#প্রেমস্পৃহা
#পর্ব_১৫
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
রোজ বসে আছে তার বাবারই সামনে। তার বাবার মুখ গম্ভীর। একটু আগেই সে বাড়িতে ফিরে এসেছে দেখে প্রথমে যতোটা খুশি দেখাচ্ছিল এখন ঠিক ততোটাই গম্ভীর লাগছে। রোজ ছোটশ্বাস ফেলে। আবারও বাবার দিকে চেয়ে জানতে চাইল,
“ কি হলো আব্বু? বলছো না কেন? সেদিন তুলি আর কুহুর রিক্সাটায় যে গাড়িটা পেছন থেকে ধাক্কা দিল তা তোমার? তুমি সত্যিই এমনটা করেছো আব্বু? তোমার মেয়েদের বয়সী দুটো মেয়েকেই মারার চেষ্টা করেছো?আব্বু সত্যিটা বলো না আব্বু.. ”
কবির সাহেব গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালেন। অতঃপর ছোটশ্বাস ফেলে দ্রুত জানালেন,
“ তোর ভুল হচ্ছে রোজ, আমি মারার চেষ্টা করিনি। শুধু আঘাত দেওয়ার চেষ্টা করেছি।”
রোজ বিশ্বাসই করতে পারল না যেন। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল কিয়ৎক্ষন। তার বাবা? তার বাবা এমনটা করেছে তার বিশ্বাস হয় না যেন। আবারও বলে,
“ কি বলছে আব্বু? তুমি সত্যিই তাদের সেদিন এ্যাটাক করেছিলে আব্বু? তুলি আর কুহুকে?সত্যিই?কি করে পারলে? ”
“ ওরা পারলে আমি পারব না কেন রোজ? তোর আপুকে ওরা জ্বলজ্যান্ত লাশ বানিয়ে দিয়েছে দেখেছিস তুই? আমার মেয়েটার দিকে আমি তাকাতে পারি না। কি অবস্থা হয়েছে আমার মেয়েটার। ওরা তো ওদের মেয়েদের কষ্ট পেতে দেখেইনি কখনো। চোখের সামনে জ্বলজ্যান্ত লাশ হয়ে যেতে দেখেনি। কি করে বুঝবে বাবার বুকে কতোটা পুড়ে তার মেয়েদের কষ্ট পেতে দেখলে। তাই করেছি এমনটা, বুঝুক ওরাও। বাবাদের কষ্ট হয়। মেয়েদের কষ্টে বাবারা কষ্ট পায়৷ আয়শান ছেলেটার সাহস কত জানিস? ও ওর বউ এর জন্য আমায় চোখ রাঙ্গায়। আমায় ধমক দেয়। যেদিন এক্সিডেন্ট হয়েছে সেদিনই ও কল করে আমাকে জানায় ভালোয় ভালো মানতে সব। ওর বউ এর ক্ষতি করতে চাইলে নাকি ও আমাকে ছাড়বে না। এইটুকু ছেলে, ও আমার সাথে এভাবে কথা বলার সাহস পায় কি করে? ”
রোজ আবারও চমকাল। চোখে বিস্ময় জেগে উঠে। দ্রুত বাবাকে বলে,
“ আয়শান ভাইও জানে বিষয়টা আব্বু?তুমি, তুমি এমনটা কেন করলে! ”
কবির সাহেব তখনও ক্রোধে জ্বলছেন। বললেন,
“ বেশ করেছি! শুধু রাগ হচ্ছে আমার।প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম কেবল। এমনকি প্রতিশোধ নিতে নিজের কোম্পানির লস দিয়ে হলেও ওদের কোম্পানির বড়সড় একটা ক্ষতি করতে পেরে আমি আনন্দিত। আমার শুধু ওদের খারাপ দেখতেই ভালো লাগবে। ”
রোজের চোখ লাল হয়ে উঠে। বাবার কথা শুনে ছোটশ্বাস ফেলে। দুইবছর আগে যে প্রতিশোধস্পৃহা ছিল এটা বোধহয় দুইবছর পর আরো জ্বলজ্যান্ত হয়ে ধরা পড়েছে। এমনটা হলর ভবিষ্যৎ কি হবে? কি করবে সে? ছোটশ্বাস ফেলে বলল,
“ তোমার ছোটমেয়ে কিন্তু এখন ও বাড়ির অংশ আব্বু। এসব করে ছোটমেয়ের মুখটা কোথায় রাখছো? তোমার মনে হয় আমি আয়শান ভাই এর সামনে দাঁড়াতে পারব আর? আযরান জানলে? ”
কবির সাহেব এবারও রেগে উঠলেন। বললেন,
“তুমি ভুল করেছো। ভুল করেছো তুমি। উচিত হয়নি তোমার আযরানকে বিয়ে করা। ঐ বাড়ির মানুষের উপর আমার অনেক রাগ আছে জানতে না?আমার মেয়েটা ভালো নেই, ভালো নেই। তুই কি দেখিস না তোর বোন ভালো নেই রোজ? এতোটা নিষ্ঠুর কিভাবে তুই? বোনের খারাপ থাকাকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজে সুখী হতে চাস ঐ বাড়ির ছেলের সাথে? ”
রোজ এবারও জানাল,
“ আপু ভালো নেই কারণ আপু এখনও আয়শান ভাইকে ভালোবাসে। এটা আপুর নিজের বিষয় না সম্পূর্ণ?আয়শান ভাই এর দোষ কি? আপু কিশোরীকাল থেকেই আয়শান ভাই এর প্রতি বেশি পসেসিভ। কিন্তু যখন জানল আয়শান ভাই ভালোবাসে না,ওর উচিত ছিল না মুভ অন করা? তা না করে ও সংসারটাও ছেড়ে আসল। আমি জানি ও ভালো নেই। কিন্তু এতে ওদের দোষ? এতদিনে তো আপুর মেনে নেওয়ার কথা আব্বু।”
কবির সাহেব দাঁতে দাঁত চাপলেন। ঘৃণা নিয়ে বললেন,
“ রোজ? তুমি আমার মেয়ে হতেই পারো না। ঐ ছেলেকে ভালোবেসে নিজের পরিবারকে ভুলে গেছো তুমি? ছিঃ! ”
“ভুলিনি আমি। কিন্তু তুমি যেটা করলে সেটা অন্যায় আব্বু। কুহু আর তুলির কোন দোষ ছিল না। তুমি কেন ওদের উপর আক্রমন করলে? যদি ওদের খারাপ কিছু হতো? ক্ষমা করতে পারতে নিজেকে আব্বু? তোমার মেয়েদের মতোই তো ওরা৷ ”
কবির সাহেব এবার ওজ্বলন্ত চাহনিতে শুধালেন
“ মেয়েদের মতো বলেই করেছি রোজ। ওরা আমার মেয়েকে সুখী হতে দেয়নি। ওরা আমার মেয়ের সুখটা চাইল না একবারও। আমার মেয়েটা দিনের পর দিন ঘুমের ঔষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে। সাইকোলজিস্টের কাছে নিয়মিত যেতে হচ্ছে। পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছে আমার মেয়েটা। ওদের জন্যই তো। আমি যেভাবে রোজ চোখের সামনে আমার মেয়েকে মরতে দেখছি ওরা তো দেখছে না। ওদের মেয়েরা হেসেখেলেই আছে। আমি চেয়েছিলাম ওরা বুঝুক, ওরা জানুক মেয়েরা কষ্ট পেলে কেমন লাগে। আর ঐ তুলি মেয়েটাকে আমি পছন্দ করি না। জীবন গেলেও আমি ওকে সহ্য করতে পারব না কখনো। ওর জন্যই আমার ডেইজিটার আজ এই অবস্থা।”
এইটুকু বলেই কবির সাহেব উঠে গেলেন। রোজের চোখ টলমল করে যেন। কয়েকমুহুর্ত নিশ্চুপ বসে থেকেই সে লাল টকটকে চোখজোড়া থেকে গড়িয়ে পড়ল পানি৷
.
আয়শানের মা এসেই কিয়ৎক্ষন বিশ্রাম করল। ভাবল তুলিকে সামনে পাবে। অথচ তুলিকে এসে পর্যন্ত একবারও উনি সামনে পেলেন না। নিজের স্বামী ব্যাতিত সবার সাথে দেখা করলেও তুলির সাথে দেখা হলো না তার এখনো। বোধহয় দুইবছর আগে তুলিকে চোখের সামনে না থাকতে বলারই ফল এটা। উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কি করে মুখ দেখাবে মেয়েটাকে? কি করেই বা কথা বলবে? যাকে নিজের মেয়ের মতো বড় করেছে তাকে পুত্রবধূ হিসেবে মানতে পারেননি, এর দ্বারা তো এটাই বুঝায় যে উনি তুলিকে কখনো আপন ভাবেননি। তুলিও এটা মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করে নিয়েছে এই দুইবছরে যে এই বাড়ির কেউই তাকে আপন ভাবেনি কখনো। উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আয়শানকে ডেকে পাঠালেন। জানতে চাইলেন,
“ আয়শান, তুলি কোথায়? ও কি আমার সামনে আসবে না সিদ্ধান্ত নিয়েছে? এতদিন পর মামনিকে একবার দেখতেও আসছে না ও? ”
আয়শান শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়। ছোটশ্বাস ফেলে বলে,
“ ও যেমন মেয়ে নিজ থেকে তোমার সামনে আসার তো কথা নয়। যেখানে তুমি নিজেই বলে দিয়েছিলে ও যাতে তোমায় মুখ না দেখায়। ”
“ কোথায় তুলি?”
আয়শান ছোট করে বলল,
“ আছে হয়তো রুমে। ”
আযরানের মা এসেছিলেন আয়শানের মায়ের সাথে কথা বলতে। মাঝখানে তুলির কথা শুনে জানাল,
“না, নেই তো। ঐ যে বের হলো ফেরেনি এখনো। এতক্ষনে অবশ্য চলে আসার কথা। বোধহয় টিউশনিতে একটু সময় লাগছে। ”
আয়শানের মা নিরাশ হলেন যেন। বললেন,
“ ওহ।”
ফের আয়শানের দিকে চেয়ে বললেন,
“ আনতে পারবি ওকে একটু আয়শান? কতদিন হলো ওকে দেখি না। ”
“ দেখি, কল দিয়ে দেখছি। ”
আয়শান কল দিল। অথচ কল দেওয়ার পর নিরাশ ভঙ্গিতে বলল,
“কলও তো যাচ্ছে না আম্মু। আমি দেখছি দাঁড়াও, তোমরা ফ্রেশ হয়ে নাও। ”
আয়শান বেরিয়ে গেল যেন।আয়জান ততক্ষনে আয়শানের পিছু পিছু বের হয়। মজা করে বলে,
“ বড়ভাইয়া? তুলিকে বলে দিও ও বাড়িতে না থাকার অপরাধে আয়জান ভাই এর তরফ থেকে ও কোন গিফ্ট টিফ্ট কিচ্ছু পাবে না। ”
আয়শান হাসে কেবল। আয়জানকে আগের মতো হাসিখুশি চঞ্চল দেখে ভালো লাগছেে।ছেলেটা সত্যিই চঞ্চল বরাবরই। এতদিন পর বাড়ি এসে যেন সে সত্যিই খুব খুশি। আয়শানকে কথাটা বলতে বলতেই দেখল আযরান রুম থেকে আসছে। একটু আগেই আযরান বাড়ি এসেছেে।বড়আম্মু আর আয়জানের সাথে কথাবার্তা বলে রুমে গিয়ে তার মাথা খারাপ হলো যেন।আযরান ভেবেছিল রোজ বাড়ি ফিরেছে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে। অথচ বাড়ি এসে দেখল রোজ ফেরেনি।বাড়িতে আসেনি আর। এমনকি বাড়ির কোথাওই নেই মেয়েটা। আযরান ভ্রু কুঁচকায়। রোজ ফিরেনি? তার মানে? কপাল কুঁচকে আসে তার। সঙ্গে সঙ্গেই রোজকে কল দিল। অথচ তাকে নিরাশ করে দিয়ে রোজ কল তুলল না। আযরান দ্বিতীয় দফায় বিরক্ত হয়।কল দিতে দিতে কিয়ৎক্ষন পায়চারি করল সে। অতঃপর ছোটশ্বাস ফেলে এখানে আসল। আয়জান খেয়াল করল সরু চোখে। আযরানকে বলল,
“ কিরে আযরান ভাইয়া? তুই নাকি রোজকে বিয়ে করে ফেলেছিস? কিন্তু রোজ কোথায়? তোকেই বা এমন লাগছে কেন হুহ?”
আযরান ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বলল,
“ তোর ভাগ্য খারাপ, এসে একটা ভাবীকেও চোখে দেখতে পেলি না। যায় হোক, রোজকে নিয়ে আসছি, আনলে দেখতে পারবি।”
আয়জান হেসে উঠল। যেন মজার কিছু শুনল। বলল,
“ভাবী? ওরা আমার ভাবী হলো কবে থেকে? এইটুকু এইটুকু মেয়ে গুলা, দুইদিন আগেও ফ্যাঁ ফ্যাঁ করে কেঁদে ফেলত আমার সামনে। ওদের আমি ভাবী ডাকব? তোমার মনে হয়? ”
আযরান বলল
“তোর বড়ভাই এর বউ বেয়দব। ভাবীই ডাকবি।”
“ তুই তুলিকে কি ডাকিস ভাইয়া? ভাবী? ”
আযরান হাসল এবার। বলল,
“ তারপর বল, ভালো আছিস তো?”
আয়জান আপসোস করে বলল,
“ কিভাবে থাকব? তোমার শ্বশুড় তো তার মেয়েকে আমায় দিল না আযরান ভাইয়া, দিল অন্য এক পুরুষকে। ”
আযরানও তালে তাল মিলিয়ে বলল,
“ ফাজিল লোক। বলে লাভ নেই বল। ”
আয়জান হেসে বলে,
“ তা ঠিক। রোজ কেমন আছে? ”
“ ভালোই থাকবে। বেয়াদবরা সবসময় ভালো থাকে। ”
আয়জান এবারেও হেসে উঠল। বলল,
“ বেয়াদব? ”
আযরান উত্তর করল,
“ অবশ্যই। ”
.
আযরান গাড়ি নিয়ে গেল কবির সাহেবদের বাড়ির সামনেই। অতঃপর নেমে গেইটের কাছে এল। দারোয়ানকে একটু কাঁধ নামিয়ে বলল,
“ আপনার কবির সাহেবের মাথা তার কানেক্ট হয়েছে কি? ”
দারোয়ান সাহেব ভ্যাবচ্যাকার মতো চাইলেন। ছেলেটাকে চেনেন না এমন নয়। চেনেন। আগে একসময় অনেক আসা যাওয়া হতো তাই চেনেন। কিন্তু দুইবছর যাবৎ তেমন একটা দেখেনি। শুনেছে এই ছেলের সাথেই নাকি কবির সাহেবের ছোট মেয়ে পালিয়েছে। তাই গোলগোল চোখে তাকিয়ে বলল,
“ আপনি তো… ”
আযরান হেসে উঠল ঠোঁট বাঁকিয়ে। বলে উঠল,
“ হ্যাঁ, আমিই আপনাদের কবির সাহেবের ছোট জামাই। একটু কষ্ট করে কবির সাহেবের ছোট মেয়েটাকে ডেকে দিতে পারবেন? ততক্ষন দরকার হলে আপনার ডিউটিটা আমি করছি এইখানে দাঁড়িয়ে। ”
দারোয়ান দ্রুত বলল,
“ হু, রোজ আপা?”
“হ্যাঁ। ”
দারোয়ান কি করবে বুঝে উঠল না। শুনেছে কবির সাহেব বিয়েটা মানেনি। এখন ডেকে দেওয়াটা উচিত কি উচিত না বুঝে না। আযরান আবারও বলল,
“ আরেহ চিন্তা নেই, আপনাদের কবির সাহেব জানবেন না। জানলে আমি আছি তো। আপনি শুধু গিয়ে বলে আসবেন তার প্রাণপ্রিয় হাজব্যান্ডে গেইটে দাঁড়িয়ে আছে। ”
দারোয়ান কিয়ৎক্ষন হা না করে অবশেষে গেলেন ভেতরে। আর যাওয়ার কিয়ৎক্ষনের মধ্যেই আযরানের ফোনে কল এল। আযরান দ্রুতই কল উঠাল। ওপাশ থেকে রোজ বলল,
“ কি সমস্যা? পরকীয়ায় লিপ্ত স্ত্রীর জন্য এতটুকু চলে এসেছেন কেন? কি সমস্যা হ্যাঁ? ”
আযরান ঠোঁট বাঁকাল যেন। বলল,
“সমস্যা তুই জান। তুই না থাকলে তো চলবে না। ”
#চলবে…
#প্রেমস্পৃহা
#পর্ব_১৬
লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
তুলি এতগুলো দিন জেনে এসেছে আয়শান ভালোবাসে ডেইজিকে। মূলত এটাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছে সে৷ কিন্তু আজ যখন বুঝতে পারল ডায়েরীর লেখাগুলোর তার জন্য লেখা ঠিক তখনই অদ্ভুত এক ভালো লাগা কাজ করছে। ফুরফুরে লাগছে কেন জানি না মনটা। এতগুলো দিন যে চাপা কষ্টে জর্জরিত ছিল আজ বোধহয় তা একটুও বোধ হলো না। তুলি সত্যিই এই ডায়েরীর লেখাগুলোর প্রতি, অনুভুতির প্রতি মুগ্ধ হয়েছিল। একটা মানুষ অনেক গভীর থেকে ভালোবাসলেই এমনটা প্রকাশ করতে পারে বোধহয়। এতদিন কোথাও চাপা আপসোস হতো এই সকল অনুভূতি ডেইজির জন্য বলে। তবে আজ কোথাও যেন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তার। সাথে একমুঠো লজ্জাও। এই দুই বছরে আয়শান নিজ থেকে অনেকদিন জড়িয়ে ধরেছে তাকে।কখনো বা চুমুও দিয়েছে। অথচ লজ্জা হয়নি। নির্জীব মনিষীর ন্যায় সে চুম্বন, জড়িয়ে ধরা সে গ্রহণ করত। অথচ এসব কিছু ছাড়াও তার লজ্জা হচ্ছে। বারবার আয়শানের কথাগুলোই মস্তিষ্কে বাজছে। তুলি বাসা থেকে বের হওয়ার আগেও একবার ডায়েরিটা হাতে নিয়ে পড়েছে। এবং প্রতিটা লাইন পড়ে, প্রতিটা অনুভূতি বুঝে সে কেবল সূক্ষ্ম আনন্দ অনুভূতিতে ভাসছিল। আজ তার অভিযোগ আসল না, অভিমান জমল না। শুধু মনে হলো আয়শান সত্যিই তাকে ভালোবেসেছিল। সত্যিই তাকে চেয়েছিল। অথচ তাকে পায়নি। সে কতভাবে অভিযোগ করেছে, কতভাবে কষ্ট দিয়েছে। বিয়ের পর শুধুমাত্র তার অসুবিধা হয় দেখে আয়শান নিজের বাড়িতেও তেমন থাকত না। কতোটা ত্যাগ! তুলির খারাপ লাগে। আবার ভালো লাগাটাকেও খুব ভালোভাবে প্রকাশ করে উঠতে পারে না সে। টিউশনি থেকে মায়ের কবরে গিয়েছিল সে, কত কথা বলে ফেলল মায়ের সাথে!তারপর যখন ফিরতে লাগল তখনই চোখ পড়ল রাস্তায় গাড়িতে আয়শান অপেক্ষা করছে। তুলির বোধহয় এই প্রথমই আয়শানকে দেখে লজ্জা হলো মনে হলো যেন। অথচ এর আগে এমনটা হতো না। তুলি দেখেও সরাসরি আয়শানের মুখোমুখি না হওয়ার এড়িয়ে গিয়ে রিক্সায় উঠতে নিল। আয়শান ভ্রু কুঁচকেই তাকায়। দ্রুত নেমে ডাকে,
“তুলি? ”
তুলি ছোটশ্বাস ফেলে মুহুর্তেই উত্তর করল,
” হু। ”
আয়শান সামনে গিয়ে তাকাল। বলল,
“ গাড়িতে যাবি। ”
তুলি আর উঠল না রিক্সায়। মেনে নিল। আয়শান রিক্সাওয়ালাক না বলে দিয়ে যখন হাঁটছিল তখন ফের শুধাল,
” এড়িয়ে যাচ্ছিলি কেন আমায়? ”
তুলি উত্তর দেয় না। আয়শান আবারও বলে,
“ আমি সম্ভবত আমার দিকে তোলা একটা অভিযোগ তুলতে পেরেছি বল? যদি তোর তোলা সবকটা অভিযোগ তুলতে পারি তাহলে আমার প্রাপ্য? ”
তুলি শান্তস্বরে শুধাল,
“ আমার থেকে? আমি খুবই ক্ষুদ্র আপনার তুলনায় আয়শান। আমার থেকে আপনার প্রাপ্য কি হতে পারে? ”
আয়শান হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“ কেউ কাউকে ভালোবাসলে সে কি পাওয়ার আশা করে ঐ মানুষটার থেকে?”
তুলি এবার দাঁড়িয়ে পড়ল যেন। সেও তো আয়শানকে পছন্দ করত। অনুভূতি ছিল এই মানুষটার প্রতি। তবে তা প্রকাশ করেনি। বলল,
“ তা পেয়েছেন অনেক আগে। আপনি জানেন, আমি আপনাকে ভালোবাসি। কিন্তু কখনো আপনাকে আমার করে চাই নি আমি৷”
” না চাইলেও তোর করে পেয়ে গেছিস তো তুলি। কিন্তু চাস নি বলেই কি সম্পর্কটাকে পূর্ণতা দিবি না? এটাই সিদ্ধান্ত তোর?”
“ সময় আসুক। ”
আয়শান দাঁড়াল। হুট করেই বলল,
“ তুলি? দাঁড়া। এখানেই দাঁড়া। আজ কথা হোক সবটা। ”
“ কি? ”
“ আমার এই জটিলতা ভালো লাগে না।সত্যিই ভালো লাগে না। আমি মারা যাচ্ছি নিয়মিত তুলি। তুই দেখছিস না, দেখেও টের পাচ্ছিস না। আমার ব্যাথাটা বুঝ।প্রিয় মানুষ কাছে থেকেও দূরে থাকার যন্ত্রনা বুঝিস? ভালোবেসেও এই নির্জীব আচরণ পাওয়ার মানে বুঝিস? আমার করেও আমার না হওয়ার যন্ত্রটা বুঝিস? আজ নিশ্চয় আমার ভালোবাসা নিয়ে সন্দেহ নেই? আমি যে শুধু তোকে ব্যবহার করেছি এই অভিযোগ নিশ্চয় নেই?”
ফের আহত স্বরে বলে,
“ প্লিজ আমায় একটু ভালোবাসা দে তুলি, একটু! বেশি ভালোবাসতে হবে না৷ অল্প ভালোবাসাতেই একটা সুন্দর সংসার হোক আমাদের। ”
তুলির কেমন যেন ভালো লাগা কাজ করে। আজকের দিনটা সুন্দর। সত্যিই সুন্দর। উত্তর বলল,
“ আচ্ছা। ”
“ হু? ”
” আমি স্যরি, এতদিন আপনাকে দোষারোপ করার জন্য।আপনার যত্ন, আপনার ভালোবাসা না বুঝতে পারার জন্য দুঃখিত। আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখিত। আমায় ক্ষমা করতে পারবেন তো? ”
আয়শানের চোখমুখ যেন হেসে উঠল। বলল,
“ যদি ভালোবাসিস তবে পারব। ”
তুলি এবারে হাসল। হাসিটায় যেন একমুঠো লজ্জাও মিশ্রিত। আয়শান তাকায়। লজ্জামুখের তুলিকে আরো আদুরে দেখায় যেন। বলে,
“আমাদের তুলিকে লজ্জা পেলে বাচ্চা বাচ্চা আদুরর দেখায় তুলি। প্লিজ তুই এমর লজ্জামাখা মুখ নিয়ে আমায় ভালোবাসিস না, তাহলে অঘটন ঘটে যাবে। ”
তুলির পেটে যেন আচমকায় কিছু উড়ে গেল। গাল উষ্ণ হয়ে হয়ে এল। এমনকি কানও। আবারও কি বুঝা যাচ্ছে সে লজ্জা পাচ্ছে?আয়শান আবারও ঠোঁট কাঁমড়ে হাসে।বলে,
“ যদি এতদিন জানতাম আমার আম্মুর মিষ্টি মেয়েটা ডায়েরীটাতে একটা ছবি আবোল তাবোল ভেবে গিয়েছে এই দুইবছর । আমাকে সর্বক্ষন বলে গিয়েছে আমি তাকে ব্যবহার করেছি, ভালোবাসি বলেও বিশ্বাস করাতে পারিনি। যদি জানতাম! আমার সংসারটা বোধহয় অনেক আগেই হয়ে উঠত। ইশশ!”
.
আযরান দাঁড়িয়ে আছে। অথচ রোজ এলো না। একঘন্টা অপেক্ষা করে আযরান ছোটশ্বাস ফেলেই কল দিয়ে বলল,
“কি হলো? আসবি না? ”
রোজ তখনও চোখমুখ লাল করে বসে আছে। কান্না পাচ্ছে তার। কেন করল তার বাবা এমনটা? আযরান ইতোমধ্যেই সেদিন তাকে প্রশ্ন করেছে সে তুলি আর কুহুর এক্সিডেন্টের পেছনে কিনা। যদি সত্যিই জানে যে তার বাবা করিয়েছে এটা? আযরান কি ভাববে? বাবাকে নিয়ে অনেক বড়বড় কথা তো সে বলে ফেলেছে আযরানকে। আচ্ছা যে আযরানকে ভালোবাসে? মুখে না বললেও সে তো সত্যিই ভালোবাসে আযরানকে। সত্যি তো এটাই যে, আযরানকে ভালোবাসে বলেই বিয়েটা করেছে সে৷ কিন্তু আযরান যদি কখনো তাকে সরিয়ে দেয় জীবন থেকে।রোজ ছোটশ্বাস ফেলে। জানায়,
“আসব না।”
আযরান সঙ্গে সঙ্গেই বলল,
“কেন? আমি ও বাড়ি থেকে এ বাড়ি আসলাম, অথচ তুই এতটুকু পথ আসতে পারছিস না? নাকি পালিয়ে একেবারের জন্য চলে এসেছিস? যদি এমন টা হয় তাহলে তুই কিন্তু জানিস আমি তোকে কিভাবে নিয়ে যেতে পারি। ”
রোজ হাসল। বলল
“ বিয়ে যখন করেই ফেলেছি আপনার মতো ছাগল প্রজাতির পুরুষকে সেহেতু সংসার তো করব। ও বাড়ি ছেড়ে একেবারে আসিনি। ”
”তোর একমুখে কত কথা জান। এই বলিস বিয়েটা মানিস না, এই বলিস মানিস। তোর কথায় আমার বিশ্বাস নেই। ”
”তো?
আযরান আচমকায় প্রশ্ন ছুড়ে,
“ তোর বাপ আসতে নিষেধ করেছে? ”
রোজ মুখ শক্ত করে। উত্তর দেয়,
“ না, আমার ভালো লাগছে না আযরান। বুঝার চেষ্টা করুন। ”
“ ওকে। ”
আযরান এটুকু বলেই কল রাখে। অতঃপর গটগট পা ফেলে চলে গেল ভেতরে। রোজের আম্মুকে দেখে ঠোঁট চওড়া করে হাসি দিল প্রথমে। বলল,
“আসসালামুআলাইকু শ্বাশুড়ি আম্মু। কি অবস্থা বলুন। ভালো আছেন তো? ”
রোজের মা নূরজাহান হাসে আযরানের কথা শুনে। এই ছেলেগুলোকে উনি পরিচয়ের শুরু থেকেই ভীষণ ভালোবাসেন। সে ছোটবেলা থেকে। হেসে বললেন,
“ আযরান তুমি? ভালো আছো আব্বু? ”
“ ভালো ছিলাম, এখন মনে হচ্ছে নেই আম্মু। আপনার মেয়েটা চলে আসল। ”
উনি হেসে বললেন,
“ কিছু করেছো নাকি যে আমার মেয়ে চলে আসল? ”
“ না তো, একদম বিনা নোটিশেই চলে এসেছে আপনার মেয়ে। ”
“ তাহলে তো ভারী অন্যায়। ”
আযরান মুখচোখ হতাশ দেখিয়ে বলল,
“ তাই তো।আচ্ছা,আপনি মেনে নিয়েছেন বিয়েটা আম্মু? ”
উনি হেসে ফের বললেন,
”অবশ্যই, তুমি তো ছেলে হিসেবে খারাপ নও আব্বু। বরং আমি রোজকে নিয়ে চিন্তাই করছিলাম যে তোমাকে না পায় তাহলে ভবিষ্যৎটা কেমন হবে? আমার মেয়েটা তোমায় পাগলের মতো ভালোবাসে আব্বু। সে স্কুল জীবন থেকেই। দুটো বছর তোমার থেকে দূরত্বে থেকে কেমন নিরব ছিল। চিন্তা হচ্ছিল ওর অবস্থাও যদি ডেইজির মতো হয়। যদি সংসারটা গুঁছিয়ে না উঠতে পেরে বড় মেয়ের মতোই চলে আসে।কিন্তু ওর বাবার জেদের কাছে কিছু বলতে পারিনি। এখন অবশ্য নিশ্চিন্ত।”
আযরান হাসল। বলল,
“ আপনার মতো করে শ্বশুড় আব্বু বুঝে গেলেই বিষয়টা সলভ হয়ে যেত বলুন আম্মু? ”
” ঠিক তো। ”
বাচ্চামতো মুখ করে আযরান বলল,
” বুঝিয়ে বলেন না আম্মা। ”
“ হয়তো একটু রেগে আছে এখন, তবে মেনে যাবে আব্বু। সে তার মেয়েদের সবথেকে বেশি ভালোবাসে। অপেক্ষা করো একটু। ”
আযরান মাথা নাড়ে। মানলেই ভালো। না মানলে সেও ত্যাড়ামো করবে। আযরান এবারে বাচ্চাদরর মতো আবদার করে বলল,
“ আপনার মেয়ের কাছে যাব একটু? যেতে দিবেন? ”
উনি হেসে উঠলেন। বললেন,
“ অবশ্যই, যাও আব্বু। ”
.
রোজ কিছু ভাবছিল বোধহয় বেলকনিতে। আযরান খুব সতর্কতার সঙ্গেই এল।নিঃশব্দে এসে পেছন থেকে জড়িল নিল রোজকে। অতঃপর ঠোঁট ছোঁয়াল রোজের কাঁধে।রোজ বুঝে উঠে যেন। বলে,
“ চলে এসেছেন এখানে?”
“তুই-ই তো আনলি জান। তুই না গেলে আমি কি তোকে না দেখেই চলে যেতাম? এতোটা সহজ সরলও আমি নই। ”
রোজ ছোটশ্বাস ফেলে। বলে,
“ দেখা হয়ে গেলে চলে যান। ”
আযরান মোটেই চলে গেল না। ওভাবেই থাকল। তারপর হঠাৎই রোজকে নিজের দিকে ঘুরাল। তারপরই যেন চমকাল। রোজ কেঁদেছে? এমন কেন চোখমুখ? বলল,
” কেঁদেছিস কেন জান? ”
রোজ বলে না কিছু। আযরান আবারও বলে,
“ বল না, কেন কাঁদলি রোজ?”
রোজ উত্তর করে না। ওভাবেই অনেকটা সময় গেল। আযরান জড়িয়ে নিয়ে রোজের দুইগালে, চোখের পাতায় চুমুও দিল। অথচ রোজ উত্তর করে না৷ আযরানও নিশ্চুপই থাকে। তারপর কিছু মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলল,
“ সায়ন তুলিকে ভালোবাসে রোজ? তুলির কেউ ক্ষতি করতে চেয়েছে। তুই জানিস সেটা বল? সায়ন নিশ্চয় তোকে বলেছে? ”
রোজ চমকে উঠল যেন। মাথা তুলে আযরানের দিকে তাকাল। গলা শুকিয়ে আসল কেন। তবুও বলল,
” না তো, বলে নি। ”
আযরান তাকায়। ভ্রু উঁচিয় বলে,
“ আমি জানি বলেছে,বল না জান। ”
রোজ দ্রুতই বলল,
“ আর করবে না ক্ষতি সে। তবুও জিজ্ঞেস করবেন না কথাটা। প্লিজ। ”
আযরান এবারে আর জিজ্ঞেস করল না। রোজকে জড়িয়ে রাখলেও এবার বন্ধনটা হালকা। রোজ বলল,
“ জড়িয়ে ধরেছিলেন কি এই উত্তরটা পাওয়ার জন্যই? এমনকি এতদূর এসেছেনও কি এই উত্তরটার জন্য? ”
আযরান ছোটছোট করে তাকায়। বলল,
” না জান, তোর জন্য এসেছি।”
“ আচ্ছা আযরান? কখনো যদি জানেন আমি আপনার পরিবারের জন্য ক্ষতিকর, কি করবেন?”
” আমার জন্য আমার পরিবারের ক্ষতি হোক তা কখনোই আমি চাইব না রোজ। তুই ক্ষতি করলে আমার ক্ষতি করবি, আমার পরিবারের নয়। এটা মাথায় রাখিস। এমনিতেই বিজন্যাস এ তোর বাপ বড় একটা লস ধরিয়ে দিয়েছে।এখন তুইও যদি আমার পরিবারের ক্ষতি করতে চাস তো তোকে ক্ষমা করব কি করে বল?”
রোজ চুপ থাকল। অতঃপর তাকাল আযরানের দিকে। খুব সরু চোখে তাকিয়ে আযরানকে পরখ করে। অতঃপর অনেকটা সময় পর রোজ ওভাবেই আযরানকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। বলল,
“আযরান? আমাকে কাছে টানবেন প্লিজ? ”
আযরান ভ্রু কুঁচকায় কেবল। রোজ আবারও বলল,
” আমায় স্ত্রীরূপে কাছে নিবেন? ”
আযরান হেসে বলল,
“ তোকে তো স্ত্রী হিসেবেই কাছে রেখেছি জান। ”
রোজ তাকিয়ে বলে,
“ আমি আমাদের বৈবাহিক সম্পর্কের কথা বুঝিয়েছি আযরান। ”
আযরান চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে তাকায় যেন এবারে। বলে,
“ তুই বলছিস? ”
“হ্যাঁ। ”
“ কিন্তু.. ”
রোজ ভ্রু কুঁচকে বলে,
“ কিন্তু? আমার প্রতি আপনার সন্দেহ আছে তাই তো? ক্ষতি করব আপনার পরিবারের?এইজন্য কাছে টানবেন না রাইট? জানতাম আমি! আপনি সেদিনও আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন। ”
এটুকু বলে আযরানের দিকে তাকায়। আবারও বলে,
“ আমি আমার উত্তর নাই ধরছি.. ”
আযরান হাসল হঠাৎ। রোজকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে দ্রুত বলল,
” না, উত্তরটা হ্যাঁ। আমার তোর প্রতি সন্দেহ নেই। সত্যিই নেই। তোকে ভালোবাসতেও দ্বিধা নেই। ”
.
তখন প্রায় রাত আটটা কি নয়টা। এতোটা সময় দুইজন নরনারী এক ঘরে। রোজ ততক্ষনে আযরানের বুকে মুখ লুকিয়েছে। আযরানের চোখেমুখে হাসি কেমন। হেসেই বলল,
“ছিঃ রোজ! কি সর্বনাশ করলি আমার? শ্বশুড়বাড়ি এসে কিনা এখন আমার ভার্জিনিটি লুপে নিলি তুই? ”
রোজ তাকাল মিনমিনে দৃষ্টিতেই। আযরান আবারও বলল,
“আমার তো লজ্জা হচ্ছে, আমার শ্বাশুড়ি আম্মু কি ভাবছে বল তো এতোটা সময় এক ঘরে আছি দেখে? ”
রোজ তাকাল। উত্তর করল,
“ কিছু ভাবছেন না। আমার আম্মুর মাইন্ড আপনার মতো নয়। ”
“মানে? ”
“কিচ্ছু না। ’
আযরান হাসে। রোজের নাকে ঠোঁট ছোঁয়াল আদুরে ভঙ্গিতে। বলল,
”ঠিক আছে। কিন্তু আমার অনেক ইচ্ছা বাসরটা আমি বিয়ের পর করব। ”
রোজ ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ বিয়ের আগে করেছেন? ”
আযরান হেসে বলে,
“না, বড়আব্বুকে আজই বলেছিলাম তোর আর আমার বিয়ের অনুষ্ঠান করতে। বড় আম্মুকেও বলেছিলাম।আমার ইচ্ছা ছিল আনুষ্ঠানিক বিয়ের রাতেই বাসর সেরে ফেলার, কিন্তু তুই বজ্জাত।”
.
কবির সাহেব এলেন প্রায় রাত এগারোটায়৷ আযরানকে অবশ্য তখন দেখা গেল না, কারণ সে রোজের রুমেই। খাবারদাবারও তাদের রুমেই পাঠিয়ে দিয়ে নূরজাহান৷ তাই কবির সাহেব আর জানতেই পারলেন না আযরান এসেছে, তারই বাড়িতে তার মেয়ের সাথে আছে। খাবার টেবিলে ডেইজি আছে, রোজ নেই দেখে উনি বললেন,
“ রোজ কোথায়? ডাকছো না ওকে? ”
ডেইজিই বাবার দিকে তাকিয়ে উত্তর করল,
“ খেয়ে নিয়েছে ও। ”
উনি মাথা নাড়ালেন। নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ ও বাড়ি থেকে রোজ আর আযরানের আনুষ্ঠানিক বিয়ের বিষয় কথা বলল। কল করে জানাল। আমি না করে দিয়েছি নূর।”
নূরজাহান স্বামীর দিকে আশাহত ভাবে তাকালেন। ডেইজিও চোখ ছোটছোট করে দ্রুত বলল,
“ তুমি রাজি হলে না কেন আব্বু? তুমি কি চাওনা রোজ সুখী হোক? ”
কবির সাহেব মুহুর্তেই বললেন,
“তাই বলে ঐ পরিবারের সাথে আম্মু? হার মানব আমি ”
ডেইজি ছোটশ্বাস ফেলে। জানাল,
“ তুমি কি তোমার মেয়েদের ভালোবাসো না আব্বু? নাকি আমায় ভালোবাসো, আর রোজকে ভালোবাসো না এমন? তুমি চাও রোজও আমার মতো কষ্ট পাক? মেনে নিচ্ছো না কেন ওদের বিয়েটা আব্বু? ভালোবাসা তো পাপ নয়! ওরা দুইজনই দুইজনকে ভালোবাসে আব্বু। শুধু তোমার ইগোর জন্য ওদের আলাদা হতে হবে? আমার মতো যন্ত্রনায় থাকতে হবে? ”
কবির সাহেব চোখ ছোট ছোট করে চাইলেন। উনার ইগোর জন্য উনার মেয়ে অসুখী হবে? কেন? ঐ পরিবারের মানুষ ভালো নাকি? উনি অবশ্যই ভালো সিদ্ধান্ত নেননি কি? ডেইজি আবারও বলল,
“ বুঝার চেষ্টা করো আব্বু, তোমার এক মেয়ে ভালোবাসা পায়নি মানে সে তোমার অন্য মেয়ের ভালোবাসায়ও বাঁধা হতে পারে না। আমায় ভিলেইন বানাচ্ছো তুমি আব্বু। রোজের চোখে খারাপ বানাচ্ছো। আমি চাই রোজ সুখী হোক, ভালো থাকুক। ভালোবাসার মানুষের সাথে সুখী থাকুক। আমার মতো কপাল ওর না হোক। ”
কবির সাহেব এবার যেন বুঝলেন। ডেইজি বোধহয় আসলে সঠিক বলছে এমনটা বুঝে উনি কেমন নিরব দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন। ডেইজি এবারে ছোটশ্বাস ফেলে মাকে বলল,
“ আম্মু? তুমি একটু কিচেন থেকে খাবারগুলো আনবে? ”
নূরজাহান ও ছোটশ্বাস ফেলে কিচেনের দিকে গেলেন। ডেইজি এবারে বাবার দিকে চাইল। বলল,
” কুহু আর তুলির সাথে এটা করা তোমার উচিত হয়নি তোমার আব্বু। সত্যিই উচিত হয়নি। আমি তুলিকে পছন্দ করি না ঠিক, তবে কুহুকে অনেক ভালোবাসি। তুমি এমনটা করতে পারো না ওদের সাথে। ”
কবির সাহেব বিস্ময় নিয়ে চাইলেন। তার বড় মেয়ে ডেইজিও জেনে গেল বিষয়টা? উনি চোখ ছোট ছোট করে তাকালেন। ডেইজি এবার দৃঢ় চাহনিতে দৃষ্টি রেখে বলল,
“ কেন করলে এমনটা বলো? ”
কবির সাহেব বড় মেয়েকে খুব বেশিই মানেন। তাই মেয়ের রাগ বুঝে দ্রুতই বললেন,
“ আর করব না আম্মু।রাগ করে না, শান্ত হও আম্মু। ”
ডেইজি তাকাল। বলল,
“ আমি চাই না আমার আব্বুকে কেউ খারাপ বলুক আব্বু। আমার আব্বু খারাপ নয়। ভালো। সে সুপারম্যান আমি জানি। এই ইমেইজটা নষ্ট করো না আব্বু। ”
“ করব না আম্মু। ”
ডেইজি মৃদু হাসল এবার। আবারও বলল,
“ আব্বু? একটা অনুরোধ করি? রোজকে সুখী হতে বাঁধা দিও না প্লিজ। আমি চাই না রোজও আমার মতো এই যন্ত্রনা ভোগ করুক। আমি চাই না আমার বোন অসুখী হোক। ওকে সুখী দেখতে চাই আব্বু। ”
কবির সাহেব কেবল উত্তর করল,
“ হবে সুখী ও। ”
#চলবে…..