কালিনী পর্ব-০৭

0
1

#কালিনী
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যা ০৭

আমি খাওয়া শেষে শাশুড়ির জন্য তৈরি করলাম অ্যাভোকাডো টোস্টে সেদ্ধ ডিমের স্লাইস আর পাশে এক বাটি বেরি ও গ্রিক দইয়ের বোল।

তিনি মুখ কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
– তোমার খাওয়া হয়েছে?

আমি মাথা হেঁট করে হেসে বললাম,
-হ্যাঁ মা, সেরে নিয়েছি।

তিনি ঠোঁট বেঁকিয়ে তিরস্কারের সুরে বললেন,
-যেভাবে খেতে শুরু করেছো, তাতে এই বাড়ি দু’দিনেই ধ্বংস করে দেবে।

আমি মুখের হাসি চাপতে না পেরে কুচকি হেসে বললাম,
-মা, আপনি তো এত বড়লোক। আপনাদের মতো লোকজন তো আমাদের মতো দু’টো কাজের মানুষকে বসিয়েও খাওয়াতে পারেন।

তিনি একবার কড়া চোখে তাকালেন, তারপর আর কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে নীরবে খেতে লাগলেন।

আমি কিছুক্ষণ নীরব থেকে মোলায়েম কন্ঠে বললাম,
-মা, ভাবছিলাম ডাক্তারের কাছে একবার যাওয়া উচিত। এতদিন হয়ে গেছে অন্তত একবার পরীক্ষা তো করা দরকার।

তার চোখ রক্তবর্ণ হয়ে উঠল, কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল মুহূর্তেই।
-কেন? আমরা কি বাচ্চা জন্ম দেইনি? আমাদেরও তো বিয়ে হয়েছিল। তখন কি বারবার ডাক্তারের পিছনে ঘুরতে হয়েছিল?

আমি শান্ত গলায় বললাম,
-মা, সময় বদলেছে। আর প্রত্যেকটা শরীর তো একরকম নয়। আপনার আশীর্বাদ থাকলে সব ঠিক হবে, শুধু একটু সাহস আর সাপোর্ট চাই।

তিনি মুখ নিচু করে খেতে লাগলেন।
আমার কথার জবাব দিলেন না, তবে একটা দীর্ঘশ্বাস যেন থেমে থাকা বাতাসের ভিতর হঠাৎ করেই ভারি হয়ে উঠল।

সেই দীর্ঘশ্বাসে কি ছিল হীনমন্যতা? ঈর্ষা? নাকি অনাগত ভবিষ্যতের ভয়?
আমি বুঝলাম না, শুধু এটুকু টের পেলাম এই ঘরে যত্নের থেকেও হিসাব বেশি চলে।

সন্ধ্যার আবছা আলোয় রান্নাঘরটায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সবার জন্য ভালোবেসে বানালাম আলুর পরটা আর ধোঁয়া ওঠা মোমো। গরম গরম পরিবেশন করতে গিয়েই শাশুড়ির নাক কুঁচকানো মুখটা দেখে থমকে গেলাম। ঠোঁট বাঁকিয়ে বললেন,
-আমি এসব খাই না। আগে থেকে জেনে নিও কে কি খায় আর কে কি খায় না, এরপর থেকে আমার মতামত নিয়েই রান্না করবে।

মুখে কিছু বললাম না, কিন্তু মনে মনে চিন্তায় ডুবে গেলাম এক মানুষ, এক মা হয়ে, আরেকজন মায়ের শরীরের কষ্টটুকু কি একফোঁটাও টের পান না? দুদিন আগেও যখন এগুলো বানিয়েছিলাম তখন তো ঠিকই খেয়েছিলেন, তাহলে এখন খাই না বলে আমাকে দিয়ে দু’বার কষ্ট করাতে চান কেনো?

শ্বশুরমশাই চুপচাপ খেয়ে নিলেন, হাসিমুখে বললেন,
-বেশ হয়েছে, অনেক দিন পরে এমন গরম মোমো খেলাম।

কিন্তু ফাহিম মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো। নিশ্চয়ই মায়ের খুশি মুখ দেখার জন্য নিজের খিদেটুকু চাপা দিয়েছে।

আমি কিছু না বলে নিঃশব্দে নিজের রুমে ফিরে এলাম। কারো জন্য আলাদা কিছু আর বানাইনি। শরীরটা ক্লান্ত, মনটা আরও ক্লান্ত। কতটুকুই বা সামলানো যায় একা হাতে?

মনটা হালকা করার জন্য আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে চোখ রেখে বললাম,
– একদিন আমিও শাশুড়ি হবো, কিন্তু আমি যেন কখনো এমনটা না করি।

পরদিন থেকে নিজের মতো করেই রান্না করতে লাগলাম। কে কী খাবে না বলেছে, তা মনে রাখতাম, তাদের পছন্দে রান্না করার পরও কেউ খাবে না বললে দ্বিতীয়বার আর তাদের জোর করতাম না। যেটুকু রান্না করতাম, তারা না খেলেও আমি আর শ্বশুর মিলে খেয়ে নিতাম।

চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ নিয়েও মুখে হাঁসি ফুটিয়ে রাখতাম। মনকে বুঝাতাম যা করি নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই করি, কারো জন্য নয়, নিজের বিবেকের শান্তির জন্যই।

তবে মাঝে মাঝে মনের কোণে একটাই প্রশ্ন উঁকি দিত একজন মা হয়ে আরেকজন নারীর কষ্ট এতটা অচেনা লাগে কীভাবে?

দিন দিন শরীর যেনো নিজের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করছে। প্রতিটি ভোর যেনো আমার কাছে আরেকটি নতুন যুদ্ধের ঘণ্টা বাজায়।

একদিন সাহস করে শাশুড়িকে বললাম,
-একটা কাজের মেয়ে রাখেন মা, এখন তো শরীরটাও আগের মতো নেই অন্তঃসত্ত্বা শরীরটা নড়াচড়া করলেই হাপ ধরে যায়।

উনি কপাল কুঁচকে রুক্ষ গলায় বললেন,
-টাকা কি গাছ থেকে পড়ে? এসব করেই তো মানুষ একেকটা বউকে বাড়ির মাথায় তোলে।

কোনো উত্তর দিলাম না। শুধু ঠোঁট চেপে রেখে চুপচাপ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।
জানতাম, কিছু বললেও ফল শূন্য তাই না বলা কথাগুলো বুকেই পাথর হয়ে জমে রইলো।

ভোর হতেই উঠে দাঁড়াতাম, শরীরের ব্যথা, বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতাম।
রান্না করতাম ঠিকই, কিন্তু একেক দিন মনে হতো, পাতিলে নুনের বদলে চোখের জল ফোটে।
দিনের পর দিন কেবল দিয়েছি ভালোবাসা, যত্ন, শ্রম। বিনিময়ে পেয়েছি অভিযোগ আর উপেক্ষা।

কখনো নিজে খেয়ে শুয়ে পড়তাম, কারো প্লেট সাজানোরও শক্তি থাকতো না।
আবার কোনোদিন নিজেরই খাওয়া হতো না শুধু পেটের ভেতরে যে ছোট্ট একটা প্রাণ ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে, তাকেই বলতাম,
-তুই কষ্ট সহ্য করে নে বাবা, মা একা খুব একা।

৮ মাস যখন শেষের পথে, আমার শরীর আরও ভারী আর ক্লান্তিতে জর্জরিত। ঠিক সেই সময়, শাশুড়ি হঠাৎই বললেন,
-তোর বাবাকে খবর দে, বলিস এসে যেন কথা বলে।

বাবা আসবেন শুনে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে এক অজানা আবেগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। শরীর চলছিল না, তবুও গ্যাসের চুলার সামনে দাঁড়িয়ে বাবার প্রিয় দু-একটা পদ রান্না করলাম। বিয়ের পর প্রথমবার বাবাকে আসতে বলেছি, এ অনুভবের মধ্যে ছিল ভয়, ছিল আবেগ, ছিল চাপা কান্নার ঢেউ।

বাবা দরজায় পা রাখতেই শুরু হলো অপমানের জলসা।
শাশুড়ি কড়া গলায় বললেন,
-আপনার মেয়ে একটা কাজেরও না। রান্নাটা করে, তাও নিজেই আগে আগে খেয়ে নেয়, কারোর দিকে ফিরেও তাকায় না। কারও মান-ইজ্জতের তোয়াক্কা নেই তার! নিজের মতো চলে, কাউকে কিছু বলে না। এই আপনার শিক্ষাদান?

আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। চোখ নিচু, হৃদয় ভার।

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
-তোকে আমি এই শিক্ষা দিয়েছি তুরিন? তুই তো এমন ছিলি না মা। কেমন করে এত বদলে গেলি?

বাবার কণ্ঠে অভিমান ছিল, কষ্ট ছিল, কিন্তু চোখে ছিলো একরাশ অব্যক্ত কান্না।
আমি চুপচাপ বসে রইলাম। বলার মতো কিছুই ছিল না।
তখনও কারও মনে হয়নি, যে মেয়ের গায়ে প্রাণ নেই, পেটে সন্তান নিয়ে সংসারের খুঁটিনাটি সামলে বাঁচতে লড়ছে, সে আসলে কেমন বেদনায় ডুবে আছে।

বাবা যখন চোখে জমে থাকা জল গোপনে মুছে শাশুড়ির সামনে মাথা নিচু করে ক্ষমা চাইতে যাচ্ছিলেন, আমি তখন কাঁপা হাতে বাবার হাত চেপে ধরলাম। ঠোঁটদুটি জোড়া দিতে পারছিলাম না, তবু বুকের ভেতর জমে থাকা সবকথা যেন অশ্রুসজল কণ্ঠে একে একে বেরিয়ে এলো।

-এখানে আমি ভালো নেই বাবা, আমাকে তোমার সাথে বাড়ি নিয়ে চলো।
এই টাকা, এই সোনা, এই রাজপ্রাসাদ কিচ্ছু আমার না।
এই ঘরে সব আছে, শুধু নেই একটু ভালোবাসা।
সারাদিন অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজ করে গেলেও কেউ একটা কথা জিজ্ঞেস করে না
“কেমন আছো তুরিন?”
সবাই শুধু নিজেরটা দেখে, আর আমি তিল তিল করে হারিয়ে যাই একা একা।

বাবা যেন মুহূর্তেই বোঝে ফেললেন মেয়ের শত অনুযোগের কান্না।
তিনি কোনো কথা বললেন না, শুধু আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
-চল মা, তোকে আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে দেবো না।
তোকে নতুন করে বাঁচাবো, আগের সেই হাসিখুশি তুরিনকে ফিরিয়ে আনবো।
আমি এক মুঠো খেলে তুই ও খাবি।

সেই মুহূর্তে না ছিল জামা কাপড় গোছানোর হুশ, না কারো অনুমতির অপেক্ষা।
শুধু একটুকরো ভরসা আর ভালোবাসা নিয়ে বাবা তাঁর মেয়েকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন।
আকাশের এক কোণে ঝুলে থাকা মেঘ তখন হয়তো সাক্ষী হয়ে বলছিলো,
“অন্তঃসত্ত্বা মেয়ের সবচেয়ে বড় আশ্রয়, তার বাবার কাঁধ।”

পেছনে পড়ে রইলো ঐশ্বর্যের মায়া, আর পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে অবাক চাহনিতে তাকিয়ে থাকা কিছু নির্বাক মানুষ,
তুরিন ফিরছিলো, ঠিক যেনো জন্মের মতো করে, বাবার আশ্রয়ে আবার নতুন করে বাঁচতে।

শাশুড়ি ফোন হাতে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে শশুর কে কল করে বললেন,
-তুমি এখনই অফিস থেকে ফিরো, ফাহিমকেও সঙ্গে আনো। ও একেবারে পেয়ে বসেছে আমাদের।

ফাহিম আর শ্বশুর যখন বাড়িতে এলেন, শাশুড়ি তখনো ক্ষুব্ধ কণ্ঠে অভিযোগের পাহাড় তুলে চলেছেন।

-একটা সংসার টিকিয়ে রাখতে শাশুড়ির ছায়া লাগে, আর আমি ওর মাথার উপর ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। অথচ সে কী করল? বেয়াই সাহেব এসে মেয়েকে এক কাপড়ে তুলে নিয়ে গেলেন! না কোনো জিজ্ঞাসা, না কোনো সম্মতি।
আর শুনলে তো অবাক হবে, বলছে নাকি আমরা তাকে খেতে দিই না, পরতে দিই না! সারাদিন কাজ করিয়ে মারি!
বিয়ে কি খেলনা নাকি? আজ মেজাজ খারাপ, তাই বাবার বাড়ি চলে যাবে যখন খুশি তখন ফিরবে, এবাড়ি কি বড়রা নেই? কারোর অনুমতি নেওয়ার ও প্রয়োজনবোধ করলো না! আর সেই বাবাও কেমন? তিনি নিজেও মেয়েকে এমন করেই গড়ে তুলেছেন একেবারে বেয়াদব!

একটু থেমে, আরো তীব্র হয়ে বললেন,
-আজ যে মেয়েকে নিয়ে গেলেন, কাল তো আবার সমাজে আমাদের মুখ দেখাতে হবে। কী মুখে বলব সবাইকে? ছেলের বউ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে! সমাজে তো এখন আমাদেরই বদনাম হবে। এই মেয়েকে ঘরে এনে যেন আগুন লাগিয়েছি ঘিয়ের হাঁড়িতে।

চারপাশে থমথমে নীরবতা। ফাহিম কেবল নিঃশব্দে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো,

গাড়ির জানালার কাঁচের ওপারে সন্ধ্যার আলোটা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে ঝিমিয়ে পড়েছে। আমি মাথা হেলিয়ে বসে আছি, বুকের ভেতরটা কেমন হাহাকার করছে।

ভাবছি,
কত শখ করে বাবার জন্য তাঁর প্রিয় শুঁটকি ভুনা আর গরম ভাত রেঁধেছিলাম যেনো তিনি মুখে তুলে বলবেন, “মেয়ের হাতেই এখনো সেই আগের মতো স্বাদ আছে।”
কিন্তু ভাগ্যই বুঝি সময়টা কেড়ে নিয়েছে তাঁর মুখে তুলে দেওয়ার সেই সাধ আজও অপূর্ণই রয়ে গেল।

পেটে একটা চাপ টের পেয়ে আমি পেটের উপর হাত রাখলাম।
এই যে অনাগত সন্তান, তার জন্যই তো ফিরে আসা কিন্তু ফিরেও কি শান্তি পাবো?

পরক্ষণেই মনে হলো এই সমাজ, এই আত্মীয়স্বজন মুখে যতই মায়া দেখাক, চোখে ততটাই কাঁটা হয়ে থাকবে আমার ফেরাটা।
কে কী বলবে, কে কিভাবে মুখ ঘুরিয়ে নেবে সবই যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

আর বাবা,
যিনি একদম নিঃস্ব হয়ে আজও টেনে চলেছেন সংসারের হাল, তিনি এখন কি ঋণের বোঝা বইবেন, না কি আমার মুখের জল মুছবেন?
হঠাৎ যেন বুকটা হু হু করে উঠলো।
আমি শুধু চুপচাপ বাবার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
তিনি একবারও আমার দিকে না তাকিয়ে জানালার বাইরে চেয়ে আছেন অথচ আমি জানি,
তাঁর চোখেও জমে আছে এক চিলতে অসমাপ্ত কান্না।

ফিরতে ফিরতে রাত নামল চুপিসারে।
চাঁদের আলো ফিকে হয়ে এসেছে, বাতাসেও যেন ক্লান্তির সুর।
শরীরটা আগেই হার মানছিল, এবার মনটাও কেমন যেন ভারী হয়ে উঠল।

পাশের বাড়ির ভাবি আমাকে দেখে যেন চমকে উঠলেন।
দৌড়ে এসে বুক ভরে জড়িয়ে ধরে বললেন,
– আরে তুরিন যে! কতদিন পর এলি । এই গাঁয়ের বাতাস তো তোদের আর সহ্য হয় না, তুইও কি কাল সকালেই চলে যাবি তোর বোনদের মতো?
শহরের হাওয়া একবার গায়ে লাগলে তো এ মাটির গন্ধই ভুলে যাস তোরা।

আমি শুধু মুচকি হেসে চুপ করে থাকলাম।
ভিতরে ভিতরে হাজারো শব্দ মুখ গলিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইল,
কিন্তু আমি গিলে ফেললাম সবকিছু, শুধুই চুপচাপ হাসলাম।

বাবা পুরো বিষয়টিই চেপে গেলেন,
ভাবির দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললেন,
-তুরিনের শরীর ভালো না।
সকালে ফোনে বলছিল,
বাবা তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
আমি আর দেরি করিনি।
নিয়ে এলাম, ভাবলাম ক’টা দিন বাবার কাছে থাকুক,
মনটা ভালো হবে।

ভাবি তখন চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
তাঁর চোখের ভাষায় অনেক প্রশ্ন,
তবু মুখে কিছু না বলে শুধু বললেন,
– ঠিকই কইছো কাকা, মেয়েরা তো বাবার ঘরেই নিরাপদ।
এই ঘরই তোর আশ্রয় তুরিন, ক’টা দিন থাক, শরীর ভালো কর।

ভাবি যেতেই গ্রামের অনেকেই এক এক করে এসে ভিড় জমালেন উঠোনে। কারও হাতে চাচার বাগানের পেয়ারা, কারও হাতে গরম দুধের বাটি, আবার কেউবা পুকুরের ঠান্ডা জল এনে বললেন,
-মুখটা ধুয়ে নে মা, ক্লান্ত লাগছে খুব।

সবাইর মুখে একরাশ কৌতূহল, মায়া আর প্রশ্নচিহ্ন। যেন অনেক কথা জমে আছে, বলবে কি বলবে না সেই দ্বিধায় থমকে আছে প্রতিটি চোখের দৃষ্টি।

তাদের সেই অপলক চাওয়া আর চাপা গুঞ্জনে আমি নিজেকে আর এ বাড়ির মেয়ে নয়, যেনো কোনো রাজপ্রাসাদ থেকে নির্বাসিত রানী মনে হচ্ছিলো, যে হঠাৎ করেই ফিরে এসেছে নিজের শিকড়ে।

বাবা ধীরে পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, এবং গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
-ও অনেক দূর পথ পেরিয়ে এসেছে, শরীরটাও ভালো নেই, একটু ঘুমাতে দাও। তোমরা সবাই তো জানোই, এ বাড়িতে সব কিছুর আগে আমার মেয়ের স্বস্তিটাই আমার কাছে বড়।

বাবার কথার পর কারও কিছু বলার রইলো না। সবাই ধীরে ধীরে উঠোন ফাঁকা করে চলে গেলো, আর আমি চুপচাপ সেই ফাঁকা উঠোনে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম,
কত অচেনা হয়ে গেছে এই চেনা উঠোনটা, অথচ বাবার কণ্ঠস্বর আজও আগের মতোই আশ্রয় হয়ে আছে।

রাতে আর রান্না করার ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেলেছিলাম।
ভেবেছিলাম, আজ না খেয়েই শুয়ে পড়ব,
বাবাকে বলবো, দোকান থেকে হালকা কিছু খেয়ে নিতে।

কিন্তু রাত প্রায় ন’টা নাগাদ হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়লেন এক চাচি।
হাতে ঠান্ডা হয়ে আসা ভাত আর তরকারির হাঁড়ি।
চোখেমুখে মায়া, কণ্ঠে স্নেহ মাখানো শব্দ বললেন,
-এমন সময় এত দূর থেকে এসে যে রান্না করবি না সেটা আমি জানি। তাই ভাবলাম একটু ভাত তরকারি দিয়ে যাই। বাবা-মেয়ে মিলে খেয়ে নিও।

আমার ভেতরে যেন কিছু একটা নরম হয়ে গেলো, গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠলো একরাশ কৃতজ্ঞতা।
ভাবলাম, হয়তো আমি কিছুই না, তবুও এই বাড়ির পুরনো উঠোনটা, পাশের বাড়ির ছাদের ছায়াটা, এমনকি এই মানুষগুলো এখনো আমাকে আপন ভাবে দেখে।
অথচ আমি নিজেই তো নিজেকে পর মনে করছিলাম।

সবার ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছিল, যেন কোনো বড় মাপের মানুষ এসে উঠেছে এ ঘরে
আসলে আমি নয়, আমার কষ্টটাই যেন সম্মান পাচ্ছে সবার কাছে।
হয়তো তারা বোঝে, একজন মেয়ে বাবার ঘরে ফিরে আসে যখন, তখন সঙ্গে থাকে অনেক না বলা কথা, কিছু চাপা কান্না আর একরাশ দায়িত্বহীন ক্লান্তি।

চুপচাপ বাবার পাশে বসে খেতে খেতে মনে হচ্ছিলো,
আজ দীর্ঘদিন পর কিছুটা শান্তি আমার গলায় নেমে এসেছে,
না, খাবারটা নয়।
এই মানুষের ভালোবাসাটা,
এইটুকুই আমার আজকের আরামের স্বাদ।

পরের দিন থেকে শুরু হলো আমার জীবনের এক নতুন সকাল।
জানালা খুলতেই চোখে পড়লো অপরূপ এক গ্রামীণ দৃশ্য।
ঘুম ভেঙে যাওয়া সকালটা যেনো আল্পনার মতো সাজানো,
পাখির কিচিরমিচির,
হাঁস-মুরগির নির্ভার ডাক,
আর পথ ধরে হেঁটে চলা পরিশ্রমী মানুষেরা,
কারো কাঁধে কোদাল, কারো হাতে ঝাঁপি।

মনটা হঠাৎ করেই প্রশান্তিতে ভরে উঠলো।
এই শান্ত সকাল, এই নির্জনতা,
এই অপার নির্ভরতার ছোঁয়া,
ওই অচেনা ইটপাথরের শহরে আর কোথায় পেতাম?

ভাবলাম, ভাগ্যিস চলে এসেছি।
নইলে আমার সন্তান যখন এ পৃথিবীতে আসবে,
তার জন্য কি এমন একটা নির্ভর পরিবেশ দিতে পারতাম?
সেই সংকটের মুহূর্তে কে-ই বা থাকতো পাশে?
কে রাখতো স্নেহের হাত কপালে?

সব ভাবনা মাথা থেকে সরিয়ে চুলগুলো হাতের আঙুলে গুটিয়ে খোঁপা বাঁধলাম।
তারপর নরম পায়ে হাঁটতে হাঁটতে রান্নাঘরের দিকে এগোলাম।

কিন্তু রান্নাঘরে ঢুকেই মনটা খানিকটা ভারী হয়ে গেলো।
একটা একটা করে কৌটো খুলে দেখলাম
সবই প্রায় খালি।
আলু-পেঁয়াজ ছাড়া তেমন কিছু নেই বললেই চলে।

বাবার কাছে গিয়ে খানিকটা সংকোচ নিয়ে বললাম,
– কি করবো এখন? রান্নাঘরে তো কিছুই নেই।
বাবা অমনি আমার মাথায় হাত রেখে স্নেহভরে বললেন,
– আমি একেবারেই ভুলে গেছি মা, দাঁড়া, পাশের দোকান থেকেই কিছু এনে দিচ্ছি।

তার চোখে একটা অদ্ভুত ক্লান্তি ছিল,
কিন্তু তার চেয়েও বেশি ছিল আগলে রাখার অভ্যাস।

-একা মানুষ তো মা, তাই সবসময় বাজার করা হয় না।
কখনো পাশের বাড়ি থেকে কেউ দিয়ে দেয়,
কখনো বা দুটো তরকারি দিয়ে কোনোভাবে চালিয়ে নিই।
আবার কখনো না খেয়েও কেটে যায় একটা দিন।

বাবার কথাগুলো শুনে বুকের ভেতর হালকা একটা কাঁপুনি খেল।
একটা দীর্ঘ সময় ধরে তিনি কী নিঃশব্দ লড়াই করে গেছেন,
আমি তখন শহরের কংক্রিটে বন্দি,
আর উনি একা একা জীবনকে জিতিয়ে গেছেন,
অভিমানের শব্দ না করে।

সবাই একটু রেসপন্স করুন, লাইক কমেন্ট করতে তো আর বেশি সময় লাগে না।
ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখুন।

চলবে,,,,,,