প্রেমস্পৃহা পর্ব-৭+৮

0
22

#প্রেমস্পৃহা
#পর্ব_০৭
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

রোজ এই বাড়ি আসার পর বিষয়টা অনেকটা উৎসবমুখরই দেখাচ্ছে এই বাড়ির মানুষদের মাঝে। আযরানের মা দুপুর থেকেই ছেলের বউ এর জন্য বেশ কয়েক পদের রান্না করবেন বলে ঠিক করে নিলেন। আয়শানের মাও কল করে কথা বললেন অনেকটা সময় যাবৎ সবার সাথে। সবার মুখই হাসিখুশি৷আযরানের বাবা এবং বড় আব্বুও তাকে আজ বাড়িতেই থাকতে বলেছে। নতুন বিয়ে করেছে বলে কথা। অফিস গিয়ে কি কাজ? আযরান হাসে কেবল এসব ভেবে। আযরান নিচে বসে মায়ের রান্না দেখেছিল কিয়ৎক্ষন, রোজও আছে। রান্না পারে না, তবে চেষ্টা চালাচ্ছে সাহায্য করার। আযরান হাসে একবার চেয়ে। পরমুহুর্তে উপরে গেল৷ কিয়ৎক্ষন রুমে সময় কাঁটিয়ে আবার ফের যখন যেতে নিবে ঠিক তখনই দেখা গেল রোজ আসছে। আযরান হাসল অল্প৷রোজের ক্লান্ত, ঘামে ভেজা মুখটা ওড়নার কিনারায় মুঁছতে দেখে বলল,

“তোকে পার্ফেক্ট বউ বউ লাগছে জান। তুই কি কোনভাবে সত্যি সত্যিই এ বাড়ির পার্মানেন্ট বউ হয়ে যেতে চাইছিস রোজ? ”

রোজ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। আযরান ততক্ষনে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মুখটা হাস্যোজ্জল!রোজ শুধাল,

“ পার্মানেন্ট বউ বানাননি নাকি? নাকি বিয়ের সময় নিদির্ষ্ট কোন সময়কাল লিখিয়েছিলেন? ”

আযরান ঝুঁকে। রোজের কপালের লেগে থাকা আটার মতো সাদা অংশটা হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে দিতে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,

” হু,লিখিয়েছি তোর শেষ নিঃশ্বাস অব্দিই তুই আমার বউ।আমি মরে গেলেও তুই আমার বউই থাকবি রোজ। অন্য কারোর হতে পারবি না তোর শেষ নিঃশ্বাস অব্দি। ”

রোজ তাকাল স্থির চোখে। শান্তভাবে বলল,

“ মেনে নিলাম। ”

আযরান বিস্মিত হলো যেন এমনভাবে চাইল। রোজ তর্ক করল না? ঝগড়া করল না? বলল,

“এত সহজেই? আশ্চর্য! ”

রোজ এবারে কিছুটা ফোঁস করে উঠল। বলল,

“ না মানার তো কিছু নেই আযরান জোর করেই হোক বা নিজ ইচ্ছায়, বিয়ে তো আপনাকেই করেছি।”

“ অথচ দুদিন আগেও তুই সায়ানের বউ হতে চেয়েছিলি। ”

রোজ রেগে তাকায় যেন। অনেকটা সময় নিয়ে সরে গিয়ে বসল বিছানার এককোণে। অতঃপর সায়ানের হয়ে বলল,

“ সায়ন যথেষ্ট ভালো আপনার থেকে আযরান। আপনার মতো ভরা অনুষ্ঠানে বন্ধুর রক্ষিতা বলে অপমান করেনি আমায়। আপনি জানেন? লাস্ট ছয়মাস আপনার প্রতি আমার ঘৃণাই হতো কেবল আমার। ”

আযরানের হুট করেই রাগ লাগল যেন। সায়ানকে সে সহ্য করতে পারে না। একসময়কার প্রাণপ্রিয় বন্ধু হলেও আজকাল এই নামটা সে শুনতেই পারে না যেন। তার উপর রোজের মুখ থেকে হলে তো আরো নয়! বলল,

“ আর সায়ানের প্রতি ভালোবাসা আসত? ”

“ সায়ানকে আমি বিশ্বাস করতে পারতাম। ”

আযরান তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসল। বলল,

“ আমিও করতাম। অতঃপর ও আমার বিশ্বাসকে টুকরো টুকরো করে ভেঙ্গে ফেলল তোর জন্য। পনেরো বছরের বন্ধুত্ব ভেঙ্গে গেল রোজ। আমি তোদের দুইজনকেই ক্ষমা করব না।বেঈমান তোরা।”

“বারবার অন্যের দিকে আঙ্গুল তুলবেন না, বেঈমান বলবেন না বারবার। আপনি কি মহান কাজ করেছেন আযরান? করেছেন কিছু? ”

আযরান এই পর্যায়ে উত্তর করে না। তীব্র রাগ নিয়ে চুপ করে দাঁড়ায় সে। রোজ ছোটশ্বাস ফেলে ফের শক্ত গলায় বলে,

“ আমার এখনও মনে হচ্ছে আমার সায়নের সাথে কথা বলা উচিত বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কিন্তু আপনার কারণে হচ্ছে না।আপনি নিশ্চয় এখন কথা বললেও বেঈমান বলবেন? কিন্তু আপনি আসলে পরিস্থিতি বুঝ… ”

রোজকে বাকিটা বলতে না দিয়ে আযরান আচমকা ভ্রু বাঁকায়। বলে,

“ আমার কারণে? আমার কারণে কথা বলতে পারছিস না ? ”

রোজ দ্বিগুণ জেদ নিয়ে বলল,

“ ইয়েস! ”

আযরান হুট করে পকেটে হাত ডুকিয়ে বুক টানটান করে দাঁড়ায়। বলে,

“ ওকে ফাইন! কথা বলবি সায়ানের সাথে, প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে! আমি তোকে আর নিষেধ করব না রোজ।বেঈমানও বলব না, প্রমিজ! ”

এটুকু বলেই সে ড্রয়ার থেকে রোজের ফোনটা আনল। অন করে দিয়ে রোজের হাতে দিয়ে বলল,

“ তোর ফোন।চাইলে গিয়ে দেখাও করে আসতে পারিস জান। আটকাব না আমি। ’

রোজ থমকায়। অল্প কিছুটা সময় ফোনের দিকে তো আযরানের দিকে তাকায়। আয়রান হাসল কিঞ্চিৎ ঠৌঁট বাঁকিয়ে। বলল,

“কল কর জান।”

রোজ করল না কল। ওভাবেই আছে। আযরান ফের মুখ নামিয়ে ফিসফিস স্বরে

“ কর কল সায়নকে! ”

এবারেও রোজ উত্তর করে না যেন। আযরানের গলাটা এবার একটু শক্তই শোনাল,

“ কি হলো? কল করতে বললাম তো সায়নকে।”

রোজ ছোটশ্বাস টানে। অতঃপর রাজ কল দিতে দিতে বলল,

“ দিচ্ছি।”

আযরান তীব্র আত্মবিশ্বাস নিয়ে চেয়ে ছিল যেন! কোথাও একটা যেন তীব্র বিশ্বাস ছিল যে রোজ কল দিবে না। অথচ রোজ কল দিল। ফোন কানে তুলল। আযরান কেমন করে বাঁকা হাসল যেন। চোখ বুঝল। অতঃপর চলে যেতে যেতে নিজে নিজেই বিড়বিড় করল,

“ আমায় আবারও কষ্ট দিলি, আবারও কষ্ট দিলি তুই জান। আমার যন্ত্রনা বুঝলি না। একটাবারও বুঝলি না তুই। ”

.

তুলির সাথে রোজের একটা সময়ে খুব ভালোই একটা সম্পর্ক ছিল। খুব সুন্দর মিষ্টি একটা সম্পর্ক। রোজ, ডেইজি এবং তুলি প্রায় একই বয়সের হওয়াতে তিনজনের মাঝেই বন্ধুদের মতোই সম্পর্ক ছিল। যদিও ডেইজি তুলিকে নিয়ে একটু ইনসিকিউরড ফিল করত। ওরই কেন জানি না মনে হতো আয়শান তুলিকে একই নজরে দেখে না। এই নিয়েই ডেইজি একটু কম পছন্দ করত তুলিকে। শেষ দিকে অবশ্য সম্পর্কটা আরো বিচ্ছিরি হয়। এবং শেষ যেদিন আয়শান তুলিকে বিয়ে করে আনল সেদিন রোজের সাথেও সম্পর্কটা খুব বিচ্ছিরি হলো। রোজ রেগে কতগুলো কথা শুনিয়ে গিয়েছিল আর তুলি নিশ্চুপে শুনেছিল।রোজ এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জড়তার কারণে সে কথা বলে উঠতে না পারলেও তুলিই প্রথমে কথা বলেছে তার সাথে। এমনকি এখনও আযরানের জন্য চা করে এনেছে। জিজ্ঞেস করছে,

“ রোজ? আযরান ভাই এর চা টা পাঠাল ছোট মামনি।রেখে গেলাম। আর হ্যাঁ, তুই কি নাস্তাটা এখানেই করবি রোজ?”

রোজের কি ভীষণ লজ্জা লাগে। অপরাধবোধ হয়। সেদিনের বাচ্চা রোজ আর আজকের রোজের বুঝদার ক্ষমতায় পার্থক্য আছে। সেদিনকার রোজ আপুকে ভীষণ ভালোবাসত বলেই তুলিকে খুব করে কথা শুনিয়েছিল। অথচ পরবর্তীতে যখন বুঝতে পারল তুলি অথবা আয়শান ভাই কেউই দোষী নয় তখনই তার তীব্র অপরাধবোধ হয়।রোজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ফ্যালফ্যাল করে তুলির দিকে তাকিয়ে থাকতেই তুলি এগিয়ে এল এবারে। শান্ত মিহি স্বরে বলল,

” রোজ? তুই কি আমার সাথে কথা বলবি না? রেগে আছিস এখনও? ”

রোজ এবারে কথা বলার সাহস করল। হুট করেই বলল,

“ তুলি? আমি, আমি তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম সেদিন।রেগে থাকার কথা তো তোর। ”

তুলি হাসল। কেমন নির্জীব হাসি। মনে পড়ে সেদিনকার কথাটা। হুট করে আয়শানের উদ্ভট সিদ্ধান্ত,কাজী অফিসে নিয়ে গিয়ে কিসব বুঝিয়ে এক ধমকে বিয়ে, অতঃপর বাড়ি ফেরার পর ডেইজি সুইসাইড এটেম্প করল দ্বিতীয়বারের মতো। আজহার সাহেবের সাথে কবির সাহেবের ঝামেলা। শুধু রোজ নয়, তুলির সবচেয়ে প্রিয় মানুষ, তার মামনি অর্থ্যাৎ আয়শানের আম্মুও রেগে গিয়েছিল সেদিন। কত কথা শুনাল। অথচ তুলি সত্যিই সেদিন নির্দোষ ছিল। তবুও সে সেদিন থেকে সবার কাছে দোষী। সবার কাছে। একে একে সব প্রিয় মানুষ থেকে দূরে সরেছে সে।বেঁছে নিয়েছে একটা নিষ্প্রাণ জীব। তুলি হেসে বলল

”দোষটা তো আমারই রোজ। ”

রোজ এবারে চুপ থাকল অল্প সময়৷ তারপর ছোটশ্বাস ফেলে বলতে লাগল

“ না, তুই নির্দোষ ছিলি তুলি। আয়শান ভাই এর ও দোষ দেখিনা আমি। সেদিনের আমি আর আজকের আমির বুঝার ক্ষমতাটা ভিন্ন তুলি। আয়শান ভাই আপুর দুর্বলতা বুঝার পর থেকেই আপুকে সতর্ক করেছিল। বলেছিল আয়শান ভাই আপুকে বোনের চোখে দেখে। কিন্তু আপুই বেশি ভালোবেসে ফেলেছিল তুলি। আপুই সবসময় আয়শান ভাইকে পেতে চেয়েছিল, তোকে অপছন্দ ও করত এই কারণে। ইনসিক্যিউরিটি ফিল করত। এরপর যখন আয়শান ভাই একদিন ডেকে নিয়ে বললেন উনি কাউকে ভালোবাসেন তখন আপু সুইসাইড করার চেষ্টা করল প্রথমবার। সেবার আকস্মিক আবেগে ভেসে মেয়ের আবদার রাখতে আব্বুও আজহার আঙ্কেলের কাছে দুই মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব রাখলেন। আজহার আঙ্কেলও না বুঝেশুনে সেদিন রাজি হয়ে গেলেন। ভেবেছিলেন আয়শান ভাই এর তেমন বিপত্তি থাকবে না। তারপর আপুর মানিসক অবস্থা এইসেই চলল। আয়শান ভাই সেসব না ভেবেই নাকোচ করেছিলেন প্রস্তাবটা। আমার এখনো মনে আছে। কিন্তু আপুর পাগলামো দেখে আব্বু পাগলের মতো চাইছিল আয়শান ভাই আপুকে বিয়েটা করুক। করুক বিয়েটা! আসলে আপু আব্বুর বড্ড আদরের মেয়ে তুলি। ছোট থেকে যা চেয়েছে তা পেয়েছে। আর এই আস্ত মানুষটাকে আব্বু দিতে পারল না কেবল তোর জন্য ওটা সেদিন বুঝলাম যেদিন আয়শান ভাই তোকে বিয়ে করে এনেছিল। এর আগ অব্দিও আমি ভেবেছিলাম আপুর সাথে আয়শান ভাই এর বিয়েটা হওয়ার চান্স আছে। কিন্তু সেদিন যখন দেখলাম, তুই, আমার প্রিয় বান্ধবীই আয়শান ভাই এর বউ। রাগ হলো। তার উপর আপু আবারও সুইসাইড এটেম্প্ট করল। অতোসবের মাঝে আমি তোকে সেদিন অনেক কথাই শুনিয়েছি তুলি। পরে ধীরে ধীরে বুঝলাম আমি ভুল করেছি। ভালোবাসলেই পেতে হয় না। অপ্রাপ্তিতেও ভালোবাসা থাকে। যদিও আপু এখনো ভালোবাসে আয়শান ভাইকে। এখনও পাগলামো করে! ”

তুলি ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। এখনোও ভালোবাসে? এখনো চায়? ইশশ! ডেইজি কতোটা ভালোবাসত আয়শানকে। তুলির কষ্ট হয়। ফের আবারও অপরাধবোধে জর্জরিত হয়ে উঠে বসে। বলল,

“ ডেইজি? ওর কাছে অন্তত একবার যদি ক্ষমা চাইতে পারতাম রোজ।এই অপরাধবোধ আর বয়ে নিতে পারি না আমি।”

রোজ হাসল মৃদু। বলল,

“ আমার সেদিনকার ব্যবহারের জন্য ক্ষমা করেছিস তুলি? ”

তুলি বলল,

“ তোর ব্যবহারটা অযৌক্তিক নয় রোজ। ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না এতে। শুধু আমাকে একটু ক্ষমা দিস দয়া করে, নয়তো আমি কোনদিন মরেও শান্তি পাব না রোজ। ”

এটুকু বলেই তুলি পা বাড়াতে নিল। তার হৃদয় ভার লাগছে। রোজ ফের ডাকল,

“ তুলি? ”

“ হু। ”

“ তোকে কেমন প্রাণহীন লাগছে।আমি ভেবেছিলাম তুই সু….”

তুলি চোখ বুঝল। যেতে যেতে বলল,

“ আমি সুখীই রোজ। নিচে আয়, নাস্তা করবি৷ ”

.

তখন রাত। আযরান চোখ বুঝে টানটান হয়ে শুয়ে আছে। রোজ বেলকনিতে বসে। বোধহয় একটু পরই রুমে আসবে। আযরান অপেক্ষা করছিল বোধহয় চোখ বুঝে রেখেই। অতঃপর রোজ এল। ডাকল,

“ আযরান?”

আযরান চোখ বুঝে রেখেই উত্তর করল,

“ হু।”

“আপনি সায়ানকে ইনভাইট করেছেন কাল ? কেন?”

আযরান ওভাবে চোখ বুঝেই হাসে।চোখ খুলে বলল,

“ভাবলাম তোর বোধহয় ঐ শু’য়োরকে দেখতে ইচ্ছে করছে। ভদ্রতার খাতিরে হয়তে দেখা করে আসতে পারছিস না৷ এর থেকে ভালো হয় বাড়িতর ডেকে নেওয়া। তোদের দেখা হয়ে যাবে।”

“হু?”

আযরান এবারে উত্তর করে না। চুপ থাকে। ফের চোখ বুঝে। অতঃপর চোখ বুঝে থাকা অবস্থায় কিয়ৎক্ষন পর বলে,

“ ঘুমাবি না? নাকি আমি পাশে ঘুমাব বলে ঘৃণায় ঘুমও নামবে না? আমায় তো ঘৃণা করিস। আর ওকে বিশ্বাস।বেঈমান সবকয়টা।”

রোজ কপাল কুঁচকাল। বলল,

“ জেনেশুনে বেঈমানকে বিয়ে করেছেন কেন? ”

” কারণ বেঈমানটা মুখে না বললেও এখনও আমায় ভালোবাসে।”

রোজ হেসে বলল,

” বেঈমানদের ভালোবাসাও বেঈমানি করে আযরান। জানেন না? ”

কথাটা বলে খাটের একপাশে খালি জায়গাটায় সে শরীর এলিয়ে দিল।রোজের আলোতে ঘুম হয় না। কাল রাতেও ঘুমায়নি সে। সে কারণেই হাত বাড়িয়ে আলো নিভাতে গিয়ে শুনল,

“ করে দেখাক কেবল,প্রাণ নিয়ে নিব। ”

রোজ আলো নিভাল। বলল,

“ আপনার কি মনে হয়?আমি চুপ করে থাকব? ”

আযরান আচমকায় অন্ধকারে রোজকে জড়িয়ে নিল। নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিয়ে কপালে শীতল চুমু আঁকল। ফিসফিস করে বলছিল,

“ তোর মরণ হলে আমার মরণ ও বাধ্যতামূলক জান।ঘুমা, শুভরাত্রি। ”

রোজ শীতল কোন বরফখন্ডের ন্যায় জমে গেল যেন আকস্মিক জড়িয়ে ধরাতে। হিম এক অনুভূতি বয়ে গেল শরীরময়। তখনও তার চোখজোড়ায় বিস্ময়। যে মানুষটা মুখে বেঈমান বলে, শেষ ছয়মাস এতোটা কষ্ট দিয়েছে সে মানুষটাই এভাবে জড়িয়ে নিতে পারে? এভাবে জড়িয়ে কপালে চুমু দিতে পারে?

.

মধ্যরাত। তুলির হাতে একটা ডায়েরী! ডায়েরীটা সে নতুন দেখছে না আজ। বহুদিন হলো সে এই ডায়েরিটা মেলে দেখে। বিড়বিড় করে। তুলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ডায়েরীর ভেতরে থাকা ডেইজির হাম্যোজ্জ্বল ছবিটা অনেকক্ষন দেখল সে। একটাই ছবি এই ডায়েরীতে। ডেইজির ছবি। কি সুন্দর মেয়েটা। কি সুন্দর এই মেয়েটার হাসি। তুলি মৃদু হাসলও ছবিতে তাকিয়ে। পরমুহুর্তেই কেমন যেন একটা কষ্ট অনুভব করল। বিড়বিড় করে বলল,

” ডেইজি তোমার সাথে আমার কেন জানি না কখনোই খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে উঠেনি। তুমি বোধহয় আমায় কম পছন্দ করতে। কিন্তু এটা জানো কি? তুমি যে বিষয়টার জন্য আমায় কম পছন্দ করতে সে বিষয়টা আসলে তুমিই পেয়েছো ডেইজি। উনার সুপ্ত ভালোবাসা তোমার জন্য ছিল, আমার জন্য নয় ডেইজি। বিশ্বাম করো, আমি সত্যিই এসব নিজে ঘটাইনি ডেইজি। আমি করিনি। আমি দোষী নয় ডেইজি। উনি আমাকে বিয়ে করেছেন কেন আমি জানি না, কিন্তু সত্যি বলছি ডেইজি আমি উনাকে কেড়ে নেইনি তোমার থেকে। সত্যিই কেড়ে নেইনি। আমি জানতাম তুমি তাকে ভালোবাসো।অসম্ভব রকম ভালোবাসতে। শুনেছি এখনও বাসো। আমায় ক্ষমা করে দিও ডেইজি। আমি এই অপরাধবোধ কতদিন বইব বলো?ক্ষমা করে দিও…..এই কষ্টটা আমি আর বইতে পারছি না। সত্যিই পারছি না ডেইজি।”

#চলবে…

#প্রেমস্পৃহা
#পর্ব_০৮
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি

সকাল বেলায় রোজের ঘুমও ভাঙ্গল আযরানের বাহুবন্ধনে থেকেই। রোজ প্রথমে উশখুশ করল। আযরানের হাতটা সরিয়ে উঠতে চাইল খুব সাবধানে। অথচ পারল না। আযরান আগের মতোই জড়িয়ে নিয়ে ফিশফিশ স্বরে বলল,

” ঘুমা জান, সকাল হতে এখনও দেরি। ”

রোজ ভ্রু কুঁচকে নেয়।সকাল হতে দেরি? অথচ ঘড়িতে স্পষ্ট এখন সকাল ছয়টা দশ মিনিট। বাইরে আলো ফুটেছে।যার দরুন জানালা দিয়ে বাইরে থেকে আলো এসে পড়েছে কিছুটা। রোজ চোখ ছোটছোট করে তাকায় উল্টোদিক ফিরে। আযরান ঘুমোচ্ছে, একদম বাচ্চাদের ন্যায়। চুলগুলো এসে পড়েছে কপালে। এলোমেলো। সুন্দরই দেখাচ্ছে দৃশ্যটা। রোজ আরও একবার ভাবে, এই মানুষটাকে সে ভালোবেসে আসছে কয়েক বছর আগ থেকেই। একদম কিশোরী বয়স থেকে। এই মানুষটাকেই অনুভূতি সব সপে দিয়েছিল সে। শুরুর দিকে এই অনুভূতিটা কোন একদিন পূর্ণতা পাবে ভরসা থাকলেও এই দুইবছর তার কোন অর্থই ছিল না। এই মানুষটাকে নিয়ে এই দুইবছর সে স্বপ্ন দেখেনি, কতবার যে ভুলার চেষ্টা করেছে। অথচ ভুলতে পারল কোথায়? এই যে আজ এই সকালটা সে দেখবে, আযরানকে এতোটা কাছ থেকে দেখতে পাবে ভেবেছিল সে এই দুইবছর? একবারও ভাবেনি৷ রোজ ছোটশ্বাস ফেলে। উঠার জন্য বলল,

“ চোখ খুলে দেখুন, সকাল হয়েছে। ”

আযরান চোখ খুলে না। বরং ছোট বাচ্চার ন্যায় গুঁটিশুঁটি হয়ে জড়িয়ে নিয়ে বলে,

“ আরেকটু ঘুমাই রোজ। মনে হচ্ছে বহুদিন পর আমি ঠিকমতো শান্তিতে ঘুমাচ্ছি।ঘুমোতে দে একটু। ”

রোজ ফোঁস করে উঠে যেন। শুধাল,

“ আপনাকে ঘুমাতে নিষেধ করেছি আমি? ”

আযরান এবারে কথা বলে না। ঘুমিয়েই থাকে যেন ওভাবে। চোখ বুঝে। রোজ ফের উঠার জন্য নড়চড় করে। আযরানের বাহুবন্ধন ছাড়াতে কিছুটা ধাক্কা দিয়েই বলল,

“ ছাড়ুন, এভাবে অস্বস্তি লাগছে আমার।ছাড়ুন। ”

আযরানের বুকে আঘাতটায় লাগল। ব্যাথায় মুখচোখ কুঁচকে নিল সে। ব্যাথায় আর্তনাদ করে,

” আহ…”

রোজের হঠাৎই খেয়াল হলো আযরানের বুকে সে নিজেই আঘাত করেছিল। এখন আবারও সে নিজেই ব্যাথা দিল। রোজ দ্রুত ব্যাকুল কন্ঠে শুধাল

” স্যরি, স্যরি, আ আমি..
দেখি, বেশি ব্যাথা পেয়েছেন? ”

এটুকু বলেই সে আযরানের শার্টের হাত রাখতে নিল। আযরান হাসে। রোজের মুখে চিন্তা ফুটে উঠেছে। আযরানের ব্যাথা লাগলে রোজ এখনও চিন্তা করে ? আগের মতো? আযরান হেসে বলল এবারে,

“ আঘাতও তো তুই-ই দিলি জান। ব্যাথাও দিলি। আমি সইতে পারব, সমস্যা নেই।তোরই তো দেওয়া… ”

রোজ বড্ড অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়। নরম কন্ঠে বলল,

“ আমি আপনাকে ইচ্ছে করে ব্যাথা দেয়নি। ”

আযরান বলে,

“ ইচ্ছে করেই তো দিস। ”

রোজ কপাল কুঁচকে ফেলে। জিজ্ঞেস করে,

” কখন?”

“ বহুক্ষেত্রে, বহুসময় তুই আমায় ইচ্ছে করেই হার্ট করিস।”

রোজও বিপরীতে বলল এবারে,

” আপনিও তো অনেকক্ষেত্রে আমায় ইচ্ছে করেই হার্ট করেছেন আযরান। অনেকভাবে অপমান করেছেন। ”

“ প্রতিশোধ নিচ্ছিস তার? ”

রোজ কাটকাট কন্ঠে বলল,

“ না। ”

“ তাহলে? ”

রোজ ছোটশ্বাস ফেলে। বলে,

” কিচ্ছু না, বেশি ব্যাথা পেয়েছেন? ”

আযরান হাসে। এবারে অন্য পাশ ফিরে চোখ বুঝে সে। বলে,

” ঘৃণাই তো করিস আমায়, ব্যাথার এত খোঁজ নিয়ে লাভ কি বল?”

রোজ এর উত্তর জানে না? জানে। কিন্তু উত্তর দিবে না সে। আযরান কি রোজকে এতোটাই নির্দয় ভেবে নিয়েছে যে সে আঘাত পেলে রোজ খোঁজ নিবে না?

.

তুলি ভার্সিটি যাওয়ার জন্য বেড়িয়েছে। রিক্সার জন্য রাস্তার মোড়ে কিয়ৎক্ষন দাঁড়াল সে।সাথে আছে আযরানের বোন কুহুও। ও কলেজে পড়ে।কোচিং এ যাবে ও এখন। অন্যসময় হলে বাবা বা ভাই দিয়ে আসত। আজ আযরান এখনো ঘুম থেকে উঠেনি, বাবাও চলে গিয়েছে এই কারণে তুলির সাথেই যাচ্ছে। তুলিকে অবশ্য বারবার বলা হলো যাতে সাবধানে ওকে কোচিং এ নামিয়ে দেয়। তুলি হেসেই দায়িত্বটা নিল। আগে আয়শানের আম্মু মানে তার মামনি থাকতে তাকেও কেউ ভার্সিটি নামিয়ে দিয়ে আসতে গেলে বারবার বলত যাতে সাবধানে ওকে ভার্সিটি অব্দি পৌঁছে দেয়। অথচ তুলি ছোট থেকেই মোটামুটি নিজের সব নিজে করতে পারত, নিজের খেয়াল নিজেই নিতে পারত সে, ভার্সিটিও একা একাই যাওয়া আসা করত। যাওয়ার সময় মামনি কতবার যে বলত সাবধানে যেতে। তুলির ভীষণ মনে পড়ে মামনিকে, ইচ্ছে হয় একবার জড়িয়ে ধরতে আগের মতো। অথচ কতদিন হয়ে গেল সে মামনির সাথে কথা অব্দি বলতে পারল না। তুলির চোখ টলমল করে যেন। কুহু সামনে থাকাতে অতি সাবধানে কান্না গিলে নিল সে। অতঃপর একটা সময় পর রিক্সা পেল।প্রথমে কুহুকে উঠতে বলে পরমুহুর্তেই সে উঠে বসল। রিক্সা চলতে লাগল। কুহুকে একটু পরই কোচিং এর সামনে নামিয়ে দিয়ে চলতে চলকে একটা সময় পর আয়শানের বাসাটা পেরিয়ে যেতে লাগল রিক্সা। তুলির হৃদস্পন্দ শীতল লাগে এই জায়গায়টায় আসলে।একটা অনুভূতি জাগে। তুলি তার মায়ামায়া দৃষ্টি তুলে তিনতলার বেলকনিটার দিকে তাকায়। একটা তোয়ালে আর টিশার্ট শুকোতে দেওয়া আছে বেলকনির দড়িতে। একটু নিচেই একটা বেলি ফুল গাছের টব৷যদিও ফুল নেই গাছটায়। তুলি তাকাল কিয়ৎক্ষন। আয়শান ওখানেই থাকে। নিশ্চয় এতক্ষনে হসপিটালে চলে গিয়েছে। তুলি ছোটশ্বাস ফেলে চোখ সরাল।আয়শান তেমন বাড়ি না গেলেও মাঝেমধ্যে আয়শানের সাথে এই গলিটায় তার দেখা হয়ে যায়। আয়শান দায়িত্বের সঙ্গে প্রতিবার জিজ্ঞেস করে ভালোমন্দ। আয়শান অবশ্য সবসময়ই দায়িত্ববান ছেলে, শুধু তাকে বিয়ে করার বেলাতেই বোধহয় দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কাজটা করে ফেলেছে বলে তুলির ধারণা৷ তুলি পথ এগোয়৷ অতঃপর একটা সময় পর ভার্সিটি পৌঁছাল। তুলির রোজকার নিয়মই এটা। ভার্সিটি যায়, আসে। বাড়ির কাজে অংশ নেয়, সবার ভালোমন্দ দেখে। এই তো! এর বাইরে তার মনের কথা বলার মতো, বা হাসি তামাশা করার মতো কোন বন্ধুবান্ধব নেই, কোন আপন মানুষ নেই৷ সে একা, বরাবরই একা। আগে তার একান্ত আপন বলতে অনেকে ছিল। তার মামনি, রোজ,আয়জান ভাই। এখন আর তেমন কারোর সাথে তুলি মিশে না। বেছে নিয়েছে দূরত্ব। ভার্সিটিতেও তুলির খুব একটা কাছের বন্ধুবান্ধব নেই। তুলি এই পুরো পৃথিবীতে নিজেকে খুব একা আবিষ্কার করল এই মুহুর্তটাই। সত্যিই তো সে একা! একা, নিঃসঙ্গ, যান্ত্রিক এক জীবন তার। তুলি মাঝেমাঝে এই জীবনটার প্রতি বিরক্ত হয়। মাঝেমাঝেই মনে হয়, এই জীবনটা যদি না থাকত? মা বাবার সাথে সাথে সে কেন মরে গেল না? কেন মা বাবা তাকে একা ছেড়ে গেল? কেন?

.

দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হলো বেশ গুরুত্ব দিয়েই। আযরান সব খাবার ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করছিল। আম্মুকে বারবার বলছিল যাতে সব খাবারই স্বাদ হয়, বিশেষ অতিথি আসবে। বার কয়েক রোজকে ডেকে বলেছেও,

“ রোজ দেখ তো আয়োজনটা ঠিক হলো কিনা? তোর উনার পছন্দ হবে তো ? ”

রোজ রাগে কেবল। ফোঁসফোঁস করে আযরানের কার্যকলাপ দেখছিল। অতঃপর আযরানকে একা পেয়ে একবার শক্তস্বরে শুধাল ও,

“ এমন নাটক করছেন কেন? যেন কোন রাজ্যের প্রধানমন্ত্রীকে আপনি ইনভাইট করেছেন? আশ্চর্য! ”

আযরান হাসে। বলে,

“ তোর মনের রাজ্যের রাজা না ও, বুঝতে হবে তো।”

রোজ দ্বিগুণ রাগে। বলে,

“ কে বলেছে আমার মনের রাজ্যের রাজা? আমি বলেছি আপনাকে? ”

” বলেছিস। ”

রোজ ফের বলল,

“ কখন? ”

আযরান এড়িয়ে গেল যেন। বলল,

“ অতোসব ভাবতে হবে না, তুই দেখ আয়োজনে কোথাও কম হচ্ছে কিনা। ”

.

তুলি ফিরল বিকেলে। ভার্সিটি শেষ হওয়ার পর মায়ের কবরে গিয়েছিল সে৷ অতঃপর অনেকটা সময় নিরব বসে থেকে কেঁদেছে সে। ঐ একটা জায়গাতেই নিরব তুলি তার কথা গুলো আওড়াতে পারে। বুকের ভেতরে জমিয়ে রাখা কথাগুলো উগড়ে দিতে পারে।তুলি নিজের ভেতরে সব কথা বলে যখন বাড়ি ফিরল ঠিক তখনই সোফায় বসা দেখল আযরান আর সায়ানকে। সায়ান কেমন নিরব দৃষ্টিতেই যেন তাকাল তুলির দিকে। চোখাচোখি হতেই একটা বিষাদ৷ হাসি উপহার দিয়ে বলল,

“ তুলি? কেমন আছো? ”

#চলবে….