#আষাঢ়িয়া_প্রেম 💓
লেখনিতে #মিমি_মুসকান
#পর্ব_২
রাতের খাওয়া দাওয়ার পর বাসার আত্মীয় স্বজন বের হতে হতে রাত্রির ১২ টা বেজে গেছে। আলাপ আলোচনা তাদের নিজেদের বিষয় নিয়েই হলো। ছোট মামা কোনদিন কি জানি বলেছিলো এই জন্য আজ বড় খালামনি নিজের ক্ষো”ভ প্রকাশ করলেন। কথা উঠল গ্রামের বাড়ির সম্পত্তি নিয়ে। এক পর্যায়ে কথা উঠল ভাগাভাগি নিয়ে। সোফার কোণায় বসে কোলে চানাচুরের প্যাকেট হাতে ফারজানা শুনছিল সমস্ত কথা। ঘরে বসে আত্মীয়-স্বজনের কথা শোনার চেয়ে মজার আর কিছু নেই। বিয়ের আগে নানা কি জানি বলেছিলো সেসব নিয়েও কথা উঠল। কথা হচ্ছিল ফারজানার বিয়ে নিয়ে। সেই কথাবার্তা উঠার পর ফারজানা একটু উত্তেজিত হয়ে উঠল। সেও আঁটসাঁট বেঁধেই আছে। নিশ্চিত তাকে জিজ্ঞেস করা হবে বিয়েতে কি মত? কিন্তু না। কথার মোড় ঘুরে গেলো। ছোট খালামনি নানাকে বলতে শুরু করলেন,
“আপনার বড় মেয়ের বিয়ের সময় আপনি তো কতো কিছুই দিলেন আব্বা। আমার বিয়ের সময় কিছুই তো দেননি!”
নানাজান কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে বললেন, “তোর শ্বশুর বাড়ি থেকে তো কিছু চায়নি মা।”
“চায়নি বলে কি দিবেন না। আপনার কি কম কিছু আছে নাকি? না না আপনি আমার প্রতি অন্যা*য় করেছেন আব্বা!”
নানা এবার ভালো রকম বিপদে পড়েছেন। ফারজানার একই সাথে মজা আর বিরক্তি লাগছে। মজা লাগছে এই ভেবে, ছোট খালামনির বিয়ে হয়েছে ৮ বছরের বেশি হবে। ৫ বছরের একটা ছেলেও আছে। এখন এসে বিয়ের সময়কার কথাবার্তা। আর বির*ক্তি লাগছে এই ভেবে যে, সকলে কি অবলীলায় তার কথাটা ভুলে গেলো। আসল কথাটা কেউ তুলছেই না। কি আশ্চর্য!
ভাবনার মাঝপথে খুব জোরে মাথায় চা*টি খেলো ফারজানা। মুখ ভার করে পিছন ঘুরল। মা ঝা*রি মেরে বললেন, “শাড়ি বদলে খা। কি করছিস? শাড়িটা নষ্ট করে ফেলছিস? এভাবে কোলের মধ্যে নিয়ে খেতে দেখেছিস কাউকে? খেতে খেতে শাড়ির সাথে মাখামাখি। ওরে নাকি আবার বিয়ে দিবে। দেখো, তোমার মেয়েকে বিয়ে দেবার পর এক দরজা দিয়ে নিয়ে গিয়ে অন্য দরজা দিয়ে ফেরত দিয়ে যাবে!”
শেষের কথাটা বাবাকে উদ্দেশ্য করে।বোকাসোকা ভালোমানুষী বাবা মায়ের কথা হেসে উড়িয়ে দিলেন। ফারজানা রীতিমতো আশাহত। কথাবার্তা আবার ঘুরেছে। বড় খালামনির শ্বশুর বাড়ি জমিজামা নিয়ে ঝামে*লা হয়েছে। বড় ভাসুর তাদের না জানিয়ে বাপের থেকে কতো কাটা জমি যেন লিখিয়ে নিয়েছে। কথা আর শোনার ইচ্ছা হলো না। বুঝে গেছে তার সামনে কেউ বিয়ের ব্যাপারে কথা তুলবে না। তাই তাদের সুযোগ করে দিয়েই ফারজানা বসার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
ঘরে ফিরে শাড়ি বদলে ফেলো। তার ৭ বছর বয়সী খালাতো বোন আর ৫ বছর বয়সী খালাতো ভাইয়ের সাথে নিজের ভাই ও হাজির। এদের দাবি শুধু দুটোই। টাকার ভাগ চাই আর ওই প্যাকেটের মধ্যে কি আছে তা জানা চাই। ফারজানা বড় জনের হাতে এক হাজার টাকা আর বাকি দুই পুঁচকের হাতে ৫০০ টাকার নোট ধরিয়ে ধ*মক দিয়ে বিদায় করল। ছেলেমেয়ে গুলোর জ্বা*লায় পারা যায় না। আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে সবার বড় সে আর তার ভাই। বড় খালামনির দুটো মেয়ে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বড় মেয়েটা ফারজানার চেয়ে খুব ছোট তবুও তার বিয়ে হয় ফারজানার আগে। অবুঝ বয়সে প্রেম করলে যা হয় আর কি। রা*গে বড় খালামনি তাকে ত্যাজ্য কন্যা করেছেন। ছোট খালামনির একটিই মাত্র ছেলে। বড় মামার মেয়ে হয়েছে দু মাস হলো। এদিকে ছোট মামার বিয়ে হয়েছে সেটাও এক মাসের কাছাকাছি। ফুফা ফুপিদের সাথে সম্পর্ক ওতো গভীর নয় কিন্তু বিয়ের জন্য সেখানে কেউ বাকি নেই। নেহাত তাদের বড় হয়েও জীবনের এই যুদ্ধে সে পিছিয়ে গেছে। যাক গে, সেসব নিয়ে ফারজানার কোনো আফসোস নেই। মা বাবাকে চিনে। তার মত নিবে! হয়তো মন থেকে চাইবেন বিয়েটা হোক কিন্তু জোর*জবরদস্তি করার মতো শক্তি তাদের নেই। সেই দুঃসাহ*স করলে তার চেয়েও বড় দুঃসাহ*সিক কাজ করার ক্ষমতা ফারজানার আছে বৈকি!
শাড়ি বদলে সুতি সেলোয়ার কামিজ পরে বিছানা এসে উল্টো হয়ে শুয়ে পড়ল সে। হাতের কাছে প্যাকেট নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। তখন ছোট খালামনি খুলতে গিয়েও খুলেনি। তার জন্যই যেন বরাদ্দ রেখেছে। ফারজানা সোজা হয়ে বসল। কোলের মধ্যে প্যাকেট নিয়ে ছাড়াতে লাগল। কি পেলো? চকলেটের একটা বাক্স। হ্যাঁ শুধুই তাই! সাথে দুটো চিরকুট ও ছিলো। একটা লাল আর নীল রঙের। অথচ ফাঁকা! মানে তাতে কিছু লেখা নেই। কেন? লোকটা কি লেখার কথা ভুলে গেছিলো।
তাতে ফারজানার কিছু যায় আসে না। সে দুটো চকলেট একসাথে মুখে পুড়ে বাক্সটা ফের প্যাকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে ড্রয়ারে রেখে দিল। মাথা ধরেছে, ঘুমানো দরকার। ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।
খুব ভোরে তার ঘুম ভাঙল। ঘুম ছেড়ে হকচকিয়ে জেগে উঠল। শেষে কেমন অগোছালো স্বপ্ন দেখলো। ওই লোকটাকেই দেখল, কি জানি নাম! হ্যাঁ ফাহাদ! তাকেই তো দেখল মনে হলো। লোকটা সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে কথা বলছিলো এমনই তো কিছু ছিল। ভাবতে গিয়ে খেয়াল করল স্বপ্ন পুরোটাই ভুলে গেছে। কেবল মনে রইল স্বপ্নে লোকটাকে সে দেখল। কি আশ্চর্য! অস্ব*স্তি হচ্ছে খুব! যদিও কেবল একটা স্বপ্ন তবুও, লোকটাকে নিয়েই দেখতে হলো। এতোই কি ভাবছে লোকটাকে নিয়ে সে।
——–
অবশেষে কাঙ্ক্ষিত আলাপ! নাস্তার টেবিলে উঠল বিয়ের কথা। টেবিলের চার কোণে তারা চারজন। কথাটা শুরু করলেন মা নিজেই। সোজাসুজি তাকে না বলে ইনডাইরেক্টলি বাবাকে বললেন,
“ছেলেটাকে আমার বেশ লেগেছে, তুমি কি বলো?”
“দেখলেই তো আর ভালো হয়ে যায় না। খোঁজখবর নিতে হবে।”
“তো নিয়ে ফেলো। এলাকার নাম জানো তো, লোকজন পাঠিয়ে দাও।”
ফারজানা নিশ্চুপে খাবার চিবাচ্ছে। আশ্চর্য! তাকে সবাই এভাবে কেন ইগনোর করছে? আগে ছোট ছিলো এখন তো আর নেই। বড় হয়ে গেছে, ভার্সিটিতে পড়ে। তাকেও তো জিজ্ঞেস করা হোক। ভাই রাজা অবশ্য মনের কথা পড়ে ফেলল। সেই বলল,
“তোমরা যে এতো কথা বলছো, আপাকে জিজ্ঞেস করেছো কিছু?”
“ওকে জিজ্ঞেস করার আবার কি আছে? আমরা কি বিয়ে ঠিক করছি নাকি? কেবল খোঁজখবর করছি!”
সেই এক কথা, বিয়ে ঠিক করছি নাকি বলতে বলতে এতো দূর। তারা নিশ্চিত বিয়ের দিনেও এই কথাই বলবে। বির*ক্তি এসে যাচ্ছে ফারজানার। খাবারের প্রতি অনীহা দেখে বাবা বলে উঠলেন,
“না তবুও, ওকে তো জিজ্ঞেস করো। ছেলেকে ওর কেমন লাগল?”
ব্যস সুযোগ পেয়েই মনের কথা এক নিমিষে উগরে দিল ফারজানা। বলেই দিল, “আমি বিয়ে করব না মা!”
মুরশিদা বেগম মেয়ের কথার পাত্তা না দিয়ে বললেন, “ধুর ধুর বিয়ে কি ঠিক করছি নাকি? আমরা তো কেবল দেখছি। দেখি ছেলে কেমন? আর এতো তাড়াতাড়ি তোকে বিয়ে দিব না। দিলেও কাবিন করিয়ে রাখব। আমার কাছেই থাকবি!”
ফারজানা ঠোঁট চেপে বসে রইল। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে সেই এক কথা। বেশ বুঝতে পারছে ছেলেকে মায়ের পছন্দ হয়েছে। না হয় তার দুই খালামনি বুদ্ধি দিয়েছে। দিবেই তো! বড় খালামনির মেয়ের কম বয়সেই বিয়ে হয়ে গেল। এই অ*পবাদ তিনি মেনে নিতে পারছেন না। তাই মায়ের কানে কথা ঠেলে দিয়েছে। “কম বয়সেই মেয়েদের বিয়ে ভালো। বয়স বাড়লে কি ভালো ছেলে পাওয়া যাবে? আর এখানকার মেয়েগুলো যা। ভার্সিটির মেয়েগুলোই সবচেয়ে বেশি খারাপ। উশৃ*ঙ্খল ভাবে ঘোরাঘুরি করে।” কথাগুলোর আগাগোড়া ফারজানার মুখস্থ। শেষের কথাটার সাথে সেও একমত। কিন্তু সবাই ওরকম না! তবে খারা*প দিকগুলো যেন সবার চোখে বেশি পড়ে। যেমনটি সে! এখন অবধি কোনো ছেলে ব্যাচমেটর নামটাও জানে না সে। কে বিশ্বাস করবে এসব।
ফারজানা এবার একটু ক*ঠোরই হলো। খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “যখন বলেছি বিয়ে করব না তো করব না। এই নিয়ে এগিয়ে কোনো লাভ নেই। আমি এতো জলদি বিয়ে করছি না।”
“আহা আমি কি তোর…
মায়ের কথা কেড়ে নিয়ে ফারজানা বলল, “জানি বিয়ে দিচ্ছ না। যেহেতু দিচ্ছ না তাই ছেলেকে নিয়ে এতো মাখামাখি করো না। পছন্দ না আমার! আর ছেলেকেও আমার পছন্দ না। তাই আর কথা বাড়িও না।”
“ছেলেকে পছন্দ না মানে?” মা যেন সপ্ত আসমান থেকে পড়লেন। বললেন, কি লম্বা, সুদর্শন ফর্সা ছেলে আর তুই বললি পছন্দ না। কেন? খারাপ কি দেখলি? আমার তো মনে তাদের সকলকে তোর মনে ধরেছে তাই তো এতো তোড়জোড় করে আসা।”
“আমি ছেলেকে দেখেছি তাই বলছি পছন্দ না!” মুখ ফসকে উড়ন্ত একটা কথা বলে দিল। মা মেয়ের হাত চেপে ধরলেন। বললেন, “দেখেছিস মানে? এই না বললি চিনতি না।”
“চেনা জানা আর দেখাদেখি কি এক মা। চিনতাম মানে মুখ চিনতাম। নাম জানতাম না! আমার ভার্সিটির সিনিয়র আর আমি চিনব না। রোজই দেখি ক্যাম্পাসে!”
দ্রুত মি*থ্যে কথা সাজাতে পেরে মনে মনে পৈ,শাচিক আনন্দ পাচ্ছে ফারজানা। মা যেন কথাগুলো বিশ্বাস করেছেন। মানুষ সত্যের চেয়ে বেশি মিথ্যে অধিক পছন্দ করে। মিথ্যে কথা তারা দ্রুত বিশ্বাস করে। অথচ সত্য কথা বিশ্বাস করার শক্তি তাদের নেই। যাই হোক, মা কথা বাড়াতে চাইলেন। বাবা থামিয়ে দিয়ে বললেন, “তাহলে বাদ দাও। ওর চেয়ে ভালো কি আর চিনবে নাকি তুমি?”
“না তবুও শুনি। খারাপ কি করল? কি করে? কেন খারাপ?”
ফেঁসে গেল ফারজানা। কি বলবে এবার। আমতা আমতা করে বলল, “রাজনীতি!”
“রাজনীতি! না না থাক বাবা! তুমি তাহলে ঘটকে না বলে দাও।”
“আচ্ছা বলব!”
ফারজানা মুখের হাসি আর মনের আনন্দ আড়াল করে বেরিয়ে গেলো। তার পরিবার রাজনীতি পছন্দ করে না মোটেও। যাক এই পন্থা বেছে বিয়েটা তো ভা*ঙা গেল। কি বুদ্ধি তোর ফারজানা! বাহবা দিতে ইচ্ছে করছে নিজেকে! তখনি নজর কাড়ল ঘড়ির কাঁটা। তার না ক্লাস আছে! আহা দেরি হয়ে যাচ্ছে। বই আর ব্যাগ হাতে দ্রুত ছুটে বেরিয়ে গেল সে।
———–
সেই সকালে এসেছে ভার্সিটিতে। এখন দুপুরবেলা! টানা এতোক্ষণ ক্লাস করে হাঁপিয়ে উঠেছে। মাঝে একটু ব্রেক দেয় ওই আধঘণ্টা। চার তলা বেয়ে নিচে নামতে নামতেই যেন সময় শেষ। বের হবে কি? ক্লাসে বসে থাকে তখন। এখন বাসায় ফিরতে হবে এই ভেবেই একরাশ ক্লান্তি এসে ঘিরে ধরল তাকে। ভার্সিটির বরাদ্দ বাসে গেলেই দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব। এছাড়া অন্যান্য সুবিধার কথা চিন্তা করে ভার্সিটির বাসের দিকে পা বাড়াল সে। বাসে ঢুকতে যাবে ওমনি পিছন থেকে ডাক পাড়ল কেউ,
“শুনুন!”
চেনা পরিচিত কোনো গলার স্বর নয়। তাই হয়তো পিছন ফিরে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি কে দেখে হকচকিয়ে গেল ফারজানা। ফাহাদ একা নয়, কয়েকজন বন্ধু বান্ধব তার চারদিকে। মধ্যে সে দাঁড়িয়ে। সেখান থেকেই কি ডাকল তাকে। পাশের ছেলেগুলো কে সে চিনে। তার বাসেই যায়। কিন্তু ফাহাদকে বাসে দেখেছিলো কখনো? মনে করতে পারছে না। সে ফের আওয়াজ দিল, “চিনতে পারছেন আমায়?”
এবার একটু এগিয়ে ডাকল। ফারজানা লজ্জা পেয়ে গেল। বলল, “জি চিনেছি!”
“কথা বলছেন না দেখে ভাবলাম চিনতে পারেননি বুঝি।”
“না না , সেরকম কিছু না!”
“ওহ আচ্ছা! একটু সময় হবে আপনার? কথা বলতাম!”
ফারজানা চেয়েছিল না বলতে। কিন্তু পিছনে তার বন্ধুমহল। লোকটাকে তাই আর অপমান করল না। বাস ছেড়ে একটু সরে দাঁড়িয়ে বলল, “বলুন।”
“এখানে না অন্য কোথাও, এখানে অনেক শোরগোল। সময় হবে না আপনার?”
ফারজানা ইতস্তত করে বলল, “না মানে বাস ছেড়ে দিবে।”
“একদিন না হয় রিক্সায় চড়ে গেলেন। খুব অসুবিধে হবে?”
ফারজানা নিশ্চুপ রইল। ইন্ট্রোভার্ট মানুষের এই এক সমস্যা। এরা মনের কথা কিছুতেই মুখে এনে বলতে পারে না। অগত্যা তার নিশ্চুপতাকে হ্যাঁ ধরে নিয়ে ফাহাদ পা বাড়াল। আবার পিছন ফিরল। অবশেষে বাসের মায়া ত্যাগ করে তার পিছনে পা বাড়াল ফারজানা!
#চলবে…