#কালিনী
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যা ০২
রাতে আপার কথা বাবাকে বলতে গিয়েও আবার থেমে গেলাম।
ভেতরে কত কথার ঢেউ উঠছিলো, তবু ঠোঁটের কোণে একটাও শব্দ এল না।
এমনিতেই বাবা কতকিছু নিয়ে দিশেহারা তাকে নতুন করে ভাবনার ভার দেওয়া কি ঠিক হবে?
চুপচাপ বাবার পাশে বসে রাতের খাবার বেড়ে দিলাম।
তারপর নিঃশব্দে উঠে নিজের ঘরে চলে এলাম, চোখ দুটো যেন জানালার গা ঘেঁষে অনেক দূর তাকিয়ে রইলো অজানা এক ভোরের প্রতীক্ষায়।
সেই কাকডাকা ভোরে ঘুম ভাঙলো হঠাৎ,
বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম নিঃশব্দে
ঘরদোর গুছিয়ে নিলাম, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা ধোঁয়ার গন্ধে ভরে উঠলো ছোট্ট সংসারটা।
রান্না শেষ করে ঠান্ডা জল ঢেলে গোসল সেরে আয়নার সামনে বসলাম।
আয়নাটা আজও সেই আগের মতোই কোনো তোষামোদ নেই, কোনো ঢাকাও নেই।
চোখ রেখে দেখলাম নিজেকে, নিজের গায়ের রঙটাকে।
এই রঙ, যে রঙ নিয়ে সবার এতো তুচ্ছতাচ্ছিল্য,
কেউ বলে কালো, কেউ বলে ম্লান, কেউবা সরাসরি বলে অপছন্দ।
সবাইকে যেমন আল্লাহ গড়েছেন, তেমনই এই আমাকেও তো আল্লাহ গড়েছেন, আমি তো নিজেকে গড়িনি, তবে কেনো এই কালো রঙ নিয়ে সবার এতো অভিযোগ।
কালো ফর্সার বিচার যদি হয় চোখে চোখে,
তবে হৃদয়ের আলোর কি কোনো মানে থাকে না?
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে হলো আজ যে আসছে, সে যদি রঙ দেখে নয়, মনের মানচিত্র দেখে বুঝে নিতে পারে আমাকে?
তবে কী জীবনটা একটু হলেও বদলাবে?
দুপুর নাগাদ দু’জন মধ্যবয়সী পুরুষ ও একজন মহিলা এসে উঠোনে বসলেন। শুনলাম, ছেলের বাবা, মা আর বোন জামাই। ছেলে নিজে আসেনি বড্ড ব্যস্ত, কিংবা হয়তো ‘দেখা করার প্রয়োজন নেই’ বলে মনে করেছে।
নাশতা শেষ হলে দাদি হাতে ধরে আমাকে নিয়ে গেলেন অন্দর থেকে। মাথা নিচু করে সামনে দাঁড়ালাম, যেন এই দুনিয়ায় আমার কোনও অধিকার নেই নিজের অপমান বোঝার।
বাবা মিন মিন করে প্রশ্ন করলেন,
-মেয়ে আপনাদের পছন্দ হয়েছে?
ছেলের মা পান চিবুতে চিবুতে হালকা হেসে বললেন,
-মেয়ে পরে, আগে বলেন তো, মেয়ের সাথে কী কী দেবেন?
বাবার মুখচোখ থমকে গেল, একটা চাপা কষ্ট চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো। যেন প্রতিটি শব্দ বুকের ভেতরে খাঁজ কেটে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
-আপনারা কী চান?
-আরে ভাই, বেশি কিছু না। এক লাখ টাকা ক্যাশ আর গয়না টয়না যতটুকু মেয়ে বাবার ঘর থেকে খুশি হয়ে পায় আর কী। আমি তো আবার খুব দয়ালু মানুষ, আপনার অবস্থা জেনেই এসেছি। ভাবলাম, মেয়ে যখন গুণবতী, তখন রূপ না থাকুক, চালচলনে যেন খামতি না থাকে। তাই একটু সমঝে বললাম, আপনার অবস্থার কথা ভেবে বেশি চাইলাম না।
এই কথাগুলো শুনে বাবার মুখে একটুকুও রাগ ফুটে উঠলো না, তবুও তাঁর নীরবতা যেন ঘরের বাতাসটাকেও ভারি করে তুললো।
বাবা কিছুক্ষণ নিরব থেকে নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-আমি রাজি।
তার কথার সাথে সাথেই ভদ্রমহিলা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন,
-আলহামদুলিল্লাহ!
ছেলের বাবা খুশির সুরে বললেন,
-তাহলে ঈদের পরপরই মেয়ে উঠিয়ে নিবো, কেমন বেয়াই মশাই?
বাবা সামান্য হাসি মুখে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন।
বিকেলের আপ্যায়নের শেষে ছেলেপক্ষের সবাই ধীরে ধীরে বিদায় নিলো।
আমি উঠোনের এক কোণে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম, ঠোঁটে কোনো শব্দ নেই, চোখে কেবল একরাশ অনিশ্চয়তা।
মনে হচ্ছিল, শরীরটা পাথর হয়ে গেছে।
আমার চোখের কোনায় এক বিন্দু জল জমে উঠলো, অথচ কাউকে বোঝানোর ভাষা ছিল না।
এই বয়সে বাবার কাঁধে এত বড়ো বোঝা?
তিনিই তো সারা জীবন আমাদের মাথার উপর ছায়া হয়ে থেকেছেন।
বাবা হয়তো আমার অন্তর্দহন অনুভব করতে পেরেছিলেন।
চুপচাপ এগিয়ে এসে মাথায় আলতো করে হাত রাখলেন।
তার কণ্ঠে ছিলো এক আশ্চর্য নির্ভরতার সুর,
– চিন্তা করিস না মা, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।
সেই মুহূর্তে মনে হলো, পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো আশ্বাস হয়তো একজন বাবার হাতের স্পর্শেই লুকিয়ে থাকে।
তবু বুকের ভেতর কেমন একটা চাপা কান্না রয়ে গেলো,
যার শব্দ কেবল আমি আর রাতের আকাশ জানলো।
পরের দিনই বাবার চোখেমুখে যেন এক অপার তৃপ্তির জ্যোতি। খুশিতে ভরে ওঠা কণ্ঠে সকলের সামনে গর্বভরে বলতে লাগলেন,
-আমার মেয়ের গায়ের রঙ নিয়ে তো কত কথা শুনেছি, কত তুচ্ছতাচ্ছিল্য, কত কথা! এখন দেখো, আমি আমার তুরিনকেও শহরে বিয়ে দিচ্ছি। বড় দুই মেয়ের মতো তার ভাগ্যেও জুটবে স্বচ্ছল সংসার, সম্মানী ঘর। রাজরানীর মতো করে থাকবে সে। তোমরা সবাই দেখে নিও আমার তুরিন অনেক সুখী হবে, সে কেমন করে নিজের ঘর সাজায় দেখে নিও।
একটুখানি থেমে বাবার কণ্ঠটা যেন একটু কেঁপে উঠলো,
-রূপ না-ই বা হলো, তাই বলে কি আমার মেয়ের স্বপ্ন দেখার অধিকার থাকবে না? আমার তুরিনের গুণ, তার মন, তার যত্নশীলতা সবকিছুতেই সে এক অপূর্ব জ্যোতি।
বাবার মুখে এমন গর্বিত উচ্চারণ এর আগে কদাচিৎ শুনেছি।
তার সেই আনন্দ, সেই তৃপ্তি দেখে আমার বুকের ভেতরটা ভরে উঠলো। যেন প্রথমবারের মতো নিজেকে গ্রহণযোগ্য মনে হলো মেয়ের মতো নয়, বাবার গর্ব হয়ে উঠার তৃপ্তি নিয়ে আমি একটু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম।
রাতে বাবা যখন ঘরে ফিরলেন, তার চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ।
আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বাবার পাশে বসে পড়লাম।
– কী রে তুরিন, কিছু বলবি?
বাবার কণ্ঠে ছিলো স্নেহ মেশানো ক্লান্তি।
আমি কিছুটা ইতস্তত করে বললাম,
– বাবা, কাল আপা ফোন করেছিলো।
বললো সামনে কোরবানির ঈদ। ও ওবাড়িতে বলে দিয়েছে, আমরা গরু কোরবানি দিচ্ছি।
বলেছে ঈদের দিন তার বাসার সবার জন্য মাংস আর দামী জামা কাপড় নিয়ে যেতে হবে।
এতোটুকু বলেই আমি চুপ করে গেলাম। গলায় যেনো একটা গ্লানি দলা পাকিয়ে আছে।
বাবা একটু কেশে উঠলেন।
আমি তাড়াতাড়ি পানি এগিয়ে দিলাম।
বাবা গ্লাসটা হাতে নিয়ে কয়েক চুমুক পান করলেন।
-বলছিলাম কি বাবা, এতো টাকা কোথায় পাবে?
বাবা একটু হেসে বললেন,
– ও নিয়ে তুই কিছু ভাবিস না তুরিন।
আল্লাহ যখন দায়িত্ব দিয়েছেন, তখন রিজিকের রাস্তা তিনিই খুলে দেবেন।
আমার মেয়ের মুখে যেনো কেউ বেদনার ছায়া না দেখে, সে খেয়াল আমার আছে।
একটা সময় তোকে নিয়েও কেউ গলা উঁচু করে কথা বলেছিলো না!
আজ যখন আমার তুরিনের বিয়ে শহরে, তখন আমার আত্মবিশ্বাসও শহরের চেয়ে কম হবে কেন?
অবাক হয়ে লক্ষ্য করছিলাম, বাবার পরিশ্রম যেনো হঠাৎ করেই কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।
ভোরের আলো ফোটার আগেই তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে যান,
আর ফিরতে ফিরতে রাত কাবার হয়ে যায়।
দুপুরে ঠিকমতো কিছু খান কি না, সেটাও আর বলেন না এখন।
কোনো অভিযোগ নেই মুখে, নেই বিরক্তি,
শুধু চোখেমুখে এক চাপা উদ্বেগ, আর নিঃশব্দ দায়বোধ।
ঠিক তখনই একদিন ফোন এল মেজো দুলাভাইয়ের কাছ থেকে।
মেজো আপার তুলনায় তিনি একটু নরম প্রকৃতির, বলা চলে আপার ধমকেই দিন কাটে তার।
তবুও কণ্ঠে ছিলো আন্তরিকতা।
-হ্যালো তুরিন।
– আসসালামু আলাইকুম দুলাভাই, কেমন আছেন?
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোমরা কেমন আছো?
-আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই।
-কী শুনলাম রে?
– কী?
-তোর নাকি সামনে বিয়ে?
লজ্জায় গলা শুকিয়ে এলো, কিছু বলতে পারলাম না।
নীরবতাই যেন স্বীকারোক্তির মতো ভেসে এলো ফোনের এপাশ থেকে।
দুলাভাই আবার বললেন,
– সামনে তো ঈদ, দাওয়াত রইলো। বাবাকে নিয়ে আসিস, বুঝলি?
-ইনশাআল্লাহ, আসার চেষ্টা করবো।
ফোন রেখে মনে হলো, এই প্রথম কেউ এমন সহজ করে কথা বললো,
যেখানে প্রশ্নের ভেতরে ছিলো না কোনো তিরস্কার,
ছিলো শুধু আপন মানুষের মতো পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটা।
এইটুকু সৌজন্যেই যেন মনটা একটু হালকা হয়ে এলো।
যেন ঈদের আগেই একটা নতুন আলোর রেখা খুঁজে পেলাম বুকের গভীরে।
কয়েক দিনের মধ্যেই বাবা বাড়ির পাশের জমির পুরনো দলিল বের করে আনলেন। চুপচাপ একদিন বিকেলে বাজারের পথ ধরলেন, আর ফেরার পর জানালেন দুই লাখ টাকা তুলে এনেছেন। চোখে মুখে কোনো উচ্ছ্বাস নেই, বরং একরকম নিঃসঙ্গতা ভেসে বেড়াচ্ছে চেহারায়।
বললেন,
-তোর বিয়ে হয়ে গেলে আমি তো একা থাকবো, খাওয়া দাওয়ায় কষ্ট হলেও সিএনজি চালিয়ে যা পাবো সেই টাকায় কিস্তি মিটিয়ে কোনো রকমে টিকে থাকবো।
আমি কিছু বললাম না। জানি, এই টিকে থাকা মানে কেবল বেঁচে থাকা নয় এটা এক বাবার নীরব যুদ্ধ, মেয়েকে বিদায় দেওয়ার প্রস্তুতির কষ্টগাথা।
ওই টাকা তুলতে গিয়ে হয়তো বাবার বুকের ভেতরেও কিছু একটা বিক্রি হয়ে গেছে আমরা যা দেখি না, কেবল অনুভব করি চুপচাপ কাঁপা কাঁপা চোখে তাকালে।
দেখতে দেখতে ঈদ এসে গেলো।
আগামীকাল ঈদ।
বড় আপার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের জন্য নতুন জামা-কাপড় আর ভালো গোশত পাঠানোর কথা মনে রেখেই সকাল সকাল বাজারে বের হয়েছিলেন বাবা।
কিন্তু দোকানের দরজায় দাঁড়িয়ে একরাশ চিন্তায় গাঢ় হয়ে উঠলো তার চোখ-মুখ।
সব কিছুর যা দাম, এই টাকায় হয়তো জামা-কাপড় কেনা যাবে, কিংবা একটু ভালো মানের গোশত।
কিন্তু যদি এই টাকা আজ খরচ হয়ে যায়, তাহলে তুরিনের বিয়েটা!
বাবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল আমার গায়ে হলুদের দিন, আমার ঘোমটা টানা মুখ, আর সেই কাঙ্ক্ষিত নতুন সংসার যার জন্য তিনি দিনের পর দিন শ্রম দিয়ে গেছেন।
এই মুহূর্তে দুটি দায়ের ভার দুদিকে টান দিচ্ছিল, একদিকে বড় মেয়ের সামাজিক সম্মান, আরেকদিকে ছোট মেয়ের ভবিষ্যতের ভিত।
শেষমেশ কিছুই না নিয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরে এলেন বাবা।
আমি স্বাভাবিক কণ্ঠেই জিজ্ঞেস করলাম,
– বড় আপার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের জন্য কিছু আনোনি বাবা?
বাবা মুখ নিচু করে বললেন,
– গেছিলাম রে মা, কিনতেই তো গেছিলাম। কিন্তু সব কিছুর যা দাম, এই টাকায় কুলানো যাবে না। মনে করলাম, মাংস হলে হয়তো একটু সামাল দেওয়া যাবে।
বাবার অসহায় চোখদুটোতে আমি দেখতে পেলাম একজোড়া কাঁপতে থাকা ভরসা। কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলাম না আমি। শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম, যেনো বাবার নিঃশব্দ স্বপ্নগুলো আমি নিজে কাঁধে তুলে নিচ্ছি।
ঈদের দিন সকাল সকাল উঠে নামাজ শেষে বাবা নিজ হাতে তিনটা গরুর কাটাকাটি, বাটাবাটি করলেন। সারাদিন ছুটে বেড়ালেন এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি। সন্ধ্যার দিকে কিছু ভালো মানের মাংস হাতে পেলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন, কিন্তু সেই হাসিতে লুকানো ছিল গভীর ক্লান্তি আর না বলা অনেক কিছু।
– তুরিন মা, আমি জানি তুই মাংস খেতে ভালোবাসিস, কিন্তু দেখ, তোর বড় আপার মুখটাও রাখতে হয় তো। এই মাংসগুলো যদি ওবাড়ি পাঠাই, ওরা খুশি হবে। মেয়েটা অন্তত ভাববে, তার বাপটা কিছু তো করেছে।
একটু থেমে গলা নিচু করে বললেন,
-মন খারাপ করিস না মা, দুদিন পর তোর বিয়ে, তুই কিন্তু বড় ঘরে যাচ্ছিস। ইনশাআল্লাহ খাওয়া-পরার অভাব হবে না, তুই থাকবি রাণীর হালে, হ্যাঁ মা, একেবারে রাণীর হালে।
বাবার হাতের কাঁপুনি দেখে বুঝলাম, কথাগুলো শুধু স্বান্তনা নয়, নিজের বুকের রক্ত দিয়ে গড়া প্রতিজ্ঞা।
আমি কিছু বললাম না, শুধু বাবার ঘামে ভেজা কাঁধের ওপর হাত রাখলাম।
কারণ সেই কাঁধেই ভর করে দাঁড়িয়ে আছে আমার ছোট্ট পৃথিবীটা।
বাবা দেরি না করে দুই হাজার টাকা পকেটে গুঁজে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লেন।
যেতে যেতে সময় লাগবে প্রায় ৫-৭ ঘণ্টা, তাই আগে থেকেই তৈরি হয়ে বসেছিলেন তিনি।
তখন হয়তো এই প্রস্তুতির গভীরতা আমাদের কারওই চোখে ধরা পড়েনি,
কিন্তু এখন এই মুহূর্তে সবটাই যেন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
রাত পোনে এগারোটার দিকে ওবাড়িতে গিয়ে পৌঁছালেন বাবা।
আপা বাবাকে দেখেই চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করলো,
– জামা-কাপড় আনো নি?
বাবা একটু থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন।
মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন যেন নিজের ভিতরের কোন অনুশোচনার ভারে নুয়ে পড়েছেন।
আপা দাঁতে দাঁত চেপে রাগ চেপে রাখতে না পেরে ঘরের ভেতর পায়চারি শুরু করলো।
তার এই ক্ষোভের মধ্যে শাশুড়ি এগিয়ে এসে ব্যঙ্গভরে বললেন,
– দেখি তো বেয়াই মশাই কি এনেছেন!
এক ঝুড়ি মিষ্টি, কিছু ফল আর মাংস, বলেই ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে মাংসগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন।
– ওমা! এইটা মাংস নাকি! সবই তো চর্বি আর হাড্ডি!
শাশুড়ির ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের ছায়া স্পষ্ট।
আপা মুখ নামিয়ে নিলো।
বাবার মুখেও লজ্জার ছায়া।
একবার তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেললেন তিনি।
মনের ভিতর এক অজানা কষ্টের ঢেউ বয়ে গেল তার,
লোকে যা দিবে, তা হাত পেতে নিতে হয়।
যে নিজের সংসারে দুধ-চিনির অভাবে চা বানায় না, সে কীভাবে জামা-কাপড়, আর গরুর রানের মাংস পাঠাবে!
দুই হাজার টাকাই ছিল তার কিছু দিনের সঞ্চয়,
তবু মেয়ে যেনো অপমানিত না হয় সেজন্য যতটুকু সম্ভব সাজিয়ে নিয়ে এসেছিলেন তিনি।
কিন্তু এখানেও যেন অভাব তার পিছু ছাড়ে না
লেখা নেই, তবু প্রতিটি চোখে লেখা অপমানের গ্লানি যেন অক্ষরে অক্ষরে পড়তে পারলেন তিনি।
বড় আপার শাশুড়ী উঁচু স্বরে বলে উঠলেন,
– সাবরিন, এই মাংস মানুষে খাওয়ার উপযুক্ত না, এগুলো আমাদের কুকুরদের দিয়ে দাও।
বড় আপা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। বাবার সামনে থেকে মাংসের প্যাকেটটি নিয়ে ধীর পায়ে ভেতরে চলে গেলো। যেন কিছুই হয়নি।
মুহূর্তেই বাবার বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো। চোখেমুখে যেন বিষাদের ছায়া নেমে এলো।
অস্ফুট গলায় তিনি ফিসফিসিয়ে বললেন,
– এই মাংস থাকলে আমার তুরিনটা নিশ্চিন্তে পেট ভরে খেতে পারতো।
কথাটা শেষ করার আগেই তার গাল বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। কেউ দেখলো না শুধু দেয়ালটা দেখলো, বাতাসটা টের পেলো।
শাশুড়ী তখনও হাসি মুখে বললেন,
– আরে বেয়াই মশাই, বসুন না, একটু কিছু মুখে তুলে তারপর না হয় বাড়ি ফিরবেন।
মুহূর্তেই সামনের টেবিলে চা, বিস্কুট, কিছু মিষ্টান্ন এনে রাখা হলো।
বাবা জানেন, তার খাওয়ার মতো মন বা শরীর কোনোটাই এখন প্রস্তুত নয়।
তবু ভেবে নিলেন, এখন না খেলে যদি মেয়েকে পরদিন কথা শুনতে হয়, অপমান সহ্য করতে হয়?
তাহলে সেটা সহ্য করা তার চেয়েও কষ্টকর হবে।
এই ভেবে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখে তুলে নিলেন এক টুকরো বিস্কুট। চায়ের কাপে চুমুক দিলেন একবার।
রাতের খাবারটা আর খাওয়া হলো না।
সবাই যখন হাসি-ঠাট্টায় ব্যস্ত, বাবা তখন নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়লেন। গেটের বাইরে পা রেখেই একটিবার পেছন ফিরে তাকালেন।
যেন দগ্ধ স্মৃতি থেকে পালিয়ে বাঁচতে চান তিনি।
মনকে প্রবোধ দিলেন ওরা যতই বড়লোক হোক না কেনো, কিন্তু বড় মনের অধিকারী কি তারা?
নিজেকে বুঝ দিলেন,
মেয়েটা ভালো আছে তো? সে ভালো থাকলে আমার এইটুকুতেই চলবে।
বাবা হিসেবে তো এতোটুকুই চাওয়া, আমার মেয়েরা যেনো ভালো থাকে।
*আপনারা যারা গল্প পড়েন সবাই রেসপন্স করুন, তাহলে গল্প নিয়মিত আসবে।
চলবে,,,,,