#প্রেমস্পৃহা
#পর্ব_১১
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
আযরান যখন বাড়ি ফেরার রাস্তায় তখনই তাকে পাশ কাঁটিয়ে একটা গাড়ি গেল। আযরান ভ্রু বাঁকায় কেন জানি না। অনেকটা সায়ানের গাড়ির মতোই গাড়িটা। এই পথে কেন? বাড়ি থেকে আর কেবল মিনিট দুয়েকের দূরত্ব! আযরান সরু নিঃশ্বাস ফেলেই এগোল। অতঃপর বাড়ি এসে আযরাস যখন রুমে এল তখন রোজ কারোর সাথে কথা বলছিল। আচমকা আযরানকে দেখেই সে চমকে উঠে যেন। দ্রুত কল রেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। কোনভাবে নিজের অপ্রস্তুতভাব লুকানোর চেষ্টা করে বলল,
“ কুহু ঠিক আছে আযরান? ”
আযরান প্রথমে কপাল কুঁচকাল।উত্তর না দিয়ে প্রথমেই ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
“ বাড়িতে তেমন কেউ ছিল না। পালানোর জন্য প্ল্যান করছিলি নাকি কারোর সাথে রোজ? ”
রোজ ছোট ছোট চোখে তাকাল। সরু শ্বাস ফেলে বলল,
“ আপনি যে এমনি এমনিই বাড়ি খালি করে যাবেন না এটুকু বুদ্ধি তো আমার মাথায় থাকবে বলুন? আর পালানোরই যদি হতো আমি যেকোন মূল্যে বিয়ের আগেই পালিয়ে যেতাম আযরান। ”
আযরান হাসে। তাকাল রোজের দিকে স্থির দৃষ্টিতে।রোজকে সুন্দর দেখাচ্ছে। বরাবরই সুন্দর লাগে। আর সাদা রংটায় যেন মারাত্মক লাগে এই শুভ্র পরীকে। আযরান তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলে। অতঃপর হেসে বলে,
“ এক মুখে আর কত কথা বলবি জান? একবার বলছিস সেদিন থেকে গেলেও তুই আসলে থাকবি না এই বাড়িতে, সবকিছু মানিসনি। আবার বলছিস পালানোর প্ল্যানও নেই? ”
রোজ এবারে এসবে পাত্তা দিল না। রোজ একই কথা ভালো লাগে না।বিরক্ত লাগছে। শুধাল,
“ কুহু ঠিক আছে?”
আযরান কেমন করে উত্তর করল,
“ জানি না। ”
“ জানেন না মানে? আপনি গিয়েছিলেন না কুহুর জন্য হসপিটালে। ”
“ হ্যাঁ। ”
“ তো? বলুন, কুহু ঠিক আছে এখন?”
এবারে আযরান উত্তর করল,
“ হয়তো। ”
“হয়তো মানে? ”
আযরান কপাল কুঁচকাল। কারণছাড়াই কেন জানি না তার বিরক্ত বিরক্ত লাগছে। মাথাটা কেমন জানি লাগছে।রোজকে সে চোখ বুঝে চাইলেও কেন জানি না মনে হচ্ছে তার রোজ তাকে আর চায় না। আগের মতো ভালোবাসে না, আগের মতো প্রেম প্রেম দৃষ্টিতে তাকে লুকিয়ে দেখে না। তবে কি সত্যিই সায়ানকে ভালোবেসে ফেলেছে রোজ? এমনটা যদি হয়? আযরানের কেন জানি বিরক্ত লাগছে সব মিলিয়ে। অপরদিকে বিজন্যাসেও একটা বড় আকারের ক্ষতি হলো আজ। তার পেছনে অবশ্য অবশ্যই রোজের বাবাই দায়ী আযরান জানে।তার উপর কুহু আর তুলির এক্সিডেন্ট। আযরান এতসব ভাবতে ভাবতে বিরক্ত হয় যেন। বলল,
“ অতোটা জানার আগ্রহ হলে তুই গিয়ে দেখে আসছিস না কেন? ”
রোজ এবারে ছোটশ্বাস টেনে বলল,
“ যাচ্ছি। ”
কথাটা বলেই রোজ দুয়েক পা বাড়াতে নিল। অতঃপর আচমকাই আযরান রোজের হাত টেনে ধরল। গম্ভীর ভরাট স্বরে ডাক দিল,
“ রোজ?”
“ কি?”
“ তুলি আর কুহুর এক্সিডেন্টে কোনভাবে তুই দায়ী নোসতো? বাড়ি ফাঁকা পেলে তো তোরই সুবিধা হতো। পালিয়ে যেতে পারতি, তাই না?”
রোজ এই পর্যায়ে যেন চমকে উঠল। দৃষ্টি মেলাল আযরানের দৃষ্টিতে। কাঁপাস্বরে বললে,
” আ্ আমি দায়ী? ”
আযরান রোজের হাতটা আরেকটুই কাছে টানল যার দরুণ রোজ এসে পড়ল তার সামনে একদম। আযরান হাসে। হেসে মাথা নিচু করে হাত রাখে রোজের থুতনির তিলটায়। অতঃপর তর্জনি আঙ্গুল নামিয়ে নামাতে নামাতে গলায় ঠেকাল। হেসে বলল,
“ তোর কন্ঠ কাঁপছে জান। ”
রোজ কিছু বলতে পারে না যেন। শুধু শুকনো ঢোক গিলে সে। আযরান আবারও হেসে বলল,
“ তুই চুপচাপ বিয়েটা মেনে নিলি জান? নিজের মতে বিয়ে করেছিস। এখনও পর্যন্ত এতোটা শান্ত আছিস। আমার কেন জানি না হজম হচ্ছে না, মাথায় কি ঘুরছে বলতো তোর? ”
রোজ ওভাবে তাকিয়েই এবার বলল,
“ কি ঘুরবে? ”
আযরান ঠোঁট কাঁমড়ে হাসে। বলে,
“ শিওর যে, কিছুই ঘুরছে না? ”
“ শিওর! ”
আযরান মুখ নিচু করে। রোজের থুতনির তিলটায় আচমকা ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে চুমু দিল। অতঃপর সরে গিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলল,
“ তোকে দেখলেই আজকাল কেমন বউ বউ ফিলিংস হচ্ছে জান। বউ-ই তো তুই তাই না? অথচ বউ হওয়ার আগে তুই যেভাবে মরিয়া হয়ে বুঝাতে চাইতি তুই আমায় ভালোবাসিস, এখন তেমন কিছুই করছিম না। রোবট রোবট বউ লাগছে তোকে। ”
“ হু?”
“তুই এখনো আমায় ভালোবাসিস শুধু তোর এই স্বীকারোক্তির অপেক্ষায় আছি জান।কিন্তু কেন জানি না আযরান অপেক্ষাটাও করতে পারছে না। ”
রোজ স্থির চাহনি রাখে। অতঃপর শক্তস্বরে বলল,
“ আপনি আমায় অনেক অপমান করেছেন আযরান। আপনার বন্ধুর রক্ষিতা হিসেবেও পরিচয় দিয়েছেন সায়ানের জম্মদিন পার্টিতে। ভুলে যাইনি আমি। সব মনে আছে।”
আযরান হাসে। তোয়ালে কাঁধে নিয়ে শার্টের বোতামে হাত রেখে বলল,
“ ওসবের প্রতিশোধ নিতে কোনভাবে চুপচাপ হয়ে আছিস নাকি? সত্যি করে বল। ”
“ আমার কাছে আমার পরিবার খুব ইম্পোর্টেন্ট আযরান। ভাবলাম আপনাদের পরিবারটাও ছন্নছাড়া করার অধিকার আমার নেই, শুধু এইটুকু কারণেই…. ”
আযরান তাকায়। শার্টের অর্ধেক বোতাম খোলা শেষে এগিয়ে এসে বলল,
” এইটুকু কারণ হোক, অথচ বৃহৎ কোন কারণ। তুই এইখানেই থাকবি, এইখানেই আমার বউ হয়ে থাকতে হবে তোকে রোজ। পালানোর চেষ্টা করবি না, আমায় ছেড়ে যাওয়ার কথাও কল্পনা করবি না। ফল ভালো হবে না। ”
রোজ প্রশ্ন ছুড়ে,
“ কি করবেন? ”
আযরান ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল কেবল,
“ অনেককিছুই করব, যা এখনো পর্যন্ত করিনি। ”
রোজ বিনিময়ে বলল,
“ তো? আমি ভয় পাব? নাকি চুপচাপ মেনে নেওয়ার মেয়ে আমি আযরান? ”
আযরান আবার ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। যেতে যেতে বলে,
“ সেটা সময়ই বলুক নাহয়?”
অতঃপর এটুকু বলেই আযরান পা চালিয়ে ওয়াশরুমে গেল। আর রোজ কেবল তাকিয়েই দেখে।
.
আয়শান তুলিকে সর্বপ্রথম নিয়ে গেল অর্থোপেডিস্ট এর কাছেই। ডক্টরের টেবিলটায় ছোট্ট একটা নেইমপ্লেটে নাম ভাসছে মার্জিয়া শেখ। তুলি তাকিয়ে দেখল।ব্যাথায় তার পা টা চিনচিন করছে। অসম্ভবত ব্যাথা হচ্ছে যেন । তবুও সে সহ্য করে আছে নিশ্চুপে।আয়শান অর্থোপেডিস্টের কাছে দেখাবে বলে আনলেও ওখানে ডক্টর নেই। যদিও এখন রোগী দেখার সময় নয় তবুও আয়শান ওকে এখানেই আনল। ডক্টর মার্জিয়া সম্পর্কে আয়শানের বন্ধু সম্পর্কীয়।ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু আবরারের স্ত্রী। মার্জিয়া ব্যাতীত ও এই হসপিটালে আবরার ও আছে। আয়শান একবার ভাবল মার্জিয়াকে কল দিয়ে এখনই ডাকিয়ে নিক, পরমুহুর্তে ভাবল তুলির কাঁটা জায়গা গুলো ব্যান্ডেজ করা বাকি৷মার্জিয়া আসতে আসতে তা করে ফেলা উচিত অতঃপর ছোটশ্বাস ফেলে সে ওখানে দরজা লাগাল।অতঃপর তুলির দিকে চেয়ে সোজা হয়ে বুক টানটান করে দাঁড়াল সে। মুখ টানটান করে দ্রুত গম্ভীর স্বরে বলল,
” তুলি? তোকে সময় দিচ্ছি মিনিট দুই। এরমধ্যেই নিজ থেকে জানাবি কোথায় কোথায় আঘাত পেয়েছিস। যদি না জানাস তো গড প্রমিজ, আমি নিজেই তোর আঘাত গুলো খুঁজে নিব। ”
তুলি তাকাল হতবিহ্বল দৃষ্টিতে। আঘাত খুঁজে নিবে মানে? পেটের দিকটায় তো জ্বলছে তার। বোধহয় পেটেও সামান্য কেঁটেছে। তো? তুলি ভেবেই অস্বস্তি বোধ করল যেন শেষের কথাটায়। পরমুহুর্তেই আয়শানের দিকে সরাসরি চেয়ে উত্তর করল,,
” শুধু হাতের কনুই গুলো জ্বলছিল একটু আর তেমন ব্যাথা পাইনি। ”
আয়শান তবুও নিশ্চিত হতে পারল না যেন। আরো কি চেপে যাচ্ছে কে জানে! সে তুলির দিকে শান্তি চাহনি ফেলেই শক্ত কন্ঠে জানাল,
“ হাতের কনুইগুলো জ্বলছিল না কেবল, হাতের কনুইগুলো কেঁটে রক্তও বেরিয়েছে বেশ! তারপরও বল তুই টের পাস নি। ”
“ ওটুকু তো তেমন গুরুতর কোন ব্যাথা নয়। ঠিক হয়ে যেতই। ”
আয়শান এবারেও কঠিন স্বরে কথা বলল। আদেশের ন্যায় বলল,
” তুই শিউর কিভাবে গুরুতর ব্যাথা নয়? জামার হাতা উঠা। ”
অস্ফুট স্বরে বলল তুলি,
” হু? ”
“ জামার হাতাটা উপরে উঠা তুলি। ”
তুলি তাকাল আয়শানের দিকে। তবে হাতা উঠাল না। নিরব দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে থাকতেই আয়শান আবারও বলল,
“ কি হলো তোল? ”
তুলি তবুও তুলল না। আয়শান এবার চেয়ার টেনে তুলির সামনে বসে নিজেই হাত টেনে নিল তুলির। অতঃপর তুলির জামার হাতাটা উপরে তুলল কিছুটা। কাঁটা অংশটা পর্যবেক্ষন করে বলল,
“ কেঁটেছে তো অনেকটা৷”
দুই হাতেই কেঁটেছে। আয়শান দেখল।রক্তগুলো জমাট বেঁধে গেছে যেন। অতঃপর তা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করার উদ্দেশ্যে তুলির কাছাকাছি চেয়ার নিয়ে বসতেই তুলি দ্রুত বলল,
“ ওটুকু আমি বাসায় ফিরে নিজেই করে নিতে পারব।আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। ”
আয়শান দৃঢ় চাহনিতে চাইল। শুনল না তুলির কথাগুলো। শুধাল কেবল,
“ তুলি শোন, তোকে আমার বিরক্ত লাগছে এই মুহুর্তে। তোর কথা গুলো বড্ড নাটক নাটক মনে হচ্ছে। তুই বোধহয় আর একটা কথা বললেও আমার রাগ উঠবে। আর তুই খুব ভালো করেই জানিস তুলি, আমি সহজে রাগি না। ”
তুলি নিরব চাহনিতেই তাকিয়ে থাকল এবার। নাটক করছে সে? কথাগুলো কি বড্ড বিরক্তিকর শোনাচ্ছে? তুলি আর কোন কথাই বলল না। অন্যদিকে আয়শান ততক্ষনে আঘাতের জায়গা গুলো ব্যান্ডেজ করল। পরমুহুর্তে চুপচাপ উঠে ওখান থেকে বেরিয়ে গেল। তুলি কেবল তাকিয়েই থাকল এবারে। কোথায় গেল সে প্রশ্নটা একবার মাথায় ঘুরল। তারপর অনেকটা সময় পর আয়শানকে আর একজন মেয়েকে দেখা গেল। মেয়েটা দরজা পেরিয়ে দাঁড়িয়েই তুলির দিকে তাকাল। অতঃপর তুলির দিকে কিছুটা সময় তাকিয়ে থাকল। পর্যবেক্ষন করল। তারপর হেসে বলল,
“ ইজ শী দ্যা লাকি গার্ল আয়শান? ”
আয়শান তুলির সামনেই এমন প্রশ্নে করে ফেলাতে শান্ত দৃষ্টিতে চাইল মার্জিয়ার দিকে। উত্তরে হেসে বলল,
“ ইয়েস। ”
কথাটা বলেই পরপরই তাকাল তুলির দিকে।তুলির চোখে বিস্ময় কিছুটা। লাকি গার্ল বলতে? কি বুঝাল উনি? আয়শান কি কখনো এর আগে তার সম্পর্কে এই ডক্টরের সাথে কথা বলেছে? কিন্তু কেন? তুলি বুঝে উঠে না। কেমন করে তাকিয়ে থাকতেই মার্জিয়া হেসে তার জন্য বরাদ্ধকৃত চেয়ারটায় গিয়ে বসল। বলল,
“তুলি? তোমাকে কি তুমি করে বলতে পারি? বয়সে ছোটই হবে আমার তাই। ”
তুলি এবারে আবারও বিস্মিত হলো। তার নামটাও জানে? কি আশ্চর্য! কিভাবে? তুলি ফ্যালফ্যাল করে তাকালেও সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর করল,
“ হ্যাঁ অবশ্যই!”
মার্জিয়া এবারেও হাসল। বলল,
“ তো অসুস্থ কি তুমি নাকি আমাদের নিউরোসার্জন?আমাকে এভাবে জরুরী তলবে ডেকে আনা হলো! ”
তুলি এবারে উত্তর করল না। আয়শানই তো নিয়ে আসল উনাকে। তাহলে আয়শান কি করে অসুস্থ হবে? তুলি আয়শানের দিকে তাকাল কেবল। আয়শানই এবারে উত্তর করল তার বিনিময়ে,
“ বোকার মতো প্রশ্ন করছিস মার্জি। আমি অসুস্থ হলে নিশ্চয় আমাকে ডক্টর দেখানোর জন্য ওকে আসতে হবে না। আমি নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পারি। কিন্তু ও সেটা পারে না। পায়ের হাড় ভেঙ্গেছে নাকি মচকে ফেলেছে ওই জানে।এইজন্যই নিয়ে এসেছি।”
আয়শানের কথা বলার ধরণ দেখে মার্জিয়া হেসে উঠল আওয়াজ করেই। মনে হলে যেন আয়শান একটা ছোটবাচ্চাকেই বিয়ে করেছে আর তার সম্বন্ধে অভিযোগ করছে।মার্জিয়া হেসেই শুধাল,
“ তবুও নিয়ে আসাতে আমরা আপনার ওয়াইফকে দেখার সুযোগ পেলাম স্যার। নাহলে তো সুযোগটা পেতামই না, কত করে বললাম।সুতারাং পা ভাঙ্গা থেকে যদি ভালো কিছু হয় তো পা ভাঙ্গাই ভালো, রাইট?”
“ বেশি কথা বলে ফেলছিস কিন্তু মার্জি! ”
আয়শানের কথাটা শুনে মার্জিয়া হাসে। অতঃপর তুলির পা দেখে। ফুলে গিয়েছে এতোটা সময়ে। ভেঙ্গেছে নাকি মচকে গেল তা জানার জন্য এক্স রে করতে বলা হলো। সে অনুযায়ী এক্সরে করিয়ে তারপরই বাসায় ফেরার সময় হলো আয়শান আর তুলির। তুলি ব্যাথায় পা ফেলতে পারছে না, অথচ তবুও নিজের মতো পা ফেলছে। আয়শান বলেছে পারবে না, তবুও তার মতামত সে পারবে। আয়শান ছোটশ্বাস। তুলিকে কোলে তুলাটা উচিত হবে কি হবে না এই দ্বিধা নিয়ে সেই শুরু থেকে এতোটা সময় পার করলেও এবারে সর সিদ্ধান্ত নিয়েই নিল। আচমকা তুলিকে কোলে তুলে নিল। অতঃপর ওভাবেই হাঁটতে নিয়ে বলল,
“ অন্য সব মেয়ের মতো জোর করে কোলে তুলেছি এমনটা ভেবে হাত পা ছুড়বি না তুলি। এটাতে তোর মতামত জানার চেষ্টা করলে তুই না ই বলতি। তাই না বলেই কোলে তুলেছি। ”
তুলি হাত পা ছুড়ে নি মোটেই।তবে উত্তর ও করল না। কেবল নিশ্চুপ তাকাল। আয়শান ওভাবেই তাকে গাড়ি পর্যন্ত নিল, গাড়িতে বসাল। অতঃপর নিজের দরকারি কিছু কাগজপত্র নিতে ফের তুলিকে বলে হসপিটালের ভেতর এল। ঠিক তখনই দেখা গেল মার্জিয়া আর আবরারকে। তাকে দেখে সর্বপ্রথম দুইজনে একটা গা জ্বালানো হাসি উপহার দিল। আবরার এসেই হেসে বলল,
“আমি খুব করে চেয়েছিলাম তোদের দুইজনের সম্পর্কটা স্বাভাবিক হোক, এমন একটা দিন আসুক আয়শান। সত্যি বলতে তোদের দুইজনকে ওভাবে দেখে আমি চমকেছিলামই বেশি। ”
আয়শান তাকাল। তুলিকে কোলে নিয়ে যাওয়ার জন্য এরা তাকিয়ে ছিল ভেবে হেসে বলল,
“ কেন? তুই মার্জিকে কোলে নিস না? ”
আবরার হেসে বলল,
“ তুই আর তুলি তো আমাদের মতো নোস। তোদের সম্পর্কও আমাদের মতো নয়। মার্জি তোদের ওভাবে দেখে বিষয়টা অন্যভাবে দেখলেও আমি জানি এটা কেবল ওর পায়ে ব্যাথা বলেই তুই করলি রাইট? সম্পর্কটা ঠিক করে নে না আয়শান। ”
আয়শান ছোটশ্বাস ফেলল। বলল,
“ একবার একটা সিদ্ধান্ত তুলির উপর জোর করে চাপিয়ে দিয়েছিলাম আবরার, বিয়ে করে ওর জীবনটা শেষ করে ফেললাম। এখন ও না চাইলে এই সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আমি আর ভাবব না আর না তো জোর করে কিছু চাপিয়ে দিব। ও কোনদিন এগোলে, মত দিলে আমি নিজেই সম্পর্কটা মজবুত করে নিব। প্রমিজ!”
“ ততদিনে ও যদি তোর থেকে দূরে চলে যায়? যদি আরো হারিয়ে যায়? তার চেয়ে ঠিক করে ফেল না। ”
আয়শান হুট করেই আবরারের দিকে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল। দূরে চলে যাবে মানে? যদি দূরে চলেও যায়? এমন তো নয় যে তারা খুব কাছাকাছি থাকে, দূরেই থাকে। দুইজনে দুই বাসায়। তবুও মাসে, সপ্তাহে, তিন চারমান পর হলেও তো মেয়েটাকে দেখতে পায়। মেয়েটার খোঁজ পায়। পাঁচছয়মাস পর যখন কোন প্রয়োজনে বাসায় যায় তখন কখনো কখনো নাহয় একবার জড়িয়ে হলেও নিতে পারে।যদি দূরে সরে যায় ও এই মেয়েটার খোঁজ পাবে? আয়শান নিজে ভেবে নিজেই ছোটশ্বাস ফেলল। বলল,
“ আমি চাইলে কি ঠিক হয়ে যাবে আবরার? আমি বহুবার ভেবেছিলাম সম্পর্কটা এগোনো উচিত আবরার, কিন্তু পারিনি। বরং অপরাধবোধ নিয়ে ফিরে এসেছি। ওর সামনে গেলেই ওর অভিযোগ ভরা মুখচাহনি দেখে আমি আর এই সম্পর্কটা এগোনোর কথা ভাবতেই পারি না। কেবল মনে হয় আমি অপরাধী। শুধুই অপরাধী। ওর এইরকম ছন্নছাড়া, নিরব জীবনটার জন্য আমি দায়ী। আমার ওকে ওভাবে সেদিন বিয়ে করাটা উচিত হয়নি বল? কিন্তু বিয়েটা ভাঙ্গাও পসিবল না, আমি ওকে ছাড়তে পারব না আবরার।”
#চলবে…
#প্রেমস্পৃহা
#পর্ব_১২
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
বাইরে মৃদুমন্দ বাতাস। গাড়ির জানালাটা খোলা। তুলি জানালার দিকে মুখ করেই বাইরে তাকাল।পা ব্যাথা হচ্ছে অনেকটা। চিনচিনে ব্যাথা। পা নাড়াতে অব্দি কষ্ট হচ্ছেে।তবুও সহ্য করে থাকল সে। বাইরে তাকাল। অতঃপর হুট করেই মাথা ঘুরিয়ে আয়শানের দিকে তাকাল সে। আয়শান গাড়ি ড্রাইভ করছিল তখন। তুলি শান্ত ভঙ্গিতে তাকাল। মনে পড়ল তখনকার লাকি গার্ল সম্বোধনটা। তুলি লাকি গার্ল? আধো তুলির সাথে এই সম্বোধনটা মিলে বলে তুলির মনে হয় না। সে ছোটশ্বাস ফেলেই আয়শানকে জিজ্ঞেস করল,
“ ডক্টর মার্জিয়া আপনার ফ্রেন্ড? ”
আয়শান তাকায় না ফিরে তুলির দিকে। ওভাবেই গাড়ি চালায়৷ তবে একটু বিস্ময়ই খেলে গেল তার মনে, এই প্রথম তুলি তাকে কোন মেয়ের বিষয়ে এভাবে জিজ্ঞেস করল, কি হয় তা জানতে চাইছে। আয়শান হাসল। তুলির আর তার স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকলে নিশ্চয় এই নিয়ে এতদিনে কত মেয়ে নিয়ে তুলি জ্বেলাস ফিল করত, ঝগড়া হতো। আয়শান হাসে তা ভেবে। যদিও কেবলই কল্পনা। মুখে উত্তর করল,
“হ্যাঁ এবং আবরারের ওয়াইফ ও। ”
তুলি মাথা নাড়াল। আবরারকে চেনে সে। আয়শানের সাথে তার যেদিন বিয়ে হলো সেদিন সবটা সময়ই আবরার ছিল। এমনকি বিয়েটার সাক্ষীও আবরার ছিল। তুলি ছোটশ্বাস ফেলে বলল,
“ উনি আমায় তখন লাকি গার্ল বলল কেন? আপনিও ইয়েস বললেন? আমার নামও জানে কিভাবে? আপনি কি আমার সম্পর্কে উনার সাথে এর আগেও কথা বলেছেন?”
আয়শান তুলির দিকে এবারেও চাইল না। শান্ত স্থির গাড়ি এগিয়ে নিতে নিতেই সে গম্ভীর স্বরে উত্তর করল,
“ বলেছি। ”
তুলি হাসল এবারে। তার বিষয়ে আয়শান কথা বলেছে কারোর সঙ্গে এটাতে তার আনন্দ, দুঃখ কিছুই হলো না। তবে হাসি এল এই নিয়ে যে আয়শান এমনভাবেই তার বিষয়ে বলল যে সে মেয়েটা ধরেই নিল যে তুলি লাকি গার্ল! অথচ তুলির তো বরাবরই ভাগ্য খারাপ। সবকিছুতেই। বাবা মারা গেল জম্মানোর আগেই, মা মারা গেল ছোটবেলাতে। অতঃপর যে মামনি তাকে আদর স্নেহ দিয়ে এতকাল বড় করেছে তার সাথে আজ দুইবছর হলো কোন কথা হয়নি, দেখা হয়নি। আর আছে তুলির প্রিয় আদুরে দাদী। সেও প্রায় শয্যাশায়ী। তুলি নিশ্চিত, সে যদি দাদীর কাছে একেবারের জন্য ফিরে যেতে চায় তবে দাদীও নিশ্চয় তাকে ফেলে পালাবে। তুলি মৃদু হেসেই বরল
“ কি বলেছেন যে একেবারে লাকি গার্ল বলল? যদিও এই সম্বোধনটার সাথে আমি মানানসই না আয়শান ভাই। ”
আয়শান ততক্ষনে গাড়ি থামিয়েছে। তুলি হুট করে গাড়ি থামানোতে চমকালেও পরমুহুর্তেই বুঝতে পারল তারা এসে পৌঁছেছে। আয়শান এবারে তুলির দিকে সরাসরিই তাকাল। অতঃপর ঝুকে তুলির সিটব্যাল্ট খুলে নিতে নিতে জানাল,
“ এটা বলেছি যে তুলিকে আমি বিয়ে করেছি, আমার ইচ্ছাতেই। সে হিসেবে তুই লাকি না? আমাকে পেয়েছিস। মার্জির বোন একটা সময়ে আমাকে অনেক চেয়েও পায়নি। শুধু মার্জির বোন না, আরো অনেকেই। ”
তুলি হাসে। মৃদুস্বরে বলল,
” আপনি সুদর্শন, অনেকে আপনার জন্য পাগল হবে স্বাভাবিক। কিন্তু আপনার সাথে বিয়ে হওয়াতে আমি লাকি গার্ল হয়ে গেলাম এটা মানতে পারলাম না। ”
পরমুহুর্তে ফের আবার বলল,
“ অযোগ্যরা মূল্যবান বস্তু ডিজার্ব করে না আয়শান, যেমন আমি আপনাকে ডিজার্ব করি না। বিয়েটাতো কেবল মাত্র একটা লোক দেখানো খেলা হয়েছি। তা আপনিও জানেন, আমিও জানি। ”
আয়শান সবটা শান্ত ভঙ্গিতে মানলেও শেষের দিকর তার চোয়াল শক্ত হলো। কিছুটা কঠিন, শীতল হয়ে এল চাহনি। বলল,
“ হু? কি বললি? ”
“ কিছু নয়। ”
“ আমি কানে কম শুনি না তুলি, বিয়েটা লোক দেখানো খেলা ছিল না, তা তুইও জানিস আমিও জানি। আমি তোকে সত্যিকারের সিরিয়াসন্যাস নিয়েই বিয়ে করেছিলাম৷ ”
তুলি তাকায়। শান্ত স্বরে বলল,
“ তা ঠিক। কিন্তু এটা একটা গেইমই আয়শান ভাই। আমি এটাই মানি। ”
আয়শান এবারে আর বুঝাল না। কি বুঝাবে? ছোট শ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে নামার আগেই সে বলল,
“ ওকে ফাইন। তবে তোর এটা জানা উচিত যে তুই ও মূল্যবান। অনেকের কাছেই তোর সমুদ্রসমান মূল্য আছে তুলি। ”
তুলি বিস্ময় নিয়ে বলল,
” সমুদ্রসমান মূল্য? ভালো তো!”
এটুকু বলেই কেমন করে যেন চোখ বুঝে নিল তুলি। ব্যাথা হচ্ছে পায়ে। ব্যাথাটা বাড়ছেই, কমছে না। আয়শান ওভাবে ক্লান্ত তুলিকে চোখ বুঝে নিতে দেখে নরম হয়ে এল। অপরাধবোধ হলো আবারও। গলা পরিষ্কার করে শুধাল,
“ তুলি? তোর কি আমাকে বড্ড অসহ্য লাগে? ঘৃণা হয় আমার প্রতি? ”
তুলি চোখ খুলে। বলে,
“ আপনার প্রতি? কেন? ”
“ এই যে তোর জীবনটা ধ্বংস করলাম। ”
তুলি হেসে সুন্দর করে উত্তর দিল,
“ ঐ যে বললাম, আমার মতো মানুষদের জীবনের আর কি এমন মূল্য বলুন? আর আপনি আমার জীবন ধ্বংস করেননি। আমার জীবন বরাবরই এমন। ”
এটুকু বলেই তুলি যখন নামার জন্য পা নামাতে নিবে ঠিক তখনই আয়শার দ্রুত বলল,
” পা ফেলবি না,আমি নিয়ে যাচ্ছি তুলি। ”
এটুকু বলেই গাড়ির সিটে বসে থাকা তুলিকে কোলে তুলল সে। অতঃপর গেইট পেরিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল। বসার ঘরে তেমন কাউকেই দেখা গেল না আয়শানের ফুফি ব্যাতীত। আয়শানের ফুফি দুইজনকে ওভাবে দেখেই কপাল কুঁচকালেন। কিছু না বলেই কেমন যেন বিরক্তি প্রকাশ করে চলে গেলেন অন্য পাশটায়।
.
আয়শান তখন বেলকনিতে বসেই ল্যাপটপে কিছু করছিল। তুলি তখন ঘুমিয়েছে। অনেকটা রাত। ঠিক তখনই ভিডিও কল দিল আয়শানের আম্মু, তুলির মামনি। আয়শান কল তুলল। ল্যাপটপের স্ক্রিনে মায়ের মুখটা দেখে সর্বপ্রথম বলল,
“ কবে আসছো আম্মু? তোমাকে খুব মিস করছি।খুব প্রয়োজন ছিল তোমায় আমার ”
আয়শানের আম্মু ছেলের কথা শুনে জবাবে বললেন,
“ বলেছিলাম তো বাপ, এই সপ্তাহেই ফিরব আমি আর আয়জান। ”
আয়শান হেসে বলল,
” আমি অপেক্ষায় আছি।”
“ একটা কথা জিজ্ঞেস করতে কল দিয়েছি আয়শান। ”
“ হ্যাঁ আম্মু, বলে ফেলো। ”
অতঃপর আয়শানের মা ছোটশ্বাস ফেলে বলল,
“ কুহুর এক্সিডেন্ট হয়েছে বলল তোর ছোট আম্মু। এখন কেমন আছে ও? ”
আয়শান উত্তর করল,
“ ব্যান্ডেজ করা হয়েছে কাঁটা জায়গাগুলো, কয়েকদিন পর ঠিক হয়ে যাবে আশা করি। ”
আয়শানের আম্মু এবার অস্বস্তিতে পড়লেন যেন। কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও জিজ্ঞেস করতে পারলেন না যেন। কেমন যেন বাঁধা কাজ করছে। আয়শা তা বুঝে বলল,
“ কিছু বলবে আম্মু? ”
আয়শানের মা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলল,
” তুলিও ছিল কুহুর সাথে? ”
“ ছিল। ”
চিন্তিত মুখ। কোনরকমে মুখ কাচুমাচু করে উনি ছেলের কাছে জানতে চাইলেন
“ ও ঠিক আছে? ”
আয়শান ছোটশ্বাস ফেলে। বলে,
“ কি করে জানব আম্মু? ”
“ জানো না মানে? ”
আয়শান হেসে বলল,
“ সম্ভবত ঠিক আছে, আবার সম্ভবত ঠিক নেই। ও যে আমায় সবটা খুলে বলবে এমনটা তুমি আশা করো? ”
আয়শানের মাকে এবার দ্বিগুণ চিন্তিত দেখাল যেন। বলল,
“ একটু দেখ না ও কোথায় আঘাত পেল আয়শান, আমার মেয়েটা ছোট থেকেই বেখেয়ালি। পড়ে গিয়ে, উষ্টা খেয়ে কত যে ব্যাথা পেত। তবুও বলত না। ”
আয়শান ছোটশ্বাস ফেলে বলে,
“ না বললে কেউ কি করে বুঝতে পারবে আম্মু? আমি তো আর সবজান্তা নই। ”
আয়শানের মা আবারও জানতে চাইল,
“ বেশি ব্যাথা পেয়েছে ও? বলে নি না? ”
আয়শান নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
” তাও জানি না, তুমিই ওকে জিজ্ঞেস করো। ”
আয়শানের মা এবারে চুপ করে গেলেন। তুলির সাথে দুইবছর আগে উনি যে ব্যবহার করেছে তা নিয়ে তিনি লজ্জায় এবং অনুশোচনায় উনি আর তুলির সাথে যোগাযোগই করেনি এই দুটো বছর। তবে দূর থেকে খোঁজ নিয়েছে। বলল,
“ না থাক। তুই একটু বলিস আমায় ও কেমন আছে। ”
আয়শান বুঝে ব্যাপারটা। বলে,
“ তোমার ওর সাথে কথা বলাটা প্রয়োজন ছিল আম্মু, ও ভাবে তুমি ওকে খারাপ ভাবো, দোষী ভাবো এইজন্য কথা বলো না। সেবারের পর থেকে ও হয়তে ভাবে যে আমরা কেউই ওকে কখনো আপন ভাবিনি৷ ভুলটা আমারই, আমার ওভাবে বিয়ে করে নেওয়াটা উচিত হয়নি। মাঝখান থেকে ও সাফার করছে, কি করব আমি আম্মু? বলবে আমায়?”
“ ওকে আমিও কষ্ট দিয়েছি তাই না আয়শান? আমার মেয়েটা কতটা কষ্ট পেয়েছে! ”
#চলবে…