#প্রেমস্পৃহা
#পর্ব_১৩
লেখনীতেঃঅলকানন্দা ঐন্দ্রি
তুলি যখন ঘুমে তখনই আয়শান ছোটশ্বাস ফেলে ঠোঁট স্পর্শ করল তুলির কপালে। পরপর দুই গালে। স্পষ্ট টের পেল তুলির শরীরের উত্তাপ। সঙ্গে সঙ্গেই বাম হাতের তালুতে পরখ করল। হ্যাঁ, গরম ঠেকছে। হয়তো ব্যাথায় জ্বর নেমেছে। আয়শান ফের বিছানা থেকে নেমে ঔষুধ আনল। তুলির ঘুম ভেঙ্গে ডাকবে কি ডাকবে না বুঝে না উঠে কিয়ৎক্ষন ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকল। পরমুহুর্তে ঔষুধ গুলো রেখে দিল। ইচ্ছে হলো না এই মেয়েটাকে ঘুম থেকে উঠাতে। ঐ ঘুম ঘুম মুখটা দেখার লোভ ও সামলাতে পারল না। আয়শান আগের মতোই আলতো করে জড়িয়ে নিল তুলিকে।অতঃপর ঘুমন্ত চেহারাটার দিকে চেয়ে হাসে যেন। বলে,
“ তোর ঘুমন্ত চেহারাটা খুবই মিষ্টি তুলি।আদুরে বাচ্চার ন্যায়। তুই তো বাচ্চাই তাই না? মায়া মায়া মুখের একটা বাচ্চা। যে বাচ্চাটার মায়া মায়া চাহনি, আর মায়াভরা মুখটা দেখলেই আমার তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হতো সেই ছোট থেকেই।কেন জানি না তোর জন্য আমার কি ভীষণ মায়া জম্মাল সেই ছোট থেকেই। তুই কষ্ট পেলে আমারও খারাপ লাগত, তুই হাসলে আমারও খুশি লাগত। তোর মুখটার দিকে তাকাতেই ইচ্ছে হতো কেবল। কিন্তু আপসোস, আমি পাকাপোক্ত ভাবে তাকানোর অধিকার করে নিতে গিয়ে এখন চোখই রাখতে পারি না তোর চোখে তুলি। সর্বক্ষণ অপরাধবোধে ভুগতে থাকি। ”
তুলি তখনও ঘুমেই। আয়শান ছোটশ্বাস ফের আবার ও বলল,
“ যদি কোন ম্যাজিকাল ঘটনা ঘটত তুলি? তোর মন থেকে আমার নামের সব অভিযোগ মুঁছে যেত যদি? তুই কি কখনো আমায় ভালোবাসবি তুলি? আমাদের সম্পর্কটা সত্যিই কখনো নর্মাল হবে? কখনো বুঝবি আমার ভালোবাসাটা? তুলি? বিশ্বাস কর, আমি ক্রমে নিজের জীবন হারাচ্ছি। আমার আজকাল নিজেকে কেমন যেন লাগে। যদি একবার আমি তোকে বুঝাতে পারতাম যে, আমি তোকেই ভালোবাসি, তোকেই! ডেইজিকে নয়। তোকে আমি ব্যবহার করিনি তুলি, তোকে অপরাধী বানাতে চাইনি সবার কাছে। আমি তোকে ভালোবেসেই নিজের করতে চেয়েছিলাম। একান্ত নিজের করে চেয়েছিলাম। অথচ তুই আজ আমার নিজের হয়েও নিজের না তুলি, এতোটা কাছে থেকেও কতোটা দূরত্ব আমাদের, কতোটা সংকোচ! ”
আয়শান চোখ বুঝে। বোধহয় খুব কষ্ট হচ্ছে তার। বুকের ভেতর নীল ব্যাথারা জাগ্রত হয়ে এল যেন।ভীষণ ভারী বোধ হয় তার বুকের ভেতর। যেন নিঃশ্বাস অব্দি রুদ্ধ হয়ে আসে।সে এভাবে চায়নি জীবনটা । এভাবে এতোটা নিঃসঙ্গতা সে চায়নি। চেয়েছিল একটা সুন্দর সংসার হবে তার, তুলি তাকে বুঝবে,কোমড়ে আঁচল গুঁজে একদম তার বউ হয়ে যাবে। সবার কাছে গম্ভীর থাকা আয়শান তুলিকে ভালোবাসবে, বিরক্ত করবে, ভীষণ করে জ্বালাবে এটাই তো চেয়েছিল। একটা প্রাণবন্ত জীবন! অথচ ঘটে গেল উল্টো। যেদিন তুলিকে বিয়ে করে বাড়ি ফিরল সেদিনই তুলিকে কাঁদতে হলো। সবার এত এত কথা শুনে কেঁদেছিল মেয়েটা। তারই তো কারণেই। তার মা তো তুলিকে চড়ও মেরেছিল। দোষারোপ করেছিল কি ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে। কেউ কি বাদ গিয়েছিল আয়শান আর তুলিকে কথা শোনাতে সেদিন? যেখানে তুলির ভালোবাসা পাওয়ার কথা ভেবেছিল সেখানে তুলি কাঁদতে কাঁদতে তাকে সর্বপ্রথম প্রশ্ন ছুড়েছিল,
“ আমায়ই কেন আয়শান ভাই? আমায়ই কেন বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতে হলো আপনাকে? আমায় কেন এভাবে সবার কাছে দোষী বানালেন? অপরাধ কি ছিল বলুন আমার? আমি তো কিছু করিনি। আপনাকে আমার ফাঁদে ফেলিনি আমি। তবুও সবাই কেন আমার দিকে আঙ্গুল তুলল বলুন? সবাই কেন আমাকে পর করে দিল? কেন বলুন? কি ক্ষতি করেছিলাম আপনার? কিসের বদলা নিলেন আয়শান ভাই? ”
আয়শান সেদিন উত্তর করতে পারেনি তুলির কান্নারত থাকা প্রশ্নগুলোর। একটা কথাও বলতে পারেনি তুলিকে। তবে মা বাবার সাথে বিস্তর ঝগড়া হলো তার সেদিন। বিস্তর এক ঝগড়া শেষ করার পরই সে সিদ্ধান্ত নিল সে আর তুলি আলাদা থাকবে। যেহেতু সবাই মানছেই না, সেহেতু এই সিদ্ধান্তটাই উত্তম। সে হিসেবে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ও নিয়ে নিল। অথচ তুলি সেদিন তাকে সঙ্গ দিল না। এই বাড়ি ছেড়ে তার সাথে গেল না। যে বাড়িতে ছোট থেকে বড় হয়েছে, যে মামনির কাছে বড় হয়েছে তাদের ছেড়ে আয়শানের সাথে চলে যাওয়াটা বেঈমানি হতো। হয়তো সেদিন আয়শানের সাথে চলে এলেই এটাই পাকাপোক্তভাবে প্রমাণ হতো যে তুলি সত্যিই আয়শানকে নিজের ফাঁদে ফেলেছে। সত্যিই আয়শানকে নিজের মতো করে চালাচ্ছে। অথচ সত্য এটা যে সে আয়শানকে নয়, বরং আয়শানই তাকে নিজের মতো করে চালিয়ে নিয়ে বিয়েটা করেছিল। আয়শান চোখ বুঝে এসব পুরাতন কথায়ই ভাবল। অতঃপর হুট করেই তুলির নড়চড় বুঝে চোখ খুলে সে। তুলির ঘুম ভেঙ্গেছে হয়তো এক্ষুনিই। কিন্তু তবুও সে ওভাবেই আয়শানের বাহুডোরে ওভাবেই থাকল। আর নড়াচড়া করল না, যেন সে ঘুমোচ্ছেই। আয়শান এবারে ডাকল,
“ তুলি?”
তুলি উত্তর করে। পায়ে ভীষণ ব্যাথা হচ্ছে। সহ্য করতে পারছে না যেন। এত বেশি যে সহ্যই হচ্ছে না তার। দাঁতে দাঁত চেপে থাকে সে। আয়শান ছোটশ্বাস ফেলে আবার বলে,
“ ব্যাথা হচ্ছে বেশি? ”
তুলি এবারে উত্তর করল,
“ একটু! ”
আয়শান ভ্রু কুঁচকে বলল,
“একটু? মিথ্যে বলে লাভ কি তুলি? ”
তুলি এবারে ছোটশ্বাস ফেলে জানাল,
“ একটু বেশিই হচ্ছে। ”
আয়শান ভ্রু কুঁচকে তাকায়। উঠে বসে তুলির পায়ে নজর দেয়। ফুলে আছে এখনোও।আয়শান উঠে আইস ব্যাগটা নিয়ে আবারও পায়ে রাখল।বলল,
“ তোর উত্তরটা হওয়া উচিত, অনেকটাই বেশি। ”
তুলি তাকাল। পায়ে ঠান্ডা কিছুর অনুভূতি পেয়ে দ্রুতই তাকাল। অতঃপর আয়শানকে পায়ে আইস ব্যাগ ধরতে দেখে উঠে বসল সঙ্গে সঙ্গেই। দ্রুত বলল,
“ আমিই দিচ্ছি, হাত সরান আয়শান ভাই। আমি নিজে দিতে পারব, তাছাড়া অতোটাও ব্যাথা হচ্ছে না আমার। ”
আয়শান হাত সরাল না। বরং বলল,
“ তোর এসব ঢং সহ্য করতে পারব না আমি তুলি।মেজাজ খারাপ করবি না অযথা। ব্যাথা হচ্ছে তা আমার থেকে লুকিয়ে রাখলে তো তোর ব্যাথা কমে যাবে না। যদি কমে যেত তাহলে নাহয় লুকিয়ে রাখায় লাভ হতো। ”
তুলি জানাল,
“ লুকাইনি তো। তবে ওটা আমায় দিন, আমি দিতে পারব তো । ”
“ আমি দিলে কি ব্যাথা বেড়ে যাবে? ”
তুলি এবারে উত্তর করে না। চুপই থাকে। আয়শান অনেকটা সময় পর তুলির দিকে চেয়ে বলল,
“ এখানে বস,রাতেও ভারী কিছু খাসনি। খাবার আনব,খেয়ে নিবি চুপচাপ। ”
তুলি আবারও আড়ষ্ট ভঙ্গিতে তাকাল। ক্ষিধে লেগেছে তার। তবে এভাবে আয়শানকে পাঠিয়ে খাবার আনানোটা তার কেমন লাগল যেন। বলল
“ এখন মাঝরাতে ক্ষিধে পায়নি। একেবারে সকালেই খেয়ে নিব… ”
আয়শান শক্ত স্বরে শোনাল,
” না, এখনই৷ খেয়ে,মেডিসিন নিয়ে ঘুমাবি। ”
তুলি আবারও বলার চেষ্টা করল,
“ আপনাকে আনতে হবে না, আমি সকালে নিজেই খেয়ে নিব। ”
আয়শানের এবারে মেজাজ খারাপ হলো যেন। ভ্রু কুঁচকেই তাকাল কঠোর দৃষ্টিতে। তারপর শুধাল গমগমে স্বরে,
“ খাবার আমি আনলে সমস্যা? জানি আমায় ঘৃণা করিস তুলি, তাই বলে আমার আনা খাবার খেতে ও তোর সমস্যা হবে? ”
তুলি অসহায় দৃষ্টিতে চাইল। কি বলা উচিত তার? কি উত্তর করা উচিত? সে ঘৃণা করে আয়শানকে? না তো। তবে কোথাও একটা এই মানুষটার প্রতি তার হাজারটা অভিযোগ আছে। অবশ্যই আছে। ওটা ঘৃণা নয়। বলল,
“ তেমন নয়, আপনার কষ্ট করে আনতে হবে বলেই নিষেধ করেছি আয়শান। আর কিছু নয়। আর হ্যা, আমি আপনাকে ঘৃণা করি না। আপনাদের বাড়ির কাউকেই ঘৃণা করা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।”
আয়শান হেসে বলল,
” অথচ তোর চোখেমুখে স্পষ্ট ফুটে উঠে আমার নামে হাজারটা অভিযোগ। স্পষ্ট বুঝা যায় আমার প্রতি তোর বিদ্বেষ! ”
তুলিও এবারে মৃদু হেসে জানাল,
” আমরা মানুষ আয়শান ভাই। স্বভাবগত কিছু বৈশিষ্ট্য তো থাকবেই যেহেতু আমিও মানুষ। এটা তো ঠিক আমি আজ সবার চোখেই অপরাধী তাই না? আমায় আগে সবাই যেমন ভালোবাসত এখন কিন্তু সবাই আমাকে অপছন্দই করে । কারণটা কি? আমি তো কিছু করিনি। বিয়েটা আপনি করেছিলেন। যদি তখনও জানতাম আপনি ডেইজিকে ভালোবাসেন…”
আয়শান এবারে রেগেই তাকাল। দ্রুতই শক্তস্বরে বলল,
“ আমি ডেইজিকে ভালোবাসি না তুলি, এটা তোর ধারণা, শুধুই তোর ধারণা। ওকে আমি কখনো ভালোবাসিনি। ”
তুলি হাসে। তাহলে ঐ ডায়েরিটা মিথ্যে? যেটার ভিতর ডেইজির ছবি আছে? তুলি হেসেই বলল,
“ আপনি খুব নিখুঁত ভাবে মিথ্যে বলেন আয়শান।”
আয়শান এবারেও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দৃঢ় স্বরে জবাব দিল,
“আয়শান মিথ্যে বলে না তুলি। ”
“ আমি আপনাকে রেসপ্যাক্ট করি, আপনার ব্যাক্তিত্বকে আদর্শ মনে করি। সে হিসেবে আমিও জানতাম আপনি মিথ্যে বলেন না আয়শান। কিন্তু সত্যটা এটাই আপনি ডেইজিকে অনেকটা ভালোবাসেন। কৈশোর কালের শুরু থেকেই ভালোবাসতেন।এতোটা অনুভূতি নিয়ে ভালোবাসতেন যে আমি নিজেই ডেইজির প্রতি আপনার অনুভূতি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। ”
আয়শানের এবারে রাগে জেদে নিজের মাথা নিজেই ফাঁটাতে ইচ্ছে হলো। কি করে সে বুঝাবে যে সে তুলিকে ভালোবাসে। তুলি ব্যাতীত অন্য কোন মেয়েকে সে কখনো ভালোবাসেনি। কখনোই না। তুলি কেন মনে করে যে সে ডেইজিকে ভালোবাসে? কেন? আয়শান ত্রুতই বলল,
“ কখন দেখিয়েছি আমি ডেইজির প্রতি মুগ্ধতা? ”
তুলি হেসে জানাল,
“ অন্তর্মুখী মানুষরা লোকসম্মুখে ভালোবাসা না দেখালেও হৃদয়ে ভালোবাসা ঠিকই রাখে। আপনিও অন্তর্মুখী মানুষ। সে হিসেবে কখনো কারো সম্মুখে ডেইজির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করেননি। কিন্তু আমি জানি, আপনি ডেইজিকে ভালোবাসেন। এবং ভালোবাসাটা অনেকটাই গাঢ়! ”
আয়শান মানল না। বলল,
“ হ্যাঁ আমি ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারি না, অন্তর্মুখী মানুষ। কিন্তু তুই ভুল জানিস তুলি। ভুল বলছিস। আমার হৃদয়ে প্রেম থাকলেও তা ডেইজির জন্য কখনোই ছিল না। আই রিপিট, ডেইজির জন্য কখনোই ছিল না। ”
তুলি এবারেও মৃদু হাসল। আয়শানের দিকে চেয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলল,
“ ডেইজিকে ভালোবাসেন এটা আমি জানলে কিছু হবে না আয়শান ভাই। এটা স্বাভাবিক। আপনি একটা মেয়েকে ভালোবাসতেই পারেন। অনুভূতি থাকতেই পারে। খারাপ নয় তো। এটা অন্যায় কিছু নয়। ”
এবার যেন আয়শানের সত্যিই রাগে জেদে চোখ লাল হয়ে এল। ইচ্ছে হলো রাগে জেদে কিছু ছুড়ে মারুক। ভেঙ্গে ফেলুক। অথচ তা পারল না। রাগে চোখ লাল করে সে তুলির দিকে ঝুঁকল। গম্ভীর,দৃঢ় আওয়াজে বলল,
“ একটু আগে কি বলেছি? আমি ডেইজিকে ভালোবাসিনি কখনো, ভালোবেসেছি তাকে যাকে বিয়ে করেছি। নয়তো তোকে একা নিয়ে গিয়ে সেদিন বিয়ে করে নিতাম না আমি তুলি! ”
কথাটা বলেই আয়শান অপেক্ষা করল না। দ্রুত পা বাড়িয়ে রুম ছেড়ে বাইরে গেল। অতঃপর তুলির জন্য খাবার গরম করে আনতে কিচেনে গেল। রাগে তার শরীরের রক্তকণিকা গুলোও যে শিরশির করছে। জেদ হচ্ছে কেমন। নিজের চুলগুলো নিজেই খামচে ধরে সে। অতঃপর বিড়বিড় স্বরে বলে,
” আমি তোকে বুঝাতে ব্যর্থ তুলি। কেন বুঝিস না? কেন বুঝিস না বল? আমি তোকে ভালোবেসেছি। তোকেই চেয়েছি। তোকেই প্রেমনজরে দেখেছিলাম সর্বপ্রথম। তোর চাহনি, নম্রস্বভাব, সহজ সরল থাকা, নিশ্চুপে কষ্ট পাওয়া, তোর সব আমায় আকৃষ্ট করেছিল তুলি। আমি ছোট থেকেই তোকে বুঝতে পারতাম খুব সহজেই, তোকে পড়তে পারতাম খোলা বই এর মতোই।তোর সবকিছু নিজের আয়ত্ত্বে নিজের খেয়ালে রাখার চেষ্টা করতাম। তারপর একটা সময় পর বুঝলাম এগুলা আমার খারাপ অভ্যেসে পরিণত হচ্ছে। আমি ক্রমেই তোর দিকে ঝুঁকে যাচ্ছিলাম তুলি, ক্রমেই তোর প্রতি একটা গাঢ় অধিকারবোধ জম্মাতে লাগল আমার।আমি এই খারাপ অভ্যেসটা ঠেকিয়ে রাখলাম না, বাঁধা দিলাম না। অতঃপর বুঝলাম এই সবকিছু কিসের ইঙ্গিত। বুঝে উঠেই স্বীকার করলাম যে তোকে আমার লাগবে। লাগবেই! আর সে কারণেই তোকে বিয়ে করেছিলাম। পাপ করে ফেলেছি না? খুব বেশি পাপ? তুলি? কেন ভাবিস যে আমি ডেইজিকে ভালোবাসি? কেন? এই ধারণা কেন জম্মাল তোর? কেই বা বলেছে এই কথাটা তোকে? আমি তোকে বুঝাতে পারছি এই ব্যর্থতায় আমার কেবল রাগ লাগে। ক্রোধে আমার নিজেকেই এক একবার নিঃশেষ করতে ইচ্ছে হয়। ”
আয়শান কথাগুলো বলেই চোখ খুলে চাইল। এক গ্লাস পানি নিয়ে ঢগঢগ করে তা পান করল। অতঃপর খাবার গুলো গরম করে প্লেটে নিল।
#চলবে….
#প্রেমস্পৃহা
#পর্ব_১৪
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
এরপরে কেঁটেছিল বেশ কয়েকটা দিন। আযরান আর রোজের সম্পর্কটা কিছু সময় বিরোধীতার হলেও কিছু সময় নিরব প্রণয়ের সাক্ষীও রাখে যেন। আযরান কোথাও রোজের চোখে ভালোবাসা খুঁজে পেলেও পরমুহুর্তেই ভীত হয় এই ভেবে যে তার প্রতি রোজের ভালোবাসাটা আসলেই আছে তো? আযরান সরু শ্বাস ফেলে। এখন সে একটা রেস্টুরেন্টে বসে। যেখানে রোজও আছে। তবে তার সাথে নয়। সায়ানের সাথে। আযরান তীক্ষ্ণ চাহনিতে কেবল পরখ করছিল।কিছু নিয়ে কথা বলছে বোধহয়।ভাবে সে, কেন এসেছে রোজ এখানে? তাও লুকিয়ে? অবশ্য আযরানকে বলে আসতত এটা সে প্রত্যাশাও করল না। আযরান হেসে দূর থেকে পর্যবেক্ষন করছিল। প্রথম কয়েক মিনিট চুপচাপ দূর থেকে পর্যবেক্ষন করে গেলেও একটা সময় পর সে উঠে দাঁড়াল।আর চুপ থাকতে পারছে না বোধহয়, কিংবা সায়ানকে সহ্য করতে পারছে না। টানটান বুক করে এগিয়ে গিয়ে রোজের ঠিক পাশেই চেয়ার টেনে বসল সে। মাথাটা ঝুঁকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
“ ডেটিং এ এসেছিস জান? রিয়েলি? তাও আবার এই রাবিশ সায়ানটের সাথেই? ”
রোজ আচমকাই চমকাল। লুকিয়ে এসেছিল সে। বাড়িতে বলেছে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে হবে। আযরানকে তো তাও বলেনি।না বলেই এসেছিল। অথচ আযরান এভাবে এখানে চলে আসবে তা তো সে স্বপ্নেও ভাবেনি। রোজ চমকে উঠলেও সামলে নিল যেন নিজেকে। ছোটশ্বাস ফেলে বলল,
” সুন্দরভাবে কথা বলুন আযরান। ”
আযরান কিছু বলতে নিবে তার আগেই সায়ান হেসে বলে উঠল,
“ ডেটিং এ আসলেও তোর কি সমস্যা আযরান? ”
আযরানের মেজাজ খারাপ হয় যেন এমন প্রশ্নে।সায়ানের কলার চেপে ধরে বলল,
“ আমি ওর হাজব্যান্ড। তুই কে? তোকে জিজ্ঞেস করেছি বেঈমান। তুই তো জা’নোয়ার থেকেও খারাপ। নিজের বন্ধুর সাথেই বেঈমানি করিস। ”
রোজ আশপাশে তাকাল। সবাই তাকাচ্ছে যেন। রোজ ছোটশ্বাস ফেলে।কপাল কুঁচকে আযরানকে শান্ত করার জন্য বলল,
”ছাড়ুন আযরান। আমি এক্সপ্লেইন করছি, সুযোগ দিন। ”
আযরান মানল না। শুধাল,
“ জাস্ট শাটআপ। ও তোর প্রেমিক, আমার নয়! ”
রোজ আবারও আযরানের হাতে হাত রেখে বলার চেষ্টা করল,
“ আযরান শুনুন আমার কথাটা। সিনক্রিয়েট করবেন না আযরান। ”
“ সিনক্রিয়েট আমি করছি? নাকি তুই? সামান্য কলার ধরাতে এতোটা প্রেম রোজ? অথচ আমার বেলায় তুই আমার বুকে চুরিই চালিয়ে দিয়েছিলি! ”
রোজ এবারে রাগে নাক লাল করে চাইল যেন। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল,
“ উনার কলার ছাড়ুন আযরান। শেষবার বলছি। ”
আযরান বারবার রোজের এই বাঁধা মানতে পারল না । যেন স্পষ্ট সে বুঝতে পারছে রোজের সায়ানের প্রতি কিছু আছে। নয়তো কেন এতোটা বাঁচাতে চাইছে? কেন? সামান্য কলার ধরাতে? আযরানের ইগো, রাগ সব যেন চূড়ায় উঠল। বলল,
“ কি বলবি তুই? স্বামী থাকা সত্ত্বেও পরকীয়ার পথ বেঁছে নিলি জান? আমি তোর থেকে এটা আশা করিনি। তুই আমায় ভালোইবাসিসনি রোজ, ওসব অনুভূতি তোর কিশোরী বয়সের আবেগ ছিল? নাকি নাটক করেছিলি? তোর থেকে তো ডেইজিই ভালো। আয়শান ভাইকে ও পাগলের মতো ভালোবেসেছিল, আর তার বোন? ”
“ আযরান। ”
আযরান ছেড়ে দিল সায়ানের কলার। অতঃপর রোজের দিকে চেয়ে বলল,
“বারবার বলেছিলাম জান, আমার সাথে গেইম খেলিস না, বিশ্বাস ভাঙ্গিস না।শুনলি না আমার কথা? চিট করলি রাইট? আমি তো সুযোগ দিয়েছিলাম তাই না? তোকে এই কয়েকদিনে আমি কখনো জোর করেছি ও বাড়িতে থাকার জন্য? বলেছিলাম জোর করে আমার সাথে থাক। আমি তো এমনও বলেছিলাম যে সায়ানকে শুধুমাত্র ইনভাইট করেছি যাতে তুই ওকে দেখতে পারিস রোজ।তুই আমায় ঠকালি রাইট? এটা তোর উচিত হয়নি। একদমই উচিত হয়নি। আমার প্রতি কয়েকবছর আগে ফেইক ভালোবাসা দেখিয়ে এখন আমার রিয়েল ভালোবাসা জিতে আমার ভালোবাসার মূল্য দিচ্ছিস না। আমি তো আর তোর মতো ফেইক ভালোবাসা বাসিনি রোজ।তোর মতো নই আমি। ”
আযরানের কথাগুলোতে রোজ ভ্রু কুঁচকাল। কথাগুলো শুনে হাসবে? নাকি কাঁদবে? কোনটা উচিত? তবুও উঠে দাঁড়াল সে। ঝুঁকে এবারে পুরো রেস্টুরেন্টের সামনেই আযরানের কলার চেপে ধরল সে। শক্ত স্বরে বলল,
“ লিসেন মিস্টার আযরান খান, আমি, রোজ শুধু আপনাকেই ভালোবেসেছিলাম। আপনাকেই। এখনও বাসি। আমার ভালোবাসা নিয়ে বারবার আঙ্গুল তোলা আমি মানব না আযরান। মাইন্ড ইট। এবং পরকীয়ার অভিযোগ তুললে আমি আপনাকে ডিরেক্ট ডিভোর্স দিব৷ ”
আযরান যেন এই কথারই অপেক্ষায় ছিল। বুকের ভেতর কেমন জানি সুখ সুখ লাগে তার। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
“ আমাকেই ভালোবাসিস? কি প্রমাণ? ”
রোজ আযরানের চোখে চোখ রাখে। বলে,
“ পেয়ে যাবেন প্রমাণ। সময় যাক, সময়ের সাথে সাথে পেয়ে যাবেন। ”
এটুকু বলেই রোজ চলে গেল নিজের পা চালিয়ে। আযরান শুধু বাঁকা হাসল। আর সায়ান তা খেয়াল করর হেসেই বলল,
“ ভাগ্যিস বিয়ে করিনি তোর বউকে। নাহলে তো ঠকে যেতাম বল। ”
আযরানের সুখ সুখ অনুভূতিটায় যেন আবকরও ঢিল ছুুড়ল। সায়ানের দিকে চেয়ে বলল,
“ তোর মতো শু’য়োর আমার রোজকে পাওয়ার যোগ্য ও নয়। ও শুধু আমার বুঝেছিস? চোখ দিবি না। ”
সায়ান হেসে বলল,
“ চোখ তো কোনকালেই দিলাম না। শুধুশুধু তুই শত্রু ভেবে গেলি আমায়। তবে কেড়ে নিতে চেয়েছিলাম অবশ্যই। শেষ মুহুর্তে এসে যখন কেড়ে নিতে পারলাম না তখন হার তো মানতেই হচ্ছে। ”
আযরাস রাগে হিসহিসিয়ে বলল,
“ লজ্জা হচ্ছে না বন্ধুর বউকে কেড়ে নেওয়া কথা এত গর্ব করে বলতে? যেখানে আজ জানতেই পেরেছিস যে ও শুধু আমাকেই ভালোবাসত, বেসেছে, ভবিষ্যৎ এ বাসবে! ”
সায়ান এবারেও হাসে। অতঃপর হাসি থামিয়ে শান্ত স্বরে বলল,
“ সাইকোলজিস্ট সায়ান এতোটা অবুঝ নয় আযরান যে তোর বউ এর চোখের ভাষা এর আগে বুঝেনি। শুরু থেকেই জানতাম ও শুধু তোকে ভালোবাসে। আমাকে নয়। আর আমিও রোজকে কখনো ভালোবাসিনি আযরান।এইজন্য বলতে লজ্জাও হচ্ছে না। আমি জাস্ট একটা বদলা নিতে চেয়েছি। ”
আযরান ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ বদলা? ”
“ হ্যাঁ, তোর বড়ভাই আমার জিনিস কেড়ে নিল বিনা নোটিশেই, আমিও চেয়েছিলাম তোর জিনিস কেড়ে নেই।কিন্তু দিনশেষে বুঝলাম প্রতিশোধের থেকেও ভালোবাসার শক্তিটাই বেশি। নয়তো তাকে ইচ্ছে করে এক্সিডেন্ট করানো হয়েছে এটা শুনে তার জন্য ভীত হতাম না। এতোটা অস্থিরও হতাম না তাকে কেউ মেরে ফেলার চিন্তা করতে পারে ভেবে।”
আযরান এবারে ভাবে। কপাল কুঁচকে যায়। অতঃপর ভেবে সে দ্রুত বলল,
“ কে? কাকে মেরে ফেলার চিন্তা করেছে কেউ সায়ান? তুলি? রিয়েলি? ”
সায়ান চুপই থাকে। আযরান আবারও বলল,
” কে মেরে ফেলার চিন্তা করেছে বল? আমি জানতে চাচ্ছি সায়ান। ”
সায়ান উত্তর দিল না। তবে উঠে দাঁড়াল। বলল,
” বাদ দে, ভালো থাক। এঞ্জয় কর ম্যারিড লাইফ। উঠছি আযরান।”
.
আজ আয়শানের আম্মু আর আয়জান আসবে। আয়শান অবশ্য তৈরি হয়েই আছে। মাকে আনতে যাবে। তুলির পা টা ও সেরেছে এই কয়েকদিন। হাড় না ভাঙ্গলেও মচকে যাওয়ার যন্ত্রনায় খুবই ভুগেছিল সে। এবং এই কয়েকটাদিন আয়শানও থেকে গেল বাড়িতেই। তুলিকে জানানো হলো কাজ আছে তার। অথচ আয়শানের কাজ নেই, সে থেকে গেল শুধু তুলির নিজের অসুস্থতায়ও নিজের যত্ন নিবে না বলে। শুধু মাত্র এই মেয়েটার যত্নের জন্যই সে থেকে গেল। অথচ এই মেয়েটা যে তা কখনো বুঝে উঠবে না তা সে শতভাব নিশ্চিত। আয়শান এসব ভাবতে ভাবতেই কিসের জন্য যেন ড্রয়ার খুলল। তুলির পড়ার টেবিলের ড্রয়ারটা। অতঃপর সর্বপ্রথমই যেটা চোখে পড়ল তা হলো একটা ডায়েরী। এই ডায়েরীটা আয়শানের নিজের ডায়েরী। যেখানে সে একটু একটু করে তুলির উপর জমে থাকা সমস্ত অনুভূতির কথন লিখেছিল সে কিশোরী বয়স থেকেই৷ কত কত মুহুর্ত যে লিখেছে সে, তবে নাম উল্লেখ করেনি কখনোই। আয়শান হাত বুলায় ডায়েরীটা। মাঝখানে অন্য বাসায় যাওয়ার পর সে এই ডায়েরিটা খুব খুঁজেছিল। অথচ পায়নি।এই বাসায়ও এই রুমে আলমারি, খাটের নিচ সব খুঁজেছিল। শুধুমাত্র তুলির জিনিসপত্র ছাড়া।তারপর এটা না পেয়ে হারিয়ে গিয়েছিল ভেবে নিয়েছিল। আয়শান বারবার তাকিয়ে দেখে। তারপর অপেক্ষায় থাকে তুলি কখন রুমে আসবে। কখন প্রশ্ন ছুড়বে। আয়শানের এই অপেক্ষা সমাপ্তির পর তুলি এল রুমে। ফ্রেশ হয়ে মুখচোখে পানি দিয়ে আসতেই আয়শান দ্রুত প্রশ্ন করল,
“এই ডায়েরীটা? তোর কাছেই ছিল এই ডায়েরীটা তুলি?”
তুলি তাকাল। এটা সে এই নিয়ে বহুবার পড়েছে। বহুবার! যেটায় ডেইজির ছবি আছে। তুলি নিজে থেকে ডেইজির ছবি পেয়ে দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করে নিয়েছিল যে এই ডায়েরিটা ডেইজির জন্য লিখা, ডেইজিকে ভেবে লিখা। তুলি অস্বীকার করল না। বরং উত্তর দিল,
“ ছিল। ”
আয়শান ছোটশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি অনেক খুঁজেছি।”
“ জিজ্ঞেস করেননি তো কখনো। দিয়ে দিতাম তাহলে। ”
আয়শানের ডায়েরী। তুলির অবশ্যই উচিত ছিল ফেরত দেওয়া। একে তো দেয়নি, আবার বলছে জিজ্ঞেস করেনি কখনো? আয়শান দ্রুত বলল,
“তুই কি এই ডায়েরীটা পড়েছিস তুলি? ”
তুলি এবারেও শান্ত ভঙ্গিতে উত্তর করল,
“পড়েছি।”
আয়শান এবারে বিস্ময় নিয়েই তাকায়। পড়েছে? নাকি মিথ্যে বলছে? একে তো তুলির মতো মেয়ে অন্যের ব্যাক্তিগত জিনিস লুকিয়ে পড়বে মানতে পারে না সে। দ্বিতীয়ত যদি পড়তই তাহলে এই ডায়েরীর সবকথা কি সে বুঝে উঠে নি? মেয়েটার ইঙ্গিত কি নিজের দিকে পায়নি? বুঝেনি যে আয়শান তাকে ভালোবাসে? আজকে একদিন দুদিন নয়, অনেক বছর যাবৎ! আয়শান বিস্ময় নিয়ে ফের বলল,
“পড়েছিস? ”
তুলি হেসে বলল,
“হ্যাঁ। আপনার ব্যাক্তিগত জিনিস, পড়ার জন্য দুঃখিত। ”
আয়শান উত্তর শুনে সন্তুষ্ট হলো না। ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ এটা পড়ার পরও তুই আমায় এখনো আপন ভাবতে পারিসনি তুলি? এটা পড়ার পরও তোর এতোটা অভিযোগ আমার প্রতি?”
তুলি বুঝে উঠে না যেন। তবে বলল,
“এই ডায়েরীর লেখার প্রতি আমি অভিযোগ রাখিনি তো আযরান ভাই। বরং মুগ্ধ হয়েছি। একজন মানুষের ভালোবাসা কতোটা প্রখর তা জানতে পেরেছি। ”
আয়শান ভ্রু বাঁকায়। বলে,
“এই প্রখর ভালোবাসাটা কার প্রতি ছিল তা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিস? ”
তুলি এবারেও হাসল। বলল,
“না বুঝতে পারার তো কিছু নেই।”
তারমানে বুঝেছে? বুঝেও তুলি সবসময় বলে যে আয়শান তুলিকে ভালোবাসে না? ডেইজিকে ভালোবাসে? তুলিকে ভালোবেসে বিয়ে করেনি? কেন? আয়শান দ্রুতই বলল,
“তাহলে? সব জেনেও কেন বারবার বলতি তুই আমাকে পাসনি? আমি তোকে ভালোবাসিনি? কেন বলতি এই কথাগুলো? ”
তুলি এবারে বুঝল না।অস্ফুট স্বরে বলে,
“ হু? ”
আয়শান এগোয়। ছোটশ্বাস ফেলে বলল,
“এ অনুভূতি গুলো কার প্রতি তা জানিস তো রাইট? ”
উত্তর এল,
“হ্যাঁ, ডেইজির প্রতি। জানি তো। ”
“ হু? কি বললি? ”
“আপনি ডেইজিকে ভালোবাসেন এটা। ”
উত্তর শুনে আয়শানের শান্ত থাকা মেজাজটা মুহুর্তেই উত্তপ্ত হলো। বলল,
“আমি ডেইজিকে ভালোবাসি না। বারবার একই কথা আমার ভালো লাগে না তুলি। ”
“এই ডায়েরিটা ডেইজির জন্য লেখা তাই এই কথাটা বলেছি। ”
আয়শান দৃঢ় স্বরে জানাল,
“ডায়েরিটা ডেইজির জন্য লেখা নয়। ”
“ কি প্রমাণ আছে? ”
“ তোর কাছে কি প্রমাণ আছে? ”
তুলি হাসল। উত্তে করল,
“ডায়েরীর ভেতরের ডেইজির ছবি ছিল। এখনও আছে। এটাই প্রমাণ!”
আয়শান মুহুর্তেই ভ্রু কুঁচকে বলে,
“ কোথায়?”
তুলি হাত বাড়িয়ে বলে,
“ এইদিকে দিন। ”
অতঃপর ডায়েরিটা নিল সে। ভেতর থেকে ডেইজির ছবিটা বের করল। হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবিটা দেখিয়ে সে বলল,
“ এই যে,এটা। ছবিটা ডেইজির নয়? ”
আয়শান তাকায়। হ্যাঁ ডেইজির ছবিই তো। কিন্তু এখানে? আয়শান ভালো করেই দেখে। তারপর মনে পড়ল এই ছবিটা তার আম্মু দিয়েছিল তাকে। যখন ডেইজিকে নিয়ে বিয়ের কথা হচ্ছিল। তখনই সরাসরি ডেইজির নাম না বলে এই ছবিটা রুমে এসে দিয়ে গিয়েছিল তার মা। জিজ্ঞেস করেছিল মেয়ে পছন্দ কিনা। আয়শান ছবিটা দেখেছিল। কিছুটা বিরক্ত হয়েই বোধহয় দেখে কপাল কুঁচকে নিয়েছিল। অতঃপর এই ছবিটা অবহেলায় কিংবা অসাবধানতা বশতই বোধহয় কখনো ডায়েরির ভাজে রেখেছিল সে। আয়শান ছোটশ্বাস ফেলে বলে,
“হ্যাঁ, ডেইজির। কিন্তু এই ছবিটা আমায় আম্মু দিয়েছিল। যখন ওর জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। ”
“ ওহ, কিন্তু ছবিটা সুন্দর হয়েছে। হাসছে ডেইজি।”
আয়শান চুপ থাকে এইবারে। তার মানে এই ছবিটা ডায়েরিতে পেয়েই তুলি ধরে নিয়েছিল যে এই ডায়েরীর সব লেখা ডেইজির জন্য? আর সে কারণেই এতদিন ভেবে এসেছে আয়শান ডেইজিকে ভালোবাসে?আয়শান ছোটশ্বাস ফেলে। বলে,
“তুলি? তুই কি সত্যিই এতোটা বোকা?আমার বেলাতেই এত বোকামো? আমি এই ডায়েরিটা ডেইজির জন্য লিখিনি। ডেইজির সাথে অন্তত আমার পরিচয় হয়েছিল ওর আট বছর বয়সে। কিন্তু এই ডায়েরিটা আমি যার জন্য লিখেছি তাকে আমি ছোট থেকে চিনি। ছোট থেকেই! আমি এটা লিখেছিও ডায়েরিটেতে। তুই পড়েছিস না?”
তুলি সহজ সরল ভাবে উত্তর দিল,
“হ্যাঁ। আমি আপনার অনুভূতি দেখে এতোটাই মুগ্ধ হয়েছি যে ডায়েরিটা কয়েকবারই পড়েছি। ”
আয়শান কি বুঝাতে চাইল তা বোধহয় তুলি কানেই নিল না। আয়শান ফের বলল,
“এই ডায়েরিটেতে আমি যতগুলো কাহিনী লিখেছি সব আমাদের বাড়ির ঘটনায়ই। তার মানে মেয়েটা আমাদের বাড়িতেই বেশি থাকত রাইট? ডেইজি আর রোজ তো মাঝেমাঝে আসত বাড়িতে, সারাক্ষন থাকত না। ”
তুলি চুপ এবারে। আয়শান আবারও বলে,
“ মেয়েটার মায়াময় মুখ, মায়ামায়া চাহনি বারবার উল্ল্যেখ করেছি আমি যা আমায় টানত। বারবার লিখেছি এটা। এচা পড়েছিস নিশ্চয়? ”
তুলি এবারেও চুপ।কিছু ভাবছে যেন। অতঃপর অনেকটা সময় পর সে প্রশ্ন তুলল,
“ তাহলে? কে হবে? কুহু? ”
আয়শান আশাহত! নিরাশ চাহনিতে চেয়ে বলে,
“ কুহু আমার বোন তুলি।বোন! তুই একবারও ডায়েরিটা পড়ে নিজের দিকে ইঙ্গিত পাসনি? এতোটাই অবুঝ তুই? ”
তুলি নিরব শীতল দৃষ্টিতেই তাকায়। যেন কোন প্রতিক্রিয়া নেই তার। কিংবা প্রতিক্রিয়া দেখাতে ভুলে বসেছে বা পারছে না৷ আয়শান আবারও বলল,
“ এই বাড়িতে কুহু ব্যাতীত মেয়ে বলতে তুই থাকতি তুলি।মেয়েটা তুই ছিলি তুলি। তোকে আমি এমনি এমনি বিয়ে করিনি , ভালোবাসতাম বলেই বিয়েটা করেছিলাম। ট্রাস্ট মি, আমি ডেইজি কে নয়,তোকেই ভালোবাসতাম। ”
তুলি শুনে গেল নিশ্চুপে। তবে বিশ্বাস করল কিনা কেজানে। কেমন শীতল, নিশ্চুপ, স্থির চাহনি। আয়শান আর কিছু বলল না। বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
“ আম্মু আর আয়জানকে আনতে যাব। দেরি হচ্ছে। তবে এটুকু বিশ্বাস কর, এই ডায়েরিটা তোকে ভেবে লেখা। অন্তত এই ডায়েরীর কথাগুলো মিথ্যে নয় তুলি। আমায় এটুকু বিশ্বাস তুই করতে পারিস। প্লিজ”
#চলবে….
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।