সাঝের প্রণয়ডোর পর্ব-০৩

0
1

#সাঝের_প্রণয়ডোর
#সাদিয়া_সুলতানা_মনি
#পর্ব_০৩

আশিয়ান রুমে আসার সুযোগ পায় রাত একটায়। একটা জরুরি কাজ এসে পরায় বউকে বাসায় নামিয়ে দিয়েই তাকে বাহিরে ছুটতে হয়েছিলো। কাজটা শেষ করে মাত্রই বাসায় আসলো। রুমে ঢুকে বেড খালি দেখতে পেয়ে বুকটা ধুক করে উঠে। বেড থেকে চোখ সরিয়ে ওয়াশরুমের দিকে তাকালে দেখতে পায় ওয়াশরুমের লাইটও অফ। তাহলে তার ননীর পুতুল গেলো কোথায়? পালিয়ে যায় নি তো আবার?

কথাটা মনে হতেই তার হার্টবিট ফাস্ট হয়ে যায়। হায়া’কে ঘরের বাহিরে খুঁজতে যাওয়ার আগে কি মনে করে বেলকনিতে যায় চেক করতে। হায়া’কে বেলকনির কাউচে একপাশ হয়ে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে আশিয়ান অস্থির হৃদয় শান্ত হয়ে আসে। এক অদ্ভুত ভালোলাগা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। চোখ জোড়ায় শীতলতা নেমে আসে। বেলকনিরে দরজার সাথে হেলান দিয়ে,, বুকে হাত গুজে প্রেমময় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে তার ননীর পুতুলের দিকে।

যাকে ছোট বেলা থেকে দেখতে পারত না সেই কিনা আজ আশিয়ানের ঘরনী। তার চক্ষু শীতলকারী নারী, কথাগুলো ভাবতেই আলাদা রকমের শান্তি পাচ্ছে আশিয়ান।

রাত গভীর হচ্ছে দেখে আশিয়ান এগিয়ে এসে আলতো হাতে হায়া’কে কোলে তুলে নেয়। তারপর ধীর পায়ে তাকে নিয়ে রুমে এসে পরে। যেই না সে হায়া’কে বেডে শোয়াবে তখনই হায়া ফট করে চোখ মেলে তাকায়।

ঘুম ভাঙার পর হঠাৎই নিজের এতো কাছে আশিয়ানকে দেখে হায়া ভয় পেয়ে আর একটা গগনবিদারী চিৎকার দেয়। আশিয়ান থতমত খেয়ে হায়া’কে ছেড়ে দিলে হায়া ধপ করে বেডে গিয়ে পরে। হুট করে এভাবে ধপ করে পরে যাওয়ায় কােমড়ে হালকা চোট পায় হায়া। কোমড়ে হাত চেপে আর্তনাদ করে বলে–

—বাবা গো!!

আশিয়ান নিজেও নিজের এমন হকচকিয়ে যায়। সে হায়া’র দিকে ঝুঁকে এসে অস্থির কণ্ঠে বলে–

—ব্যথা পেয়েছো সোনা?

ব্যস হায়া’র রাগকে আর থামায় কে। হায়া আশিয়ানের পাঞ্জাবির কলার খামচে ধরে নিজের একদম কাছে নিয়ে আসে । তারপর রাগে হিসহিসিয়ে বলে–

—নাহ মজা পেয়েছি। ওয়ান্স মোর প্লিজ জামাই।

হায়া’র বড়বড় চোখ করে তাকানো আর কিড়মিড়িয়ে বলা কথাগুলো দ্বারা আশিয়ান বেশ ভালো করেই বুঝতে পারে বেশ ভালোই রেগে গিয়েছে তার নববধূ। অসহায় গলায় বলে–

—আই এম সরি বউ। আমি বুঝতে পারি নি তুমি ব্যথা পেয়ে যাবে।

—আমার বেলায় শুধু আপনি অবুঝ। কিন্তু কি করলে আমি কষ্ট পাবো বা কিসে ব্যথা পাবো সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝেন। সেই আমার জন্মের পর থেকেই।

কথাটা বলে হায়া আশিয়ানের পাঞ্জাবির কলার ছেড়ে দেয়। তারপর সেই অবস্থায় শুয়েই চোখে হাত রেখে কাঁদতে থাকে। পাপার কথা মনে পরছে তার ভীষণ।

হায়া’কে কাঁদতে দেখে আশিয়ান বিচলিত হয়ে যায়। হায়া’র চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে তার দু’গালে হাত রেখে অস্থির হয়ে বলে–

—আমি সরি না বউ। কেঁদো না। দেখি কোথায় ব্যথা পেয়েছো? দেখাও আমায়।

আশিয়ান হায়া’র কোমড়ে রাখা হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলে–

—এখানে ব্যথা পেয়েছো? ওয়েট আমি তোমায় ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছি এখনি চলে যাবে।

কথাটা বলে হন্তদন্ত হয়ে ড্রেসিংটেবিলের কাছে গিয়ে ফার্স্ট এড বক্স থেকে ব্যথার স্প্রে’টা নিয়ে দৌড়ে আবার হায়া’র কাছে আসে। স্প্রে টা কয়েকবার স্প্রে করে দেয় কোমড়ে। কাজটা শেষ করে যেই না সেখান থেকে সরে আসতে যাবে তখনই শুনতে পায় কে জানি তাদের রুমের দরজা নক করছে।

আশিয়ান চপল পায়ে হেঁটে গিয়ে দরজা খুলে দিলে দেখতে পায় তার মা-বাবা দাঁড়িয়ে আছে। আশিয়ান লক্ষ করে আবরারের হাতে একটা স্কেল আর মুখটা কেমন রাগী রাগী।স্কেলটা দেখে আশিয়ান একটা শুকনো ঢোক গিলে। তারপর মুখটা স্বাভাবিক করে বলে–

—আম্মু,, বাবা তোমরা এত রাতে আমার ঘরে কি?

স্পর্শ বিচলিত হয়ে বলে–

—একটু আগে হায়া’র চিৎকারের আওয়াজ শুনলাম। হ্যাঁ রে আশু, তুই কি ওকে মেরেছিস আবার?

মায়ের কথা শুনে আশিয়ান হকচকিয়ে যায়। আশিয়ানের ঘাড়ে কয়টা মাথা যে এই ননীর পুতুল বউটাকে মারবে? যেই না ননীর পুতুল বিয়ে করে এনেছে সে, বাপের বাড়ি ছাড়ার পর থেকে তাঁকে একের পর এক প্যারা দিয়েই আসছে। তার উপর যদি মারে,,তাহলে তো আশিয়ান শ্যাষ।

আশিয়ান গম্ভীর গলায় বলে–

—না আম্মু। মারবো কেন শুধু শুধু ওকে?

এবার আবরার মুখ খুলে। খানিকটা ধমকের সুরে বলে–

—তাহলে চিৎকারের আওয়াজ পেলাম কেনো?

আশিয়ানের বলতে মন চাইলো–

—হায়রে বোকা আম্মু আর বাবা। আজকে বাসর রাত,,আর বাসর রাতে চিৎকারের আওয়াজ শোনা কি স্বাভাবিক বিষয় না? নেহাৎ হায়া ব্যথা পেয়ে চিৎকার করেছিলো বলে দরজাটা খুলতে পেরেছিলাম,, যদি এটা সুখের চিৎকার হতো তাহলে কি দরজা খুলে এই জবাবদিহি করতে পারতাম?

মনের কথা মনেই চেপে আশিয়ান মুখে বলে–

—আসলে একটা তেলাপোকা দেখে ভয়ে চিৎকার করেছিলো।

স্পর্শ রুমে উঁকি দিয়ে দেখে হায়া পা ঝুলিয়ে শুয়ে আছে। মাঝে মধ্যে শরীরটা অল্পবিস্তর কেঁপে কেঁপে উঠছে। মেয়েটা কি তাহলে কাঁদছে?

স্পর্শ আশিয়ানকে প্রশ্ন করে–

—হায়া ওমন ভাবে শুনে আছে কেন? আর কাঁপছেই বা কেন?

আশিয়ানের মন চাইলে কচু গাছের সাথে নিজেকে ফাঁসি দিতে। এখন যদি তার বাবা-মা রুমে ঢুকে জানতে পারে তার বউকে নিজের অজান্তেই সে কাদিয়েছে,, তাহলে সে ১০০% সিউর কালকেই তাদের তালাক করিয়ে দিবে তার সম্মানীয় বাবা। কি বলবে? কি বলে তাদের বিদায় করবে– কথা গুলো ভাবতে ভাবতেই তার হাতে ব্যথা অনুভব হয়।

ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তব ফিরলে সে বুঝতে পারে তার বাবা নিজের হাতের ঐ স্কেল দিয়ে তাকে মেরেছে। আশিয়ান ব্যথা জায়গাটা ডলতে ডলতে বলে–

—বাবা এটা কি হলো? তুমি আমায় আমার এত স্পেশাল একটা দিনেও মারলে?

আবরার রেগেমেগে বলে–

—মারবো না কি তোমায় চুমু দিবো? আসো তাহলে চুমু দেই।

আশিয়ান দুই কদম পিছিয়ে গিয়ে বলে–

—বাবা হিসেবে তুমি আমায় চুমু দিতেই পারো। কিন্তু ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন,, আমায় চুমু দেওয়ার জন্য আলাদা মানুষ এসে পরেছে। আপাতত তুমি এই চুমু দেওয়ার দায়িত্বটা তার উপরই ছেড়ে দিলে ভালো হবে। আরেকজনের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা ঠিক না কিন্তু বাবা।

আবরার আর স্পর্শ আশিয়ানের এমন ঠোঁটকাটা কথা শুনে লজ্জার সাগরে পরে। স্পর্শ তড়িঘড়ি করে বলে–

—নিচে থেকে কিসের যেনো একটা আওয়াজ পেলাম। আশু’র বাবা আমি দেখে আসছি কিসের আওয়াজ হলো।

কথাটা বলে ভদ্রমহিলা হনহনিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। আবরার রাগে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে–

—তোমার মতো অসভ্য ছেলে আমি আমার জীবনে খুব কম দেখেছি। সময় থাকতে সুধরে যাও। নাহলে নাতী নাতনিদের শাসন করার বয়সে তোমায় শাসন করতে আমি বাধ্য হবো।

কথাটা বলে সেও চলে যায় সেখান থেকে। আশিয়ান দরজা আটকাতে আটকাতে মনে মনে একটা ভেঙচি কেটে বলে–

—নাতি নাতনিদের আনার প্রসেসিং-ই শুরু করতে দিচ্ছে না,, পুত্রবধুর সামান্য চিৎকারের আওয়াজ শুনেই দরজায় এসে হামলা করছে। সে আবার নাতি-নাতনীদের শাসন করার স্বপ্ন দেখে।

কথাটা বলে আরো দু’টো ভেঙচি কাটে। তারপর নজর দেয় বিছানায় এলোমেলো হয়ে থাকা তার বাচ্চা বউয়ের দিকে। মেয়েটা বোধহয় একটু বেশিই ক্লান্ত। আবারও ঘুমিয়ে পরেছে। আশিয়ান ভাবে সে আগে ফ্রেশ হয়ে আসুক তারপর হায়া’কে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ডাক দিবে না হয়।

যেই ভাবা সেই কাজ। আশিয়ান একটা ট্রাউজার আর টি-শার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। রাত একটা বাজে সে আধা ঘণ্টা লাগিয়ে শাওয়ার নিয়ে বের হয়। মাথার চুল মুছে এগিয়ে আসে হায়া’র কাছে। হায়া’র একপাশে হাত রেখে তার দিকে ঝুঁকে মৃদু স্বরে বলে উঠে–

—হায়া, এই সোনা, উঠো। ফ্রেশ হয়ে এসে আবার ঘুমিয়ো। উঠো সোনা।

আশিয়ানের ডাকাডাকিতে হায়া’র ঘুম ভেঙে যায়। চোখ খুলে আশিয়ানের হালকা ভেজা মুখটা দেখে হায়া কেমন একটা ঘোরে চলে যায়। যতই রাগারাগি করুক হায়া আশিয়ানের উপর, কিন্তু সে অস্বীকার করতে পারবে না একসময় ভালোলাগার পুরুষ ছিলো এই আশিয়ান তার। হয়ত বা ভালোবাসারও। কিন্তু আশিয়ানের একটা কাজের জন্য হায়া আজ তাঁকে সহ্য করতে পারে না।

হায়া নিজের একটা হাত বাড়িয়ে আশিয়ানের গাল স্পর্শ করে। বৃদ্ধাঙ্গুল দ্বারা চাপ দাঁড়িওয়ালা গাল টায় স্লাইড করতে থাকে।

আশিয়ান তো হায়া’র এহেন কাণ্ড অবাক হয়ে যায়। যেই মেয়ে একটু আগে তাঁকে নিজের কাছে দেখে চিৎকার দিয়ে শ্বশুর শ্বাশুড়িকে নিয়ে এসেছে,,সেই মেয়ে এখন এমন আদুরে স্পর্শ করছে। আশিয়ান অবাক হলেও কোন ওভার রিয়েক্ট করে না। সে দেখতে চায় হায়া কি করতে চাইছে তার সাথে।

হায়া আশিয়ানের দিকে তাকিয়ে ঘোরের মধ্যেই বলে–

—আপনি ভীষণ সুন্দর আশিয়ান ভাই।

হায়া’র প্রশংসায় আশিয়ানের চিত্ত আনন্দে উল্লাস করে উঠে। কিন্তু পরক্ষণেই তা ফিকে হয়ে যায় শেষের “ভাই” ডাকটা শুনে। বউ কিনা জামাইকে ভাই ডাকছে। তাহলে তাদের সন্তান তো তাকে বাবা না ডেকে মামা ডাকবে। তার এত কষ্টের ফল সন্তানরা নাকি তাকে মামা ডাকবে,,এই কষ্ট আশিয়ান কই রাখবে?

আশিয়ান নিজের গালের উপর রাখা হায়া’র হাতটার উপর হাত রাখে। তারপর হাতটা মুখের কাছে নিয়ে এসে তাতে নিজের ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ দেয়। আবেশে হায়া চোখ বন্ধ করে ফেলে। স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া প্রথম স্পর্শ ছিলো এটা। ভীষণ সুন্দর ও স্নিগ্ধ।

আশিয়ান হাস্কি স্বরে বলে–

—আমার থেকেও তুই বেশি সুন্দর বউ। একদম জীবন্ত পুতুল। মনে হয় তোকে সাজিয়ে গুছিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজের সামনে বসিয়ে রেখে দেখি। আমার আদুরে ননীর পুতুল।

কথাটা শেষ করে আশিয়ান আরেকটু এগিয়ে এসে হায়া’র ললাটে নিজের পুরুষালী ঠোঁটের ঈষদুষ্ণ আদর দেয়। স্পর্শটার স্থায়ীত্ব ছিলো বেশ কিছুক্ষণ। হঠাৎই হায়ার ধ্যাণ ফিরে। সে কি করছিলো বুঝতে পেরে লজ্জায় তার কায়া কেঁপে উঠে। সেই সাথে নিজের উপর রাগও হয়। ফট করে চোখ খুলে আশিয়ানকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

আশিয়ান হতভম্ব হয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেলে হায়া তটস্থ পায়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ধড়াম করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। আশিয়ান হা করে তাকিয়ে থেকে পুরো বিষয়টা প্রত্যক্ষ করে। হায়া ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে সেটার সাথে পিঠ ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। নিজেকে থাপড়াতে ইচ্ছে করছে তার। কেন সে আশিয়ানের গালে হাত রাখলো? কমপ্লিমেন্টও তো দিলো। ধুরু!

হায়া দরজা থেকে সরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজের বিধ্বস্ত প্রতিবিম্ব দেখে এলিটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। ভাগ্যের প্রতি তার ভীষণ অভিযোগ করতে ইচ্ছে করে। কেন কিছু না করেও তাকেই সবসময় কষ্ট সইতে হয়? পুরানো কিছু কথা ভাবতে ভাবতে হায়া’র চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরে।

হায়া নিজের অশ্রু নিজেই মুছে নেয়। আয়নার দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে নিজেকে নিজেই বলে–

—এত সহজে ভেঙে পরলি? এই তোর ওয়াদা ছিলো নিজের কাছে? তুই না বলেছিলি ওই লোককে দেখিয়ে দিবি তুই তাকে ছাড়াই ভালো আছিস? শুন হায়া, ঐ ব্যক্তি সাধারণ পুরুষ না। ভীষণ মায়াময় একজন পুরুষ। খুব সহজেই তোকে আবারও মায়ায় ফেলে দিবে। এমনটা তুই হতে দিবি না। তোকে অপমান করার শোধ নিতে হবে। এর আগে কিছুতেই ধরা দেওয়া যাবে না তাকে।

কথাগুলো বলে নিজেকে নিজেই শাসায় হায়া।

শব্দসংখ্যা~১৫২৪
~চলবে?