#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৪৭
দরজার টোকা পড়তেই আয়না কেঁপে উঠল। অতিরিক্ত ভয়ে যেভাবে উঠে ঠিক সেভাবে। কেঁপেই বীণার হাত খামচে ধরলো। ভয়ে তার মরি মরি অবস্থা। বাঁচানোর মতো তো কেউ নেই। তবুও এই বিপদের অথৈ সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে ঘুরে ফিরে একটা নামই মাথায় আসে। কেন? একটু জড়িয়ে ধরেছে বলে, নাকি একটা রাত তার সাথে ছিল বলে? তিন কবুল বলে বউ হলে এই রকম অধিকার সব পুরুষরাই দেখায়। এই আর কি? এরা জড়িয়ে ধরতেও সময় নেয় না, আবার স্বার্থে আঘাত লাগলে সেই কবুল পড়া বউকে ছুঁড়ে ফেলতেও ভাবে না। তাই মাথায় আসতেই আয়না সাথে সাথে ঝেড়ে ফেলে। সারেং বাড়ির কেউ ভালো না। তার বাঁচা মরায় কারো কিছু আসবে যাবেও না। এতোদিন শুধু ছিল পৃথিলা আপা। আর এখন সারেং বাড়ির মেয়ে। পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। কেউ তাকে ছাড়বে না, ঐ যে ঘুরে ফিরে যেই মানুষটার নাম মাথায় আসছে, সেও ছাড়বে না। না জেনে ক্ষতি করতে চেয়েছে, এখন কি আর করবে? কখনও না। বরং তার মাথায়ই আগে দেয়ালে ঢুকে দেবে। এই সব ঢুকাঢুকিতে তাদের হাত কাঁপে না। আয়নার বেলায় তো আরো না। তার বাবা নেই, মা নেই, শক্ত ভাবে কেউ পাশে দাঁড়াবে সেই রকমও কেউ নেই। চাইলেই তাকে যা খুশি করা যায়। তো এই আর নতুন কি?
বীণাও নিজেও কেঁপে উঠল। বিয়ের কনের কোন হাবভাবই তার মধ্যে নেই। এমন অবস্থায় থাকার কথাও না। বরং বিয়ে, সব কিছু মাথা থেকে কখন যে বেরিয়ে গেছে, বুঝতেও পারেনি। এখন যা আছে সেটা আতঙ্ক, ভয়। ভাইদের এই রুপগুলো তো কখনও দেখেনি। তাই হজম করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। স্কুল, আশে পাশে পিঠ পিছে কতকিছু শুনতো। তবে কখনও গা করে নি। ভেবেছে পিঠ পিছে অনেক কথাই হয়, তার মধ্যে সত্য কয়টা থাকে। আর এখন মনের অজান্তেই মন বলছে সব সত্য, সব। তার এই প্রিয় পরিচিত ভাইয়ের অচেনা অনেক রুপ আছে। তার ভাবনার বাহিরে আছে। আর সেটা ভাবতেই ভেতরটা ভেঙে এলো। সেই ভাঙার মাঝেই দরজায় আবার মৃদু টোকার শব্দ ভেসে এলো। তারা দুজনের একজনও টু শব্দ করলো না। হাত ধরাধরি করে বসে রইল। সেই বসার মাঝেই দরজার ওপাশ থেকে ভেসে এলো শান্ত একটা কণ্ঠ।
— বীণা, আমি ফরহাদ, দরজা খোল।
বীণা শোনার সাথে সাথেই দরজার দিকে তাকালো। যাকে বিয়ে করবে না, করবে না বলে এতকিছু। তার এই কয়েকটা শব্দে কোন ভরসা পেলো কে জানে।ঝট করে দাঁড়িয়েই কিছুটা দৌড়ে দরজার খিল খুললো। খুলতেই ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেললো। আজ সন্ধ্যায় তাদের বিয়ে হয়েছে, তাদের গায়ে এখনোও বিয়ের শাড়ি, শেরওয়ানি। সেই কিছু বীণার মাথায়ও নেই। সে কেঁদেই বলল, — ফরহাদ ভাই, ভাইয়ের কি হয়েছে? এমন করছে কেন?
ফরহাদ তাকিয়ে তার নববধূকে দেখলো। বিয়ের পরে তাদের শুভ দৃষ্টি হয়নি। এই যে এখন হলো। গায়ে আলুথালু শাড়ি, মাথায় ঘোমটা এলোমেলো, গহনা টিকলি টায়রা চুল সব এলোমেলো। কাজল লেপটে চিবুক ছুঁয়েছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, নববধু তাকে ভাই বলে ডাকছে। এই জমানায় এমন বিরল ঘটনা দেখেছে বলে ফরহাদের মনে পড়ে না। আসলে বিয়ে নিয়ে তো তার আলাদা ভাবনা ছিল না, সব সময় ভাব ছিল গা-ছাড়া। তাই হয়ত আল্লাহ আজ সেই বিয়ে দিয়েই তার গায়ের রস, জান সব চিপড়ে বের করলো।করবে না কেন? আল্লাহর ফরজ জিনিস নিয়ে ভাব দেখিয়েছে। ছেড়ে দিলে হবে।
তাই বড় একটা শ্বাস ফেললো। বীণার কোন উত্তর তার কাছে নেই। এই এরশাদ তার নিজেরও অচেনা। তাই ফেলেই আয়নার দিকে তাকালো। প্রবল ঝড়ের পরে প্রকৃতি যেমন শান্ত নিশ্চুপ হয়ে যায়, সারেং বাড়ির অবস্থাও তেমন। একেবারে শান্ত, নিশ্চুপ, মৃত বাড়ির ন্যায়। এরশাদ তখনই বেরিয়ে গেছে, কোথায় যাচ্ছে বলার অপেক্ষা রাখে না। যাওয়ার আগে একবার জাফরের দিকে তাকিয়ে ফরহাদকে শুধু বলল, — পারলে মান্নার সাথে শাহবাজের কাছে যা। দেখ কি অবস্থা।
— আর তুই?
— ও স্টেশনে যায়নি। স্টেশন সহ সব জায়গায় আমার লোক আছে। কারো না কারো চোখে পড়ত। আর না পড়লেও ট্রেনে উঠতে হলে টিকিট কাটতে হবে। সেই লোকই আমার। তাই ও মিঠাপুকুরেই আছে। ব্যস, খুঁজতে দেরি।
জাফর শুনে আগের মতোই শান্তভাবে বলল,– খুঁজে কি করবি, আমি বেঁচে থাকতে আমার মেয়ে কোন পিশাচের হাতে দেবো না। কোনদিনও না।
এরশাদ তার মতোই হাসলো! হেসে চাচার কথার বিপরিতে কোনো উত্তর দিলো না। নিজের মতো বেরিয়ে গেলো। পুরো গ্রাম এখন এফোঁড় ওফোঁড় করবে বুঝতে কারো বাকি রইল না।
এরশাদ বেরুতেই ফরহাদ খেয়াল করলো, তার বাবা নেই। শুধু সে না, সবাই করলো। করে কারোই তেমন ভাবান্তর হলো না। এমন অবস্থায় কিই বা ভাবান্তর হবে, আছে হয়তো আশেপাশেই। তাই তারাও যে যার মতো বেরুলো। এখানে বসে থাকার আর মানে হয় না। ইমরানও সাবিহাকে ধরে নিজেদের ঘরে ফিরলো। ফিরতেই সাবিহা পৃথিলার সব জিনিস দেখে হাউমাউ করে কাঁদলো। কোথায়, কিভাবে আছে মেয়েটা আল্লাহ’ই জানে? তার জন্য, তার জন্যই সব হলো। যদি এখানে না আসতে বলতো, অন্তত বেঁচে থাকতো।
তারা বেরুতেই ফরহাদ আম্বিয়ার দিকে তাকালো। আম্বিয়া আজ নীরব দর্শক। যে নিজে ভালো থাকে না, অন্যের দুঃখে তার কী আসে যায়। তাছাড়া তার এই এক জীবনের বলিদান হিসেবে তার মনে হচ্ছে আল্লাহ স্বয়ং সারেং বাড়ির বিচার করেছেন। তাই তাকে তেমন বিচলিত দেখা গেলো না। সে এক সাইডে তার মতোই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সেই দাঁড়ানোর মাঝেই ফরহাদ বলল, — দাদিকে রুমে নিয়ে যান।
আম্বিয়া কিছু বলল না, এগিয়ে জয়তুন আরাকে ধরলো। জয়তুন তখন নিস্তেজ। নিস্তেজ ভাবেই উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে জাফরের দিকে তাকালো। তাকাতেই সেই যে আলাউদ্দিনের কথা আবার কানে বেজে উঠল, — কেন করলে এই পাপ সখী। দুনিয়াতে সব মোছা যায়, তবে পাপ না। সেটা ঘুরে ফিরে আসবেই। তুমি বিন্দু পরিমাণ করবে, সেটা অথৈ সাগর হয়ে ফিরে আসবে । এই ফেরার শেষ নেই। পিড়ির পর পিড়ি চলে, চলতেই থাকে। আর তুমি তো করলে মহাপাপ। এই মহা পাপের ভার সইতে পারবে তো?
জয়তুন পারছে না, সত্যিই আর পারছে না। কার জন্য করেছিল এই পাপ। তাই তো পিড়ির পর পিড়ি চলছে। আর দেখো যাদের জন্য করেছে তারাই নিজ হাতে সেই শাস্তি দিচ্ছে। এজন্যই হয়ত বলে, আল্লাহ ছাড় দেয়, তবে ছেড়ে দেয় না। এই যে মুঠো করে জন্মের মতো ধরেছে। এই ধরা থেকে জয়তুনের আর রক্ষে নাই। একদম নাই। তাই কাঁপা কাঁপা কণ্ঠেই ডাকলো, — জাফর, এদিকে আয়। কথা আছে আমার।
জাফর ফিরেও তাকালো না। সে নিজের মতো বাহিরের দিকে এগুলো। এখন সে যাবে থানায়, অনেক হয়েছে। আম্বা, আব্বা, ভাই, ভাতিজা তার কেউ নেই। এক আছে তার মেয়ে। জানে না কি অবস্থায় আছে। ভালো থাকলে ভালো, তবে খোঁজ না পেলে, যেই সারেং বাড়ির বাহাদুরি সবাই করে, সেই সারেং বাড়ির সব হাওয়ায় উঠিয়ে দেবে। তখন সে দেখবে টাকা পয়সা সয়- সম্পতির ছাড়া কার কতো ক্ষমতা।
ফরহাদ সবই দেখলো। দেখে কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। এই ঝড় তো ঝড়’ই না। আসল ঝড় শুরু হবে পৃথিলাকে না পেলে। আর না পেলেই এরশাদের মাথা আবার খারাপ হবে। ভয়ংকর খারাপ। সেই খারাপ হওয়ার আগে আয়নাকে সরাতে হবে। কেননা খারাপ হলেই সব ঝড় আয়নার উপরেই এসে পড়বে। তাই তাকিয়ে বলল, — কিছুক্ষণের মধ্যে আমি শাহবাজের কাছে যাবো। তুমিও চলো।
আয়না কোন টু শব্দ করলো না। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো। সে ভালো করেই জানে, সে যেখানে যাবে সেখানেই বিপদ। হোক বিপদ! তবুও কেন জানি ঐ শয়তান লোকটাই তাকে টানছে। কি আজব ব্যাপার!
আয়না বেরুতেই ফরহাদ বীণার দিকে তাকিয়ে বলল, — কাপড়-টাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে নে। দাদির দিকে খেয়াল রাখিস।
বীণা আস্তে করে মাথা কাত করলো। ফরহাদ সেই কাত করা মুখের দিকে একপলক তাকালো। তাকিয়ে এগুবে, তখনই বীণা সেরোয়ানি টেনে ধরলো। ফরহাদ ফিরে একবার টেনে ধরা সেরোয়ানি, আরেকবার বীণার দিকে তাকালো। তাকাতেই বীণা বলল, — ভাবিকে আপনার বাবা সাহায্য করেছে। তার লোকই পৃথিলা আপাকে নৌকা করে নিয়ে গেছে।
ফরহাদ চমকালো। চমকে অবাক হয়ে তাকালো। সেই চমকানো চোখে দিকে তাকিয়ে বীণা আগের মতোই বলল, — আমি কাউকে কিচ্ছু বলবো না। শুধু সব ঠিক করে দিন। আমি, আমার দুভাই, ভাবি, পৃথিলা আপা সবাইকে একসাথে চাই।
ফরহাদ আগের মতোই তাকিয়ে রইল। তার বাবা আবার এই সবের মধ্যে জড়িয়েছে কেন কে জানে? এরশাদের কানে গেলেই বিরাট ঝামেলা বাঁধবে। তাই বীণার কথার উত্তরে বলার মতো একটা শব্দও পেলো না। তবে ঠিক বুঝতে পারলো। কিছুই আর ঠিক হবে না, একদম না।
আর ঠিক না হওয়ার লক্ষণ শুরু হলো, ফরহাদ আয়নাকে নিয়ে বেরুতেই। জাফর চাচা রেগে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এমন রাগে তাকে ফরহাদ কখনও দেখেছে বলে মনে পড়ে না । আর সেই রাগের মাঝেই তাকে অবাক করে, জাফর চাচা জীবনে যা কখনও করে নি, তাই আজ করলো। গেইটের লোকের গালে ঠাস এক চড় বসিয়ে দিলো। তার বাড়ি, তার ঘর। সেখান তাকে বেরুতে দেবে না। এতো সাহস?
অবশ্য দিয়েও কোন লাভ হলো না। তারা তাদের মতোই দাঁড়িয়ে রইল। কেননা এরশাদ সোজা হুকুম জারি করে গেছে। ফরহাদ ছাড়া একটা পক্ষীও যেন সারেং বাড়ির দরজা না পেরুতে পারে।
আয়না অসহায় ভাবে ফরহাদের দিকে তাকালো। ফরহাদ অবশ্য এক সেকেন্ডও আর সময় নষ্ট করলো না। তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঢাকা যেতে হবে। শাহবাজের কি অবস্থা কে জানে? এতো ঝড় তার একা সামাল দেওয়া সম্ভব না। আর আয়নামতিকে কেউ যদি এখন বাঁচাতে পারে সেটা একমাত্র শাহবাজ।
মাগরিবের আযানটা পৃথিলার কানে এসেছে অস্পষ্টভাবে। সেই আসাও হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। কয়টা বাজে, কোথায় আছে জানেও না। তখন নোংরা হাতের স্পর্শ থেকে বাঁচার জন্য নিজের হাতে চোখ বাঁধলেও, এখন তার হাত, মুখ, পা সবই বাঁধা। সেই বাঁধা অবস্থায়’ই আছে নৌকার পাটাতনের ভেতরে। গায়ের শাড়ি ভিজে চুপচুপে। অনেকক্ষণ এভাবে পড়ে থাকার কারণে শরীর তার অসাড়। হাত পা ব্যথায় ঝিম দিয়ে আছে।
তবে কি হয়েছে, কোন কারণে সে নিজেও জানে না। তখন কোন বিলের কথা বলল কে জানে। তবে বিলে দিকে এগুতে না এগুতেই হলো বিপত্তি। কোনো কিছু নিয়ে দু’পক্ষের ঝামেলা হয়েছে। হয়তো ক্ষেত-টেত নিয়ে। নানান মানুষের হইচই, চেঁচামেচি। গ্রাম গঞ্জে এগুলো সাধারণ ব্যাপার। তবে নৌকায় তাকে দেখা সাধারণ না। দেখা মানেই প্রমাণ। তাই তখনই তিনজনের দুজন দৌড় এলো। কোন কথা টথা নেই। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব হাত, পা, মুখ সব বাঁধলো। বেঁধে বলতে গেলে পাটাতনের ভেতরে ছুঁড়ে ফেললো। ফেলে বিরক্তমাখা সুরে বলল, — হালার কপালই খারাপ। ঝামেলা লাগার আর সময় পায় না। বলেই সুন্দর মতো পাটানের মুখ বন্ধ করে দিলো। দিয়েই কোথায় যেন হারিয়ে গেলো।
পৃথিলা এভাবেই এখানে পড়ে রইল। ছুঁড়ে ফেলায় ব্যথা পেয়েছে। হাতের কুনুই, কোমর জ্বলছে। কেটেছে কি না কে জানে? তবে এই কাটা, ব্যথার চেয়েও তার ঘৃণায় গা গুলিয়ে এলো বেশি। যেই শরীরে আজ পর্যন্ত কখনও পর পুরুষের ছোঁয়া লাগেনি, আজ কি নির্ধিধায় কাগজের টুকরোর মতো ইচ্ছে মতো ধুমড়ে মুচড়ে ফেলছে। অবশ্য সে ভালো করেই জানে, এই ফেলা তো সবে মাত্র শুরু। শেষ দুপুর, নির্জন বিলে তো আর বসে বসে মুখ দেখার জন্য নিতে চায়নি।
অবশ্য সে নিজেকে তৈরি করেই তখন চুপচাপ নৌকায় বসে ছিল। হাজারবার মৃত্যুর চেয়ে একবার মরা ভালো। সাঁতার জানে না, নদীতে স্রোত ছিল। সুযোগ বুঝেই ঝাঁপিয়ে পড়তো সে। আর পড়লেই সব সমস্যার সমাধান। তাই টু-শব্দও করেনি। তবে তার ভাগ্য, এই সাধারণ সমাধান দিতেও নারাজ। তাই অযথাই ঝামেলা লেগে গেলো। তা না হলে আজই এই ঝামেলার কোন দরকার ছিল? না নেই । ও যে তার ভাগ্য। তাই লেগে গেছে। তার দাদি বলতো, — যা হয়, ভালোর জন্যই হয়। আমরা ধৈর্য্য রাখতে পারি না। পারলেই মানুষ দেখতো উপরে যিনি আছেন কতো নিখুঁত কারিগর।
পৃথিলা কি ধৈর্য্য ধরবে? কি জানি? তার ধারণা তার মাথাও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এই যে যখনি মাগরিবের আযানটা পড়ল। তার কিছুক্ষণ পড়েই পৃথিলার মনে হলো, তার পাশ ঘেঁষে কে যেন বসলো। এতো ভয়ের মাঝেও অন্য রকম ভয়ে শরীর তার কাটা দিলো। আসলেই সে পাগল হচ্ছে। একটা পর একটা ঘটনা মস্তিষ্ক আর নিতে পারছে না। তাই হাবিজাবি সব কল্পনা করছে।
তখনই নৌকায় মানুষের শব্দ পাওয়া গেলো। পৃথিলা নিজের অজান্তেই চমকালো। না, মানুষের জন্য না। তারা তো আসতোই, পৃথিলা জানে। তবে চমকালো, কারণ তার মনে হলো, কেউ তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, — ভয় নেই, মহাজন আসছে।
ভয়ে আতঙ্কে পৃথিলার জমে গেলো। জমে গেলেও এক অবচেতন মন তাকে বলছে। এসব কিচ্ছু না। মন মস্তিষ্ক ভয়ে বুদ হয়ে আছে। তাই এমন মনে হয়েছে। তাছাড়া মহাজন আসবে কোথা থেকে? আজকে তার ছেলের বিয়ে। এতক্ষণে ছেলের বউকে নিয়ে বাড়িতে ফেরার কথা। আর তার ভাবনাকে সত্য প্রমাণ করে সেই তিনজনের কণ্ঠই পৃথিলা পেলো। পাওয়ার সাথে সাথেই দু’জন পাটাতনের ভেতরে চলে এলো। এসে এক ঝটকায় পৃথিলাকে টেনে বের করলো। বের করতেই চোখ থেকে গামছাটা সরালো।
রাত হয়ে গেছে। নৌকায় টিমটিম করে ছোট্ট হারিকের জ্বলছে। সেই আলোতে সামনে বসা মানুষগুলোর দিকে পৃথিলা তাকালো। তাদের দৃষ্টি অবশ্য পৃথিলার দিকে নেই। তাদের দৃষ্টি ঘুরছে পৃথিলার ভেজা কাপড়ের শরীরের আনাচে কানাচে । যেই আনাচে কানাচের ভেজা কাপড় টানা-হেঁচড়ায় প্রায় বেহাল দশা হয়ে আছে। আর আছে বলেই পৃথিলা নদীর দিকে তাকালো। তার চোখ গলিয়ে গাল বেয়ে পানি পড়ল। মৃত্যু আসলে কী? শুধু দেহ থেকে রূহটা বের হওয়া ? না, মৃত্যু হলো এই যে রূহটা বের হওয়ার আগে যেই ভয়ংকর সময়টা যায় সেটা। এই যে পৃথিলা মরছে, মরতে মরতে দোয়া করছে, রূহটা তাড়াতাড়ি বের হয়ে যাক। তাড়াতাড়ি যাক। যতো তাড়াতাড়ি যাবে ততোই তাড়াতাড়ি মুক্তি। তবে সে জানে, পৃথিলা নামক মেয়েটার জীবনে কিছুই সহজভাবে হয় না, রূহটাও সহজে বের হবে না।
তখনই একজন এগিয়ে আসতে গেলো। আরেকজন টেনে ধরলো। ধরে বলল, — আমি আগে যাবো, বড় কে?
এগিয়ে আসা লোকটা মুখ কালো করে বলল, — সারাদিন তো আমি বসে বসে পাহারা দিলাম।
— হাত-পা বাঁধা। মেয়েও তো লক্ষী সামান্ত মেয়ে। দেখ একটা টু শব্দও করেনি। তো পাহারা দেওয়ার কী হলো! তাছাড়া সারা রাত পড়ে আছে। যতবার খুশি যাস। এখন সর। মেজাজ গরম করবি না।
পৃথিলা আর শুনতে পারলো না। বিপদে সবাই বাঁচার আকুতি করলেও, সে আকুতি করলো মৃত্যুর। তাড়াতাড়ি মৃত্যুর। সে আকুতির মাঝেই লোকটা এগিয়ে এলো, এসে পায়ের বাঁধন খুললো। খুলতেই পৃথিলা মৃদু হাসলো। ভুল করে ফেলেছে আহাম্মকের দল। বলেই যা কখনও করার কথা চিন্তাও করেনি, তাই আজ করলো। লোকটার মুখ বরাবর লাথি বসালো। বসিয়ে চোখের পলকে উঠে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। পড়তে পড়তে সে স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেললো। গায়ে প্যাঁচানো কাপড়, হাত বাঁধা। রূহটা বের হতে সময় লাগবে না।
লোকগুলো হকচকিয়ে গেলো। তাদের কাছে টর্চ নেই। হারিকেনের মৃদু আলোয় কোথায় পড়েছে, বোঝাও গেলো না। তখনই ওপাশে আরেকটা বড় নৌকা এলো। পানির উপরে পড়ল টর্চের আলো। পড়তেই ওপাশ থেকে আজিজ হুঙ্কার ছাড়লো। বয়স হয়েছে, শরীর ভারী, তা না হলে নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়ত। সেটা সম্ভব নয় বলেই হুঙ্কার ছেড়ে বলল, — কিছু যদি হয়, খুন করে ফেলবো রে হারামজাদা! পানি থেকে তোল, তাড়াতাড়ি তোল।
পানিতে কোনো হুটোপুটি নেই, বাঁচার তাগিদ নেই। যেখানে নৌকা রাখা, নদীর শেষ, বিলের দিকটা শুরু। তাই স্রোতও নেই। তবে পড়ার কারণে বুদবুদ উঠছে। উঠছে বলেই ঠিক সেই জায়গায় তিনজন সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে পড়লো। পড়তে দেরি, খুঁজে পেতে দেরি হয়নি। তবে ততক্ষণে পৃথিলা প্রায় নিস্তেজ, হাত পা ছেড়ে দিয়েছে। সেই অবস্থায় টেনে পাড়ে আনলো।
আজিজের নৌকা পাড়ে ভেড়তেই দৌড়ে নামলো। বিয়ের জন্য পাঞ্জাবির সাইডে চাদর ভাঁজ করে সাইডে নিয়েছিল। সেই চাদর মেলে পৃথিলাকে জড়িয়ে নিলো। নিয়ে পেটে চাপ দিলো। দুনিয়ার পানি খেয়েছে। জানটা না বেরিয়ে গেলেই হয়।
চলবে…..
#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৪৮
পৃথিলা যখন পুরোপুরি হুঁশে এলো, তখন মাত্রই নিঝুম রজনী শুরু হয়েছে। নদীর পাড়ের গৃহস্থ বাড়িগুলোর টিমটিম করা হরিকেনের আলোগুলো ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। আকাশে আজ থালার মতো চাঁদ হেসে আছে। সেই চাঁদের আলোয় জোছনায় চারদিক মুখরিত হয়ে আছে। সেই মুখরিত নিশ্চুপ নৌকায়, নৌকার বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ গানটা পৃথিলার কানে যেতেই ফট করে চোখ খুলে তাকালো।
নৌকার ছাউনির ভেতরে শুয়ে আছে সে। হাত খোলা, এলোমেলো আধভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গায়ে একটা চাদর পেঁচানো। পেঁচানো থাকলেও গায়ের পুরো কাপড় ভেজা। সেই ভেজা কাপড়েই পৃথিলা ধীরে ধীরে উঠে বসলো। সারা শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি। সেই ক্লান্তি মাখা চোখে সামনে তাকাতেই দেখলো, একটু দূরে সাদা শুভ্র পাঞ্জাবি গায়ে, পেছনে দু’হাত মুড়ে মহাজন দাঁড়িয়ে আছে।
মহাজনকে দেখে পৃথিলার তেমন ভাবান্তর হলো না। ঐ যে, কে যেন ফিসফিস করে আগেই বললো, ভয় নেই, মহাজন আসছে। তা নিয়েও বিচলিত দেখা গেলো না। তার সাথে কি হচ্ছে, না হচ্ছে, কেন হচ্ছে কিছুই তার ভাবতে ইচ্ছে করছে না। সে পা গুটিয়ে বাচ্চাদের মতো দু’হাতে নিজেকে জড়িয়ে বসলো। সে আছে একটা ঘোরের মাঝে। এই নিয়ে দু,দুবার মৃত্যর দুয়ার থেকে ফিরে এলো সে। আসলে উপরওয়ালা উদ্দেশ্য কি? নাকি বাবা, মায়ের মনে কষ্ট দেওয়ার নীবর এক শাস্তি।
তখনি আজিজ ফিরে তাকালো। তাকিয়ে বললো, — তুমি ঠিক আছো?
পৃথিলা উত্তর দিলো না। যে ভাবে বসে ছিল, সেই ভাবেই বসে রইল। নৌকার মধ্যে সেই তিনজনের দু’জনও আছে। এখন অবশ্য দৃষ্টি পৃথিলার দিকে না। বরং লুকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। যেন তাকালেই ধ্বংস হয়ে যাবে। আরেকজন সম্ভবত পেছনের নৌকায়। তাদের নৌকার পাশাপাশি আরেকটা নৌকাও যাচ্ছে। অন্ধকারে অবশ্য স্পষ্ট দেখা যায় না, তবে বোঝা যায়। আর বোঝা যায় বলেই পৃথিলা অনায়াসেই বুঝলো কার ইশারায় এরা সব করেছে।
আজিজ এগিয়ে এলো। বসলো পৃথিলার একটু দূরে। বসে বললো, — আর ভয় নেই।
পৃথিলা চোখ তুলে তাকালো! তাকিয়ে তার শান্ত স্বরে বলল, — কেন করেছেন ?
আজিজ মৃদু হাসলো! হেসে বললো, — সব কিছুর পেছনে কোন না কোন যথাযতো কারণ অবশ্যই থাকে?
— থাকে, তবে কোনো কারণই মানুষের জীবনের ঊর্ধ্বে নয়।
— তোমার সাথে যা হয়েছে, সেটা বদলাতে পারবো না। তবে তার জন্য আমি দুঃখিত।
— কেন? আমি নিশ্চয়ই এমন কেউ না, যাকে আপনি প্রথম এভাবে হত্যা করার ব্যবস্থা করেছেন।
— না, তবে আমি আমার রক্তের যোগ আছে এমন কাউকে করিনি।
পৃথিলা শান্ত চোখে তাকিয়ে রইল। তার জীবনে আরো কত কত ধাক্কা খাওয়ার বাকি আছে, কে জানে? এই যে, মনে ভেতরে যা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে, তা সে শুনতে চাইছে না। তবে সে জানে, তাকে শুনতে হবে, শুনে সুন্দর মতো হজমও করতে হবে।
আজিজ সেই শান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, — জাফর ঢাকায় বিয়ে করেছিল শুনেছিলাম। তবে অনেকটা পরে। তাই কিছু করবো তার আগেই আবার শুনি তালাক হয়ে গেছে। তবে সেই ঘরে সন্তান আছে, সেটা জানতাম না। আজই জানলাম।
পৃথিলা বেশ কিছুক্ষণ যেভাবে ছিল সেভাবেই থমকে বসে রইল। তারপর চোখ ফিরিয়ে নদীর পানির দিকে তাকালো। নদীর পানি আর তার চোখে তেমন কোন তফাৎ নেই। দুটোই চাঁদের আলোতে চিকচিক করছে। সেই চিকচিক করা পানি, চোখ থেকে গালে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আহা, কি হতো এই মিঠাপুকুরে না এলে, কি হতো ট্রেনটা তার উপর দিয়ে চলে গেলে। অনেক গুলো কষ্টের টেউ থেকে বেঁচে যেত। এজন্যই বুঝি এতো স্নেহ, এতো নাটক, এতো ভালো মানুষের চেহেরা।
আজিজ নিজেও নদীর পানির দিকে তাকালো। তাকিয়ে নিজের মতোই বলল, — আমার ফুপুর জন্ম আমার বছর চারেক আগে। শেষ বয়সের সন্তান। কালো, খাটো। তার মধ্যে ছিল পায়ের গোঁড়ালি একটু বাঁকা। সোজা হাঁটতে পারতো না। হাঁটতে গেলে বাঁকিয়ে হাঁটতে হতো। এই রকম সন্তান শেষ বয়সে এসে বাবা-মায়ের ঘাড়ে বোঝার মতো। তাও আবার মেয়ে। কারো ঘাড়ে যে সহজে গছাতে পারবে না তাও জানে। তাই যত রকমের অবহেলা আছে, তার মধ্যে তার বেড়ে ওঠা। আর বাড়ির আদরের প্রথম সন্তান আজিজের বিনা বেতনের বান্দী।
আমরা দুজন বড় হই একসাথে। সম্পর্কে ফুপু হলেও, বোন বলো, বন্ধু বলো, খেলার সাথী বলো আমার সব ছিল সে। তার মলিন জামার কোণা ধরে ঘুরে ঘুরে সকাল থেকে সন্ধ্যা হতো আমার। কী সুন্দর নিষ্পাপ একটা মুখ। দিন-দুনিয়া চেনে না, ভালো-মন্দ চেনে না। এই যে মহাজন বাড়ি, সেই বাড়ির বাইরে রাস্তাটাও চেনে না। তার দুনিয়া ছিল বাড়ি, বাড়ির উঠান, রান্নাঘর আর এই যে, এই আজিজ। এই আজিজের সাথেই ছিল সব কথা, তার চোখেই দেখতো মিঠাপুকুর গ্রাম, মিঠাপুকুরের নদী, মিঠাপুকুরের কোণা কোণা। গুটুর গুটুর করে আজিজ সব বলতো, আর সে চোখে মুখে বিস্ময় নিয়ে শুনতো।
সেই দুনিয়া ভেঙে গেল সারেং বাড়ির প্রস্তাবে। জানা কথা, অমত করবে কে? ঘাড় থেকে বোঝা নামছে এই তো কত! ব্যস, নেমে গেল।
একই গ্রাম, তাছাড়া আমার ফুপুকে ছাড়া আমার চলবে নাকি? আমিও বলতে গেলে চলে এলাম তার সাথে। সারেং বাড়ি হয়ে গেল আমার দ্বিতীয় বাড়ি। যখন তখন আসি, নিজের ইচ্ছে মতো ঘুরে ফিরে চলি। ফুপুর সাথে গুটুর গুটুর করে গল্প করি।
এই বাড়িতে ফুপুর গায়ে মলিন জামা থাকে না, থাকে ভাঁজভাঙা নতুন শাড়ি, গলায়, হাতে, নাকে গহনা। কোনো কাজের কৌটাটাও নাড়তে হয় না। নিজের রুমে থাকে। তবে সেই থাকার মাঝেও মুখটা হাসে না। মলিন চোখে জানালা ঘেঁষে সকাল থেকে সন্ধ্যা দূর আকাশে তাকিয়ে থাকে।
ওই বয়সে এই মলিনতা আমি বুঝি না। আমি বুঝি, আমার ফুপু ভালো আছে। এখন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাঁকা পা নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে কাজ করতে হয় না, খাবারের সময় তার খাবারের ভাগ কম পড়ে না। গায়ে নতুন কাপড়, গহনা। তার জন্য এক কাজের লোক সব সময় থাকে। সে’ই খাবার থেকে সব কিছু প্রয়োজনের আগে রুমে নিয়ে আসে।
সেই কৈশোরের অবুঝ মাথা বুঝে নি। আমার ফুপুর যেমন বাপের বাড়ি ছিল না, তেমনি স্বামীর বাড়িও ছিল না। বাপের বাড়িতে সে কাজের বিনিময়ে দু’মুঠো ভাত খেতো, আর সারেং বাড়িতে এই যে এত আরাম আয়েশ, গহনা সব একটা বাচ্চার জন্য। এখানে আমার ফুপু কিছুই ছিল না।
আমার ফুপুর যেমন কিছুই ছিল না, তেমনি সংসারও হয়নি, স্বামীও হয়নি। এই সংসার ছিল জয়তুনের। এই বিশাল রুমটুকু ছাড়া তার আর কিছু নেই। আলতাফ উদ্দিন খারাপ লোক ছিল না। তবে সে ছিল তার চাঁদের মতো প্রথম বউতে দেওয়ানা। বাবা-মায়ের কথায় বংশরক্ষায় বিয়ে তো করেছে। তবে দায়িত্ব ছাড়া আর কোনো কিছুর জন্যই আমার ফুপুর দিকে ফিরে তাকায়নি। তার ধ্যান, জ্ঞান, দুনিয়া ছিল জয়তুন আরা। জয়তুন আরার কথাতেই সব শুরু, তার কথাতেই সব শেষ।
আর এই কিছুই না হওয়ার দুনিয়ায় আল্লাহ তাকে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় নেয়ামত দিলেন, তার সন্তান। প্রথমবার আমি ফুপুকে হাসতে দেখলাম। খিলখিল হাসি, চোখে-মুখে বাঁধভাঙা খুশির জোয়ার। সেই খুশির জোয়ারে ভেসে প্রায়ই তিনি আমাকে বলতেন, — ও আজিজ, বলতো কন্যা হবে না পুত্র?
আমি কিছু বলতে পারতাম না। আমি চেয়ে ফুপুর খুশি দেখতাম। সেই দেখার মাঝেই আবার বলতো, — আমার সন্তান হলে প্রথম কোলে নিবি তুই, নিবি না?
আমি সাথে সাথেই মাথা নাড়াতাম। সে লাগার মাঝেই ফিসফিস করে বলতো, — এই সন্তান আমার, শুধু আমার। আমি এর ভাগ কাউকে দেবো না।
যার কিছুই থাকে না, সে জীবনে হঠাৎ কিছু পেলে দিন-দুনিয়া ফেলে আকড়ে ধরে। আমার ফুপুও ধরলেন। সেই ধরায় সে কাউকে দেখতে পারে না। বাড়ির বড় ছেলে তখন জসিম। বাচ্চা ছেলে। পুরো বাড়ি হুটোপুটি করে খেলতো। সেই খেলার মাঝেই একদিন ধাক্কা লাগলো।
ফুপু পা এমনিতেই বাঁকা, পেটে বাচ্চা। ফুপু পড়তে পড়তে বাঁচলো। আর বেঁচেই জসিমকে এক থাপ্পড় লাগালো।
আমার নাদান ফুপুতো আর জানে না, কার জিনিসে হাত লাগিয়েছে সে। জয়তুন, জয়তুন আরা। জয়তুন আরার কলিজা জসিম। সে জয়তুন আরার গর্ভে না জন্মালেও, তার দুনিয়া সে।
আর তখন থেকেই জয়তুনের চোখের বালি হয়ে গেল সে। তার মধ্যে আলতাফের আচরণ। স্বাভাবিক, এত সাধনার পর প্রথম সন্তান দুনিয়ায় আসছে। মনোযোগ সন্তান, সন্তানের মায়ের প্রতি আসবেই। আর এটাকেই পাগল ফুপু তার শক্তি ভেবে বসলো।
জয়তুনের চোখের বালি যেমন সে, তেমনি তার চোখের বালি জয়তুন, জয়তুনের ছেলে জসিম। সে তার চোখের বালিদের ঘৃণা করে। তবে সে তো জানে না, জয়তুন চোখের বালিদের এই সামান্য ঘৃণায় তার পুষে না। বরং নিঃশেষ করে ফেলে। করলোও তাই।
আমার ফুপু জন্মের পরে ছেলের মুখটাও দেখেনি। তাকে দুনিয়ায় আনতে গিয়ে বেহুঁশ হয়েছিল। সেই হুঁশ জয়তুন আর ফিরতে দেয়নি। দাইয়ের মুখ বন্ধ করেছিল বিশাল টাকায়। সংসার তার, স্বামী তার, সারেং বাড়ির রক্ত তার, ক্ষমতা তার। এক চোখের বালি নিঃশেষে সব তার।
কেউ জানলো না, কেউ বুঝলো না। ঐ যে সারেং বাড়ির দক্ষিণ কোণের রুম, সেই বিশাল রুমে তার ফুপু নিজের অজান্তে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। সবাই জানলেন, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে। এই আর কি? গ্রামে অহরহ মেয়ে এভাবে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মরছে। তাছাড়া তার ফুপুর এই আজিজ ছাড়া ছিলই বা কে? বংশ রক্ষায় এনেছিল, বংশ রক্ষা হয়েছে, কাহিনী শেষ।
এই সারেং বাড়ির ইট, দেয়াল শুধু ঐ যে ভয়ংকর রাত, সেই রাতের সাক্ষী না, সাক্ষী তারো আগে তার ফুপুর মৃত্যর। ইট, দেয়ালের তো মুখ নাই, তাই কেউ জানতেও পারে নাই। আমি তখনও সারেং বাড়িতে ঘুরি ফিরি। ফুপুর গায়ের গন্ধ খুঁজি। জাফরের সাথে লেপ্টে থাকি। তার গায়ে যে তার ফুপুর সুবাস।
আসলে কি জানো? সত্য কখনো চাপা থাকে না। বের হবেই। হলোও তাই। সেই দাইয়ের মুখ বন্ধ রাখার জন্য আরো টাকা চাই। তাই জয়তুনকে হুমকি ধমকি দিতে লাগলো। জয়তুন আরা যে কী চিজ, সে তো জানে না। ব্যস, জন্মের মতো মুখ বন্ধ করে দিলো। সেই দেওয়ার আগেই আমি সব দেখে ফেললাম। এই সারেং বাড়ির পুরো আনাচে কানাচে ঘুরি ফিরি। কে ওতো খেয়াল করে। তাই তাদের সব কথা সুন্দর মতোই শুনলাম। শুনে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালাম না, চুপচাপ সারেং বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। যেতে যেতে মনে মনে একটা কথাই বললাম, — যেই সারেং বাড়িতে তার ফুপুর জায়গা হয়নি, সেই সারেং বাড়িকে আমি ধুলোয় মিশিয়ে দেবো আর দেবো জয়তুন আরাকে। তাকে আমি মৃত্যুর দেবো, ধীরে ধীরে। ব্যস, মনের আগুন মনে চেপে দিন গুনতে লাগলাম। সময় গেল, কৈশোর থেকে যুবক, ঘুবক থেকে পুরুষ। বাবার সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিলাম। নিয়ে জাল বুনতে লাগলাম। সেই জালে সেই ভয়ংকর রাতে সারেং বাড়ি ধ্বংস তো হলো, তবে জয়তুনকে পারলাম কই। ভাগ্য তার সত্যিই ভালো। তাই রয়ে গেল আফসোস। কতটা আফসোস, তুমি জানো না গো মা। সেই আফসোস নিয়ে আমি ঘুমাতে পারি না। তাই আবার জাল বুনি। এই যে, আবার সেই জালে সব আটকে ফেলেছি। এবার আর সারেং বাড়ি বাঁচতে পারবে না।
পৃথিলা অবাক হয়ে আজিজের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কোন দুঃখে দুঃখি হবে সে বুঝতে পারছে না। নিজের পরিচয়, না এই করুণ গল্পে। বরং তার মাথায় ফট করেই অন্য কিছু ঘুরে গেলো। যেতেই অবাক হয়ে বললো, — বীণার সাথে কি করবেন আপনি?
আজিজ হাসলো! হেসে বলল, — জয়তুন আরা যা আমার ফুপুর সাথে করেছে, আমিও তাই করবো। তার নাতনিকে শাড়ি দেবো, গহনা দেবো, তিন-চারটা বান্দী দেবো। আমার প্রিয় ছেলেকে দেবো। তার বিনিময়ে সে আমাকে দেবে শুধু আমার বংশের বাতি, আর তার জীবন।
পৃথিলা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। দুনিয়ার সব ভয়ংকর মুখগুলো দেখানোর জন্যই বুঝি তাকে বাঁচিয়ে রাখা। সে সেই স্তব্ধতার মাঝেই বললো, — আয়নার মাথাটাও আপনি নষ্ট করেছেন, তাই না?
আজিজ হো হো করে হাসলো। হেসে বললো, — সব শুভ কাজে বলি দিতে হয় জানো? আয়না হচ্ছে আমার সেই বলি।
— মানলাম, আপনার ফুপুর সাথে অন্যায় হয়েছে। জয়তুন আরা দোষী। তবে জয়তুন আরার ছোট্ট ছেলেটা কোনো দোষ করেনি, করেনি তার বউ, করেনি আপনার প্রিয় ভাতিজার বউ। তাহলে এক অন্যায় জয়তুন করেছে, আপনি করেছেন তার তিনগুন। তবুও কিসের এতো ক্ষোভ।
আজিজ ভ্রু কুঁচকে বলল, — আপনার ফুপু কী? দাদি হয় তোমার ।
পৃথিলা নিজের মতোই বলল, — আমার দাদির নাম হাফসা বেগম। তাঁর ছেলের নাম সাবেত, সাবেত মাহমুদ। আমি সাবেত মাহমুদ আর শায়লার বড় মেয়ে। এটাই সত্য। আর এই সত্য কখনও বদলাবে না।
আজিজ কিছুক্ষণ পৃথিলার শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর তারমতোই শান্ত ভাবে বলল, — আমার জাফর নির্দোষ। সে শুধু পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল।
— কোন গল্প’ই আমার ভেতরের ঘৃণাকে শেষ করতে পারবে না।
— কেন পারবে না। তোমার শরীরে তার রক্ত।
— এই রক্তকে আগলে রেখেছে আমার বাবা। তার জায়গা দুনিয়ার এমন কেউ নেই সরিয়ে ফেলবে। জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না। বাবার হতে হলে তার কাবিল হতে হয়। সেই যোগ্যতা আপনার জাফরের নেই।
আজিজ স্তব্ধ হয়েই কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর আগের মতোই বললো, — আমার জাফর ঋণের বোঝা টানতে গিয়ে যোগ্য স্বামী, যোগ্য পিতা হতে পারেনি। এই যে, এই জয়তুন আরার জন্যই। তিনি সব কিছু জসিমকে দিয়ে রেখেছিল। আর জাফরকে স্নেহের নামে এমনভাবে আটকে রেখেছে। সে দায় থেকে সে বের হতে পারেনি। তার ভালোবাসার কথা জেনেও গলা টিপে নিজের বোনের মেয়েকে জাফরের গলায় ঝুলিয়েছে। সেই ঝুলানোর দায় জাফর কত কষ্টে হজম করেছে, জয়তুন জানে না, আমি জানি। অথচ জসিম বিয়ে করেছিল নিজের পছন্দে। জসিম, এরশাদ, শাহবাজ, এদের সবকিছুতেই সে উদার। তবে জাফরের ক্ষেত্রে তা হয়নি। তবুও দুনিয়া দেখেছে, সৎ মা হয়েও কী সুন্দর বুকে আগলে রেখেছে। আর এই কারণেই আমি কাউকে ছাড়িনি। তারা থাকলে আমার জাফর ভালো থাকতো না, তাছাড়া জয়তুনের কলিজা ছেড়ার জন্যই তো এতো কিছু।
— অন্যায় অন্যায়ই হয়। জয়তুন আরা যা করেছে, সেটাও অন্যায়, আপনি যা করেছেন, সেটাও অন্যায়। একজনের পাপ কখনও অন্যজন বহন করে না। আর আপনার নির্দোষ জাফর যা করেছে, সেটাও আমার মায়ের দিক থেকে অন্যায়। তাই দয়া করে এই সব পাপের খেলা বন্ধ করুন। বীণা, আয়না ওরা নির্দোষ।”
আজিজ আগের মতোই হালকা হাসলো। হেসে বলল, — আমি বন্ধ করলেও, এরশাদ করবে না। আমি যেমন কসম খেয়েছি সারেং বাড়িকে ধুলায় মেশাবো, তেমনি সে কসম খেয়েছে, তার পরিবারকে হত্যায় যারা যারা আছে, তাদের বংশ নির্বংশ করবে। তুমি কি জানো, সেই দিন রাতে এরশাদ যেই কয়জনকে লাশ বানিয়ে ছিল, তাদের পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। কোথায় গেছে, কী হয়েছে, প্রমাণও নেই। কেন নেই জানো? এরশাদ তাদের নির্মমভাবে হত্যা করে ইটের চুলায় জ্বালিয়ে দিয়েছে। কোনো লাশ নেই, প্রমাণও নেই। এখন বলো, তাদের কী দোষ?
পৃথিলা আর শুনতে পারলো না। এরা মানুষ? মানুষের মতো দেখতে ভয়ংকর এক পশু! সে ক্লান্তভাবে ছাউনিতে মাথা রাখলো। ভালো লাগছে না তার। কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠছে। তখনই নৌকা পাড়ে ভিড়লো। এমনিতেই তেমন কিছু চেনে না। তার মধ্যে রাত, কোথায় এসেছে জানেও না।
আজিজ দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, — আমার কাজ হলে আমি নিজে তোমাকে ঢাকায় পৌঁছে দেবো। তাছাড়া আমি চাইলেও এখন ঢাকায় পৌঁছানো সম্ভব না। এরশাদ কাঁচা খেলোয়াড় না। পুরো গ্রামে তার লোক আছে। আমার বাড়িতে তো নেয়া সম্ভব না। সেই পর্যন্ত চেয়ারম্যান বাড়িতে তুমি থাকবে। সেখানে তোমার কোনো সমস্যা হবে না।
— কিসের কাজ?
— আসলে বলতে গেলে সেই হিসেবে কাজও নেই। আমি এখন শুধু বসে বসে তামাশা দেখবো। কেননা এরশাদ তোমাকে পাবে না। না পেলে, তার বিগড়ানো মাথা আরও বিগড়াবে। সেই বিগড়ানো মাথার ঝড় আয়নার ওপর দিয়ে যাবে। মাথার চুল তো আর বাতাসে পাকে নাই। রূপবতী বউয়ের রূপে সারেং বাড়ির ছোট নাতি অনেক আগেই কুপোকাত। সেই বুঝি চুপচাপ বসে থাকবে? জয়তুন আরার দুই লাঠি নিজেরাই নিজেদের শেষ করবে। তারা শেষ হলে, জয়তুন আরা এমনিতেই শেষ। ব্যস, কাহিনী খতম।
— আয়না আপনাকে নিজের বাবার মতো বিশ্বাস করে।
— তার বাবাও করতো। তুমি হয়তো জানো না, আয়নার বাবা-মাও গায়েব। তবে তাদের গায়েব এরশাদ করেনি। আয়না যাকে বাবার মতো ভরসা করে, সে’ই করেছে।
— আপনারা সবাই পিশাচ।
— হ্যাঁ, তবে আমার ফুপু নিষ্পাপ। তার কিছু ভুল ছিল, তবে পাপ করেনি। আমার জাফর নিষ্পাপ। সে যা করেছে, দায়বদ্ধ থেকে করেছে। আর এই দায়বদ্ধতার শাস্তি সে মরমে মরমে পেয়েছে। আর আমার জাফরের মেয়েও নিষ্পাপ। তার উপর এরশাদের পাপের ছায়া আমি পড়তে দেবো না। তাই, তাদের ধ্বংসই সব সমস্যার সমাধান।
পৃথিলা গলা দিয়ে আর একটা শব্দও বেরুলো না। সে যেভাবে বসে ছিল, সে ভাবেই বসে রইল। তার চোখের সামনে ভাসতে লাগলো, দুটো নিষ্পাপ মানুষের মুখ। বীণা আর আয়না। কী করবে সে? এই গল্পে কে ভালো, কে খারাপ, কে বেশি দোষী, সে জানতে চায় না। সে শুধু জানে, এই দুটো প্রাণ বাঁচাতে হবে। যে ভাবেই হোক বাঁচাতে হবে।
আজিজও পৃথিলাকে আর কিছু বললো না। তবে যেই তিনজন পৃথিলাকে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, — জান বাঁচাতে চাইলে মিঠাপুকুর থেকে গায়েব হয়ে যা। সারেং বাড়ির ঘাটে তোদের নৌকা ভিড়েছে। কার নৌকা ভিড়েছে, এটা বের করা এরশাদের বা হাতের কাজ। আর যদি আমার নাম মুখে আসে, তোরা তো এরশাদের হাতেই শেষ, বাকি তোদের বউ-বাচ্চা, সেগুলোকে আমি নিজ দায়িত্বে শেষ করবো। তাই নিজেরা মরলে মরবি, তবুও আজিজের নাম যেন মুখে আসে না।
তারা তিনজন’ই ঢোক গিললো। টাকার জন্য অকাম, কুকাম তো আজ নতুন করে না। তবুও টাকার লোভ যে কতটা ভয়ংকর, আজ হাড়ে হাড়ে টের পেলো। পেয়েই রাতের আধারে গ্রাম ছাড়তে চাইলো। চাইলেই বুঝি সব পাওয়া যায়? আর যেখানে স্বয়ং এরশাদ! তাই শেষ রাতে গ্রাম থেকে বের হওয়ার আগেই ধরা পড়লো। এরশাদ অবশ্য জানে না, কী কী করেছে এরা। সে শুধু তার সব লোকদের বলেছে, গ্রাম থেকে বের হওয়ার সব রাস্তায় লোক রাখতে। যাকে সন্দেহ হবে, তাকেই ধরতে। আর ধরতেই হড়বড় করে জান বাঁচানোর জন্য তারা বলল, — তারা কিছু করেনি। বিয়ে বাড়ির লোক নিয়ে ঘাটে গিয়েছিল। তখনই একটা মেয়ে তাদের কাছে সাহায্য চায়। ব্যস, তারা সাহায্য করেছে। স্টেশনের ঘাটে নামিয়ে দিয়েছে। তারপর কোথায় গেছে জানে না।
এরশাদ শুনে সব সময়ের মতোই হাসলো। হেসে ঠোঁটে সিগারেট রাখলো। আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে বলল,– ইটের চুলায় আগুন দিতে বল।
চলবে……
#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৪৯
পৃথিলা বসে আছে চুপচাপ। গায়ে মিষ্টি রঙের মোটা পাড়ের একটা কাপড়। খোলা এলোমেলো চুল গুলো ফ্যানের বাতাসে নিজ ছন্দে উড়াউড়ি করছে। করলেও আজ তাদের প্রতি বড় অবহেলা। না চিরুনি পড়েছে, না হাত। সেই যে পানি থেকে উঠেছে। আর গুছানো হয়নি, শুকিয়ে দলা পাকিয়ে আছে। সেই দলা পাকানো চুল নিয়েই পৃথিলা খাটের এক কোণে চুপচাপ বসে আছে। রাত কতো জানেও না। তবে দু’চোখের পাতায় ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই। অবশ্য ঘুমের আর দোষ দিয়ে লাভ কি? অচেনা বাড়ি, অচেনা রুম, অচেনা মানুষের মাঝে কারোই ঘুম আসার কথা না। তার মধ্যে বারো চিন্তায় মাথা ঘোরপাক খাচ্ছে।
চেয়ারম্যান বাড়িটা সদরের কাছাকাছি। তখন মহাজন একেবারে চেয়ারম্যান বাড়ির ঘাটেই নৌকা নিয়ে এসেছে। রাত তখন বেশি না। দশটা এগারোটা হতে পারে। অবশ্য বলতে গেলে গ্রামের দিকে এ’ই অনেক। তবুও চেয়ারম্যান বাড়ি ঝলমল করতেই দেখলো। সেই ঝলমলের মাঝেই পৃথিলা এই বাড়ির বসার ঘরে পা রাখলো। চেয়ারম্যান মোটা খাটো স্বাস্থ্যবান মানুষ। সে সামনে দাঁড়াতেই পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো। দেখে বললো,– আচ্ছা, এই হলো এরশাদের পাখি?
আজিজ বিরক্তমাখা সুরে বলল,– আমার জাফরের মেয়ে। এটাই যেন মাথায় থাকে।
চেয়ারম্যান হেসে বলল,– আরে ধুর বন্ধু! অযথা চান্দি গরম করো কি জন্য। তোমার বাড়ির মেয়ে, আমার বাড়ির মেয়ে একই কথা। নিশ্চিন্তে থাকো। তাছাড়া ঘর গৃহস্থ বাড়ি আমার। বাড়িতে বউ, বাচ্চা, নাতি নাতনি নিয়ে থাকি আমি। এতোটাও আবার খারাপ মনে কইরো না।
— কতোটা খারাপ আমার চেয়ে ভালো কে জানে? তাই যে কোন হাবিজাবি চিন্তা মাথায় আনার আগে, এটা মাথায় রাখবা। আমাদের গায়ে কোন কালির দাগ নাই। নাই বলেই পর পর তিনবার তুমি চেয়ারম্যান। সেই তিন বার যদি চারবার করতে চাও, তাহলে বন্ধুকে তো তোমার লাগবেই লাগবে। তাই সাবধান। আমার জাফরের মেয়ের গায়ে কালি লাগলে, তুমিও ধলা থাকবা না। বলেই পৃথিলার দিকে তাকালো। তাকিয়ে কোমল ভাবেই বলল,– আমি কাল আবার আসবো। বলেই নিজের মতো চলে গেলো।
যেতেই চেয়ারম্যান তার স্ত্রীকে ডাকলো। ডেকে খুব আমুদে গলায় বলল, — একে মেহমানদের রুমে নিয়ে যাও। শুকনো কাপড়, রাতের খাবার দেও। কিছুদিন থাকবে এখানে।
যতো আমুদে সে বলল, তার ছিটেফোঁটাও তার স্ত্রীর চোখে মুখে দেখা গেলো না। বরং খুব বিরক্ত নিয়েই তাকে এখানে আনলো। এনে কাপড়, খাবার টাবার দিলো।
পৃথিলা খেতে পারেনি। না পারাই তার জন্য স্বাভাবিক। মনে অশান্তি নিয়ে সে কখনও গলা দিয়ে খাবার নামাতে পারে না । আজও পারে নি। অথচ খিদেয় শরীর ঝিমিয়ে আসছে। তাই এক গ্লাস পানি কোন রকম গলায় ঢেলে, যেমন যা তেমনি পাঠিয়ে দিয়েছে।
তার পরে এই রুমে কেউ আর আসেনি। এমন না তাকে আটকে বা বন্দি করে রেখেছে। বরং পৃথিলাই দরজা ভেতর থেকে আটকে বসে আছে। চেয়ারম্যানের নজর তার ভালো লাগেনি। তাছাড়া গত কয়েকদিনে মানুষের যে যে রুপ দেখছে। মানুষের উপর থেকে তার বিশ্বাস’ই উঠে গেছে।
তাই একটু সুযোগের অপেক্ষায় আছে। চেয়ারম্যান বাড়িটা কোথায় সে বুঝতে পারছে। ঘাট থেকে যখন উঠান পেরিয়ে বাড়ির ভেতরে এলো, তখনি রাস্তাটা অনুমান করতে পারলো। অবশ্য তার কারণ আছে, বাড়িটা সদরের কাছাকাছি। স্কুলে, সদরে আসা হয়েছে তার বেশ কয়েকবার। সেই হিসেবে কিছুটা পরিচিত হয়েছে। অবশ্য ঝলমল করা বাড়ি না হলে বুঝতে পারতো না। আর বুঝলো বলেই জানে, স্টেশন এখান থেকে খুব একটা দূরে না, না সদর।
সারেং বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। সেখানে যাওয়া মানেই আটকে যাওয়া। আয়না, বীণা বাঁচবে, তবে সে বাঁচবে না। কেননা, এই কয়দিনে এইটুকু ঠিক বুঝতে পেরেছে, এরশাদ তাকে ছাড়বে না, মরে গেলেও না। তাই এমন কিছু করতে হবে, যেন বীণা, আয়নাও বাঁচে, সে নিজেও বাঁচে।
আর এই সব কিছুর জন্য যা করতে হবে, তা হলো, তাকে পালাতে হবে। স্টেশনে ভুলেও যাওয়া যাবে না। মহাজন তো বলল, পুরো গ্রামে এরশাদের লোক আছে। তাই এমন জায়গায় যেতে হবে যেখানে এরশাদের পাওয়ার খাটবে না। সেটা মিঠাপুকুরে এক জায়গায়’ই। থানা! থানায় গেলেই সে বাবার পরিচয় দেবে। প্রত্যেক থানায় ওয়্যালেস আছে। কোন ভাবে মুগদা থানায় খবর পাঠাতে পারলেই হলো। ব্যস! যা করার বাকি বাবাই করবে।
তবে সমস্যা হলো, সে এই বাড়ি থেকে সদরের রাস্থা চিনলেও থানা চিনে না। তাছাড়া এতো রাতে সদরে দোকান পাটও থাকবে বন্ধ। তাই জিজ্ঞেস করবে কাকে? পৃথিলা ভাবে, ভাবতে ভাবতেই ফট করে তার হাসপাতালের কথা মনে পড়ে। যত রাত’ই থাক, হাসপাতালে কেউ না কেউ থাকবে। আর তাদের কাছেই সাহায্য চাওয়া যাবে।
তাই তখনি পৃথিলা উঠে দাঁড়ালো। মহাজনের চাদরটা মাথা থেকে নিয়ে ভালো ভাবে পেঁচালো। পেঁচিয়ে আস্তে করে দরজা খুললো। খুলে রুম থেকে বের হতেই দেখল, পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ। সবাই ঘুমে তলিয়ে আছে। সে কিছুটা পা টিপে টিপে সদর দরজার কাছে গেল। গিয়ে দরজায় হাত রাখতেই দেখল তালা মারা। এবার বুঝল, কেন তাকে বন্দি করা হয়নি। পুরো বাড়িতে একটাই দরজা। সেটায় তালা। রুমের দরজা আটকালেই কি, না আটকালেই কি?
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলেই ঘুরে দাঁড়ালো। দাঁড়াতেই দেখল, চেয়ারম্যান গিন্নি দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখ নির্বিকার।
——-
শাহবাজ যখন চোখ খুলল তখন শেষ রাত। ফজরের আযান দেবে দেবে করছে। রুমজুড়ে আধো আলো, আধো অন্ধকার। এক কোণে এক নার্স হা করে বসে বসে ঘুমাচ্ছে। সে সম্ভবত জরুরি বিভাগে আছে। তাই বাইরের কেউ নেই। তার পাশেই দুই রোগী মরার মতো পড়ে আছে।
শাহবাজ নড়ল না, কোনো শব্দও করল না। কিছুক্ষণ উপরের সিলিংয়ের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রইল। নিজের সাথে যুদ্ধ তার। এই যুদ্ধের রাজা সে, হাতিয়ারও সে, সেনাপতিও সে, শত্রুও সে, আবার বন্ধুও সে। আর এতো কিছুর রানী একজন, তার আয়নামতি। যাকে মন দিয়েছে সে, পেয়েছে সে, তবে নিজের করে শক্ত করে ধরে রাখায় যত দ্বিধা।
এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মাঝেই হাতের ক্যানোলা নিজেই টেনে খুলল। মাথায় কোথাও যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণার চেয়েও বড় যন্ত্রণা বুকে। সেই যন্ত্রণা নিয়েই উঠে বসলো। বসতে বসতে বুকের রাবারের ইলেকট্রোড গুলো টেনে খুলল। খুলতেই মেশিনে টু-টু করে বেজে উঠল।
নার্স ধড়ফড়িয়ে উঠল। উঠেই হতভম্ব! হতম্ভব হয়েই দৌড়ে আসতে গেল। শাহবাজ এক চড় লাগাল। লাগিয়ে দাঁত চেপে বলল, — দূরে। দশ হাত দূরে। এমনিই মন মেজাজ খারাপ। বেশি ঢং হজম হবে না।
কাঁচা ঘুম, হতভম্ব, তার মধ্যে চড়। নার্স গালে হাত দিয়েই কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর এক দৌড় দিল। সে ভাবল, মাথায় আঘাতের কারণে হয়তো এই রোগীর মাথায় কোনো সমস্যা হয়েছে। তবে সে তো জানে না, এর মাথা জন্মগতই খারাপ।
তার দৌড়ে যেতে দেরি, ওয়ার্ড বয় আর ডাক্তারদের দৌড়ে আসতে সময় লাগেনি। শাহবাজ ততক্ষণে রুম থেকে বেরিয়ে করিডোরে। তাদের দেখেই বলল, — ঠিক আছি আমি, একদম ঠিক। এখন জোর টোর করে রাখতে গেলে আরেক সমস্যা। এইসব আবার একদম পছন্দ না। পরে ঊনিশ বিশ করলে দোষ দিতে পারবেন না।
ওয়ার্ড বয়রা দৌড়ে আসতে গেল। ডাক্তার থামাল। থামিয়ে একজনকে বলল, — এই পেশেন্টের সঙ্গে কে আছে, তাদের ডাকো। তারপর শাহবাজের দিকে তাকিয়ে বলল, — শান্ত হন। আমরা বসে কথা বলি। মাথায় আঘাত পেয়েছেন আপনি। সেলাই কয়টা পড়েছে, আপনি জানেন? কোনো রকম স্ট্রেস আপনার জন্য ভালো না।
শাহবাজ হাসল! হেসে কথা বাড়ালো না। আসুক তার চেলাবেলা। তাই করিডোরের দেয়াল ঘেঁষে রাখা কয়েকটা চেয়ারে মধ্যে একটায় শান্তভাবে বসলো। বসতে বসতে বলল, — শালার মাথা! এক বিয়ে করে কতবার ফাটবে, কে জানে?
তখনই ফরহাদ এলো। সে এখানে পৌঁছেছে ঘণ্টা খানেক হয়ে গেছে। এই রাতে জরুরি বিভাগের রোগী তারা দেখতে দেবে না। যা করার সকালে। তাই সবাই বাইরেই ছিল।
আর সে আসতেই শাহবাজ চোখ তুলে তাকালো। তাকাতেই শান্ত চোখে মুহূর্তেই আগুন লেগে গেল। এত ভালো মানুষি, এত এত মধুর বন্ধুত্ব, সব বুঝি বাপের মতো সারেং বাড়ির ধ্বংসের জন্য? আর তার বোন? এই জায়গায় হাত দেওয়া ঠিক হয়নিরে ফরহাইদা।
তাই চোখের পলকে এক ঝটকায় উঠল। উঠেই নাক বরাবর মারতে গেলো। ওয়ার্ড বয়রা তৈরি হয়েই ছিল। নার্সের গায়ে যে হাত তুলতে পারে, বাকি মানুষ আবার কি? তাই উঠতেই সাথে সাথে ঝাপটে ধরলো।
ফরহাদ আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারলো না। তবে শাহবাজ তার দিকে যে তেড়ে আসতে যাচ্ছিলো, ঠিক বুঝলো। বুঝতেই বিরক্ত চোখেই তাকালো। যেখানে কিছুই ঠিক নেই, সেখানে নতুন ঝামেলার মানে হয় না। তাই কোন শব্দ উচ্চারণ করলো না। তবে ডাক্তার এগিয়ে এসে বলল,– শান্ত হন, শান্ত হন। কী সমস্যা আপনার?
শাহবাজ শান্ত হলো না, বরং ওয়ার্ড বয়কে ছুঁড়ে ফেলল। ফেলে ফরহাদের দিকে আবার এগুলো। ফরহাদ দাঁড়িয়ে আছে আগের জায়গায়, নির্বিকার ভাবে। শাহবাজ এগুতেই বলল, — তোর আয়নামতি বিপদে। বাঁচাতে চাইলে সময় আর এনার্জি নষ্ট কম কর।
শাহবাজ থামল! থেমে হাসল। হেসে সাথে সাথেই ভদ্র ভাবে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে বলল, — শাহবাজের বউ সে। শাহবাজ ছাড়া কার সাধ্য তার গায়ে টোকা দেওয়ার?
— তোর প্রাণ প্রিয় বড় ভাই। যার পাখির খাঁচার দরজা তোর বউ খুলে দিয়েছে। সেই পাখি গায়েব। বুঝতে পারছিস?
শাহবাজের এবারও তেমন ভাবান্তর হলো না। বোকা বউ তার, সে তো বোকামিই করবেই। এই বোকামি দেখে দেখেই তো প্রেমে পড়েছে সে। বরং ঐ পৃথিলার মতো জ্ঞানের জাহাজ হলেই হতো সমস্যা। এতদিনে খুন টুন ঠিক হয়ে যেত।
তাই দাঁতে দাঁত চেপে বলল, — তোর ভাবতে হবে না। আমার বউ, আমার ভাই, আমার বোন, সব কিছু থেকে তোরা দূরে, একদম দূরে। তা না হলে খুন করে ফেলব।
ফরহাদ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। আসলে তার মাথায় এবারো কিছুই এলো না। কোন কারণে এর তার ছিঁড়েছে কে জানে। তাই তাকে পুরো উপেক্ষা করে, এগিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেল। তাদের ঝামেলা পরে দেখা যাবে। আগে এখানকার ঝামেলা শেষ করা যাক। শাহবাজকে নিয়ে ফেরা দরকার।
ঠিক তখনই মান্নাও এলো। এত মানুষ এখানে ঢুকতে দেয় না। তবুও ঝামেলার কথা বলে বুঝিয়ে শুনিয়ে এলো। এসেই শাহবাজের কাছে দৌড়ে এলো। এসে বাড়ির সব কিছু বলল। শাহবাজ শান্তভাবে সব শুনল। তার নিজেরই মাথা গরম, আর এদিকে সবার মাথায় আগুন লেগে বসে আছে। কোন দিকে যাবে? ধুর!
ভাবতে ভাবতেই শাহবাজ আবার চেয়ারে বসলো। শরীর আসলেই ঠিক নেই। তাই মহাজন আর মহাজনের পুতের খবর পরে নেওয়া যাবে। তার আগে আগুন নেভানো দরকার। আর সেই আগুনের একমাত্র পানি, তাদের নতুন নতুন পৃথিলা আপা। অবশ্য আপা না, মাহামন্য বড় ভাবি বুঝতে পারছে না। তবে এইটুকু ঠিক জানে, এই সবের সব কিছুতে একজনেরই বা হাত আছে। আবদুল আজিজ।
তোকে তো আমি কুটিকুটি করে কুত্তাকে খাওয়াবো শালা। বলেই ফরহাদের দিকে তাকাল। তাকিয়ে মান্নাকে বলল, — আজ্ঞান-টজ্ঞান করে কী দিয়ে যেন?
— জানি না তো ভাই।
— না জানলে খবর নে। হাসপাতালেই তো আছিস।
মান্না দৌড়ে গেল। শাহবাজ ফরহাদের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে রইল। বিয়ে টিয়ে মানে না সে। দরকার পড়লে, বোনকে সারাজীবন ঘরে খুঁটি দিয়ে দেবে। তবুও মহাজন বাড়িতে পা মাড়াতে দেবে না সে। মরে গেলেও না।
ঠিক তখনই ফরহাদ শাহবাজের দিকে তাকাল। শাহবাজ তার চেনা ভঙিতে ঠোঁট ছাড়িয়ে হাসল। যা করার সে করবে। আজিজ, আয়নার বাপের খবর ভাইয়ের কান পর্যন্ত যেতেই দেবে না সে।
ফরহাদ শাহবাজের সেই হাসির দিকে তাকিয়ে রইল।সে তো আর বোকা না। এই শয়তানের মাথায় যে কিছু চলছে, ভালো করেই জানে। তবে কী, ধরতে পারছে না। আর এই কথা বলল কেন? সবার কাছ থেকে একদম দূরে। দূরের কথা মনে পড়তেই তার বীণার মুখটা ভাসল। ঐ যে ফুলের গহনা নিয়ে হলুদ শাড়ি গায়ে। টলমলো চোখ, মায়াবি একটা মুখ। আর এই মুখের মানুষটাই এখন বউ।
ফজরের আযান পড়তেই তারা বেরুলো। ডাক্তার শাহবাজকে ছাড়বে না, তবে ফরহাদ বুঝালো। সেখানে ডাক্তার আছে, ঔষুধপত্র যা লাগে দিয়ে দিন। তাছাড়া রোগী নিজেও থাকতে চাইছে না। দেখলেন তো, জোর করতে গিয়ে কী হলো।
ডাক্তার, হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ মেনেছে। তবে সহজে না। পকেট গরম করতে হয়েছে। তাছাড়া রোগীর লোকজন না রাখলে তাদের কিছু করার নেই। রোগীও আধা পাগল। একে জোর করে রাখা মানেই ঝামেলা। তাই শাহবাজকে ছেড়েই যেন বাঁচলো, তবে মিঠাপুকুর পর্যন্ত গাড়ি যায় না। যেই পর্যন্ত যায়, সেই পর্যন্ত যাওয়ার জন্যই শাহবাজের চেলাপেলারা গাড়ি ভাড়া করল। তারপর ট্রেন বা অন্য কোনো উপায়ে যাওয়া যাবে। এভাবে যেমন শাহবাজের জন্য ভালো হবে, তেমনি সময়ও কম লাগবে।
সেই হিসেবেই গাড়িতে উঠে বসলো। ফরহাদ আর শাহবাজ পাশাপাশি। বসতেই ফরহাদ বলল, — শাহবাজ, এত ঝামেলায়.. বাড়তি কোনো ঝামেলায় যেতে চাই না। তবে হাড়ে হাড়ে চিনি তো, তাই সোজা বল, কাহিনি কী?
— যদি না বলি?
— না বললে নেই। তবে শুনে রাখ, যতই পালোয়ানগিরি দেখাও, আমি পুরো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ, আর তুই আধমরা। তোর চেলাপেলারা যদি অজ্ঞান করতে আসে, তারা আসতে আসতে আমি আগে তোর মাথায় হাত দেব। জায়গামতোই দেব। বাকি তোর ইচ্ছা।
শাহবাজ হাসল। হেসে মান্নার দিকে তাকিয়ে বলল,
— শালার বেজাত, একটা কাজ তো ঠিকমতো কর!
ফরহাদও তার মতো বলল,– ওদের দোষ কী? আমি তো বোকা না। তাছাড়া হাসপাতালে যা করেছিস। তাই তারা নিজেরাই ডেকে জানিয়ে দিলো।
— একদম সত্য! তোরা বোকা হবি কেন? আজিজের রক্ত! বোকা তো আমরা, তাই তো এতদিনে তিল পরিমাণও বুঝতে পারি নাই রে। ঐ তো আমার সোনা কপালি আয়নামতি। সে যদি না আসতো, তাহলে তলে তলে তল কেটে ফ্যালা ফ্যালা করে ফেলরেও ধরতে পারতাম না।
— বাপ বাদে যা খুশি তাই বল, শাহবাজ। তা না হলে এই যে মেজাজ শান্ত রাখার চেষ্টা করছি, সেটা আর করব না।
— না করলে কী করবি? আধমরা আমি হতে পারি, আমার সঙ্গী-সাথীরা তো না। একবার ইশারা দেই, তখন দেখা যাবে কে কত পালোয়ান!
ফরহাদ শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করল। সে সত্যিই ঝামেলা চাইছে না। মন, মেজাজ, শরীর কিছুই ঠিক নেই। তাই শান্ত ভাবেই বলল, — আমাকে আটকে তোর লাভ কী?
শাহবাজ ফরহাদের দিকে ঘুরলো! ঘুরে বলল, — কান টানলে মাথা আসে, সেটা তো জানিস। তুই হচ্ছিস আজিজ কুত্তার কান। তাই তোকে টানব। সেই কুত্তা লেজ নাড়াতে নাড়াতে দৌড়ে আসবে।
ব্যস! ফরহাদের ধৈর্য শেষ। সে ঝট করে উঠে শাহবাজের গলা চেপে ধরল। শাহবাজের চেলাপেলারা টেনে সরাতে চাইলো। আর ড্রাইভার সাথে সাথে গাড়ির ব্রেক কষল। সে তো আতঙ্কে শেষ। কোন পাগলদের গাড়িতে তুলেছে সে।
সেই আতঙ্কের মাঝেই গাড়ির ভেতরেই হুলস্থুল লেগে গেল। ফরহাদ তাও ছাড়ল না, বরং আরও চেপে ধরে বলল, — বলেছি না, বাপে যাবি না!
শাহবাজ আগের মতো এবার আর হাসল না। না চেষ্টা করলো ফরহাদকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে। চোখ তার টকটকে লাল। সেই লাল চোখ নিয়েই শান্তভাবে বলল,
— সামান্য বাপের নামেই আগুন লেগে গেছে। অথচ আমার বাপ-মাকে খুন করেছিস তোরা। তাহলে ভাব, আমাদের অবস্থা কী!
ফরহাদ থমকালো না, অবাকও হলো না। বরং হেসে বলল,– পাগলের প্রলাপ অন্য কোথায়ও গিয়ে কর।
— আচ্ছা, তাহলে তোর বাপ পৃথিলাকে আটকে রেখেছে কেন?
— আটকে রাখে নি, শুধু তোর বউকে সাহায্য করেছে।
— কেন করেছে?
— আমার বাপ তোদের মতো না, সে সবাইকে সাহায্য করে।
শাহবাজ হো হো করে হাসল। হেসে বলল, তাহলে চল, হাতে নাতে প্রমাণ হয়ে যাক!
— দুনিয়ার কারো কথাই আমি বিশ্বাস করবো না।
— আর যদি তোর বাপের নিজে মুখের হয়?
ফরহাদ উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর গলা ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। তার চোখে মুখে স্পষ্ট আগুন।
শাহবাজ সেই আগুন দেখে হো হো করে হাসলো। হেসে মান্নার উদ্দেশ্য বলল,– গাড়ি ঘোড়া মান্না, খালাশাশুড়ি মিঠাপুকুরে অনেকদিন পা রাখেন না। এতো বড় গাড়ি যাচ্ছে। চল সাথে করেই নিয়ে যাই।
চলবে……