#আষাঢ়িয়া_প্রেম 💓
লেখনিতে #মিমি_মুসকান
#পর্ব_৩
তারা বসেছে একটা ফুচকার দোকানে। দুপুর বেলা। লোকজন নেই বললেই চলে। পুরো খালি। এমনকি ফুচকা ওয়ালা ও নেই। ফারজানার বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। এমন খালি দোকানে এসে তারা করছে কি? জিজ্ঞেস করার আগেই ফাহাদ ফোন চাপল। ফারজানা অপেক্ষা করছে। ফোনে কাউকে তাড়াতাড়ি আসার কথা বলেই ফাহাদ হেসে বলল,
“ফুচকাওয়ালা আসছে!”
“আসছে মানে? আপনার পরিচিতি কেউ?”
“আমারই বন্ধু। শখ হয়েছে ফুচকার দোকান দিয়েছে। ফুচকার দোকানে নাকি লাভ বেশি। চা খেতে গেছে। এই আসছে। ওহ আপনার জন্য চা আনতে বলি। চা খাবেন তো?”
ফারজানা কিছু বলার আগেই ফাহাদ নিজ থেকেই ফোন দিয়ে চায়ের জন্য বলল। ফারজানা হাসল। অন্যকিছু হলে না-ই বলত। কিন্তু চায়ের লোভ সে সামলাতে পারে না। এক কাপ চায়ের লোভ বড় লোভ!
দুজনেই নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। ফাহাদ এই মাথা নিচু করছে, এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। তার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে তিনি কথা গুছিয়ে নিচ্ছে। ফারজানা সময় দিল। থাক বেচারা কথা গুছিয়ে নিক। এরপর ভেবে চিন্তে বলুক। ততোক্ষণ সে দেখুক এই বান্দাকে। ওদিন দূর থেকেই দেখেছিলো আজ সামনাসামনি ভালো করে দেখল। মাথায় এক ঝাঁক কোঁকড়ানো চুল। কোঁকড়ানো চুলের এক অসুবিধে হচ্ছে এদের যতই গুছিয়ে রাখা হোক না কেন? দেখতে সেই অগোছালোই লাগে। তবে এই অগোছালো ভঙ্গিতে ফাহাদ কে মানাচ্ছে। ফারজানার মনে হলো, কোঁকড়ানো চুল না হয়ে অন্যরকম চুল হলে উনাকে কোনোভাবেই মানাতো না। আচ্ছা তবে টাকলু হলে?
মুখ টিপে হেসে উঠল। সেটাও চেপে নিল ফাহাদের কারণে। তার কথা গোছানো শেষ। এবার বলবে বোধহয়,
“আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আপনি এখনো একসেপ্ট করেননি?”
“ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট?” মস্তিষ্কে তরঙ্গ ছুটে গেল। ওহ হ্যাঁ, গতকাল তার ভাবী তো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের কথা বলেছিল। ইশ, সে বেমালুম ভুলে গেল। বেচারার মনে হয় এই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের আশায় সারারাত ঘুম হয়নি। আহা বেচারা!
“কি ভাবছেন?”
“সরি ভুলে গেছিলাম। আমি বাসায় গিয়েই একসেপ্ট করছি। এখন এমবি নেই তো..
“আমি হটস্পট দিচ্ছি। নিন!”
ওমা! এতো জোর*জুলুম। পুরোপুরি জবর*দস্তি করে একসেপ্ট করাচ্ছে। কি করা উচিত? উঠে দাঁড়িয়ে একটা ঝাড়ি মা*রুক। বলুক, ভাগ ব্যাটা। তোর সাথে বন্ধুত্ব পাতানোর ইচ্ছে নেই আমার। তুই ভাগ এখান থেকে! বলতে পারল না। নেহাত ছেলেটাকে ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে বলে। বলার ভঙ্গিতেও ভদ্রতা মিশানো। কেন জানি না বলা যায় না। ফারজানা খেয়াল করল, এখন অবধি ফাহাদের সমস্ত কথায় সে হ্যাঁ বিধায় কিছু বলতে পারেনি। কোন এক অলৌকিক শক্তি যেন তাকে বাঁধা দিচ্ছে। এবার ও কি তাই হবে?
গাম্ভীর্য স্বর আবারো ভেসে এলো, “অসুবিধে আছে?”
“জি?”
“বলছি একসেপ্ট করতে অসুবিধে আছে?”
“না না কি অসুবিধে? ফেসবুক ফ্রেন্ড-ই তো হবেন। আমি অবশ্য স্যোশাল মিডিয়াতে ওতো এক্টিভ থাকি না।”
পুরোপুরি মিথ্যে কথা। সারাদিনে একবার ফেসবুকে পোস্ট না করলে তার পেটের ভাত হজম হয় না। যাক ফোনটা সে এগিয়ে দিল। ফাহাদ নিজ থেকেই হটস্পট চালু করে দিল। ফারজানা ফেসবুকে ঢুকে তার আইডি খুঁজছে। পেলো। একসেপ্ট করল। ঘুরে দেখার ইচ্ছে ছিল। ফাহাদ তার দিকেই তাকিয়ে আছে দেখে মনোবাসনা মনেই রেখে দিল। বাসায় ফিরে দেখা যাবে ক্ষন।
এরই মধ্যে তার বন্ধু সেই ফুচকাওয়ালা ফেরত এলো দু কাপ চা হাতে নিয়ে। নিজের বন্ধুর সাথে অপ্রত্যাশিত এই মেয়েকে তিনি যেন নিতে পারেননি। তার চোখ বলে দিচ্ছে সেই কথা। খানিকটা অপ্রস্তুত দেখালো তাকে। চায়ের কাপ রাখল টেবিলের উপর। তার সাথে সাথে কিছু একটা বাড়িয়ে দিচ্ছিল ফাহাদের দিকে। ফাহাদ চোখ রাঙাতেই পাতের মুঠোয় গুটিয়ে নিল সেটা। অতঃপর ফারজানার দিকে হেসে তাকিয়ে বলল,
“কি খাবেন? ফুচকা তো?”
ফারজানা এতোক্ষণ চিনতে পারেনি। এতোক্ষণে পারল। এতো তার ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ভাই। সে দাঁড়িয়েই গেল প্রায়। সালাম দিয়ে বলল, “ভাই আমি ফারজানা মাহবুবা, ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টের..
বাকি কথা বলার আগেই তিনি হেসে বললেন, “হয়েছে! বসুন। নতুন জুনিয়র নাকি? ওসব ভার্সিটিতে করবেন। এটা আমার দোকান আর আপনি আমার কাস্টমার। মেহমানদারি তো আমিই করব!”
ফারজানা লজ্জিত হলো। চট করে তার দাঁড়িয়ে পড়াতে ফাহাদ ও যেন একটু অবাক হলো। ঠোঁট কামড়ে বসে পড়ল। ইশ কি লজ্জায় পড়ল সে। ফাহাদ এই ব্যাপারে কথা বলে আর তাকে লজ্জিত করল না। কেবল চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগল।
ফারজানা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে কিন্তু ভালো লাগছে না। কেমন বিস্বাদ ঠেকছে সবকিছু। ছিঃ ছিঃ কি বোকামি করল সে। আচ্ছা ফাহাদ তো তার সিনিয়র। কোন ডিপার্টমেন্টের? জানা হলো না তো? জিজ্ঞেস করবে? করুক। কিছু একটা তো বলা উচিত!
মাথা নিচু করে নিচু স্বরে বলল, “আচ্ছা আপনি কোন ডিপার্টমেন্টের?”
“আপনার ডিপার্টমেন্টের! চতুর্থ বর্ষ!”
শুকনো ঢোক গিলল ফারজানা। কি অদ্ভুত! সে তারই ডিপার্টমেন্ট বড় ভাইদের সাথে বসে আছে। এ কথা জানার পর কলিজার পানি শুকিয়ে গেলো তার। শুকনো ঢোক গিলল সে।
“ভয় পাচ্ছেন?”
চমকে উঠল সে। মাথা দুলিয়ে বলল, “না না তো।”
“ভ*য় পাবার কিছু নেই তো।”
“না সবাই তো বলে আমাদের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ভাই অনেক বদমে*জাজি!”
ফাহাদ মুখটা মলিন করে শুধায়, “কারা বলে?”
এরই মধ্যে সৌরভ এসে ফুচকার প্লেট সামনে রেখে বলল, “বদমে*জাজী! বদমে*জাজি হলে কি আর আপনাকে নিজের হাতে বানিয়ে ফুচকা খাওয়াতাম!”
লজ্জায় ফারজানা মাথা নোয়ালো। ফাহাদ গুরু গম্ভীর স্বরে বলল, “আছে কিছু কিন্তু সবাই না। কার ওতো সময় আছে? কেন? আপনাকে কেউ কিছু বলেছে?”
ফারজানা দ্রুত মাথা দুলালো। চায়ের কাপ এক চুমুকেই শেষ করে ফেলল। এক প্লেট ফুচকা দেখে ফিরে চাইল। ফাহাদ হেসে বলল, “আমি ফুচকা খাই না।”
“তাহলে আমি একা একা খাব আপনার সামনে?”
“রোজই তো খান।”
“মানে?”
“মানে আপনাকে রোজই দেখি ভার্সিটি শেষে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেতে। আজ খেলেন না যে?”
“ওই দেরি হয়ে যাচ্ছিল তাই..
ফাহাদ মাথা দুলিয়ে পিছন ফিরল। সৌরভ বেরিয়ে গেল। যেন তাদের দুজনকে একাকী একটু সময় করে দিল। ফারজানার নজরে পড়ল সবটা। সে ফুচকা খেতে শুরু করেছে। এখন বোধহয় একটু সহজ হতে শুরু করেছে সে। খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি কিছু একটা বলবেন বলছিলেন।”
“হ্যাঁ, ওই বলেছি তো। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের কথা।”
“ওহ আচ্ছা। আমি আরো ভাবলাম..
“কি ভাবলেন?”
“কিছু না। আপনার ভাবীর সাথে আপনার অনেক ভালো সম্পর্ক তাই না?”
“ও আসলে আমার কাজিন!”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ, আমার বড় ফুপুর মেয়ে। তাই একটু বেশিই ভাব আমাদের মধ্যে।”
“হ্যাঁ গতকালই বোঝা যাচ্ছিল। তা পাত্রী দেখতে গেলেই বুঝি তাকে চকলেট বক্স গিফট দেন।”
একটা ফুচকা মুখে পুড়ে ফিরে তাকাল ফাহাদের দিকে। ফাহাদের চোখে মুখে লাজুকতা। লোকটার চোখ দুটো সুন্দর। ছোট ছোট, একটু পর পরই চোখ মিনিমিনি করে। হাসিটাও সুন্দর তো! ফারজানা আড়চোখে দেখে নিচ্ছে সবকিছু। কিন্তু কেন? বিয়ের জন্য তো নাই বলে এসেছিলো সে। তাহলে এখন তার কি হচ্ছে? কেন এখানে বসে থাকতে ভালো লাগছে। কথা বলতে ভালো লাগছে তার। কারণ কি এসবের?
ফাহাদ স্পষ্ট স্বরে বলল, “আমার জীবনে আপনাকে প্রথম দেখতে গেছি আমি!”
“ইশ মি*থ্যে কথা? আপনার ফ্যামিলি বুঝি আপনার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখেনি।”
“না দেখেনি, আসলে সেই কথা কখনো তোলা হয়নি। আমিই বলেছিলাম আপনার কথা।”
“কোথায় দেখেছিলেন আমায়?”
“ওরিয়েন্টেশনের দিন।”
“এই এক মাসেই প্রেমে পড়ে গেলেন আপনি?”
ফাহাদ হাসির রেখা দীর্ঘ করে বলল, “কি জানি? কেবল মনে হলো আমার পাশে আপনি হলে মন্দ হয় না!”
চামচ দিয়ে ফুচকার প্লেটের টক খাচ্ছিল ফারজানা। শেষের এই কথাটা বড় ভালো লাগল তার। মাথা নুইয়ে রেখেই কথা শুনল সে। ফুচকা শেষ। ব্যাগ হাতড়ে খালি পানির বোতল পেল। ফাহাদ তৎক্ষণাৎ উঠে চলে গেল। আটকানোর সময়টুকু পেলো না ফারজানা। ফিরে এলো কিছুক্ষণের মধ্যে। হাতে মিনারেল ওয়াটার বোতল। টেবিলের উপর সেটা রাখতে রাখতে আরেকটা চকলেটের প্যাকেট ও রাখল সে। ফারজানা হেসে উঠে বলল, “আমাকে কি আপনার বাচ্চা মনে হয়। কথা নেই বার্তা নেই হুট করে কেবল চকলেট নিয়ে আসেন!”
ফাহাদ লজ্জা পেলো। মাথা চুলকে বলল, “একবার আপনিই তো বলেছিলেন চকলেট আপনার অনেক পছন্দ। যত দিবে ততো খাবেন।”
“আমি আপনাকে কখন বললাম এসব?”
“আমায় না। আপনার এক বান্ধবীকে বলছিলেন। আমি পিছনেই ছিলাম।”
পানি খেয়ে উঠে দাঁড়াল ফারজানা। বলল, “ওহ? ফলো করতেন আমায়?”
“যদি বলি হ্যাঁ!”
“আমি বলব খুব বাজে কাজ করতেন? আচ্ছা আমার বাসার ঠিকানা পেলেন কি করে?”
“একদিন আপনার বাসে চড়ে ছিলাম।”
মুচকি হেসে জবাব দিল ফাহাদ। তার হাসিই বলে দিচ্ছিলো তার এসব ছেলেমানুষী কাজের জন্য সে বড়ই লজ্জিত। দুজনে বেড়িয়ে গেল ফুচকার দোকান থেকে। সৌরভ ভাইয়ের দেখা পেলো না সে। দুজনে একই সাথে হাঁটছে রাস্তার পাশ দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে ফারজানা বলল, “আপনি তো ভীষণ চতুর!”
“এতোটুকু চালাকি করা কি আমার কাম্য নয়?”
“তবুও? সোজা বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব। জানেন? আমি তো পুরো এক রাত ঘুমাইনি। যখন জানলাম আমার ভার্সিটির সিনিয়র তখন তো আরো ঘুম আসছিলো না। কে সে? মাথার মধ্যে খালি ভনভন করছিলো কে হতে পারে? আচ্ছা আমার বাসায় যাওয়ার বুদ্ধি কে দিলো আপনাকে?
“যদি বলি আপনি!”
“আমি? মানে কি বলছেন?”
“আপনিই একবার বলেছিলেন লাভ ম্যারেজ আপনি করবেন না। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ আপনার জন্য পারফেক্ট।”
ফারজানা এসব শুনে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেল। হতভম্ব স্বরে বলল, “কতোটুকু জানেন আপনার সম্পর্কে?”
“যতখানি জানা থাকলে একটা সম্পর্কে আগানো যায় ঠিক ততোখানি!”
ফারজানা চুপ হয়ে গেল, নিস্তব্ধ হয়ে রইল। মধ্যাহ্নে রোদের তাপে মাঝরাস্তায় তারা দু’জন দেখছে একে অপরকে। স্পষ্ট ভাবে কিছুই দেখা যাচ্ছে না তবুও দেখার চেষ্টা করছে। ফারজানা নিস্তব্ধতা অন্যকিছুর জাগান দিচ্ছিল। ফাহাদ চোখ সরিয়ে নিল। একটা রিক্সা থামিয়ে তাতে ভাড়া মিটিয়ে ফারজানাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “উঠে পড়ুন।”
নিস্তব্ধ ফারজানা সেখানে উঠে বসল। ফাহাদ নিজ দায়িত্বে রিক্সার হুড তুলে দিল। অতঃপর ফারজানাকে বলল, “বাসায় পৌঁছে জানাবেন।”
ফারজানা মাথা নাড়াল। রিক্সা চলতে শুরু করল। চলন্ত রিক্সার চাকা গুলো বড় বড় পাথরের সাথে ধাক্কা খেয়ে একটু দুলতে লাগলো। ফারজানার মনে হলো তার মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এই মধ্যদুপুরে ফাঁকা রাস্তার মতো তার হৃদয় কেমন খা খা করছে। কিসের যেন একটা কমতি লাগছে। লোকটাকে কি বলা উচিত ছিল, আপনিও উঠে পড়ুন। একসাথে বসে যাই দুজন। আরেকটু আলাপ করি!”
মুখ ফুটে বলতে পারেনি সে। খারাপ লাগল। মন বিষণ্ন হয়ে উঠল। অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা আঁকড়ে ধরল তাকে!
#চলবে…