#প্রেমস্পৃহা
#পর্ব_০৩
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
বিয়ের পর্ব শেষ হতেই আযরান আর রোজকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যেই রওনা হয়েছিল আয়শানরা। অতএব মধ্যেরাতে এসে বাড়ি পৌঁছাল। বাড়ির ভেতর প্রবেশ করেই আয়শান -আযরান দুইজনেই সমান তালে ডাকল। দুই ভাইয়ের ডাক শুনে ততক্ষনে বাড়ির বাকি সদস্যরা ঘুম ছেড়ে উঠে এখানে হাজির হতে বাধ্য যেন। সবাই-ই এল। আজহার খান এসেই আয়শানকে বলে উঠলেন,
“ মাঝরাতে এমন ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছো কেন আয়শান? সমস্যা কি তোমাদের? ”
রোজকে তখনো চোখে পড়েনি কারোরই। কারণ রোজ আযরানে পেঁছনে। দেখাই যাচ্ছে না মেয়েটাকে। আযরান বড্ড উৎসুক হয়ে উত্তর করলেন আজহার খানকে,
“ খান বাড়ির দ্বিতীয় ছেলে বিয়ে করেছে। সবাইকে এই বিষয়টা না জানিয়ে তো বাসর কম্প্লিট করতে পারব না বড়আব্বু। তোমরা তোমাদের পুত্রবধূর মুখটা দেখবে না?”
আজহার খান যেন দুই এ দুই এ চার মিলিয়ে ফেললেন মুহুর্তেই। ততক্ষনে আযরানের বাবা এগিয়ে এসে দ্রুত বিস্মিত স্বরে বলল,
“ কি? বিয়ে করেছো? আযরান! খানবাড়ির ছেলেরা সব কি তোমরা এভাবে হুটহাট বিয়ে করেই বাড়িতে বউ তুলবে? আমাদের কি কোন অধিকার নেই! ”
আযরান চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। বলে,
“ ক্ষতি কি আব্বু? তোমরা যদি ছেলেদের পছন্দের ব্যাপারে টুকটাক খেয়াল রাখো, তাহলে তো আর এমনটা হয় না। বাধ্য হয়ে আমাদেরই হুটহাট বউ নিয়ে আসতে হয়৷ তোমরা বুঝলে তো এটা আর হয় না!”
আযরানের বাবা ছেলের এমন কথা শুনে বিরক্ত হলেন যেন। শাসিয়ে বললেন,
“আযরান। কার সাথে কথা বলছো ভুলে যাচ্ছো? ”
” একদমই নয়। ”
আজহার খান ততক্ষনে এগিয়ে এলেন। আয়শানকে ইঙ্গিত দিয়ে বললেন,
” তুমি বোধহয় ভুলে গিয়েছো তোমার বিয়ে নিয়ে আমি কারোর কাছে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ ছিলাম আমি আয়শান। অথচ তুমি? সেই প্রতিশ্রুতির কোন মূল্যই দিলে না। তোমার কাছে সেসব প্রতিশ্রুতির কোন মূল্য না থাকলেও আমার কাছে আছে। তুমি নিশ্চয় জানো আযরানের বিয়ে নিয়েও আমি ঐ একই মানুষটার কাছেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম? আমার একবার উচিত ছিল প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের আগে তাদের জানানো।যদিও আমি জানি তোমরা… ”
আযরান মুহুর্তেই ফট করে উচ্ছাস নিয়ে শুধাল,
“ আমরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিনি তাই তো বড় আব্বু? কিন্তু এবারে প্রতিশ্রুতি ঐ লোকটা ভেঙ্গেছে বড় আব্বু! বারবার বলেছিলাম তোমার বুড়ো বন্ধুকে, যাতে ছোট মেয়েটা অন্য কোথাও বিয়ে না দেয়! ”
আযরানের কথা শুনে তার মা অল্প হাসল যেন। এগিয়ে আজহার খানকে বললেন,
“ তাই তো! ওরা জানিয়েছে আমাদের? আমার পুত্রবধূকেই অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দিবে? এত সাহস!অতো মহান সাজবেন না বড়ভাই। আমি আপনার এই মহানতার বিরুদ্ধেই যাচ্ছি। আমাদের আয়জানটার কথা ভাবুন? পাগলের মতো ভালোবেসেছিল। উনি শুধু উনার মেয়ের ভালোবাসাটাই দেখেছেন!আমাদের আয়জান কি ঠুনকো নাকি? ”
আজহার খান এবারে কিছু বললেন না। মুখ গম্ভীর করে রাখলেন। আয়শান ততক্ষনে এগিয়ে এল। রোজকে বাবার সামনে দাঁড় করিয়ে বাবার হাত মুঠো করে ধরে বললেন,
“ আব্বু, আমরা এবারে সত্যিই প্রতিশ্রুতি ভাঙ্গিনি। যার সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলে তার মেয়েকেই আযরান বিয়ে করে এনেছে ! ”
আজহার খান দ্রুত শুধালেন,
“ রোজ! ”
আয়শান আশ্বাস দিয়ে বলল,
“ হ্যাঁ, রোজ! ”
আজহার খান নরম চোখেই চাইলেন। রোজকে তারা মেয়ের থেকে কম কিছু দেখেননি। রোজ, ডেইজি, তুলি, সবাই সমান ছিল! আজহার খান ভাঙ্গা স্বরে শুধাতে লাগলেন,
“আম্মাজ…
বাকিটা বলার আগেই রোজ দ্রুত টলমলে চোখে চেয়ে বলল,
“চাচ্চু? কেমন আছো? ”
দ্রুত উত্তর এল,
“ ভালো, ভালো! আমার মা টাকে দেখে ভালো না থেকে পারি? আযরান? রোজকে নিয়ে ঘরে যা। ও কেঁদে ফেলবে যেন। বিয়ে যখন করেছিস তখন পার্ফেক্টলিই ওর দায়িত্ব নিবি। বাকিসব আমি আর আয়শান মিটিয়ে নিব।”
আযরান ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
কি মিটিয়ে নিবে?
আয়শান ঘাড় কাঁত করে।আযরানকে বলে,
“তোর শ্বশুড় মহাশয় অলরেডি থানায় পৌঁছে গেছে আযরান। খুব সম্ভবত আজকের রাতের মধ্যেই পুলিশ নিয়ে হাজির হবে দেখবি! ”
আযরান আৎকে উঠার ন্যায় বলল,
“কি সাংঘাতিক! নিজের মেয়ে জামাইকে আসামি বানিয়ে দিতে চাইছে। ”
আয়শান হেসে বলে,
“ আসলেই তো আসামি। তার মেয়েকে কিডন্যাপ করলি তুই। ”
আযরান কেমন করে যেন চাইল। পরমুহুর্তে এই আয়শানের বউ তুলির দিকে চেয়ে বলল,
“ তুমি যে আমাদের তুলিটাকে জোর করে ধমকেধামকে বিয়ে করে ফেললে? ”
আয়শান হাসল। ভাইকে বলল শুধু,
“ সবকিছুতেই আমায় ফলো করা ব্যাটা! যা ঘরে যা।”
.
আয়শান ঘরে এল অনেকটা সময় পরই। বাবার সাথে কিছু আলোচনা সেরে। ভেবেছিল তুলি ততক্ষনে ঘুমিয়ে পড়েছে। আয়শান তা ভেবেই ফ্রেশ হয়ে ঘুমোতে এল। আলো নিভিয়ে আলতো করে তুলিকে জড়িয়ে নিয়ে চোখ বুঝতে আচমকা কানে এল তুলির চিকন গলার আওয়াজ,
“ আমায় বিয়ে কেন করেছিলেন আয়শান ভাই? কি প্রয়োজন পড়েছিল যে আমায় বিয়ে করতেই হলো? ”
আয়শান হাসে। ওভাবেই তুলিকে জড়িয়ে রেখে উত্তর করল,
“ তুলি? তুই নিজেই আস্ত এক প্রয়োজন আমার। ”
তুলি স্থির, স্বাভাবিক ভাবেই বলল এবারে,
”আমি কখনোই আপনার প্রয়োজন হতে চাইনি আয়শান ভাই। ”
“ তাহলে কি হতে চেয়েছিলি? ”
“ কিছুই না। ”
আয়শান দ্বিমত করল। মুহুর্তেই জানাল,
“ উহ, ভুল! চেয়েছিলি, কিন্তু প্রকাশ করিসি নি। ”
তুলি চুপ থাকল কিয়ৎক্ষন। চেয়েছিল? হ্যাঁ চেয়েছিল। এই চাওয়াটাই অপরাধ? তুলি তো কোনদিনই প্রকাশ করেনি এই মুগ্ধতার কথা। কোনদিনই জানতে দেয়নি। কোনদিন ভাই ব্যাতীত কথাও বলে নি। তুলি চুপ থাকল। অতঃপর অনেকটা সময় পর বলল,
“ আমার চেয়েও আপনাকে বেশি চেয়েছিল ডেইজি। ”
আয়শান ভ্রু কুঁচকায়। ঘুমঘুম ভাবটা এবার কেঁটে গেল তার। বলল,
“ তো? ”
“ ডেইজি আপনাকে পাগলের মতো ভালোবাসত আয়শান। কেন ওর ভালোবাসাকে মূল্য দেননি বলুন? আপনার জন্য যোগ্য,পার্ফেক্ট পাত্রী ছিল ডেইজি। অস্বীকার করতে পারবেন তা? ”
“তো?”
তুলি চুপ থাকল আবার ও। রুদ্ধ হয়ে আসা স্বরে ফের বলল,
“ আমি আপনার সাথে মানিয়ে উঠতে পারছি না। সত্যিই পারছি না। আমার প্রতি মুহুর্তে মনে হচ্ছে আমার কারণে ডেইজি তার ভালোবাসা পায়নি। এতোটা ভালোবেসেও…”
আয়শানের স্বর এবারে কিছুটা দৃঢ়ই শোনাল। শক্ত স্বরে বলল,
“ বারবার এতোটা ভালোবাসত, পাগলের মতো ভালোবাসত এগুলো বলে কি বুঝাতে চাইছিস? ”
তুলি শুধাল,
“ এটাই যে ওর এই সমুদ্র সমান ভালোবাসাকে আপনার গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। ”
আয়শান তুলিকে ছেড়ে দিল এই পর্যায়ে। চিৎ হয়ে শুয়ে উত্তর করল,
“ তুই বোধহয় ভুলে যাচ্ছিস, ডেইজিকে আয়জান পাগলের মতে ভালোবাসত তুলি। এই মাঝরাতে এসব পুরোনো আলোচনা বাদ রাখি? ঘুমোতে দে আমায়। ক্লান্ত। ’
তুলির চোখ আচমকায় টলমল করল। শুধু এই কারণটার কারণেই আয়শান ডেইজিকে বিয়ে করেনি। ছোটভাই ভালোবাসত বলে। ত্যাগ দেখিয়েছে সে? তুলি জানে,খুব ভালো ভাবেই জানে যে আয়শান ডেইজিকে ভালোবাসে। তুলির টলমলে চোখ বেয়ে এবারে পানি গড়িয়ে গেল। কিয়ৎক্ষন চুপ থেকে সে বলল,
“ আয়জান ভাই ডেইজিকে ভালো না বাসলে আপনি অবশ্যই ডেইজিকে বিয়ে করতেন আয়শান। আমি জানি, আপনি ডেইজিকে ভালোবাসেন। অথচ আমায় দাবার গুঁটি বানিয়ে প্রত্যেকের চোখে খারাপ বানিয়েছেন। আমাকে প্রত্যেকটা মুহুর্তে আপনি অপরাধবোধে মারছেন। অথচ আমার দোষ নেই, সত্যিই দোষ নেই। শুধু আপনাকে পছন্ত করেছিলাম যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও, এটাই অপরাধ! ”
আয়শান ফের ফিরল বউ এর দিকে। আবারও জড়িয়ে নিয়ে গম্ভীর আওয়াজে বলে উঠল,
“ তুলি? আমি তোর চোখের পানি সহ্য করতে পারি না। জানিস তুই, তবুও কেন আমার দুর্বলতায় আঘাত করিস? ”
তুলি মেনে নিল নিজের সব দুঃখ, সব কষ্ট! অভিযোগ করে লাভ কি? সত্য যা, তা সত্যিই! তুলি কাউকেই দোষ দেয় না। কাউকেই না। শুধ চোখ বুঝে নিয়ে শান্তস্বরে বলল,
“ আর করব না। ঘুমান। ”
.
রোজ আযরানের ঘরে এসে প্রথমেই ফুলে সজ্জ্বিত একটা ঘর পেল। এই বাড়ির কেউই নাকি তেমন জানে না বিয়ে নিয়ে, অথচ বাসর ঘর সাজিয়ে ফেলল? রোজ ভ্রু কুঁচকে তাকাতে থাকে। এক পর্যায়ে চোখে পড়ে বিছানায় পড়ে থাকা কিছু মেয়েলি টিশার্ট, প্লাজু, থ্রিপিস সহ অনেক পোশাক। রোজ উল্টেপাল্টে দেখল। অতঃপর আযরানকে দেখা মাত্রই বলল,
“আযরান খান এর ঘরে দেখছি মেয়েলি পোশাক আশাক ও রাখেন? দারুণ তো ব্যাপারটা! তো কয়টা মেয়েকে ঘরে এনেছেন এই পর্যন্ত আযরান?”
আযরান ঠোঁট বাঁকাল। উত্তরে বলল,
“ কয়টা মেয়েকে আনতে চাস জান? তুই চাইলে আনব এর পর থেকে। ”
রোজ মুখ ভেঙ্গায়। বলে,
“ পরে আনলে পরেই জামাকাপড় আনতেন।”
আযরান সোজাসুজিই দাঁড়াল। ঝুঁকে চোখ রাখল রোজের চোখে। অতঃপর বলল,
“ এই শাড়ি পরে নিশ্চয় সারা রাত কাঁটবে না তোর রোজ? ঘুমাতে পারবি এই শাড়ি নিয়ে? ”
রোজ ভ্রু কুঁচকায়। বলে,
“ আমার জন্য নাকি?আমার বিষয়ে ভাবছেন? বাহ! ”
আযরান হেসে বলল,
“ তোর মতো অমানুষ নই আমি জান। ”
“ আপনি মানুষ? কোনদিক থেকে? ”
আযরান ফের হেসে বলল,
“ যেদিক থেকে আমি তোর প্রিয়পুরুষ ছিলাম! ”
রোজ ছোটশ্বাস ফেলে। বলে,
“ এখনোও প্রিয়পুরুষ আছেন তা ভাবছেন নাকি? ”
আযরান উত্তর করতে নিবে ঠিক তখনই কল এল।আযরান পকেট থেকে ফোন বের করল। এটা রোজের ফোন। তার কাছেই ছিল। অফ করা। একটু আগেই অন করেছিল সে। অতঃপর কল! কলটা যার তার নয় আবার। সায়ানের! তারই বন্ধুর, এবং রোজের সে না হওয়া বরের। আযরান স্ক্রিনে তাকিয়ে বলল,
“ উমম ম! তোর সায়ান কল দিয়ে দিল রে রোজ! ফোনটা এই কারণেই অন করতে চাইনি। ”
রোজ নিজের ফোনটা দেখে দ্রুত বলল,
“ফোন দিন। ”
“খুব তাড়া? খুব ভালোবাসিস নাকি তোর সায়ানকে? ”
রোজ শক্ত গলাতেই বলল,
“ ফোনটা আমায় দিন আযরান ।”
আযরানের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। শাসিয়ে বলে,
“ ওর সাথে কথা বলার জন্য এত তাড়া আমার সামনে দেখাবি না রোজ। ওয়ার্ন করছি আজ। নেক্সটবার হলে তোর সায়ান আর সায়ান থাকবে না। ”
এটুকু বলেই আযরান গলা পরিষ্কার করল। কল রিসিভড করে হেসে হেসে বলল,
“ সায়ান? কনগ্রাচুলেশন তোর না হওয়া বউ আমার সাথে পালিয়ে আসার জন্য। অলসো কনগ্রেচুলেশন ফর মি, বিয়ে করে বউ ঘরে তোলার জন্য। ”
ওপাশ থেকে সায়ান ততক্ষনে দ্রুত বলল,
“ রোজ তোর কাছে? ”
আযরান হাসে কেবল। সায়ান ফের রেগে বলল,
“ কি হলো উত্তর দে, রোজ তোর কাছে?”
আযরান গম্ভীর স্বরে বলল এবারে,
“ ওকে রোজ শুধু আমরা ডাকি। তোর ডাকার রাইটস নেই। ”
সায়ান রেগে আছে। রেগে ফেটে পড়বে যেন এমনভাবেই বলল,
“ তুই আমায় রাইট শিখাতে আসবি না আযরান। মেরে তোর হাত পা ভেঙ্গে দিব, সাহস কি করে হলো তোর রোজকে নিয়ে যাওয়ার? বল?”
আযরান হাসে কেবল। পরমুহুর্তেই দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত করে উত্তর করল,
“ যেভাবে তুই সাহস করলি আমার ফুলে চোখ তুলে তাকানোর। ভাগ্য ভালো তোর যে তোর চোখ উপড়ে ফেলিনি এখনো আমি। বেইমান কোথাকার। তোরা সবকটা বেইমান!”
#চলবে….