#নিকুঞ্জ_কানন
#নুজহাত_আদিবা
[পর্ব ২]
একে তো নতুন পরিবেশ এরমধ্যে আবার খাট ভাঙ্গার মতো কুৎসিত কাহিনী! ভয়ে, অস্বস্তিতে তরী জমে গেল। এই অপ্রীতিকর অবস্থা থেকে তরীকে রক্ষা করলেন শোভা। খবর পেয়েই শোভা দ্রুত এসে তরীকে রুমির সঙ্গে অন্য ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। সকলকে বেশ বকা-ঝকাও করলেন। পরিস্থিতি শান্ত করে শোভা তরীর কাছে গেলেন। অতি নরমসূরে বললেন,
” তুমি কী ভয় পেয়েছো মা? ওই ঘরটা সুন্দর আর বড় বলে সবাই ওখানেই বাসরঘর সাজিয়ে ছিল। ওটা তোমার দাদা শশুরের ঘর ছিল। আত্নীয় স্বজন সকাল থেকেই ওই ঘরে বসে হেসেছে খেলেছে। পুরনো আমলের খাট তো এত ভার সহ্য করতে পারেনি। তুমি এরজন্য নিজেকে দোষ দিও না;তোমার দোষ নেই। যা ভেঙ্গে যাওয়ার তা ভাঙ্গবেই। তুমি কিংবা আমি কেউ চাইলেও সেটা ধরে রাখতে পারবো না। আহসানের বাবাকে অনেকদিন বলেছি ওই ঘরের খাটটা তুলে দিতে; বেশ নড়বড়ে হয়ে গেছে। নতুন খাট কিনে বসাতে। উনি বাবার স্মৃতি বলে এড়িয়ে গেছেন। আজ ভাঙ্গলো তো ভাঙ্গলো নতুন বউয়ের সামনেই ভাঙ্গলো! তুমি আমাকে ক্ষমা করো মা।”
তরী আড়ষ্টতা কাটিয়ে কথা বলতে পারলো না। শোভা আবারও বললেন,
” এটা তোমার আর তোমার বরের ঘর। আমি কত বলেছিলাম এই ঘরে বাসর সাজাতে। নচ্ছার ছেলে মেয়েগুলো আমার কথাই শুনলো না। আচ্ছা করে বকে দিয়েছি সবগুলোকে। ওই ঘুরে ফিরে আহসানের ঘরেই আসতে হলো তোমায়। খামোখা তোমায় এত লজ্জায় ফেললাম।”
শোভা তরীর শাড়িটা ঠিকঠাক করে দিয়ে রুমিকে নিয়ে বের হয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় আলতো করে ঘরের দোর দিয়ে গেলেন। তরী জড়তা-সংকোচে আবারও কেঁদে ফেললো। এত কান্না পাচ্ছে কেন তাঁর? ভয়ে নাকি লজ্জায়?
তরীর তুলতুলে কপোল ছুঁয়ে নোনা পানির স্রোত গেল। মিনিটখানেক পর দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে তরী নড়েচড়ে বসলো। বড় একটা ঘোমটা তুলে সটান হয়ে বসে রইলো। ঘোমটার আড়ালে টলটলে অশ্রু মুছতে ব্যস্ত হয়ে গেল সে। অকস্মাৎ এক বলিষ্ঠ হাত তরীর মুখের ঘোমটাটা তুলে দিলো। তরী চোখ মেলে তাকালো। চোখে বারিধারা চিকচিক করছে। আহসান ক্ষীন স্বরে বললো,
” এখনও কাঁদছো? আর কেঁদো না।”
তরী প্রতিত্তরে বললো,
” আমি কিন্তু মোটেও আপনাদের বাড়ির খাট ভাঙ্গিনি। ওটা একা-ই ভেঙ্গে গেছে।”
আহসান শান্ত গলায় বললো,
”আচ্ছা মানলাম। কিন্তু, এখন আর কেঁদো না। এত কাঁদলে শরীরের লোনা পানি সব শেষ হয়ে যাবে। পরে সারাদিন স্যালাইন খেয়ে কাটাতে হবে? তোমার বুঝি স্যালাইন খুব পছন্দ?”
তরী ভেজা গলায় বললো,
” মোটেও না। ওটা কোনো খাবার জিনিসই নয়।”
আহসান ঠোঁট টিপে হাসলো। হাসোজ্জল স্বরে বললো,
” তাহলে কেঁদো না। ”
তরী কান্না থামিয়ে প্রতিবাদী কন্ঠে বললো,
” সবকিছু নিজে ঘটিয়ে আমাকে কাঁদতে নিষেধ করছেন? সবকিছু আপনার জন্যই হয়েছে আমি জানি।”
আহসান বিষ্মিত হয়ে বললো,
” ওমা! এই মেয়ে বলে কী? আমি আবার কী করলাম?”
তরীর মুখে যেন খই ফুটে উঠলো। রূঢ় কন্ঠে সে বললো,
” আপনিই তো আমাকে আমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে এলেন। আপনি যদি আমাকে না নিয়ে আসতেন তবে কী আমি এত কাঁদতাম? সব দোষ আপনার! ”
আহসান ঠোঁট এলিয়ে হেসে ফেললো। তরী টলমল চোখে আহসানের হাসিমাখা মুখ অবলোকন করলো। আহসান মিষ্টি করে হেসে বললো,
” মানলাম সব দোষ আমার। ঘাট হয়েছে আমার; তবুও তুমি আর কেঁদো না। ”
তরী আহসানের কথায় বিশেষ কান দিলো না। উল্টো তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললো,
” কাঁদবো। আরো বেশি করে কাঁদবো। তাতে আপনার কী?”
আহসান তরীর দিকে এক পলক তাকিয়ে রইলো। জবাবে বললো,
” সবটাই তো আমার। এরপরেও এই প্রশ্ন?”
আহসানের এরূপ ঘোর মিশ্রিত কন্ঠ শুনে তরীর মনে কেমন যেন ঢেউ বয়ে গেল। অস্বস্তিতে চোখ ফিরিয়ে নিতে চাইলেও আহসানের দৃষ্টিতে বাঁধা পড়ে গেল সে। অদ্ভুত বিষয় তো! লোকটা তাঁর দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেন?
তরী আড়চোখে আহসানের দিকে তাকিয়ে রুষ্ট গলায় বললো,
” আপনি এভাবে তাকাবেন না।”
তরীর এরূপ উক্তি শুনে আহসান প্রথমে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। ফের বললো,
” কেন? তাকালে ক্ষতি কী? আমার বউ আমি তাকাতেই পারি।”
তরী পিলে চমকে উঠলো! গায়ের লোমগুলো যেন দাঁড়িয়ে গেল তাঁর। ড্যাবড্যাব করে মিনিট খানেক আহসানের মুখপানে চেয়ে রইলো। লোকটা কী তাঁকে বউ বললো? তবে, পরমুহূর্তেই তরী লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। আহসান তরীর কার্যকলাপ সূক্ষ ভাবে লক্ষ্য করতেই মনে মনে এক দফা হেসে নিলো। তরীর দিকে নিজের হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
” আমাকে কী বিশ্বাস করা যায় তরী? তুমি কী বিশ্বাস করতে পারছো আমায়?”
তরী নির্বিগ্নে কঠোর স্বরে বললো,
” না যায় না।”
না-বোধক উত্তর শুনে আহসান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অনেকটা সময় নিশ্চুপ রইলো। অতঃপর বিছানা থেকে নেমে আলমারি খুলে পরনের উপযোগী জামা কাপড় বের করলো। তরীকে উদ্দেশ্য করে বললো,
” তুমি বসো। আমি জামাকাপড় ছেড়ে আসছি।”
তরী কোনো সংগতিপূর্ণ উত্তর দিলো না। আহসান আর অপেক্ষাও করলো না। জামাকাপড় হাতে যখনই দরজা খুলে বের হতে;যাবে সেই মুহূর্তে তরী বললো,
” একটু শুনুন।”
আহসান পেছন ফিরে তাকালো। তরী মিহিস্বরে বললো,
” আপনাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না। তবে, একটু একটু করা যায়। ”
আহসান পাশ ফিরে নিজের বদনখানি ঢেকে ফেললো। মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে সে বললো,
” আমি একটু’তেই সন্তুষ্ট। ”
আহসান আর দাঁড়ালো না। দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। আহসান যাওয়ার পরপরই তরী নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানার মাঝে শপে দিলো। সারাদিনের ক্লান্তি, ধকলের চাপে নিমেষেই সে নিদ্রাদেশে তলিয়ে গেল। আহসান দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করতেই থমকে গেল। বিছানায় জুবুথুবু তরীকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে সে নমনীয় হয়ে পরলো। বালিশটা নিয়ে তরীর সন্নিকটে গিয়ে বসলো। তরীর মুখোমুখি বালিশটা রেখে সে নিজেও শুয়ে পরলো। আহসান এক দৃষ্টিতে তরীর দিকে তাকিয়ে রইলো। পলক যেন পরছেই না! এই ভারী জামাকাপড় নিয়ে মেয়েটা পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে কী করে? সে চলে যাওয়ার পর ভারী শাড়িটা বদলে নিলেও তো পারতো? এত খামখেয়ালী হলে কী চলে? আহসান তরীর শাড়ির আঁচলটা হাত দিয়ে স্পর্শ করলো। নাকের সামনে নিয়ে ঘ্রানও নিলো। কেমন একটা নারীসূলভ ঘ্রান। এই লাল টুকটুকে গম্ভীর মেয়েটা কী আসলেই তাঁর বউ? মুহূর্তটাকে স্বপ্ন ভেবে আহসান নিজের হাতে চিমটি কাটলো। বেশ ব্যাথা লাগলো!
★
মুখায়বের ওপরে রোদ্দুরের তীব্র ঝলকানির অস্তিত্ব টের পেতেই ঘুম ভেঙে গেল তরীর। চোখ মেলতেই দেখলো আহসান ঠিক তাঁর বরাবর মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে আছে। শিথিল দেহে তীব্র যৌবনের ছাপ। তরী কেমন নড়েচড়ে উঠলো। একমনে তাকিয়ে রইলো স্বামীর পানে। মানুষটাকে দেখে কালকে যতটা ভয় লেগেছিল। আজ মোটেও সেরকম লাগছে না। আচ্ছা, লোকটা কী আদতে আসলেই এরূপ শান্ত? তরী তর্জনীটা স্বামীর ঠিক গাল বরাবর রাখলো। চাপ দাঁড়িগুলো আলতো হাতে ছুঁয়ে দেখলো। এরপর থুতনিটা ছুঁয়ে দেখার জন্য যখন হাত বাড়াতেই যাবে ;অকস্মাৎ আহসান ঘুম থেকে উঠে গেল। ফোলা ফোলা চোখে তরীকে দেখলো। তরী অস্বস্তিতে চোখ নামিয়ে নিলো। আমতাআমতা করে বললো,
” মশা বসেছিল।”
আহসান পাশ ফিরে শুয়ে পরলো। তরীর সংগোপনে মুচকি হাসতে হাসতে বললো,
” আচ্ছা। ”
আহসানের উত্তর শুনে তরী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। ভাগ্যিস লোকটা টের পায়নি!
তরী বিছানা থেকে উঠে বসলো। তাঁর আর ঘুম আসছে না। আলমারির ওপাশ থেকে লাগেজটা নিয়ে সেটা খুললো; পরনের জন্য একটা শাড়ি বের করলো। মনোয়ারা তরীকে বারবার বলে দিয়েছেন বিয়ের পরদিন নতুন বউরা শাড়ি পড়ে। মনোয়ারা নিজেই তরীকে গাঢ় নীল রঙের শাড়িটা কিনে দিয়েছেন। সঙ্গে মানানসই ব্লাউজ বানিয়ে রেখেছেন দর্জিকে বলে। তরী শাড়ি হাতে পা টিপে টিপে গোসলখানায় গেল। গোসল শেষ করে গাঢ় নীল রঙের শাড়িটা পড়ে তোয়ালে মাথায় ঘরে ঢুকলো। আহসান তখন সবেমাত্র বিছানা থেকে উঠে বসেছে।
তরীকে নীল রঙে দেখে বড়সড় চমক খেলো। তরীর চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পরে কোমর পিঠ ভিজে যাচ্ছে। তরী অন্যমনস্ক হয়ে বারবার তোয়ালে দিয়ে চুল মোছার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। আহসান চোখ ফেরালো না। উজ্জ্বল দৃষ্টিতে সে তরীকে বারংবার ঘুরেফিরে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষনে ব্যস্ত। পর্যবেক্ষনের মাত্রা এতটাই গভীর যে, একপর্যায়ে আহসানের মনে হলো সে চাইলেই; তরীর চুল বেয়ে পড়া পানির ফোঁটাগুলোকে নিমেষেই গুনে শেষ করতে পারবে।
আনমনে তাঁর চোখ পরলো তরীর পিঠের ব্লাউজের ফিতার দিকে; অবহেলিত ফিতাদুটো খোলা। এত নিখুঁত বিষয়বস্তুর মাঝে এইটুকু ভুল ঠিক মানাচ্ছে না।এই অবাধ্য জিনিসগুলোকে একটা বাঁধনে বাঁধা দরকার। আহসান ত্বরিত তরীর ঠিক পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।পিঠে টান অনুভব করতেই তরী একবার পেছন ফিরে তাকাতে চাইলো। তবে, আয়নায় আহসানের প্রতিচ্ছবি দেখে আর পিছু ফিরলো না। আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ফিতাদুটোকে বেঁধে দিতে গিয়ে আহসান তরীর মসৃণ পিঠের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষন। কোমল হৃদয়ে উত্তাপ বয়ে গেল যেন। প্রথমে দ্বিধাবোধ করলেও মনের নিকট দ্বিধা যেন বাঁধা পরলো। আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো তরীর পিঠদেশে। আকস্মিক বৈধ ছোঁয়ায় তরী যেন কেমন মিইয়ে গেল। এরূপ স্পর্শ সে আগে কখনো পায়নি। পেছন ফিরে লাজে সে আহসানের বুকে মুখ লুকালো। সম্বিত ফিরতেই চমকে উঠলো! দ্রুত সরেও গেল। মানুষটাকে কাল রাতেও তাঁর বড্ড মন্দ বলে মনে হয়েছিল। আজ তাঁর স্পর্শে বিন্দুমাত্র খারাপ লাগছে না কেন?
★
শোভা তখন নাস্তার টেবিল সাজাতে ব্যস্ত। তরী তাঁর সামনে এসে দাঁড়াতেই ঠোঁটে ঝলমলে হাসির ঝলক দেখা গেল। মাজদাক টেবিলের ঠিক সাইডের সারির চেয়ারে বসে একমনে পেপার পড়ছিলেন। তরীকে দেখে পেপার ভাঁজ করে ফেললেন। তরী জড়তা-সংকোচে মাজদাককে সালাম দিলো। মাজদাক তরীর সালামের জবাব নিলেন। ফের তরীকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
” তোমাকে দেখলেই আমার বুকের ভেতরটা ফেটে যায় মা। তোমার বাবা কতটা অমায়িক ব্যাক্তিত্বের মানুষ ছিলেন সেটা শুধু আমিই জানি। ভাবতে পারিনি হায়দার এভাবে চলে যাবে! চায়ের আড্ডায় তোমার বাবার স্থানটা যখন ফাঁকা দেখি না? কতটা শুন্য মনে হয় তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। সেই ছোট্ট বেলা থেকে হাসি খেল, দুষ্টমি করে একসঙ্গে বড় হয়েছি। আহারে বন্ধু আমার!”
স্বভাবত তরী খুবই আবেগপ্রবণ একটি মেয়ে। বাবার প্রসঙ্গ উঠতেই চোখ ঝাপসা হয়ে গেল তাঁর। বিষয়টা লক্ষ্য করতেই শোভা নিজ স্বামীকে বললেন,
” দিলে তো এই সকাল সকাল মেয়েটাকে কাঁদিয়ে? সকালবেলা এসব না বললে কী হতো না তোমার? ”
মাজদাক অতি নরম সূরে তরীকে বললেন,
” কেঁদো না মা। তোমার বাবাকে আমি কথা দিয়েছি আমি কখনোই তোমার চোখে জল আসছে দেবো না। তোমাকে কাঁদতে দেখলে হায়দার কিন্তু আমার সঙ্গে অভিমান করবে।”
তরী শাড়ীর আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে ফেললো। বাবার কথা মনে পরলেই তাঁর খুব কষ্ট হয়। খুব!
সকলে নাস্তা খেয়ে ওঠবার সময় মধুবিবি বেশ কিছুক্ষন তরীর গতিবিধির দিকে লক্ষ্য রাখলেন। তরীকে ডাক দিয়ে কিছু বলতেও চাইলেন। তবে, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সামনে এত খোলামেলা বিষয় আলোচনা বাঞ্চনীয় না;ভেবে আর বললেন না। কিন্তু, তরীর ভেজা চুল দেখে আত্নতৃপ্তি পেলেন। তখনই শোভা তরীর হাতে এক কাপ চা দিয়ে বললেন,
” আহসানকে দিয়ে এসো। নাস্তা শেষে চা না পেলে তাঁর আবার মাথা ব্যাথা হয়।”
তরী চায়ের কাপ নিয়ে সোজা ঘরের দিকে গেল। আহসানের দিকে চায়ের কাপটা এগিয়ে দেওয়ার সময় তরীর হাতটা ঠকঠক করে কাঁপছিল। চায়ের পিরিচে ফোঁটা কয়েক চা পড়েও গেল। আহসান কাপটা তুলে নিয়ে টেবিলে রাখলো। নরম সূরে বললো,
” এত কাঁপা-কাঁপি কেন? গরম জিনিসে ভয় বুঝি?”
তরী ঠোঁট কামড়ে উত্তর দিলো,
” গরম চা ভয় লাগে না। কিন্তু…”
আহসান চায়ের কাপটা হাতে তুলে তাতে একটা চুমুক দিলো। অতঃপর বললো,
” কিন্তু কী?”
তরী বড়সড় ঢোক গিলে বললো,
” আপনি আমার সামনে এলেই আমার বুক কাঁপে। হাত কাঁপে আবার পা কাঁপে। সত্যি বলছি আমার আগে এরকম কিছু ছিল না। এখন কেন এসব হচ্ছে জানি না। আচ্ছা, আপনারও কী এমন হয়?”
আহসান মনে মনে এক ধাপ হাসলো। চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে তরীর সামনে এসে দাঁড়ালো। অত্যন্ত গভীর গলায় বললো,
” হ্যাঁ। হয় তো! কিন্তু হাত কাঁপে না। পা-ও কাঁপে না; বুক কাঁপে। আবার মনে হয় বুকে যেন কেউ ড্রাম পেটাচ্ছে। কেমন ধুকপুকানির আওয়াজ ও হয়।”
তরী মিনিট দেড়েকের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। নিচু স্বরে বললো,
” সত্যি? ”
আহসান তরীর ডান হাতটা নিজের হাতের সঙ্গে মিশিয়ে ফেললো। তরীর অত্যন্ত সন্নিকটে গিয়ে বললো,
” হ্যাঁ। এই যে আমার বুক;মাথা রেখে কান পেতে শুনে দেখো।”
তরী এবার সত্যি সত্যি স্বামীর বুকে মাথা রাখলো। নাহ! মানুষটা মিথ্যে বলেনি। আসলেই কেমন ধুকপুক আওয়াজ হচ্ছে।
মাজদাক সরোয়ারের ডাকে দুই যুগলের ঘোর কাটলো। তরী স্বামীর বুক ছেড়ে সরে দাঁড়ালো। বাবার ডাক শুনতে পেয়ে আহসান দ্রুত পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল। তরী দরজার সামনে এগিয়ে গিয়ে আহসানের নীরব প্রস্থান দেখলো। দরজার সামনে থেকে সরে আসার সময়; একটা নারী কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে তরী কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালো। হাসোজ্জল একটা নারী অবয়ব তাঁর দিকে হেঁটে আসছে। মেয়েটাকে তরী চেনে। মেয়েটার নাম রুমি; সম্পর্কে আহসানের ছোট বোন। বিয়ের দিন রুমিকে দেখেছিল তরী। রুমি এসে তরীর হাত দুটো ধরে বললো,
” কেমন আছো ভাবী?”
তরী ইতস্ততভাবে উত্তর দিলো,
” ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? ”
রুমি ঠোঁট এলিয়ে হেসে বললো,
” তুমি চাইলে আমাকে তুই করে বলতে পারো। আমি কিছু মনে করবো না। তোমার আর আমার বয়সের পার্থক্য মাত্র দুই বছর। তোমার আঠারো আর আমার ষোলো। ভেবো না ভাবী বলে তোমার সঙ্গে বাঙালী ননদীদের মতো ঝগড়া করবো। আমি এত হিংসুটে, ঝগড়াটে কুটকুটে নই। তুমি কিন্তু আমার সই!”
তরী যেন বুকে প্রান ফিরে পেল। নরমস্বরে বললো,
” ইস! আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে সিরিয়ালের মতো গয়না চুরির দায়ে ফাঁসাবে। ”
রুমি পেট চেপে ধরে হাসতে হাসতে বললো,
” হ্যাঁ তা তো ফাঁসাবোই। পারলে গয়নাগুলো সামলে রেখো। নাহলে গয়না না পেলে মা আর বুবু গোপী বাহু সরি তরী বাহু, তরী বাহু বলে চিৎকার করে উঠবে। আর আমি তখন ধুমতা-না- না ধুম-তা-না আর বর্জ্রপাতের সাউন্ড বাজাবো।”
না চাইতেও তরী হেসে ফেললো। এই বাড়ির সবাই খুব ভালো। কাউকে তরীর এখন আর মন্দ লাগছে না।
★
দুপুরে প্রতিবেশীগন সরোয়ার বাড়িতে হানা দিলো। নতুন বউয়ের চাঁদমুখ খানি দেখাই তাঁদের মূখ্য উদ্দেশ্য। তরীর চকচকে উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রং। কোমর অবধি চুল, নব যৌবনে বিগলিত রূপ দেখে কারো মুখে কোনো ‘রা’ নেই। প্রতিবেশীরা তরীকে নিয়ে তেমন বিশ্লেষণে মত্ত্ব হতে পারলো না। শোভা তাঁদের সেই সুযোগ দিলেন না। খাইয়ে দাইয়ে সকলকে বিদায় করে দিলেন। মধ্যাহ্ন ভোজের আশায় সেই সময় মাজদাক আর আহসানও হাজির হলো। ব্যবসার কাজ সামলাতে গিয়ে প্রায়ই এই পিতা পুত্রের দুপুরের খাবার খেতে দেরি হয়ে যায়। শোভা দ্রুত হাতে স্বামী আর সন্তানকে খাবার বেড়ে দিলেন।
” কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?”
দুপুরের খাবার শেষ করে কাজের ছুতোয় সবে ঘরে ঢুকেছিল আহসান। নিজ স্ত্রীর প্রশ্নে বাঁধা পরলো সে। হাতের কাজ ছেড়ে তরী প্রশ্নের উত্তরে বললো,
” কাজে। কাজ যদি না করি তবে তুমিই বেকারত্বের অজুহাত দেখিয়ে ছেড়ে চলে যাবে।”
তরী নির্দ্বিধায় বিজ্ঞের ন্যায় বললো,
” মোটেও না। মা আমাকে বলেছেন সবসময় সুখে দুঃখে স্বামীর পাশে থাকতে।”
আহসান তরীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তরীর ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে; স্বামীর ঠোঁটের হাসিকে অবলোকন করলো। ঠোঁটগুলো তাঁর গোলাপি রঙের; আজকালকার উশৃংখল ছেলেপেলেদের মতো সিগারেট খেয়ে ঠোঁট কালো করে ফেলা ছেলেদের মতো নয়। তরীর ভাবুকতা দেখে আহসান তাঁর দিকে কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল। পকেট থেকে মুঠো ভর্তি কাঁচের চুড়ি বের করলো। নীল রঙের জ্বলজ্বলে তকতকে চুড়িগুলোকে তরীর হাতে পরিয়ে দেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। তরী সেই হাত সাদরে গ্রহন করলো। উদীয়মান প্রতীকের ন্যায় নিজের হাতখানা মেলে ধরলো স্বামীর দিকে। গোল গোল চুড়িগুলোকে হাতে পরানোর সময় সুরসুরিতে তরী চোখ বুঁজে ফেললো। আহসান সে-সব অগ্রাহ্য করে নিজের কাজে ব্যাতিব্যস্ত রইলো। চুড়িগুলো সে কিনেছে অতি গোপনে। সকলের অগোচরেই বলা যায়। পকেটে ঝনঝন আওয়াজের শব্দে মাজদাক কয়েকবার সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। আহসান সুকৌশলে পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে। নীল রঙের শাড়িটার সঙ্গে চুড়িগুলো দারুন মানিয়েছে। তরী চুড়ি ভর্তি হাতদুটো ঝাঁকালো। আহসান নিঃশব্দে চুড়ির সেই ঝনঝন আওয়াজের শব্দ শুনতে লাগলো। চুড়িগুলো পরস্পরের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে যে-ই অদ্ভুত শব্দ সৃষ্টি করছে। তা আহসানের কাছে বড়ই মধুর বলে মনে হলো। আজ সকাল থেকে সবকিছু এত অপূর্ব লাগছে কেন তাঁর? কারণটা কী? তরী?
চলবে…