কালিনী পর্ব-১৩

0
1

#কালিনী
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যা ১৩

পরদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে তুরিন হাঁটতে হাঁটতে আবার সেই দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
হাতে ধরা একটা ছোট ব্যাগ যেখানে তার দোকানের পাওনা টাকাগুলো গুছিয়ে এনেছে।
সাথে ছিলো আরও কিছু নতুন মাল নেওয়ার ইচ্ছে।

দোকানের ছেলেটি (বাহার) দূর থেকেই তাকে দেখে চেনা হাসিতে মুখ ভরালো,
কণ্ঠে একরাশ রসিকতা মিশিয়ে বলে উঠলো,

-আরে বেগম রোকেয়া এসেছে!
গতকাল তো কোনো খোঁজই পাওয়া গেলো না, ভাবছিলাম তুমি বুঝি ঢাকা চলে গেলে নতুন কোনো বিপ্লব ঘটাতে।

তুরিন হালকা হাসলো,
কিন্তু চোখে-মুখে ছিলো একটা স্থিরতা।
চুপচাপ গিয়ে দোকানের বাঁদিকের চেয়ারটায় বসে বললো,

-মজা করছেন আমায় নিয়ে?

হাসির রেখা মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো বাহারের মুখ থেকে।
কণ্ঠটা নরম হলো, চোখ দুটো একটুও সরলো না তুরিনের চোখ থেকে।

-আরে না, কখনো না।
তুমি রাগ করো না, আমি ব্যঙ্গ করে বলিনি।
তুমি সত্যিই আমাদের বেগম রোকেয়া।
তোমার মতো সাহস আর সংগ্রাম দেখি কয়জনের আছে?
এই গ্রামে? এমনকি শহরেও?
তুমি তো একটা চলন্ত উদাহরণ, বুঝলে না?”

তুরিন কিছু না বলে চুপচাপ থলেটা এগিয়ে দিলো তার দিকে।
ছেলেটা টাকাগুলো হাতে নিয়ে একটু থেমে বললো,

-এই টাকাগুলো পরে দিলেও চলতো।
তোমার মতো মানুষদের আমি ব্যবসায়ী হিসেবেই দেখি না।
তুমি বরং আগে এগিয়ে যাও, দোকানটা দাঁড় করাও।
তুরিন কিছু না বলে ব্যাগ থেকে আরও তিন হাজার টাকা বের করলো।
টাকাগুলো ছেলেটার হাতে দিয়ে মৃদু স্বরে বললো,

-এই টাকায় সব অল্প অল্প করে দিন, যাতে দোকানে রাখলে মানুষ যা চাইবে, আমি দিতে পারি।

বাহার (ছেলেটা) মাথা নেড়ে সব অল্প অল্প করে গুছিয়ে দিলো, যেন প্রতিটি জিনিস বেছে নেওয়ার সময়ও যত্নের কমতি নেই।

ঠিক তখনই পেছন থেকে এক বৃদ্ধ কণ্ঠ ভেসে এলো,

-এই বাহার!

বাহার মাথা তুলে সাড়া দিলো,
-জ্বি বাবা?

-ফেরার সময় তোর মায়ের ওষুধ নিতে ভুলিস না যেনো?

-হ্যাঁ, ঠিক আছে। তুমি আগে বাড়ি যাও।

তুরিন এতদিন এই দোকানে বহুবার এসেছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত বাহারের পরিবার বা ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেনি।
তবুও আজ হঠাৎ তার মনে হলো এই নীরব, সরল ছেলেটা আসলে কেমন জীবনে বাস করছে?

মোলায়েম কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,

-শুনুন, কিছু মনে করবেন না, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

-হ্যাঁ, বলো।
-উনি আপনার বাবা?
-হুম।
-বাড়িতে আর কে কে আছেন?
-মা, বাবা আর আমি। আর একটা ছোট ঘর আছে। জায়গা-জমি ছিলো, কিন্তু সব বিক্রি করে বাবা এই বড় দোকানটা খুলে দিলেন।
একমাত্র ছেলে চোখের আড়াল করতে চান না বলে বিদেশ পাঠাননি, বরং দোকানটা দিয়ে দিয়েছেন।

তুরিন চুপচাপ শুনছিলো, তারপর কৌতূহলী চোখে বললো,

-বিয়ে করলেন না কেন?

বাহার হেসে বললো,
-বয়স তো মাত্র ৩০।

তুরিন ভ্রু তুলে তাকালো,
-৩০ বছরকে আবার ‘মাত্র’ বলছেন নাকি?

বাহার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
-পুরুষ মানুষ তো চাইলে ৫০ বছর বয়সেও বিয়ে করে ফেলতে পারে।
কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে সমাজ যেন ঘড়ির কাঁটা বেঁধে দেয়।

তুরিনের ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি ফুটে উঠলো,
কিন্তু মনে এক অদ্ভুত প্রশ্নের ঢেউ উঠলো,
সমাজ কি সত্যিই পুরুষকে এতটা স্বাধীনতা দেয়, নাকি পুরুষরা নিজেরাই তা কুড়িয়ে নেয়?

বাহার ঠোঁটে হালকা হাসি টেনে আবারও বললো,
-কি বেগম রোকেয়া, আজ বড় চুপচাপ দেখা যাচ্ছে যে?

তুরিন চোখ তুলে এক মুহূর্ত তাকালো, কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না।
চুপচাপ হাতে ব্যাগ তুলে নিলো, যেন শব্দগুলো তার কানে পৌঁছালেও মন পর্যন্ত পৌঁছায়নি।

দোকান থেকে বেরিয়ে গ্রামের কাঁচা রাস্তায় পা বাড়ালো সে।
হাওয়া হালকা ধুলো উড়িয়ে আনছে, কিন্তু তার মাথার ভেতর যেন ঝড় বইছে।
একটার পর একটা প্রশ্ন গুনগুন করছে মনে,
মানুষকে কি সত্যিই এত সহজে পড়া যায়?
বাহারের কথাগুলো কি কেবলই মজা?

বাড়ি ফিরে বাবার পাশে বসে ধীরে বললাম,
-বাবা, দোকানটা এবার একটু বড় করা দরকার।

তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকালেন,
-মানে?

আমি মৃদু হাসলাম,
-মানে দোকানে শুধু যে জিনিসগুলো আছে তাই নয়,
এবার একটু আধটু মশলাপাতি, চাল-ডাল এগুলোও রাখা দরকার।
যাতে গ্রামের মানুষ এক দোকানেই সব পায়।

বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-কিন্তু মা, এতে তো অনেক টাকা লাগবে।

আমি আশ্বস্ত করলাম,
-সব একসাথে তো আনবো না বাবা,
ধীরে ধীরে, অল্প অল্প করে সাজাবো দোকান।
যেমন নদী ফোঁটা ফোঁটা জল পেয়ে পূর্ণ হয়,
তেমনি আমার দোকানও ধীরে ধীরে ভরে উঠবে।

তিনি একটু চুপ থেকে মাথা নেড়ে বললেন,
-হুম, তুই যা ভালো বুঝিস মা।
তোর চোখে আমি আগুনের শিখা দেখছি,
যা একদিন তোর জীবনই বদলে দেবে।

রাতে হঠাৎ ফোনের পর্দায় ভেসে উঠলো ফাহিমের নাম।
ইচ্ছে করেই ধরলাম না।
দ্বিতীয়বার বেজে উঠলো তাও না।
তৃতীয়, চতুর্থ, অবশেষে পরপর কয়েকবারের পর রিসিভ করলাম।
শীতল কণ্ঠে সালাম দিলাম।

ওপাশ থেকে মধুর, অথচ কেমন যেন অপরিচিত শোনানো স্বর,
-আগামী পরশু আমার বিয়ে, তোমার দাওয়াত রইলো।

না চাইলেও বুকের ভেতরটা যেন কেউ মুঠো করে চেপে ধরলো।
ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম,
-বেশ ভালো।

-তুমি আসবে?
-কোন অধিকারে আসবো?
-বিয়েতে আসতেও কি অধিকারের প্রয়োজন পড়ে ?

এরপর আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না, চিৎকার করে উঠলাম,
-আপনি শুধু দেখতে মানুষ, কিন্তু আপনার আচরণ, পশুর মতো হয়ে গেছে।
আপনি জানতেন আমি আপনাকে কতখানি ভালোবাসি,
তাও আপনি আমায় টুকরো টুকরো করে ফেলেছেন।
আর আজ সেই ক্ষতের উপর লবণ ছিটাতে এসেছেন?
আপনি কি আমায় একটুখানি ভালো থাকতে দেবেন না?
শান্তিতে বাঁচতে দেবেন না?

ওপাশ থেকে দীর্ঘ নীরবতা,
তারপর হঠাৎ কল কেটে গেলো।

আমি বিছানায় মুখ গুঁজে ভেঙে পড়লাম।
মনে হলো যেন ভেতরটা কেউ শূন্য করে দিয়েছে।
নিজেকে ভীষণ নিঃস্ব মনে হলো,
যেন শূন্য ঘরে হঠাৎ সব আলো নিভে গেছে।
কেনো এমন হচ্ছে?
এ তো হওয়ারই ছিলো,
সে তো কখনো আমার ছিলো না।
তবু আজ মনে হচ্ছে,
হারিয়েছি একটুকরো নিজেরই প্রাণ।

পুরোটা রাত চোখে এক ফোঁটা ঘুম নামেনি।
ভোরের প্রথম আলোও যেন চোখের ফোলাভাব ঢাকতে পারলো না।
সকালে বাবা বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন,
-চোখ মুখ এত ফোলা কেন মা?
আমি হেসে বললাম,
-কিছু না বাবা, হয়তো এমনিই হয়েছে।
কিন্তু তিনি থামলেন না।
শেষমেশ অনিচ্ছায় বলে ফেললাম,
-আগামীকাল ফাওয়াদের বাবার বিয়ে।

বাবা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন,
-তুই তার জন্য কাঁদছিস?
আমি তৎক্ষণাৎ মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম,
-কই না তো, তার জন্য কেন কাঁদবো? সে যেমন আমার কেউ না, আমিও তেমন তার কেউ না।
বলেই রান্নাঘরের দিকে চলে এলাম, বাবার সন্দেহের দৃষ্টি থেকে পালাতে।

সকাল গড়ানোর আগেই খবর এলো এক চাচির ঘরে নাতি এসেছে।
খুশিতে তিনি মিষ্টি নিয়ে এলেন।
শুনেই মনটা ভালো হয়ে গেলো।
নাদিয়া তো আমার ছোটবেলার খেলার সাথী, তাই মনে হলো গিয়ে একবার তার ছেলেকে দেখে আসি।

ধোঁয়া ছুঁয়ে ঘরে ঢুকলাম।
বাচ্চাটির কাছে গিয়ে স্নেহভরা চোখে তাকাতেই,
হঠাৎ চাচি বাচ্চার মুখ ঢেকে দিলেন।
কঠোর গলায় বললেন,
-বিধবা ডিভোর্সি নারী নবজাতকের মুখ দেখতে নেই, জানিস না?

অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম,
-দেখলে কী হয়?
তিনি বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে উত্তর দিলেন,
-বাচ্চার ক্ষতি হয়।

পাশেই শুয়ে ছিল নাদিয়া।
সে মায়ের কথায় একবারও প্রতিবাদ করলো না।
হয়তো ভাবলো, নিজের ছেলের সামনে আমি তার কে?

আমি নিঃশব্দে পেছন ফিরলাম।
বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো,
এই সমাজের হৃদয়ে যেন অদৃশ্য কাঁটা বিঁধে আছে,
যা ভালোবাসা নয়, কেবল ঘৃণা আর কুসংস্কার জন্ম দেয়।
আমার ভেতরে তীব্র বিতৃষ্ণার ঢেউ উঠলো,
এই সমাজ তার চোখের কালোটা হারিয়ে ফেলেছে,
শুধু দেখে, কে বিধবা, কে ডিভোর্সি,
মানুষটা আর দেখে না।

বিকেল নাগাদ গ্রামের প্রতিটি বিধবা ও ডিভোর্সি নারীকে খবর পাঠালাম।
গ্রামের তথাকথিত সভ্য মানুষরা আমার ডাকে সাড়া দেয়নি,
কিন্তু যারা আমার মতো অবহেলিত,
যারা প্রতিদিন সমাজের তির্যক দৃষ্টি সহ্য করে বেঁচে আছে,
তারা একে একে চলে এলো।

আমার ছোট্ট ঘরটিতে তারা মাটিতে গোল হয়ে বসলো।
কারও মুখে লাজুক নীরবতা,
কারও চোখে দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভের ছায়া।

আমি চারপাশে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বললাম,
-এভাবে আর কত?
আমরা যদি চুপচাপ শুধু সহ্য করেই যাই,
তবে এই অন্যায়, এই কুসংস্কার
আজ নয়, শত বছর পরেও একইভাবে বেঁচে থাকবে।
আমাদের মতো অসংখ্য মেয়ের জীবন রাতের অন্ধকারের মতো
নিঃশেষ হয়ে যাবে,
অদেখা, অশ্রুত, অবহেলিত।

আমরা মানুষ, শাপগ্রস্ত ছায়া নই।
আমাদের বুক ফুলিয়ে হাঁটার অধিকার আছে,
মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার আছে।
এখন সময় এসেছে,
আমরা নিজেরাই শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলি,
সমাজকে জানিয়ে দিই,
বিধবা বা ডিভোর্সি কোনো অভিশাপ নয়,
এ আমাদের জীবনের আরেকটি অধ্যায় মাত্র।

এর মধ্যে এক বয়স্কা মহিলা দ্বিধাভরা গলায় বললেন,
-আমাদের এখন কী করা উচিত?

আমি দৃঢ় স্বরে উত্তর দিলাম,
-আমাদের সবার আগে স্বাবলম্বী হতে হবে।
নিজের যোগ্যতায়, নিজের পরিশ্রমে এগিয়ে যেতে হবে,
যেন সমাজের কেউ আমাদের তুচ্ছ করে ফেলে না যেতে পারে।

আরেকজন বললেন,
-কি করবো আমরা? তোমার মতো তো আর সবাই দোকান খুলতে পারবো না।
এক গ্রামে কয়টা দোকানই বা থাকবে!

আমি মৃদু হেসে বললাম,
-দোকান কেন খুলতে হবে?
তোমরা যে কাজে পারদর্শী, সেই কাজটাই ধরো।
যা করতে ভালো পারো, সেটাই তোমার হাতিয়ার হবে।

পাশ থেকে আরেকজন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-আমরা তো তেমন কিছুই পারি না।

আমি এবার গলা উঁচু করে বললাম,
-ভুল! সবার ভেতরেই কিছু না কিছু প্রতিভা লুকিয়ে থাকে।
আমাদের শুধু সেই প্রতিভাকে জাগিয়ে তুলতে হবে।
পারবো না এই কথাটা জীবনে কখনও জায়গা পাবে না।
মনে রেখো আমরা সব পারি, আমাদের সব পারতেই হবে।

কেউই জন্মের সময় হাতে কোনো কাজ নিয়ে আসে না,
প্রতিটি দক্ষতা গড়ে ওঠে সময়ের সাথে, ধৈর্য ও চেষ্টার মাধ্যমে।
আজ যদি আমরা প্রথম পদক্ষেপ নিই,
আগামীকাল পথ নিজেই তৈরি হয়ে যাবে।

আমি চারপাশে সবার মুখের দিকে তাকালাম।
সবার চোখে এক ধরনের ভয়, অনিশ্চয়তা,
কিন্তু তার নিচে লুকিয়ে আছে মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা।

আমি দৃঢ় কণ্ঠে বললাম,
-শোনো, আমরা যদি আজও চুপ করে থাকি,
তাহলে আগামীকাল আমাদের মেয়েরা, নাতনিরা,
ঠিক এই একই অপমানের শিকার হবে।
তাদের জীবনও কেটে যাবে চোখের জল আর মানুষের বিষাক্ত কথার মধ্যে।

আমরা কারো দয়া ভিক্ষা চাই না।
আমরা চাই আমাদের অধিকার, আমাদের সম্মান।
যা হাত বাড়িয়ে কেউ দেবে না,
নিজেদের শক্তিতে কুড়িয়ে আনতে হবে।

তোমরা যে বীজ বুনতে জানো, সেটা দিয়ে শাকসবজি চাষ করো।
যে সেলাই জানো, সেটা দিয়ে কাপড় বানাও।
কেউ যদি মসলা গুঁড়োতে পারে, সেটা বাজারে বেচো।
ছোট হোক বা বড়, প্রতিটি কাজেরই মূল্য আছে।

আমাদের কণ্ঠ চেপে রাখা হবে না আর।
আমরা যে হাসতে জানি, বাঁচতে জানি,
এটা এই সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে।

আজ থেকে আমরা শুধু অবহেলিত নারী নই,
আমরা হবো আমাদের বেঁচে থাকার শক্তি।
আমাদের বুকের ভেতর যে আগুন জ্বলছে,
সেটাই হবে আমাদের পথচলার আলো।

আমি হাত উঁচু করে বললাম,
-কে কে আমার সাথে আছেন?

এক মুহূর্ত নীরবতার পর,
সবাই একসাথে বলে উঠলো,
আমরা আছি!

এদিকে পরদিনই ফাহিমের বিয়ে সম্পন্ন হলো নিভৃতে,
মাত্র চার-পাঁচজন আত্মীয়ের উপস্থিতিতে সাদামাটা আয়োজনে।
তবু সেই ছোট্ট পরিসরেও শাশুড়ি মেঘলাকে
মনে প্রাণে বরণ করে নিলেন,
যেন বহু প্রতীক্ষার পর ঘরে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে।

ঘরে এসে বিয়ের শাড়ি খুলে মুহূর্তেই সেলোয়ার-কামিজ পরে নিল মেঘলা।
শাশুড়ির চোখে খানিক বিস্ময় আর অভ্যাসগত প্রত্যাশা ভেসে উঠলো।
নরম স্বরে বললেন,
-নতুন বউয়েরা শাড়ি পরবে, সেলোয়ার-কামিজ নয় মা।

মেঘলা যেন কথাটা শুনেও না শোনার ভান করলো,
তার চলাফেরায় অদ্ভুত এক স্বাধীনতার ছাপ।

শাশুড়ি পুনরায়, এবার একটু মৃদু অনুনয়ে বললেন,
-বেশি না হলেও মাসখানেক শাড়ি পরে নাও।
প্রতি উত্তরে মেঘলা অবিচল গলায় জানিয়ে দিল,
-আমি শাড়ি পরে অভ্যস্ত নই, মা।

শাশুড়ি এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন,
ঠোঁটের কোণে অদৃশ্য এক দীর্ঘশ্বাস,
মনে হয় বুঝে গেলেন।
এই মেয়েটি তার ঘরে এসেছে বউ হয়ে,
কিন্তু নিজের মতো করেই চলার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে।

বাড়ি ফেরার পথে,
পেছন থেকে এক চাচার তীক্ষ্ণ কণ্ঠ কানে এলো,
-নিজে তো দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসেছো, হুঁ!
নিজের কতটুকু সামর্থ্য, কতটুকু মুরদ আছে,
যে কিনা গ্রামের বাকি মেয়েদের স্বাবলম্বী করার
দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছো?
নিজে পায়ে দাঁড়াতে পারো না,
তারপরও আরেকজনকে স্বপ্ন দেখাও?
মেয়ে মানুষ হয়ে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াও,
নিজের ইজ্জত নিজেই নষ্ট করছো,
সাথে গ্রামের বাকি মেয়ে-বউদেরও নষ্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছো।

তার কণ্ঠে অবজ্ঞা,
চোখে উপহাসের ঝিলিক,
যেন আমি অপরাধী,
শুধু আমার স্বপ্ন দেখার সাহসের জন্য।
চলবে,,,,,,