কালিনী পর্ব-০৮

0
1

#কালিনী
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যা ০৮

বাবা টুকিটাকি কিছু বাজার এনে হাতে তুলে দিলেন।
স্নেহভরা সে স্পর্শে যেন অজান্তেই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো।
আমি সেইসব সামগ্রী দিয়ে রান্নায় মন দিলাম চালের হাঁড়ি চাপানো, ডালের গন্ধে ভরে উঠলো উঠোন।

বাইরে পা রাখতেই যেন অনুভব করলাম আমি আর আগের আমি নেই।
গ্রামের মাটির ধুলোও যেন আজ আমাকে ছুঁয়ে আশীর্বাদ করছে।
প্রতিটি চেনা মুখে এক নতুন উষ্ণতা,
একটা শ্রদ্ধার দৃষ্টি,
একটা মায়াবতী মুগ্ধতা।
কারও হাতে পেয়ারা মাখা, কেউ এগিয়ে দিচ্ছে আমের আচার।
কে যেন বলে উঠল,
-তুরিন তোমার জন্য আড়ত থেকে টাটকা শাক এনেছি।
অন্যজন চা বানিয়ে হাতে ধরিয়ে দিল।
আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি এই আমি! যে কিনা এতদিন কারো নখদর্পণেও ছিল না, আজ সবার স্নেহের কেন্দ্রবিন্দু।

তারা জানতে চায় আমার স্বামী কী করেন, কোথায় থাকেন, আমার শ্বশুরবাড়ির অবস্থা কেমন,
সব প্রশ্নের জবাবেই আমি হালকা এক মৃদু হাসি ছুঁড়ে দিই,
কারণ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয় আমার বর্তমান, সে এক মিশ্র অনুভবের গল্প।

আজ বুঝলাম, বিয়ের পর একজন নারীর চারপাশের দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে বদলে যায়।
যাদের কাছে এতকাল আমি কেবল একজন অবহেলিত মেয়ে ছিলাম,
আজ সেই সমাজের চোখেই আমি এক গৃহবধূ,
একজন পুরুষের ভালোবাসার অধিকারিনী।
বুকের গভীরে কেবল একটাই দীর্ঘশ্বাস জমা থাকে।
কেন এমন মমতা পেতে নারীদের অপেক্ষা করতে হয়, নিজের নামের পাশে অন্য একটি নামের অর্থ বহন করতে হয়?

উঠোনে বসে আছি, মাথায় ঠান্ডা বাতাসের মতো শান্তির স্পর্শে পাশের বাসার ভাবি যত্ন করে তেল দিচ্ছেন।
সেই আদর, সেই কোমল স্পর্শে যেনো হারিয়ে যাচ্ছি কোনো এক দূর অতীতে।
ইশ্! কত বছর পর এমন স্নেহ পেলাম,
মা মারা যাবার পর মাথায় এমন আদরে কেউ হাত রাখে নি।
চোখ বন্ধ করতেই যেনো মা এসে দাঁড়ালো আমার সামনে,
হালকা হাসিতে মুখভর্তি আলোর রেখা,
কাঁধে শাড়ির আঁচল, হাতে নারকেল তেল,
মাঝে মাঝে কপালে চুমু দিচ্ছেন, আর বলছেন
– কালো হলে কি হয়েছে, আমার মেয়ের মনটা তো সোনা!

চোখের কোনা ভিজে এলো।
কালো গায়ের রঙের জন্য একের পর এক রিজেকশন,
আর পেছনে দাঁড়িয়ে মা-বাবার নির্বাক, কষ্টে ডুবে থাকা মুখ।
প্রতিটি প্রত্যাখ্যান যেনো কেবল আমাকেই নয়,
আমার পরিবারের স্বপ্নকেও প্রতিবার করে খান খান করেছে।

সেদিন ভাগ্যের এক অলিখিত টানে ফাহিমের বউ হলাম বটে,
কিন্তু বউ হয়ে কী সত্যিই আমি ঘর পেয়েছিলাম?
যে ঘরে মমতা নেই, সেখানে দেওয়াল থাকলেই বা কী আসে যায়?

আজ যখন এই উঠোনে বসে আছি,
মাথায় তেলের সেই নরম হাতের ছোঁয়ায়
আমার ভিতরের প্রশ্নগুলো গর্জে ওঠে,
একজন মেয়ের জীবনের পরিচয় কি কেবল তার স্বামী?
তার নিজের পরিচয়, তার নিজস্ব স্বপ্ন, তার সংগ্রাম।
এসবের কোনো দাম নেই?

সে কি শুধু ভালো বা খারাপ স্বামী নির্ভর জীবন পাড়ি দেবে?
সে কি কখনো নিজের জন্য, নিজের নামে,
নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না?

বাইরের মৃদু হাওয়ায় মনটা নিমিষেই শান্ত হয়ে গেলো।
নিজেই নিজের মনে সাহস যোগালাম, আমি পারবো।
এবার আমাকে আর কোনো পরিচয়ের ছায়ায় নয়,
নিজের আলোয় জ্বলে উঠতে হবে,
নিজের নামেই পরিচিত হতে হবে,
একজন ‘আমি’ হিসেবে।

চুপচাপ উঠে মায়ের রুমে গেলাম।
ওড়না দিয়ে ঢাকা সেই পুরোনো সেলাই মেশিনটা নিঃশব্দে উন্মোচন করলাম।
মেশিনের ধুলো জমা গায়ে যেনো মা’র স্পর্শ এখনো লেগে আছে।
মনে হলো মা যেনো পাশ থেকে বলছেন,
“তোর হাতের কাজ তো আমার থেকেও ভালো রে, এখন দেখিয়ে দে সবাইকে!”

মায়ের কাছ থেকে শুধু ভালবাসা নয়, শিখেছি জীবন লড়াইয়ের হাতিয়ার।
রান্না, ধোয়া-মোছা, আলনা গোছানো, শিশুর যত্ন আর সেলাই।
এই সেলাই মেশিন একসময় ছিলো বাবার ভরসার পাশে দাঁড়ানো মায়ের সাহস।
আজ হয়তো আমিও ঠিক সেভাবেই দাঁড়াবো, যদি আমার সন্তানটা একবার চোখ মেলে তাকায় এই পৃথিবীর দিকে।

সন্ধ্যার সোনালি আলো জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে।
ঠিক তখনই দূর থেকে ভেসে এলো এক চেনা কণ্ঠ,
-তুরিন, তুরিন।

তুরিনের বুক কেঁপে উঠলো।
সেই ডাক, সেই স্বর ফাহিম!

সে নিঃশব্দে দরজার পাল্লা সরিয়ে উঠোনে এলো।
চাঁদের আলোয় ফাহিমের মুখে কষ্টের রেখা, গলায় পরিতাপ।

-তুমি কাউকে কিছু না বলে এখানে চলে এলে কেনো?

তুরিন চোখ নামিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো,
-বলার মতো জায়গা কোথায় ছিলো?
যে ঘরে আমার কান্নার শব্দও কষ্টের নয়, শুধু লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়ায়,
সেই ঘরে আমি কী বলতাম আর কাকে?
আপনি যদি সত্যিই জানতে চাইতে, তাহলে এমন করে প্রশ্ন করতে না, পাশে এসে দাঁড়াতেন।

ফাহিম কিছুক্ষণ নীরব রইলো।
তুরিন আবার বললো,
– আমি এসেছি বাঁচতে, লড়তে, নিজের অস্তিত্বটা ধরে রাখতে।

সে ঠান্ডা গলায় বললো,
– মা বলেছে বাড়ি আসতে।
– আমার বাচ্চা যতদিন না বাইরের আলো দেখছে, ততদিন আমি এখানেই থাকবো।
আমার সন্তান জন্মের পরে না-হয় আমায় নিতে আসবেন।

ফাহিম এক পলক তুরিনের দিকে তাকিয়ে রইলো।
তুরিন চোখ নামিয়ে ধীর কণ্ঠে বললো,
-আসুন, ঘরে এসে বসুন।

ফাহিম ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের রেখা এঁকে বললো,
– এই পিচ্চি ঘরে বসতে গেলে তো ঘরের চাল এসে আমার মাথায় লাগবে।

তুরিন চোয়াল শক্ত করে তাকালো তার দিকে,
-আপনি আমাকে নিতে এসেছেন, নাকি অপমানের ঢেউ তুলতে এসেছেন?

– তুমি যেটা ভাবো। আচ্ছা বাদ দাও, তাহলে কি তুমি যাচ্ছো না?

-আপাতত না।

-ওকে, আমি চললাম।

তুরিন চোখ তুলে তাকালেও কিছু বললো না।
একটি নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস যেন চোখের পাতার আড়াল ভেঙে নেমে এলো।
অথচ তার চোখে ছিলো না কোনো অভিমান, ছিলো অদ্ভুত এক দৃঢ়তা।

ফাহিম পেছন ফিরে পা বাড়ালো,
তুরিন থেমে থেমে বললো,
– একটু বসে যেতে পারতেন।

ফাহিম থামলো না।
-রুচি নেই।
সংক্ষেপে বলেই হাটতে শুরু করলো।

তুরিন দাঁড়িয়ে থেকে দেখলো মানুষটার সরে যাওয়া,
যার ছায়ার নিচে একদিন আশ্রয় খুঁজেছিলো সে,
আজ সেই ছায়া নিজেই হয়ে উঠেছে বিষাক্ত রোদ্দুর।

রাতে বাবা বাড়ি ফিরলেন একটু ক্লান্ত মুখে। দরজার ছায়ায় দাঁড়িয়ে যেনো কিছুক্ষণ আমাকে নিরবে দেখলেন। তারপর পকেট থেকে ভাঁজ করা দুইটা এক হাজার টাকার নোট বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন,
-কাল একবার তোর ভাবিকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাস। শরীর ঠিক নাই বুঝতে পারতেছি।

আমি চুপচাপ টাকা হাতে নিলাম, কিন্তু মুখে কিছু বললাম না। মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস এলিয়ে দিলাম,
এটাই বুঝি বাবার ছায়াতল, নিঃশব্দ অথচ অমোঘ আশ্রয়।
ওদিকে শ্বশুরবাড়ির সম্পদের পাহাড় অথচ একবারও শাশুড়ি মুখে বলেননি, চল মা, ডাক্তার দেখাই।
উল্টো আমি যখন সাহস করে বলেছিলাম, উনি চেঁচিয়ে উঠেছিলেন এমনভাবে যেন আমার অসুখটা এক প্রকার দোষ!

বাবার কিছু নেই, তবু তার আদর-আশ্বাস যেনো রত্নের চেয়েও দামি।
এই দুই হাজার টাকায় শুধু চিকিৎসা নয়, বাবার অগাধ ভালোবাসা মিশে আছে।

আমি মিনমিন করে বললাম,
-বাবা, আজ উনি এসেছিলেন,
বাবা কপাল কুঁচকে তাকালেন,
-কেন?
-আমাকে নিতে। আমি বলেছি, এখন যাবো না।
-ভালো করেছিস, জামাইকে বসতে বলিস নি?
– বসতে বলেছিলাম, কিন্তু উনি বসেননি। দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে গেছেন।

বাবা একটুখানি হাসলেন।
-আচ্ছা, যা, তুই এখন এসব নিয়ে ভাবিস না। যেটা কপালে আছে, সেটা ঠিকই দেখা যাবে।
তারপর আমার মাথায় আলতো করে হাত রাখলেন। সেই স্পর্শে যেনো সমস্ত ভাঙচুর, সমস্ত অবহেলার হাহাকার মুহূর্তে শান্ত হয়ে গেল।

কিন্তু কোথাও একটুখানি ব্যথা ঠিক রয়ে গেল,
যেখানে বাবারা মেয়েদের আগলে রাখেন, সেখানে স্বামীরা কেন শুধু ছাড়ার অজুহাত খোঁজে?
মেয়েরা এতটাই একা হয় কেনো, যখন তারা মা হতে যাচ্ছে?

ভোরের নিস্তব্ধতা ভেঙে বাবার ফোন বেজে উঠতেই মন কেমন করে উঠেছিল।
আহত পাখির মতো আমার বুকের ভিতরটা ছটফট করছিল।
শুধু আন্দাজ করছিলাম, নিশ্চয় ও দিক থেকে আবার কোনো অপমান ছুটে আসবে।

ঠিক তাই হলো।
শাশুড়ির কণ্ঠে মমতার লেশমাত্র নেই, ছিল শুধু কঠোরতা আর অবজ্ঞার বিষ।
ভালো-মন্দ কিছু না শুনেই জোর গলায় বলে উঠলেন,
-ওমন বেয়াদব মেয়েকে আমি আর ঘরে তুলবো না বেয়াই মশাই। আদব কায়দা শেখান নি বুঝি?
জামাই যখন নিতে গেছে, তখন তাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিলো! এই মেয়েকে আমার বাড়ির চৌকাঠে আমি আনবো না। আমার ছেলেকে আবার বিয়ে দেবো।

শব্দগুলো বিষাক্ত তীর হয়ে বিদ্ধ করলো আমার আত্মায়।
ফোন কেটে দেওয়ার শব্দটা যেন বজ্রপাতের মতো আমার কানে বাজলো।

বাবা ধপ করে মাটিতে বসে পড়লেন।
আমি ছুটে গিয়ে বাবার কাঁধে হাত রাখলাম, কিন্তু তাঁর মুখটা এমন নিস্তেজ, এমন থমথমে
যেনো সব শব্দ, সব আশ্বাস কোথায় হারিয়ে গেছে।

আমার নিজের বুকের ভিতরেও অদ্ভুত হাহাকার।
একটা জীবন দিয়ে যে সম্পর্কটাকে টিকিয়ে রেখেছিলাম, আজ তার ইতি টানার ঘোষণা শুনে হৃদয় যেন চিৎকার করে উঠতে চাইছে।

শত অবহেলা, শত অপমান সয়েও পড়ে ছিলাম ও বাড়িতে শুধু ওনার একটু ভরসার জন্য।
আজ বুঝি, সবকিছু শেষ।
তবু কোথায় যেন একফোঁটা ভালোবাসা জমে ছিল, তাই বুকটা এমন কান্নায় ভরে যাচ্ছে।

দম বন্ধ লাগছে।
জীবনের সমস্ত রং এক মুহূর্তে ফিকে হয়ে গেছে।
আলো-অন্ধকারের মাঝে ঝাপসা হয়ে গেছে ভবিষ্যতের ছবি।
সবকিছু থেমে আছে, শুধু চোখের কোনা বেয়ে নীরব কান্না গড়িয়ে পড়ছে প্রতিধ্বনি ছাড়া, প্রতিশ্রুতি ছাড়া।

নিজেকে দৃঢ় রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও গলার কাঁপুনি লুকোতে পারছিলাম না। তবুও চোখের জল গিলে নিয়ে বাবার কাঁধে হাত রেখে মৃদুস্বরে বললাম,
– হয়ে যাক না বিচ্ছেদ, এটা নিয়ে এতটা ভেঙে পড়ো না বাবা। তুমি কি পারবে না আমাদের দুমুঠো খাওয়াতে?

বাবার শুকনো মুখটা থমকে রইল, তারপর নিঃশব্দে বললেন,
-খাওয়াতে পারবো, হয়তো সোনার থালা নয়, কিন্তু আমার নিজের হাতে খাবার খাইয়ে দিতে পারবো।
কিন্তু ঐ বাড়ির মত ঐশ্বর্য, তা তো আর দিতে পারবো না মা।

আমি হেসে ফেললাম একবুক দুঃখ নিয়ে,
-বাবা, সত্যিই কি তুমি মনে করো ঐ বাড়িতে আমি ভালো ছিলাম? তুমি ভেবেছিলে, মেয়েকে বড় ঘরে দিলে বাকি জীবনটা সে রাজরানীর মতো কাটাবে।
কিন্তু তুমি জানো না, সেই প্রাসাদে আমার মন কেঁদেছে,
সেই বাড়ির ঝকমকে আলোর নিচে আমার আত্মা নিভে গেছে।

বিশ্বাস করো বাবা, টাকা পয়সা, সাজানো সংসার, দামি আসবাব এগুলো দিয়ে হৃদয়ের ক্ষুধা মেটে না।
ও বাড়ি আমার জন্য ছিল একটা সোনার খাঁচা।
সেখানে ভালোবাসা ছিল না, সম্মান ছিল না, ছিল না একটুকরো প্রশ্রয়।

তার চেয়ে আমি এখানেই ভালো আছি। তোমার ছায়ায়, নিজের পরিচয়ে।
আমি আর ও বাড়িতে ফিরতে চাই না বাবা।
আমি মুক্তি চাই।
নিজেকে আবার খুঁজে পেতে চাই এই মাটির ঘ্রাণে, এই ভালোবাসার ঘরে।
বাবা চুপ করে রইলেন।

রান্না ঘরে গিয়ে বাবাকে ভাত বেড়ে দিয়ে আমি ধীরে ধীরে নিজের ঘরে চলে এলাম।
আজ আর কারোর মুখে কোনো কথা নেই, আর প্লেটে কোনো খাবারের স্বাদ নেই।
ঘরজুড়ে যেন এক বিষণ্ন স্তব্ধতা। দম বন্ধ করা এক নিঃসঙ্গতা।

হঠাৎ দাদি এসে দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন
-কি রে তুরিন, এই দুপুরবেলা শুয়ে শুয়ে থাকছিস যে?
-কিছু না দাদি, এমনি একটু শুয়ে পড়েছি।
-তোর বাপ কি কাজে চলে গেছে?
-এই তো, এখনই যাবে। কিছু দরকার?
– সেদিন আমার থেকে এক হাজার টাকা নিয়েছিলো, সেটা ফেরত চাইতে এলাম। একটু দরকার ছিলো।

আমি আর কিছু না বলে আমার ছোট হাতব্যাগ খুলে ব্যাগের ভেতর পড়ে থাকা দুই হাজারের মধ্য থেকে এক হাজার টাকা বের করে দাদির দিকে বাড়িয়ে দিলাম।
দাদি একটু হকচকিয়ে তাকালেন, তারপর নীরবে টাকা নিয়ে চলে গেলেন।
সেই নিরবতা যেন আরও ভারী হয়ে পড়লো আমার বুকের উপর।

একটু পর বাবা তাড়াহুড়ো করে কাজে বেরিয়ে গেলেন।
ঘরটা এখন সম্পূর্ণ নিঃস্তব্ধ।
ঘড়ির টিক টিক শব্দ ছাড়া যেন আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না।

আমি জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
দিগন্ত জোড়া ধানের ক্ষেতের ওপার থেকে বাতাস এসে চুলে লেপ্টে যাচ্ছে।
একবার ভাবলাম, এটাই কি আমার জীবন?
একটা ভাঙা বিয়ে, কিছু চেনা ব্যথা আর নীরব চোখের কান্না?

না। আমি এখানেই থেমে যাবো না।

নিজেকে শক্ত করলাম, নিজেকে বললাম,
তুরিন, আজ থেকে তুই বাঁচবি, নতুন করে বাঁচবি। শুধু নিজের জন্য না,
তুই বাঁচবি তাদের জন্যও,
যারা তোর মতো একদিন অবহেলার কাঁটায় রক্তাক্ত হয়েছিলো,
যাদের স্বপ্নগুলো সমাজের গর্তে পড়ে পচে গিয়েছিলো।

তুই তাদের হাত ধরে তুলবি,
তুই নতুন এক আলো জ্বালাবি,
তাদের নিয়ে গড়বি এক আশ্রয়ের ঘর,
যেখানে থাকবেনা তুচ্ছতা, থাকবেনা নতমাথা চোখ।
থাকবে সম্মান, সাহস আর আত্মবিশ্বাস।

আজ থেকে আমি কাঁদি না, কাঁদতে নেই।
আমার চোখের জল একদিন কাউকে পথ দেখাবে, সেই বিশ্বাস নিয়েই আমি আবার হাঁটবো।
কারণ আমি শুধু একা তুরিন না, আমি হাজারো তুরিনের প্রতিধ্বনি।
আমি নিজের জন্য না, একটা সমাজ বদলানোর স্বপ্নে বাঁচবো।

দেখতে দেখতে সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি এসে উপস্থিত হলো।
নবজাতকের কান্না ভেদ করে আনন্দে ভরে উঠলো গোটা ঘর।
তুরিন জন্ম দিলো এক অপূর্ব সুন্দর ফুটফুটে পুত্রসন্তানের যেনো তার গায়ের রঙেই মিশে আছে রোদের দীপ্তি আর পূর্ণিমার জ্যোৎস্না।

রমিস মিয়া কাঁপা হাতে নাতিকে কোলে তুলে নিয়ে কানের কাছে মুখ এনে ধীরে ধীরে আযান দিলেন।
সেই শব্দে যেন আসমান-জমিন সাক্ষী হয়ে গেলো এই নতুন জীবনের সূচনার।

সন্তানের মুখ দেখে এক নিমেষে সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে গেলো তুরিন।
চোখে নেমে এলো এক অব্যক্ত প্রশান্তি যেনো বেঁচে থাকাটাও এখন অর্থবহ হয়ে উঠলো।
ভাঙ্গা কণ্ঠে, কান্না চেপে রেখে সে বললো,
-যাক, এবার তোর বাবা আর তার পরিবার তোকে নিয়ে লজ্জা পাবে না। তুই তাদের সন্তান বলতে দ্বিধাবোধ করবে না।
তোর বাবার আর গা ঢাকা দিয়ে, মুখ লুকিয়ে চলতে হবে না।
তুই তো কালো নস, তোর জন্ম দিয়েই তুই আমার অসম্মান ঢেকে ফেললি বাপ।

এক এক করে গ্রামবাসী ছুটে এলো দেখতে,
কে কেমন বলছে, কে কী ব্যাখ্যা দিচ্ছে সব যেনো কানে ভেসে আসছে,
– মা তো কালো, ছেলেটা এমন ফর্সা কই পেলো?
-হা হা, ওর বাপ দেখেছো? রাজপুত্র যেন!
-আমি তো জানি, ওর দাদার গোত্রেই এমন গৌরবর্ণ।
-ভাগ্য করে জন্মেছে মেয়েটা, না হলে এমন ঘরে বিয়েই বা হতো কেমনে!

তাদের এইসব মন্তব্য যেন বাতাসের তরঙ্গে ভেসে এসে তুরিনের কানে লেগে যাচ্ছিল।
সে শুয়ে শুয়ে নিঃশব্দে হাসলো।
মনে মনে বললো, বাহিরটা দেখেই মানুষ বিচার করে ভেতরের আলো-অন্ধকার।
রঙ ফর্সা মানেই যদি ভালো মানুষ হতো, তবে কালো হৃদয়ের কী হতো?

ছেলেটা সত্যিই তার জীবনের নতুন রোদের নাম।
দাদি এসে ছেলেটাকে তুরিনের পাশে রেখে গেলে,
তুরিন সন্তানের মুখে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বললো,
-আজ থেকে শুরু তুরিনের নতুন পথচলা।
এই ছোট্ট মুখটাই হবে আমার সাহসের নাম, আমার যুদ্ধের মন্ত্র।
তুরিন আর হারবে না,
তুরিন প্রমাণ করবে,
রঙ নয়, চোখে জল নিয়ে রাত কাটানো মানুষগুলোকেই আসলে বলে সত্যিকারের সৌন্দর্য।
তুরিন একদিন জিতে দেখাবে,
একজন কালো রমণীর মমতা, সাহস আর শ্রম কেমন করে আকাশ ছুঁতে জানে।

জীবনের পাথেয় নিয়ে, বুক ভরা বিশ্বাসে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিঃশব্দে চোখ বন্ধ করলো তুরিন,
মনে হলো, শত অপমান সয়েও যেন এই একটি জীবন তার কোলেই সৌভাগ্যের আলো হয়ে এসেছে।
এটুকুই তার জয়ের শুরু।
❝এই যে হাজার হাজার মানুষ গল্প পড়েন, আপনারা রেসপন্স করেন না কেনো? একটা লাইক দিতে তো বেশি সময় লাগে না।❞

চলবে,,,