#কালিনী
#আরেব্বা_চৌধুরী
পর্ব_সংখ্যা ১৫
সকালটা যেন অদ্ভুত এক টানটান উত্তেজনায় ভরপুর।
ইচ্ছে করেই ঘরের বাইরে পা রেখেছে তুরিন,
মাথায় অদৃশ্য মুকুটের মতো জেদ, চোখে নিভে না যাওয়া দীপ্তি।
তাকে দেখেই দাদি যেন আগুন হয়ে উঠলেন,
-অলক্ষী! কতবার বলেছি, ভোরে বাইরে আসবি না, পুরুষ মানুষ রুজিরোজগারে যাবে,
তোর মুখ দেখে যাত্রা করলে কি আর কামে বরকত থাকে?
তুরিনের ঠোঁটের কোণে হালকা বিদ্রূপের রেখা ফুটে উঠলো।
-আমি কি কাউকে যেতে মানা করেছি?
দাদি চোখ কুঁচকে বললেন,
-তোর এই অপয়া মুখ দেখলেই তাদের রিজিক শুকিয়ে যাবে।
তুরিন এবার গলার সুর শক্ত করলো,
-আর কত পড়ে থাকবেন অন্ধকারে?
এখনও কি সময় হয়নি কুসংস্কারের বেড়াজাল ভাঙার?
দাদি ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,
-এত কথা না বলে ঘরে যা!
তুরিন স্থির গলায় উত্তর দিলো,
-আজ ঘরে ফিরবো না। এখানেই থাকবো,
দেখি আজ আমার মুখ দেখে রিজিক উড়ে যায় নাকি বরকত বেড়ে যায়।
দাদির চোখে তীব্র বিদ্বেষ ঝলসে উঠলো,
-তোর ছাড়াছাড়ির পর দেখি মুখে বেশ তেজ জমেছে।
তুরিন কোনো জবাব দিলো না, শুধু ফাওয়াদকে বুকে জড়িয়ে বাড়ির এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে
অটল ভঙ্গিতে পায়চারি করতে লাগলো।
দাদি দাঁত কটমট করে ভেতরে চলে গেলেন,
আর উঠোনে রইলো তুরিনের দৃঢ় পায়ের শব্দ,
যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে পুরো গ্রামকে।
শাশুড়ি ফাহিমকে পাশে নিয়ে শহরের এক অভিজ্ঞ উকিলের দপ্তরে ঢুকলেন।
চোখে একরাশ আশা, ঠোঁটে হিসাবি হাসি,
যেভাবে হোক ফাওয়াদকে নিজের কোলে আনতে হবে।
উকিল চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে ধীরস্বরে বললেন,
-বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে তিন মাসের শিশুকে তার মায়ের কাছ থেকে আলাদা করার কোনো বিধান নেই।
সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগ পর্যন্ত বিশেষত ১৮ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত, তার অভিভাবক হবে মা।
শুধু ব্যতিক্রম ঘটে যদি আদালতে প্রমাণ হয় যে মায়ের কাছে থাকাটা সন্তানের জন্য ক্ষতিকর।
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর সন্তানের নিজস্ব ইচ্ছা অনুযায়ী সে যেখানেই থাকতে চাইবে, থাকতে পারবে।
কথা শুনে শাশুড়ির মুখ গম্ভীর হয়ে এলো।
কিন্তু পরক্ষণেই চেয়ারে হেলে হেসে উঠলেন,
-দেখেন, আইনের কথা তো বুঝলাম, তবে আইনেরও তো নানা ব্যাখ্যা হয়।
যদি ব্যাখ্যাটাকে একটু আমার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়?
তারপর আঁচল সরিয়ে চুপিচুপি টেবিলের উপর মোটা টাকার বান্ডিল ঠেলে দিলেন।
-এই নিন, কষ্টের খরচ ধরা হলো।
আপনি যদি চান, পরের কিস্তি আরও মোটা হবে।
উকিলের মুখে তখনো ভদ্রতার মুখোশ, কিন্তু চোখের ভেতর লোভের ঝিলিক খেলে গেল।
তিনি কাগজপত্র গুছিয়ে রেখে ধীর কণ্ঠে বললেন,
-ঠিক আছে, দেখি, হয়তো এমন একটা পথ বের করা যাবে, যাতে আপনিই সবচেয়ে যোগ্য অভিভাবক হয়ে উঠবেন আদালতের চোখে।
বেরিয়ে আসার সময় শাশুড়ির মুখে আবার সেই আত্মবিশ্বাসী হাসি ফুটে উঠলো,
যেন ফাওয়াদের ছোট্ট হাত ইতিমধ্যেই তার আঁচলে এসে ধরা দিয়েছে।
সকালের রোদটা যেন তুরিনের মনকেও আলোকিত করে তুলেছিল।
আজও গ্রামের সব মেয়ে-বউদের ডেকে একত্র করলো সে মায়ের ঘরের আঙিনা ভরে উঠলো গুঞ্জনে, হাসি-কথায়।
তুরিন কোমল অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
-বলো দেখি, কে কোন কাজে পারদর্শী?
এক এক করে সবাই নিজেদের দক্ষতার কথা জানাতে লাগলো।
কেউ দারুণ সেলাই জানে, কেউ আবার সুচ-সুতা হাতে কাঁথা সেলাইয়ে জাদু আনতে পারে।
কারও হাত বাঁশের কাজে হাতপাখা, ঝুড়ি, ধামা, চালনি, কুলো সবই যেন মায়া মেখে বেরিয়ে আসে তার আঙুলের ছোঁয়ায়।
কেউ বেত দিয়ে ছোট্ট চায়ের ট্রে বানাতে পারে, কেউ রঙিন ঝাড়বাতি গেঁথে তোলে।
অন্য কেউ সুতা দিয়ে রঙ-বেরঙের ফুল ফুটিয়ে তুলতে পারে,
আর কেউ কাপড়ে ফেব্রিকস আর রেশমি সুতায় নকশা কেটে দিতে পারে যেন শিল্পীর ক্যানভাসে তুলির আঁচড়ে।
সব শুনে তুরিনের মুখে এক চিলতে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো।
-ঠিক আছে, যে যা পারে, সে কাজটাই করো।
কাজের ভাগ হয়ে গেল মুহূর্তেই,
চারজন বসলো মেশিনে, কাপড়ের সেলাইয়ের শব্দে ঘরটা মুখর হয়ে উঠলো।
দু’জন কাঁচি হাতে কাপড় কাটায় ব্যস্ত,
দু’জন মগ্ন হাতের কাজে, বাকিরা নিজ নিজ দক্ষতায় তৈরি করছে গ্রাম্য শিল্পের নানা রূপ।
আর তুরিন ফাওয়াদকে কোলে নিয়ে, তার ছোট্ট আঙুলগুলো আলতো করে চেপে ধরে এদিক থেকে ওদিকে ঘুরে ঘুরে তদারকি করছে।
মনে মনে ভাবছে,
এ ঘরটিই হবে স্বপ্নের কারখানা,
যেখানে প্রতিটি সুতা, প্রতিটি বাঁশের ফালি, প্রতিটি সেলাই তাদের জীবনের নতুন অধ্যায়ের গল্প বুনবে।
কেটে গেছে সাতদিন,
মেশিনের গুনগুন ধ্বনি আর হাতের কাজের টুংটাং শব্দে ঘর ভরে থাকলেও, দোকানের তাকগুলো যেন ঠিক সেভাবেই ঠাসা পড়ে আছে।
যে কাপড়, সুতা, আর রঙিন মালামাল এত যত্নে এনেছিল, সেগুলো তেমন বিক্রি হলো না একটা গ্রামে ক্রেতাই বা ক’জন!
দিন শেষে এক-আধটু বিক্রির টাকা হাতে এলেও, তা দিয়ে তো ব্যাংকের কিস্তি মেটানো দূরের কথা, কাজ করা মেয়েদের পারিশ্রমিক দেওয়াও দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মনের ভেতর চাপা অস্থিরতা জমতে লাগলো।
হিসেব করে দেখলো, প্রায় সব টাকাই মালামালের পেছনে আটকে আছে।
আর কিছুদিন পরেই ব্যাংকের লোকজন আসবে, জবাব চাইবে কিস্তির।
একেকবার ভাবছে, এই উদ্যোগ কি তবে ভুল ছিল?
স্বপ্নের পথ বেছে নিয়েও কেন আজ বাস্তবের ভারে হাঁপিয়ে উঠতে হচ্ছে?
ফাওয়াদ তখন শান্ত ঘুমে মগ্ন, তবুও তুরিনের বুকের ভেতর একরাশ দমচাপা কষ্ট জমে রইলো।
জীবনের এই বাঁকে এসে সে প্রথমবারের মতো নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়লো,
এ পথ কি তবে তাকে আলোয় নিয়ে যাবে,
না কি ধীরে ধীরে ঠেলে দেবে অন্ধকারে তা সে ভেবে পায় না।
দুপুর গড়িয়ে রোদ যখন মাথার ওপর এসে থেমেছে,
ঠিক তখনই দরজার সামনে এসে থামলো একটা প্রাইভেট কার।
নামলেন শশুর, শাশুড়ি, ফাহিম আর এক অপরিচিত লোক,
তাদের উপস্থিতি যেন শান্ত দুপুরের বাতাসে হঠাৎ বজ্রপাতের মতো লাগলো তুরিনের মনে।
চোখে অকারণ আশঙ্কা ভেসে উঠলো,
ভদ্রতার গণ্ডি ভেঙে সরাসরি বলেই ফেললো,
-কি চাই আপনাদের?
শাশুড়ি ঠোঁট চেপে, চোখের ইশারায় পাশে দাঁড়ানো মানুষটিকে কিছু বোঝালেন।
লোকটি গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
-আমি অ্যাডভোকেট মাহবুব। উনারা, মানে আপনার শশুর- শাশুড়ি,
তাদের নাতি ফাওয়াদকে নিজেদের কাছে নিতে চান।
তুরিনের কণ্ঠ কঠিন হয়ে উঠলো,
-আমি আমার ছেলেকে দেবো না।
তখন উকিল ব্যাগ থেকে ভাঁজ করা এক কাগজ বের করলেন,
যেন সেটির ভেতরে লুকানো আছে তুরিনের হৃদয়ের ওপর আঘাত হানার অস্ত্র।
তিনি কাগজ খুলে গম্ভীর স্বরে পড়তে শুরু করলেন,
আইনি নোটিশ_
বিষয়: নাতি ফাওয়াদ আহমেদের তত্ত্বাবধান ও হেফাজত সংক্রান্ত।
জনাবা তুরিন আক্তার,
আমরা, ফাওয়াদ আহমেদের পিতামহ-পিতামহী,
আমাদের নাতির শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক উন্নতির জন্য
তাকে আমাদের নিকট অবিলম্বে হস্তান্তরের দাবি জানাচ্ছি।
সন্তানের পিতা ফাহিম আহমেদ বর্তমানে আমাদের অভিভাবকত্বে রয়েছেন, এবং আমরা মনে করি, পিতামাতার বিচ্ছেদের পর
সন্তানের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার পূর্ণ অধিকার আমাদের রয়েছে।
উক্ত দাবী মেনে নিতে ব্যর্থ হলে
আমরা পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করবো।
এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
অ্যাডভোকেট মাহবুব হাসান,
জজ আদালত, ঢাকা।
নোটিশের শেষ শব্দগুলো যেন ঠান্ডা লোহার মতো এসে বিঁধলো তুরিনের বুকে।
তার চোখে মুহূর্তে রাগ আর অপমানের রেখা দেখা দিলো,
কিন্তু ঠোঁট শক্ত করে চেপে রইলো,
সে জানতো, এই লড়াই কেবল কথার নয়,
এটা হবে বুদ্ধি আর সাহসের লড়াই।
তুরিনের বুকের ভেতর যেন অগ্নিগিরির লাভা দাউদাউ করে জ্বলছিল।
চোখের মণি রক্তিম, শ্বাস দ্রুত, আর হাতে ঝলসে উঠলো বটিদার ধারালো ইস্পাত।
এক দৌড়ে ঘর থেকে ফিরে এসে সে দাঁড়িয়ে গেলো দরজার মাঝখানে,
কণ্ঠস্বর বজ্রের মতো কাঁপিয়ে উঠলো চারপাশ।
-আমার ছেলে আমার বুকের ভেতরেই সবচেয়ে সুস্থ, সবচেয়ে নিরাপদে আছে।
এরপরও যদি কেউ এক কদমও এগোয়,
তাহলে তার দেহ থেকে মাথা আলাদা হয়ে যাবে
শপথ আমার মাটির, শপথ আমার সন্তানের!
বাতাস হঠাৎ থমকে গেলো,
দু’এক মুহূর্ত কেউ নড়তেও সাহস করলো না।
শাশুড়ির চোখে ক্ষণিকের আতঙ্ক, ফাহিমের ঠোঁট শুকিয়ে সাদা,
উকিল নিঃশব্দে নোটিশ ভাঁজ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো।
তারপর হঠাৎই তারা সবাই যেন একই সংকেতে নড়লো,
দ্রুত গাড়িতে উঠে, ধুলো উড়িয়ে, শহরের দিকে মিলিয়ে গেলো।
দরজা বন্ধ হতেই তুরিনের হাত কাঁপতে লাগলো,
বটিদাটা ধপ করে পড়ে গেলো মাটিতে।
মুহূর্তেই বুকের ভেতরের আগুন জায়গা করে দিলো এক অদৃশ্য শূন্যতাকে।
তার শ্বাস ভারী, চোখ ঝাপসা, গলা বাঁধা, এ যেন এমন এক লড়াই, যেখানে শত্রু চোখে দেখা যায় না, কিন্তু প্রতিটি মুহূর্তে ঘিরে ধরে।
সে জানতো, আজ তারা পিছু হটেছে,
কিন্তু এই পিছু হটা শুধু সময়ের কৌশল।
একবার যখন ছেলেকে নেওয়ার চেষ্টা করেছে,
তখন তারা থামবে না।
আবারও আসবে, হয়তো আরও বড় খেলায়,
আর তুরিনকে প্রস্তুত থাকতে হবে সেই ঝড় সামলানোর জন্য।
এদিকে দোকানের মালও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। তাই তুরিন পা বাড়ালো বাহারের দোকানের দিকে।
সেদিনের ঘটনার পর থেকে বাহার যেন বদলে গেছে।
আগের মতো ফটর ফটর বা গল্পগুজব নেই,
চুপচাপ মাল তুলে দেয় হাতে, আর আমি টাকা গুনে রাখি তার কাউন্টারে।
আজও টাকা দিলাম, কিন্তু মাল নিতে গিয়ে চেয়ারের কোণে ঢলে পড়লাম ক্লান্ত হয়ে।
বাহার কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলো,
তারপর নিরবতা ভেঙে বললো,
-কী হয়েছে? তোমাকে আজকাল কেমন যেন লাগে, মুখে হাসি নেই, চোখে আলো নেই।
জানি না কেন, তার কণ্ঠে এমন এক নিশ্চিন্ত ভরসা ছিল, যাতে মনে হলো, এই বোঝা একা বইবার দরকার নেই।
হঠাৎ করেই গড়গড় করে সব বলে ফেললাম,
ফাওয়াদের কথা, ব্যবসার টানাপোড়েন,
শশুরবাড়ির হুমকি, কিছুই লুকালাম না তার থেকে।
বাহারের কপালে চিন্তার ভাঁজ গভীর হলো,
কিছুক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর স্বরে বললো,
-শোনো, তুমি এখানকার থানায় গিয়ে একটা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে রাখো।
পরের বার যদি তারা আসে, তখন তোমার হাতে প্রমাণ থাকবে।
কথাটা শুনে তুরিনের বুকের ভেতর অদ্ভুত এক স্থিরতা নেমে এলো।
পরামর্শটা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত মনে হলো,
তাই সেদিনই থানায় গিয়ে মামলা লিখিয়ে রাখলো।
যেন আগামীর যেকোনো আঘাতের জন্য নিজেকে ঢাল বানিয়ে রাখতে পারে।
গোটা রাত তুরিনের চোখে ঘুম নামে না।
শুয়ে থেকেও বুকের ভেতর যেন শিকল বাঁধা ভারী পাথরের চাপ।
একদিকে ব্যবসার বেহাল অবস্থা, বিক্রি নেই বললেই চলে, বাবার দোকানের ও সব তাক প্রায় ফাঁকা।
অন্যদিকে ব্যাংকের কিস্তির বোঝা যেন গলায় ফাঁস হয়ে ঝুলছে।
তার উপর মামলামকদ্দমার খরচও কম নয়,
আইনের দরজায় দাঁড়াতে গেলেও হাজার হাজার টাকা গুনতে হয়।
সব মিলিয়ে তুরিন যেন এক অদৃশ্য ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে,
যেখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা দেখা যায় না।
এরই মধ্যে পরদিন সকালের ডাকবাক্সে আবারও এসে পৌঁছালো আরেকটি আইনি নোটিশ।
এই নোটিশের ভাষা যেন ইস্পাতের মতো ঠান্ডা,
তবুও তার ধার এমন তীক্ষ্ণ যে বুক চিরে ঢুকে যায়।
তাতে স্পষ্টভাবে লেখা।
আইনি নোটিশ_
বিষয়: ফাওয়াদকে তার পিতামহ-পিতামহীর বৈধ অভিভাবকত্বে নেয়ার প্রক্রিয়া।
আমরা, স্বাক্ষরকারীগণ, জানাইতেছি যে উক্ত তুরিন আক্তার, বর্তমানে গ্রাম,,, এর বাসিন্দা,
গত,,,,, তারিখে আমাদের মক্কেল, ফাওয়াদের দাদা ও দাদি, বৈধ অভিভাবকত্ব দাবি করিয়া তাহাকে নিতেই গিয়াছিলেন।
কিন্তু তুরিন আক্তার, উপস্থিত সাক্ষীগণের সম্মুখে,
আমাদের মক্কেলদের প্রাণনাশের হুমকি প্রদান করেন,
এবং হাতে ধারালো বটি দিয়া আক্রমণের চেষ্টা করেন,
যা দণ্ডবিধির ধারা ৩২৩, ৫০৬, ও ৩৫২ এর আওতায় গুরুতর দণ্ডনীয় অপরাধ।
অতএব, এই নোটিশ প্রাপ্তির ৭ (সাত) দিনের মধ্যে আপনার নিকট হইতে লিখিত জবাব প্রদান না করিলে আমরা আদালতের শরণাপন্ন হইতে বাধ্য থাকিব এবং আপনার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করিব।
স্বাক্ষর:
আইনজীবী মাহবুব।
নোটিশের শেষ লাইনে কালি শুকায়নি, অথচ তুরিনের মনে হলো,
এই কালি নয়, তার নিজের রক্ত শুকিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
হাতের কাগজ যেন তার শত্রুর যুদ্ধঘোষণা,
যেখানে প্রতিটি শব্দই বুকে তীরের মতো বিঁধছে।
কেটে গেছে কয়েকদিন,
মামলা-পালটা মামলার দৌড়ঝাঁপে তুরিনের হাতে থাকা শেষ ক’টি টাকাও ঝরে গেছে বালুর মতো।
বুকের ভেতর হাহাকার, চোখে শুধু জলরাশি,
যেন প্রতিটি অশ্রুবিন্দু তার পরাজয়ের সাক্ষী হয়ে ঝরছে।
সে আজ বুঝে গেছে, সামনে কোনো আলোর রেখা নেই,
সব পথ যেন বন্ধ, সব দোর যেন তালাবদ্ধ।
হয়তো এবার সত্যিই ফাওয়াদকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে ওরা।
না আছে টাকা, না আছে ব্যবসা,
আর নেই সেই দৃঢ় মনোবল, যা একসময় ঝড়ের বেগে চলতে শিখিয়েছিলো।
শরীর ভেঙে পড়েছে, মন ক্লান্ত,
মানসিক শান্তি যেন বহু দূরের এক মরীচিকা।
গ্রামের মানুষজনও পিঠ ফেরাতে শুরু করেছে।
কেউ বিদ্রূপের হাসি ছুঁড়ে বলছে,
-যে মেয়ের নিজের পায়ের তলায় মাটি নেই, সে আবার নাকি গ্রামের মেয়ে-বউদের স্বাবলম্বী করবে!
আরেকজন খোঁচা দিচ্ছে,
-তাই তো বলে, অতি বাড় বেড়ো না, ঝড়ে পড়ে যাবে। এতোদিন মুখে খই ফুটছিলো, এখন গিলে ফেলছে কথা!
আজ তুরিনের ঠোঁট সিল হয়ে গেছে।
কোনো জবাব নেই, কোনো প্রতিবাদ নেই,
তার চোখের নীরবতা, কাঁপা নিঃশ্বাসই বলে দিচ্ছে, সে আজ কতটা একা, কতটা অসহায়,
এবং ঠিক কত গভীর এক অন্ধকারের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে।
বাবার দোকানটাও শেষমেশ তালাবদ্ধ হলো,
যা ছিলো সবই মামলার খরচে গিলে খেয়েছে সময় ও কাগজের লাল সিল।
কিন্তু তবু সেই মামলার রায় যেন আকাশের তারার মতো দূরে।
শুধু তারিখের পর তারিখ, আদালতের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তর্ক-বিতর্ক শোনা,
তারপর আবার থেমে যাওয়া,
যেন জীবনের ঘড়ি এক জায়গায় আটকে গেছে।
বাবাও শেষমেশ হাল ছেড়ে দিলেন,
বাধ্য হয়ে ফের পুরনো পেশায় ফিরে গেলেন,
রোদ-বৃষ্টি-ধুলো-ঝড় মাথায় নিয়ে আবারও গাড়ি চালানো শুরু করলেন।
দিনগুলো যেন আবার ফিরে গেছে সেই আগের দুঃসহ দিনে।
অভাব, অনটন, আর নিরন্তর অপেক্ষার অন্ধকারে।
মাঝেমধ্যে তুরিনের মনে হয়,
এভাবে প্রতিদিন হারতে হারতে বেঁচে থাকার চেয়ে, সারাজীবনের জন্য চোখ বুজে চলে যাওয়া হয়তো ভালো ছিলো।
না সমাজ তাকে বাঁচতে দিচ্ছে,
না আইন তাকে সঠিক বিচার দিতে পারছে।
তবু কোথাও এক ক্ষীণ আশার প্রদীপ জ্বলছে,
ভাবছে, হয়তো দু-একটি শুনানিতেই সব মিটে যেতে পারে।
কিন্তু প্রতিটি সমাধান যেন এসে থেমে যায় টাকার কাছে,
টাকা যা তার কাছে এখন মরুভূমিতে বৃষ্টির মতো দুর্লভ।
এমন সময় এক বিকেলে বাহার নিজেই এসে দাঁড়ালো তুরিনের উঠোনে।
দোকান হারানোর পর থেকে আর যাওয়া হয়নি বাহারের দোকানে,
তাই এই হঠাৎ আগমন তুরিনের মনে এক অদ্ভুত কৌতূহল জাগাল। কেন যেন মনে হলো,
বাহারের এই আগমন হয়তো নতুন কোনো খবর, বা হয়তো ভাগ্যের নতুন কোনো মোড়।
❝আইনি বিষয়ে ভুলত্রুটি কিছু লিখলে মার্জনা করবেন। আমার জানায় ভুল থাকতেও পারে এ বিষয়ে আমি এতোটাও দক্ষ নই।❞
চলবে,,,,,