ধূপছায়া পর্ব-৫০+৫১

0
9

#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৫০

আবদুল আজিজ ঘুমিয়েছে মধ্যরাতে। তাই সবসময় আযানের পরপর উঠলেও, আজ ওঠার নাম গন্ধও নেই। শেষ রাত থেকে আবার মিঠাপুকুরের আকাশ মুখ কালো করে আছে। এই নামে তো, সেই নামে। এই নামায় সকাল তো হয়েছে, তবে সূর্য আর উঁকি দিতে পারে নি। দেখতে লাগছে ভোর রাতের মতো। তাই আর বিছানাও ছাড়েনি। এমন আবহাওয়া বিছানা শরীরকে টানে। আজিজ কেও টানছে। তাছাড়া মেজাজ তার ফুরফুরে। এই ফুরফুরে মেজাজ নিয়েই আধো ঘুম, আধো জাগরণে বিছানায় গড়াগড়ি দিচ্ছে।

দিলেও পুরো বাড়ি তার নখদর্পণে। তাই ভালো করেই জানে বিয়েবাড়ির সব আনন্দ-আয়োজন ধূলিসাৎ। ফাতিমা মুখ কালো করে বসে আছে। আত্মীয়-স্বজন সবাই কানাকানি করছে, “বউ অপয়া! কবুল বলতে না বলতেই বাপের বাড়ি ধূলিসাৎ। এই মেয়ে স্বামীর বাড়ি এলেও সব ধ্বংস করে ফেলবে।”

ফাতিমার মন যতই উদার হোক, গ্রামের চিন্তাধারার তো আর বাইরে না! তাই তার মনও বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। বিয়ে বউ নিয়ে যত আহ্লাদ ছিল, সবই এখন শূন্যের কোটায়। আর এসব আজিজকে বিচলিত করছে না; বরং শান্তি দিচ্ছে। সেই শান্তি নিয়েই আরামসে শুয়ে আছে। সেই শান্তির মাঝেই ফাতিমা বিরক্ত মুখে আজিজকে ডাকলো। ডাকতে ডাকতে বলল, — জব্বার আড়ৎ থেকে খবর পাঠাইছে, কী নাকি জরুরি কাজ পড়ছে। এক্ষুণি যাইতে কইছে।

ফাতিমা যত বিরক্ত হয়ে ডাকলো, আজিজ অবশ্য তার ছিটেফোঁটাও বিরক্ত হলো না। এত সহজে বিরক্ত হওয়ার মানুষ সে না। তাছাড়া জব্বার তাকে খালি খালি এই সাত সকালে খবর পাঠাবে না। তাই স্বাভাবিকভাবেই উঠল। উঠে চোখে মুখে পানি দিয়ে পাঞ্জাবিটা গায়ে চড়ালো। চড়িয়ে বেরিয়ে এলো।

যেই স্বাভাবিকভাবে বেরিয়ে এলো, সেই স্বাভাবিক অবশ্য বেশিক্ষণ টিকে থাকলো না। কেননা আড়তে পা দিয়েই দেখলো, শাহবাজ হাত পা ছড়িয়ে তার বসার জায়গায় বসে আছে, মাথায় ব্যান্ডেজ। আর সবচেয়ে বড় কথা, তার পাশেই কাচুমাচু হয়ে আয়নার খালা দাঁড়িয়ে আছে।

সে নিজেকে সামলালো। তার কাজের কোনো সাক্ষী নেই, হয়তো অন্য কোনো কারণে এসেছে। তাই এগিয়ে হালকা হেসেই বলল, — যাক, ফিরেছো তাহলে?

শাহবাজ নিজেও তার চিরচেনা ভঙিতে হাসলো! হেসে আড়মোড়া ভাঙলো। ভেঙে বলল, — সময় কম গো চাচা। কি ভাবে যে উড়ে পুড়ে এসেছি, আপনাকে বোঝাতে পারবো না। তা না হলে আপনার মতো ঘাঘু অভিনয় আমিও একটু করে দেখাতাম। তাই অভিনয় টভিনয় সাইডে রেখে সোজা বলছি, — পৃথিলা কোথায়?

মহাজন হাসলো! তার জায়গায় শাহবাজ বসা, তাই চেয়ার টেনে বসলো। বসতে বসতে বলল, — কোন পৃথিলা? ওহ! ঐ যে স্কুলের নতুন ম্যাডাম, যার জন্য তোমাগো এরশাদ, দুনিয়াকে দুনিয়া মনে করছে না। এত সম্মানের দাদি, তাকে তো কাপড়ের মতো ধুলো। আর আয়না, বাবা গো, আরেকটু হলে তো খুন করে ফেলতো।

শাহবাজের চোয়াল শক্ত হলো! তবে আগের মতোই শান্ত বলল, — জ্বি সেই পৃথিলা, যে আপনার ফুপুর নাতনি, আর প্রিয় ভাইয়ের একমাত্র কন্যা।

মহাজন কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল, তারপর বলল — কি চাও?

— আপতত পৃথিলা। পরের হিসাব পরে।

— কিসের পরের হিসাব?

— কতো কিছু। সেগুলো আজ থাক চাচা। আপতত শুধু এইটুকু বলেন, পৃথিলা ম্যাডাম কোথায়?

— সেটা কি আমার জানার কথা?

— না, তবে আয়না তো বললো, আপনার লোক ঘাটে থেকে নিয়ে গেছে।

মহাজনের তেমন ভাবান্তর হলো না। আয়না গাধীর উপরে সে পুরোপুরি ভরসা কখনও করেনি। এই মেয়ে আকাম তো করে, তবে হজম করতে পারে না। তাই তো নিজের এত লোক থাকতে চেয়ারম্যানের ভাড়া করা লোক ঘাটে রেখেছে। সেই হিসেবেই বলল, — আমি অনেক কিছুই করি শাহবাজ। করি বলেই, এই যে একসময় আয়নার সাথে বিয়েটা তো আমার জন্যই হলো। তা না হলে, তোমরা কবে মানুষকে মানুষ মনে করছো? আমার কাছে তো সবাই সমান। তাই আয়না সাহায্য চাইল। আমার দিল তো দুনিয়ার বড়। তাই শুধু লোক ঠিক করে দিয়েছি। এর পরে কী হয়েছে, কোথায় গিয়েছে আমার তো জানার কথা না। তাছাড়া জেনেও আমার কোনো লাভ?

শাহবাজ এক পলকে চেয়েই, আজিজের ঢং দেখলো। দেখে বললো — যেই লাভ সারেং বাড়ির মানুষদের খুন করে হয়েছে, সেই লাভ।

মহাজন থমকালো! এই কথা শাহবাজ পর্যন্ত যাওয়ার কথা না। সে তখনই আয়নার খালার দিকে তাকালো। বুঝতে তার অসুবিধা হলো না। আয়নার মা গিট্টু লাগিয়েই মরেছে। অথচ সে ভেবেছে সব শেষ। ভুল করেছে, বড় ভুল। সে সাথে সাথেই নিজেকে সামলে বললো, — সবাই চিন্তা করছে, বাড়িত যাও শাহবাজ। অযথা কোনো আঙুল আমার দিকে তুলবা না।

— অযথা? বলেই আয়নার খালার দিকে তাকালো। তাকিয়ে বলল,– খালা শাশুড়ি, কি বলে মহাজন চাচা। আপনি কি কিছু বলবেন? হাজার হলেও বোন, বোন জামাইয়ের খুনি।

কুলসুম কিছু বললো না। তার চোখে ভয়, টলমলে পানি। সেই পানি নিয়ে এক দলা থু থু সাইডে ফেললো। আয়নার বাপ খারাপ, তবে আয়নার মা, আয়না নিষ্পাপ। এরা খুন করে কি সুন্দর অভিনয় করে। তারা তো পারে না।

আজিজ দাঁতে দাঁত চাপলো। মহাজন সে! আর দুই টাকার রাস্তার মহিলার এতো সাহস, আজিজের সামনে থু থু ফেলে। সে দাঁত চিবিয়ে বলল,– বোনের পরিণিতি থেকে কিছু শেখ কুলসুম। বেশি বাড় বেড়ে ছিল। কেমনে কমে গেছে।

কুলসুম হাসলো! তাচ্ছিল্যের হাসি। হেসে বললো,– কমে নি, আপনারা শেষ করছেন।

— জ্বিহা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো।

— আমার বোনের টাও বুঝি এভাবেই ছিঁড়েছিলেন।

— কুলসুম…..

— চেঁচালে সত্য বদলাই না মহাজনসাব। আমরা গরীর তো, তাই এগিয়ে কিছু বলি না। তবুও আপনারা কি অনায়াসেই আমাদের মেরে ফেলেন। অযথা আমরা সেধে কিছুই করিনা, আয়নার মাও করেনি। পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। তাও দেননি? কেন ঐ যে আপনাদের মর্জি মতো যে চলেনি?

আজিজের রাগ মাথায় উঠল! তার মুখে মুখে তর্ক? তাই রাগে মুখ ফসকালো! ফসকে বললো,– না! তোদের মতো মাছি মেরে আজিজ হাত নোংরা করে না। তাই শয়তানের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। শয়তান তাকে খুবলে খেয়েছে। এখন তোদের পালা।

শাহবাজ হাসলো! হেসে বললো,— সবার’ই একটা সময় থাকে চাচা। সেই সময় আপনার ছিল। বিশ্বাস করেন এখন আর নাই। তাই আপতত ঝামেলা চাইছি না। বাড়িতে আগুন লেগে আছে। সেই আগুন নেভানো দরকার। তাই ভালোয় ভালোয় পৃথিলাকে দিয়ে দেন। আমার ভাই ঠান্ডা, আমি ঠান্ডা, সারেং বাড়িও ঠান্ডা।

— যদি না দেই?

— সত্য টেনে বের করবো।

— প্রমাণ আছে?

— প্রমাণ না থাক, তবে সদ্য গজানো বোনের জামাই আছে।

মহাজন চমকে উঠল! ফরহাদ কই? তখনি মনে পড়লো, ঢাকা গেছে এই শয়তানকে আনতে, তো এই শয়তান এখানে, ফরহাদ কই? তবুও তার বিশ্বাস হলো না। তাই আগের মতোই বললো, — ফাঁকা ঢোক অন্য কোথাও গিয়ে মার।

— আরে ধুর! এতোদিনে শাহবাজকে এই চিনলেন চাচা? শাহবাজ আর যাই করুক, ফাঁকা কলসির মতো ঠন ঠন করে না।

আজিজ আগুন চোখে তাকালো। শাহবাজ এগিয়ে দাঁড়ালো মহাজনের ঠিক সামনে। তারপর একটু ঝুকে সেই আগুন চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, — আপনি আমার পুরো পরিবার খুন করছেন, আমি কিন্তু করবো না? আমি করবো শুধু একজনকে। আর সে আপনার কলিজার টুকরো। আমাদের ছটফট দেখে আপনি শান্তিতে ছিলেন। আপনার ছটফট দেখে বাকি জীবন আমরা শান্তিতে থাকবো।

মহাজন রাগে শাহবাজের গেঞ্জির কলার চেপে ধরলো। ধরে বলল, — আমার ছেলের কিছু হলে খুন করে ফেলবো, একেবারে খুন।

— তাহলে হিসাব বরাবর, পৃথিলা দেন, ছেলে নেন।

— কোনদিনও না, বরং বাঘের খাঁচায় এসেছিস। আমি না চাইলে বুঝি এখান থেকে বেরুতে পারবি? এমিনেও তোদের নিঃশেষ করার আমার এক জনমের ইচ্ছা। নিজে আজ সেধে এসেছিস, আজিজ ছেড়ে দেবে? তাই তুই এখানেই থাক। পৃথিলাকে তোর ভাই জীবনেও পাবেনা। রাতটুকু যেমন তেমন গেছে, তবে আজকে আয়নাকে সে কিছুতেই ছাড়বে না। আর রইল আমার ছেলে, তাকে আমি ঠিক খুঁজে নেবো।

শাহবাজ আগের মতোই হাসলো! হেসে কলার থেকে আস্তে করে হাত সরিয়ে বললো,– আমি আমার চেলাপেলাদের বলেছি পনের বিশ মিনিট দেখবি। না ফিরলে কাম খতম। অজ্ঞান তো, তাই সময় লাগবে না। বলেছি আমার বাপ মায়ের মতোই যেন মাথাটা আলাদা হয়।

আজিজ হিতাহিত জ্ঞান হারালো। এগিয়ে ফুঁসে বললো, — আমার ছেলের গায়ে যদি ফুলের টোকাও আসেরে শাহবাজ। বিশ্বাস কর, লোক লজ্জা, সম্মান আমি কোন কিছুর দিকে তাকাবো না। তোদের পুরো গুষ্টিকে যে ভাবে শেষ করেছি, সেই ভাবে তোদের বাকি সবাইকেও শেষ করবো।

শাহবাজ হো হো করে হাসলো! হেসে বললো, — ভয় পেয়েছি আমি! এই যে দেখেন বাথরুমের চাপে সোজা দাঁড়াতে পারছি না। তাই যান আপনার ছেলে কোথায় বলেই দিচ্ছি। ঐ যে, দেখেন। তার খুব গর্ব ছিল তার বাপকে নিয়ে। তাই আমার, এই যে আমার খালা শাশুড়ি কারো কথাই সে বিশ্বাস করেনি। এখন?

মহাজন থমকালো! এতোক্ষণে সব তার মাথায় এলো। আর কি করেছে সেটাও বুঝতে পারলো। পারলো বলেই ধীরে ধীরে পেছনে ফিরে তাকালো। পাটের আড়ৎ দুনিয়ার হাবি যাবি দিয়ে ঠাসা। সেই ঠাসার মধ্যে অন্ধকারে তার কলিজার টুকরো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি শান্ত শীতল।

আজিজের শরীর কাঁপতে লাগলো। এই ছেলেটা যে তার কতো প্রিয় দুনিয়ার কেউ জানে না। শুভ্র পদ্ম ফুলের মতো তার ছেলে। তার বড় ছেলে যখন বউয়ের আঁচল ধরে চলে গেলো। তখন এক বুক কষ্টের মাঝে, এই ছেলেটা বুকে হাত রেখে বলেছিল,” আমি আছি তো। তোমাদের ছেড়ে আমি কখনও যাবো না বাবা।”

যায়ও নাই। এই যে লেখা পড়া করে, নিজের অপছন্দের চাকরি করছে, বিয়ে করছে, আরো কতো কি? হিসেব করতে গেলে হিসেব মিলবে না। তার এক কথায় এই ছেলে সব করে ফেলে।। আজ সেই ছেলের চোখে ঘৃণা কি করে দেখবে। তাই কাঁপতে কাঁপতে ঠাস করে চেয়ারে বসলো। বসতে বসতে বলল, — আমি যা করেছি সব আমার ফুপুর জন্য। তাকে জয়তুন আরা নির্মম ভাবে খুন করেছিল। কি করতাম আমি? ছোট মানুষ, প্রমাণ নাই, সাক্ষী নাই। যতোই গলা ফাটিয়ে বলতাম। কে বিশ্বাস করতো। তাই ফুপুকে ইনসাফ দিতে গিয়ে খুনি হয়ে গেছিরে আব্বাজান। তবে বিশ্বাস কর, এই পাপ করে আমার কোন আফসোস নাই, তিল পরিমাণও নাই।

তখনই জব্বার দৌড়ে এলো। এসে বললো, — চেয়ারম্যান খবর পাঠাইছে, পৃথিলা আপা ভাগছে।

ফরহাদ, মহাজন, শাহবাজ কারোই কোন ভাবান্তর হলো না। ফরহাদ আগের মতোই শান্ত চোখে তার বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। আর শাহবাজ বিস্ময় নিয়ে। তার দাদি, তার প্রিয় দাদি। যার প্রতি তার অগাদ বিশ্বাস। যে সারেং বাড়ির মানুষদের জীবন দিয়ে আগলে রাখেন। তাদের জন্য সব করতে পারে। সে’ই কি না, সারেং বাড়ির ছোট বউকে নিজ হাতে শেষ করেছে। আর করেছে বলেই সারেং বাড়ির এতো ধ্বংস।

পৃথিলা নদীর পাড়ে একটু উঁচু জায়গায় বসলো। বসে পায়ের দিকে তাকালো। পচা শামুকে পা কেটে গেছে। সামান্য কাটা না, রক্ত তরতরিয়ে বের হচ্ছে। সে হাত দিয়ে চেপে ধরলো। রক্ত থামছে না।

চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে সে বের হয়েছে, আযানের একটু পরে। সারা রাত সদর দরজার চাবি থাকে চেয়ারম্যানের কাছে। গ্রামের মানুষের কাছে ভালো থাকতে হয়। তাই প্রতি ওয়াক্ত নামজ মসজিদে গিয়ে আদায় করে। তাই সকালে দরজা খুলে বেরিয়ে যান। সেই সুযোগেই বেরিয়ে এসেছে। অবশ্য সব হয়েছে চেয়ারম্যানের গিন্নীর জন্য।

রাতে তখন দেখা হতেই নির্বিকার ভাবে বলল,– আমি তো ভেবেছি নিজ ইচ্ছায় এসেছো?

পৃথিলা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল,– না, আমি আসিনি।

— তাহলে?

— বললে বিশ্বাস করবেন?

— বিশ্বাস করার মতো কিছু আছে?

— আছে।

— বলো শুনি।

— বলবো, তবে আপনি কি বিশ্বাস করার মতো?

সে উত্তর দেয়নি , তার এমন ভাব। তোমার যা ইচ্ছে।

পৃথিলা সব বোঝে, এই যে যেমন বুঝেছে, স্বামীর সাথে এই মহিলার মন, মহব্বতের সম্পর্ক নেই। আছে লোক দেখানো। তবে কেন জানি মানুষ চিনতে পারে না। এতো সুন্দর করে মুখোশ পড়ে থাকে, সে ধরতেই পারে না। তবুও মনের কথা শুনে ধীরে ধীরে সব বললো। যদি একটু উপকার হয়।

তার সব কথা তিনি সুন্দর ভাবেই শুনলেন। শুনে আগের মতোই নির্বিকার ভাবে বললেন,– সবই বুঝলাম, তবে আমার কিছু করার নেই। তাছাড়া কেউই অচেনা এক মেয়ের জন্য, সংসারে আগুন লাগায় না। যাও, রুমে যাও।

পৃথিলা আর কিছু বলেনি। কি বা বলার আছে। তাই চুপচাপ’ই রুমে চলে এসেছে। তবে তাকে অবাক করে, আযানের পরপর দরজায় টোকা দিয়েছে। পৃথিলা দরজা খুলতেই তাড়াতাড়ি চাদরটা গায়ে জড়িয়ে বলেছে। সদর রাস্তায় ভুলেও যাবে না। কারো না কারো চোখে ঠিক পড়ে যাবে। নদীর ঘাটে যাও। নদীর পাড় ঘেঁষে জঙ্গল। সেই জঙ্গল দিয়ে যাবে। যতোটা কাছে ভাবছো ততটাও না। যেতে যেতে আলো ফুটে যাবে। তাই মুখ ভালো করে ঢাকো। জানি না যেতে পারবে কি না, তবে যেতে পারলে সদরের ঘাট পর্যন্ত ঠিক পৌঁছে যাবে। আর থানা, হাসপাতাল যেই রাস্তায়, সেই বরাবর একটু সামনে গেলেই পাবে।

বলেই এক সেকেন্ডও নষ্ট করেনি। টেনে বের করে এনেছে। পৃথিলা জুতা পরারও সময় পায়নি। এই বাড়িতে সারেং বাড়ির মতো পাহারা নেই। তবুও দুই একজন চেয়ারম্যানের লোক আছে। তাদের চোখ বাঁচিয়ে উঠান পেঁরিয়ে দিয়েছে। দিতেই পৃথিলা তাকালো। তাকিয়ে বললো, — আপনি?

— বাড়ির বউদের ঘরে দাম না থাকলেও, সমাজের সামনে আছে। এরা গায়ে দাগ লাগাবে না। তাই একটু ঝাল দেখালেও জানে মারবে না।

পৃথিলা অসহায় চোখে তাকালো। তার জন্য কেউ কষ্টের মধ্যে পড়বে, এটা সে মানতে পারে না।

মহিলাটা এখন নির্বিকার নেই। বরং কোমল, কোমল স্বরেই বলল,– নামের চেয়ারম্যান গিন্নী আমি। তুমি তো গ্রামের কিছু চেনো না। সদরে জেলে পাড়ায় বউ বাজার আছে। এক রাতের সুখের বউ। সেখানের নিত্য নতুন মেয়ে ঐ যে দেখো উঠানের আরেক কোণে চৌচালা ঘর। নিশি রাতে সেই ঘরে অনায়াসেই আসে। শুধু মহাজনের জন্য হয়ত তোমার দিকে তাকাবে না। তবে অনেক দিন আগে তোমার মতোই একটা মেয়েকে আনা হয়েছিল। নিশি রাতে, ঐ যে ঐ চৌচালা ঘরে। অসম্ভব রুপবতী মেয়ে। তার সব শেষ করে নির্মম ভাবে খুন করা হয়েছিল। চাপা দেওয়া হয়েছিল, ঐ যে ঐ চৌচালা ঘরের পেছনে। তাই যদি সব ঠিক করতে পারো। তবে আয়না নামের মেয়েটিকে বলো। তার মা কোথায় শুয়ে আছে।

পৃথিলা নিস্তব্দ হয়ে তাকিয়ে রইল। সেই থাকার মাঝেই তাড়া দিয়ে বললো, ” তাড়াতাড়ি যাও। তার আসতে সময় লাগবে না।”

পৃথিলা আর দাঁড়ায়নি। অন্ধকার, জঙ্গল, কত কিছুর ভয়। সেই ভয় উপেক্ষা করে দৌড়ে এসেছে। কিভাবে এসেছে নিজেও জানে না। আসতে আসতেই হাত পা তো গাছের আঁচড়ে গেছেই, তবে পা একেবারে গেলো। কতো দূর এখনও বুঝতে পারছে। তবে সকাল হয়ে গেছে। মেঘের কারণে অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না কয়টা বাজে। তবুও পৃথিলা উঠল। নতুন শাড়ি, তার মধ্যে মোটা পাড়। হাজার চেষ্টা করেও ছিঁড়তে পারলো না। তাই কাটা পা নিয়েই খুঁড়াতে খুঁড়াতে এগিয়ে গেলো। যেতে যেতে এক ঘাট চোখে পড়লো। আসতে আসতে অবশ্য অনেক গুলোই ঘাট চোখে পড়েছে। তবে বসত বাড়ির ঘাট আর বাজারের ঘাটের তফাৎ আছে। তাই বুঝতে এতোটুকুও সমস্যা হলো না, এটা সদরের।

সে হাঁফ ছেড়েই ভালো করে চোখ মুখ ঢাকলো। তার অবস্থা খারাপ। এলোমেলো ঝট পাঁকানো চুল, আঁচল, কাপড় নিচ থেকে সব কাদায়, বালিতে মাখামাখি। যে কেউ দেখলে, এক পলকে পাগল ভাবা স্বাভাবিক। তাই ঢেকে ঘাট থেকে বাজারে চলে এলো। সকাল বেলা তার মধ্যে মেঘলা আকাশ। খুব একটা লোক নেই। তবুও পৃথিলা ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলো। হাসপাতাল বাজারের সামনেই, তাই খুঁজে পেলো অনায়াসেই। সেই হাসপাতাল ধরে একটু এগুতে এগুতেই থমকে দাঁড়ালো। রাস্তার ওপারে থানা। তার কাঙ্খিত থানা। সে বলতে গেলে দৌড়ে গেলো।

সাত সকালে থানায় একা একটা মেয়ে। সে ভেবেছিল, যেতেই সবাই অবাক হবে। তবে সেই রকম কিছুই দেখা গেলো না। কনস্টেবল এগিয়ে অফিসার ইন চার্জের রুমে নিয়ে গেলো। যেতেই সে অতি ভদ্রভাবে বসালো। বসিয়ে বলল,— বলুন, কী সাহায্য করতে পারি?

— আমি পৃথিলা। মুগদা থানার অফিসার ইন চার্জ সাবেত মাহমুদের মেয়ে।

— বুঝলাম, তো?

— আমার সাহায্য দরকার। প্লিজ। আমার বাবাকে একটু খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।

অফিসার পৃথিলাকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। দিতে দিতে পেছনে তাকালো। নিচে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ, পা কেটেছে বোধহয়। সে চোখ ফিরিয়ে বলল, — আমরা অবশ্যই সাহায্য করবো। তবে কেউ এসে বললেই তো আমরা ফট করে আরেক থানায় নোটিশ জানাতে পারি না। আপনি আপনার সমস্যা খুলে বলুন।

পৃথিলা ঢোক গিললো। অফিসারের জায়গা থেকে সে একদম ঠিক। কেউ দৌড়ে এসে বললেই তারা শুনবে কেন? তাদের নিয়ম আছে। তাই সুন্দর করেই আবার সব গুছিয়ে বলল। বীণা, আয়নার কথাও বললো। আজিজের কথাও বললো। ভয়, আতঙ্ক, সারা রাত নির্ঘুম। তারমধ্যে অন্ধকারে জঙ্গল টঙ্গল পেঁরিয়ে সে ক্লান্ত। ক্লান্ত ভাবেই হরবর করে সব বললো।

বলতে বলতেই সিগারেটের গন্ধ তার নাকে লাগলো। আর লাগতেই ফট করে পেঁছনে তাকালো।

এরশাদ দাঁড়িয়ে আছে, সাদা শার্ট গায়ে। তবে মার্জিত গোছানো ভাব টা নেই। কেমন যেন অগোছালো, কুঁচানো। তবে সব সময়ের মতো হাতে সিগারেট। আর মুখ ভয়ংঙ্করের চেয়েও ভয়ংঙ্কর।

পৃথিলা ভয় পেলো না, অবাকও হলো না। অফিসারের দিকে ফিরে তাকালো। তাকিয়ে বলল,– টাকার কাছে বিক্রি না হলেও পারতেন।

অফিসারের কোনো ভাবান্তর হলো না। আসলে এরশাদ থানায় এসে বসে আছে শেষ রাত থেকে। এসে এক কথাই বলল, ” সে ঘুরে ফিরে এখানেই আসবে। ব্যস, তাকে আমার চাই। এখন আপনাদের কী লাগবে বলুন।

এমন সুযোগ কোনো অফিসারই হাতছাড়া করবে না। কয়টাকাই বা বেতন! তাই রাজি হয়েছে অনায়াসেই। তবে এই জল যে এতো গভীর, সে ভাবতে পারেনি। গ্রামের বড় তিন মাথার দখলদার। মহাজন, চেয়ারম্যান, এরশাদ। ঝামেলা লাগলে কাকে সামাল দেবে?

চলবে….

#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৫১

শাহবাজ বাড়ি ফিরলো কিছুটা হেলে দুলে। আড়ৎ থেকে বেরিয়ে গেছে আড্ডা খানায়। সেখান থেকেই খেলো দু’ঢোক তাড়ি। যে শরীরের হাল, এই শরীরে শক্তি জোগান কি আর ঔষুধ দিতে পারে? পারে তো এই ঘোলা পানি।

সেই ঘোলা পানির শক্তিতে সব সময় বাড়িতে ফিরে যেমন জয়তুনের কাছে যায়, আজও সোজা জয়তুনের কাছেই এলো। না আজকে আর প্রিয় দাদির কোল ঘেঁষে বসলো না। বসলো দূরে, ঐ যে ঘরের কোণায় চেয়ার পাতা সেখানে। বসেই গা এলিয়ে দিলো। মাথায় যন্ত্রনা, শরীর চলছে বায়ের জোড়ে। তাই গা এলিয়ে বললো,– গল্প শোনাতে এলাম দাদি। এক জয়তুন আরার গল্প, এক জোছনার গল্প, এক আজিজের গল্প,এক এরশাদের গল্প আর সর্বশেষ এক আয়নার গল্প। শুনবে? অবশ্য না শুনতে চাইলেও বলবো। না শুনলে বুঝবা কিভাবে? জয়তুন আরার এক মাটি চাপা ছোট্ট পাপের বিজ, শিকড় – বাকড়, ডাল – পালা সব ছাড়িয়ে আজ কিভাবে বিশাল এক বৃক্ষে পরিণিত হয়েছে।

জয়তুন শান্ত চোখেই শাহবাজের দিকে তাকিয়ে রইল। আজকে জয়তুনের ঘুম ভেঙেছে সব সময়ের মতো সকালে। তবে সব সময়ের মতো বিছানা ছাড়েনি। ঐ যে নীল রঙা লোহার সিকের জানালা, সেই জানালা গলিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাকিয়ে তাকিয়ে জীবনের হিসেব মিলানোর চেষ্টা করলো। অন্য সব মানুষেরা মরে তো একবার, জয়তুন তার জীবনে মরেছে বারবার। একবার মরলো সন্তান না হওয়ার অপরাধে। চোখের সামনে স্বামীর বিয়ে দেখল, বউ নিয়ে ফিরতে দেখলো, দেখল তাদের সংসার। যাক, হজম হয়ে গেছে। জয়তুন কে আল্লাহ যেমন রুপ দিছে, গুণ দিছে, বুদ্ধি দিছে, তেমনি দিছে হজম করার অসীম শক্তি।

তারপর সব গুছিয়ে যখন সুখে আছে, তখন আবার মরলো। ঐ যে কাল রাত, সেই রাতে। সেটাও সয়ে গেছে। এই হাতে নাতি-নাতনিদের মানুষ করতে করতে দুঃখগুলো কবে যে হাওয়ায় মিশে গেছে। বুঝতেও পারেনি।

তারপর আবার মৃত্যু এসে হানা দিলো। এই যে গত রাতে। যাদের মানুষ করতে করতে দুঃখগুলো হাওয়ায় মিশেছে, তারাই আজ ছুঁড়ে ফেলেছে। দাদির আজকাল কতো দোষ। এই যে যেই দাদির মুখের এক কথায় উপরে দুনিয়া ভেঙে চুড়ে ফেলতো। আজ এসেছে গল্প শোনাতে। সে হাসলো, তাচ্ছিল্যের হাসি। হেসে বললো,– শোনা তোর গল্প।

শাহবাজও হাসলো। হেসে সুন্দর করে পাটে পাটে সব বললো। বলে সুন্দর করেই বললো, — আসলে আমার বাবা-মায়ের খুনি কে? আজিজ না তুমি?

আকাশটা অন্ধকার হয়ে আছে। যে কোনো সময় ঝুম বৃষ্টি হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। এই বছর মিঠাপুকুরে বৃষ্টি নেই। সেই যে গেলো, আর খবর’ই নেই। অন্য বছর এই সময় খাল- বিল, পুকুর, নদী বৃষ্টির পানিতে টইটুম্বুর থাকে। আর এবার তার ছিটেফোঁটা ও নেই।

জয়তুন শাহবাজ থেকে চোখ ফিরিয়ে আবার জানালার দিকে তাকালো। সে শুয়ে আছে আগের মতোই। তবে বৃদ্ধা জয়তুন, আজ সত্যিই বৃদ্ধ। সাদা-সোনালি চুলগুলো এলোমেলো। ভাঁজ করা চামড়ায় আর রুপোলি ঝিলিক নেই।

এমন না আম্বিয়া আসেনি। হাজার কষ্টের মাঝেও এই মেয়ে সব কাজ ঠিকমতো করে যায়। এই যে বিয়ে বাড়ির আয়োজনের ধকলের সব কাজ এক হাতেই সামলে করছে। তবে জয়তুনই ওঠেনি। আম্বিয়াকে বলেছে, একা থাকতে দে। ব্যস, সেও আর আসেনি। অন্য সময় হলে আবার এসে ঘুরে যেত, তবে জয়তুন এখন সবার চোখের বিষ।

তাই চোখ ফিরিয়ে বলল — বৃদ্ধ হইছি, হাত-রতের শক্তি ক্ষয় হইছে। এক পা কবরে। এই আছি, এই নাই। তবে আমি যেই জয়তুন, সেই জয়তুনই। আর জয়তুন কোনো কাজের কৈফিয়ত কাউরে দেয় না। কী করেছি, কেন করেছি, কোন অবস্থায় করেছি, সেগুলো সব আমার। এখন যা, তোদের যা খুশি কর। তবে একটা কথা মনে রাখিস। জসিম আমার কোল থেকে না হলেও, সে আমার সন্তান। তোদের বাপ-মা হওয়ার আগেও সে আমার সন্তান ছিল, আছে, থাকবে। এটাই সত্য।

— আর ছোট চাচা?

— সে সারেং বাড়ির বংশধর। যার জন্য জয়তুনের সাথে অন্যায় হয়েছে। তবু জয়তুন ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। অথচ সে গর্ভে আসার সাথে সাথেই তার সিদেসাধা দুনিয়া না-চেনা মায়ের রূপ ঠিক বদলে গিয়েছিল। অথচ জয়তুন সব সময়’ই এক। না সে কারো ডরে রুপ বদলায়, না কারো মহব্বতে। আর সেই রুপ বদলনালো গিরগিটির জন্য আজ তোদের যতো নীতি। অথচ জয়তুন হাত গুটায়ে বসে থাকলে, তোরা হতি রাস্তার কুত্তা।

— আমরা রাস্তার কুত্তার চেয়েও অধম দাদি। সে তার পরিবারকে খুন করে না।

— শাহবাজ…..

— জ্বি দাদি, আমি আপনার শাহবাজ’ই। আমি ভাবতাম আমার দাদি যা করে, সব সারেং বাড়িকে রক্ষার জন্য, আগলে রাখার জন্য। অথচ সে করে সব তার জেদের জন্য।

— তোদের বড় করেছি কোনো জেদের জন্য?

— তুমি যা করো, সব নিজের জন্য। আমারাও তোমার সেই নিজের অংশ। অফসোস বুঝতে বুঝতে যুদ্ধের ঘন্টা বেজে গেলো।

জয়তুন আর রাগলো না, চেঁচিয়ে উঠল না। তবে শান্তভাবে বলল, — আমার সামনে থেকে যা শাহবাজ। তোদের কারো মুখ আমি আর দেখতে চাই না।

শাহবাজ গেল না। বরং উঠল। উঠে দাদির পাশেই শুয়ে পড়ল। শুয়ে ছোট্ট শাহবাজ যেমন বলতো, তেমন করেই বলল, — ভয় করছে, দাদি। উঁহুম, অন্য কোনো ভয় না। বড় ভাইয়ের বিপরীতে দাঁড়াবো, সে ভয়। ছোটবেলায় তো ভয় পেলে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে, জয়তুন বেঁচে থাকতে কিসের ভয়?’ আজও একটু বলতো?

জয়তুন উত্তর দিলো না, নিজের পেটের উপরে গোছানো হাত গোছানোই রইল। সেই গোছানো হাত নিয়ে আগের মতোই জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল। সেই তাকানোর মাঝেই, ঐ যে সেইদিন আলাউদ্দিনের কথা আবার কানে বাজলো — তোমার নাতি, এজন্যই তো ভয় সখী।”

জয়তুনের ঠোঁটে হাসি ফুটলো। সে হার মানে না, জেদের কাছে মাথা নত করে না, তেমনি এরশাদও। তাই হেসেই বলল, — মাথায় যদি হাত রাখার হয়, রাখবো এরশাদের। আমি জানি, ভালো করেই জানি। সবাই পাল্টি মারলেও এরশাদ মারবে না। আমার জসিমের খুনি এরা। সবাইকে মরতেই হবে।

শাহবাজ হাসলো। হো হো করে হাসি। হাসতে হাসতেই দাদির দিকে ফিরলো। ফিরে বলল, — ঐ যে বললাম, তুমি যা করো, নিজের জন্য করো। তা না হলে এই ভয়ংকর এরশাদ তৈরিই হতো না। একবার ভালোবেসে মাথায় হাত রেখে বোঝাতে, তাহলে ইটের ভাটায় যে চিতা এরশাদ ভাই জ্বালিয়েছে, সেটা অনেক আগেই নিঃশেষ হয়ে যেত। তবে তুমি তা দাওনি। তুমি মদদ দিয়েছো। এরশাদ ভাইয়ের রক্তে রক্তে প্রতিশোধ মিশিয়েছো।

— হ্যাঁ, এখন তো এই কথা ফুটবোই। বাপ-মায়ের খুনির মেয়ে যে এখন মনের প্রিয়সী।

— একদম! খুনি দাদি কলজে হতে পারলে, খুনির মেয়ে প্রেয়সী হওয়া বড় কথা না।

— তুই আমার সামনে থেকে যা শাহবাজ।

শাহবাজের যাওয়ার কোন নাম গন্ধ দেখা গেলো না। বরং আরেকটু আরাম করে শুলো। শুতে শুতে বলল — এতোদিন পৃথিলা চোখের বালি ছিল, এখন আয়নামতি। অথচ এই আয়নামতিকেই সারেং বাড়ির বউ করার জন্য মরে যাচ্ছিলে তুমি, তোমার সখা। সে তো ভাই অন্তর্যামী। তাই এই ধ্বংসলীলা যে হবে ঠিক বুঝেছিল। বুঝেই থামাতে সামান্য চেষ্টা করেছিল।

— আলাউদ্দিনকে নিয়ে একটা হাবিজাবিও না শাহবাজ।

— হাবিজাবির কি হলো? সত্য দাদি। সে আয়নার রূপ আর সোনা-কাপালীর লোভ দেখিয়ে ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। কেন চেয়েছিল? গায়ে রুপবতী মেয়ের অভাব আছে? বিয়ে হলেই পৃথিলার বালা কাটতো। কাটতো এই ধ্বংসলীলার। সে মিঠাপুকুর এসে কি করলো, না করলো। কে মাথা ঘামাতো? আর ভাই ব্যস্ত থাকতো বউ নিয়ে। আর এই যে এতো এতো কাহিনি, হতোই না।

কিন্তু উপরে যে আছে, তার সাথে পারার সাধ্য কার? এই যে এতো এতো পাপ, সব মাটি চাপা হয়ে আছে। তাদের সাথেও তো ইনসাফ দরকার। আর আয়না, তাদের ইনসাফ হয়েই এসেছে। তোমার সখা বলেছিলো না, ” সে যে ঘরে যাবে, ঘর আলোকিত হবে?
‘আলোকিত’ মানে কি আর শুধু ঘর, সংসার, বংশের বাতি। নাগো দাদি, না। এই যে এতো এতো বছর ধরে সারেং বাড়ি পাপে অন্ধকারে ডুবে আছে, সেই অন্ধকারের পাপ দূর করায়ও আলোকিত হয়। আর আমার আয়নামতি বুঝে, না বুঝে সেই কাজগুলোই করেছে গো দাদি।

— বাপ-মায়ের খুনির মেয়ের তারিফ করতে লজ্জা করে না তোর?

— না, করে না। এই যে মন-শরীর ভালো থাকলে, তোমার পাশে শুয়ে শুয়ে সময় নষ্ট করি। ঘরে এত সুন্দর বউ আমার!

জয়তুন আর উত্তর দিলো না। দাঁতে দাঁত চেপে আগের মতোই শুয়ে রইল। শাহবাজ উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়াতে দাঁড়াতেই আগের মতো কৌতুক সুরে বলল, — সারেং বাড়ি তৃতীয় পিড়ি, আয়নামতি দ্বারাই হবে দাদি। তাই দাঁতের সাথে দাঁতের যুদ্ধ কম করো।

— তার আগে যেন আমার মৃত্য হয়।

এবার শাহবাজ, আর কৌতুক সুরে কথা বললো না। বরং শান্ত স্বরে বলল, — আমার হায়েত নিয়ে তুমি বেঁচে থাকো দাদি। তুমি নিজের জন্য আমাদের ভালোবাসলেও, আমরা সব কিছুর ঊর্ধ্বেই তোমাকে ভালোবেসেছি। তবে আজিজ মরবে। সেটা আমার হাতে হোক বা ভাইয়ের। কিন্তু শালা সফল। তোমার সিংহাসনের দুই হাত, যুদ্ধের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে। অথচ তুমি যদি সত্যিই আমাদের ভালোবাসতে, অন্তত আমাদের সুখের কথা ভেবে, একবার থামানোর চেষ্টা করতে। তবে তোমার সব চিন্তা এক জায়গাতেই, জয়তুন আরা!

জয়তুন এবারও কিছু বললো না। শাহবাজও দাঁড়ালো না। চেনা মানুষের নতুন নতুন রূপ দেখছে। আশ্চর্য হবে, না দুঃখ পাবে, বুঝতেই পারছে না। শালার দুই দিনের জিন্দেগী, তার মধ্যে তিন দিনই যায় একেক জনের রং দেখতে দেখতে।

শাহবাজ বলেই বেরিয়ে এলো। আসতেই বীণার সামনে পড়লো। পড়তেই বলল, — কোনো বিয়ে-টিয়ে হয়নি। লেখাপড়া করতে চাস কর, যত খুশি কর। মিঠাপুকুর গ্রামের প্রথম মেয়ে তুই হবি, যে ঢাকায় গিয়ে লেখাপড়া করেছে।

বীণা কিছুই বুঝতে পারলো না। সে অবুঝের মতো তার ছোট ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সেই তাকানোর মাঝেই শাহবাজ রুমের দিকে এগুলো। যেতে যেতে বলল, — তোর ভাবি কই?

— আমার রুমে।

— ভয় কি বেশি পেয়েছে?

বীণা উপর-নিচে মাথা নাড়ালো। শাহবাজ আর কিছু বললো না। নিজের মতো উপরে চলে গেলো। শরীর আর চলছে না, ঘুম দরকার তার।

বীণা সেই যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। আয়নাকে গিয়ে বললো,
— ছোট ভাই এসেছে।

আয়নার একবার দৌড়ে যেতে ইচ্ছে করলো। আবার সাথে সাথেই ভয়ে চুপসে গেলো। যে আগুন লাগিয়েছে, কেউ তাকে ছাড়বে না, শাহবাজও না। সে কি আর ভাই, দাদির উপরে যাবে? বরং আরও কয়েকটা দেবে। আর সেই কথা ভেবেই আরো জড়সড় হয়ে গেলো। পুরো বাড়িতে বীণাই আছে একটু ভরসার মতো। তাই আর রুম থেকে বেরই হয়নি। বের তো ভালোই সারা রাত ভয়ে দু’চোখ এক করতেও পারেনি। যখনি একটু চোখ লেগে এসেছে। তখনি মনে হয়েছে, এই বুঝি এরশাদ ভাই দরজায় এসে থাবা মারলো।

……

সারেং বাড়ি যেমন মৃত বাড়ির মতো নিশ্চুপ, মহাজন বাড়িরও সেই অবস্থা হলো। ফরহাদ তখনও নিশ্চুপ ছিল, এখনও নিশ্চুপ। সেই নিশ্চুপ হয়েই বাড়ি ফিরলো।
সব সময় ঝাঁজ-তেজ-বিরক্ত দেখানো ছেলেটা একেবারে নিশ্চুপভাবে নিজের রুমের দিকে গেলো। সে যে গেলো, আর কোন টু শব্দ করেনি।

আজিজও বাড়ি ফিরলো নিস্তেজ হয়ে । ফিরে শুধু ফাতিমাকে বলল, — বাড়ি খালি করো। আমি যেন একটা মানুষকেও না দেখি।

ফাতিমা কী করবে, দিশে পায় না। সব আত্মীয়-স্বজনকে হাত ধরে ক্ষমা চেয়ে যার যার বাড়ির মুখো করলো। এমন পরিস্থিতিতে সে জীবনে পড়েছে বলে মনে পড়ে না। সব দোষ ফেললো অপয়া বউয়ের ঘাড়ে। যত যাই হোক, এই বউ আর সে বাড়িতে আনবে না।

সে কথাই রাগ-জেদ নিয়ে স্বামীর কাছে বলতে গেলো। কী ঝামেলা, সে তো জানে না। সাদাসিধে মহিলা। সব সময় স্বামীর কোমল রুপ দেখে এসেছে। তবে আজ
যেতেই যা কখনও হয় নি, তাই আজ হলো। মিষ্টি কোমল স্বরের আজিজ এক ধমক দিলো।

ফাতিমা কেঁপে উঠল। সেই কেঁপে উঠার সাথে সাথে চোখে মুখে বিস্ময়। আজিজ সেই বিস্ময় ফিরেও দেখল না। সে এগিয়ে গেল ছেলের রুমের দিকে। দরজা চাপানো। সেই চাপানো দরজা ঠেলেই ঢুকলো, ঢুকে কোমল স্বরে বললো, — যা শাস্তি দেওয়ার দে। তবে বাবার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকিস না আব্বাজান।

ফরহাদ বসে ছিল চুপচাপ। শান্ত ভাবেই ফিরে তাকালো। তাকিয়ে বলল, — ভুলের শাস্তি হয়, পাপের না।

— ওদেরটা তোর চোখে পড়ছে না?

— ওরা কিছু করেইনি, বাবা। করেছে জয়তুন আরা।

— তার দোষেই সবাই পাপি তারা।

— সেই হিসেব করার অধিকার তো তোমার না। উপরে যে আছেন, তার।

— না, মহব্বতে এতো হিসেব আসে না। উপরওয়ার আশায় বসে থাকে না। এই ধর, আমি কিছু করিনি। তোর আদর্শ বাপ। বিনা দোষে আমাকে কেউ শেষ করলো। তুই কী করতি? যেই বাপের নামে একটা কটু কথা সহ্য করতে পারিস না, তাকে বিনা অপরাধে শেষ করলে, কী করতি?

— এই প্রশ্নটা তুমি একবার তোমার প্রিয় ফুপুর ছেলেকে জিজ্ঞেস করো, পারলে তার মেয়েকে একবার জিজ্ঞেস করো। তোমার প্রিয় ফুপু যেমন ছিল, তার ছেলেও হুবহু সেই রকম। তারা ভুল করে, অনুতপ্ত হয়, অপরাধ দেখলে মুখ খুলে। এমনকি হাজার অপরাধ দেখলে কঠিন হয়, তবে পাপ করতে পারবে না।

তবে এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারবো না বাবা। কারণ, আমি তোমার সন্তান। যেই অসুস্থ পাপের রক্ত তোমার শরীরে, সেই রক্ত যে আমার শরীরেও। তাই চিন্তা-ধারণাও একই রকম। আর এজন্যই আমি তোমাকে ঘৃণা করছি না, করছি নিজেকে। একজন নিকৃষ্ট পিতার সন্তানকে।

— ফরহাদ…

— চেঁচিয়ো না বাবা। আমার কষ্টের পরিমাপ তুমি করতে পারবে না, বুঝতেও পারবে না। যদি বুঝতে, তাহলে প্রতিশোধ নিতে তোমার প্রিয় পুত্রকে ব্যবহার করতে পারতে না। পারতে না তার ভরসা, বিশ্বাস, ভালোবাসাকে বলি দিতে।

আজিজ উত্তর দিতে পারে না। তবে ফাতিমা দরজায় দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে উঠে। উঠে এগিয়ে বলে, — কী করছেন আপনি আমার ছেলের সাথে, বলেন কী করছেন?

আজিজ এবারও উত্তর দেয় না। তবে ফরহাদ মায়ের উদ্দ্যেশে বলে, — নতুন কিছু করেনি মা। সামান্য খুন করেছে। যেই খুনে তার আফসোস নেই, তিল পরিমাণও নেই। তবে তফাৎ এটাই, এতদিন অন্যকে করেছে, আজ করেছে নিজের প্রিয় সন্তানকে।

ফাতিমা মুখে আঁচল চাপলো। আজিজ অসহায় ভাবে ডাকলো, — ফরহাদ….

— ফরহাদ মরে গেছে বাবা, তুমি তোমার সন্তানকে নিজ হাতে খুন করেছো।

……

অন্ধকার মেঘের কোল ঘেঁষে সূর্য উঁকি দিয়েছে। এই তো কিছুক্ষণ’ই হলো। মেঘের সাথে যুদ্ধ জিতে, একটু যেন মুচকি হাসলো । তবে সেই হাসিতে আগুন ঝড়াতে পারে না। বরং সকালের কচি আলোর মতো ঝিকিমিকি করছে। অথচ বেলা তখন ঘড়িতে এগোরোটা ছুঁইছুঁই।

সেই কচি আলোয় গা ভাসিয়ে এরশাদ বসে আছে থানার এরিয়ার একটু পাশে। মোটা একটা গাছের শিকড়ে। হাতে সিগারেট। বেশ কয়েকটা ফিল্টার সামনেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একটার পর একটা টেনে শেষ করেছে।

তবে ভয়ংকর মুখ এখন শান্ত। যাদের এতোকাল খুঁজেছে, আজ সবাই তারা সামনে। খুশি হওয়ার কথা, তবে খেয়েছে ধাক্কা।

অবশ্য খাওয়া স্বাভাবিক। এতো এতো খোঁজের মধ্যে আজিজের কথা মাথায় আসেনি। অথচ কী সুন্দর নাকের ডগায় ঘুরে বেড়িয়েছে।

ফরহাদের সাথে গলায় গলায় ভাব থাকলেও, তার সাথে সেই ভাব কখনও হয়নি। তবে সম্মান ছিল। আর দেখো, সেই-ই কী সুন্দর তাদের ধ্বংসের জাল বুনেছে। এমনকি তার বোনের দিকেও হাত বাড়িয়েছে।
বলেই এরশাদ সব সময়ের মতো হাসলো। তার সেই নিষ্পাপ, সরলতার হাসি। ছোটবেলায় হাসলেই মা মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো, “মাশাআল্লাহ, আমার ছেলের হাসি দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়।” অথচ সেই হাসিই এখন একেক জনের কাছে আতঙ্ক, ভয়ংকর।

এরশাদ উঠল! এতক্ষণ মনে ঝড়ের তাণ্ডব ছিল।
সবার যে পরিণতি হয়েছে, আজিজেরও হবে। এতে দ্বিতীয়বার ভাবার কিছু নেই। তবে বাকি সবাইকে নিয়ে ছিল।

একদিকে প্রাণপ্রিয় বন্ধু, আরেকদিকে ছোট ভাইয়ের বউ। ঝড় তো হবেই। তবে সেই ঝড় এখন শান্ত। কেননা সিন্ধান্ত নেওয়া শেষ।

এরশাদের দুটো জায়গায় এসে কোনো সম্পর্ক নেই। এক. তার প্রতিজ্ঞা, দুই পৃথিলা। তাই সবার যা পরিণতি হয়েছে, এদেরও হবে। এই বিষয়ে সে কাউকে এক চুল ছাড় দেবে না।

বলেই থানার ভেতরে গেলো। থানার কাজ থানার মতোই চলছে। পৃথিলাকে বসানো হয়েছে অন্য রুমে।
এরশাদকে কিছু বলতে হয়নি। কালাম নিজেই নিজের কাজ করেছে।

হাসপাতাল কাছে। পৃথিলার পা দেখেই ডাক্তার এনেছে।
তবুও এই মেয়ে ভাঙবে না। ডাক্তারকে কিছু করতেই দেয়নি। জানা কথা, এরশাদের কিছুই সে নেবে না। তবে এক কনস্টেবলের থেকে কাঁচি নিয়ে শাড়ির আঁচলের কোণা কেটেছে। কেঁটে সেটা দিয়ে নিজেই পা ভালো করে বেঁধেছে।

এরশাদ দরজায় দাঁড়াতেই পৃথিলা এক পলক তাকালো। তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। চোখে মুখে সব সময়ের মতো বিরক্তি। এরশাদ দেখলো। দেখে স্বাভাবিক ভাবেই এগিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। বসে বলল, — সোজাই বলি, আমি আপনাকে সময় দিতে চেয়েছিলাম। তবে জোর করতে বাধ্য করলেন। কাজী আসছে, বিয়ে পড়ানো হবে।

পৃথিলা চমকালো। চমকে এরশাদের দিকে তাকালো। অতিরিক্ত কষ্টে, আবেগে অন্য সবার মতো চিৎকার, চেঁচামেচি, চোখের পানি সে ফেলতে পারে না। আজও পারলো না। ব্যস, শান্ত নদীর মতো শান্ত হয়ে গেলো।
গিয়ে বলল, — চেষ্টা করে দেখতে পারেন। আপনাদের মতো এত ক্ষমতা না থাক, তবে এই মুখ দিয়ে আপনার নামে কবুল কখনও বের হবে না।

— হবে। খারাপ মানুষের কোনো দায় নেই, তবে ভালো মানুষের আছে। তারা হেঁটে যাওয়া রাস্তার পাশে ভিক্ষুকের দুঃখও এড়াতে পারে না।

পৃথিলার বাড়তি একটা কথাও বলতে ইচ্ছে করলো না। সে উঠল। এই রুম থেকে বের হবে, এরশাদ হাত ধরলো। আর ধরতেই পৃথিলা অবাক চোখে তাকালো।

এরশাদ সেই অবাক চোখের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে আরও ভালো করে হাত মুঠোয় নিতে নিতে বলল, — আগেই বলেছিলাম পৃথিলা, একটা জিনিস ছাড়া আর কোনো কিছুতেই জোর করবো না। সেই একটা জিনিসটা আজ করবো। বিশ্বাস করুন, এই একটা জিনিসের জন্য আমি সবচেয়ে নিকৃষ্ট পথে নামতে হলেও নামবো।

সব মানুষের’ই ধৈর্য্যর একটা সীমা আছে। পৃথিলার সেই সীমা যেন আজ শেষ হলো। আর হতেই ঠাস করে এক চড় এরশাদের গালে বসিয়ে দিলো। দিয়ে বললো, — হাত ছাড়ুন।

এরশাদের রাগ জেদ এরশাদের ভয়ংকর মুখে বোঝা গেলো না। তবে তার হাতের মুঠোর হাতটা আরো শক্ত করেই ধরলো।

চলবে……..