কালিনী পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
3

#কালিনী
আরেব্বা_চৌধুরী
#পর্ব_সংখ্যা ২০ (অন্তিম পর্ব)

খানেক পর বাড়ির পরিবেশ যেনো একটু স্তিমিত হলো, কিন্তু সেই স্তিমিততায় ছিলো অশান্তির গাঢ় ছায়া।
মেঘলা ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেলো। সকালের নাশতা তৈরি করে ফেললেও ফাহিম এখনো কিছুই খায়নি। মনে মনে ভাবলো
-যাই, এবার তাকে ডেকে আনি, হয়তো রাগ ভেঙে যাবে।

ইফা আর শাশুড়ি তখনো সোফায় বসে রইলেন। শাশুড়ির মুখে রাগের ছাপ স্পষ্ট, যেনো ঝড়ের পরও বজ্রের গুঞ্জন রয়ে গেছে।
মেঘলা ফাহিমের জন্য গরম খাবার সাজিয়ে টেবিলে রেখে নিঃশব্দে রুমের দিকে হাঁটলো।

রুমের দরজার কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো সে।
দরজা ভেতর থেকে লক করা।
আশ্চর্য হয়ে কয়েকবার ডাকলো,
-ফাহিম, দরজা খোলো, শোনো না, এই।
কোনো উত্তর নেই।
মেঘলার বুক ধকধক করতে লাগলো। বারবার কড়া নাড়লো, তবুও নিস্তব্ধতা।

হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে গেলো শাশুড়ির কাছে।
-মা, ফাহিম সাড়া দিচ্ছে না, দরজা ভেতর থেকে লক করা।

শাশুড়ির বুক কেঁপে উঠলো।
তিনি নিজেও দ্রুত পায়ে ফাহিমের দরজার সামনে গিয়ে ধাক্কাতে লাগলেন।
-বাবা, দরজা খোল, তুই রাগ করেছিস জানি, কিন্তু এমন করিস না।
তবুও কোনো সাড়া নেই।

হুড়োহুড়ি শুরু হলো বাড়িতে। কান্নার রোল উঠলো,
-দরজা ভাঙো, কিছু একটা হয়েছে!
ঠিক তখনই ফিরে এলেন ফাহিমের বাবা, হাতে মর্নিং ওয়াকের লাঠি। অবস্থা দেখে কিছু না বলে সোজা দৌড়ে গিয়ে রান্নাঘর থেকে খুন্তি এনে সজোরে আঘাত করলেন তালায়।
ধড়াম শব্দে দরজার তালা ভেঙে পড়লো।

দরজা খোলার সাথে সাথেই নিস্তব্ধ হয়ে গেলো সবাই।
চোখ আটকে গেলো সিলিং ফ্যানের দিকে।
আদরের একমাত্র ছেলে ফাহিম, দুলছে নির্জীব দেহ নিয়ে। ঠোঁটের কোণে কালচে দাগ, জিহ্বা বাইরে বেরিয়ে আছে।
সেই দৃশ্য মুহূর্তেই যেনো হাজার বজ্রপাত হয়ে আঘাত করলো সবার বুকে।

মেঘলার হাত থেকে আঁচল খসে পড়লো, তার শরীর ঠান্ডা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
শাশুড়ি পাগলের মতো চিৎকার করে উঠলেন,
-না বাবা! না! তুই আমাকে ছেড়ে যেতে পারিস না, আমি তোকে ছাড়বো না, তুই নিঃশ্বাস নে, আমি আছি, আমি আছি তোর সাথে।

তিনি ছেলের পা শক্ত করে ধরে উঁচু করলেন, যেনো ভার কমে যায়, যেনো ছেলের গলার ফাঁস আলগা হয়, সে নিঃশ্বাস নিতে পারে।
তার হাত-পা কাঁপছে, মুখ ভিজছে অঝোর অশ্রুতে, কিন্তু বুক ভরা আশা,
আমার ছেলে এখনো বাঁচবে, ও আমাকে মা বলে ডাকবে।

ফাহিমের বাবা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
কথা বেরোচ্ছে না মুখ দিয়ে, হাত-পা যেনো শক্ত হয়ে গেছে।
ইফা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসে ভাইয়ের ঠান্ডা হাত ধরল।

কিছুক্ষণ পরই পুলিশের গাড়ির সাইরেন নীরবতাকে ভেদ করে উঠলো।
অল্প সময়ের মধ্যেই কয়েকজন পুলিশ এসে নিথর ফাহিমকে সিলিং ফ্যান থেকে নামিয়ে আনলো।
ঘরের ভেতর তখন এক অদ্ভুত স্তব্ধতা। শোক যেন দেয়াল ভেদ করে বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে, নিঃশ্বাস নেওয়াটাও ভারী মনে হচ্ছিল সবার কাছে।

মেঘলা কোণের দিকে বসে আছে, কাঁপা হাতে শক্ত করে ধরে আছে ফাহিমের লেখা শেষ দুইটি চিঠি।
চোখের দৃষ্টি ফাঁকা, শরীর নিস্তেজ, না আছে কান্নার জোর, না আছে উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা।
বুকের ভেতরে শুধু একটাই আর্তনাদ,
-আমি তো এমনটা চাইনি ফাহিম, স্বপ্ন ভরা মন নিয়ে তোমার ঘরে এসেছিলাম। তুমি যদি চলে যেতেই চাও, তবে আমায় কেন সঙ্গে নিয়ে গেলে না? কেনো এমন শূন্যতায় ফেলে দিলে?

তার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। চোখের কোণ বেয়ে অশ্রুধারা ঝরে পড়তে লাগলো টুপটাপ শব্দে।
মনে মনে নিজেকেই দোষারোপ করলো,
-যদি জানতাম আমার অভিমান, আমার কথার ঝাঁজই তোমাকে চিরতরে দূরে নিয়ে যাবে, তবে সব নিরবে সহ্য করতাম। অন্তত তুমি তো থাকতে আমার পাশে।

ফাহিমের মৃত্যু যেন মুহূর্তেই আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়লো আশপাশে।
চারদিকের বাতাস ভারী হয়ে উঠলো শোকে, যেন প্রকৃতিও কেঁদে উঠলো এই অপূর্ণ মৃত্যুর জন্য।

ফাহিমের বাবা চুপচাপ বসে আছেন, হঠাৎ ইফার দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বললেন,
-যাই হোক না কেন, তুরিন এই ঘরের বউ ছিল, ফাহিমের স্ত্রী ছিল। তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে, একসাথে অনেক গুলো দিন পেরিয়েছে তারা।
ফাহিমের ভুল-ভ্রান্তি থাকতেই পারে, তা যেনো তুরিন মাফ করে দেয়, আর ফাওয়াদকে আজ বাবার কাছে নিয়ে আসা উচিত, বাবার শেষ নিঃশ্বাসের সঙ্গী হতে না পারলেও অন্তত কিছু স্মৃতি যদি তার মনে থেকে যায়, যা সে সারাজীবন আঁকড়ে রাখতে পারবে।

ইফার হাত কাঁপছিলো, তার কষ্টে গলা শুকিয়ে আসছিলো, তবুও ফোন হাতে নিলো।
রমিস মিয়াকে কাঁপা গলায় জানালো সব।

ওপাশে দীর্ঘ নীরবতা। রমিস মিয়ার যেন কথা বলার শক্তি হারিয়ে গেছে।
শেষমেশ ভারী গলায় শুধু বলতে পারলেন,
-এ কি শুনছি আমি, ফুটফুটে এত সুন্দর একটা ছেলের এমন অকালমৃত্যু! এ তো মৃত্যুর থেকেও বড় অভিশাপ। কিন্তু যে একবার চলে যায়, সে কি আর ফিরে আসে?
কালই তো আমার মেয়ের বিয়ে হলো, তার জীবনের শুরুতে এমন খবর শোনালে মেয়েটার হৃদয় সহ্য করতে পারবে তো? তার স্বপ্নগুলো এক নিমিষে ভেঙে যাবে, আমি কিভাবে ওকে এই শোকের ভার দেবো?

চারদিকের বাতাসে শোক আর অসহায়তার ভার জমাট বাঁধতে লাগলো।
জীবন আর মৃত্যুর ফারাক বোঝাতে অনেক বড় বড় দার্শনিকের প্রয়োজন হয় না,
ফাহিমের ঝুলে থাকা দেহটাই যেন জীবনের অনিশ্চয়তার সবটুকু সত্যি উন্মোচন করে দিলো।

রমিস মিয়া ধীর, ভারী পায়ে তুরিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
গলায় যেন কথা আটকে আসছে, তবু কোনোমতে আমতা আমতা করে ফাহিমের মৃত্যুর সংবাদটা জানিয়ে দিলেন।

শুনে তুরিনের বুকের ভেতরটা যেন মোচড় দিয়ে উঠলো।
এক মুহূর্তের জন্য হলেও, সে তো মানুষটাকে ভালোবেসেছিলো, সেই মানুষই তো তার জীবনের প্রথম পুরুষ, তার ফাওয়াদের জনক।
হঠাৎ মনে হলো, বুকের উপর কেউ যেন এক পাহাড়সম ভারী পাথর চাপিয়ে দিয়েছে, যা সরানোর মতো শক্তি তার নেই, থাকবে কীভাবে?
চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে, বুক ফেটে কান্না বেরোতে চাইছে, তবু সে নীরব।

রমিস মিয়া নিঃশ্বাস ফেলে বাহারকে বললেন,
-ফাওয়াদকে নিয়ে তুরিনের একবার যাওয়া উচিত। শেষবার বাবাকে না দেখলে বড় হয়ে ছেলেটার মনেও হাহাকার থেকে যাবে।

তুরিন কোনো প্রশ্ন করেনি, কোনো অভিযোগ করেনি।
যেমন ছিলো তেমনই, নিঃশব্দে শুধু উপর একটা কালো বোরখা জড়িয়ে নিলো।
কোলের ফাওয়াদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো যেন ভয়ের চাপে ওকেও হারিয়ে না ফেলে।
বাহার নিঃশব্দে একটা গাড়ি রিজার্ভ করলো, গন্তব্য ফাহিমের বাড়ি।
ওদিকে শাশুড়ির আহাজারিতে পুরো বাড়ির বাতাস ভারী হয়ে উঠছে।
তার বুকফাটা কান্না যেন ছিঁড়ে ফেলছে দেয়ালগুলোও।
কান্নার ফাঁকে ফাঁকে চিৎকার করে বলতে লাগলেন,
-আমার সোনা ছেলে! আমার হীরের টুকরো, আমার একমাত্র ভরসা!
ফাহিম বাবা, তুই কই গেলি রে?
চলে আয়, তোরে ছাড়া আমার চোখে আর আলো দেখিনা।
তুই ছাড়া আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে না রে বাবা
তোকে নিজ হাতে খাইয়ে না দিলে আমার বুক ভরে না, তুই তো জানিস!
কেন আমার বুক খালি করে চলে গেলি।

তার আহাজারি শুনে আশপাশের মানুষও চোখের জল ধরে রাখতে পারলো না।
একজন মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ যেন পুরো আকাশে ছড়িয়ে পড়লো।
যেন বলছে, একটা ছেলের মৃত্যুতে শুধু সে নয়, একটা পুরো পৃথিবী শূন্য হয়ে গেছে।

বিকেল নাগাদ ফাহিমের বাড়ির দোরগোড়ায় এসে দাঁড়ালো তুরিন।
আজ যেন চারপাশের বাতাসও শোকের রঙে রঙিন।
দেয়ালের প্রতিটি ইট, আঙিনার প্রতিটি গাছপালা, এমনকি দরজার কপাটও যেন নিঃশব্দে কাঁদছে।

তুরিনকে দেখেই ফাহিমের বাবা ভারী গলায় বলে উঠলেন,
-তুমি আমার ফাহিমকে মাফ করে দিও মা। একসাথে চলতে গিয়ে হয়তো ভুল করেছে, কখনো তোমায় আঘাত দিয়েছে। সেসব আর মনে রেখো না।
তুরিনের গলা বুজে এলেও অস্ফুটস্বরে বললো,
-আমি তো সেসব মনে রাখি নি, বহু আগেই তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।

দূর থেকে চেয়ে দেখলো ফাহিমকে শান্ত, নির্জীব, অনড়।
এই মানুষটিকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে তার সহ্য হচ্ছিল না।
নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে, হৃদয়ের গহীন থেকে চাপা স্বরে ফিসফিস করে উঠলো,
-আপনি কেন এমন করলেন? এতোই কি অশান্তি ছিল আপনার ভেতরে যে মৃত্যুর পথই বেছে নিতে হলো? একবার যদি বলতেন, আমি আবারও আপনাকে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরতাম।

তার ইচ্ছে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে ফাহিমকে বুকে জড়িয়ে ধরতে,
আরও একবার বলতে,আমি এখনো আপনাকে ভালোবাসি।
কিন্তু কোন অধিকারে ছোঁবে তাকে?
তুরিন তো এখন আরেকজনের স্ত্রী, অন্য এক জীবনের বাধ্যবধূ।

বহুক্ষণ নীরবতার পর মেঘলা হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো।
তার বুকফাটা কান্নায় ঘর কেঁপে উঠলো,
-ও মরে নি, আমরা সবাই মেরে ফেলেছি ওকে! আমরা সবাই খুনি। সংসারের অবিরাম কলহ একটা মানুষকে শেষ করে দিয়েছে।
আমার কপালের সামান্য সুখটুকুও মুছে দিলো।
আজ যদি শাশুড়ি একটু নরম হতেন, একটু স্নেহ দিতেন, তবে ওকে এ পথ বেছে নিতে হতো না।
ও তো বরাবরই মায়ের কথা শুনতো, তার কাছে শান্তি খুঁজতো।
কিন্তু তিনি প্রতিনিয়ত আগুনে ঘি ঢেলেছেন, ছেলের বুকটা পোড়াতে থাকলেন।

মেঘলার আর্তনাদে বাতাস আরও ভারী হয়ে উঠলো।
শাশুড়ি মাথায় হাত দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন, কিন্তু সত্যের তীর তখন সবার বুক বিদ্ধ করেছে।

তুরিন বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো,
-যে মায়েরা সন্তানের পাশে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারেন না এমনকি তার স্ত্রীকেও না, তাদের ছেলেকে বিয়ে দেওয়া উচিত নয়।
যদি বউয়ের সুখে হিংসা হয়, তবে ছেলে নিয়েই থাকুন।
কিন্তু ছেলেকে বিয়ে দিয়ে, দুইটা মানুষের জীবন নষ্ট করার অধিকার কারও নেই।

শাশুড়ি ফাওয়াদকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।
কখনো ফাওয়াদকে নিয়ে ছুটে যান ফাহিমের নিথর দেহের কাছে,
ছোট্ট নরম হাতগুলো ছুঁইয়ে দেন বাবার বুকে, যেন শেষবারের মতো সন্তানের স্পর্শে প্রাণ ফিরে আসে।
আবারও বুকভাঙা কান্নায় লুটিয়ে পড়েন, কিছুক্ষণ পরপরই জ্ঞান হারান।
শোকে পাথর হয়ে যাওয়া বাড়ির বাতাসে শুধু হাহাকারের শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

তুরিন ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ফাহিমের মাথার কাছে বসলো।
অচল, নিশ্চল মানুষটির মুখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
এখনো সেই নিষ্পাপ, মায়াময় চেহারা,
যার সৌন্দর্য একসময় তার চোখে আলো জ্বালাতো,
আজ তা নিথর হয়ে পড়ে আছে।

গলা কান্নায় ভারী হয়ে এলেও তুরিন ফিসফিস করে বললো,
-আপনি একবারও ফাওয়াদের কথা ভাবলেন না?
কীভাবে পারলেন তাকে এতিম করে যেতে?
যে সন্তান একদিন ছোট ছোট হাতে লিখতে শিখবে,
তার বাবার নামের আগে কিভাবে বসাবে সেই নিষ্ঠুর ‘মৃত’ শব্দটা?
কেন এমন করে নিজের অস্তিত্ব নিজেই মুছে দিলেন?

তার কথাগুলো শুনে উপস্থিত সবার চোখে জল এসে যায়,
শব্দেরা যেন বাতাসে ভেসে এক অদৃশ্য ব্যথার ঢেউ তুলছিল।

সন্ধ্যা সাতটার দিকে দাফনের প্রস্তুতি শুরু হলো।
ঠিক ছ’টা পঁয়তাল্লিশে লাশ নিয়ে যাওয়ার জন্য সবাই রওনা হলো।
একজন এসে বললো, সময় হয়ে গেছে, লাশ নিয়ে চলুন।
কি অদ্ভুত যে মানুষটা কাল পর্যন্ত ছিল ফাহিম,
ছিল হাসি-কান্নায় ভরা এক উচ্ছল নাম,
আজ সে কেবলই ‘লাশ’।
জীবনের নির্মমতা এই যে, একদিন আমাদের সবারই ঠিক এভাবেই চলে যেতে হবে,
শরীরের পরিচয়ের বদলে শুধু নিথর দেহ হয়ে।

লাশ বহন করা শুরু হলে শাশুড়ি হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
জ্ঞান ফিরতেই পাগলের মতো দিকবিদিক ছুটতে থাকেন,
আকুল হয়ে কখনো ফাহিমের নাম ধরে ডাকেন, কখনো নিজের মাথায় হাত ঠুকতে থাকেন।
তার আর্তনাদে চারপাশের মানুষও হাহাকার করে ওঠে।
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে তিনি প্রলাপ বকতে থাকেন,
-আমার সোনা, আমার বুকের ধন, আমাকে ফেলে তুই কই গেলি?
আমি তোরে ছাড়া বাঁচবো কেমনে?

চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে যায় সেই মাতৃহৃদয়ের বুকফাটা আর্তনাদে।
এ যেন শুধু একজন মায়ের কান্না নয়,
এ যেন সমগ্র পৃথিবীর নিঃশব্দ হাহাকার,
যে হাহাকারে হারিয়ে যায় অগণিত স্বপ্ন, অপূর্ণ ভালোবাসা আর জীবনের নির্মম পরিসমাপ্তি।

আঁকাবাঁকা পথ ধরে বাড়ি ফিরছিল তুরিন, বাহার আর ছোট্ট ফাওয়াদ।
আজ তুরিনের মন ভারে নুইয়ে আছে, এমনকি কান্নারও ভাষা হারিয়েছে।
চোখে জল নেই, অথচ বুকের ভেতর যেন সমুদ্র গর্জে চলেছে।

বাহার নিঃশব্দে তুরিনের হাতটা ধরে রাখল।
শব্দ খুঁজে পেল না, শুধু নীরব সঙ্গ দিয়ে বোঝাতে চাইল, আমি আছি তোমার পাশে।
মধ্যরাতে বাড়ি ফিরে ফাওয়াদকে আঁচলে জড়িয়ে ঘুম পাড়াল তুরিন।
বাহারও না খেয়ে শুয়ে পড়ল,
কিন্তু তুরিনের চোখে ঘুম এল না।

ভেতরের হাহাকার কি এত সহজে থামে?
মন কেবলই কুরে কুরে খাচ্ছে, সেদিন কেন ফাহিমের ফোনটা রাখলাম না?
কেন প্রতিদিন ফাওয়াদকে দেখালাম না ফোনে?
হয়তো ছেলেকে দেখার অপূর্ণ আক্ষেপ নিয়েই ফাহিম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিল।
ভাবনাগুলো কাঁটার মতো বিদ্ধ করছে তাকে।
একটা যন্ত্রণা আছে, যা দেখা যায় না, স্পর্শ করা যায় না,
শুধু বুকের গভীরে ধুকপুক করে, আর সেই যন্ত্রণার সাক্ষী হয় না কেউ।

এভাবেই কেটে গেল সাতটি দিন।
তুরিনের দোকান এখনো বন্ধ।
বাহারও কিছু বলে নি, বুঝে নিয়েছে, তুরিন এখনো স্বাভাবিক হয়নি।
কিন্তু আজ হঠাৎই বাহার শান্ত গলায় বলল,
-দোকানে যাবে না? ওটা কি বন্ধই করে দেবে?
তুমি তো নিজেই বলেছিলে, তুমি নিজের পরিচয় গড়বে,
হাজার মেয়ের পাশে দাঁড়াবে, সমাজ বদলাবে।
দিন রাত এই অন্যমনস্ক হয়ে ঘরে বসে থাকলে তো সেই স্বপ্নগুলোও মরে যাবে তুরিন।

তুরিন নিঃশব্দে বলল,
-মানুষ কি বলবে? বিয়ের সাত দিনের মাথায় দোকানে গিয়ে বসেছে।

বাহার মৃদু হেসে তুরিনের হাত চেপে ধরল,
-তুমিই তো বলেছিলে, লোকের কথায় কান দিতে নেই।
আর এই লোকগুলোকেই তো তুমি পরিবর্তন করতে চাও,
যাদের চোখে আজও মেয়েদের স্বপ্ন অপরাধ হয়ে দাঁড়ায়।
ভয় পেয়ো না, আমি বাহার সবসময় তোমার পাশে আছি।
তুমি সামনে এগিয়ে যাও তুরিন, একদিন তোমারই গল্প অন্য মেয়েদের সাহস জোগাবে।

বাহারের কথাগুলো তুরিনের বুকের ভেতরে হাওয়া বইয়ে দিল।
হয়তো আবারও স্বপ্নগুলোকে গুছিয়ে তোলার সময় এসেছে,
ফাওয়াদের জন্য, নিজের জন্য, আর সেই অগণিত মেয়েদের জন্য, যারা অন্ধকার ভেদ করে আলো খুঁজে পেতে চায়।

তুরিন ধীরে ধীরে আবার নিজের কাজে ডুবে গেল।
দোকানের ব্যস্ততা তাকে কিছুটা হলেও জীবনের ধাক্কা ভুলিয়ে দিচ্ছিল।
এই সময় বড় আপা আর মেজো আপা একে একে ফোন করলেন।
দূর থেকে খবর পেয়ে তারাও যেন গর্বে বুক ভরে উঠল।

এক সময় যে তুরিনকে গ্রামের মানুষ ঠোঁটকাটা বিদ্রূপে বিদ্ধ করত,
যে কালো মেয়েটিকে নিয়ে সমাজের আঙুল উঠত, তার সাথে কেউ ছবি পর্যন্ত তুলতে চাইতো না,
আজ সেই তুরিন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে,
নিজ হাতে গড়ে তুলেছে এক বড় ব্যবসা।
সময় সত্যিই কত অদ্ভুত,
যে মেয়েটিকে একদিন অবহেলার চোখে দেখা হতো,
আজ তার সফলতা অন্যদের চোখে বিস্ময় হয়ে ধরা দেয়।

ফোনের ওপাশ থেকে বড় আপা আবেগে বললেন,
-এখন বুঝতে পারছি, রূপ নয়, গুণই আসল।
তুই এখন নিজের নামে পরিচিতি পাবি,
কিন্তু আমরা দেখ,এখনো স্বামীর নামের ছায়াতেই আছি।

মেজো আপা হেসে যোগ করলেন,
-জীবনে অনেক বড় হ, তুরিন।
তোর সাফল্য যেন আরও দূর ছড়িয়ে পড়ে।
ছেলের পরীক্ষা শেষ হলে একবার গ্রামে এসে তোর দোকানটা দেখে যাব।

তাদের কথায় তুরিনের চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠল।
এ যেন অনেক দিনের কষ্টের প্রতিদান,
অসংখ্য অপমান আর অবহেলার পর জীবনের দেওয়া এক মিষ্টি পুরস্কার।
মনটা ভরে উঠল এক অদ্ভুত তৃপ্তিতে,
হয়তো এভাবেই ধীরে ধীরে সে নিজের ভাঙা স্বপ্নগুলো নতুন করে গড়ে তুলবে।

কেটে গেছে তিনটি বছর।

এই সময়ে তুরিন যেন এক আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছে অসংখ্য নারীর জীবনে।
আজ তার হয়ে কাজ করছে প্রায় পাঁচশত নারী।
সবাই যে ডিভোর্সি বা বিধবা, তা নয়,
সে বৈবাহিক অবস্থার বাঁধন মানেনি,
মানুষ হিসেবে প্রতিটি নারীর স্বপ্ন দেখার অধিকারকে সে মর্যাদা দিয়েছে।
যে হাতগুলো একসময় অবহেলায় থেমে ছিল,
আজ সেসব হাতেই জীবনের চাকা ঘুরছে নতুন করে।

সেলাইয়ের জন্য আলাদা গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠা করেছে তুরিন।
বাঁশ-বেতের কাজ, কাপড়ের ফেব্রিকস, হাতে বানানো শৈল্পিক সব জিনিসের জন্য আছে তার এক বিশাল প্রদর্শনীঘর।
একটি দোকান নয়, এ যেন এক নারীর অদম্য ইচ্ছাশক্তির প্রতীক।

এবার তুরিনের স্বপ্ন আরও বড়,
সে উদ্যোগ নিয়েছে গ্রামে একটি স্কুল গড়ে তোলার।
এ স্কুলে থাকবে না শুধু বইয়ের পাতার জড়ো করা জ্ঞান।
শিশুরা শিখবে বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া সেই শিক্ষাও,
যা মানুষকে মানুষ বানায়, দুঃসময় পেরোতে সাহস জোগায়।
তুরিন এবার ভাঙাগড়া গ্রামের স্বপ্ন-শিল্পী,
সে ঠিক করেছে এই গ্রামকে নতুন করে গড়বে,
যেখানে থাকবে আলো, সচেতনতা আর ভালোবাসার স্পর্শ।

সমাজের কু-ধারণার শেকল সে নিজ হাতে ভেঙে দিয়েছে।
সবার চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করেছে,
ডিভোর্সি বা বিধবা কোনো অভিশাপ নয়,
বরং তারাই পারে আলো ছড়াতে যদি সুযোগ দেওয়া হয়।
তুরিন দেখিয়ে দিয়েছে,
যে নারীকে ‘অলক্ষী’ বলে তিরস্কার করা হয়,
তার উদ্যোগেই আজ কয়েকশো পরিবারে চুলা জ্বলছে।
যে মুখ দেখে অনেকে সকাল সকাল কাজে যাওয়া এড়িয়ে যেত,
আজ সেই মুখের কারণেই তারা রোজ ৫০০-৭০০ টাকা রোজগার করে ঘরে ফিরছে।

তুরিন বিশ্বাস করে, রিজিক তো মানুষের হাতে নয়।
রিজিক পাঠান সৃষ্টিকর্তা,
মানুষ কেবল সেই রিজিক আসার উছিলা মাত্র।
কাজ করতে হয়, পরিশ্রম করতে হয়,
বাকি সব উপরে যার হাতে, তিনি ঠিকই দেন।

এই বিশ্বাস আর অদম্য পরিশ্রমে তুরিন আজ অনুপ্রেরণার আরেক নাম।
তার চোখে নতুন দিনের স্বপ্ন,
যেখানে কোনো নারী আর অবহেলার অন্ধকারে হারিয়ে যাবে না।

কাজ সেরে ক্লান্ত পায়ে তুরিন বাড়ি ফিরলো।
দরজায় ঢুকেই অভ্যাসমতো শ্বশুর-শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনারা খেয়েছেন তো?

উনারা মৃদু হেসে তুরিনের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলেন।
শাশুড়ি ধরা গলায় বললেন,
– তোর মতো মেয়ে হয় না রে মা। তিন বছরে একদিনও তোকে আমাদের প্রতি অবহেলা করতে দেখিনি।
বাহারের সাথেও মন কষাকষি করতে দেখিনি।
একটা সংসারে আর কি-ই বা চাই, এতোটুকুই তো সুখ প্রতিটি মানুষ খোঁজে।

তুরিন নীরবে শুনলো, কিছু বললো না।
মনে মনে ভাবলো, বাহারের মতো পুরুষ যদি প্রতিটি নারীর জীবনে আসতে পারতো,
হয়তো সবার জীবনেই এমন সুন্দর সফলতার গল্প লেখা হতো।

চুপচাপ সবার জামাকাপড় গুছিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে সবার জন্য চা বানালো তুরিন।
ফাওয়াদ তখন আদো আদো গলায় দাদা-দাদির সাথে গল্প করছে।
নতুন নতুন কথা শিখেছে, আর তার সেই সরল মধুর উচ্চারণ শুনে
শ্বশুর-শাশুড়ির মুখে হাসি ফুটে ওঠে,
তারা তো শুধু ওর প্রতিটি কথা শুনতেই বসে থাকেন।

রাত ১০টার দিকে দোকানে তালা ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরলো বাহার।
ঘামে ভেজা চুল আর ক্লান্তি মাখা মুখে ঘরে ঢুকতেই তুরিন পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো।
বাহার মৃদু হেসে বললো,
– আজও তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করছো?
তুরিন কিছু না বলে শুধু চোখের দিকে তাকালো,
সে দৃষ্টিতেই যেন হাজারো অনুচ্চারিত ভালোবাসা।

ঘামে ভেজা শরীরের জন্য আবারও দ্রুত গোসল করে খেয়ে নিলো বাহার।
এদিকে তুরিন শ্বশুর-শাশুড়িকে ওষুধ খাইয়ে নিজের ঘরে এল।
বাহার আলতো করে তুরিনকে বুকে টেনে নিলো।
তার কণ্ঠে গর্বের সুর,
-জানো বেগম রোকেয়া, তোমাকে নিয়ে আমার কত গর্ব হয়!
আজকাল সবাই তোমার নামে বাহবা দেয়, শুনে আমার বুকটা ভরে যায়।

তুরিন মাথা ঘুরিয়ে বাহারের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
– আমার এই সাফল্যের পেছনে তোমার অবদান সবচেয়ে বড়।
আমি আজ যে তুরিন, একজন উদ্যোগতা, একজন সংগ্রামী নারী,
তা শুধু তোমার জন্যই সম্ভব হয়েছে।
ভেঙে যাওয়া আমিকে তুমি পুনর্জীবন দিয়েছো।
না হলে এই প্রতিবাদী তুরিন অনেক আগেই মাটিতে মিশে যেত।
আমি শুধু তুরিন নই, আমি বাহারের বেগম রোকেয়া শুধুই বাহারের।
তুমি বারবার আমার পাশে থেকেছো, ভরসা দিয়েছো, আগলে রেখেছো।
তোমাকে নতুন করে আর ব্যাখ্যা করতে চাই না,
কারণ তুমি নিজেই আমার জীবনের ব্যাখ্যা।

বাহার হেসে তার চুলে হাত বুলিয়ে দিলো,
-তোমার স্কুলের জায়গাটা দেখে এলাম।
সব ঠিক থাকলে আগামী মাসেই নির্মাণ কাজ শুরু হবে।
আমি জানি তোমার এই স্বপ্নও খুব দ্রুত পূরণ হবে।
তুমি এগিয়ে যাবে, নতুন পরিচয়ে সারা গ্রাম তোমার নাম নেবে।

তুরিনের চোখ ভিজে উঠলো।
-আমার যত শত পরিচয়ই হোক না কেন, আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়
আমি বাহারের অর্ধাঙ্গিনী।

বাহার মৃদু হাসলো, চোখে এক ঝলক দুষ্টুমি,
-সব কথায় কি আমাকেই টানতে হবে নাকি?

তুরিন তার ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি এনে ফিসফিস করে বললো,
-আমার অস্তিত্ব জুড়েই যে শুধু তুমি, তোমাকে বাদ দিয়ে বাকিটা লিখবো কিভাবে?

বাহার আর কিছু বললো না।
শুধু তুরিনকে বুকে চেপে ধরলো।
ক্লান্ত দিনের শেষে তাদের ভালোবাসার সেই নিঃশব্দ আলিঙ্গনেই যেন
সারা দুনিয়ার সব শান্তি মিশে আছে।
রাতের অন্ধকার ধীরে ধীরে গভীর হচ্ছিলো,
আর তারা দু’জন নিজেরদের ভালোবাসার উষ্ণতায় জড়িয়ে
এক নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখছিলো,
যেখানে একে অপরের পাশে থাকাটাই তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।

রোজকার মতো আজও ভোরের আলো ফুটতেই তুরিন ঘুম থেকে উঠে পড়ল।
মুখে একফোঁটা আলসেমি নেই, তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে গেলো।
বাহারও ঘুমচোখে উঠে, নিজেকে ফ্রেশ করে নিলো।
ফাওয়াদকে আদর করে ধুয়ে-মুছে, জামাকাপড় পরিয়ে রুমটা গুছিয়ে দিলো।
এই তো তাদের সংসার, দু’জনের ভাগাভাগি দায়িত্বে সাজানো এক ছোট্ট জগৎ।
একে অপরের হাত ধরে তারা শিখেছে, সংসার শুধু একজনের কাঁধে নয়,
বরং দু’জনের সমান সহযোগিতায় এগিয়ে চলে।

তুরিন রান্না শেষে শ্বশুর-শাশুড়িকে খাইয়ে দিলো,
দুপুরের খাবারও আলাদা করে সাজিয়ে রাখলো।
বাহারের জন্য একটি টিফিনে খাবার ভরলো,
অন্য একটি নিজের জন্য, আরেকটিতে ফাওয়াদের ও বাবার জন্য।
সব টিফিন হাতে নিয়ে সকালের রোদে একসাথে বেরিয়ে পড়ল তুরিন আর বাহার।
তাদের গন্তব্য আলাদা, কিন্তু উদ্দেশ্য এক,
পরিশ্রম করে পরিবারের মুখে হাসি ফোটানো।

কাজে পৌঁছেই তুরিন শুনলো,
আনিসুর চাচার ১৭ বছরের মেয়েকে আজ কনে দেখতে আসছে।
পছন্দ হলে নাকি আজই বিয়ের আসর বসবে!
খবর শুনে তুরিনের বুকের ভেতর কেমন হু-হু করে উঠল।
সে তার কর্মীদের নিয়ে ছুটে গেল আনিসুর চাচার বাড়ি।
দৃঢ় কণ্ঠে নিষেধ করলো,
-এসব যদি বন্ধ না করেন, আমি নিজে পুলিশকে জানাবো।

সে সবাইকে বুঝালো,
-মেয়ে মানেই সংসারের বোঝা নয়।
বিয়ে দিয়ে দিলেই মেয়ের প্রতি দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না।
বরং মেয়েকে সুন্দর জীবন দিন,
পড়াশোনা করান, তাকে স্বাবলম্বী হতে দিন।
যাতে জীবন তাকে যত ঝড়ঝাপটাই দিক না কেন,
সে যেন ভেঙে না পড়ে,
বরং নতুন করে নিজেকে গড়ে তোলার শক্তি পায়।
মেয়ে বড় হয়েছে মানেই তাকে বিয়ে দিতে হবে,
এই ধারণা সমাজের সবচেয়ে বড় ভুল।
বরং মেয়ের বড় হওয়া মানে তাকে আরও সুন্দর, স্বপ্নময় জীবন দেওয়া।

তুরিনের দৃঢ়তা আর যুক্তির কাছে অবশেষে নরম হলেন আনিসুর চাচা।
পাত্রপক্ষকে ফোন করে সরাসরি না করে দিলেন।
বললেন,
– আমার মেয়ে পড়াশোনা করবে, নিজের জীবনটা নিজেই গড়বে।

এমন ঘটনা এই প্রথম নয়।
তুরিনের উদ্যোগে এর আগেও ২০টিরও বেশি অল্পবয়সী বিয়ে বন্ধ হয়েছে।
নিজে না পারলে আইনের সাহায্য নিয়েছে সে।
একসময় এই গ্রাম ছিল পুরোনো কুসংস্কারের আঁধারঘর,
মেয়ের বয়স আঠারো পেরোলেই বুড়ি,
আর ১৬-১৭ বছর হলেই বিয়ের উপযুক্ত!
তুরিনের সংগ্রাম আর সাহসে সেই মানসিকতায় বদল এসেছে।
আজ অন্তত কিছুটা হলেও মানুষ বুঝতে শিখেছে,
মেয়ের জীবন শুধু বিয়ে-সংসারের গল্প নয়,
তারও স্বপ্ন আছে, সম্ভাবনা আছে।

হয়তো সবার দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে তুরিনের বোঝানোর কারণে,
আবার কারও কারও মনে আইনভীতি কাজ করেছে।
কিন্তু তুরিন জানে,
পরিবর্তনের শুরুটুকু যদি হয়,
একদিন না একদিন সমাজের চোখে সত্যের আলো জ্বলবেই।

দেখতে দেখতে আরেকটি বছর পেরিয়ে গেল।

ঘরের পরিবেশটা যেন হঠাৎ করেই স্তব্ধ হয়ে গেছে।
আগের মতো আর ঝগড়া নেই, নেই কোনো উচ্চস্বরে তর্ক কিংবা অশান্তি।
সব কলহ থেমে গেছে, কিন্তু সেই নীরবতার মূল্য দিতে হয়েছে একটি প্রাণকে।

ফাহিমের চলে যাওয়ার পর এই ঘরে আর হাসির কোনো প্রতিধ্বনি নেই,
আছে শুধু চাপা কান্না আর ভারী নিস্তব্ধতা।

শাশুড়ির চোখের নিচে কালি জমেছে, তার চাপা বুক যেন ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে।
রাতভর ছেলের ছবি বুকে জড়িয়ে নিঃশব্দে কান্না করেন তিনি।
একটা সময় কলহে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া সেই মা,
এখন ছবি ছাড়া আর কিছু আঁকড়ে ধরতে পারেন না।
একটাই তো ছেলে ছিলো ফাহিম।
মরার পর তার কবরে মাটি দেওয়ার মতো ও আর কেউ রইলো না।

খাবারের থালা প্রতিদিন ফাহিমের ছবির সামনে রাখেন তিনি,
চোখ মুছে নিঃশব্দে ফিসফিস করে বলেন,
– তোকে না খাইয়ে আমি কীভাবে খাই বল?
বরাবরের মতোই তো নিজের আগে তোকে খাইয়েছি,
আজও অভ্যাস যায় না রে বাবা।

মাঝে মাঝে গ্রামে গিয়ে ফাওয়াদকেও দেখে আসেন তিনি।
ওই ছোট্ট ছেলেটাই তো এখন একমাত্র উত্তরসূরি, ফাহিমের রক্তের ধারা।
ফাওয়াদকে দেখলেই বুকটা চিরে যায় কান্নায়,
জড়িয়ে ধরে কাঁপা হাতে আদর করতে থাকেন তিনি,
যেন সেই আদরে ফাহিমকে নতুন করে একবার ছুঁয়ে দেখছেন।
কখনো বা ফোনে কথা হয় ফাওয়াদের অমলিন হাসি শুনে,
তার টুকরো টুকরো শব্দে ফাহিমের শৈশব খুঁজে পান।
এই ক্ষণিক দেখা আর শোনা যেন শাশুড়ির নিঃশেষ হয়ে যাওয়া জীবনে
একটুকরো আলো, তবু তা মুহূর্তেই মিলিয়ে যায় অনন্ত শূন্যতায়।

বুকের হাহাকার এত গভীর যে,
এটা না দেখা যায়, না বোঝা যায়,
শুধু অনুভব করা যায় সেই নীরব কান্নায়,
যা দেয়াল ভেদ করে পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ে।
এখন এই ঘরের বাতাসে আছে অনুশোচনা আর অপূরণীয় শূন্যতার গন্ধ,
যেন প্রতিটি নিঃশ্বাস বলছে,
যদি আগে বুঝতাম, যদি আগে থামাতে পারতাম!

তুরিনের স্বপ্নের স্কুল আজ পূর্ণাঙ্গ রূপে দাঁড়িয়ে আছে।
সব সাজসজ্জা শেষ, আঙিনায় উড়ছে বেলুন আর রঙিন ফিতা।
আজ স্কুলের উদ্বোধন।

তুরিনের বড় দুই বোন এসেছে তাদের স্বামী-সন্তান নিয়ে।
এখানে আজ উপস্থিত তুরিনের বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি,
গ্রামের প্রবীণরা, তুরিনের কর্মী আর শুভাকাঙ্ক্ষী সবাই।
মুখে সবার আনন্দের ঝলক, চোখে ভবিষ্যতের স্বপ্ন।

স্কুলের ভেতর ছোট্ট করে আয়োজন করেছে তুরিন।
বাহার হাতে কাঁচি তুলে দিয়ে বললো,
– চল, আজ তোমার স্বপ্নের দরজা খুলো।

তুরিন মৃদু হেসে মাথা নাড়লো,
– না, আমি একা নই। এই স্বপ্নে তোমার সমান অবদান।
তুমি না থাকলে এই পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব হতো না।

অবশেষে দুজন একসাথে লাল ফিতা কাটলো।
তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচশোরও বেশি মানুষ,
যাদের জীবনে তুরিন জ্বালিয়েছে স্বাবলম্বিতার আলো।
তুরিন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে ভাবলো,
অন্ধকার থেকে আলোয় আসার এই পথটাই তার সত্যিকারের অর্জন।

বাহার এগিয়ে এসে বললো,
-আজ থেকে কেউ অশিক্ষিত থাকবে না।
এই স্কুল হবে তোমাদের মুক্তির সোপান।
কুসংস্কার, ভয় আর হেরে যাওয়ার গল্প এখানেই শেষ।
তোমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই শক্তি আছে,
শুধু সাহস আর চেষ্টা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

তুরিন সবার সামনে দাঁড়িয়ে, তার চোখ আবেগে ভিজে উঠলো।
তার কণ্ঠে দৃঢ়তা, চোখে স্বপ্নের দীপ্তি,
– আজ আমার স্বপ্ন পূর্ণ হলো, কিন্তু এটাই শেষ নয়।
আমি চাই এই আলো ছড়িয়ে পড়ুক প্রতিটি গ্রামে,
প্রতিটি মেয়ের চোখে জ্বলুক নিজের শক্তির দীপ্তি।
আজ যারা হেরে গিয়েছে, তারা আবার জিতবে।
আমরা সবাই মিলে এক নতুন সমাজ গড়বো,
যেখানে কারও স্বপ্ন অপূর্ণ থাকবে না।

আকাশে তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে,
কিন্তু তুরিনের জীবনে আলো ফুরোবার নয়।
স্কুলের উঠোনে দাঁড়িয়ে সে অনুভব করলো,
অতীতের সমস্ত ব্যথা আজ সার্থক হয়েছে।
যে গ্রাম একদিন তাকে তিরস্কার করেছিল,
আজ সেই গ্রাম তার হাত ধরে নতুন স্বপ্ন দেখতে শিখেছে।

বাহার ধীরে তুরিনের হাত ধরে ফিসফিস করে বললো,
– তুমি পারেছো, আমার বেগম রোকেয়া।

তুরিন হাসলো, আকাশের লালিমায় চোখ রাখলো।
জীবন তাকে শিখিয়েছে,
অন্ধকারের শেষে আলো আসবেই,
যদি ভেতরের স্বপ্নটাকে জিইয়ে রাখা যায়।
_সমাপ্ত
#আরেব্বা_চৌধুরী