কালিনী পর্ব-১৭

0
1

#কালিনী
#আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যা ১৭

ফাওয়াদের বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল বাহার।
মনে হলো এই মামলার তো কিছু একটা হওয়া দরকার, নইলে ধুলো জমে যাবে ফাইলের পাতায়।
তারওপর মেয়ে মানুষ হয়ে তুরিন একা একা কত আর দৌড়ঝাঁপ করবে!

পরদিন সকালেই তুরিনকে ডেকে বসল বাহার।
গভীর সুরে বলল, এই উকিল আর রাখা যাবে না, ইনি কেসের এক ইঞ্চিও এগোচ্ছেন না।
তুরিন দ্বিধায় ভরা চোখে বাহারের দিকে তাকাল, যেন কিছু বলতে চাইছে আবার চুপ করে যাচ্ছে।
বাহার তুরিনের মুখের অল্প হাসি, অল্প দুশ্চিন্তা মেশানো ভাব দেখে বুঝে নিল সবটাই টাকার ঝামেলা।
তুরিন কাচুমাচু গলায় বলল, উকিল বদলাতে গেলেও তো নতুন করে টাকা লাগবে।

বাহার মুচকি হেসে সোজাসাপ্টা বলল,
-আমি আছি।

কথাটুকু যেনো তুরিনের ভেতরকার ভার এক নিমিষে হালকা করে দিল।
বাহার আর সময় নিলো না, তুরিন কে বিদায় জানিয়ে সেদিনই বাহার নিজে অন্য এক উকিলের সাথে কথা বলে নিল, সব শর্ত মেনে কাজের প্রতিশ্রুতি আদায় করল।
নির্ধারিত কোর্টের তারিখে দুজন একসাথে হাজির হলো।
টাকা না দিলে কেস আদালতে উঠবেই না এই নিয়মে বিরক্ত হলেও বাহার পকেট থেকে কয়েক হাজার টাকা বের করে উকিলের হাতে দিলো, যেন আর কোনো অজুহাত না থাকে।

সেই মুহূর্তে তুরিনের মনে হলো, বাহার কেবল একজন সহপথিক নয়, বরং কঠিন সময়ে দাঁড়াবার সাহসী অবলম্বন।
কোর্টের করিডোরে কাগজপত্রের গন্ধ, মানুষের গুঞ্জন, আর আদালতের কাঠের হাতুড়ির শব্দে মিলেমিশে যেন এক অদৃশ্য উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল,
আজ হয়তো সত্যিই মামলার প্রথম শোনানি শুরু হবে।

দূর থেকে তুরিনকে দেখে এগিয়ে এলেন শাশুড়ি।
তুরিনের পাশ দিয়ে যেতে যেতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বললেন,
-আজকাল মেয়েদের ছাড়াছাড়ি হবার বছর দিন ও যায় না, চৌদ্দ পুরুষ নিয়ে ঘুরতে শুরু করে, সবই চরিত্রের দোষ।

বাহার মুহূর্তেই নিজের মাথা নিচু করে ফেললো,
চোখেমুখে অপরাধবোধের এক ফিকে ছায়া নেমে এলো।
চারপাশ যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলো,
শুধু বাতাসের হালকা শোঁ শোঁ শব্দে বোঝা যাচ্ছিল,
অদৃশ্য এক অস্বস্তি তাদের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে।

তুরিনের চোখে ঝিলিক খেলো অদ্ভুত এক দৃঢ়তা।
ঠোঁটের কোণে স্নিগ্ধ অথচ ব্যঙ্গ মিশ্রিত হাসি এনে
সে ধীর কণ্ঠে বলল,
-চরিত্রের রায় দেওয়ার আগে আয়নায় একবার নিজের মুখটা দেখা ভালো, মা।
মানুষের ভাগ্য আল্লাহ্‌ লেখেন, আর অপবাদ মানুষ।
তফাৎ শুধু এটাই আল্লাহ্‌র লেখা মুছে যায় না,
কিন্তু মানুষের লেখা অপবাদ সময়ের স্রোতে নিজেই ধুয়ে যায়।

শাশুড়ির মুখে হালকা বিরক্তি খেলে গেলো,
কিন্তু তুরিনের চোখের দৃঢ়তা তাকে থামিয়ে দিলো।
বাহার, একপাশে দাঁড়িয়ে,
মনে মনে বুঝতে পারলো কথা যতই ধারালো হোক,
সত্যের সামনে তার আঘাত টিকতে পারে না।

অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। কোর্টের কাঠগড়া পেরিয়ে রায় ঘোষিত হলো, সন্তানের অভিভাবকত্ব থাকবে তার মায়ের কাছেই। বিচারক স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করলেন, সন্তানের লালনপালন ও মানসিক বিকাশে মাতৃস্নেহই সবচেয়ে বড় অধিকার, আর আইনের দৃষ্টিতে তা কেড়ে নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত কারণ প্রমাণিত হয়নি।

রায় শোনামাত্র বাহার ও তুরিনের চোখেমুখে ফুটে উঠল রাজ্যজয়ের উজ্জ্বল হাসি। ছোট্ট ফাওয়াদ এবার মায়ের হাত শক্ত করে ধরে নতুন করে আশ্রয়ের নিরাপত্তা পাবে।

কিন্তু বিপরীতে শাশুড়ির চোখে জ্বলজ্বল করছিল দমিত ক্ষোভ, ঠোঁট কামড়ে তিনি ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছিলেন। সেই সুযোগে তুরিন ঠাণ্ডা গলায়, অথচ কাঁটার মতো বিঁধে যায় এমন স্বরে বলল,

– মা, সন্তানের জন্য আইনও আজ বুঝে গেল, কে তাকে সত্যি ভালোবাসতে পারে। অন্যায় দিয়ে যা ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলেন, তা তো অবশেষে ন্যায়ের হাতেই ফিরে এলো।

শাশুড়ি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন, যেন শব্দগুলো গলায় আটকে গেছে। আদালত কক্ষের বাতাসে তখন নীরব বিজয়ের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে, আর তুরিনের চোখে সেই নীরবতায় ঝিলিক দিচ্ছিল আত্মসম্মান আর অটল দৃঢ়তায়।

আজ তুরিনের সুখের শেষ নেই যেনো এক জীবনে তার সমস্ত স্বপ্ন, সমস্ত চাওয়া পূর্ণ হয়ে গেছে আজকের দিনে।
পথে হাঁটতে হাঁটতে তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছিলো এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা, আর সে আনন্দের ঢেউয়ে ভেসে ছুটে চললো বাড়ির দিকে।
পেছন পেছন ধীর পায়ে বাহারও হাঁটছিলো, মনে মনে তুরিনের এই আনন্দের ভাগীদার হয়ে।

বাড়ি ফিরেই তুরিন নিজ হাতে মন দিয়ে কষিয়ে মাংস রান্না করলো।
বাহারকে কোনো মতেই যেতে দিলো না তার এক কথা, আজকে না খেয়ে কেউ বাড়ি যাবে না।
বাহারও জোর করে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলো না, কারণ তার নিজেরও মন চাইছিলো তুরিনের হাতের রান্নার স্বাদ নিতে।

বাহার দিনের পর দিন দ্বিধার এক অদ্ভুত কারাগারে আটকে আছে।
শরম ভেঙে বার দু-এক মুখ খুলেতে চেয়েছে, বলতে চেয়েছে সে তুরিনকে বিয়ে করতে চায়।
কিন্তু প্রতিবারই কথাগুলো বুকের ভেতরে গিলে ফেলেছে।
যদি তুরিন রাজি না হয়?
যদি রাগে মুখ ফিরিয়ে নেয়?
যদি অভিমান করে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় তখন?
এই আশঙ্কাগুলো তাকে পা বাড়াতেই দেয় না।

খাওয়া শেষ হলে বাহার আয়নার সামনে দাঁড়াল।
নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে প্রশ্ন করলো,
আমি কি দেখতে এতোটাই খারাপ?
প্রশ্নটা বাতাসে মিলিয়ে গেলো, উত্তর খুঁজে পেলো না সে।

রাত ঘনিয়ে এলে বাহার বাড়ি ফিরলো।
দরজার দোরগোড়ায় পা রাখতেই বাবা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন,
-আজকাল দোকানে তোকে তেমন দেখা যায় না, কই থাকিস রে?
এতো বড় একটা দোকান কি এভাবে কর্মচারীর হাতে ফেলে রাখা যায়?

বাহার চুপ করে রইলো, চোখ নামিয়ে রাখলো।
মা পাশ থেকে বললেন,
-খেয়ে রুমে যা।
বাহার ছোট করে উত্তর দিলো,
-আমি খেয়ে এসেছি।

তারপর নিঃশব্দে নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।
বাহিরে চাঁদের আলো নেমেছে, কিন্তু তার মনটা রয়ে গেছে নিভু-নিভু প্রদীপের মতো, আলো থাকলেও উষ্ণতা নেই।

পরের দিন সকাল গড়াতেই গোটা গ্রাম জুড়ে বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগলো কানাঘুষার গুঞ্জন। যেন কাকের ডাকে খবর ছড়িয়ে পড়েছে তুরিনের ঘরে নাকি রাতের আধারে বাজারের বড় ব্যবসায়ী ঢুকেছিল।

-রাত-বিরেতে এক ছেলে আর এক মেয়ে একই ঘরে থাকলে তার মানে কী, সেটা আর আলাদা করে বলার দরকার আছে?
-তাই তো বলি, মেয়েটার এতো গলার জোর এলো কোথা থেকে! এখন বুঝি জোরটা ওই পথেই আসে।
-বলি হারি, ওই ছেলেটা আবার কী দেখে এর প্রেমে মজলো?
-আরে বাবা, ছেলে মানুষ বলে কথা, সে কি বিয়ে করতে এসেছে নাকি? এসেছে থাকতে, মৌমাছি যেমন ফুলে বসে মধু খায়, তেমনি মধু শেষ হলে মৌমাছি উড়াল দেবে।
-এইসব ডিভোর্সী আর বিধবার ঘরেই তো থাকে ‘আঠারো জামাই’, দিন গেলে জামাইও বদলায়, কথা বদলায়, আর ইজ্জতও গলে যায়।
-আবার শোনা যাচ্ছে, রাতে ঘরের বাতি অনেকক্ষণ নিভছিল না, এও নাকি ভালো লক্ষণ নয়।
-ওই বয়সী মেয়েদের নাকি একা রাখা ঠিক না, নইলে ঘরে আগুন ধরে।
হায় হায়, আজকালকার মেয়েরা যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে গোপনে সব খেলা জমিয়ে রাখে।
– শালীনতার মুখোশ পরে ভেতরে ভেতরে আগুন জ্বালায়, আবার বাইরে এসে সাধ্বীর মত চোখ নামিয়ে কথা বলে।
– রাতের আঁধারে কারা কারা যে আসে, কাকও জানে না, শুধু কাকের ডাক শোনা যায়।
-ঢেকে রাখলেই কি হয়, কাদা চাপা দিলেও গন্ধ কিন্তু বের হবেই।
-মুখে ধর্মের বুলি, মনে বিষের গুলি,
ওই মেয়ে যে গ্রামের জন্য কলঙ্ক, তা বুঝতে কারো বাকি নেই।

এইসব কুৎসা, কুসংস্কার আর নোংরা মন্তব্যে গ্রামের আকাশ ভারী হয়ে উঠলো। কেউ মুখে সরাসরি কিছু না বললেও চোখের ভাষা, ঠোঁটের বাঁক, আর ফিসফিসের শব্দ সব মিলিয়ে তুরিনের চারপাশে যেন অদৃশ্য কাঁটাতারের বেড়া তুলে দিল।

বাতাসে ভেসে আসা প্রতিটি শব্দ যেন তুরিনের কানের পর্দায় নয়, হৃদয়ের গভীরে আঘাত হানছিল।
সকালের নরম আলোও আজ তার চোখে ঝলসে উঠলো, কারণ এই আলোও যেন গ্রাম জুড়ে ছড়ানো কুৎসার সাক্ষী।
অকারণেই রাগ জমে উঠলো বাহারের ওপর যেন সমস্ত অপমানের দায় একাই সেই বয়ে বেড়াচ্ছে।

ক্ষোভে পা চালিয়ে বাহারের দোকানের দিকে ছুটে গেল তুরিন।
দোকান ফাঁকা, বাহার নেই।
ধপ করে বসে পড়লো ডানপাশের পুরনো বেঞ্চটায় যেন এই কাঠও বুঝতে পারছে তার ভেতরের ক্ষরণ।

অল্প কিছুক্ষণ পর বাহার ফিরলো, মুখে স্বভাবসুলভ হাসি।
মজার সুরে বললো,
-সূর্য কোন দিকে উঠলো? সকাল সকাল বেগম রোকেয়ার পায়ের ছাপ আমার দোকানে যে!

কিন্তু আজ সেই রসিকতায় তুরিনের ঠোঁটের কোণ একটুও নড়লো না।
ঠাণ্ডা, রাগান্বিত স্বরে বললো,
-আপনি একটু আড়ালে আসুন, আপনার সাথে কিছু কথা আছে।

দুজন দোকান থেকে কিছুটা দূরে সরে গেল।
তুরিনের চোখে চিকচিক করছে জমে থাকা অশ্রু, গলায় থরথর কম্পন।
-দেখুন, আপনি আমার জন্য যা করেছেন, তার ঋণ শোধ করা সম্ভব না, তবুও আপনার পেছনে যত টাকা খরচ হয়েছে, আমি যত তাড়াতাড়ি পারি গুণে গুণে ফেরত দেবো।
শুধু একটাই অনুরোধ আপনি আর কখনো আমাকে সাহায্য করতে আসবেন না, আমার কাছাকাছি থাকবেন না।
আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দিন, মুখ তুলে সমাজে হাঁটতে দিন।

কথার ভেতর হঠাৎই এক দমকা শ্বাসের মতো বেদনা মিশে গেল,
-আমার তো রূপ নেই, গুণ নেই, অর্থ নেই, শুধু এই চরিত্রটাই আছে আমার শেষ সম্বল। যদি এটাও হারিয়ে ফেলি, তাহলে আমার বেঁচে থাকা আর মৃত্যুর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না।
একটা মেয়ের চরিত্র এটাই তার অমূল্য ধন, বাকি সবই ক্ষণস্থায়ী।

বাহার চুপ করে তাকিয়ে আছে, ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
-কে কি বলছে আমাকে বলো?
তুরিন যেন নিজের বুকে জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস ঝেড়ে বললো,
-গ্রাম জুড়ে আপনাকে জড়িয়ে আমার নাম নিয়ে বিষ ছড়ানো হচ্ছে।
এই সমাজ ডিভোর্সি আর বিধবাদের চোখে দেখে না, যেন আমরা মানুষ নই, যেন আমাদের ইজ্জতের কোনো দাম নেই।
আমাদের প্রতি আঙুল তুলতে কারো হাত কাঁপে না, বরং আনন্দ পায়।

এই বলে তুরিন মুখ ফিরিয়ে নিল, আর বাহারের নীরবতা সেই মুহূর্তে অনেক বড় এক উত্তর হয়ে রইলো।

তুরিন উল্টো দিকে ঘুরে হাটা দিলো, পেছনে বাতাসে যেনো আরও তীব্র হয়ে উঠলো।

পিছন থেকে বাহারের কণ্ঠনাদ ভেসে এলো, কোমল, অতি স্নিগ্ধ,

-আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।

তুরিনের পা অচেতনভাবে থেমে গেলো, মনে হলো হৃদয়ও তার সঙ্গে থেমে গেছে।

-আপনি আমাদের জন্য অনেক করেছেন, কিন্তু আর না, আমি আমার ছেলেকে নিয়েই বাঁচতে চাই। আমার আর কারো প্রয়োজন নেই, আমার জীবন আমার সিদ্ধান্তের অধীনে।

হাওয়ার সাথে মিশে তুরিনের গলায় ভেসে এলো এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, যা কেবল তার বেঁচে থাকার ইচ্ছা নয়, তার চরিত্রের অটলতায় ভরা।
বাহার একটি মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, তার চোখে মিশে রয়ে গেলো প্রশান্তি আর অনুরাগের মিলিত ছায়া, জানে, এই নারী শুধু বেঁচে থাকার জন্য নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষণে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ে যাচ্ছে।

তুরিন কয়েক ধাপ এগিয়ে মাথা উঁচু রেখে, মনে মনে বললো,
-আমার সন্তান, আমার চরিত্র, আমার স্বাধীনতা, আমার মর্যাদা, এগুলোই আমার জীবনের অমূল্য রত্ন।

এদিকে সংসারের অশান্তি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, মেঘলা ও শাশুড়ির মধ্যে আভ্যন্তরীণ উত্তেজনা হাতাহাতিতে রূপ নিলো। ফাহিম দুজনের মধ্যে লাফিয়ে পড়লো, মেঘলাকে সামলাতে গিয়ে হালকা থাপ্পড় দিলো, যেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চায়।

রাগের জ্বালায় মেঘলা দরজা বন্ধ করে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলো।
শাশুড়ির ক্ষিপ্ত সুরে বাইরে থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে,
– মর মর, মরে যা, আমাদের মুক্তি দে।

পরক্ষণেই মেঘলার হাত থেমে গেলো। মনে হলো, নিজের রাগ আর আতঙ্ককে শান্ত করতে হবে। সে ভাবলো, আমি মরে গেলেও তাদের কোনো ক্ষতি হবে না। বরং এই মায়ের আঁচল ধরা ছেলে পুনরায় বিয়ে করবে, সংসার ঠিকই চলবে। অবশেষে সে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালো, চোখে ধীরে ধীরে সংযমের ছায়া।

গোটা দিন স্বাভাবিক কাটলেও, ফাহিমের সাথে কোনো কথাবার্তা হয়নি। মেঘলা জানে, রাতের আঁধারে ফাহিম তার কাছে ক্ষমা চাইতে আসবে এমন দৃশ্য যা নতুন নয়, বরাবরই এভাবে হয়ে আসছে।

মেঘলা বুঝতে পারলো, ফাহিম তাকে ভালোবাসে কিন্তু মায়ের মুখের উপর কথা বলার সাহস নেই তার। অতিরিক্ত মা ভক্ত ছেলে হোক বা মেয়ে , এরা সংসার জীবনে সত্যিকারের সুখী হতে পারে না। পুরুষ হলো সেই, যে মা ও বউ দুই দিকই সামলে নিতে পারে। কিন্তু এই ফাহিম! সে মায়ের সামনে বউয়ের পক্ষে কোনো কথাই বলবে না, মা অন্যায় করলেও তার চোখে মা সঠিকই থাকবেন।

মেঘলা নিজেকে মনে মনে বললো, “আমি হয়তো সবকিছু একাই সামলে নিতে পারব, কিন্তু এভাবে কেউ কেউ মা ও বউ দুই দিকের ভার একত্রে বোঝা কখনো শিখবে না। আমার জন্য এই জীবনই চূড়ান্ত পরীক্ষা।”

কেটে গেছে কয়েক দিন, এবং এই কয়েকদিনের মধ্যে বাহার ও তুরিন একবারের জন্যও একে অপরের চোখের সঙ্গে চোখ মেলাতে পারেনি। তবুও সমাজের গুঞ্জন থেমে নেই, আজও তুরিনের নামে সেই মিথ্যা অভিযোগ জোরেশোরে ঘুরছে। কেউ কেউ মিথ্যা সাক্ষী পর্যন্ত দাঁড়িয়েছে, বলছে তুরিনের ঘরে পরপুরুষ ঢুকে গেছে। যেন গোটা গ্রাম ইচ্ছাকৃতভাবে তার বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে বসেছে।

তুরিন সারাদিন তার দোকানঘরে লুকিয়ে থাকে। বাইরে বের হওয়ার সাহসই হয় না, তবু মানুষের কটু কথা, ছেঁচড়া মন্তব্য তার কানে ভেসে আসে, মন চেপে ধরে।
আজ কথার এক মুহূর্তে সে ক্ষুব্ধ কন্ঠে ভাবিকে বলল,
-এই সমাজে শিক্ষার অভাব, ভাবি। শিক্ষার অভাবে আজ গ্রামের মানুষ এত স্বল্পচেতা। যদি বইয়ের দুটোও পাতা পড়ত, তবে এসব কুসংস্কার, মিথ্যা আর গুজবের জাল বোনা হত না।

ভাবি হালকা সস্মিত মুখে উত্তর দিলেন,
-সমাজের কথা পরে ভেবো, তুমি আগে নিজের চরিত্র ঠিক রাখো।
-আপনার চরিত্র ঠিক আছে তো ভাবি? আপনার চরিত্র ঠিক থাকলেই চলবে, আমাকে নিয়ে বেশি চিন্তা করার দরকার নেই।

তুরিন চুপচাপ কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল, তারপর মনে মনে ভাবলো, যতই সমাজে কুপ্রচলিত কথা ছড়াক, যতই মানুষ আমার ওপর কু-চোখ রাখুক, আমার চরিত্র, আমার নৈতিকতা আমার অমূল্য সম্পদ। আর এই সম্পদকে কেউ নষ্ট করতে পারবে না।

এখন আর প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে বা দোকানের মাল আনতে তুরিন নিজে বাজারে বের হয় না, তার বাবা গিয়ে সব দেখাশোনা করে। সেই বাজার থেকেই বাহার নিয়মিত তুরিন ও ছোট ফাওয়াদের খোঁজ খবর রাখে, জিজ্ঞেস করে, তারা ঠিক আছে কি নেই।

কিছুদিনের মধ্যেই তুরিনের দোকানটি বড় আকার ধারণ করতে থাকে। শহরের পাইকারেরা আসে, মালামাল ক্রয় করে, টাকা দিয়ে যায় এবং প্রয়োজনীয় কাজের লিস্টও সরবরাহ করে। এখন আর শুধু বিধবা বা ডিভোর্সি মহিলারাই কাজ করে না, অনেকেই এখানে যুক্ত হয়েছে যারা দক্ষ, প্রেরণাদায়ক এবং প্রতিশ্রুতিশীল।

তুরিনের এই অগ্রগতি দেখে অনেকে হিংসা ও ঈর্ষার আগুনে পুড়ছে। ইচ্ছাকৃতভাবে তারা নানান অভিযোগ, নোংরা গুঞ্জন ছড়িয়ে দেয়। তুরিনের উপরে কেবল সমাজ নয়, পুরোনো রীতিনীতি ও কুপ্রচলিত মানসিকতাও চাপিয়ে দিতে চায়।

কিন্তু তুরিন নিরব, দৃঢ়চেতা ও আত্মনির্ভর। সে জানে সে ব্যবসা করে টাকা কামায়, নষ্টামি করে নয়। তার প্রতিটি ধাপে কাজের নৈতিকতা, নিজের চরিত্রের মর্যাদা এবং বাচ্চার নিরাপত্তা সর্বাগ্রে। সমাজ যতই চিৎকার করুক, গুজব ছড়াক, তুরিনের চোখে শুধুই একটিই লক্ষ্য নিজের ও পরিবারের স্বাবলম্বিতা ও সম্মান বজায় রাখা।
চলবে।