#প্রেমস্পৃহা
#অন্তিম_পর্ব
#লেখনীতেঃ অলকানন্দা ঐন্দ্রি
রোজ আর আযরানের বিয়ের ব্যবস্থা করা হলো খুব দ্রুতই। এবং খুব সুন্দরভাবেই দুইজনের আনুষ্ঠানিক ভাবে বিয়ের অনুষ্ঠানও সম্পন্ন হলো। কিন্তু যখন কনে নেওয়ার সময় হলো তখনই রোজের কি ভীষণ কান্না! আযরান তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল কেবল। দূর থেকে আয়জান তা দেখে হাসে। এইরকম দৃশ্যটা দ্রুত ক্যামেরায় বন্দি করে নিয়ে পাশে ডেইজিকে দেখে বিড়বিড় করে বলে,
“ তোর বোন কাঁদছে, আর আমার ভাই নিরবে ছাগলের মতো তাকিয়ে আছে। দৃশ্যটা সুন্দর না বল।”
ডেইজি তাকাল রেগে যেন। একটা মেয়ে কাঁদছে তা নিয়েও হাসতে হবে? ফোঁস করে শ্বাস ফেলে শুধাল,
“ আপনি মেয়ে হলে বিয়ের সময় কান্না করতেন না আয়জান ভাইয়া? ”
আয়জান সরু চোখে তাকাল। সে কি বলেছে মেয়ে হলে কাঁদবে না? বা রোজের কান্না নিয়ে হেসেছে নাকি? সে হেসেছে তার ভাই এর সহজ সরল দৃষ্টি দেখে। বলল,
“ আমি ছেলে থেকে মেয়ে হতে যাব কেন? ছেলে হয়ে জম্মেছি ছেলে হয়েই থাকব৷ ”
ডেইজি এইবারে কিছু বলল না। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ল। এইদিকে কিছু উত্তর করল না দেখেই আয়জান মুখ বাঁকিয়ে বলে,
“ ভাবওয়ালি! বেশি ভাব দেখাস তুই ডেইজি। আমি তোর সাথে কথা বলতে মরিয়া হয়ে যাচ্ছি না নিশ্চয়? ”
ডেইজি এবারেও রেগে তাকাল। দাঁত চিড়বিড় করছে তার। বলল,
” মরিয়া হয়ে না গেলে একটু চুপ থাকুন প্লিজ। যেচে পড়ে এমন ছাগলের মতো কথা বলতে থাকবেন না। ”
আয়জান নিজেকে ছাগল বলার জন্য খুব করে প্রতিবাদ করল। বলল,
“ তুই ছাগল। তোকেই লাগছে একদম ছাগলের মতো। ”
এইটুকু বলে ঐ স্থান থেকে হুড়হুড় করে চলে যেতে নিতেই আবারও ঘটল বিপত্তি। নিচে বোধহয় কলার খোসা ছিল। আয়জান সে কলার খোসায় পা রেখেই স্লিপ কেঁটে ধপাস করে পড়ল সবার সম্মুখে। মুহুর্তেই সে ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলেও আয়জানের পড়ার স্টাইলটা দেখে জোরে হেসে উঠল ডেইজি। এমনভাবে চিৎপটাং হয়ে পড়েছে না হাসলেও হাসি আসতই! উপস্থিত সবাই যখন ঘটনাটা খেয়াল করল তখনই ডেইজি বুঝে উঠে নিজের হাসিটা থামাল। আয়জান ততক্ষনে আর্তনাদ করে বলল,
”বেয়াদব, দাঁত কেলিয়ে হাসবি না। তুই পড়িসনি, ব্যাথা তোর লাগে নি। আমার লেগেছে। ”
ডেইজি হাসি থামাল ঠিক তবে তখনও তার হাসি পাচ্ছে। ভীষণ হাসি পাচ্ছে। কেউ পড়ে গেলে হাসাটা কি অপরাধ? অন্য দিকে কবির সাহেব নিজের বড় মেয়েকে আবারও অনেকদিন পর মন খুলে হাসতে দেখে আনন্দিত হলেন। খুশি হলো মনে মনে।
.
তুলি খুঁজে খুঁজে ডেইজির সাথে একটু একা কথা বলতে চেয়েছিল। অবশেষে সে সুযোগটা হলো কনে বর গাড়িতে উঠে বসার পর। আয়জানরা ডাকতে আসলে তুলি একটু পর আসছেই বলল। তুলি ডেইজিকে পেছন থেকেই ডাক দিল। বলল,
” ডেইজি,শুনছো? ”
ডেইজি তাকাল পেছন ঘুরে। তুলিকে দেখে চোখ ছোটছোট করে চাইল। স্বভাবতই সে তুলিকে পছন্দ করেনি কোনদিন। হয়তো জীবনে যা চেয়েছে তা পেয়েছে বলেই! ডেইজি এখন মানতে শিখেছে যে এই ঘটনায় কারোরই দোষ নেই। কারো না। আয়শান তাকে ভালোবাসেনি এটা নিশ্চয় আয়শানের দোষ নয়? তুলিকে আয়শান ভালোবেসেছে,বিয়ে করেছে এটা নিশ্চয় তুলির দোষ নয়। সে এখন সত্যটা মানে। তবুও কোথায় জানির তুলির প্রতি একটা জ্বেলাসন্যাস থাকেই। কেন থাকে জানে না। ডেইজি উত্তর করল,
“ কিছু বলবে তুলি? ”
তুলি মাথা নাড়ল। এসে হেসে বলল,
” আমায় কখনে ক্ষমা করতে পারবে না ডেইজি? ”
ডেইজি বিস্ময় নিয়ে চাইল। তুলি তার কাছে ক্ষমা চাচ্ছে? কেন? বলল,
“ কেন তুলি? তুমি তো কিছু করোনি। ”
তুলি শান্তস্বরে জানাল,
“ তোমার ভালোবাসার মানুষকে কেড়ে নিয়েছিলাম বলেছিলে ডেইজি। এখনও নিশ্চয় রাগ করে আছো?কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি কেড়ে নেইনি ডেইজি। ”
ডেইজি হাসে। সে বাচ্চা বাচ্চা অভিযোগ, রাগ, জেদ গুলো মনে করে সে হাসল। তুলির দিকে চেয়ে বলল,
“ লজ্জা দিচ্ছো তুলি? তুমি কেড়ে নাওনি সেটা আমি সময়ের সাথে সাথে বুঝতে পেরেছি। নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি ডিয়ার। ”
“ তবুও তোমার আজ এই খারাপ থাকার পেছনে কোথাও না কোথাও আমি দায়ী ডেইজি। আমায় ক্ষমা করে দিও। ক্ষমা করো… ”
ডেইজি নিজেই মৃদু হাসল। মৃদু হেসে বলল,
” উহ তুলি।তুমি দায়ী নও, দায়ী আমিই কারণ আমি মুভ অন করতে পারছি না এখনো। তোমায় ক্ষমা করার প্রশ্নই উঠে না, তুমি তো নির্দোষ। বরং ক্ষমা আমায় করে দিও ডিয়ার, তোমায় না জেনে শুনেই অনেক কথা শুনিয়েছি। অনেকভাবে হার্ট করেছিলাম। দোষী তো আমিই। ”
“না, তুমি দোষী নও ডেইজি। তুমি…”
” উহ তুলি, নিজেকে দোষারোপ করো না আর। আমার লজ্জা হচ্ছে।তবে সত্যি বলব? আমি তোমার প্রতি জ্বেলাস তুলি? তোমার ভাগ্যে নিয়ে জ্বেলাস! যদি তোমার ভাগ্যটা আমার হতো তবে আমি বিশ্বজয় করে ফেলতাম। ”
তুলি তাকায়। ডেইজি এখনও আয়শানকে ভালোবাসে। এখনো। তা স্পষ্ট! তুলি তার চোখে তাকাতে ডেইজি নিজে আবারও হেসে বলল,
“তোমার সংসারের জন্য শুভকামনা ডিয়ার। আমি তোমার প্রতি সব অভিযোগ মুঁছে নিয়েছি অনেক আগেই, সব দোষারোপ তুলে নিয়েছি বহুআগে। তোমার দোষ নেই। বুঝেছো? নিজেকে দোষারোপ করবে না। তোমার ক্ষমা চাওয়ারও কোন প্রয়োজন নেই বুঝলে? বরং জানবে, আমি চাই তোমরা সুখীই হও। ”
তুলি ক্লান্ত হাসে। বলে,
“ তুমি খুব ভালো ডেইজি। ”
“ তুমিও। ”
এইটুকু কথোপকোতন হতেই এল আয়জান। তুলির মাথায় হাত দিয়ে মেরে বলল,
“কি হলো যাবি না? নাকি থেকে যাবি? ”
তুলি হেসে মাথায় হাত ঠেকায়। বলে,
“এই তো আসছি আয়জান ভাই। ”
আয়জান ও হাসে। মাথা নাড়িয়ে তাকায় ডেইজির দিকে। কিয়ৎক্ষন তাকিয়ে পথ ঘুরিয়ে চলে যেতে যেতেই বিড়বিড় করে শুধাল,
“তুমি আমার না হওয়া প্রেম ডেইজি। তোমার প্রতি আমার প্রেমস্পৃহা কখনো না নিভুক, কখনো না কমুক। তুমি সারাজীবন থেকে যাও আমার বুকে, আমার হৃদয়ে। ”
.
বাইরে মুষল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে। শীতল আবহাওয়া। একটা ঠান্ডা ঠান্ডা সুন্দর পরিবেশ। আযরান বোধহয় নিজের বাসর রাতে এমন একটা পরিবেশে খুশিই হলো। খুশি খুশি মনেই নিজের রুমে প্রবেশ করল সে। ফুলের ঘ্রান নাকে ঠেকছে। আলো নিভানো। শুধু কয়েকটা মোম জ্বলছে। আযরান চোখ বুঝে একবার। পরমুহুর্তে ধীর পায়ে রোজের সামনে গিয়ে বসল। রোজকে বউ বউ লাগছে আজ খুব। একদম নতুন বউ এর মতো বসে আছে মেয়েটা। মুখ নত। আযরান ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে ঘোমটা তুলে। চেয়ে থেকে রোজের মুখটা দেখে বলল,
“তোর কি মনে হচ্ছে না তুই শুধু শুধু লজ্জা পাওয়ার ভান করছিস জান? অলরেডি তোর আমার বাসর ডান না? তাও তোর প্ররোচনায় হয়েছিল। ”
রোজ এবারে ভ্রু কুঁচকাল। এই লোকের কি কোনকিছুই সুষ্ঠুভাবে পছন্দ নয়? বলল,
“তাহলে কি করব? লজ্জা না পেয়ে ধেই ধেই করে নাচ করব আযরান? ”
আযরান হেসে বলল,
“মন্দ নয় । করতেই পারিস। আযরান খানকে পাওয়ার সুখে নাচ করাটা বেমানান লাগবে না। ”
“ওকে ফাইন।”
এইটুকু বলেই রোজ নেমে দাঁড়াল। উদ্দেশ্য এই আজব লোকের থেকে সরে গিয়ে বেলকনিতে বসা। আযরান ততক্ষনে বলল,
“সত্যিই নাচ করবি নাকি? ”
“নাহ, বেলকনিতে গিয়ে আকাশ দেখব। আপনার সাথে থাকার চেয়ে সারারাত আকাশ দেখা ভালো তাই না? ”
আযরান ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“সারারাত? ”
“হ্যাঁ সারারাত। ”
এটুকু বলেই সে বেলকনিতে গেল। আযরান ছোটশ্বাস ফেলে ফ্রেশ হতে গেল। অতঃপর ফ্রেশ হয়ে এসেই বেলকনিতে গেল প্রথমে। তার বউ হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখছে। আযরান গেল। বউকে পেছনে থেকে জড়িয়ে মুখ রাখল কাঁধে। বলল,
“আমি কতগুলো দিন পর আমার বউ পেয়েছি। তুই সারারাত আকাশ দেখার প্ল্যান করছিস?তাই আবার আমার বাসর রাতে? কি নিষ্ঠুর! পৃথিবী এই নিষ্ঠুরতা মানবে না। ”
রোজ হাসে।তবুও হাসি প্রকাশ না করে বলে,
”কেন? ফার্স্ট বাসর তো ডান আযরান। তাই না? ”
“খুব কথা শিখে গেছিস বেয়াদব! ”
রোজ হাসে। পরমুহুর্তেই কিছু মনে পড়াতে চুপ হয়ে গেল। ফিরে অনেকটা সময় চুপ থেকে সে বলল,
“ আযরান? আপনাকে আমার কিছু বলার ছিল। ক্ষমা চাওয়ার ছিল আপনার কাছে। ”
আযরান ভ্রু বাঁকিয়ে বলে,
“ ক্ষমা? তাও তুই? অসম্ভব ব্যাপার স্যাপার।”
রোজের গলা কাঁপল কেমন জানি। তবুও বলার চেষ্টা করল,
“ তুলির ক্ষতিটা আমার….”
আযরান মাঝপথেই বাঁধা দিল৷ সে জানে সত্যটা। জেনেও প্রকাশ করেনি। এতদিন নরমাল ভাবেই থেকেছে। আয়শানই না করেছে। বলেছে সব মিটিয়ে নিয়েছে।নিজেদের মাঝে ঝামেলা না করতে। আযরান অবশ্য ঝামেলা করত ও না রোজের সাথে এই নিয়ে। যদি রোজ দোষ করত তাহলে অন্য বিষয় ছিল। আযরান ঠোঁট এগোয় বউ এর ঠোঁটের দিকে। দৃষ্টি কেমন লোভাতুর ঠেকে। অতঃপর কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে এগোতে এগোতে সে বলল,
“ উহহ! এই বিষয়টা থাক জান। আমি জানি। তোকে এ নিয়ে ভাবতে হবে না হুহ?”
রোজ চমকায়। আযরানের ঘোরলাগা দৃষ্টি পরখ না করে দ্রুত বলে,
“ জানেন? কিভাবে? ”
আযরান প্রশ্নটার উত্তর করল ফিসফিস করা স্বরেই
“ জানতে সময় লাগে নাকি? যায় হোক, এসব বাদ দিই? দয়া করে আমার দ্বিতীয় বাসরটা নষ্ট করে দিস না রোজ। ”
অতঃপর সে রোজকে আর ছাড় দিল। আঁকড়ে ধরল। উষ্ণতা, উম্মাদনা সব ছাড়িয়ে বউ এর অধরে দখল নিল। বাইরের মুষলধারের বৃষ্টি আর রোজের এর গায়ের মিষ্টি সুভাস বোধহয় এবারে তার উম্মাদনা আরেকটু বাড়ায়। অতঃপর দুয়েকমিনিট পর নিজের অধর ছোঁয়াল মেয়েটার গাল,নাক, কপাল, ঠোঁট, গলায়। ফিসফিসি স্বরে বলে,
“ সম্ভবত বৃষ্টিও জানে আজ আমার বাসর রাত। তাই এই মুষলধারে বৃষ্টি। আমি ইম্প্রেসড প্রকৃতির উপর বুঝলি! ”
অতঃপর আর দেরি না করেই মেয়েটাকে কোলে তুলল। বিড়বিড় করে বলল,
“ তোকে দেখলেই আজকে কেমন প্রেম অনুভূতি জেগে উঠছে। বিষয়টা আমি বুঝতে পারছি না। কিছুমিছু করে ফেলিসনি তো আমায়? ”
“ হু? ”
“ তোর আকাশ দেখা নিষেধ করলাম জান।ক্ষমা করিস। আমি এতটাও ভালো নই। আর তুই তো জানিস, তুইও ভালো নোস। ”
রোজ হাসে এবারে। আযরানও বাঁকা হাসে। শুধায়,
” এক জনমের প্রেমস্পৃহা আমার তোর প্রতি। কখনো না কাঁটুক জান। কখনোই না।এই স্পৃহা মৃত্যুর পরও থাকুক। ”
.
তুলি অনেকটা সময় পর ঘরে এল। আলো নেভানো। অতঃপর এসেই ঘরে আলো জ্বালিয়ে সে চমকে উঠে। ঘরটা ফুলে ফুলে সজ্জিত।নাকে দারুণ ভাবে বাঁধছে ঘরভর্তি ফুলের সুভাস। তুলি এমন সুন্দর সাঁজ, সুভাস, পুরো ঘরটা দেখে থমকে যায়। বুকের ভেতর অজানা মোচড় উতলে উঠে। কোথাও আনন্দ, কোথাও বা ভয় হচ্ছে। মিশ্র অনুভূতি। অথচ তুলি পরিপক্ব মন মানসিকতার। বাচ্চা মেয়ে নয়। স্বামীর অধিকার সম্পর্কে তো সে জানে। তুলি ছোটশ্বাস ফেলে। স্বামীর অধিকার সম্পর্কে জানলেও এই অধিকার প্রাপ্তির বিষয়টা বুঝে সে শুকনো ঢোক গিলে। এসব কি আয়শান করেছে? আয়শান কি আজই চাইছে এসব? তুলি বুঝে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
অন্যদিকে আয়শান ভাই এর বিয়ের অনুষ্ঠান, বাবার সাথে কথোপকোতন সব নিয়ে আসতে আসতে অনেক লেইটই হলো। তারপর যখন রুমে এল তার একটু আগেই তার ফোনে ম্যাসেজ দিল আয়জান,
” ভাইয়া, তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে আযরান ভাই এর পক্ষ থেকে। অবশ্য আমিও আছি। এন্জয় করবে কেমন? কাল সকালে কিছু টাকা পকেটে গুঁজে দিও এই সুখে। ”
আয়শান তখন কিছু না বুঝলেও রুমে ডুকে ঠিকই বুঝল সে। এই বিচ্ছু গুলো সত্যিই অসাধারণ একটা কাজ করেছে বলে মনে হলো যেন। মুহুর্তেই ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসি এল। কেন এল সত্যিই জানে না। তবে সত্যি তার পছন্দ হয়েছে ঘরটা, ফুলের সুভাস সবই! আয়শান তাকিয়ে দেখে নিজের হাতের ঘড়িটা খুলতে নিতেই তুলি বেলকনি থেকে এল। শুকনো স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“ এসব? আপনি করেছেন? ”
আয়শান ভ্রু বাঁকায়। তুলির মুখটা দেখে তার হাসি পাচ্ছে। কি ভয়, কি চিন্তা!অথচ তুলিকে সুন্দরও দেখাচ্ছে ভীষণ পরনের গোলাপি শাড়িটায়। বাড়িতে অতিথি বলেই হয়তো শাড়ি পড়েছে। তুলির মুখচোখে পানির ছিটেফোটেও বুঝা যাচ্ছে। বৃষ্টির পানি? নাকি মুখচোখে পানি দিয়েছে? আয়শান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে স্নিগ্ধময়ী তুলিকে পরখ করে। অতঃপর শুকনো ঢোক গিলে নিজের প্রেম প্রেম অনুভূতিকে ঢেকে রাখার চেষ্টা চালিয়ে বলে,
“বোধহয় আযরান আর আয়জান করেছে।চিন্তা নেই, আমি ওসব মাথায় আনব না।”
তুলির এবার আরো লজ্জা হলো। আযরান আয়জান? নিজের বড় ভাই এর বয়সী দুইজন যাদের কিনা সে বড়ভাই মানে তারা এই ঘর সাজানোর দায়িত্বে? ইশশ! কি লজ্জাজনক! মাথা নুইয়ে বলল,
“ কোনসব? ”
আয়শান ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল।পরনের পাঞ্জানি দুই হাতে খুলে নিয়েই বলল,
“এমন ফুলে সজ্জিত ঘরে থাকলে যা মাথায় আসে তুলি। তবে তুই যতদিন চাইবি না আমি তোকে জোর করব না। ”
তুলি হঠাৎ চমকাল আয়শানকে পাঞ্জাবি খুলতে দেখে। কিন্তু পরমুহুর্তেই দেখা গেল টিশার্ট নিয়ে পরেছে। তুলি অস্ফুট স্বরে বলে,
“ হু? ”
আয়শান ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“আই থিংক তুই এতোটা অবুঝ নোস। ”
তুলি শুকনো ঢোক গিলে। ফ্রেশ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা না থাকলেও বলল,
“ আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। ”
আয়শান দ্রুতই বলল,
“ দাঁড়া। ”
তুলি দাঁড়িয়ে গেল। আয়শান ছোটশ্বাস ফেলে বলল,
“ আমাদের বিবাহিত লাইফ এঞ্জয় করা উচিত বল? একসাথে থাকতে থাকতে কখনো নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে কিছু করে ফেললে? আমি চাই না তোর উপর জোর করে কখনো কিছু করতে তুলি। ’
তুলি ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। আয়শান আবারও বলল,
“ আমরা কি সবসময় এমন হাজব্যান্ড ওয়াইফ পর্যন্ত, আই মিন এই পর্যন্তই থাকব তুলি? আমি আর তুই একসাথে থাকা শুরু করলাম। একইসাথে, একে অপরের সংস্পর্শে। মন, শরীর উভয়কেই খুব শক্তপোক্তভাবে নিয়ন্ত্রনে রাখতে আমার ক্লান্তি আসে। মাঝেমাঝে অবাধ্য হতে ইচ্ছে হয়। তুই জানিস এই দুইবছর কেন বাড়ি তেমন ফিরতাম না তেমন? শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে তোর সাথে কখনো কিছু করে ফেলার ভয়ে।কারণ তোকে ভালোবাসি, ছোটবেলা থেকেই ভেবে এসেছি তোর উপর কেবল আমার অধিকার।”
তুলি এবারেও উত্তর করে না।আয়শান হতাশ হয়ে বলল,
“আমি ভুল না হলে তোর সাথে ডেইজির আজ কথা হয়েছে তুলি। ”
উত্তর এল,
“ হয়েছে। ”
আয়শান শান্ত স্বরে বলল,
“তুই বলেছিলি আমরা সম্পূর্ণ স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে এগোনোর আগে ডেইজির সাথে তোর কিছু কথা বলা বাকি। ”
“ বলেছিলাম। ”
“কথা বলা কি ফলপ্রূস হয়নি তুলি? ”
“ হয়েছে। ”
তুলি যত পারে কম শব্দেই উত্তর করছে। আয়শান ভেবে নিল তুলি এই বিষয়ে এখনো প্রস্তুত নয়। রাজি নয়। সে হিসেবেই আর কথা এগোল না। মৃদু হেসে বলল,
“ওকে এই টপিক বাদ। ফ্রেশ হয়ে আয়, আমি ততক্ষনে এসব পরিষ্কার করছি। ”
তুলি ফিরে চাইল। দ্রুতই বলল,
“ কেন? ”
আয়শান হেসে ফেলল যেন। বলল,
“ তোর কি ঘরটা পছন্দ হয়েছে? তাহলে থাকুক বরং। ”
তুলি উত্তর করল,
“ পছন্দ হয়েছে বলে নয়। ”
“ তাহলে?”
“ আপনি একটা সুন্দর সংসার চেয়েছিলেন না? ”
আয়শান মাথা নাড়াল। হেসে বলল,
“ হ্যাঁ, এখনকার সংসারটাও আমার ব্যাপক সুন্দর লাগছে। মন্দ নয়। আম্মুর নম্র সভ্য মেয়ের লজ্জামাখা মুখ, মাঝেমাঝে মায়ামায়া দৃষ্টিতে ভালোবাসা নিয়ে তাকাচ্ছে, ঘুমানোর সময় আম্মুর নম্র সভ্য মেয়েকে জড়িয়ে ঘুমালে শান্তি লাগছে। সুন্দর না? ”
“ মজা করছেন? ”
আয়শান এগিয়ে তুলির কপালে চুমু খেল। বলল,
“না, সত্যিই সুন্দর তুলি। আগের থেকে বহুগুণ সুন্দর। আমার নিষ্প্রাণ তুলিকে আজকাল আমার সজীব লাগে। অনুভূতিহীন তুলিকে অনুভূতিময় লাগে। আমি এটুকুই চেয়েছিলাম। ”
তুলি নম্র দৃষ্টিতে তাকায়। এবারে বহু কষ্টে গলা থেকে বের করল,
” কিন্তু আমার মনে হয় এই সংসারটা পরিপূর্ণ হওয়া উচিত। আপনাকে এভাবে অপেক্ষায় রাখাটা অনুচিত হচ্ছে আমার। আমাদের সত্যিই বিবাহিত লাইফ নিয়ে ভাবা উচিত। ”
আয়শান ঠোঁট কাঁমড়ে হাসে। তুলি বলছে এসব? বাহ! খুব উন্নতি। বলে,
” তাই নাকি?”
তুলি তাকাল। বলল,
“ আজকাল মানুষ কমসময় বাঁচে। সে হিসেবে আমরা এসব নিয়ে অনেকটা সময় নিলে বাচ্চাকাচ্চা বড় হতে হতে বুড়োবুড়ি হয়ে যাব বলুন? ”
আয়শান লজিক শুনে হেসে উঠল হুট করেই। বলল,
“ তুই ডিরেক্ট বাচ্চাকাচ্চা বড় করাতে চলে গেলি তুলি? তবে এটা ঠিক,বয়স হচ্ছে! বাবা হতে হবে তো বল। বাচ্চার আম্মুর এই সিদ্ধান্ত সুন্দরই বলা চলে। ”
তুলির লজ্জা হলো যেন। লজ্জায় লাল হয়ে এল নাকমুখ।কান উষ্ণ ঠেকছে। আয়শান তা দেখে হেসেই বলল,
“ ফ্রেশ হতে যাবি না? ”
তুলি গেল না। আয়শান তা দেখে আবারও হাসল। নিজেই ফ্রেশ হয়ে এল। তারপর তুলিকে দেখে বলল,
“ আরেকটু ভাব তুলি।”
তুলি এবারে নিরব চাহনিতে তাকিয়েই আচমকায় ফুলে সজ্জিক খাটটায় ওভাবেই ফুলের উপর শুুয়ে চোখ বুঝে নিল।আয়শান ভ্রু কুঁচকায়। বুঝে না উঠে বলল,
” কি হলো? চোখ বুঝে নিলি কেন? ”
তুলি এবারে তাকাল। বলল,
” আরেকটু ভেবে বলার মতো ক্ষমতা আমার নেই। আশা করি বুঝবেন। যেটুকু বলার বলে ফেলেছি। ”
আয়শান হাসে। আলো নিভাল হুট করেই। অতঃপর ঐ মায়ামায়া মুখের মেয়েটির দিকে এগিয়ে ফিসফিস করে বলে,
“ তুই সত্যিই রাজি? ”
তুলি চোখ খিচে ন্যায়। বলল,
” রাজি। ”
আয়শান ঠোঁট কাঁমড়ে হাসে। গাঢ় চুম্বন আঁকল মেয়েটার নরম গালে। বিড়বিড় করে বলল,
” আমার মনে হচ্ছে তুই নার্ভাস।হয়তো আমিও নার্ভাস ফিল করছি তুলি। বিবাহিত জীবনের বৈবাহিক সম্পর্কে আমাদের দুইজনকেই স্বাগতম জানানো উচিত? ”
তুলি হাসল নিশ্চুপে। অতঃপর নিজের একান্তা পুরুষটির সান্নিধ্যে চোখ বুঝে এল লজ্জায়, আবেশে। স্পর্শ, উষ্ণ শ্বাস প্রশ্বাস এবং প্রথমবারের মতো এতোটা পুরুষ সান্নিধ্য সবেই তুলির অস্থিরতা বাড়ে যেন। নিজেকে মনে হয় পাগলপ্রায়। তুলি চোখ বুঝে, চোখ তুলে চাইবার শক্তি বোধহয় তার নেই। সত্যিই নেই।
.
সকালে তুলির দেখাই মিলল না। আয়শানের সামনেই পড়েনি আর মেয়েটা। অন্য আয়শান তাকে সকাল হওয়ার পরই খুঁজেছে। তুলিকে একবার কিচেনে দেখেছে ঠিক তবে তুলি চোখ তুলে তাকায়নি। তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে স্পষ্টভাবে। আয়শান বোধহয় ঠোঁট কামড়ে হাসে মেয়েটার অবস্থা দেখে। কৌশলে কিছু পাচ্ছে না বলে ডেকে নিয়ে গিয়েই রুমের দরজা লাগাল সে। অতঃপর খুবই সুন্দরভাবে নিজের ঘাড়ের দিকটায় কলার নামিয়ে তুলিকে দেখিয়ে শুধাল,
” কি করেছিস বিড়ালের মতো? এই গলা নিয়ে আমি হসপিটাল যাব? পিঠের অবস্থা তো আরো ভয়াবহ! তোর নখ তো বড় না তাই না? ”
তুলি অসহায়ের মতো তাকাল। লজ্জায় শরমে সে মাথা তুলতে পারে না যেন। যতোই এই ঘটনার সম্মুখীন হতে চায়নি এই লোক তো ততই এই ঘটনা মনে করিয়ে দিতে প্রস্তুত। তুলি মিনমিন করে বলল,
” কাল নখ কেঁটেছিলাম।নখ কাঁটার পর একটু ধারালই ঠেকে, বোধহয় তাইই। ”
আয়শান চোখ ছোট ছোট করে বলল,
” আমি কিন্তু তোর কোথাও এভাবে দাগ ফেলিনি তুলি যাতে তোকে লজ্জায় পড়তে হয়, আর তুই! আয়জান অলরেডি দেখে ফেলেছে।”
তুলি লজ্জায় চোখ খিচল। ছিঃ! আয়জান ভাইও দেখে ফেলেছে।নরম গলায় দ্রুত বলল,
“ আপনার জন্যই তো। কেন যে কাল… ”
এটুকু বলতে নিয়ে ফের বলল,
“ স্যরি, এমনটা এরপর মাথায় রাখব। ”
আয়শান হাসল যেন। এটাতে স্যরি? অন্য মেয়ে হলে নিশ্চয় গলা চেপে ধরত তার। হেসে ফেলে তুলির মুখ আগলে ধরে সে। মুখ নামিয়ে তুলির কপালে চুমু দিয়ে বলল,
“ আমার আম্মু নম্রসভ্য মেয়েটা সবসময় এমনই থাকুক। এমনই! ভালোবাসি মেয়ে। ”
#সমাপ্তি…