#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_০১
বিয়ে করবে না বলে পাঁচ বছর আগে বিয়ের দিন পালিয়ে যাওয়া লোকটার সাথেই আজ বিয়ে হলো হায়া’র। ভাগ্য তাকে এই লোকের সাথেই যে জুড়ে রেখেছিলো সেটা হায়া ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। অতীতে ভরা আসরে প্রত্যাখ্যান করার মাধ্যমে লোকটি হায়াকে যেই অপমান করেছিলো,, আজ তার চেয়েও দ্বিগুণ অপমানিত বোধ করলো সে। সেদিন তো পুরো পরিবারকে নিজের পাশে পেয়েছিলো কিন্তু আজ কেউ নেই হায়া’র পাশে। পুরো পৃথিবীতে নিজেকে একটা ছোট্ট বিন্দুর মতো সম্পূর্ণ একা লাগছে।
মাথায় কারো স্নেহের স্পর্শ পেয়ে চোখ তুলে তাকায়। দেখতে পায় লোকটি আর কেউ না তার মামা,,যিনি কিনা কিছুক্ষণ আগে হায়া’র শ্বশুরমশাই হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। বাবাই আর ভাইদের পর তার ভালোলাগার একটি পুরুষ হলো এই মামা। হায়া’র শ্বশুর মানে আবরার মির্জা হায়া’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে–
—আম্মাজান,,এখন তো যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। পুরানো ঠিকানায় নতুন পরিচয় নিয়ে যেতে আপনি প্রস্তুত তো? নাকি আজ থাকবে?
নিজের বাবার এমন বিটকেল মার্কা কথা শুনে আশিয়ানের চোখ কপালে উঠে যায়। বিয়ে করা বউকে নাকি রেখে যাবে আশিয়ান। কস্মিনকালেও এহেন কাজ করবে না আশিয়ান,, লাগলে সে নিজেও থেকে যাবে তার বউয়ের সাথে। কত কাঠখড় পুড়িয়ে সে এই বিয়ে করতে পেরেছে তা শুধু উপরওয়ালা আশিয়ান আর তার বেস্টফ্রেন্ডই জানে।
আশিয়ান নিজের অস্থিরতাকে নিজের মধ্যেই চেপে রেখে, কণ্ঠে গাম্ভীর্যতা নিয়ে বলে–
—আমি যেখানে যাবো আমার বউও সেখানেই যাবে। বউ ছাড়া আমি এক কদমও নড়ছি না কথাটা বলে রাখলাম।
আবরার চোখ গরম করে আশিয়ানের দিকে তাকায়। অসভ্য,, বাদর ছেলেটা একঘন্টাও হয়নি বিয়ে করেছে এরই মধ্যে বউয়ের জন্য পাগল হয়ে উঠেছে৷ এটা কি তার সন্তান? আবরারের তো মাঝে মধ্যে সন্দেহ হয় ছেলেটাকে নিয়ে। মনে হয় আশিয়ান জন্মানোর পর হসপিটালে কারো সাথে পাল্টাপাল্টি হয়ে গিয়েছে।
আবরার রেগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে–
—তোমার কাছে কেউ মতামত জানতে চায় নি। দয়া করে ফালতু বকবক করা বন্ধ করো।
এরই মধ্যে হানিয়া ভাই আর মেয়ের কাছে এগিয়ে আসে। নরম গলায় সুধায়–
—ভাই ওরা দু’জন এই বাড়িতেই না হয় থাকুক আজ। কাল-পরশু ও বাড়িতে যা….
হানিয়া পুরো কথা শেষ করতে পারে না। এর আগেই হায়া বলে উঠে–
—ভালোবাবাই গাড়ি বের করতে বলো। আমি আজ এক্ষুনি বিদায় নিতে চাই এ’বাড়ি থেকে।
মেয়ের এমন কাঠকাঠ গলায় বলা কথায় জাভিয়ান-হানিয়া দু’জনই আহত হয়। কিন্তু তারা জানে তাদের থেকেও বেশি আহত যে তাদের মেয়ে হয়েছে এই বিয়ে করার মাধ্যমে। হায়া’র ব্যক্তিত্বের সাথে আজকের এই ঘটনা কিছুতেই যায় না। কিন্তু তাদেরও তো কিছু করার ছিলো না। একটা মেয়ের যদি দু’দুবার বিয়ে ভেঙে যায় এই সমাজ তো সেই মেয়েকে বাঁচতে দিবে না।
জাভিয়ান এগিয়ে আসে মেয়েকে বুঝানোর জন্য। তখনই হায়া তড়াক করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তাকে দাঁড়াতে দেখে আশিয়ানও দাঁড়িয়ে যায়। আপাতত সে তার বউয়ের বাধ্যগত ভেড়া থুক্কু বাধ্যগত স্বামী। বউটা যে নিজের অজান্তেই আশিয়ানকে খুশি করে দিয়েছে। আবরারের সামনে সামনে এসে বলে–
—চলো ভালো বাবাই।
কথাটা বলে নিজেই আগে আগে হাটা শুরু করে। তার পেছন পেছন বাকি সবাই আসতে থাকে। হায়া’র বিয়ের অ্যরেঞ্জমেন্টটা শহরের এক নামীদামী হোটেলে করা হয়েছিলো। হায়া হোটেল থেকে বের হয়ে এসে গাড়িতে বসবে তখনই পেছন থেকে একটা পুরুষালী কন্ঠে ডাক শোনা যায়। লোকটি বলে–
—পুতুল আমার কাছ থেকেও বিদায় নিবি না?
হায়া দাঁড়িয়ে পরে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পায় তার ছোট দা’ভাইকে। দুই ভাইয়ের আদরের দুলালি সে। আজ এমন বাজে ভাবে বিয়েটা হওয়ায় সে কারো থেকে বিদায় না নিয়েই চলে যাচ্ছিল হায়া৷ কিন্তু এখন সে কিছুতেই আর মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে পারবে না।
হায়া এগিয়ে এসে তার ছোট দা’ভাই জায়িনকে জড়িয়ে ধরে । জায়িনও বোনকে আগলে নেয় পরম মমতায়। ভাইকে জড়িয়ে ধরে হায়া নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না,,ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে শব্দ করে কেঁদে দেয়। জায়িনের চোখেও অল্প বিস্তর অশ্রুদের আগমন ঘটেছে কিন্তু পুরুষ মানুষ বলে শব্দ করে কাঁদতে পারছে না।
কন্যা বিদায়—চারটে খানি কথা না। জন্ম হলো এক ঘরে,,জীবনের অর্ধেক সময় সেই ঘরে কাটিয়ে দিয়ে হুট করে অন্য ঘরের চলে যাওয়ার এই রীতি বহুদিনের পুরানো। সকলের চোখে অশ্রুদের আনাগোনা চলছে। আশিয়ান করুণ চোখে হায়া’র দিকে তাকিয়ে আছে।
জাভিয়ান আর হানিয়া এগিয়ে আসে। জাভিয়ান মেয়ের মাথায় হাত রেখে ডেকে উঠলে হায়া রাগ টাকে কিছুক্ষণের জন্য এক সাইডে রেখে বাবার বুকে আছড়ে পরে। বাবার কাছে এসে যেনো তার কান্নার বেগ আরো বেড়ে গিয়েছে। হায়া তার বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে। এতটা ভালোবাসা সে আর কাউকে বাসে না। জাভিয়ানও মেয়ে অন্ত প্রাণ।
মা’কেও কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে বিদায় নেয় হায়া তার কাছ থেকে। পর্যায়ক্রমে দাদু আর ছোট দাদী মা’র থেকেও বিদায় নেয় হায়া। সকলে নিজেদের চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে। রাত বাড়তে থাকায় আবরার তাঁদের যাওয়ার জন্য তাড়া দেয়। জাভিয়ান হায়া’র হাতটা আশিয়ানের হাতে তুলে দিয়ে অশ্রু শিক্ত চোখ নিয়ে ধরা গলায় বলে–
—তুমি তো জানোই আমার মেয়ে কতটা শখের আমার। আমার শখকে আজ তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি বহু আশা নিয়ে। অতীতের কথা ভুলে গিয়ে নতুন করে সবটা শুরু করো। ভাগ্য সবাইকে দ্বিতীয় বার সুযোগ দেয় না,,কিন্তু আমি আর তুমি সেই সুযোগটা পেয়েছি আর পাচ্ছো। তুমি বুদ্ধিমান ছেলে সুযোগের সদ্ব্যবহার কীভাবে করতে হয় জানো আশা করি।
আশিয়ান হায়া’র হাতটা শক্ত করে ধরে জাভিয়ানকে ভরসা দিয়ে বলে–
—আশা ভঙ্গ করবো না কথা দিলাম। শেষবার ভরসা করে দেখতে পারো বাবাই।
জাভিয়ান মেয়ের কপালে স্নেহের পরশ দিয়ে কিছুটা পেছনে চলে যায়। হায়া গাড়িতে উঠার আগে শেষ বারের মতো পেছনে ফিরে অভিমানী কণ্ঠে বলে–
—নিজেকে আজ সবচেয়ে বড় বোঝা মনে হচ্ছে। দু’দুবার একই কাজ করা হলো অথচ আমার থেকে জিজ্ঞেসটা পর্যন্ত করা হয়নি, অনুমতি তো দূরের কথা। এবার তো একেবারে ধরে বেধে বিয়েই দিয়ে দিলে। বড় দা’ভাই থাকলে এমনটা কখনোই হতে দিতো না।
কথাটা বলে হায়া গাড়িতে উঠে বসে। জাহান বোনের বিয়েতে উপস্থিত ছিলো না। হঠাৎই হসপিটালে একটা ইমার্জেন্সি এসে পরায় সেই যে সকালে বাসা থেকে বের হয়েছে, এখনো আসেনি।
আশিয়ান জায়িনের সাথে একবার ম্যানলি হাগ করে সেও গাড়িতে চড়ে যায়। আবরার তাদের পেছনের গাড়িতে স্ব স্ত্রীসহ উঠে বসে। মিনিট খানেকের মধ্যে দু’টো গাড়িই রওনা হয় তাঁদের গন্তব্যের উদ্দেশে। গাড়ি ছাড়ার সাথে সাথে হানিয়া প্রচন্ড কান্নায় ভেঙে পরলে জাভিয়ান তাঁকে নিজের সাথে আগলে নেয়।
হায়া’ গাড়ির সাইড মিররে মায়ের কান্না দেখতে পায়। তার ভেতর থেকেও কান্নারা ঠেলে বের হয়ে আসতে চাইছে কিন্তু হায়া দাঁতে দাঁত চেপে নিজের কান্না সংবরণ করছে। তাদের গাড়ি আস্তে আস্তে কমিউনিটি সেন্টারের বাহিরে এসে মেইন রোডে উঠে আসে।
কঠিন ভাবে আসা কান্নাকে আটকানোর কারণে হায়া এখন ফুপাচ্ছে। তার ফুপানোর আওয়াজ আশিয়ানও শুনতে পায়। সে ঘাড় ঘুড়িয়ে হায়া’র দিকে তাকালে দেখতে পায়,, হায়া গাড়ির সিটে গা এলিয়ে দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ফুপাচ্ছে।
গাড়ির ভেতরে জ্বলতে থাকা হালকা লাইটের আলোয় আশিয়ান খুব ভালো করেই দেখতে পায় হায়া’র টকটকে লাল হয়ে যাওয়া নাক’টাকে। এই মেয়ে যে তার বাপ ভাইয়ের ননীর পুতুল সেটা সে ভালো করেই জানে। এতদিন বাপ-ভাই তাকে তুলুতুলু করে রেখেছিল এখন তার পালা। বহুত কাঁদিয়েছে আর না। এবার ভালোবাসার পালা। তার এখন আফসোস হচ্ছে সেই ভুলটা না করলে এতদিনে এই ননীর পুতুল তাকে একটা ননীর পুতুল গিফট করে আরেকটা প্রসেসিংয়ে থাকত হয়তো।
আশিয়ান ড্রাইভারকে গাড়ির লাইটা অফ করে দিতে বলে। লাইট অফ করা হলে আশিয়ান এগিয়ে আসে হায়া’র কাছে। হাত বাড়িয়ে তাকে আগলে নিতে চায় নিজের বক্ষে। হঠাৎই হাতে কারো স্পর্শে হায়া হকচকিয়ে গিয়ে চোখ খুলে তাকালে আশিয়ানকে দেখতে পায়। হুট করে প্রচন্ড রাগ তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। আশিয়ানের বাড়ন্ত হাতটা এক প্রকার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে–
—দূরে থাকুন।
হায়া’র এহেন কাজে আশিয়ানের পুরুষালী ইগোতে লাগে। সুন্দর করে বললেই তো হতো,, তা না করে এমন দূর্ব্যবহার করার কি ছিলো। আশিয়ান নিজের ইগো বজায় রাখতে হায়া’র আরেকটু কাছে এসে খপ করে তাঁর কোমড় চেপে ধরে নিজের কোলের উপর বসিয়ে নেয়। তারপর হায়া’র মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে। হায়া নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করলে আশিয়ান তাঁকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হিসহিসিয়ে বলে–
—সামনে ড্রাইভার আছে তাই বেশি নড়াচড়া করো না সোনা। পরে আমি কিছু করলে তোমাকেই লজ্জা পেতে হবে কিন্তু।
আশিয়ান কি মিন করে কথাটা বলেছে হায়া’র তা বুঝতে বাকি থাকে না। কথাটা বুঝতে পেরে রাগে তার গা পিত্তি জ্বলে উঠে। আশিয়ানের বাহু থেকে এত সহজে ছাড়া পাবে না সে, এটা বুঝতে পেরে হায়া’র সব শক্তি দিয়ে ধপ করে এক কিল লাগায় আশিয়ানের বুকে। আকস্মিক এমন হামলা আশিয়ান স্তব্ধ হয়ে যায়। ব্যথায় বুকটা অবশ হয়ে আসছে। চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে রাখে ঠেলে বের নিয়ে আসতে চাওয়া আর্তনাদকে প্রতিহত করার জন্য।
হায়া কিল মেরেও শান্ত হয় না। হায়া’র মাথা চেপে রাখা আশিয়ানের হাতটা হালকা ঢিলে হয়ে আসলে, হায়া নিজের মুখ এগিয়ে আশিয়ানের কাধে করচ করে একটা কামড় দিয়ে ধরে রাখে। নিজের সব রাগ,,অপমান যেন এই কামড়ের মাধ্যমে উশুল করে নিতে চাচ্ছে। আশিয়ান চোখমুখ খিঁচে রেখে সদ্য বিয়ে করা বউয়ের এই ভালোবাসাহীন আদর নিচ্ছে।
নিজের মনের কিছুটা ক্ষোভ মিটিয়ে হায়া আশিয়ানের কাঁধ থেকে নিজের দন্ত সরিয়ে আনে। হুট করেই সে আশিয়ানের কাঁধে মুখ গুঁজে শব্দ করে কেঁদে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে বলে–
—কেন আবার ফিরে এসেছেন? আমায় কাঁদানোর জন্য? একবার কাঁদিয়ে,, অপমান করে মনের খায়েশ মিটেনি? চলে যান আপনি আমার জীবন থেকে। আমার জীবনের জন্য অভিশাপ আপনি।
ভুলক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং মাই লাভিং রিডার্স 🤍]