কালিনী পর্ব-১৬

0
1

#কালিনী
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যা ১৬

রমিস মিয়ার সাথে অল্পক্ষণ কথা বলার পর বাহারের দৃষ্টি পড়ল তুরিনের দিকে।
তুরিনের দিকে তাকিয়ে নিমিষেই সে চোখ সরিয়ে নিলো, যেন লুকিয়ে রাখছে কোন গোপন ভোরের আলো।
এক কাপ চায়ের ধোঁয়ায় মিশে থাকা মৃদু আলোয় বসে বসে বাহার বলল,
-আগামীকাল সকালে একবার আমার দোকানে আসবেন তো? কিছু দরকার ছিলো আপনার সাথে।
রমিস মিয়া বিনয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।

বসার ফাঁকে উঠে যাওয়ার সময় বাহার তুরিনের কানে ধীরে বলল,
-চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোমার পাশে আছি।

তুরিনের মনে এক দমে শীতল প্রশান্তির ছোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল,
মনে হলো যেন এই শব্দগুলো কেবল শব্দ নয়,
একটা আশার সুর, এক অন্যরকম শক্তির বার্তা।
তার চোখে অজান্তেই জল জড়ো হলো,
এই কঠিন সময়েও কেউ পাশে নেই,
কিন্তু বাহার যেনো তার জীবনযুদ্ধের এক নতুন আলোকবর্তিকা।

কিছুই নাই-বা দিলেন উনি, তবু কথা বলে যে আশ্বাস দিলেন কতজনই বা এমন করে?
তুরিনের মন থেকে নীরবতাটাই গভীরতর হয়ে উঠল সেই রাতে।
দুঃশ্চিন্তার কুয়াশায় ঢেকে গেলো হৃদয়,
মায়ের ঘরেও সেলাইয়ের সুতা, কাপড় আর অর্ধেক অজানা স্বপ্নের ভার অপেক্ষায় ছিলো বিক্রির।
মনটাকে যেন কোথাও আটকানো গেল না, কোনো শান্তির আশ্রয় মিলল না।

সকালে দেরিতে ঘুম থেকে উঠলেন বাবা,
কারণ বাহারের দোকানে যাওয়ার ব্যস্ততা তাকে জড়িয়ে রেখেছিলো।
সকালে ভোর হতেই পা বাড়ালেন, যদিও বাহারের দোকানে যাবেন বলে আজ গাড়ি চালাতে যান নি।

রমিস মিয়া যখন বাহারের দোকানে পৌঁছালেন, অবাক হয়ে দেখলেন,
ছেলেটা আগেভাগেই সব কিছু সজোরে সাজিয়ে রেখেছে।
ভ্যানে শুধু চারটে বস্তা ছিল, যার ভিতর কি আছে রমিস মিয়া নিজেও জানেন না।
বাহার বললো,
-চাচা, এগুলো নিয়ে যান। আজ থেকে আর গাড়ি চালাবেন না,
দোকানটা নিজের মতো সাজিয়ে নিন।
আবার সব আগের মতো শুরু করুন, কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবেন।

রমিস মিয়ার চোখ ভেজা, শুধু বাহারের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মনে হল, এই ছেলেটা কেন এমন সহৃদয় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল?
মানুষ কি সত্যিই এতো আন্তরিক ও ভালো হতে পারে?
তার মনের গভীরে এক অজানা কৃতজ্ঞতার সুর বাজতে লাগল,
যা ভবিষ্যতের অন্ধকারেও এক ঝলমলে আলো জ্বালিয়ে দিচ্ছিল।

রমিস মিয়া বাড়ি ফিরেই তুরিনকে সব বর্ণনা করলেন,
কিন্তু তুরিন তখন রাগের অগ্নিঝরা শব্দে গর্জন করে উঠল,
-চেনা নেই, জানা নেই, এমন লোক থেকে এসব মাল আনার কী দরকার?
ভ্যান থেকে মাল নামাতেই যেনো মুখ ফেটে গেল তার,
সেই মাল পুনরায় ভ্যানে তুলে নিয়ে বাহারের দোকানের দিকে রওনা দিল।

কিন্তু পৌঁছে দেখল,
বাহারের দোকানের দরজায় তালা ঝুলছে।
তুরিন পাশের দোকানের ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলো,
-এই দোকানের লোকটা কোথায়?
পাশের দোকানের ছেলে বলল,
-কিছুক্ষণ আগে ভাই তো শহরের উদ্দেশ্যে চলে গেছেন।

হতাশ হয়ে ফিরে এলো তুরিন,
মালগুলো এক এক করে খুলে দেখতে লাগল মনোযোগ দিয়ে,
বস্তাগুলো যেনো ছোট ছোট স্বপ্নের আধার,
একেকটি ভরে আছে দোকানের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে,
ডাল, চিনি, মশলা, দুধ, বিস্কুট, চানাচুর সব।

রমিস মিয়া দ্রুত দোকান সাজাতে শুরু করলেন,
প্রতিটি তাক, প্রতিটি র‍্যাক যেনো নতুন প্রাণ পেয়েছে।
দোকানের ভিতর ভরে উঠল প্রাণের আলো,
যেনো ঘর ছেড়ে পালানো স্বপ্নগুলো ফেরত এসেছে।

তুরিনের মনেও অদ্ভুত এক প্রশান্তি ভরে উঠল,
দোকানের দিকে তাকাতে তাকাতে মনে হচ্ছিলো,
একটি ছোট্ট আলোর কিরণ হারিয়ে যাওয়া আশার দরজা খুলে দিয়েছে।
প্রতিটি তাক যেনো তার জীবনের গল্প বলে,
অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার, লড়াই করার ও স্বপ্ন দেখার গল্প।

মালপত্রগুলো আর কেবল বস্তু নয়,
তারা হলো তার সংগ্রামের স্মৃতি,
অসহায়তায় হার না মানার প্রতীক,
আর এক নতুন সূচনা, এক নতুন দিনের সপ্ন।

এই দোকানের আলোকিত কোণে,
তুরিন দেখলো নিজের জীবনের নতুন অধ্যায়,
যা শুধুই কঠোর পরিশ্রম আর আশা দিয়ে লেখা হবে।
আর এই পথেই গড়ে উঠবে তার ও গ্রামান্তের বঞ্চিত নারীদের জীবনের নতুন স্বপ্ন।

গোটা দিন দোকানের ব্যস্ততায় কেটে গেলো তুরিনের।
মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল যেনো এতো কষ্টের ভিড়ে হঠাৎ কেউ এক মুঠো আলো ঢেলে দিয়েছে তার জীবনে, ছোট্ট সেই আলোয় ভরে উঠেছে চারপাশ।

পরদিন ভোরেই মনস্থির করলো, বাহারের দোকানে গিয়ে প্রশ্ন করবে এতো কিছু হঠাৎ কেনো পাঠালো সে?
আবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো, সে তো শহরে, ফিরেছে কি?

ভাবতে ভাবতেই তার চোখ চলে গেলো বাবার দোকানের দিকে।
দেখলো, আগের মতোই দোকানে মানুষের ভিড় কেউ চিনি চাইছে, কেউ লবণ, কেউ আবার গল্পে মেতে আছে।
কথার ফাঁকে বাবার মুখে সেই চিরচেনা হাসি, যেন প্রতিটি ক্রেতাকে নিজের আপনজন মনে করছেন।

অজান্তেই তুরিনের ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি হয়তো কৃতজ্ঞতার, হয়তো অজানা এক টান থেকে জন্ম নেওয়া বাহারের প্রতি শ্রদ্ধা।

বেলা একটা ছুই ছুই, তখনই বাহার এসে উঠোনে উপস্থিত হলো, সাথে আরও চার-পাঁচজন অপরিচিত মানুষ।
হঠাৎ এতো লোক দেখে তুরিনের বুকের ভেতর কেমন যেন ধক করে উঠলো, ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো।
এখানে এভাবে সবাই একসাথে কেন এসেছে মাথায় হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিলো, কিন্তু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলো না।

ভীতু পায়ের ভরসায় ধীরে ধীরে বাহারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো তুরিন। চোখ নামানো, গলায় দ্বিধা জমাট বেঁধে আছে।
বাহার নরম, কিন্তু দৃঢ় স্বরে বললো,
-বেগম রোকেয়া, তোমার হাতের তৈরি জিনিসগুলো উনাদের দেখাও।

তুরিন কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-উনারা কারা?

বাহার মৃদু হাসিতে উত্তর দিলো,
-কাল শহরে গিয়েছিলাম তোমার ব্যবসার জন্য পাইকার খুঁজতে। ভাবছি, এই ব্যবসাটা কেমন করে আরও ভালোভাবে জমিয়ে তোলা যায়।

তুরিন নিঃশব্দে মাথা নেড়ে মায়ের তালাবদ্ধ ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।

বাহার তুরিনকে আর একটুও কথা বলার অবকাশ দিলো না।
নিজেই যেনো উৎসাহী এক প্রদর্শক, ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকটি জিনিস দেখাতে লাগলো যত্নে গড়া হাতের ছোঁয়ায় প্রাণ পাওয়া সব শিল্পকর্ম।
প্রত্যেকটা হাতের কাজেই লুকিয়ে ছিলো কারিগরের মনপ্রাণ, আর তাতে ফুটে উঠছিলো এক অপূর্ব সৌন্দর্যের দীপ্তি।

লোকগুলো যখন একবাক্যে স্বীকার করলো তাদের ভীষণ পছন্দ হয়েছে, তখন বাহারের চোখে যেনো বিজয়ের আলো ঝলমল করে উঠলো।
সে আর দেরি না করে দ্রুত চুক্তির কথায় চলে গেলো, যেনো সুযোগটা হাতছাড়া হওয়ার আগেই আঁকড়ে ধরতে চায়।

লাভ খুব বেশি না হলেও খারাপও নয় কমপক্ষে লোকসানের ভয় নেই।
অবশেষে বাহার শর্ত বেঁধে নিলো আপনারা যা যতগুলো প্রয়োজন, তালিকা তৈরি করে পাঠিয়ে দেবেন, আমরা সেই অনুযায়ী সব তৈরি করে রাখবো।

তুরিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো, একদৃষ্টিতে বাহারের দিকে তাকিয়ে।
তার চোখে বিস্ময়ের সঙ্গে মিশে ছিলো এক অদ্ভুত প্রশংসা যেনো প্রথমবার সে বাহারের এই রূপ দেখছে।
রমিস মিয়া এখনো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে, মুখে অল্প বিস্ময়, হয়তো ভাবছেন এইসব ঘটনার ভেতরে কোথায় যে লুকিয়ে আছে তাদের আগামী দিনের গল্প, তা এখনো তার কাছে ধোঁয়াশা।

সব মাল মুহূর্তেই একটি গাড়িতে উঠানো হলো, আর মায়ের ঘর যেনো খালি হয়ে গেলো এক ঝটকায়।
তুরিনের হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকা তুলে দেওয়া হলো, হাতে ধরতেই যেনো তার মন কাঁপতে লাগলো। এতোগুলো টাকা, নিজের উপার্জিত অর্থ, একসাথে হাতে পাওয়ার অনুভূতি তাকে অদ্ভুত ঘোরে ভাসিয়ে দিলো।

বাহার, রমিস মিয়ার থেকে বিদায় নিয়ে, লোকগুলোকে নিয়ে চলে গেলো।
তুরিন তখনও যেনো বাস্তবতা মেনে নিতে পারছে না, ঘোরের মধ্যে হেটে চলছিলো।

সন্ধ্যার দিকে সে ঠিক করলো একবার বাহারের সঙ্গে দেখা করা উচিত।
উনি কেনো আমাদের এত উপকার করছেন?এই প্রশ্ন মনের গভীরে ঘুরপাক খাচ্ছিলো।

ভর সন্ধ্যায় বাহারের দোকানে প্রবেশ করলো তুরিন।
দোকানেই চোখ আটকে গেলো, অনেক ছোট ছোট বাচ্চা ছেলেরা বসে বসে নানা কাজে ব্যস্ত।
তাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভেতরে ঢুকলো সে।

দৃশ্য আরো বিস্ময়কর হলো বাহারের হাতে একটি পোস্টার।
পোস্টারে লেখা, তুরিনেত নাম, এই দোকানে সেলাই করা হয়, আপনার পছন্দমতো কাপড় কেটে বানানো যায়, কুলো ঢালা, নিজস্ব ছাপা কাপড়সহ নানা জিনিস পাওয়া যায় সুলভ মূল্যে সাথে ঠিকানা।
তুরিন ভ্রু কুঁচকে বললো,
-এসব কি?
বাহার নির্মল চাহনিতে উত্তর দিলো,
-প্রচারণা। আমরা যদি প্রচার না করি, তাহলে লোকেরা জানবে কি করে এখানে কি পাওয়া যায়? তাই এই বাচ্চাদের মাধ্যমে আশপাশের গ্রামে একটু প্রচার করে দিলাম।

-আপনি কেনো এগুলো করছেন?
-আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই, আমি শুধু সেই আগের প্রতিবাদী তুরিনকে দেখতে চাই, এমন মিথ্যে ভয়ে গুটিয়ে নেওয়া তুরিনকে নয়।
তুমি শুধু তুরিন-ই নয়, তুমি শত নারীর অনুপ্রেরণা তাদেরও অন্ধকার থেকে বের করে আনো।

তুরিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-বাবার দোকানে কত টাকার মাল দিয়েছেন?
বাহার বললো,
-বলবো?
-বলার জন্যই তো প্রশ্ন করলাম।
-পঞ্চাশ হাজার।
-ঠিক আছে, কাল এসে টাকা ফেরত দেবো?
-একদম নয়, ওই টাকা অযথা খরচ করা যাবে না। আমি লোকগুলোকে কথা দিয়ে দিয়েছি, তারা তাদের পছন্দমতো জিনিস তৈরি করাবে তোমাকে দিয়ে। তাতে অনেক টাকা লাগবে, আমি চাই ওই টাকা দিয়ে তোমার দোকানের যাবতীয় জিনিস কেনো, আর হ্যাঁ, কাল দোকানে সাইনবোর্ডও লাগাবো পাইকারী দোকান হিসেবে।

শেষ কথাটুকু বলার সময় বাহার চোখ টিপ দিলো, আর তুরিন তৎক্ষণাৎ নিজের চোখ নামিয়ে নিলো মনে হলো, এ চোখ-মুখের বিনিময়ে তার অদ্ভুত একটি ভরসা ও শান্তি মিলল।

তুরিন যখন বাড়ি ফিরছিলো তখন পেছন থেকে একজন ঠোঁট বেঁধে বলল,
-দেখ বাঘিনী, এখন কেমন ভেজা বেড়াল হয়ে গেছে।

আরেকজন ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপে হেসে বলল,
-একে তো কালো রূপের নাই সুরত, তার মধ্যে কথার ঝাঁজ মাগো মা! এই মেয়ের রূপ থাকলে যে কি হতো।

একজন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-ভাগ্যিস এর রূপ নেই, থাকলে তো মাটিতে পা পড়তো না। নিজেই ঠিক মতো দাঁড়াতে পারে না, আবার বাকিদের নাকি অন্ধকার থেকে বের করবে!

এই কটু কথাগুলো তুরিনের কানে যেন ছুরি মেরে গেল। প্রতিটি বাক্য হৃদয়ে বিষ ঢেলে দিচ্ছিলো। মুখে কিছু বলার সামর্থ্য ছিলো না, শুধু চোখ নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো। তবু ভেতরে, হৃৎপিণ্ডের গভীরে উদিত হলো এক অগ্নি নিজের মূল্য, নিজের সংগ্রাম, নিজের লক্ষ্যকে কেউ কেবলমাত্র কথার খেলা দিয়ে স্তব্ধ করতে পারবে না।

তুরিন মনে মনে বলল, তোমরা যা বলছো, যা ভাবছো, তা আমাকে থামাতে পারবে না। আমি আমার পথে যাবো, ধীরে ধীরে, দৃঢ়তা নিয়ে, নিজের ছন্দে। তোমাদের কুৎসিত কথা আমাকে দমিয়ে রাখতে পারবে না।

পরের দিন সকালে তুরিন আবারও ডিভোর্সি ও বিধবা মহিলাদের একত্রিত করলো। ধীরে ধীরে তারা প্রত্যেকেই বুঝতে লাগলো, আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াবো, আর পেছন ফেরা নয়।
আমাদের হাতেই এখন ক্ষমতা আছে নিজেদের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার। তুরিন তাদের হাতে কাজ ধরালো কারো হাতে সেলাই মেশিন, কারো হাতে কাপড় কাটার সরঞ্জাম, কারো হাতে হাতের কাজ, কাঁথা সেলাই, বেতের ঝুড়ি ও বাঁশের ছোটখাটো বাসন।

এই সময় কোর্টের তারিখ আসলো, কিন্তু তুরিন মনোযোগী থাকলো তাদের জীবনের পুনর্গঠনে। প্রতিটি দিন যেনো নতুন আশা, নতুন উদ্যমে ভরে ওঠে। বাজারের ব্যস্ততা, সেলাইয়ের শব্দ, হাতে তৈরি জিনিসপত্রের গন্ধ সবই তার মনকে প্রফুল্লতা ও সন্তুষ্টিতে ভরে তুললো।

বাহার নিজেই হাতে হাত মিলিয়ে তুরিনের সঙ্গে দোকানের সমস্ত কেনা-কাটার কাজ সম্পন্ন করলো। ফাঁকে ফাঁকে তুরিন লক্ষ্য করলো, কিছু কিছু জিনিসের জন্য বাহার নিজের পকেট থেকে অর্থ দিয়েছে কোনো অভিযোগ বা অজুহাত ছাড়াই।

তুরিন একটু হেসে আপত্তি করলো,
-আপনি নিজের থেকে দেন কেনো?
বাহার কোমল ও স্থির কণ্ঠে বললেন,
-যখন তোমার দোকান স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে যাবে, তখন প্রতিটি টাকা গুনে গুনে আমাকে দেবে। আমি শুধু চাই সবার আগে দোকানটা ঠিকভাবে হোক, দোকান একবার দাঁড়িয়ে গেলে এক টাকার ও ছাড় নেই, তাই এখন থেকে হিসেবও লিখে রাখছি।

তুরিন শুধুই তাকিয়ে রইলো, চোখে অব্যক্ত বিস্ময়। ভেতরে এক অদ্ভুত উত্তাপ জন্ম নিলো কীভাবে একজন মানুষ এত ভালো হতে পারে, সবসময় হাসিখুশি থেকে অন্যের জন্য নিজেকে এতটা বিলিয়ে দিতে পারে। এমন দয়া, এমন উদারতা, এমন ধৈর্য এই মানুষটির প্রতি তুরিনের হৃদয়ে জন্ম নিলো গভীর শ্রদ্ধা ও অশেষ কৃতজ্ঞতা।

এক মুহূর্ত থেমে দাঁড়িয়ে ভাবলো, আমার এই ছোট ছোট স্বপ্নের দোকানটা যদি এমন একজন মানুষের সাহায্যে এগিয়ে যায়, তবে আমার জন্য সবই সম্ভব, অসম্ভব কিছু নেই।
তুরিনের হৃদয়ে ধীরে ধীরে গড়ে উঠল এক নতুন আশা, এক নতুন দৃঢ়তা, যা আগের সকল হতাশাকে পিছনে ফেলে দিয়ে এক উজ্জ্বল ভোরের পথে নিয়ে যাবে।

এদিকে এক মাসের মতো ফাহিমের বোন ইফা বাবার বাড়িতে অবস্থান করছে।

শাশুড়ী মেয়ের মাথায় তেল দিতে দিতে বারবার বোঝাচ্ছেন,
-শাশুড়ির থেকে সংসার নিজের মুঠোয় আনতে শিখ। তোর সংসার তোকে বুঝতে হবে মা। জামাই আর সংসার এই দুটো জিনিস সবসময় নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়, নাহলে কে কখন কী চুরি করে বা বুঝিয়ে নেয়, তা কেউ জানে না। তোর সংসারের ভালো-মন্দ তুই নিজেই অনুভব করবি, তোর শাশুড়ি না।
নিজেরটা নিজে বুঝে নিতে শিখ, ভালো শাশুড়ী না হলে, আগে জামাইকে নিজের কব্জায় আনা জরুরি। আর কত বলবো তোকে!

কথার মাঝখানে মেঘলা ভেতরে ঢুকে বললো,
-হ্যাঁ মা, সত্যিই বলেছেন। বিয়ের পর সংসার বউদের এখানে শাশুড়িদের মাথা খাটানো একদমই মানায় না। বুড়ো বয়সে তারা হয়তো ভালো-মন্দ বুঝবে না। আপনারও তো বয়স হয়েছে, আপনিও নিশ্চয়ই সংসার জীবন থেকে কিছুটা অবসর নিতে চান, আমার কিন্তু কোনো আপত্তি নেই।
আমিও মনে করি আপনি এবার সব কিছু থেকে অবসর নিয়ে শুয়ে বসে দিন কাটান, আর কত বউয়ের পেছনে খবরদারী করবেন।

শাশুড়ীর চোখে তখন রাগ।
মেঘলা তাও থামলো না,
-আমার কপালটাই খারাপ। সব জামাই তো আর ইফার জামাইয়ের মতো নয়। আমার জামাইকে তো কব্জা করতেই পারি না। কি জানি, ঘরের লোকজন কি কোনো জাদুটাদু করে রেখেছে কিনা, নাহলে কি এমন মা-ভক্ত ছেলেও সম্ভব? আমারই দোষ, আপনাদের মিষ্টি মিষ্টি কথা আর জামাই সাহেবের সুন্দর চেহারা দেখে ভুল ভেবে বসেছিলাম। মনে হয়েছিলো আগের বউয়ের সব দোষ ছিলো, কিন্তু এখন তো দেখি, দোষ উনি ঘরে রেখে বাইরে সাঁতরে বেড়াচ্ছেন।

চলবে,,,,,