#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৫৫
সন্ধ্যার আযানটা পড়তেই পৃথিলা হারিকেন জ্বালালো। আশে পাশে বাড়ি ঘর নেই, মসজিদও যে অনেকটা দূরে আযানের ক্ষণ আওয়াজ খেয়াল করলেই সহজে অনুমান করা যায়। হারিকেনের আলোটা জ্বালিয়ে জুঁইয়ের হাত ধরেই পৃথিলা বারান্দায় এসে বসলো। দরজা এখন খোলা, ক্ষেতের মধ্যে মাটি উঁচু করে বাড়িটা করা । না, নতুন না। উঠানের মাটি শক্ত, মসৃণ প্রলেপ। আশপাশে বড় বড় সারিবদ্ধ অসংখ্য গাছগাছালি। এই সব গাছ গাছালি অল্প কিছু দিনে হওয়ার কথা না। অনেকটা দিন লেগেছে। সেই গাছগাছালি ধরেই পুরো বাড়ি মোটা কাটা তারের বেড়ায় ঘিরে আছে। এক কোণায় আসা যাওয়ার ছোট্ট একটা ঢালু রাস্তা। সেখানে দু’জন জলচৌকিতে বসে আরামছে সিগারেট খাচ্ছে। পৃথিলাকে দেখেই সাথে সাথে সিগারেট ফেলে দিলো। দিয়ে অন্য পাশে মুখ দিয়ে বসলো।
পৃথিলা বুঝতে অসুবিধা হলো না, বাড়িটা কিসের। গ্রামের মানুষ ধীরে ধীরে নিখোঁজ হয়েছে। তাদের ধরেই শেষ করা যায় না। সময়, সঠিক সুযোগ দরকার। সেই পর্যন্ত লুকিয়ে রাখার জায়গা দরকার। এই বাড়িটা সেই জায়গা। যদি ভুল না হয়, আশে পাশের জমি সব সারেং বাড়ির। চকের শেষ মাথার এক সাইড। এমন সাইডের কিছু জমি চাষাবাদ না করলে তাদের কিছু আসবে যাবে না।
পৃথিলা লোক দু’টোর উপর থেকে চোখ ফিরিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। আকাশটা মেঘলা। মেঘলা হলেও থালার মতো একটা চাঁদ খিলখিল করে হাসছে । সেই হাসিটাকে মেঘ আড়াল করাতে খুব কসরত করছে। এই ঢাকছে, এই আবার হেসে ঝিলিক দিয়ে হেসে উঠছে। সেই হেসে উঠা চাঁদের দিকে পৃথিলা তাকিয়ে রইল।
জুঁই বাইরে এসেই নিজের মতো নেমে গেছে। পৃথিলার কারণে সে ভয় পাচ্ছে না। বাবা মায়ের জন্য মন খারাপ আছে, তবে চিন্তা নেই। ভেবেছে সময়তো বাড়ি ফিরে যাবে। তাই নেমেই লতা পাতার পাতা এই গাছ, ঐ গাছ থেকে ঘুরে ঘুরে নিয়ে হাতে আপন মনে জমা করতে লাগছে।
এরশাদ গোছলে গিয়েছিল, মাথা মুছতে মুছতে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। পৃথিলা ব্যাগের কাপড়-টাপড় ছুঁয়েও দেখেনি। এরশাদ নিজে থেকেই বলল,” গোসল করে নিন, ভালো লাগবে।
সে শান্ত ভাবেই বলেছে, — আমাকে আমার মতো থাকতে দিন।
ব্যস, এরশাদ দ্বিতীয়বার আর কোন শব্দ করেনি। তবে এবার এগিয়ে গেলো। বারান্দা মাটির, তার মধ্যে মানুষজনের বসবাস নেই। পিঁপড়ে বিচ্ছু থাকা স্বাভাবিক ব্যাপার। পৃথিলা সেই বারান্দার মাটির মধ্যেই বসে আছে। তার মধ্যে পা খালি, সকালে বেরোনের সময় তার জুতা রেখে গিয়েছিল। সে জুতাও ছুঁয়ে দেখেনি। পা টা শেষ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। তবুও ভালো নিজে থেকে দুপুরে ঔষুধ টা খেয়েছে। এখন পেকে না গেলেই হয়।
সে বাড়ির ভেতরে গেলো। মাদুর, আর জুতা নিয়ে এলো। তার জুতা না, পৃথিলার জুতা। সেই যে হসপিটালে প্রথম পৃথিলার জন্য কিনলো। সে তো ফিরে তাকিয়ে দেখেনি। তবে এরশাদ যত্ন করে তুলে রেখেছিল। পৃথিলার নামের একটা সুতাও তার কাছে হিরে রত্নের মতো দামি।
আজ আবার নিয়ে এসেছে। তাই এগিয়ে পায়ের কাছে রাখলো। বলল, — উঠুন, এটা বিছিয়ে দিচ্ছি।
পৃথিলা জুতা জোড়া দেখলো। দেখে চিনতে অসুবিধা হলো না। এই জুতার দিকে দৃষ্টি রেখেই বলল,— প্রয়োজন নেই।
— আছে, উঠুন।
পৃথিলা উঠল না, আগের মতোই বসে রইল। জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, — ওকে বাসায় দেবেন কখন?
— কাল।
— ওকে এনে কি পাপ করালেন সাবিহাকে দিয়ে?
— ছোট্ট একটা পাপ, এতো আপনার বান্ধবী জাহান্নামে যাবে না।
— কেন করছেন এসব?
— শাস্তি।
— কিসের?
— আমার বাবা-মায়ের খুনির।
— আর আপনার দাদি?
— দাদি?
— খুন তো সেও করেছে, তার শাস্তির কি?
— সেটা আমার দেখার বিষয় না, সে আমার দাদি, আমাদের আগলে মানুষ করেছেন। সে তার জীবনে কি করেছেন, সেটা তার ব্যাপার।
পৃথিলা হেসে ফেললো! হেসে এরশাদের দিকে তাকালো। তাকিয়ে বলল,– যে নিজের চোখ নিজে বেঁধে রাখে, কারো সাধ্য নেই চোখ খোলার। আপনারও সেই অবস্থা। তা না হলে আপনি ঠিক দেখতেন, আপনার দাদি তার জীবনে এই অন্যায়টা করেছে বলেই, আজিজও এই অন্যায় করেছে। আর করেছে বলেই আপনার বাবা, মা নেই।
— সবই বুঝলাম, তো বলুন, এই সব কিছুতে আমার বাবা মায়ের দোষ কি?
— কোন দোষ নেই। আপনার দাদি এক অন্যায় করেছে, আজিজ সেই প্রতিশোধের আগুনে করেছে তার তিনগুণ, সেই তিনগুণের আপনি করেছেন হাজার গুণ। আর কতো? প্রত্যেক মানুষের জীবনের পথে ধূপছায়া দু’টোই থাকে। ব্যস, সঠিক সময়ে সঠিক সিন্ধান্ত নিতে হয়। আপনি ছায়ায় নরম ঘাসের উপর দিয়ে আঁলতো পায়ে এগিয়ে যাবেন, না ধূপের আগুনে ঝলসে। তবে তিক্ত হলেও সত্য আপনারা সবাই ঝলসে যাওয়ার সাইড ধরে এগিয়েছেন। অথচ চাইলেই, একটু থেমে ছায়ার পথে হেঁটে সব ক্লান্তি দূর করতে পারতেন।
এরশাদ মাদুরটা আর পাতল না। খারাপ ভালো যা’ই বলুক, পৃথিলা যখন কথা বলে শুনতে ভালো লাগে। কি শান্ত, কোমল সুরে বলে। এরশাদের ঘোরের মতো লাগে। তাই নিজেও বারান্দার মাটিতে বসলো। তবে কিছুটা দূরে। বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, — আমার জায়গায় সেই দিন আপনি থাকলে কি করতেন?
— আপনি যা করেছেন তাই করতাম। তবে নিজের পরিবারকে বাঁচানোর জন্য তলোয়ার হাতে নিলে সেটা পাপ হয় না। সেইদিন সেই যুবক এরশাদ যা করেছে, সেটা পাপ না। তবে তারপরে যা যা করেছে, সবই পাপ। সেই রাতটুকু দিয়ে পরের পাপটুকু আপনি মুছে ফেলতে পারবেন না। তখন করেছেন সেগুলোও পাপ এখন যা করেছেন এগুলোও পাপ। তাই এই পাপের খেলা বন্ধ করুন। আর কত?
— করলে আপনি আমার হবেন?
পৃথিলা উত্তর দিলো না। জুঁই এক জোনাকি পোকা ধরেছে, খুশিতে এক চিৎকার দিয়ে পৃথিলার কাছে দৌড়ে এলো। পৃথিলাও হাসলো! হেসে হাতে নিলো। নিয়ে আবার ছেড়ে দিলো। দিতে দিতে বলল,— আমাদের দেখাটা বড় ভুল সময়ে হয়েছে। ধরুন, আপনার দাদি পাপ টা করলো না। আপনার ছোট চাচা বড় হলো মায়ের আপন কোলো। তার মা তার ভালাবাসা মেনে নিলো। আমি বড় হতাম এই মিঠাপুকুরের বুকে। তারপর, হয়ত অন্য একটা গল্প হতো। সেই গল্প পাপ থাকতো না, ভয়ংকর এরশাদ থাকতো না। থাকতো…. পৃথিলা থেমে এরশাদের দিকে তাকালো, সব সময়ের মতো চোখে। আধো আলো, আধো অন্ধকারে চোখটা জ্বলজ্বল করছে। তবে আজকের জ্বলজ্বল ভিন্ন। এই ভিন্নতে কোন মুখোশ নেই, নাটক নেই, আছে বেঁধে রাখা শক্ত পুরুষের অবাধ্য অশ্রু।
পৃথিলা সেই অশ্রু দিকে তাকিয়ে বলল,— আপনি মানেন আর না মানেন। আপনার দাদি শুধু আপনার ছোট চাচির সাথে অন্যায় করেনি, করেছে সারেং বাড়ির প্রতিটা মানুষের সাথে। সেই মানুষের মধ্যে যেমন বাইরের আজিজ আছে, তেমনি ভেতরের আপনিও আছেন। আর অনেক অনেক দূরের পৃথিলা নামক মেয়েটা আছে।
এরশাদ চোখ ফিরিয়ে নিলো, পৃথিলা মৃদু হাসলো। আয়নায় মুখ দেখা খুবই সহজ, তবে কর্ম দেখা এতো সহজ না। তখনই এক লোক দৌড়ে এলো। এসে বলল,
— পুলিশ আয়না ভাবিকে ধরতে বাড়ি দিকে যাচ্ছে।
এরশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আয়নাকে আজকে ধরতে যাবে কেন? আয়নাকে ধরতে গেলেই শাহবাজ গন্ডগোল করবে। গন্ডগোল লাগলেই সব কথা ছোট চাচার কান পর্যন্ত যাবে। আয়না আছে হাতের কাছেই। তাই আজিজের ব্যবস্থা করে, পরে ওইদিকে যেতে বলেছিল। তো?
সে ভ্রু কুঁচকেই বলল,— অফিসারের মাথা ঠিক আছে?
লোকটা একবার পৃথিলার দিকে তাকালো। তাকিয়ে আবার এরশাদের দিকে তাকালো। এরশাদ বুঝলো, বুঝে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, — জুঁইকে নিয়ে ভেতরে যান।
পৃথিলা উঠে দাঁড়াতে গেলো, এরশাদ নিচু হয়ে আস্তে করে কাটা পায়ে জুতাটা পরিয়ে দিলো। দিতে দিতে বলল,— সময় ভুল হোক, আর যাই হোক। আমার কাছে এখন তুমিই সব। তাই যা বলার বলুন, আমার কাছে এখন শুধু, তুমি আমি, তুমিই আমি, এবং তোমাতেই আমি।
পৃথিলা উঠল না, এরশাদও আর কিছু বললো না। পাহারার দু’টো লোককে ইশারা দিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। বেরিয়ে রাস্তায় উঠতেই লোকটা বলল,– ঢাকা থেকে পুলিশ আইছে। একদল, তাদের মধ্যে একজন নাকি বড় ভাবির আব্বা।
এরশাদ রাগে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা, গাছের গুঁড়িতে এক লাথি দিলো। লাথিতে যেমন গাছের গুঁড়ি ভাঙলো, তেমনি তার পা কাটলো।
সাবেত যখন মিঠাপুকুর থানায় পা রেখেছে তখন সন্ধ্যা হবে হবে করছে। আজিজকে থানায় আনতেই থানা গরম। আজিজের লোক, চেয়ারম্যানের লোক সব মিলিয়ে হুলুস্থুল। সেই হুলুস্থুলকে সামলাতে গিয়ে অফিসারের জান যায় যায় অবস্থা। সেই যাওয়ার মাঝেই এক কনস্টেবল এসে তাকে জানালো, মুগদা থানার অফিসার এসেছে, সাথে পুরো এক টিম নিয়ে।
শুনেই তার শরীর দিয়ে চিকন ঘাম দিলো। আর কেউ না জানুক, সে তো জানে সাবেত কে? তাই ঘাম সামলানোর সুযোগও হলো না। তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গেলো। সবার সাথে সম্মানের সাথে হাত মেলালো। মিলিয়ে বসিয়ে চা পানির ব্যবস্থা করলো। করে না জানার ভান করে বলল, — কোন কেইসে সমস্যা হয়েছে?
সাবেত শান্ত ভাবেই নড়ে চড়ে আরাম করে বসলো। তাদের থানার ল্যান্ডলাইনে ফোন এসেছে দুপুরের পরে। ফোন করেছিল পৃথিলার শাশুড়ি। কখনো পরিচয় ছিল না। তারেকের কেস ঘাটাঘাটি করতে করতে যেইটুকু জেনেছে। তবে সে সুন্দর মতোই সব ফোনে বললো। তবে সমস্যা হলো চিঠিতে নাকি নাম ঠিকানা ভিন্ন। নাম ঠিকানা নিয়ে সমস্যা নেই। পৃথিলা বুদ্ধিমতি মেয়ে। বিপদে অনেক কিছুই করতে পারে। তাই ঝড়ের গতিতে সব করেছে। যতো ক্ষমতাই থাক, অচেনা জায়গায় প্রস্তুতি ছাড়া যাওয়া বোকামি ছাড়া কিছু না। তাছাড়া চিঠিটা সপ্তাহ খানেক আগের, কি অবস্থায় তার মেয়েটা আছে জানেও না।
তাই নড়ে চড়ে বসে শান্ত ভাবেই পৃথিলার ব্যাপারে সব বললো। বলে বললো, “চিঠিটা এখনো আমার হাতে পৌঁছায়নি। চিঠিটা লিখেছে সে, তার প্রাক্তন শাশুড়ির কাছে। আজকে দুপুরেই তারা হাতে পেয়েছে। পেয়ে ল্যান্ডলাইনে ফোন করে ব্যাপারটা আমাকে জানিয়েছে। আমি তো চিঠির জন্য বসে থাকতে পারি না। মেয়ে আমার, চিন্তাও আমার। তাই সেখানে লোক পাঠানো হয়েছে, চিঠি আসছে। আপাতত আপনি বলুন, কিছু শুনি।”
অফিসার ঢোক গিললো। কোন অফিসার কেমন, কণ্ঠ শুনেই ধারণা করা যায়। আর এই মেয়েও ভাই, চোরের উপরে সামসের। এরশাদের মতো চতুর লোকের চোখে কি সুন্দর ধুলো ছিটিয়েছে। এরশাদ ধরতেও পারেনি। সে ঢোক গিলে একটু হেসে বলল, — আপনার মেয়ের কেসে আমরাও কাজ করছি। এমনকি আজকে আসামিকেও ধরেছি। তবে সমস্যা, সে গ্রামের গণ্যমান্য একজন। এই যে থানা ভর্তি লোক, সব তার। আর সে মুখ খুলছে না।
সাবেত আগের মতোই শান্ত চোখে অফিসারের কথা শুনলো। বয়স অল্প, নতুন অফিসার। তাই শান্তভাবেই শুনে বলল, — এই কেসের ফাইলটা আমাকে দিন।
— জ্বি?
সাবেত শান্তভাবেই আরেকটা কাগজ এগিয়ে দিলো। দিতে দিতে বলল, —- মানুষের মাংস মানুষ খায় না। হাজার তেল ঝোল দিয়ে রান্না করে দিলেও খাবে না। তবে কুকুরের এই সমস্যা নেই, তার চোখের সামনে একটা কুকুর মারবেন। মেরে তেল ঝোল দিয়ে রান্না করে দিলেই টুপ করে খেয়ে ফেলবে। পুলিশ আর কুকুরের মাঝে খুব একটা তফাৎ নেই। সেটা আমি যেমন জানি, আপনিও জানেন। তবে জানার অভিজ্ঞতা আপনার চেয়ে আমার একটু বেশি।
কোন উদ্দেশ্য কি বললো অফিসারের বুঝতে অসুবিধা হলো না। তাই থমথমে মুখে কাগজটা টেনে নিলো, নিয়ে দেখলো। উপরমহল থেকে সব অর্ডার আছে। সে মনে মনে একটা গালি দিলো। দিয়ে এক লোকের দিকে তাকালো। এতো ভিড়ে এখানে এরশাদের লোকও দুনিয়ায়। সে তাকাতেই আস্তে করে লোকটা বেরিয়ে গেলো। যেতেই সে ড্রয়ার থেকে ফাইল এগিয়ে দিলো।
সাবেত ফাইলের সব দেখলো। দেখতে দেখতে বলল, — কেইস হয়েছে দুজনের নামে। অথচ ধরেছেন একজনকে। ব্যাপার কি?
— বললামই তো গণ্যমান্য লোক। ধরতেই দুনিয়ার ঝামেলা হয়েছে। তাই ওইদিকে আর আজকে এগোনো যায়নি। তবে কাল ব্যবস্থা করতাম।
সাবেত শুনলো। শুনেই উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে বলল,
— চলুন, যাওয়া যাক।
অফিসার অবাক হয়ে বলল, — কোথায়?
— আসামি ধরতে।
— আসল আসামি তো ধরেছিই।
— চিঠিতে আমার মেয়ে স্পষ্টভাবে বলেছে এরশাদ নামক এক লোক তাকে আটকে রেখেছে। আর আপনি ধরেছেন মহাজনকে।
— এই চিঠির সত্যতা আমি জানি না। তবে আপনার মেয়েকে মহাজন সরিয়েছে। প্রমান সাক্ষী ফাইলে তো দেখার কথা।
— জ্বি দেখেছি। এবার আসুন। আর একটা কথা জানার ছিল। আসলে এটা তো ফাইলে নেই তাই।
অফিসার ভদ্রতার হাসি কোন রকম হেসে বলল, — জ্বি বলুন?
—- দ্বিতীয় আসামি, মানে আয়নামতী এরশাদ নামের লোকের পরিচিত?
আফিসার মনে মনে আরেকটা গালি দিলো। দিয়ে বলল,– তার ছোট ভাইয়ের বউ।
সাবেত শীতল চোখে অফিসারের দিকে তাকালো। তাকিয়ে বের হতে হতে বলল,— সারেং বাড়ি রাইট?
অফিসারও আগের মতোই বললো,– জ্বি স্যার।
সাবেত এবার হাসলো! হেসে বলল,— চলুন! যাওয়া যাক। এই সারেং বাড়ি আমার এমনিতেও দেখার খুব শখ।
এশার আযানটা পড়তে না পড়তেই ক্যারেন্ট টুপ করে চলে গেলো। যেতেই নিস্তব্ধ সারেং বাড়ি পুরো অন্ধকারে ডুবে গেলো। এই আর কি? নিত্য দিনের ঘটনা। তবুও আয়না চমকে উঠল। সে রুম থেকে আর বের হয়নি। এরশাদ ভাই বাড়িতেই আছে কি না জানে না। শাহবাজও আর এদিকে আসেনি। তাই ভয়ে আর বেরই হয়নি।
হারিকেন রাখা দরজার সাইডে। আয়না অন্ধকারে হাতড়ে হারিকেনের সামনে গেলো। হারিকেন জ্বালিয়ে ছোট ছোট কদমে সিঁড়ির কাছে গেলো।
আম্বিয়া বু নিচে হারিকেন তেল দিচ্ছে। তাকে দেখে বললো, — আজকে ছাদের কাপড় তুলেছিলে আয়না?
আয়না তো তোলেনি। এতো ঝামেলায় মাথায়’ই ছিল না। সে তড়িঘড়ি করে রুমে গেলো, হারিকেন টা নিয়ে ছাদের দিকে এগিয়ে গেলো। গিয়েই থমকালো। অন্ধকারে হাত পা ছড়িয়ে শাহবাজ শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ। দেখতো কান্ড! এই লোকের আজিব এক অভ্যাস। এখানে, ওখানে, যেখানে ভালো লাগে সেখাই হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে।
আয়না ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো। হারিকেনটা এক সাইডে রেখে আস্তে করে বলল,– জেগে আছেন না, ঘুমিয়ে?
শাহবাজ সাথে সাথেই বলল,— কোন অবস্থায় থাকলে তোমার উপকার হয়?
— কোনটাই না। ঘরে গিয়ে ঘুমান।
— কেন?
— এখানে শোয় কে?
— আমি শুই।
আয়না বড় একটা শ্বাস ফেললো। তার কেন জানি মনে হচ্ছে, কোন কারণে শাহবাজের মন খারাপ। বীণারও একই অবস্থা। ফরহাদ ভাই যাওয়ার পর থেকেই থম মেরে আছে। সে সেটাই জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলো। মাঝে এরশাদ ভাই পরে গেছে। সে শ্বাস ফেলেই বলল,– আপনার কি মন খারাপ?
— যদি বলি হ্যাঁ, কি করবে?
শাহবাজ সব সময় সোজা কথাই বলে। তবুও আয়না সব সময় থমকে যায়। এই যে এখনো গেলো। সে ভেবেছিলো সবার মতো মন খারাপ থাকলেও শাহবাজ বলবে, না। তবে এই বান্দা বলেনি। আবার বলে কি করবে? সে করবে টা কি?
সে কাপড় তুলতে তুলতে বলল,– আমি কি করবো?
শাহবাজ চোখ খুললো! ঘাড় কাত করে তাকালো। পেঁয়াজ রঙের কাপড়ে হারিকের মৃদু আলোয় তার বধুকে দেখলো। দেখতেই বুকটা টিপটিপ করতে লাগলো। উঠে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করলো। প্রেম ট্রেম সে জানে না। ভালোবাসা আবার কি? তবে সে জানে, এই বোকা সোজা মেয়েটা তার বউ। গায়ে আগুন দিয়ে তাকে কবুল বলিয়ে বিয়ে করেছে। সাথে ঘৃণা করে, আবার মায়াও করে। সে নিজেও ঘৃণা করে, চোখের বিষ । আর এই ঘৃণা, বিষ, মায়া সব কিছু মিলিয়ে কিছু একটা হয়ে গেছে। এই হওয়া শাহবাজের ভালো লাগে। তাই তাকিয়ে তার মতোই বলল,– এসে তো একটা চুমুও খেতে পারো। খেলে তো আর ঠোঁট কতোটুকু কমে যাবে না। জায়গায় জিনিস জায়গায়’ই থাকবে।
আয়না থমকে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে মুখ গোঁজ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। শাহবাজ তার মতোই বলল,
— গোঁজ টোঁজ করে লাভ নেই। না পারলে আসো, আমি নিজেই দেই।
আয়নার রাগ হলো। বাড়ি ভরা দুনিয়ার ঝামেলা। এতো ঢং আসে কোথা থেকে! সে হাতের কাপড় নিয়েই হনহন করে চলে গেলো। শাহবাজ হাসলো। হেসে উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়াতেই দেখলো আয়না আবার দৌড়ে আসছে। হাতে এইমাত্র তোলা কোনো কাপড়ই নেই। চোখ মুখে ভয় স্পষ্ট। আর সেই ভয় নিয়েই তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
শাহবাজ তাল সামলাতে পারল না। দু’কদম পেছালো। পেছিয়ে কিছু বলবে তার আগেই আয়না ভয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, — মান্না ভাই আইছে। পুলিশ নাকি আসছে। আমাকে ধরে নিবো।
শাহবাজের তেমন পরিবর্তন হলো না। থানা থেকে ফিরেই ইমরান তাকে সব বলেছে। জুঁই ভাইয়ের কাছে। ভাইয়ের কথা না শুনলে, জুঁইকে ভুলে যেতে বলেছে। তা’ই সে সারাদিন আর বাড়ি থেকে বের’ই হয়নি। সে জানতো, এমন কিছুই হবে।
শাহবাজ আয়নার ছোট্ট শরীরটা দু’হাতে আগলে জড়িয়ে শূন্যে তুলে ফেললো। প্রথমবার বউ নিজে থেকে বুকে এসেছে। সদ্ব্যবহার না করলে শাহবাজের বদনাম হয়ে যাবে। তাই আরো শক্ত করে জড়িয়ে নিতে নিতে বলল,— এভাবে ঝড় তুফান তুলে বুকে আছড়ে পড়বে, বাকি সব আমার।
চলবে…..
#ধূপছায়া
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব_৫৬
সারেং বাড়ির আকাশেও তখন চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলা। ঝিঁঝিঁ পোকা সমান তালে গান গেয়ে যাচ্ছে। মৃদু শীতল বাতাস দু’জন মানব মানবীকে যেন আলতো করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। শাহবাজ আয়নাকে বুকে জড়িয়ে সেই ছুঁয়ে যাওয়া অনুভব করল কিছুক্ষণ। তারপর সেভাবেই ধীরে ধীরে নিজেদের রুমে চলে এলো।
আর আয়না ঐ যে আকাশের খিলখিলানো চাঁদ, সেই চাঁদের মতোই শাহবাজের আকাশে লেপটে রইল। রুমে আসতে আসতে শাহবাজ বলল,
— এখন জোঁকের মতো লেপটে কোন লাভ? আকাম করার সময় মনে থাকে না?
আয়না ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলল। গ্রামের সহজ সরল মানুষের কাছে পুলিশ জমের মতো, আয়নাও তার বাইরে না। তাই ঝরঝরিয়ে কেঁদে বলল,
— আমাকে নিয়ে কি করবে? ফাঁসি দেবে?
— দিতেও পারে। আকাম করার সময় এতো ভয় থাকে কোথায়?
— আমি তো পৃথিলা আপাকে শুধু সাহায্য করলাম।
— করেছো, এখন জ্বালা সামলাও।
— আপনি না বললেন সব আপনার?
— ওটা তো এমনিই বললাম। তাছাড়া ঘৃণার মানুষকে সাহায্য কে করে?
আয়না শাহবাজের বুক থেকে মাথা তুলল। শাহবাজের ঠোঁটের কোণে সব সময়ের মতো হাসি। তবে এই হাসি আয়নার কাছে সব সময়ের মতো মনে হলো না। মনে হলো জোর করে হাসি। তবুও আয়না মুখ ফোলালো। এক মুখে যে এরা কত কথা বলে! তার আসলেই কেউ নাই। তাই মুখ ফুলিয়ে নামার চেষ্টা করল।
শাহবাজ আরো শক্ত করে জড়িয়ে বলল,
— সেধে বুকে এসেছো, সেধে একটা চুমু খাও। তাহলে কিছু করতেও পারি।
আয়না শাহবাজের কথা শুনলও না। ভয়ে তার মাথা ভোঁ-ভোঁ করছে। শাহবাজ সেই ভয়ের মুখটা দেখল। দেখে রুমে এসে নিজেই নামিয়ে দিল। দিয়ে খাটে বসলো। বসতেই আয়না বলল,
— সাবিহা ভাবি আমার নামে কেস করতে পারলো? আর কেউ না জানুক, সে তো জানে। আমি পৃথিলা আপার কখনো খারাপ চাইনি।
— জুঁই ভাইয়ের কাছে।
আয়না অবাক হলো! অবাক হয়ে বলল, — মানে?
শাহবাজ উত্তর দিল না। এখন আর তার মুখে হাসি টুকু নেই, তবে দৃষ্টি আগের মতোই আয়নার মুখে। কত রং যে এই মুখটুকুর মধ্যে! সেই রঙে ভরা মুখের দিকে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে বলল, — সারেং বাড়ির অসংখ্য দোষ আছে। আমি, ভাই, দাদি কেউই দুধে ধোয়া না, আয়না। তবে সেই অসংখ্য দোষের মাঝে তোমার বাবা মায়ের রক্ত নেই। সত্যিই নেই। তোমার বাবা আজিজের লোক ছিল। তার সাথে মিলে সারেং বাড়িতে যে কাল রাত এসেছিল, সেই রাতের সঙ্গী হয়েছিল। আর…
শাহবাজ একটু থামল। বাবা মা তো তার নিজেরও। তাই বুক ছিঁড়ে আসে। সেই ছেঁড়ার কষ্টটুকু গিলে আয়নার মুখের দিকে তাকালো।
আয়নার সাদা মুখটা ফ্যাকাশে হচ্ছে। চোখে পানি নেই, থমকে তাকিয়ে আছে। থাক, তবে সত্য জানা দরকার। একদিন না একদিন তো জানবেই। তাই যত তাড়াতাড়ি জানা যায় ততই ভালো। তাই শাহবাজ চোখ ফিরিয়ে দরজার দিকে তাকাল। তাকিয়ে বলল, — তোমার বাবা মাকে আজিজ মেরেছে। এটাই সত্য। আরেকটা সত্য কি আয়না জানো? আমাদের কপালটাই জুড়েছে ঘৃণা দিয়ে। এই ঘৃণা দিয়েই আমাদের দেখা হয়েছে, বিয়ে হয়েছে, এই যে সামনি সামনি দাঁড়িয়ে আছি, সেই ঘৃণা নিয়েই। আর এই ঘৃণা নিয়েই আজীবন আমাদের দু’জনকে বাঁচতে হবে।
— আমি বিশ্বাস করি না।
— না করলে নেই, তবে এটাই সত্যি। যেই মহাজনকে তুমি বাবার মতো সম্মান করেছো, চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছো, সে তোমার বাবা মাকে খুন করেছে। তোমাকে গুটির চাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। আমাকে সব বলেছে তোমার খালা। আমি ঢাকায় সত্য জানতেই তার কাছে গিয়েছিলাম।
আয়না হাত পা গুটিয়ে নিচে বসে পড়ল। কত বোকা সে! বসে ফুঁপিয়ে উঠল। উঠেই বলল, — এজন্যই এরশাদ ভাই আমাকে মারতে চাইছে তাই না?
— আমি বেঁচে থাকতে তোমার গায়ে ফুলের টোকাও আসবে না।
— কেন আসবে না? এটাই তো ঠিক। আমিও তো তাই করেছি।
— তুমি সত্য না জেনে করেছো।
— তবুও সত্য তো সত্যই। আমি আপনার বাবা মায়ের খুনির মেয়ে।
— তুমি শাহবাজের বউ। এটাই তোমার বর্তমান পরিচয়। আর কিছু মনে রাখার দরকার নাই।
— আপনি ভুলতে পারবেন? আমার মুখের দিকে তাকালে মনে হবে না, আমি খুনির মেয়ে।
— ভুলতে পারবো কি না, তা তো জানি না। তবে তোমার মুখের দিকে তাকালে আমি দুনিয়া ভুলে যাই।
— আমি মরে যাবো। সত্যিই মরে যাবো। এই পাপের বোঝা নিয়ে আমি বাঁচতে পারবো না।
— তুমি কোন পাপ করোনি আয়না।
— আমার রক্ত তো করেছো।
— করুক! আমরা কেউই শুদ্ধ না। তাই হাবিজাবি
কিছু করা আগে একটা কথা মাথায় রেখো। একটা একরোখা, ঘ্যাড়ত্যাড়া, শয়তান লোকের তোমাকে ছাড়া চলবে না।
— কেন?
— এক কালনাগিনী বিষের ছোবল মেরেছে। এই বিষ আর এই জীবনে নামবে না।
বলেই শাহবাজ উঠল! উঠে দরজার কাছে এগিয়ে গেল। আয়না ভেজা চোখে, চোখ তুলে তাকাল। শাহবাজ সেই ভেজা চোখের দিকে তাকিয়েই দরজায় বাইরে থেকে খিল দিলো। দিয়ে তালা ঝুলালো। ঝুলিয়ে চাবি পকেটে রাখতে রাখতে জাফরের রুমের দিকে একবার তাকাল। তাকিয়ে তার মতোই নিচে নামল। নেমে নিচের অন্য একটা রুমে ঢুকলো। এই রুমে বাড়ির কাজ করার জন্য দা, কোদাল থেকে শুরু করে যাবতীয় সব কিছুই আছে। সেখান থেকে কুড়াল হাতে তুলে নিল। নিয়ে বের হতেই আম্বিয়া দেখে আঁতকে বলল,
— কি করছিস তোরা?
শাহবাজ হাসল, তবে উত্তর দিল না। বের হতেই দেখল এরশাদ উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। শাহবাজ অবাক হলো না, জানত আসবে। তাই তার মতো করেই এরশাদের বরাবর সারেং বাড়ির লম্বা টানা সিঁড়িতে বসলো। বসে বলল, — দুনিয়া না জানুক, তবে আমরা তো জানি ভাই, এরশাদ শুধু তার শত্রুদের জন্য ভয়ংকর। কিন্তু তার প্রিয় মানুষদের সে যত্ন করে আগলে ভালোবাসে। সেটা জয়তুন হোক, ছোট চাচা হোক, ভাই বোন হোক, আর হোক পৃথিলা। এজন্যই ভাই, পুরো দুনিয়ার সাথে তুমি সহজে জিতলেও, আমার সাথে হেরে যাবে।
এরশাদ বড় একটা শ্বাস ফেলল! ফেলে শান্তভাবে বলল, — কুড়াল ফেল, ভেতরে যা। আমি পুলিশকে দেখছি।
শাহবাজ হাসল, তার সেই চিরচেনা হাসি। হেসে বলল,
— আমি পুলিশের জন্য বের হয়েছি, তোমাকে কে বলল? আমি তো চাই পুলিশ আসুক। আয়নাকে নিয়ে কি করবে? বড়জোর ধরে নিয়ে যাবে। সে তো আর কাউকে খুন করেনি, ভাই।
এরশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। শাহবাজ আগের মতোই বলল, — আমি বের হয়েছি তোমার জন্য। তুমি, তোমার লোক, কেউই পুলিশকে সারেং বাড়ির সদর দরজা পেরুতে দেবে না। আমি জানি, ভালো করেই জানি। তাই! এখন শেষবার একটা কথা বলি ভাই। পৃথিলাকে তার মতো ছেড়ে দাও। আজিজ মরবে, সেটা আমার হাতে হোক বা তোমার। তবে বাকি সবাই নির্দোষ।
— যদি না ছাড়ি! কি করবি তুই?
— তুমি যেই ঝামেলা চাও না, সেই ঝামেলাই করব।
— দাদির কথা একবারও ভাববি না তুই?
— ভেবেছি বলেই তো এখনো চুপচাপ। সব ভুলে যাও ভাই। তুমি তোমার জেদ থেকে একটু সরলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। দাদি ভালো থাকবে। চাচার শেষ সম্বল তার মেয়ে। যখন দেখবে তার মেয়ে ভালো আছে, সে তার সব দুঃখ জেদ এমনিতেই ভুলে যাবে। কেননা জয়তুনকে ঘৃণা করলেও, এরশাদ, শাহবাজ, বীণা এদের ঘৃণা করার সাধ্য তার নাই। তাই ভুলে যাও ভাই, ভুলে গেলেই সবাই ভালো থাকবে।
— আর আমি?
—- সে তোমাকে ভালোবাসে না ।
— আয়না তোকে বাসে?
— না বাসলেও, ভরসা করে, মায়া করে। বিপদে পড়লে দৌড়ে আমার কাছে আসে। তবে তুমি পৃথিলার কোথাও নাই।
— দাদির হাতের ঝুনঝুনির জবান খুলেছে। অথচ তার এক মুখের কথার জন্য খুন করতেও তো এতোদিন একবার ভাবতি না। হঠাৎ করে এতো ভালো, হজম হচ্ছে না।
— জয়তুন আরার নাতি কেউই ভালা না ভাই। যদি ভালো হতো, বড় ভাইয়ের বুকে কোপ মারার জন্য কুড়াল হাতে নিত না।
এরশাদ শান্ত চোখে তাকালো। তখনই তার এক লোক দৌড়ে এসে বলল, — পুলিশ মোড়ে এসে পড়ছে ভাই।
এরশাদের ভাবান্তর হলো না। আসুক! এসেও লাভ নেই। দরজা ভেতর থেকে লাগানো। সারেং বাড়িতে প্রবেশ করা এতো সোজা না। এরশাদ চাইবে, একমাত্র তখনই। তাই এরশাদও আর সময় নষ্ট করল না। আপাতত শাহবাজকে কিছুদিনের জন্য আটকানো দরকার। শাহবাজকে আটকালেই সব রাস্তা পরিষ্কার। তাই তার লোকের দিকে তাকালো। তাকাতেই তারা শাহবাজ ধরতে এগোলো।
শাহবাজ হাসল, ঘাড় এই কাত করে ঐ কাত করতে করতে উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে কুড়ালটা শক্ত করে মুঠো করে ধরল। আর তারপর যা হলো, আম্বিয়া দেখে এক চিৎকার দিল। তার চিৎকার সারেং বাড়ির প্রতিটা কোণায় ঝংকার তুলল। আর তুলল বলেই এই নিস্তব্ধ রাতে সবাই কেঁপে উঠল।
এরশাদ অবশ্য দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। তবে এক পলকে তাকিয়ে আছে। তার লোকেরা পিছু হটে গেছে। অবশ্য তাদের দোষ দিয়ে লাভ কি? দু- তিনটাকে শাহবাজ শুইয়ে ফেলেছে। আর এই ফেলার মাঝেই অনেক দিন পরে নিজেকে দেখল, ঐ যে যুবক বয়সের এরশাদ। তার ছোট ছোট ভাই বোন, দাদির জীবন বাঁচাতে বটি হাতে নিয়ে একের পর এক কোপ ফেলেছিল। তেমনি সারেং বাড়ির উঠোনে অনেক দিন পর সেই রকম কোপ পড়ল, রক্তে ভাসলো। তফাত এই যে, সেই দিন সে ছিল, আজ তার ছোট ভাই। সেই এক রাত তার জীবন নরক বানিয়ে দিয়েছিল। তার ভেতরে যে মানুষ বাস করত, সেই মানুষকে শেষ করে দিয়েছিল। জন্ম হয়েছিল এক পিশাচের। যেই পিশাচের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, তার পরিবার শেষ, যারা এর পেছনে তাদেরও শেষ হতে হবে। তবে শেষ করতে করতে সে সেই দিন, রাতের মতো আজিজের জায়গায় চলে এসেছে। এসেছে বলেই জয়তুন আরার দুই লাঠি। আজ দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে।
এরশাদ চোখ বন্ধ করল। তার কানে বাজল তার বাবার কথা, যে তার হাতে ছোট ছোট ভাই বোনদের হাত দিয়ে বলেছিল, ওদের দেখে রাখিস। আজ থেকে ওরা তোর আমানত।
এরশাদ সাথে সাথে চোখ খুলল। খুলে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকালো। তাকালো শাহবাজও। রক্তে মাখা হাতে কুড়ালটা আরো শক্ত করে ধরল।
ততক্ষণে সবাই বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়েছে সাবিহা, ইমরানও। সবাই হতবাক! হতবাক ভাবেই দৌড়ে গিয়ে বীণা এরশাদকে আড়াল করে দাঁড়ালো। ছোট ভাই তো কারোর পরোয়া করে না, যদি বড় ভাইকে কোপ দিয়ে বসে।
জয়তুন কাঁপতে কাঁপতে নিচে বসে পড়লো। আম্বিয়া এগিয়ে ধরলো। পাপ, আহা পাপ! পাপ ছাড়ে না বাপেরও। এই যে দুই প্রিয় নাতি, কি সুন্দর বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে। কার জন্য? তার জন্য। তার খুশি হওয়ার কথা। সে হতে পারলো না। যত কিছুই বলুক, পালছে তো বুকে রেখে। তাই হয়তো বুক কেঁপে উঠলো। আর উঠলো বলেই প্রথমবার জয়তুন নিজের দোষ স্বীকার করল। কাঁপতে কাঁপতে জাফরের উদ্দেশে আর্দ্র কণ্ঠে বলল, — জোছনাকে আমি খুন করেছিলাম। এই যে এই হাতে। এই হাতেই তোর সাথে আমি অন্যায় করেছিলাম। নে, যা শাস্তি দেওয়ার দে। তবুও এই পাপের বোঝা এখনই শেষ হোক।
জাফর থমকে গেলো। থমকে তার আম্মার দিকে তাকালো। কি বলে তার আম্মা?
জয়তুন জাফরের মুখটা দেখলো। দেখে প্রথম বার মনটা ছিঁড়ে যেতে চাইলো। যেই চোখে সম্মান দেখে আসছে, সেই চোখে ঘৃণা দেখা সহজ কথা না।
চমকালো বাকি সবাইও। তবে শাহবাজ নির্বিকার, এরশাদ হাসল, তার সেই সরলতা মাখা হাসি। হেসে বীণার মাথায় হাত রাখল। রেখে মমতায় হাত বুলিয়ে বলল, — ফরহাদকে বলিস, আমি তার গলায় সত্যিই ছুরি ধরতে পারতাম। অমানুষ তো, অমানুষরা সব পারে।
বলেই শাহবাজের দিকে এগোলো। এগিয়ে তার হাত থেকে কুড়ালটা টেনে নিল। ভাইয়ে ভাইয়ে মুখ দেখানো আহ্লাদ কখনও ছিল না। তবে আজ হাতের সাদা শার্টের কোণা টেনে ভাইয়ের রক্তে ছিটকে যাওয়া মাথা মুছল, মুখ মুছল, হাত মুছল। মুছতে মুছতে বলল, — সারেং বাড়িতে ভয়ংকর একজনই থাক। সেই ভয়ংকর মানুষটার হাতের আমানত তোরা। সেই আমানতের খুশির জন্য বাকি সবাইকে মাফ করলাম।
শাহবাজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এই ভাই যে তাদের বড় অচেনা। এই অচেনা ভাইকে চেনার চেষ্টায় চোখের কোণা লাল হয়ে গেলো। এরশাদ সেই লাল চোখের দিকে আর তাকালো না। তার প্রিয় ছোট চাচার দিকে তাকালো। তাকিয়ে বলল, — তোমার মাকে আমার দাদি খুন করেছে। আমার পুরো পরিবারকে তোমার ভাই খুন করেছে। আর বাকি সব তো জানোই। নাও এবার সন্তান, স্বামী, বাবার দায়িত্ব পালন করো। আর তোমার মেয়েকে এরশাদ কোথায় রাখতে পারে আর কেউ না জানলেও তুমি জানো। এরশাদের এমন কোন কারবার নেই, এরশাদের প্রিয় চাচা জানে না।
বলেই সদর দরজা নিজ হাতেই খুলে দিল। দিয়ে ঘাটের দিকে যেতে যেতে তার বাকি লোককে বলল, — ইমরানের দরজা দিয়ে এদের হাসপাতালে নিয়ে যা। একটারও যেন দম না বেরোয়। আমার ভাইয়ের হাতে যেন খুনের দাগ না লাগে।
তারা সাথে সাথেই ইমরানের বাড়ির দিকে নিয়ে গেল। আর শাহবাজ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল। পাথর হয়ে! পুরুষ মানুষ কাঁদে না, তবুও শাহবাজের চোখ থেকে টুপ করে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। বড় ভাইরা হারলে বুঝি এতোটাই কষ্ট লাগলে।আর তখনই পুলিশের জিপ গাড়ি এসে সদর দরজায় থামল।
থামতেই সব পুলিশ সারেং বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। তবে সাবেত দাঁড়ালো সদর দরজার সামনে। সে বাড়ির ভেতরে পা রাখল না। সেখান থেকেই জাফরের দিকে শান্ত চোখে তাকালো।
সেই শান্ত দৃষ্টির দিকেই জাফর চোখ তুলে তাকালো। সাবেতকে সে চেনে। পৃথিলার খোঁজ যখন ঢাকায় পেয়েছিল, তখন দেখেছে। না, হিংসে হয়নি। হিংসে করার মতো মানুষ জাফর না। বরং শায়লা ভালো আছে, জেনে ভালো লেগেছে। তবে এই লোকের সামনে পৃথিলাকে নিজের মেয়ে বলার সাহস তার হলো না। কেননা জন্ম দিলেই পিতা হওয়া যায় না। পিতা হতে হৃদয় লাগে, সাহস লাগে, কলিজা লাগে। এগুলো তার কোনদিনও ছিল না। সে সব সময় কাপুরুষই ছিল। তাই শান্ত ভাবেই বলল, — আপনার মেয়ে কোথায় আছে, আমি জানি। তবে তার আগে আমি কেইস ফাইল করতে চাই। আমার মায়ের খুনির নামে। আমার দ্বিতীয় স্ত্রী, বড় ভাই, ভাবি, আমার মেয়ে, তুল্য আম্বিয়ার মায়ের খুনির আবদুল আজিজের নামে। আর সাক্ষী দিতে চাই আমাদের গ্রামে যত মানুষ গায়েব হয়েছে, আর আপনার মেয়ের প্রাক্তন স্বামী তারেকের খুনি এরশাদের বিপক্ষে।
সাবেতের কোন ভাবান্তর হলো না। তার সব চিন্তা তার মেয়েকে নিয়ে। সে শান্তভাবেই বলল, — আমার মেয়ের কাছে নিয়ে চলুন।
— যাচ্ছি।
— আমার মেয়ের অপরাধী কে?
— এরশাদ।
— সে কোথায়?
— আছে, সে পালাবে না। চিন্তা নেই।
— পালালেও আমি তাকে ছাড়বো? আমার মেয়ের এক একটা চোখের পানির হিসেব দিতে হবে।
জাফর উত্তর দিলো না। তার কেন জানি মরে যেতে ইচ্ছে করছে। এই যে এই লোকটা, এই লোকটার সামনে নিজেকে এতো ছোট মনে হচ্ছে। সে ঘরে যাওয়ার জন্যই পা বাড়াতেই ধপ করে পড়ে গেলো।
শাহবাজ ইমরান সবাই দৌড়ে ধরলো। ধরতেই শাহবাজকে বলল, — তাড়াতাড়ি থানায় যা। এরশাদ তার বাবা মায়ের লাশ ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে, মৃত্যুর আগে হলেও বাবা মায়ের খুনিকে শেষ করবে। আর আজিজ থানায়। মিঠাপুকুরে এমন কোন কাজ নেই সে করতে পারে না। আমার এরশাদের হাতে আর কোন পাপ না হোক।
সাবেত শুনে হাসলো! শাহবাজ সেই হাসি আগুন চোখেই দেখলো। তবে সময় নষ্ট করলো না। দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। থানার ভেতরে এমন কিছু করলে, ভাইকে কোনদিনও আর বাঁচানো যাবে না।
হঠাৎ করেই পুরো থানা অন্ধকারে তলিয়ে গেল। নতুন কিছু না। দিন, রাত ক্যারেন্ট আসে যায়। ঘড়ির কাঁটা তখন বারোটার ঘরে। মহাজনকে থানায় আনার পর সরগরম থাকলেও, অফিসার সারেং বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাওয়ার পরে আস্তে আস্তে কমেছে। এখন নেই বললেই চলে। কনস্টেবল আছে এক, দুজন। এখানে, ওখানে ঝিমুচ্ছে। কারেন্ট গেছে, আলো জালালোর কোন তাড়া তাদের মধ্যে দেখা গেলো না।
সেই না, যাওয়ার মাঝেই আজিজ খেয়াল করল, তার সেলের তালা খোলা হচ্ছে। অন্ধকারে সে কিছুই বুঝলো না। তবে একটু খেয়াল করতেই জ্বলজ্বল করা দুটো চোখ দেখল। দেখে কিছু বলবে, তার আগেই কেউ মুখ চেপে ধরল। ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
—- ইচ্ছে ছিল অনেক শাস্তি দেওয়ার। আমি যেমন রাতের পর রাত ছটফট করেছি, সেইভাবেই ছটফট করে করে শাস্তি দেওয়ার। তবে তোর কপাল ভালো, খুব কম শাস্তিই দিলাম।
বলেই ব্লেড দিয়ে গলায় এক টান দিল। আজিজ ছটফটিয়ে উঠল। শক্ত পোক্ত এরশাদের সাথে তার পারার কথা না। তাই গলা দিয়ে একটু শব্দও বের করতে পারল না। তবে চোখের সামনে শুধু একটা মুখই ভেসে উঠল, — তার প্রিয় সন্তান, ফরহাদ।
ফরহাদের মুখটাই আস্তে আস্তে ঘোলা হতে লাগল। আর আবদুল আজিজ সেই ঘোলা চোখ নিয়েই শরীর ছেড়ে দিল। এরশাদ সেই ছেড়ে দেওয়া শরীর রাস্তার কীটের মতো ছুড়ে ফেলল। ফেলেও কেন জানি শান্তি হলো না। এত সহজ মৃত্যু! এটা তার মন মানতে পারল না। তাই লোহার সিকের পাশে কুড়ালটা রেখেছিল। সেটা হাতে তুলে নিল। নিয়ে মনে মনে বলল, — পৃথিলা, আপনার ধারণা ঠিক। এরশাদ আসলেই পাগল। বলেই এগিয়ে গেল।
আর নিস্তব্ধ থানার সব কনস্টেবলরা কোন কিছুর শব্দে চমকে উঠলো। চমকে ধড়ফড়িয়ে উঠল ফরহাদও। টেবিলে মাথা রেখেই ক্লান্ত ভাবে চোখ লেগে গিয়েছিল। আর উঠেই অন্য রকম এক অস্থিরতায় ছটফট করে উঠলো। যেই পিতার প্রতি ঘুমানোর আগ পর্যন্তও ঘৃণা গলায় দলা পাকিয়ে ছিল, সেই ঘৃণা কোথায় যেন উবে গেল। আর গেলো বলেই মন বাবার কাছে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে গেল। আর গেল বলেই দৌড়ে বেরোলো।
চলবে…..