময় নাই। বিয়ের ব্যাপারে কী ভাবলি?

— ভাবার কী আছে! সব হয়ে যাবে। কাল থেকেই প্যান্ডেলের লোক কাজ শুরু করবে। বাজার, টাজার নিয়ে ভাবতে হবে না। সেগুলো আমি দেখব। শুধু দাওয়াতের ব্যাপারটা শাহবাজকে দেখতে বলো। আজকেই মধ্যেই বইলো। হাতে আছে দু’দিন। আজকের মাঝে দাওয়াতটা না পৌঁছালে খারাপ দেখায়। হঠাৎ বিয়ে সে ভাবেই ওকে বলতে বলো। তাছাড়া, বলার মতো আত্মীয়-স্বজন তো আমাদের নেইও। গ্রামের মানুষ সমস্যা হবে না।

— আমার একমাত্র নাতনি। পুরনো গহনা আমি দেব না। নতুন চাই।

— সেগুলোর জন্য সময় দরকার। এখন যা আছে দাও। পরে আমি সব ব্যবস্থা করছি।

— না! বিয়ের সময়ই তো সবাই দেখে। পরে তো কেউ দেখতে আইবো না।

— তাহলে কী করব? এখন বানাতে দিলেও কমপক্ষে এক সপ্তাহ লাগবে। অথচ সময় মাত্র দু’দিন।

— ঢাকায় যা। সেখানে নাকি বিশাল বিশাল দোকান থাকে। তাদের নাকি তৈরি’ই থাকে। ফরহাদের ভাবিও তো সেখান থেকেই নিতাছে।

— এখন এতো কাজের মাঝে ঢাকায় যাওয়ার সময় কোথায়?

— কাজ শাহবাজ দেখবে। তুই গহনার ব্যাপারটা দেখ। তাছাড়া জামাইকেও তো অন্তত একটা নতুন চেইন, হাতের আন্টি দিতে হইবে। আমি পুরনো গহনা দিয়ে জামাই বরণ করব না।

— আমার এখন ঢাকায় যাওয়া সম্ভব না। শাহবাজকে বলো।

— ও বুঝবে? ও জীবনে এসব করেছে?

— জীবনে করবে না বলে, এমন কোন কথা নেই। করতে দিলেই পারবে।

— তোর গেলে সমস্যা কি?

এরশাদ উত্তর দিল না। সে যে ভাবে বসেছে, সে ভাবেই উঠে দাঁড়াল। জয়তুনও তার মতো বললেন, — তা যাবি কেন? আমি তো খারাপ’ই। ভাই, বোন সব এখন পর!

এরশাদ এবারো উত্তর দিল না। বেরিয়ে গেলো। জয়তুন দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইল। আয়না বসে বসে সবই দেখলো। দেখতে দেখতেই আরেকটু পান মুখে পুরল। এরশাদ ভাই ঢাকা যাবে নাকি? আজিজ চাচাকে জানাতে হবে। অবশ্য তিনি বলেছেন, টুকিটাকি সব জানাতে। যেভাবে পারে সেভাবে জানাতে। এই বাড়ি থেকে একটা সুতোও গেলে, যাবে আগে তার হাত হয়েই। তাই নিশ্চিন্তে সব কিছু করতে বলেছে।

এরশাদ সোজা বেরুতে গিয়েও থামলো। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। পৃথিলা সাবিহাদের গেইটের ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে ছাইরঙা একটা কাপড়। মাথায় সব সময়ের মতো হাত খোঁপা। জ্বর, গত কয়েক দিনের ধাক্কায় কিছুটা শুকনো লাগছে, তবুও এরশাদের চোখে অন্যরকম’ই লাগলো। আর এই লাগায় তার ঘোর লাগে। তাই মৌহ মুগ্ধের মতো এগিয়ে গেলো। কাছে অবশ্য না, কিছুটা দূরে। সেই দূরে দাঁড়িয়ে বলল, — হাঁটতে যাবেন পৃথিলা?

পৃথিলা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তার চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। সেই বিরক্ত নিয়েই ভেতরে যেতে নিলো। এরশাদ আগের মতোই বলল, — ভয় পাচ্ছেন?

পৃথিলা থামলো! থেমে তার মতোই বলল,– হ্যাঁ, পাচ্ছি। ভয়ংকর মানুষ দেখে ভয় পাওয়া স্বাভাবিক।

— নিশ্চিন্তে থাকুন, আমি একটা বিষয় ছাড়া আর কোন কিছুতেই জোর করবো না।

পৃথিলা শান্ত চোখে তাকালো! এরশাদ হাসলো। হেসে বলল, — বীণার বিয়ে, নানান ঝামেলায় থাকবো। এই সুযোগ সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আর পাবেন না। তাই ভেবে দেখুন।

পৃথিলা এক সেকেন্ডও ভাবলো না। ভেতরে চলে গেলো। এরশাদ জানতো এমনি হবে। তাই ফিরে সদর দরজার কাছে এলো। বেরুবে তখনি তাকে অবাক করে পৃথিলা আবার বেরিয়ে এলো। হাতে তার হ্যান্ডব্যাগ। এরশাদ থমকালো! পৃথিলা অবশ্য স্বাভাবিক, স্বাভাবিক ভাবেই এসে বলল, — আমার কিছু কেনা কেটা আছে। সদরে যাবো।

পৃথিলা প্রথম তাকে কিছু বলছে। এরশাদের গলা শুকিয়ে এলো। সেই শুকনো গলায় ঢোক গিলে বিনা বাক্যে বলল,– আসুন।

ভ্যানে দু’জন বসলো দু’ প্রান্তে। এরশাদ যেমন পা ঝুলিয়ে বসলো, পৃথিলাও তেমন। এরশাদ দেখে বলল,– পড়ে যাবেন পৃথিলা, উঠে বসুন।

পৃথিলা উত্তর দেয় নি, না উঠে বসেছে। সে বসলো নিজের মতো। আসলে তার কোন কেনাকাটা নেই। যদি থাকেও অন্তত এই লোকের সাথে সে কখনও যাবে না। যে যাচ্ছে পত্রিকা দেখতে। সেটা দেখলেই হাবভাব কিছুটা বোঝা যাবে। আর একটা চিঠি, নাম ঠিকানা অবশ্য তার বা ঢাকার পরিচিত গন্ডির কারো নেই। নামটা বানানো, ঠিকানা পাশের গ্রামের। চিঠিটা যাবে তারেকদের গ্রামের বাড়িতে। ভিন্ন নাম, তারেকের গ্রামের বাড়ির ঠিকানা এখানের কারো জানার কথা না। তাই এই চিঠি যে পৃথিলার কেউ বুঝবেও না। অবশ্য সে জানে না, ডাকঘর পর্যন্ত কিভাবে যাবে। তবুও একটা চেষ্টা তো করাই যায়। কোন ভাবে গিয়ে যদি পৌঁচ্ছায়, তারা নিশ্চয়’ই কিছু একটা করবে। তাই তার মতোই চুপচাপ বসে রইল। তার দৃষ্টি ধানের ক্ষেতে। ধানের ক্ষেতে থাকলেও সে জানে পাশে বসা মানুষটার দৃষ্টি কোথায়। এই রকম দৃষ্টি যে কোন মেয়ের জন্যই অস্বস্তিকর। তাই না চাইতেও শান্ত স্বরে বলল,– দয়া করে দৃষ্টি সংযত রাখুন। তা না হলে আমি ভ্যান থেকে নেমে যাবো।

এরশাদ হাসলো! সে ইচ্ছে করেই তাকিয়ে ছিল। সে জানতো তার কথায় পৃথিলা উত্তর দেবে না। তাই কথা বলার ছোট্ট একটা প্রয়াস। সে হেসেই দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনে নিয়ে বলল,– কি কেনাকাটা করবেন?

পৃথিলা মিথ্যা বলতে পারে না। বলতে গেলে গলা কাঁপে। তাছাড়া এই লোকের কথার উত্তর দিতে ইচ্ছেও করছে না। তাই চুপচাপ’ই রইল।

— কিছু কিনতে আমার সাথে আসবেন না, সেটা জানি। কারণটা বলুন পৃথিলা।

— যদি না বলি?

— না, বললে নেই। তবে আমার কাছে নিজ থেকে প্রথম কিছু বললেন। সেই খুশিতে আমি সেটা এমনিতেই করে দেবো। তাই বলতে চাইলে বলতে পারেন। আপনার কষ্ট কম হবে।

— মনে হয় না করবেন?

— বলে দেখুন।

— জবান ঠিক আছে তো আপনার ?

— দুনিয়ার কাছে আছে কি না জানি। কখনও মহৎ হওয়ার চেষ্টা করিনি। নিজের মতো থেকেছি। তবে আপনার কাছে যেটা বলবো, কখনও নড়চড় হবে না। সত্যি বলছি, কখনও হবে না।

পৃথিলা এবারো শান্ত ভাবেই তাকালো। কিছু কিছু কথা গায়ে গরম সীসার মতো পড়ে। তাই তাকিয়ে শান্ত ভাবেই বলল,– মহৎ হওয়ার চেষ্টা করেন নি। তবে ভালো মানুষের মুখোশ ঠিক পরেছেন।

— কোথায় পরলাম?

— গ্রামে সারেং বাড়ির বদনাম আছে, তবে আপনার নেই। অথচ সারেং বাড়ির সবচেয়ে ভয়ংকর মানুষটা হচ্ছেন আপনি।

এরশাদ হাসল! হেসে বলল, — তো? মানুষ অপরাধতো আর ডেকে ডেকে সবাইকে দেখিয়ে করবে না।

— না দেখানো, আর অপরাধে পর্দা ফেলায় ফারাক আছে।

— হয়ত! আমিতো আর আপনার মতো এতো জ্ঞানী না। তাই জানা নেই। তবে দুনিয়ার কাছে যাই থাক, আমার দ্বিতীয় কোন রুপ আপনার সামনে থাকবে না, আমি যা তাই থাকবে।

— জানতে পারি, এতো রহম আমার প্রতি কেন? মেয়ের অভাব হওয়ার তো কারণ নেই। রুপের দেওয়ানা আপনি না সেটা জানি। কারন, তা হলে আমার জায়গায় আয়না থাকতো। সে আমার চেয়ে হাজার গুণ সুন্দরী। তো, সাধারণ দেখতে একটা তালাক প্রাপ্ত মেয়ের প্রতি এতোটা সদয় হওয়ার কারণটা কি?

— অনেক কারণ আছে। যদি বলতে যাই এই পথ শেষ হয়ে যাবে। তাই কখনও বলবো অফুরন্ত সময়ে।

পৃথিলার মুখ তেতো হয়ে এলো। তারেকের ধোকার পরে এই সব মিষ্টি যে কোন শব্দে তার এক আকাশ সমান ঘৃণা। সে কাউকে দেখায় না, বোঝায় না। তবে কেউ কি জানে। পুরো দুনিয়া ছেড়ে একজনের হাত ধরতে কতোটা সাহস লাগে? আর সেই একজন যদি ধোকা দেয়, কতোটা আঘাত লাগে। তাই সেই তেতো কণ্ঠে’ই বলল — সেই অফুরন্ত সময় কখনও আসবে না।

— সময় বলবে।

— ভালো।

— অবশ্যই ভালো। তবে বললেন না, সদরে কেন?

— আজকের পত্রিকা দেখবো।

এরশাদ হাসলো! তার সেই সরলতা মাখা হাসি। হেসে পকেট থেকে সিগারেট বের করলো। এতোক্ষণ পৃথিলার কথা ভেবে সিগারেট না ধরালেও এখন ধরালো। ধরিয়ে বলল,– হয়ে যাবে।

— আর একটু লাইব্রেরিতে যাবো।

— কোন লাইব্রেরি?

পৃথিলা একটু ভাবলো। ডাকঘর সে চেনে না। তাহলে আশে পাশের কোন দোকান বলা যেতো। তাই বলল, — আমি এখানের কিছু চিনি না। একটা লাইব্রেরি চিনি, সেখানে’ই চলুন। এক কাজে দু’কাজ হলো। কয়েকটা বইও নেওয়া যাবে। জেল খানার কয়েদি বানিয়ে রেখেছেন। সময় কাটানোর জন্য কিছু তো দরকার।

এরশাদ আবারো হাসলো। হো হো করা হাসি। সে যেমন সেইদিন ঘুরিয়ে শান্ত ভাবে হুমকি দিয়েছে, তেমনি আজ ঘুয়িয়ে শান্ত ভাবে বলে দিলো। আপনার উপহারের আমার প্রয়োজন নেই। তাই হেসেই বলল, — কোন লাইব্রেরি?

— সদর বাজারের ভেতরে যেটা।

এরশাদ আর কিছু বলল না। ভ্যানওয়ালাকে দোকানের কথা বলল। বলে বলল, — পত্রিকা দেখে কি হবে?

— মনের শান্তি, হাজার খারাপ হলেও, সংসার তো করেছি। কতোদিন করেছি? ওহ! আপনার তো জানার কথা না। চার বছর। তারেকের সাথে আমার সংসার জীবন চার বছর।

এরশাদ এবার হাসলো না। বরং চোয়াল শক্ত হয়েছে। পৃথিলা যে তাকে ইচ্ছে করেই এই সব বলছে, সে জানে। ঘাটে ঘাটে বুদ্ধি। এরশাদের সহ্য হবে না, ঠিক জানে। হলোও তাই, তার মেজাজ বিগড়ে গেছে। অবশ্য তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। সে সব সময়ের মতোই শান্ত। শান্ত ভাবেই আগের মতো সিগারেটে টান দিলো।

সারা রাস্তা আর একটা কথা কেউ কাওকে বলল না। তবে এরশাদ একটার পর একটা সিগারেট খেলো। সেই সিগারেটের ধোঁয়ায় পৃথিলার দম বন্ধ হয়ে এলো। আর না পেরে আঁচল দিয়ে নাক, মুখ চেপে ধরল।

সাজেশন দেখে বীণার মাথায় হাত। অন্য বিষয় যেমন তেমন, গ্রামার আর গণিতে অনেক পড়া। সে পড়া দেখে তার মাথা ঘুরে গেলো। ঘুরে যাওয়া মাথা আর পড়ার চিন্তায় সে তার “পড়া শেষ, হজম শেষ ” এর ডাট বাট সব ভুলে গেলো। আর ভুলেই দৌড়ে গেলো।

এরশাদ চলে গেছে। জয়তুন বসে আছে আগের মতোই। তার মন মেজাজ ঠিক নেই। এরশাদকে সরানো দরকার। তবে মনে হয় না, সরবে। নতুন গহনার কথা বলেছে, গহনা ঠিকই আসবে। তার লোকের অভাব নেই। চেনে তো এরশাদকে? কোন কাজ সে ফেলে রাখে না। তবে সরাবে টা কী করে?

ঠিক তখনই বীণা এসে বলল, — ফরহাদ ভাইকে আসতে বলো।

জয়তুন চিন্তায় ছিল, খেয়াল করেনি। ভ্রু কুঁচকে বলল, — কারে আইতে বলবো?

— ফরহাদ ভাইকে।

— কোন কালের ভাই তোর?

— যেই কালেরই হোক, সেটা তোমার দরকার নেই। তাকে আসতে বলো।

— ক্যা ?

— দুনিয়ার পড়া বাকি। আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না।

জয়তুন দাঁতে দাঁত চেপে তাকালো। এরশাদ, শাহবাজকে তিনি উঠতে বসতে বকাবকি করেন, আগে শক্তি থাকতে দুই চারটা চড় থাপ্পড়ও দিয়েছেন। তবে বীণার সঙ্গে কখনও জয়তুন কড়া হয়নি। বরং ধৈর্য নিয়ে বুঝিয়ে সুজিয়ে সব করেছেন। এখন মনে হচ্ছে কয়েকটা চড় থাপ্পড় এই মেয়েকে দেওয়ার দরকার ছিল। তা না হলে আজ এমন বেয়াদব হতো না। আর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল এই ডারে স্কুলে দেওয়া। তাই ঝাঁজের সাথেই বলল, — থাপড়াইয়া দাঁত ফেইলা দেবো রে বীণা! শরম লজ্জার ধার নাই। যার সাথে বিয়া, তারে কয় ভাই আবা খবর দিয়া বাড়িতেও আসতে কছ!

— বললে কী হবে? সে কি আমাদের বাড়িতে নতুন আসছে?

— তুই যাবি, বীণা?

— না, তাকে আসতে বলো।

— আমি তো জীবনেও বলুম না।

বীণা মুখ ফুলিয়ে চলে এলো। তার খবরে ফরহাদ ভাই আসবে না। সে মাথার চুল টেনে ধরলো। তখনই আয়না এলো। আয়নাকে দেখে বীণা যেন কলিজায় পানি পেলো। এরশাদ ভাই কখন ফিরবে ঠিক নেই। সে থাকলে এক ব্যবস্থা হয়ে যেত। তাই ঝটপট সাজেশনে যা যা পারে না, লাল কালি দিয়ে বৃত্ত করলো। তারপর আয়নার হাতে ধরিয়ে দিলো।

আয়না অবাক হয়ে বলল, — আমি কী করবো?

— আমি কী জানি? ভাবি হইছো, ননদের মুশকিল আসান করো।

— আমি?

— হুম। ছোট ভাই তো এখনো বাড়িতে। যাও যাও, তাড়াতাড়ি যাও। চলে গেলে আরেক ঝামেলা।

আয়না ঢোক গিললো। গিলে তার পান খাওয়া ঠোঁট দুটো ফুলিয়ে এগিয়ে গেলো। যেতে যেতে অবশ্য সে আরেকটা কাজ করলো। চিঠি লিখে সুন্দর করে সাজেশনের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো। জীবন যখন হাতের তালুতে নিয়ে বাঘের গুহায় যাবেই, এক কাজে দু’কাজ হোক।

চলবে……